• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৪ | জুন ২০১৩ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • সতত হে নদ : একটি পর্যালোচনা ! : সৌভিকদা


    সতত হে নদ ; মাসকাওয়াথ আহসান; প্রথম প্রকাশ : , জনান্তিক - পৃষ্ঠাঃ ; ISBN :

    কৈশোরে সুনীল-শীর্ষেন্দু পড়ে যেমন অদ্ভুত ভাবালুতায় দুপুরটা পার হয়ে যেত বিষণ্ণ বিকেলের মধ্য দিয়ে, তেমনি লেখক মাসকাওয়াথ আহসানের ‘সতত হে নদ’ বইটি পড়ার পর কী এক ভাললাগায় আক্রান্ত হয়ে পুরো বিকেল উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা যায়। আর মাথার ভেতর তখন ঘুরতে থাকে জার্মানীর বন, রাইন নদীর তীর, বাড গোডেস বার্গ, বাদেন বাদেনের প্রাচীন পানশালা, পাহাড়ী ঢাল, রোমান দালান, সর্বোপরি জার্মান-বাঙালিদের উদ্বাস্তু জীবন যাপন। পলিমাটির ভেতরে ফেলে আসা প্রাণবীজ, সমস্ত রকম নিরাপত্তা-নিশ্চয়তার পরেও কী যেন নেই, কী যেন নেই, কী যেন থাকা জরুরী ছিল, ভীষণ জরুরী!

    তুই ফেলে এসেছিস কারে মন, মনরে আমার!

    এই রকম প্রবল দুঃখবোধ ও স্মৃতিকাতরতার ভেতরেও ছাপিয়ে ওঠা যে দিকটি এ বইকে আর দশটা উপন্যাস থেকে আলাদা করেছে তা হলো: মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কিছু বিষয় যেগুলো নিয়ে পরিকল্পনামাফিক ইচ্ছাকৃত বিতর্ক তৈরী করা হয়েছে, দলীয় স্বার্থে ইতিহাসের ওপর বারবার চালানো হয়েছে লাল কালি, সেই বিষয়গুলো নিয়ে একটি নির্মোহ ধারণা দেয়া হয়েছে উপন্যাসটিতে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক বাংলাদেশের একটি চিত্রও আঁকা হয়েছে খুব যত্নের সাথে…

    “৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতে যখন বাবরী মসজিদ ভাঙা হয়, তখন সাম্প্রদায়িক উসকানিতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হয় বিএনপি-জামাতের ক্যাডাররা। ইনকিলাব তখন প্রতিদিন উস্কানি দিচ্ছে। বিজেপির বাংলাদেশ সংস্করণ হিসেবে কাজ করছে জামায়াতে ইসলামি। পঞ্চগড় শহরের এক হিন্দু বিধবা বুড়ির ওপর যথারীতি চড়াও হয় বিএনপি-জামাত ক্যাডাররা। তারা চাঁদা হাঁকে--এই বুড়ি তিনদিনের মধ্যে তিন লাখ টাকা রেডি রাখবি। আমরা এসে নিয়ে যাবো। বুড়ি আর যায় কোথায় আওয়ামী লীগের নেতা রহিম মিয়ার শরণাপন্ন হয়। আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ দল, রহিম মিয়াঁর চোখ ছলছল করে ওঠে: মাসিমা ওই জন্যই ওরা সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা মুছে দিয়েছে। আমরা ক্ষমতায় গেলে আবার স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিবো।

    "মাসিমা পূজোর প্রসাদ এগিয়ে দিয়ে বলে,

    "— বাবা রহিম তুমিতো আমার সন্তানতুল্য। এই বিপদে আমারে বাঁচাও।

    "— নিশ্চয়ই মাসিমা। আমার ছাত্রলীগের ক্যাডাররা আপনার বাড়ি পাহারা দেবে। এটা আমাদের রাজনৈতিক কর্তব্য।

    "এরপর শোনা যায় রহিম মাসিমার ধর্মছেলে হয়ে যায়। সন্তান যেমন মায়ের দেখাশোনা করে ঠিক তেমনি। পঞ্চগড় বাজারে মাসিমার বাড়ি, কয়েকটা দোকান, কালীমন্দির এইসব নিজের নামে লিখিয়ে নেয় ধর্মনিরপেক্ষ রহিম। তারপর মাসিমাকে বর্ডার পার করে কলকাতা পৌছে দিয়ে আসে। বর্ডারের চেক পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ধূসর চোখে একবার পেছন ফিরে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের দিকে তাকিয়ে মাসিমা প্রায় আর্তনাদের ভঙ্গীতে বলেছিল

    "— তোমারে বিশ্বাস করছিলাম বাবা।”

    ঘটনাটি ১৯৯২ সালের প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও ২০১৩’তে যে অবস্থার কোনই হেরফের ঘটেনি, তা বিশ্বজিৎ হত্যার দগদগে ঘা-ই প্রমাণ করে। উপরন্তু রামুতে বৌদ্ধ মন্দির হামলা, যুদ্ধপরাধ ইস্যুতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ--মন্দির ভাঙচুর তো বাড়তি পাওনা।

    উপন্যাসটির মূল চরিত্র শক্তি ৫৭ বছর বয়সেও অবিবাহিত। জার্মানীতে এসেছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। তারপর সেখানেই বসবাস। বিয়ে নামক ইনস্টিটিউশনে তার প্রবল অভক্তি। তার ভাষায়-- "গণতন্ত্র যেমন ব্যর্থ তন্ত্র, বিয়েও তেমন ব্যর্থ এক মন্ত্র"; "বিশ তিরিশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড"; "আনএথিক্যাল অবাস্তব বন্দোবস্ত"।

    ডয়চেভেলে পত্রিকার সম্পাদক মাসকাওয়াথ আহসান বইটিতে তুলে এনেছেন প্রবাসী বাঙালিদের শেকড়ে ফেরার টান, নষ্টালজিয়ার পাশাপাশি দেশ নিয়ে তাদের গভীর উদ্বেগ। হয়ত কখনই আর ফেরা হবে না তাদের নাড়ির গন্ধ যে-মাটিতে লেগে আছে। কিন্তু উপন্যাসের চরিত্র ‘রমিজুল’ চায় তার জার্মান বংশোদ্ভুত দুই মেয়ে বড় হবে বাঙালি সেন্টিমেন্ট ধারণ করে। অথচ বড় মেয়ে সেদেশের সামাজিক কাঠামোর সাথে আশৈশব মাখামাখি হয়ে তার বয়ফ্রেণ্ডের সাথে একদিন লিভ টুগেদার শুরু করে, আর ছোট মেয়ে তার মেয়ে বন্ধুটির সাথে আলাদা এপার্টমেন্টে উঠতে চায়। কারণ তারা দুজন দুজনকে ভালবাসে!!!

    অন্যদিকে উপন্যাসের আরেকটি চরিত্র, ‘তৃণা’ যেখানে চায় তার ছেলে ‘মিদু’ হবে জার্মান বাচ্চাদের মত ডিসিপ্লিনড, তখন ‘মিদু’ ম্যাগডোনালড্‌সে ঢুকে "এমন ভাবে চেয়ারে পা তুলে বসে যেন মধুর ক্যান্টিনে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের কোন প্রতিষ্ঠানবিরোধী নেতা … মিদুর কাছে জার্মানিটা একটা ভিনদেশ। ওর মন পড়ে থাকে নানু দাদুর দেশে।" ড্রয়িংরুমের দেয়ালে গাছপালা ঘেরা একটি বাড়ির পেইন্টিং দেখে মিদু ভাবে ওটা তার দাদুর বাড়ি। দুহাত তুলে সে পাখির মত উড়ে চলে যেতে চায় ওই গ্রামে, মেঠোপথে। এলবামে ছবি দেখে অস্থির হয়ে ওঠে--"নানুর কাছে যাবো।" এইরকম বিচিত্র সব ক্রাইসিসের ভেতর দিয়ে প্রবাসী বাঙালিদের দৈনন্দিন দিন-যাপন, উপন্যাসটি এগোয় একটি অনিশ্চিত পরিণতির দিকে, সমাধানহীন কতগুলো সমস্যার সমাধানের খোঁজে। আর এভাবেই উপন্যাস 'সতত হে নদ' বয়ে যায় স্বার্থক নামাঙ্করণের মধ্য দিয়ে। নদীর জলের গন্তব্যহীন যাত্রায় অনিশ্চয়তা যেমন তার শৈশব-সঙ্গী, 'সতত হে নদ' বইয়ের চরিত্র নির্মাণ ও ঘটনাপ্রবাহের উপর লেখকের নিয়ন্ত্রণটাও ঠিক তেমন। লেখক যেন শুধু দৃশ্যের বর্ণনা করে গেছেন। সেই অর্থে কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে উপন্যাসের চরিত্রগুলিকে নিয়ে যেতে চাননি।

    মাসকাওয়াথ আহসানের লেখার সাথে আমার পরিচয় প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’র মাধ্যমে, সময়টা মনে নেই। ৩ পৃষ্ঠার একটা ফিচার ‘বিষণ্ণতার শহর’ পড়তে পড়তে যে গভীর বিষণ্ণতায় ডুবে গেছিলো সেই কিশোর, তা আজও কাটেনি, এই পরিণত যৌবনে এসেও: বাঙালির মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট, শো-অফ প্রবণতা, জেনারেশান গ্যাপ, নদীর পাড় ভাঙার মত সামাজিক জীবনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবক্ষয়ের অনুপ্রবেশ, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের প্রতিযোগিতা এবং এসবের সাথে শহরবাসীর প্রতিদিনকার সমঝোতা… লেখক আমাদের আটপৌরে জীবন থেকে তার মাইক্রো প্রাইম লেন্স অবজার্ভেশানের মাধ্যমে এমনভাবে তুলে এনেছিলেন যে, পড়তে গিয়ে প্রতি লাইনে একবার করে চমকে উঠতে হয়, কীভাবে কত সহজে আমরা এসবের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, যাচ্ছি : "এই শহরের সবচেয়ে জয়ী মানুষটি, যে দারিদ্র্যে দিন কাটাচ্ছে, অথচ একটি বড়সড় চেয়ার জুড়ে রেখেছে। তার সকল আত্মীয়-স্বজন তাকে অপদার্থ বলে মজা পায়। সৎ মানুষের আশ্রয় এ শহর দিতে পারে না।" এই হতাশা দেখা যায় তার ‘সতত হে নদ’ বইটিতেও। দারুণ অক্ষম এক ক্ষোভ থেকে যখন লেখেন--"মাঝে মধ্যে শক্তির মনে হয় স্বর্ণ চোরাচালানকারী, মাফিয়া, আর্মস ক্যাডার, ছিঁচকে চোর, মাস্তান, এরা যখন মন্ত্রী হচ্ছে, এমপি হচ্ছে তারচেয়ে বৃটিশ রয়্যাল শাসন কিংবা পাকিস্তানের শাসন ভালো ছিল! তবু আমার চেয়ে লম্বা ফর্সা দেখতে ভাল কেউ আমাকে শাসন করছিলো। শক্তি জানে এটা খুবই যুক্তিহীন একটা চিন্তা।" মনের ভেতর পারস্পরিক প্রতিক্রিয়াশীল এই অভিঘাতগুলো কখনও কখনও এদেশের প্রান্তিক মানুষগুলোর মধ্যেও বিদ্রোহ করে ওঠে, একদিকে ক্ষমতাবান মানুষদের বিভিন্ন অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার অক্ষমতা, অপর দিকে টোটাল সিস্টেমটা ভেঙে নতুনভাবে গড়তে না পারার যন্ত্রণা, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কিংবা ‘ইসলামি মূল্যবোধ’ কোনটাই ব্যক্তিস্বার্থে ক্যাশ করতে না পারা: তাদের মনের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ বিদ্রোহ করে ওঠে--"রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা"!

    ‘জাতির পিতা’ প্রসঙ্গে লেখক উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র ‘শক্তি’র বর্ণনা দেন যেভাবে; মাঝে মাঝে মনে হয় লেখক নিজেকেই চিত্রিত করেছেন তার মধ্য দিয়ে--"শক্তি কট্টর বামপন্থী ছিল, মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরতো, প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগকে দু’চোখে দেখতে পারে না কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সব সময়ই জাতির পিতা বলে মনে হয়েছে তার। যার যে সন্মান তা তাকে দিতে হবে।"

    পাশাপাশি যে বিতর্কিত বিষয়টির অবতারণা করেছেন--"বঙ্গবন্ধুর সাথে একবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর দেখা হয়েছিল। ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, করছো কী মুজিব, স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দিয়ে দাও।

    "মুজিব বলেছিলেন, বলো কী ক্যাস্ট্রো, আমি তা পারবো না। ওরা আমারই সন্তান।

    "মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে ওদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। অথচ সেই রাজাকাররা আজো ফিরে আসতে পারেনি স্বাভাবিক জীবনে। পাকিস্তানের স্বপ্ন বুকে নিয়ে স্বৈরিণী হয়ে শুয়ে আছে ক্ষমতার বিছানায়।"

    বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও তৎপরবর্তী প্রেক্ষাপট সম্পর্কে লেখক অত্যন্ত সচেতন হওয়া সত্বেও রাজনৈতিক বক্তব্য নির্ভর এই উপন্যাসটিতে ১৯৭২ সালে প্রণীত ‘দালাল আইন’-এর ব্যপারটি লেখক মনে হলো সতর্কতার সাথে এড়িয়ে গেছেন। যদিও খুব প্রাসঙ্গিক ভাবেই বিষয়টি তাঁর উপন্যাসে উঠে আসা প্রয়োজন ছিল। নিদেনপক্ষে একটা বক্তব্য বা মতামত।

    আবার বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত বহুল আলোচিত ও সমালোচিত শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ কনসেপ্টকে লেখক ডিফেন্ড করেন, শক্তির জার্মান গার্লফ্রেন্ড ক্রিস্টা যখন জানতে চায় মুজিব একদলীয় শাসন ব্যবস্থার ধারণাটা কোত্থেকে পেল - "মুজিব প্রধানত সামাজিক গণতন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, সমস্ত অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে, পাকিস্তানের শোষণে দেশ আগে থেকেই নিঃস্ব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করছে, তেমন কোন বিদেশী সাহায্য আসছে না কোথাও থেকে, ভারত মুক্তিযুদ্ধকালীন সাহায্যের রিটার্ন চাইছে, অনেকটা পাওনাদারের মত বসে আছে, আওয়ামী লীগের মূর্খ উইং তাজউদ্দীনকে মুজিব থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রশাসনে মূর্খের স্বর্গ রচনা করেছে, চারিদিকে লুটপাট চলছে, মুজিব বোধহয় তখন ক্যাস্ট্রোর পথে যাচ্ছিলেন। … মুজিব কিন্তু বলেননি যে বাকশালই ধ্রুব, এ জাতির ম্যাগনাকার্টা। মুজিব বলেছিলেন, চেষ্টা করে দেখি চললে চলবে। না চললে অন্য ব্যবস্থা।

    "কিন্তু অতি উৎসাহী ছাত্রলীগের পাণ্ডারা উদারপন্থী মানুষদের যারা বাকশালে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানালেন তাদের গলায় গামছা দিয়ে নিয়ে গেলো বাকশালে যোগ দেওয়াতে। আওয়ামী লীগের সবচে বড় ক্ষতি করেছে অতিউৎসাহী খারাপ ছাত্রনেতারা আর গ্রামের চাওয়াজী নেতারা।"

    উপন্যাসের আরেকটি গুরত্বপূর্ণ চরিত্র ‘খোকন ভাই’ যিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিকদের একজন, জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে জার্মান সাংবাদিক আন্দ্রেয়াঁসকে বলছেন এভাবে--"২৭ মার্চ মেজর জিয়া মুজিবের পক্ষে ঐ ঘোষণা পাঠ করেছেন মাত্র। ঐ মূহুর্তে একজন সামরিক কর্মকর্তার বিপ্লবী রেডিওতে ঘোষণা পাঠের একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব অবশ্যই রয়েছে। … কিন্তু বেঁচে থাকতে তিনি নিজেও কখনো নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবী করেননি। … জিয়া মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সার্কের মতো আঞ্চলিক ফোরাম তৈরীতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাকে জোর করে (এইভাবে) স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর দরকারটা কী?"

    যুদ্ধপরাধী রাজাকারদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের ব্যপারে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ভূমিকা প্রসঙ্গে লেখক বলেন--"তিনি কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিলেন। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পুনর্বাসিত হতে সাহায্য করলেন। আর সবচেয়ে বড়ো যে ভুল করলেন স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি রাজাকারদের পুনর্বাসিত করলেন। জিয়াউর রহমানের ঐসব ভুলের জন্য দেশ এখনো ভুগছে।"

    মুজিব হত্যাকাণ্ড এবং জিয়া হত্যাকাণ্ড সম্পর্কেও লেখক একটা ধারণা দিয়েছেন তার পাঠকদের এভাবে--"বাংলাদেশের যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বা জিয়ার হত্যাকাণ্ড সেখানে একটা জিনিস লক্ষ্য করবে, যখনই মুজিব আঞ্চলিক সংহতিতে ব্রতী হলেন, ওআইসি-জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় হলেন তখনি সাম্রাজ্যবাদীরা ব্যপারটা ভাল চোখে দেখলো না। তার উপর বাকশাল, সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের চেষ্টা। আবার যখনই জিয়া সার্কের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় একটা শক্তিশালী জোট গড়তে চাইলেন, তার পেছন থেকে পশ্চিমা সমর্থন সরে যেতে থাকলো। … বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র এক বদ্বীপের কোন রাষ্ট্রনায়ক ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বিকশিত হবে এটা যেন কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা।"

    এদেশ রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে। এখন আমাদের প্রয়োজন অর্থনৈতিক মুক্তি। এটাই মুক্তিযুদ্ধের ২য় পর্যায়, যেখানে একনিষ্ঠভাবে ভূমিকা রাখছেন প্রবাসী বাঙালিরা, তাদেরকেই বরং এ-সময়ের মুক্তিযোদ্ধা বলা উচিত। অথচ তারা যেন সতীনের ছেলে। এই এক শাহবাগ আন্দোলনের সাফল্য নিশ্চিত করতে বিগত এক মাসে আমাদের গণ-মাধ্যমগুলো যত মেহনত করেছে, তার দশভাগের এক ভাগও কি প্রাপ্য ছিলো না আমাদের প্রবাসী বাঙালিদের গত দশ বছরে? তাদের অধিকার, তাদের জন্য সরকারী উদ্যোগ ও তৎপরতা, আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সফলতা-ব্যর্থতা; সর্বোপরি সরকারের করণীয় নিয়ে আরো বেশি গুরুত্বের অবকাশ কি ছিলো না আমাদের মিডিয়া কর্মীদের, সংবাদ মাধ্যমগুলোর? "আহারে মাইজুদ্দি, আবু তালেব, রশিদ, বক্কর তোমরা কোত্থেকে দেশকে ভালবাসার এত শক্তি পাও। যে তোমরা বায়ান্ন, বাষট্টি, উনসত্তর, একাত্তরে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছো। এখনো দিচ্ছো। দেশের বাইরে এসে রক্ত পানি করা উপার্জন দেশে পাঠাও। একজন জব্বার, একজন বরকত যে হয়তো গ্রীষ্মগ্রামের একদা আদরের ছেলে, রাস্তা থেকে বরফ কেটে কেটে সরাও অথবা মাইনাস টেম্পারেচারে কনস্ট্রাকশানের দিনমজুর – সেও দেশে গিয়ে নিজের গ্রামে একটা স্কুল করতে চায়। কিংবা একটা সমবায় সমিতি খুলে দিয়ে আসে, মসজিদে দুটো ফ্যান লাগিয়ে দ্যায়, ছয়টা জায়নামাজ কিনে দেয় মুসল্লিদের জন্য, ধর্মের জন্য এসব দ্বায়িত্ব পালন করতে তো আর জামাতের রোকন হতে হয় না। অথচ আমাদের মাননীয় রাজনীতিবিদ, আমলা মহোদয়, সামরিক নায়কেরা, ব্যবসা জগতের বড়ো বড়ো মাছ, এনজিওর বড়ো বড়ো টর্চবাহক, ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন সুশীল সমাজ, স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ সুযোগসন্ধানী পাতাকুড়ানির দল তারা কি কেউ কখনো এইভাবে ভালবাসতে পারবে বাংলাদেশকে? যেভাবে ভালবাসে মাইনাস টেম্পারেচারে কাজ করা দিনমজুর মইজুদ্দী কিংবা রশীদ।

    "… ওরাই হচ্ছে বাংলাদেশের আসল হিরো। বাংলাদেশের কথা লিখতে গেলে প্রথমে ওদের কথা লিখতে হবে। ওরা ঢাকা ক্লাবের দ্য ভিঞ্চি কোড নিয়ে ইন্টেলেকচুয়াল ছেনালীপনা করে না। কিংবা ইসলাম ইজ আ কমপ্লিট কোড অফ লাইফ বলে ব্ল্যাক লেবেলে সীপ করে না। কিন্তু ওরাই বাংলাদেশ।"

    বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী এই বিষয়গুলো বর্তমান সময়ের পটভূমিতে রেখে খুবই প্রাসঙ্গিক ও নির্মোহভাবে উঠে এসেছে 'জনান্তিক' থেকে প্রকাশিত ৫ ফর্মার ‘সতত হে নদ’ বইটিতে। উপন্যাসটি এই সময়ের সেইসব মানুষদের জন্য একটি প্রামাণিক বয়ান হিসেবে থেকে যাবে: যারা বিএনপি নন, আওয়ামী লীগ নন, জামাত কিংবা কম্যুনিষ্ট নন, ব্যর্থ সোশ্যালিজমের ধ্বজাধারী নন অথচ রাজনীতি সচেতন, দলনিরপেক্ষ, যারা তাদের অনুভুতির ভেতর এ দেশকে ধারণ করেন, একটি পতাকা ও মানচিত্রের অহংকার যাদের বোধকে আন্দোলিত করে, যারা প্রতিটি মূহুর্তে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন, ভিড় দেখলে আশাবাদী হয়ে ওঠেন, জনসমাগম দেখলে যাদের রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে- এই বুঝি জনতা আবার জেগেছে : সেইসব মানুষদের জন্য এই উপন্যাস ‘সতত হে নদ’ !

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments