• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৪ | জুন ২০১৩ | গল্প
    Share
  • শূন্যতার মাঝে যখন তুমি এলে : নিগার সুলতানা


    ঠাৎ যেন সে একা হয়ে গেল। এই কিছুক্ষণ আগেও সে একা ছিল না। ব্যস্ততা, আনন্দ, যন্ত্রণার ব্যাপকতা, ছিল নতুন কিছুর অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছুটা প্রাণবন্ত। যেমন ছিল অনেকগুলো বছর। সীমাহীন সময় অতিক্রম করা নিয়মের আবদ্ধে। এই মূহুর্তে সব কিছু তোলপাড় তছনছ হয়ে নিমেষেই সব আনন্দ নিভে গেল। ভূমিকম্পের পর যেমন সুনামী হয়, তেমনি হঠাৎ কম্পিত হৃদয় নিংড়ে এখন কেবল অশ্রুর আহ্বান। মুহর্তগুলো তাঁর কাছে অস্পষ্ট হয়ে উঠে। এখন সে যেন আলাদা, একা, বিচ্ছিন্ন, সব কিছুর সাথে যোগসূত্রহীন একটি সর্বগ্রাসী নিরর্থকতার অনুভূতি দ্বারা ভারাক্রান্ত। নিজেকে মনে হয় একটা বিচিত্র শ্লেষপূর্ণ করুণার বোধ দ্বারা আচ্ছন্ন। সামনে এগুতে পা সরে না, লাইনে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। নিথর হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেরা ডানা মেলে সুদূরে যেতে চায়--খুঁজে পেতে চায় একটি মুখচ্ছবি, শুনতে চায় কণ্ঠের রিদম। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে শুনতে পায়--কে একজন বলছে, বোডিং কার্ড প্লিজ—।

    সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট। ঠিক সাত দিন আগে এই পথেই সে এসেছিল। প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশনের দিকে এগুতে দেখতে পেল "তানিয়া তাবাচ্ছুম'' লেখা প্লাকার্ড হাতে বেশ লম্বা, দেখতে ভাল, উজ্জল শ্যামবর্ণের, মাঝবয়েসি একজন দাঁড়িয়ে। তানিয়া বুঝতে পারলো, ইনি--ইমতিয়াজ রায়হান। তানিয়া হাত নেড়ে তার উপস্থিতি জানায়। মিষ্টি হেসে তিনিও হাত তোলেন। বাইরে বেরিয়ে এলে ইমতিয়াজ রায়হান এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে তানিয়ার হাত থেকে ছোটো ট্রলিব্যাগটি নিয়ে সামনে এগিয়ে যান। লাল রঙের গাড়িটি ইমতিয়াজ নিজেই চালিয়ে এসেছেন। গাড়ি ছুটছে ফ্লাইওভার দিয়ে শহরমুখী। এখন পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বলা শুরু করেন নি। তানিয়া কিছুটা বিব্রত। কারণ, বান্ধবীর ছোটো বোন ''বেলা''র আজ তাকে নিতে আসবার কথা ছিল। বেলার বাড়িতেই তানিয়া থাকবে। এই কারণে সঙ্গে আর কেউ এলো না। আর কেইবা আসবে! সবাই যার যার কর্মজীবন, সংসার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। বেলা ব্যবসায়ী স্বামী আর এক মেয়ে নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে এই শহরে আছে। সুতরাং বেলার আন্তরিক ইচ্ছায় তানিয়া সাহস নিয়ে একাই আসবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আসবার দু'দিন আগে তানিয়া ইমেল পায় যে আচমকা বেলার শ্বশুরবাবা স্ট্রোক করে এক অংশ অবশ হয়ে বিছানা নিয়েছেন। বাঁচা-মরার ব্যাপার। শ্বশুরবাবাকে দেখতে বেলা স্বামী মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে যায়। এই অনাকাংক্ষিত ঘটনায় বেলা বার বার দুঃখ প্রকাশ করে লিখেছে--তার স্বামীর বড় ভাই ইমতিয়াজ রায়হান তাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে আসবে এবং সার্বক্ষণিক সময় দিবে। বেলার ওখানে তানিয়ার থাকার সব ব্যবস্থা করা আছে। মেইল পাবার পর তানিয়া কিছুটা বিব্রত অবস্থায় পড়ে যায়, দ্রুত সে হসপিটাল লাগোয়া ''সারা ইন'' হোটেলে একটি রুম বুকিং দেয়। বেলার অনুপস্থিতিতে ওর বাড়িতে থাকতে মন সায় দিল না।

    পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সব দৃশ্যপট মাড়িয়ে গাড়ি ছুটছে শহরের দিকে। ইতিমধ্যে ইমতিয়াজ রায়হান নিজেও জানাল কেন বেলা আসতে পারেনি। তানিয়া হেসে বলল--বিপদ আপদ তো বলে কয়ে আসেনা। দোয়া করি সব কিছু ভাল হোক। এই বলেই তানিয়া বলে, তাকে যেন হাসপাতালের পাশেই ''সারা ইন'' হোটেলে নিয়ে যায়। হঠাৎ যেন গাড়ির গতি কমে গেল, ইমতিয়াজ রায়হান জিজ্ঞাসু চোখে তানিয়ার দিকে তাকালো। তানিয়া কিছুই বললো না, তাঁর চোখের দৃঢ়তায় ইমতিয়াজ চুপসে গেল।

    হোটেলে তানিয়াকে নামিয়ে বিদায় নেবার সময় ইমতিয়াজ একটি মোবাইল সেট এগিয়ে দিয়ে বলে, আপনার কাছে রাখুন, এই কটা দিনে যোগাযোগে কাজে লাগবে। আর কিছু টাকাও রাখুন, আগামিকাল ডলার ভাঙিয়ে না হয় দেবেন, আমি সকালে এসে আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব। ইমতিয়াজ সব গুছিয়ে দিয়ে রিসিপশান থেকেই চলে যায়। তানিয়া মুগ্ধ হয়ে দেখে ব্যক্তিত্বপূর্ণ দায়িত্ববান ইমতিয়াজ রায়হান কে। রুমে ঢুকে হাত ব্যাগটি টেবিলে রাখতে যাবে অমনি মোবাইল ফোনটি বেজে উঠে। ভরাট কন্ঠের হ্যালো শুনে তানিয়া বুঝতে পারে ইমতিয়াজ রায়হান। এটি আমার নাম্বার--তাড়াহুড়ায় আপনাকে নাম্বার দিতে ভুলে গিয়েছি, ভাল থাকুন, যে কোনো সমস্যায় যত রাতই হোক আমাকে ফোন করবেন। ছন্দোময় কন্ঠের আলোড়ন তুলে লাইন কেটে যায়। তানিয়া বলতে গিয়েও বলার সুযোগ পায়নি যে ইমতিয়াজের নাম্বার তাকে বেলা আগেই দিয়েছে।

    এরপর সাতটি দিনের প্রতিটি দিন ইমতিয়াজ তানিয়াকে সময় দিয়েছে। হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, টাকা জমা দেওয়া, রিপোর্ট উঠানো সব বিষয়ে সাথে থেকে সাহায্য করেছে। তানিয়া ক্লান্ত হয়ে উঠলে, কোনো এক সোফায় বসিয়ে বাকি কাজ সে নিজেই করেছে। দিনের বেশিরভাগ সময় কেটে যেত হাসপাতালেই। বিকেলে ইমতিয়াজ গাড়ি নিয়ে তানিয়াকে শহরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখাত। রাতে কোনো রেস্টুরেন্টে দুজনে খেয়ে তানিয়াকে হোটেলে নামিয়ে দিত। যতক্ষণ না আবার দেখা হত--ততক্ষণে বেশ কয়েকবার ইমতিয়াজ ফোন করে খোঁজখবর নিত।

    তানিয়া তেমন ভাল করে জানেনা ইমতিয়াজের ব্যক্তিগত জীবনের কথা। বেলার কাছ থেকে জেনেছিল বিদেশি স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যাবার পর একাই আছেন। দুই মেয়ে ইংল্যান্ডে লেখাপড়া করছে। তারা খুব একটা আসে না, তিনি সময় নিয়ে তাদের দেখে আসেন। দাম্পত্যজীবন না থাকলেও তাঁর দায়দায়িত্ব পালন করে যান নিয়মিত। তানিয়া পছন্দ করে না যেচে কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলতে। সে লক্ষ্য করেছে ইমতিয়াজও তার সম্বন্ধে কিছু জানার আগ্রহ দেখায় না। হয়ত কিছুটা জেনে থাকবে বেলার কাছ থেকে। আর কি বা জানার আছে। একা, নিঃসঙ্গ জীবন। কবে শেষ হয়ে গেছে জীবনের সব চাওয়া পাওয়া, শেষ হয়ে গেছে মনের সব চাহিদা। ভালো লাগা ভালোবাসার জন্য এক সময় হাহাকার করত মন। লেখাপড়া শেষ করে আর দশটা মেয়ের মত স্বপ্ন দেখত--একটি ছোট্ট ঘর, ভালোবাসার মানুষ আর ভালোবাসার সৃষ্টিকে। সেটেল বিয়েতে বিশ্বাসী ছিল না, ভালো না বেসে, একজন আরেকজনে ভালো করে না জেনে কি করে বিয়ে করে এটা তানিয়া ভাবতেই পারে না। খুব গোছানো, দায়িত্ববান, ব্যক্তিত্বসম্পূর্ণ একজন মানুষের স্বপ্ন ছিল তার মানসপটে আঁকা। সে নিজেও খুব গোছানো। পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে গল্প কবিতা প্রবন্ধ লিখতে পছন্দ করে, তাঁর সিক্সথ সেন্স অসাধারণ।

    সহজেই আপন করে নেবার গুণও ছিল অপরিসীম। দেখতে ভালো তানিয়ার জীবনে যে কেউ সহজেই ধরা দিতে চাইত। শুধু তানিয়ার খুঁতখুঁতুনির কারণে বয়স গড়ায় সময়ের নিয়মে। মেধাবী ছাত্রী তানিয়া লেখাপড়া শেষ করে চাকু্রিতে ঢুকে পড়ে। অতঃপর--অফিসের কাজের চাপ, পিতৃহীন ভাইবোনদের দায়িত্ব, সব মিলিয়ে পরিবারের সবার বড় মেয়েটির এক সময় সব স্বপ্নের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। নীরবে নিভৃতে লুকিয়ে রাখে সব স্বপ্ন, নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেয়।

    তানিয়ার জন্য এই প্রথম এই দেশ। চাকুরির প্রয়োজনে বেশ কয়েকটি দেশে যাবার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে কখনো কেউ আসত রিসিভ করতে, নাহলে সে নিজেই চলে যেত নির্দিষ্ট ঠিকানায়। দায়িত্ববান তানিয়া খুব অল্প দিনেই সফলতার শিখরে নিজেকে অধিষ্ঠিত করে। কাজ এবং পেশাকে অসম্ভব আপন করে নিয়েছিলো। কাজের ব্যস্ততায় ভুলে থাকতো সব। রাতদিনের অতিরিক্ত পরিশ্রমে হয়ত তানিয়া জানতে পারেনি--কখন তার শরীরে কর্কট আস্তানা গেড়েছে। দেশের চিকিৎসার পর সবার ইচ্ছে--একবার বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া। তানিয়া জানে কোনো লাভ হবে না। তাও সকলকে খুশি করতে আজ তার এখানে আসা।

    যেদিন মেডিক্যাল রিপোর্ট সব হাতে এলো তানিয়া দেখতে পেলো ইমতিয়াজ গম্ভীর হয়ে গেলেন। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে গিয়ে গলার স্বর আটকে যাচ্ছে। তানিয়া স্বাভাবিক। তানিয়া জানে তার কি হয়েছে। যে জানা-জীবনকে তানিয়া নিজে সাজাতে পারেনি, সেই জীবনকে সাজিয়েছে মরণব্যাধি--। তানিয়া এমন ভাব করলো যেন সে কিছুই জানে না। ইমতিয়াজকে বলল, আমার কিছুই হয়নি, দেখছেন না ভালো আছি। একা মানুষ। নিশ্চিন্তে জীবন কাটছে। কোনো পিছুটান নেই। কেউ কোথাও নেই। কন্ঠস্বর ভিজে উঠে। কাঁপা কন্ঠে বলে--আপনি আমার ফিরে যাবার ব্যবস্থা করুন।

    ইমতিয়াজ ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারে, ভালোভাবে নিয়ম ধরে চিকিৎসায় থাকলে অনেকদিন ভালো থাকতে পারবে। শুনে তানিয়া মৃদু হেসে বলে ঢাকায় এখন অনেক ভাল চিকিৎসা হয়। আমি অবশ্যই নিয়ম মেনে চলব। তানিয়ার বুকের ভেতরে ঝড় উঠে।

    এমন আকুলতা কারো মাঝে দেখতে পাবে আশা ছিল না। শেষ কটা দিন ইমতিয়াজ তানিয়াকে নিয়ে পুরো ব্যাংকক ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। পাতাইয়া একদিনে গিয়ে আসা যায় জেনেও তানিয়া অসুস্থতার জন্য যেতে রাজী হয়নি।

    বিষণ্ণ এক বিকেলে তানিয়া ফিরে আসে ঢাকায়। এয়ারপোর্টে শেষ বিদায়ের ক্ষণে ইমতিয়াজ নিজের ভিজিটিং কার্ড তানিয়াকে দিয়ে বলে--সময় পেলে ই-মেইল করবেন। আমি অপেক্ষায় থাকব। দেখবেন, আবার ভুলে যাবেন না যেন। তানিয়া কার্ড দেয়নি। মেইল আইডি মুখে বলে। ইমিগ্রেশন পার হবার পর তার ভেতরে কিসের যেন এক শূন্যতা টের পায়। বার বার ইমতিয়াজের মুখটি ভেসে উঠে। মনের ভেতরের মন বলে আর কি হবে দেখা/ হবে কি প্রাণের টানে, কিছু কথা/ কিছু সুর, কিছু গান, কিছু কিছু দুঃখ ব্যথা / হবে কি মালা গাঁথা?

    দেশে ফিরে নানা ব্যস্ততায় কটা দিন মেইল খোলা হয়না। শরীরটাও ভাল যাচ্ছিল না। সময় করে একদিন দেখে বেশ কয়েকটি মেইল জমে আছে ইনবক্সে। বেশিরভাগ ইমতিয়াজের। কালো মেঘের ফাঁকে এক ফালি সুর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল তানিয়ার সমস্ত শরীরে। প্রথম মেইলে লিখেছে--একটি মুখ বার বার আমার সামনে ভেসে উঠছে। সরি, কিছু মনে করবেন না, সেই মুখটি আপনার। ক্ষমা করবেন। আরেক জায়গায় কোটেশন দিয়েছে-- ''যখন তুমি ছিলে না, তখন ঘর ছিল খালি। আর তুমি যখন চলে গেলে ঘর হয়ে গেল শূন্য।'' ইমতিয়াজের লেখা তানিয়াকে অসহায় করে তোলে। মনের অজান্তে স্বপ্ন দেখে। বাঁচার আকুলতা তীব্র হতে থাকে। এমনি করে একদিন সব দ্বিধা, সব সংশয় ঝেড়ে তানিয়া লিখলো--''কেন নিঃশেষিত জীবনে, দুহাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিলে/ কেন তোলপাড় তুললে দগ্ধ হৃদয়ে/ কেন যোগসুত্রহীন ভালোবাসায় টানলে এত নিবিড় করে--।" এই ভাবে ইমেইলে তাদের যোগাযোগ চলতে থাকল। যে-কথা তাঁরা সামনে বলতে পারেনি সে-কথাও নির্দ্বিধায় লিখছে। সংযত, পরিমিত ভাষাও মাঝে মাঝে এলোমেলো হয়ে যায়।

    কত দূরে! যোজন যোজন মাইল দূরে থাকে একজন আরেকজন থেকে। সেইতো মাত্র কটা দিন, ঘন্টার হিসাবে হয়ত বেশি কিন্তু প্রতিটি মুহর্ত কেটেছিল অসম্ভব ভালো লাগায়। তানিয়া লিখে--আর কি হবে দেখা, হবে কি প্রাণের কিছু কথা? ইমতিয়াজ লিখত--নিশ্চয় হবে দেখা। একাকী নির্জনে হবে অনেক কথা। তানিয়ার সাহসী মন বলে উঠত--সেই নির্জনে, ইমতিয়াজের বুকে মুখ লুকিয়ে গভীর নিশ্বাসে অনেক্ষণ হৃদয়ের উষ্ণতা নেবে। ইমতিয়াজ দুষ্টুমি করে প্রতি উত্তরে লিখত--সাগরের উত্তাল ঢেউ উঠলে আমি কিন্তু শান্ত থাকতে পারব না। কিশোরীর লজ্জায় রক্তিম হতো তানিয়া। গোধুলিবেলার প্রেম। নিজেকে সংযত রাখা সময় শিখিয়ে দেয়। তারপরও মনে হত ভালোবাসার কোনো বয়স নেই। আবেগ, অনুভূতি, আকুলতার কোনো পরিবর্তন নেই। মনের কি তা হলে বয়স বাড়ে না? তানিয়া এই রকম চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ করে মনের সাথে।

    এই রকম করে কেউ তাঁর জন্য এত আন্তরিকতা দেখাবে, সময় নষ্ট করে সময় দেবে—তানিয়া ভাবতেও পারেনি। তানিয়া নিজেই নিজ দায়িত্বে চলবে এই রকম প্রস্তুতি নিয়েই সবসময় চলে। তানিয়া প্রথমে ভেবেছিল, বেলার পরিচিত বলে হয়ত এতটা করেছেন । পরে ধরে নেন এটা তাঁর স্বভাবসুলভ আচরণ হয়ত। তিনি এইরকম সবার জন্যই করে থাকেন। ইমতিয়াজের কথা ভেবে ভেবে শরীর আর মনের সাথে যুদ্ধ করে দিন মাস বছর কেটে যায় তানিয়ার।

    তানিয়া একাই যায় বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে। তাদের কথা শুনে, নিয়ম শুনে, মানবে বলে আশ্বাস দেয়। ওষুধ লিখে দিলে তানিয়া অযথা বলে তা কেনে না। শুধু কষ্টের ওষুধটা কেনে, কিছুটা লাঘব হবার জন্য। ব্যাংকক থেকে ফেরার পর তানিয়া লক্ষ্য করেছে তার যে দিকটার ক্ষত শুকিয়ে গিয়েছিল সেটাও জেগে উঠেছে, শরীরের অন্যান্য যন্ত্রণার সাথে হৃদয়ের যন্ত্রণাও যোগ হয়েছে। ব্যাংককের স্মৃতিময় সময়গুলোর কথা মনে হলেইমতিয়াজের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে মনটা। খুব সাহসী মন বলে ওঠে শেষ সময়টা ওখানেই কাটাতে। কারো হাতের একটু ভালোবাসার ছোঁয়া, একটু সেবা, একটু আদর যদি পাওয়া যায় মন্দ কি, পৃথিবী থেকে খালি হাতে তো ফিরতে হলো না। তানিয়ার চোখ ভিজে ওঠে। কপোল বেয়ে উষ্ণ নোনা জল গড়ায় চিবুকে।

    নিয়মভঙ্গের অনিয়মে খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসে সময়। আজকাল কোনো কাজে ঠিকমত মন বসাতে পারছে না। মেইলে বসাও হয় না। অসুস্থতার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। ইমতিয়াজ এস্‌এম্‌এস্‌ দেয়, তানিয়ার শক্তিতে কুলোয় না উত্তর লিখতে। ফোন করে তানিয়া তখন শারীরিক কষ্টের সাথে লড়ছে। ফোন ধরার শক্তিও নিতে পারছে না। তানিয়ার কোনো খোঁজখবর না পেয়ে ইমতিয়াজ অস্থির হয়ে উঠে। বেলাকে দিয়ে খবর নিয়ে জানতে পারেন তানিয়া হাসপাতালে। খুব খুব অসুস্থ। এত দ্রুত সব শেষ হবে ইমতিয়াজ ভাবতেও পারেননি। নিয়ম মেনে চললে, আর ঠিকমত ওষুধ খেলে আরো কয়েক বছর সুস্থ থাকতে পারবে--ডাক্তার বার বার বলেছিলেন। লিভারের অসুস্থতা নিয়ে অনেকেই ভাল আছে। তানিয়ার সমস্যাও তেমন জটিল ছিল না।

    ইমতিয়াজের মনে পড়ে, এয়ারপোর্টে প্রথম দেখে বেলার কাছ থেকে শুনার সাথে তানিয়াকে মিলাতে পারেনি। দেখতে টিন এজ, সুন্দর, হাসিখুশি চমৎকার একজন মানুষ। কখন নারী বা মেয়েমানুষ মনে হয়নি। ইমতিয়াজ জানে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান ভাল নয়, সে তাঁর আত্মীয়স্বজনদের এবং প্রতিদিনের পত্রিকা পড়ে জানতে পারে। তাই কিছুটা দুর্বল অসহায় মনে করেছিল তানিয়াকে। তার উপর একা আসা। বিদেশে একা একজন বাংলাদেশী নারী? আসছে চিকিৎসার জন্য, ইমতিয়াজ তাই সব কাজকর্ম থেকে ছুটি নিয়ে রেখেছিল সর্বক্ষণ সময় দেবে বলে। চমৎকার লেগেছে, শিক্ষিত, আত্মসচেতন, স্বাধীনচেতা, ব্যক্তিত্বপূর্ণ তানিয়া কে।

    মনে পড়ে, সমস্ত রিপোর্ট দেখে ডাক্তার গম্ভীর মুখে যখন বললেন, নিয়ম মেনে না চললে, দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। শুনে ইমতিয়াজের খুব খারাপ লেগেছিল। সেই মূহুর্তে তানিয়ার চোখের দিকে তাকাতে পারেননি--যন্ত্র্ণায় নীল হয়ে গিয়েছিল। এর পর মানসিক সাপোর্ট দেবার জন্য হাজার মাইল দূরে থেকেও, ইমতিয়াজ একটি নিরাপদ সম্পর্কে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল তানিয়াকে। নিঃসঙ্গ জীবনে এতটুকু প্রাণের ছোঁয়ায় উজ্জীবিত রাখতে চেয়েছিল। পড়ন্ত বিকেলের উত্তাপহীন আলোয় আলোকিত করতে চেয়েছিল। প্রকৃতির কাছে হেরে যাওয়া ইমতিয়াজ, আজ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। প্লেন থেকে নেমেই ইমতিয়াজ হাসপাতালে ছুটে গেল।

    শুভ্র ফেনিল বিছানায় শায়িত তানিয়া। যেন একরাশ সাদা ফুলের মাঝে ফুটন্ত গোলাপ। সমস্ত যন্ত্রণা ছাপিয়ে শিশুর সরলতা কোমল মুখখানিতে। ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অসময় বলে তেমন কাছের কেউ নেই এখন। নির্জন কেবিনে তাঁরা দুজন। একজন পৃথিবীর সকল হিসেব নিকেষ গুছিয়ে আপন ও আপনাকে ছেড়ে স্থায়ী হবার যাত্রাপথে, আরেকজন জীবন ও জীবনবোধের যন্ত্রণায় দগ্ধ, নিঃশেষিত। ইমতিয়াজ তানিয়ার বিছানার পাশে গিয়ে বসল সকল সংশয়, দ্বিধা উপেক্ষা করে আলতো করে তানিয়ার মুখটি তুলে নিজের বুকের কাছে নিল। পরম মমতায় মাথায় হাত রাখলো, কপালে আলতো করে চুমু খেল। মনে হলো ফর্সা মুখটিতে গোলাপী আভা ছড়িয়ে পড়ল। এমনি সময় তানিয়ার নিথর বাম হাতটি এসে পড়ল ইমতিয়াজের কোলে। স্তব্ধ ইমতিয়াজ বাক্‌রুদ্ধ হয়ে বসে থাকলো একটি নারীর অসম্পূর্ণ ভালোবাসাকে কোলে নিয়ে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)