পাঁচই নভেম্বর, দুহাজার বারো, বেলা একটা সাত -
কলসির পেটে (কুম্ভ এক্সপ্রেস) বসে কাকা-ভাইপোয় চলেছি হরদোয়ার (এখন নাম অবশ্য হরিদ্বার। বেচারা শিবঠাকুর। হরিভক্তদের ল্যাং খেয়ে নিজভূমেই অনাবাসী হয়ে যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রীর উদ্দেশে।
রাত সাতটা সতেরো -
সাত সতেরো ভাবার দরকার নেই, বুঝতেই পারছি বিহারবাসী হয়েছি - এক একটা সিটে পাঁচজন।
ছয়ই নভেম্বর, ভোর পাঁচটা -
ভিড় এখন সহনীয়। ভোর চারটে থেকে লক্ষ মহিলার (পরে জেনেছিলাম তেতাল্লিশ জন) কলকলানি। তারা নামল সুলতানপুরে - কোনো এক বাবার মাজার দর্শনে।
বেলা সাড়ে চারটে-
অবশেষে শিবভূমির প্রবেশদ্বারে পদার্পণ।
সন্ধে ছ-টা -
সেই গলি, রিকশা, ধর্মমাখা গন্ধ, সেই দোকান ঘিরে গলি জুড়ে বাঙালির হুজুগে কেনাকাটা, "দাদা বৌদির হোটেলে" খাবার লাইন, সেই সাধুদের হরেকরকমবা সেই হরদোয়ার।
সাতই নভেম্বর, ভোর ছ'টা -
আজ উত্তরণের পয়লা ধাপ - হরদোয়ার থেকে ধরাসু বেণ্ড। হোটেল ছেড়ে বেরোতেই শীতবাবাজী জাপটে ধরল। দু গ্লাস চায়ে তাকে খানিক তফাৎ করা গেল।
বেলা একটা কুড়ি -
সেই 'সাত' সকালে বাহন গড়াতে শুরু করেছিল। হৃষিকেশ ছাড়িয়ে ভদ্রকালীকে এক পলকের ভদ্রতা দেখিয়ে বামপন্থী হয়ে বাস ধরল পাহাড়ী পথ। এঁকেবেঁকে মসুরী (আমাদের মুসৌরি) রোড ধরে নরেন্দ্রনগর, আগরাখাল, ফকোট, বেমুণ্ডা (কন্ধকাটা?), জাজল পেরিয়ে খাড়ী পৌঁছে খাড়াপথ বেয়ে উঠতে শুরু করল। চাম্বায় চা খেয়ে ধারকোটের ধার ঘেঁষে কিরগনি, কাণ্ডীখাল, চিন্য়ালী গৌড়, বড়েঠি হয়ে ধরাসুকে পেরিয়ে ধরাসু বেণ্ড-য়ে এসে ধরাধামে অবতীর্ণ হলাম। এবার বড়কোট হয়ে যমুনোত্রী পর্ব।
বেলা পৌনে দু-টো -
যথাসম্ভব ঠেসে গাড়ি গড়ালো — গঙ্গোত্রীর পথ এড়িয়ে যমুনোত্রীর পথে। সুন্দর, মসৃণ পিচঢালা পথটা সবুজবন মেখে চলেছে। পনোথ, ব্রহ্মখাল (ব্রহ্মদর্শন মানে কি ভিড়দর্শনা বোঝায়? বাপ্স, কী ভিড়!) পেরিয়ে ঘনৌতির মোড়ের একমাত্র চায়ের দোকানে চা-খোর হওয়া গেল। গলা ভিজিয়ে আবার দৌড়।
বেলা চারটে -
দোবাট্টা (দুরাস্তার সংযোগস্থল) থেকে বামপন্থী হয়ে বড়কোটের অতিথি হওয়া গেল। বড়কোট দিব্যি বড় — প্রায় এক কিলোমিটার। আজ জানকীচটী পৌঁছবার কোনো উপায় নেই। অতএব অদ্য অত্র অবস্থান।
সন্ধ্যা ছ-টা -
বড়কোটকে বড়ই ভালো লেগে গেছে। ছোট ছোট দোকানপাট, আলোয় ঝলমল। আকাশে আঁধার ঘনাতেই ভিড় যেটুকু ছিল, ফাঁকা হয়ে গেল। দিব্যি ঠাণ্ডা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে তুষারমৌলি নজর রাখছেন। শান্ত, সরল বড়কোটকে ভালো না লাগাটাই মুশকিল।
আটই নভেম্বর, ভোর ছ-টা -
ঠাণ্ডা আর ভোরের আলোর যুগলবন্দী বেশ জমেছে। একটা গাড়িতে তেঁতুলপাতায় দিব্যি ন-জন, থুড়ি, আটজন হয়ে বসেছি — যাব যমুনোত্রী। সেখানে যমুনা খানিক উত্তরবাহিনী হয়েছেন, তাই যমুনোত্তরী। তার থেকে যমুনোত্রী। গঙ্গোত্রীর নামমাহাত্ম্যও একই কারণে।
সকাল সাড়ে সাতটা -
দোবাট্টা হয়ে গাড়ি গড়ালো বাঁদিকে, যমুনাকে সাক্ষী রেখে। ওপারের পাহাড়ে তপনকিরণের উষ্ণআশীর্বাদ।
সকাল সাতটা একান্ন -
গঙ্গানী। যদিও সঙ্গিনী গঙ্গা নয়, যমুনা। পূষণের আশিস এখন আমাদেরও ছুঁয়ে যাচ্ছে।
সকাল আটটা এগারো -
কুথনৌর। পথবাবাজী খুব একটা সহানুভূতিশীল নন।
সকাল আটটা ষোলো -
পালী গাডকে পেরোবার পালা।সকাল আটটা সাঁইত্রিশ -
স্যানা চটি। একসময় তীর্থযাত্রীরা এখানে পয়লা পড়াও রাখতেন। আজ এই গতির যুগে স্যানা চটীর সেয়ানাগিরি অনেকটাই স্তিমিত। শুধু তুষারকিরীটির পাহারা একই রকম।
সকাল আটটা সাতচল্লিশ -
রাণা চটী এখন বীরানা - জনশূন্য।
সকাল ন-টা সতেরো -
অস্নোল গাডকে টপকে ফুলচটী। ফুলটুল অবশ্য নজরে পড়ল না। এখানে সাধারণত দ্বিতীয় পড়াও হত।
সকাল ন-টা সাতাশ -
জানকী চটী। সীতার এখানে কী কাম? রাম জানে। গাড়ির দৌড় এখানেই শেষ। এবার শ্রীচরণ ভরসা।
সকাল দশটা দশ -
তুষারশৃঙ্গদের নজরদারিতে শুরু হল পথ চলা, মানে চড়া।
সকাল দশটা পঞ্চাশ -
চড়ি, চড়ি, চড়ি, চড়াই-র তো নেই শেষ ...। বাঁধানো পথ ধাপে ধাপে ধপধপিয়ে চড়েই চলেছে। রামমন্দির পেয়ে রামের ভরসায় খানিক দম নেওয়া গেল।
বেলা এগারোটা চল্লিশ -
ধাপের ধাপ্পাবাজির বুঝি শেষ নেই! আমাদের অবস্থা দেখে দু-ধারের পাহাড় আঁকড়ানো গাছগাছালি হেসেই আকুল। এমনকী হুই নীচ থেকে যমুনার হাসিও শোনা যাচ্ছে। বাঁকের মুখে চায়ের দোকানের ডাক এড়ানো গেল না — এলিয়ে পড়লাম রেলিং ঘেঁষা বেঞ্চির ওপর। দমদম থেকে দমের আসতে সময় লাগবে তো।
বেলা একটা -
চড়চড়িয়ে চড়েই চলেছে পথ। দুদিকের পাহাড় কোলাকুলি করতে কাছিয়ে আসছে ক্রমশ।
বেলা একটা চল্লিশ -
ওই তো দেখা যাচ্ছে যমুনোত্রীর মন্দির। ও বাবাগো — ঠ্যাংবাবাজির টানে চিৎ .. না, ঠিক চিৎ না, কাৎপটাং — মাস্ল্ ক্র্যাম্প। অতএব, নিজেরই পদসেবায় লেগে পড়লাম।
বেলা পৌনে দুটো -
বেলা দুটো চব্বিশ -
যমুনোত্রীর চাপা পরিবেশে কেমন হাঁসফাঁস লাগছে — মনটা পালাই পালাই করছে দু-জনেরই। অতএব ফিরতি পথে পা।
বেলা চারটে দশ -
পালিয়ে এলাম জানকী চটিতে। শেষবেলার রাঙা আলো মেখে তুষারমৌলীরা ধ্যানে বসেছেন।সন্ধ্যা সাড়ে ছ-টা -
ব্যাক টু বড়কোট।
রাত আটটা -
বড়কোটের সাঁঝবেলাটা বড় মনকাড়া। আকাশ ভরা আঁধারের নিচে আলোর পসরা। ঝলমলে দোকানপাট, হাস্যমুখ লোকজন। ভিড় হলেও হই হট্টগোল নেই। আসন্ন দিওয়ালী উপলক্ষ্যে আলোর বাজি, বাজির আলো — ওপর থেকে তারার দল সব দেখে মিটিমিটি হাসছে।
নয়ই নভেম্বর, সাত-সকাল -
উত্তরকাশী যাবে বলে শীতের ঠাণ্ডা মেখে বাস আড়মোড়া ভাঙল। প্রথম রোদ্দুরে রাঙা হয়ে সুদর্শন (সু-দর্শন তো বটেই) দর্শন দিল।
বেলা পৌনে এগারোটা -
বেলা এগারোটা এগারো -
অনেকখানি পথ ঠেঙিয়ে বনদপ্তরে এসেছি অনুমতির আশায়। গোমুখ 'গঙ্গোত্রী সংরক্ষিত বনাঞ্চল' -এর ভিতর অবস্থিত। তাই অনুমতি একান্তই জরুরী।
বেলা সাড়ে এগারোটা -
মাথা পিছু দেড়শো টাকার বিনিময়ে অনুমতি আদায় হল।
বিকেল পাঁচটা -
ভাগীরথীর এখনকার শান্ত রূপ দেখে কে বলবে, ইনিই এই বর্ষায় রণচণ্ডীর রূপ ধারণ করেছিলেন! তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ অবশ্য স-শরীরে, ঠিকভাবে বলতে গেলে ভগ্নশরীরে উপস্থিত। ভাগীরথীর ওপরের লোহার পুলখানা এখন পাকানো ছেঁড়া দড়ি হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে নুড়ির রাশির ওপর। শীতের শান্তঅ মেয়ে নিজের কীর্তি দেখে মুচকি হাসছে।
দশই নভেম্বর, সাত-সকাল -
গঙ্গোত্রী যাবার বাস গা ঝাড়া দিল। সিমেন্টের জঙ্গল ফুঁড়ে শীতের হাওয়া খামচি মেরে যাচ্ছে অনবরত।
সকাল সাড়ে সাতটা -
ভাগীরথীকে ডানদিকে রেখে নেতালা পার করে বাস এসে পড়েছে মনেরিতে। এখানে বাঁধ দিয়ে ভাগীরথীকে বাঁধার চেষ্টা হয়েছে। অনেকখানি ছড়ানো নীলচে সবুজ জল প্রায় নিস্তরঙ্গ।সকাল আটটা ঊনপঞ্চাশ -
লাটাসেরা, মল্লা, ভট্তয়াড়ী হয়ে হেল্গু গাড পেরিয়ে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বাস এসে দাঁড়াল গঙ্গ্নালীর উষ্ণকুণ্ড ঘেঁষে, একটু উষ্ণতা পেতে। বাস থেকে নামতেই পাঁচশো মেগাবাইটের ঠাণ্ডা জাপটে ধরল। বিচ্ছু রোদ্দুর খানিক দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। তার দিকে এগোতেই পথের ধার থেকে ডাক দিল চা-কফির দোকান। আমরাও বিরহিনী রাধার মতো সে ডাকে সাড়া দিতে এক মুহূর্তও দেরি করলাম না। ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ দু-হাতে ধরে তাতে চুমুক — দুনিয়ার সেরা আরাম; অন্তত এই মুহূর্তে।
বেলা পৌনে এগারোটা -
সুখী ক্যাম্প, ঝালা, ধরালীর ধার ঘেঁষে, হরশিলকে ভাগীরথীর তীরে রেখে, তুষারশৃঙ্গ আর হিমেল পাইনবনকে সঙ্গী করে কোপাঙ্গ, লঙ্কা পেরিয়ে ৩০৪৮ মিটার উঁচু ভৈরোঘাঁটীতে এসে সূয্যিমামার আদরের ছোঁয়া পেলাম। একসময় লঙ্কা পেরিয়ে এই ভৈরোঘাঁটীতে পৌঁছতে গিয়ে অনেকে মাটি নিত। যারা পৌঁছত, তারা বাবা ভৈরবনাথকে পুজো দিত। ভৈরবের পুজো না করলে গঙ্গাপুজো নাকি সম্পূর্ণ হয় না। তাই বাস থামতেই প্রায় সবাই ছুটল বাবার সেবায়। আমরা দুই মূর্তিমান নাস্তিক বাসে বসে ভৈরোঘাঁটীর সৌন্দর্য চাখতে লাগলাম। পাইনবনে ঘেরা GMVN-এর বাংলো মন্দিরের মুখোমুখি ছায়া মেখে বসে আছে। পাখিরা সব গাছের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যকিরণ মেখে উড়ে বেড়াচ্ছে।বেলা সোয়া এগারোটা -
বাস গঙ্গোত্রীর একফালি বাস (এবং ট্যাক্সি) স্ট্যাণ্ডে এসে গা ছেড়ে দিল। আমরাও বাস ছেড়ে নেমে এলাম। দু-দিকের উত্তুঙ্গ পাহাড়ের পাহারায় দুরন্ত, উদ্দাম ভাগীরথী এসে আছড়ে পড়ে তৈরি করেছে সূর্যকুণ্ড। একফালি বাঁধানো পথ দুসারি দোকানপাট, হোটেল রেস্তোরাঁ ধর্মশালা, পূজাসামগ্রীর দোকানের মাঝখান দিয়ে গিয়ে পড়েছে মন্দিরে। তার খানিক আগেই পথের একটা ফালি ডানদিকে ছিটকে পুল পেরিয়ে ওপারে গিয়েছে। সেখানেও বেশ কিছু হোটেল, ধর্মশালা। দূর থেকে সুদর্শন তার সঙ্গীসাথী নিয়ে এদিকে নজর রাখছে আর হিমেল নিঃশ্বাস পাঠাচ্ছে অহরহ। ৩১৪০ মিটার উঁচুতে ওই হিমনিঃশ্বাসের ধাক্কায় আমাদের দাঁতে দাঁতে কত্তাল। এই ভরদুপুরেও তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আটকে।
বেলা সোয়া দুটো -
গঙ্গোত্রী আকাশ থেকে সাবুদানা আমদানি করা শুরু করেছে। সাদামাটা সরল মন্দির দেখে, ধাপ বেয়ে নেমে দেখে এলাম কোথায় বসে ধ্যান করে করে ভগীরথ পাথর ক্ষইয়ে ফেলেছিলেন।
বেলা পৌনে চারটে -
পুলের ওপর দাঁড়িয়ে যে নীলচে সবুজ ভাগীরথীর পাথর ডিঙোনো নাচ দেখব, তার কলতান শুনতে শুনতে যে সুদর্শন দর্শন করব, সেটা হিংসুটে ওপরওয়ালার সহ্য হল না; পাঠিয়ে দিল এই কোটি কোটি বরফের সাবুদানা।
রাত আটটা -
সাবুদানা যে পি. সি. সরকারের 'ওয়াটার অফ ইণ্ডিয়া' হয়ে উঠেছে! ঝরতে ঝরতে একটু দম নেয়, আবার ঝরে। তবে মুষলধারায় যে নয়, সেটাই রক্ষে। ঘরের মধ্যেই ৩ ডিগ্রি। গোমুখ বোধহয় এবার বিমুখ করল। পরশু কালীপুজো, দীপাবলী — মন্দিরের ঝাঁপ বন্ধ হবে — গঙ্গোত্রী হয়ে পড়বে জনশূন্য। এখনই নব্বই ভাগ দোকানপাটের ঝাঁপ পড়ে গেছে এ বছরের মতো। ফেরার গাড়িও গোনাগুন্তি।রাত ন-টা -
লেপের তলায় ঢুকে স্থির হল কাল অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। ঘরে এখন ২ ডিগ্রি।
এগারোই নভেম্বর, ভোর ছ-টা -
ঘর ছেড়ে বেরোতেই ১ ডিগ্রির থাপ্পড় — শরীর ঝনঝন করে উঠল। পুণ্যার্থীদের ভক্তির জোর দেখে থমকে গেলাম — এই ঠাণ্ডায় জমে কুলপি হতে হতেও ভক্ত-ভক্তারা ভাগীরথীর বরফ জল নিজেদের গায়ে মাথায় ছিটোচ্ছে। দু একজন তো স্নানও সারলো, তারপর উসেইন বোল্টকে লজ্জা দেওয়া স্পীডে সিঁড়ি টপকে পোশাক বদলাবার ঘরে সেঁধিয়ে গেল। মন্দিরে আরতির ঘন্টা বাজছে। সেই শুনে পুবের আকাশ আড়মোড়া ভাঙল। আকাশ পরিষ্কার। শুধু সুদর্শনদের গায়ে বেশ কিছু মেঘের ধেড়ে খোকা ঘুমোচ্ছে। বাঁদিকের পাহাড়ের পাথুরে গায়ে ঝাঁপ দিয়ে নামা ঝরনা জমে কুলপি হয়ে থমকে গিয়েছে। এই অহল্যার ঘুম ভাঙাতে সূর্যকিরণ রামের আগমণের এখনও বহু দেরি।
সকাল সাতটা -
এদিকে না ঘেঁষলেও চিরবাসার দিকে বাসা করে থাকা মেঘগুলোর হাবভাব মোটেই সুবিধের মনে হচ্ছে না। তাই ঠিক হল, দুপুরবেলা পর্যন্ত যাওয়া যায়, ততদূরই যাব। তারপর গঙ্গোত্রীর ছেলে গঙ্গোত্রীতে — পারলে উত্তরকাশী।
সকাল ন-টা -
তাড়া নেই, তাই পথে পা পড়ল বেশ বেলায়। তাপমাত্রা এখন সহনীয় - ৪.৭ ডিগ্রি। মন্দিরের উঠোন থেকে উঠে যাওয়া সিঁড়ি ধরে পাকদণ্ডীতে পা রাখা গেল। আকাশে গঙ্গাবন্দনার সুর ভেসে বেড়াচ্ছে। ভাগীরথীর ওপারে পাহাড়ের উঁচুমাথা টপকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রোদ।
সকাল সাড়ে ন-টা -
গঙ্গোত্রীর সবাক চলচ্চিত্র এখন বাঁকের আড়ালে। ডানদিকে ভাগীরথীর আনন্দগান, আর বাঁদিকে গাছগাছালির পাতায় বাতাসের তুর্কি নাচন। গাছপালার পাতারা রংবদলের খেলায় মেতেছে। ধুমসো ধুমসো পাথরগুলো সর্বত্র ঠাণ্ডা মেখে থুম মেরে বসে রয়েছে। পাখিরা চিক চিক করে তাদের সাথে খুনসুটিতে মেতেছে। এই অপূর্ব ছবির মাঝে আমাদের পায়ের ধুপধাপ আর ঘন ঘন শ্বাস নেবার শব্দ বড্ড বেমানান।
সকাল ন-টা পঞ্চাশ -
কন্খু। ছোট্ট মন্দিরের গায়ে বিশাল তোরণ জানিয়ে দিচ্ছে, আমরা গঙ্গোত্রী সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রবেশ করতে চলেছি। অনুমতিপত্র পরীক্ষা করিয়ে, প্রয়োজনীয় সই সাবুদ করে আমরা পা বাড়ালাম।
সকাল দশটা দশ -
সংরক্ষিত বনাঞ্চলে দুটো অসংরক্ষিত উজবুকের পা পড়ল। বন্ধুর পথ বন্ধু-র মতোই আহ্বান জানাচ্ছে। বাঁকে বাঁকে তার 'টুকি' খেলা। নীল আকাশের গায়ে ইদিক উদিক ছুলির মতো মেঘের ছোপ।
সকাল দশটা বাইশ -
বড় গাছপালারা আর আমাদের সঙ্গ দিতে নারাজ। তবে ঝোপঝাড়েরা সানন্দে সঙ্গী হয়েছে। পায়ের তলায় মাটি কমছে, পাথর বাড়ছে। এবার একটু চা না হলে নিজেকে বাঙালী বলে ভাবতে কষ্ট হবে। অতএব, পাথরের চেয়ারে বসে দৃশ্যাবলোকন করতে করতে মেজাজে চা-পান। সঙ্গে চকোলেটের অনুপান।
সকাল দশটা একত্রিশ -
চা-চকোলেটে চাঙ্গা হয়ে বত্রিশ দুগুনে চৌষট্টি (দু-চারটে কমও হতে পারে) পাটি দাঁত বার করে আবার আমরা খাড়া। এখন এই এলাকায় প্রাণী বলতে আমরা দু-জন। সুদর্শনকে তাক করে নাক বরাবর চলার ইচ্ছে আমাদের, কিন্তু পথ যে ঘোরতর বঙ্কিম। অতএব মোচড়ের পর মোচড়।
সকাল এগারোটা -
এরকমই একটা মোচড়ের পর এবারের মোক্ষম মোচড়! আমাদের থেকে মাত্র শ-খানেক ফুট দূরে একদল হিমালয়ান আইবেক্স - বঢ়াল। সত্যি? নাকি স্বপ্ন! নাঃ, চোখ কচলাবার পরেও বঢ়ালেরা যথাস্থানে। অন্যান্যরা চরতে ব্যস্ত হলেও দলপতি আমাদের দিকে সতর্ক নজর রেখেছে। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। আমাদের দেখে ওরা যে খুব একটা ঘাবড়েছে, এমন মনে হল না। একেবারে বুড়ি ছোঁয়া দূরত্বে পৌঁছতে দলপতি একলাফে ওপরের ঢালে উঠে পড়ল, তারপর নিশ্চিন্তে সদলবলে ঝোপঝাড় চিবুতে লাগল। ওরা বুঝতে পেরেছে, আমরা দু-জন নেহাৎই গো-বেচারা। এবারের বেড়ানোর পয়সা উসুল হয়ে গেল।
সকাল এগারোটা আট -
সবাই যে আমাদের মতো গোবেচারা নয়, তার নমুনা এখন আমাদের সামনে; ঠিক করে বলতে গেলে বাঁপাশে। একটা বঢ়াল। জনৈক তুষারচিতা তার ছাল ছাড়িয়ে (নুন মাখিয়ে কিনা বলতে পারব না), তার মাংস দিয়ে ডিনার (লাঞ্চও হতে পারে, কিংবা দুটোই) সেরেছে সম্প্রতি। হাড়ের গায়ে লেগে থাকা মাংসের টাটকা টুকরোই বলে দিচ্ছে, খুব একটা বাসি মড়া নন।
বেলা পৌনে বারোটা -
বড় বড় বোল্ডার টপকে একটা অস্থায়ী পাথুরে পুল পেরোতে গিয়ে খেয়ালই করিনি, মেঘেরা কখন চুপিসাড়ে আকাশের দখল নিয়েছে।
ঠিক দুক্কুরবেলা -
ভূতে ঢেলা না মারলেও, মেঘেরা ঠেলা মারছে। হুই দূরে চিরবাসার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মেঘেদের জমায়েত থেকে মাঝেমধ্যেই হুমকিমাখা স্লোগান শোনা যাচ্ছে।
বেলা বারোটা দশ -
মেঘেরা রীতিমতো জঙ্গীহানার লক্ষণ দেখাচ্ছে। এই ভরদুপুরেও তাপমাত্রা নেমে এসেছে দুইয়ের কাছে। অতএব - 'ফিরে চল আপন ঘরপানে -' চাচা আপনি বাঁচা। বেঁচে থাকলে চিরবাসা ভুজবাসা সব হবে।
বেলা দু-টো পাঁচ -
গঙ্গোত্রীর ছেলে গঙ্গোত্রীতে। এখানে কিন্তু আকাশে মেঘের ঘেরাও নেই — যদিও তাপমাত্রা ছয় ছুঁই ছুঁই।
বেলা তিনটে -
হায় রে! ফেরার কোনও গাড়ি নেই। অতএব আজ বাধ্যতামূলক তীর্থবাস।
বারোই নভেম্বর, ভোর পাঁচটা -
১ ডিগ্রির দলাই মলাই সহ্য করে গাড়ির খোঁজ চালাচ্ছি। সর্বত্রই 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট এ গাড়ি'।
সকাল সাতটা -
অবশেষে এক ফিরতিপথের দোকানদারের গাড়িতে ঠাঁইয়ের ভরসা মিলল।
সকাল আটটা -
গাড়ি গড়ালো। বিদায় গঙ্গোত্রী। দুই নাস্তিকের তীর্থযাত্রার এবারের মতো এখানেই ইতি। নটে গাছটি ....