জীবন বেঁধেছি হাতবোমায়; পিনাকী ঠাকুর; প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১৩, সিগনেট প্রেস - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ৯৬ ; ISBN : 978-93-5040-231-3
পিনাকী ঠাকুর বিপজ্জনক কবি। কিন্তু কেন? কারণ এই কবি কখন কী করে ফেলবেন তা আগে থেকে বোঝা মুশকিল। বলতে চাইছি অপ্রত্যাশিত। কবিতার শুরু থেকে বোঝাই যায় না শেষে গিয়ে কী হতে পারে। বাংলা কবিতার অর্ফিয়ুস সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পিনাকী ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকা লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন 'পিনাকী ঠাকুরের প্রধান বৈশিষ্ট্য, অতি সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ। বেকার জীবন, রেল স্টেশন, সিনেমা হলের সামনে সাইকেল রিক্সা, মফঃস্বলী ট্রেনের যাত্রী - এই সব কিছুই এসে পড়তে পারে তার কবিতায়। কৌতুকের সঙ্গে কাব্যময়তার কঠিন সংমিশ্রণ একালে একমাত্র পিনাকী ঠাকুরের পক্ষেই সম্ভব। আপাত সহজ ও লঘু চালের পঙ্ক্তিগুলির মধ্যে মিশে থাকে গভীর জীবনবোধ। পিনাকীর কাব্যগ্রন্থগুলির পর পর যেন উত্তরণের ছবি এনে দেয়।' 'একদিন, অশরীরী' থেকে 'জীবন বেঁধেছি হাতবোমায়' এই উত্তরণের চিহ্ন ধরেই আমরা, পাঠকেরা হেঁটেছি। কিন্তু কীরকম সে হাঁটা? এতবছর একটা মফস্সল শহরে আছি। এখনও নতুন রাস্তা আবিষ্কার করে ফেলি মাঝেমধ্যে। একটা গলিতে ঢুকে মনে হয় এখানেই রাস্তা শেষ। ফিরতে হবে। তখনই আধুনিক বউদের সিঁথির মতো এক-একটা সরু রাস্তা পেয়ে যাই। একবারে অপ্রত্যাশিত। দারুণ উত্তেজনার। যেরকম 'চুম্বনের ক্ষত'র পর 'জীবন বেঁধেছি হাতবোমায়'।
কলকাতা শহরে এখন হাতবোমার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়? আমাদের মফস্সলে এখনও ছেলে-ছোকরারা মারামারি গণ্ডগোলের সময় হাতবোমার যথেচ্ছ ব্যবহার করে। এখন এর ডাকনাম পেটো অগ্নিযুগে ছিল হাতবোমা। সারাদিনের হতাশা, লড়াই, ক্লান্তি। শুধু বেঁচে থাকার জন্য কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে বেড়ানোর পর কোথায়? কেন সহজ উত্তর - বাড়ি। কিন্তু বাকি রাতও যদি বলতে হয় 'এই বাড়িটা ডিপ্রেশনের বাড়ি / এই বাড়িটায় বাজতো গ্রামোফোন! / কাব্য উধাও, পাঞ্জাবি আর দাড়ি / রয়েই গেল! চাকরি খুঁজব? ক্ষুদ্রশিল্পে লোন?'। শুধু বেকার জীবনে গ্লানি থাকে? চাকরি জীবনে থাকে না? জ্বলছি তো সবাই দাদা। কেউ খেয়ে কেউ না খেয়ে। এই যে 'দেহাতি মেয়েটা একা। / ঝড়ে যার ঝোপড়ি উড়ে গেছে।' রঙিন শহরে, ফ্লাই ওভারের শহরে, বিজ্ঞাপন-প্রচারের শহরে যার দুটো বাচ্চা আছে অথচ 'এক দানা চালও নেই। রাস্তার হারামিগুলো আড় চোখে মাই দেখছে ...' সে কী করবে বলতে পারেন? আমি আপনি তো ছাপোষা - সাধারণ মানুষ কোনও বিধানসভা, কোনও পার্লামেন্ট এর উত্তর দিতে পারবে? প্রধানমন্ত্রী এই দেহাতি মেয়েটিকে চেনেন? মেয়েটিও ওর গ্রাম্য ভাষায় নাম বলতে পারবে মন্ত্রীসভার একজনেরও? পারবে না। সমস্ত রাগ-ঘৃণা জড়ো করে সে শুধু বলে উঠবে হয়তো 'শালা চোট্টা থুক দিই এই টাউনে মরদ কুথায়!' আর এইসব শব্দবাণে আপনি জর্জরিত হবেন সেই আপনি দিগভ্রান্তের মতো রাস্তা চলবেন। পরিত্রাণ খুঁজতে হয়তো আচমকা দাঁড়িয়ে পড়বেন সাপ খেলা দেখতে। আর সাপুড়েকে বলতে শুনবেন '— সাপ বিড়ি খাবে! সাপ খেলা দেখাবে! দেখেন বাবু দেখেন, সার দেখেন, মেডাম দেখেন - সাপ বিড়ি খাবে, সাপ খেলা দেখাবে।' কিন্তু সাপ কী বিড়ি খায় কখনো? হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আপনি সাপুড়েকে পয়সা দেবেন। আর তারপর দেখলেন 'সাপুড়ে একটা বিড়ি ধরালো। মুখে বাক্যবাণ। গোড়ার দিকের লোকজন সরে গিয়ে নতুন নতুন মুখের উঁকিঝুকি।' আপনি কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। সময় এবং পয়সা আপনার তো দুটোই ইনভেস্ট হয়েছে। একসময় অধৈর্য হয়ে আপনি বলে ফেলবেনই—'কই হে, তোমার সাপ তো বিড়ি খেলে না! সেই সাপুড়ে নতুন লোকজনের কাছে বলবে 'আরে দেখেন বাবুমশাই, দাদা দিদি সার মেডাম। হাঃ হাঃ। এই দাদু তো পাগলা আছেন! সাপ কখনও বিড়ি খায়? আরে হামি বিড়ি খাবে, সাপ খেলা দেখাবে, ব্যস!'। পার্কে-দোকানে-সংসারে এই কালচারই কী চলছে না? সবাই তো সাপুড়ে হয়ে বিড়িতে সুখটান দিতে চাইছে আর অপরজনকে ভাবছে খেলা দেখানো সাপ। আরে দাদা সাপেরও তো একই বাসনা সাপুড়ে হবার। ফিরে আসি অর্ফিয়ুসের কথায়। পিনাকী সম্পর্কে উনি যা বলেছিলেন মিলিয়ে নিন পাই টু পাই।
এই কাব্যগ্রন্থে একটিই মাত্র দীর্ঘ কবিতা আছে। নাম 'টাইম স্পেসের রাস্তা'। রোজকার জীবন দিয়ে শুরু হয় এই কবিতা। ব্যাণ্ডেল লোকাল হাওড়া যাবার জন্য ছাড়লে আমরাও উঠে বসি তাতে। ভর্তি ট্রেন, হকার আর হাজার শব্দের মধ্যে মাইক টেস্টিং চলে। অ্যানাসিন আর জল খেলেও মনে পড়ে যায় 'চেনাকণ্ঠ' স্টুডিও, প্রেম!
আমরা সবাই জানি 'এ লড়াই বাঁচার লড়াই, তাই না?'। ট্রেনে গান শুনিয়ে 'চকরা বকরা শার্ট' যে জীবনযুদ্ধের শরিক ভাষাচার্য দাশবাবু স্যার কি তার বাইরে? এরপরই সেই অপ্রত্যাশিত। পিনাকী লিখলেন 'রাখিবন্ধের গান লিখে ভাঙা-বাংলা জোড়া দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ এই তো সেদিন / কর্মাটঁড়ে ঈশ্বরচন্দ্র সাঁওতালি মাদলের সুরে বিতরণ করছেন হোমিওপ্যাথি / তখন কোথায় তাঁর স্নেহধন্য কবি মধুসূদন?' একটি কবিতার মধ্যে জুরাসিক যুগ থেকে আবহমানের বাঙালি সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই কবি বিপজ্জনক। তাই বলে উঠতে পারেন 'চিন্তা নেই, ফাঁসির মঞ্চে উঠে জীবনের জয়গান গাইবার আগে / তোমার লিপস্টিকের রং-টাকে কমপ্লিমেন্ট দিয়ে যাব-'।
এই কাব্যগ্রন্থকে প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন কবি। প্রথম অংশের নাম 'শরমচিহ্ন' দ্বিতীয়টি 'নতুন ব্লেডের ধার'। চোখ বন্ধ করে মানুষ বাঁচতে পারে? সে যদি ভাবে 'বাচ্চা কোলে মায়ের কান্না', জব্দ চাষীর অসহায় মুখ হাত কাটা ভাইয়ের পয়সা চাওয়া কিংবা আমাদের চারপাশে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহ থেকে সে পালিয়ে যাবে, পারবে? কথা বলে উঠেছে কবিতা। পারবে না। 'যতই তুমি প্রাণ বাঁচাতে সরোবরের গর্ভে লুকোও / হাজার বেদব্যাসের কণ্ঠে শুনতে পাচ্ছ, মহাভারত?' বাংলা কবিতায় অনেক নতুনত্বের চর্চা শুরু করেছিলেন পিনাকী। ধারাবাহিক ভাবে সেই কাজকে উনি এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। সমসাময়িক ঘটনা-প্রবাহের সঙ্গে ইতিহাসের সেতু নির্মাণ এমনই এক পদক্ষেপ। যা 'জীবন বেঁধেছি হাতবোমায়'ও উপস্থিত।
'নতুন ব্লেডের ধার' কেমন হয় জানে শুধু পকেটমার। আর পকেটমারের লোমশ হাতে যার সবকিছু খোয়া গেছে জীবন-যৌবন-স্বপ্ন-প্রেম সে কী জানে না নতুন ব্লেডের ধার কেমন হয়? সেই তো জানে সব থেকে বেশি। যার 'বন্ধুরা কেউ শিবপুর বি ই, কেউ মেডিক্যাল, / প্রেসিডেন্সিতে কিংবা আর. জি. কর...' কারখানার শ্রম ও ঘামের গন্ধ যাদের ঘিরে থাকে কৈশোর থেকে সেই তো বলবে 'তখন আমারও তোমাদের মতো আঠারো বছর ... / শনিবার ছিল হপ্তাবাজার, প্রেম নেই, শুধু সারাদিন পর / আড়াইশো গ্রাম মাংস রাঁধার গন্ধ!'—এই হচ্ছেন পিনাকী ঠাকুর, বাংলা কবিতার মনস্ক পাঠককে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমরা পিনাকীর কবিতার পাঠকেরা বাচ্চাদের সঙ্গে খেলবো প্রাণখুলে। কিন্তু দুর্বোধ্য পাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যেসব যৌবনে জ্যাঠাপ্রাপ্ত পণ্ডিত, তাঁদের উদ্দেশে বলতে পারি 'কিন্তু প্রবীণ, কিন্তু পাকা, তোদের মাঠে কক্ষনো নামব না!'
'জীবন বেঁধেছি হাতবোমায়'—উপলব্ধির লম্বা এক রাস্তা। যার মধ্যে দিয়ে না গেলে জানতামই না আমাদেরও জীবনের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে আছে হাতবোমা।