আপনি কি মনে করেন না যে এই মানসিক রোগী মেয়েদের হোম-এ যে ঘটনাটা ঘটেছে তা চূড়ান্ত অমানবিক?
প্রশ্ন নয়—একেবারে সোজাসুজি আক্রমণ। লতিকা সেন দুচোখে অস্বস্তি নিয়ে সামনে বসা মেয়েটির দিকে তাকালেন। অত্যন্ত সপ্রতিভ এবং চটপটে মেয়েটি হাসিমুখে লতিকা সেনের দিকে তাকিয়ে আছে। কতই বা বয়েস মেয়েটির—জোর পঁচিশ ছাব্বিশ হবে। কিন্তু যা কথার তোড়—যে কোনো পদস্থ লোককে নাকানি চোবানি খাইয়ে দিতে পারে। এসব চাকরিতে এরা যেরকম প্রশিক্ষণ পায় তাতে হাসিমুখে চাঁচাছোলা প্রশ্ন করে—এমনকি মন্ত্রীদেরও রেয়াত করে না। পাশে বসা ছেলেটি বরং শান্ত গোছের—বেশি কথা বলছে না। ওর হাতে নোটবুক আর পেন। ফটাফট কি সব টুকে নিচ্ছে।
লতিকা সাবধান ছিলেনই—এবার আরও সাবধান হলেন। বেফাঁস কিছু বলে ফেললেই সর্বনাশ। ফলাও করে সব কথা কাগজে বেরোবে—টিভিতে তাই নিয়ে আলোচনা হবে। সব থেকে ভালো হচ্ছে এ-জাতীয় প্রশ্নের কোনো উত্তর সোজাসুজি না দেওয়া। ঘুরিয়ে অন্য কথা বলতে হয়। তাহলে একটু পরেই ওই প্রশ্ন চাপা পড়ে যায়—নতুন প্রশ্ন আসে। লতিকা মুখটা রুমাল দিয়ে চেপে চেপে মুছে নিলেন—ঘষে মুখ মুছলে মুখের মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে। সামনের বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিলটাতে জলভর্তি ঢাকা-দেয়া গেলাস—তার থেকে একঢোঁক জল খেলেন। একটু সময় নেওয়া দরকার। এ-কথার জবাবে কি বলা যায় তা ভেবে নেয়ার জন্যে। সামনে বসা মেয়েটি একটু অধৈর্য হচ্ছিল। কিন্তু ওর মুখের হাসিটা সেরকমই আছে। ও আবার লতিকাকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ল—হ্যাঁ, তাহলে বলুন—এ ঘটনাটা কি চূড়ান্ত অমানবিক নয়?
লতিকা মেয়েটির চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। একবার পাশের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে, একবার ঘরের কোণে রাখা গোদা সাইজের আলমারির দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন—থেমে থেমে, যা বলতে যাচ্ছেন সে-সব কথা ভেবে ভেবে দেখুন, আমাদের এই হোমের রেকর্ড খুবই ভালো। কখনো কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসে নি। ঘটনাটা খুবই দুঃখজনক—তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটা একেবারেই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমরা তার জন্যে যা করার সবই করছি।
কিন্তু এটা কি আপনাদের একটা বিরাট প্রশাসনিক গাফিলতি নয়? মেয়েটি আবার প্রশ্ন করে—তার মুখের মৃদু হাসিটি অটুট।
লতিকা মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ালেন। আগের প্রশ্নটা চাপা পড়ে গেছে। এবার নতুনটাকেও পাশ কাটানো দরকার।
দেখুন, আমাদের সব কাজকর্মই নিয়মকানুন অনুসারে হয়—কাজেই এই গাফিলতির কথাটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারছি না। ঘটনাটার ওপর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই তদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পরই আমরা কিভাবে এই ঘটনা ঘটতে পেরেছিল তা বলতে পারব, আর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারব। আশা করি তখন আপনাদের সব কিছু বিশদ করে আমরা বলতে পারব।
আরও কিছুক্ষণ পরে ওরা চলে গেল। প্রশ্নোত্তর যে শেষ হয়েছে তা নয়। আসলে ওদের হাতে আর সময় নেই। আরও কয়েক জায়গায় ওদের দুজনকে যেতে হবে। সেখানে সময় দিতে হবে—অফিসে গিয়েও ওদের যথেষ্ট কাজ আছে। কাজেই লতিকা সেন এবারকার মতো ছাড়া পেয়ে গেলেন।
ওরা চলে যেতে লতিকা বড় একটা হাঁফ ছাড়লেন। মোটা শরীর—ঘামে ভিজে গিয়েছে। মাথার ওপর অনেক পুরনো পাখাটা ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ করে ক্লান্তভাবে অত্যন্ত অনিচ্ছায় ঘুরছে। দেয়ালের সুইচবোর্ডে পাখার রেগুলেটারের দিকে তাকালেন লতিকা। পুরোদমে করা আছে। ভোল্টেজ কম—এর চাইতে বেশি জোরে ঘুরবে না। এই হোমের বাড়িটার বাইরের দিকে বঙ্কিমের চায়ের দোকান। এতক্ষণে লতিকার দুবার চা খাওয়া হয়ে যায়। বঙ্কিমের থেকে চা নিয়ে আসে রাধা—লতিকার খাস পিওন। মেয়েটা লতিকার খুব ভক্ত। ওর মুখের একটা দিক বিকৃত—চোখের পাশ থেকে গাল, গলার এক পাশ—অ্যাসিডে পোড়া। পতিদেবতার আর একটি প্রেমিকা ছিল। একদিন ঐ নিয়ে তুমুল ঝগড়া হওয়ায় বাড়িতে ব্যবহার করার অ্যাসিড ছুঁড়ে দিয়েছিল রাধার মুখে। লোকটার অবশ্য কোনো শাস্তি হয়নি। রাধা বলেছিল বাড়ির কাজ করার সময় অতর্কিতে ওর নিজেরই হাত ফসকে অ্যাসিড ওর মুখে পড়ে গিয়েছিল। তবে ও আর বরের ঘরে যায় নি। ওর বাবা নেই। মায়ের সঙ্গে থাকে—চাকরির পয়সায় পেট চলে যায়। এমনিতে মেয়েটা লতিকার কাছে কাছেই থাকে আজ কোথায় পালিয়েছে। বোধহয় মিডিয়ার লোকজন দেখে ভয় পেয়েছে। টেবিলের ওপরে রাখা কলিং বেলের হাতলে চাপ দিলেন লতিকা। ক্যাঁ ক্যাঁ করে আওয়াজ। একবারের পর দু বার বাজালেন। রাধার টিকির দেখা নেই। অল্প বয়সে লতিকা যখন কলেজে পড়তেন, চেহারা যখন ছিপছিপে ছিল, তখন গলায় খুব সুর ছিল—বেশ গাইতে পারতেন লতিকা। এখন মিডিয়ার লোকদের হাত থেকে আপাত মুক্তির আনন্দে একটা জনপ্রিয় বাংলা গানের সুর মনে এল। কয়েকটা শব্দ পালটে মনে মনে কয়েকবার আওড়ালেন—রাধার দেখা নাই রে, রাধার দেখা নাই। তারপর টেবিলে রাখা গেলাসের জলটা পুরো শেষ করলেন।
প্রায় তিনবছর হল লতিকা এখানে পোস্টেড হয়ে আছেন। হোমের বাসিন্দা মেয়েদের ম্যানেজার মা—কর্মচারীদের লতিকাদি। হাল্কা কাজ। কর্মচারীরাই সব কিছু করে।—লতিকাকে খালি কিছু সই সাবুদ করতে হয়। স্বামীও সরকারি অফিসার। যদিও এখন চাকরি উত্তরবঙ্গে কলকাতায় বদলি হবে হবে করছে। শ্বশুরের সল্টলেকের বাড়িতে লতিকারই হুকুম চলে—আর সবাই তার বশংবদ। ছেলেকে দার্জিলিংয়ে নামী আবাসিক স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছেন। ছেলে এখন বাপের ইংরেজি কথার ভুল ধরে। চারদিকে সব সুখ—এমন সময় এই উটকো ঝামেলা। এখন কোথাকার জল যে কোথায় গড়াবে কে জানে। ওই হারামজাদা ধ্রুবটা। হাতের কাছে পেলে পায়ের জুতো খুলে ওর মুখে মারতেন লতিকা। ওপরে ওপরে শান্তশিষ্ট ব্যবহার—কে জানত পেটে পেটে এত বদমায়েসি।
লতিকা টেবিলের ওপরে রাখা ফোন তুললেন। স্বামীর সঙ্গে কথা বলার দরকার। এসব কাজের জন্যে নিজস্ব মোবাইল ব্যবহার করলে মোবাইলের খরচা বাড়ে। স্বামীকে আজকের ঘটনা—মিডিয়ার আসা—সব জানালেন। যদিও বাড়িতে লতিকাই কর্ত্রী—অফিসের কাজে সব সময়েই স্বামীর পরামর্শ নিয়ে থাকেন লতিকা। নির্দেশ এল—যতটা সম্ভব মুখ বন্ধ রাখবে—কথা বিশেষ বলবে না। ঘটনাটা কোন দিকে গড়ায় তা আরও কিছুদিন ওয়াচ করো।
টেবিলের সোজাসুজি ঘরের দেয়ালে লাগানো ঘড়ির দিকে লতিকার চোখ পড়ল। তিনটে সাঁইত্রিশ। টেবিলের ওপর রাখা ব্যাগটা তুলে নিয়ে উঠে পড়লেন লতিকা। বাড়ি পৌঁছতে লাগবে পাকা এক ঘন্টা। যদি আবার মিডিয়ার শুভাগমন হয় তাহলে কর্মচারীরা সামাল দেবে। বলবে, লতিকাদি কলকাতায় মিটিংয়ে গেছেন।
হাতের ঘড়ি দেখল ধ্রুব। আটটা বাজে। বাসটা আসে আটটা চল্লিশ নাগাদ। হোমে গিয়ে পৌঁছতে পাক্কা সোয়া ঘন্টা। মদনের ডিউটি দশটায় শেষ। পৌঁছতে দশটার বেশি দেরি হলেই ও ঝামেলা করতে থাকে—চাবি হ্যাণ্ডওভার করার সময় মুখ খিস্তি করে। রোববার জামাটামা পরে ফেলেছে ধ্রুব—এখন খালি ভাত খেয়ে পায়ে স্যাণ্ডেল গলিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। বউদি এদিক ওদিক ঘুরছে—ধ্রুবকে ভাত বেড়ে দেবার কোনো লক্ষণই দেখাচ্ছে না। ধ্রুব বলে ফেলল—বউদি, ভাত দিয়ে দাও। সাড়ে আটটার বাসটা না ধরতে পারলে সময়মতো হোমে পৌঁছতে পারব না।
বউদি খ্যার খ্যার করে উঠল, দাঁড়াও বাপু—ভাত এখনও হয়নি।
ওর বউদি মালতীর রোগা, সিঁটকে চেহারা। যদিও বয়েস পঁয়তিরিশ ছাড়ায় নি এখনই বেশ বুড়ি বুড়ি দেখায়। স্বভাবটাও খিটকেল বুড়িদের মতো। ধ্রুবর সঙ্গে তো একাবারেই বনিবনা নেই। দাদাটা সাইকেল রিকশা চালায়—সাড়ে আটটার আগে বাড়ি আসে না। ধ্রুব ব্যাপারটা বোঝে। বর এলে তাকে গরম ভাত দিতে হবে—সেজন্যে দেরি। অথচ এ-বাড়ি যে চলে তার বড়ো খরচাটাই ধ্রুব দেয়। ওর বউদি তিনটে বাড়িতে ঠিকে কাজ করে আর ওর দাদা সাইকেল রিকশা চালিয়ে যা রোজগার করে ধ্রুব একাই তার থেকে বেশি মাইনে পায়। নেহাৎ কপালজোরে এই সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিটা পেয়ে গেছিল ধ্রুব। আজকাল তো বিএ এমএ পাশ করেও সব ছেলে এসব চাকরি পাওয়ার জন্যে মাথা ঠুকছে। অবশ্য পঞ্চায়েতের গোরাদা সাহায্য করেছিল। নইলে এক একটা চাকরি পাবার জন্যে তিরিশ চল্লিশ হাজার করে এর ওর তার হাতে দিতে হয়। ধ্রুবকে টাকা দিতে হলে ওর আর চাকরি করা হোত না। ও টাকা পেত কোথা থেকে?
ও একটু বেশি টাকা পায় বলে বউদি মাঝে মাঝেই এটা ওটা সেটা ছুতো করে ওর থেকে টাকা নেয়। এমনিতে তো ধ্রুবর অর্ধেকের কমই দেওয়ার কথা। ওরা তিনজন—বাপ, মা আর বছর আটের একটা ছেলে। এদিকে ধ্রুব আর তার মা মোটে তো দুজন। তবুও বউদি বেশি বেশি চায়। ধ্রুব ঝামেলা বাড়ায় না—বেশিরভাগ সময়ই দিয়ে দেয়।
বাড়িতে দুটো ছোট্ট ছোট্ট ঘর—এসবেস্টসের চাল দেওয়া। একটাতে দাদা, বৌদি আর তাদের ছেলে। অন্যটা ধ্রুব আর তার মার ব্যবহারের জন্য। ঘরে দুটো সরু সরু তক্তপোষের ওপর বিছানা। একটাতে ওর মা পাকাপাকিভাবে শোয়া। হাত পা নাড়তে পারে না। ওর মার এই অবস্থা হয়েছে এই বছরখানেক হোল। তার আগে দিব্যি সুস্থ শক্তপোক্ত ছিল। দু বাড়িতে রান্নার কাজ করত—কামাই ভালই ছিল। ধ্রুবর নাইট ডিউটিই থাকে বেশিরভাগ সময়—ও ডিউটি সেরে ফিরে এসে ঘুমোচ্ছিল। মা গেছে কাজের বাড়িতে—ফিরে এসে ডেকে দেবে। ও উঠে চান করে খাবে। ওর ঘুম ভাঙল তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে—দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। ও একটু অবাক হয়ে গেল। কৈ—মা আজকে ডেকে দেয়নি তো। তক্তপোষ থেকে নামতে গিয়েই চোখে পড়ল, মা মাটিতে সটান পড়ে আছে। দু চোখ বন্ধ—মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে।
দাদা প্রায়ই দুপুরবেলা ফেরে না। বৌদিও বাড়ি নেই—গেছে তার কাজের বাড়িতে। কাছাকাছি দু একজন ডাক্তার আছে—কিন্তু এসময়টাতে তাদের চেম্বার বন্ধ থাকে। পাড়ার বন্ধুদের ডাকল ধ্রুব। পল্টু, মনা আর বাদলা। মাকে সাইকেল রিকশায় বসানো যাবে না। ভ্যান রিকশা ডেকে তার পাটাতনে শুইয়ে নিয়ে গেল হাসপাতালে।
প্রথমে যে ডাক্তার দেখলেন তিনি অত্যন্ত স্বল্পভাষী, মৌনি নিয়েছেন বললেও হয়। ধ্রুবর কোনো কথারই তিনি কোনো জবাব দিলেন না। কপাল আর নাক কুঁচকে তিনি দু আঙুলে ওর মার চোখের পাতা খুলে টর্চের আলো ফেলে দেখলেন। তারপর হাসপাতালের ছাপানো কাগজে কি সব লিখে দিয়ে ধ্রুবর হাতে দিলেন।
মাকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বেশ কিছু পকেট হাল্কা হোল ধ্রুবর। চারদিকে হাত পাতা রয়েছে। সে সব হাতে কিছু না দিলে কাজ এগোয় না। মাকে ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়ে বেডে শোয়াবার পর যে নার্স ডিউটিতে ছিলেন ধ্রুবর প্রশ্নের উত্তরে তিনিই বোমাটা ফাটালেন। বললেন—এ তো বিষ খেয়েছে। এই যে ডাক্তারবাবু লিখে দিয়েছেন—অজানা কোন বিষক্রিয়ার ফল। আপনি ওনার ছেলে? আপনি থাকবেন এখানে। পুলিস আসবে—আপনাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করবে।
রাতটা ধ্রুব হাসপাতালেই রইল। মাঝে মাঝে ওয়ার্ডে যাচ্ছে। রাউণ্ডে থাকা ডাক্তারবাবু ওষুধ লিখছেন—ওয়ার্ডের নার্স সেই কাগজ হাতে ধরাচ্ছেন। তখন ছোট রাতদিন খোলা এরকম ওষুধের দোকানে—ওষুধ এনে নার্সের হাতে দাও। সকালবেলা বড় ডাক্তার এলেন। তিনি দেখে বললেন বিষ তো খায়নি—এর স্ট্রোক হয়েছে।
বোঝ কাণ্ড। হয়েছে স্ট্রোক আর চিকিৎসা চলছে শরীর থেকে বিষ তাড়ানোর। মাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হল অন্য ওয়ার্ডে। সেখানে নতুন করে চিকিৎসা। কিন্তু আসল চিকিৎসা শুরু করতে তো দেরি হয়ে গিয়েছে। মা বাঁচল ঠিকই—কিন্তু হাত পা অসাড় হয়ে গেল।
নাঃ, দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই বৌদি মহিলাটি তার বর ফিরে না এলে ভাত চাপাবে না। অতি খচ্চর মহিলা। মায়ের বিছানাতে বেডপ্যান লাগিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল ধ্রুব। এই বেডপ্যানটা দিতে ভুলে গেলে কেলেঙ্কারি। মা সব বিছানাপত্র নোংরা করে রাখবে। সেই হাসিখুশি মোটাসোটা ধ্রুবর মা—এখন শুকিয়ে একেবারে প্যাঁকাটি হয়ে গেছে। আর বেশিদিন টিঁকবে বলে মনে হয় না। আবার মা মরে গেলেও বিপদ। দাদা বৌদি তাদের ছেলেটা আর ঘরের যত কাচড়া জিনিসপত্র ধ্রুবর ঘরে ঠেলে দেবে। এখন ছেলে ঘুমিয়ে পড়লে তবে দুজনে শরীরের কাজকর্ম করে—তখন আর সেই অসুবিধেটা থাকবে না। অবশ্য ছেলেটা অতি বখা। এ বয়েসের মধ্যেই পাড়ার শয়তান ছেলেগুলোর সঙ্গে মিশে সব কিছু শিখে গেছে। ইস্কুলে ইচ্ছেমত যায়—কামাই করে। ক্লাস ওয়ানেই দুবার ফেল মেরেছে। তবুও—যতই বখা হোক—নিজের ছেলে প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে থাকলে তো আর এসব করা যায় না। কাজেই ছেলেকে ঠেলে দাও ঠাকুমার খালি হয়ে যাওয়া জায়গাটায়। বৌদি হেসে হেসে বলবে—দ্যাখো, পুরো ঘরটা তো তোমার ব্যবহার করতে লাগছে না। তখন হবে এক ঝামেলা।
বাস স্টপের আগে অখিলের চায়ের দোকান। ওখানে খেয়ে নিল ধ্রুব। আধ গেলাস চা—আর চারটে বড় বড় মোটা মোটা পিস উনুনে সেঁকা পাঁউরুটি। ওপরে মোটা করে লাগানো মাখন আর ঘন করে ছড়ানো বড় দানার চিনি। যদিও ভাতের খিদে গেল না, কিছু তো পেটে পড়ল।
আজ বাসটা দেরি করে এসেছে। ধ্রুব যখন হোমের গেটে পৌঁছল তখন সোয়া দশটা বাজে। মদনের মুখখারাবি শুনতে হল। সাল্লা হারামি—রোজ লেট করে আসবে। বাড়িতে তো বউ নেই—কাকে নিয়ে শুয়েছিলি?
ধ্রুব কথা বলে না। মদনের সঙ্গে ঝামেলা করলে বিপদ আছে। ওর ভালরকম লাইন আছে ওপর মহলে। ওর কি একটা কাকা না মামা একজন নেতা গোছের লোক। তাছাড়া দোষটা তো ধ্রুবরই। দশটার মধ্যে ওর আসার কথা। ওই তো আসতে দেরি করেছে।
হাজিরাখাতায় চট করে সই মেরে এসে চাবি নেয় ধ্রুব। মদন বেরিয়ে গিয়ে রাস্তা ধরে প্রায় দৌড় মারে নিজের বাড়ির দিকে। ওর বাড়ি কাছেই। হাঁটা রাস্তা। বাড়িতে বৌ বসে আছে রাতের খাবার নিয়ে। বৌটাকে দেখেছে ধ্রুব। একবার মদন অসুখ করে প্রায় দিন পনেরো কাজে আসেনি। ধ্রুব ডবল ডিউটি দিচ্ছিল। একদিন অফিসের আরও তিন চারজনের সঙ্গে ওর বাড়ি গিয়েছিল ওকে দেখতে। মদনের বৌ ওদের সবাইকে চা দিয়েছিল। কাপে চা নিয়ে একটা করে প্লেট। সবাই আড়ে আড়ে দেখছিল বৌটাকে। চোখ টানবার মতো চেহারা। একবার দেখলে আবার দেখতে ইচ্ছে হয়। মদনটার কপাল ভাল।
গেটে ভেতর থেকে তালাচাবি লাগায় ধ্রুব। হোমের বাড়িটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাড়িটা আর বাইরের পাঁচিলের মাঝখানে অনেকটা জমি। ধ্রুব বাড়িটার চারপাশে চক্কর লাগায়—মাটিতে লাঠি ঠুকে ঠুকে। আর মাঝে মাঝে হুইসিল ফোঁকে। গেটের ঠিক ভেতরে ওয়াচম্যানের ঘর—ছোট্ট এবং বেঁটে উচ্চতার দেওয়ালে লাগানো সিমেন্টের বেঞ্চি। খানিক্ষণ চক্কর লাগিয়ে হাঁপিয়ে গেলে এখানে বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেয় ধ্রুব। তবে রাত একটার পর আর চক্কর দেয় না—তখন এই ঘরে বসেই একটু ঘুমিয়ে নেয়। এই চাকরিতে এসে বসে বসে ঘুমোবার অভ্যেসটা রপ্ত করে ফেলেছে। তবে চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ নিজে থেকেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। তখন আবার মাঝে মাঝে চক্কর। ছটার সময় নতুন লোকের ডিউটি। ধ্রুব অফিসের বাথরুমে সকালের বেগ টেগ সেরে নেয়—তারপর বাড়ি যায়। বর্ষাকালটায় অবশ্য একটু অসুবিধে। বাড়িটার চারপাশের জমি বিষ্টিতে ভিজে কাদা হয়ে থাকে। অফিস থেকে একজোড়া গামবুট পায় ধ্রুব। আর একটা ছাতা। ওগুলো তখন খুব কাজে লাগে। গামবুট ও অফিসেই রেখে দেয়। তবে ছাতাটা বাড়ি নিয়ে যায়। অন্য কোনো ছাতা তো বাড়িতে নেই।
হোমের বাড়িটার একতলাতে অফিস—বাসিন্দা মেয়েরা থাকে দোতলায়। এমনিতে দোতলার থেকে নানারকম আওয়াজ আসে। বেসুরো গান, চেঁচিয়ে বা বিলাপ করে কান্না, খিলখিল করে হাসি। কিন্তু এই রাতের দিকে সব চুপচাপ। মেয়েদের যারা দেখাশোনা করে সেসব আয়ারা পালা করে ঘুমোয়—তাদের ঘুম চটে গেলে তারা মেয়েদের ওপর দু হাতের যথেচ্ছ ব্যবহার করে। মেয়েদের মাথা খারাপ হলেও এটা তারা বুঝে গেছে যে আলো নিভলে পর মুখে আওয়াজ করা চলবে না।
বাড়িটার পেছনদিকের দোতলায় টানা বারান্দা। কিন্তু বারান্দার রেলিং-এর ওপর থেকে ওপরের দেয়াল পর্যন্ত জাল দিয়ে ঢাকা। মানসিক রোগী মেয়েরা যাতে বারান্দা থেকে নিচে লাফিয়ে না পড়তে পারে। তবে জাল লাগানো হয়েছিল বহু বছর আগে—এই হোম যখন চালু হয়েছিল তখন। এখন এই জালের অনেক জায়গায় বড় করে ছিঁড়ে গেছে—বাসিন্দা মেয়েরা সেইসব জায়গায় জাল আরও টেনেছে বা ঠেলেছে। জাল দুমড়ে গিয়ে বড় বড় ফাঁক হয়েছে—প্রায় জানালার আধখোলা পাল্লার মতো মাপের। ধ্রুব কয়েকবার রাউণ্ড লাগাল। তারপর দোতলার জালের একটা খোলা জায়গার নিচে এসে দাঁড়াল। হাতের লাঠি মাটিতে কয়েকবার ঠুকে আওয়াজ করল।
দোতলার বারান্দার জালের ফোকরে যে মুখটা উঁকি দিল সেটা দেখে একটু নিরাশ হল ধ্রুব। মেয়েদের থাকার জায়গা বলে বাড়িটার বিভিন্ন জায়গায় আলো লাগানো আছে। এ জায়গাটাতেও আবছা আবছা আলো আসে—রাতেও দেখতে বিশেষ অসুবিধে হয় না। ওপর থেকে গঙ্গা বলল, হেই ধ্রুব, একটু দাঁড়িয়ে যা এখানে। আমি নিচে নেমে আসছি।
গঙ্গা এই হোমের চাকুরে আয়াদের একজন। ওর বাপ মা হিন্দুস্থানী। কিন্তু ও একদম বাচ্চা বয়েস থেকে এখানে আছে বলে পরিষ্কার বাংলা বলে—তবে মাঝে মাঝে হিন্দুস্থানী টান আসে ওর কথায়। ও বয়েসে ধ্রুবর থেকে বড়োই হবে। গায়ের রঙ কালো, দশাসই চেহারা, বিশাল বুক এবং পেট। কিছুদিন আগে একটা লোকের সঙ্গে থাকত—বিয়ে ফিয়ে না করে। একদিন জোর ঝগড়া হয়েছিল দুজনের। গঙ্গা লোকটাকে প্রচণ্ড মার দেয়। লোকটা পালিয়ে যায়—আর ওকে এ তল্লাটে দেখা যায় নি। তার পর থেকেই গঙ্গা ধ্রুবর পেছনে পড়ে গেছে। প্রেমের রং ঢং দেখাচ্ছে। ধ্রুবও একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিল ওর ওপর—মাস দুই আগে ওর সঙ্গে একটা সিনেমা গিয়েছিল। সেই থেকে গঙ্গা ওকে চাপ দিচ্ছে বিয়ে করে নেয়ার জন্যে। কিন্তু ধ্রুব নানা বাহানায় ওকে কাটাচ্ছে। ঘরে মা খুব অসুস্থ, এই ছুতো দিচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে ভাবে—মা চলে যাবার পর কি করবে। গঙ্গাকে বৌ করে ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলেছে, ভাবতেই ধ্রুবর মজা লাগে। রোগা, সিঁটকে, খ্যারখ্যারে স্বভাবের বউদি আর ওর সাইকেল রিকশা চালানো মিটমিটে শয়তান দাদা। গঙ্গা ওদের এক হাতে পিটিয়ে সোজা করে দেবে। চাই কি বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দিতে পারে। গঙ্গা হোমে চাকরি করা মেয়েছেলে। ধ্রুবর দাদা বউদি ওর কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু ধ্রুব? গঙ্গা কি ধ্রুবকে পেয়ার করে খাতিরযত্ন করবে? করলেও তা কতদিন? একটু পুরোনো হয়ে গেলেই ধ্রুবকেও কি পিটবে না গঙ্গা?
নিচে নেমে ধ্রুবর কাছে এসে দাঁড়াল গঙ্গা। ওর হাতে একটা তালা আর তাতে লাগানো চাবি। দোতলায় উঠবার দরজার তালা। দোতলার আয়াদের হাতেই এই তালার চাবি থাকে। লতিকা সেনের বিশেষ অনুমতি ছাড়া পুরুষ মানুষের দোতলায় ওঠা বারণ। গঙ্গা ধ্রুবর বড় বেশি কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ধ্রুব অস্বস্তি অনুভব করল—এক পা পেছনে সরে গেলে।
গলার ভেতরে হাসল গঙ্গা। তুই বড্ড ডরপোক। একটু থেমে আবার বলল—ম্যারেজ রেজিস্টারের ঠিকানা জোগাড় করেছি। প্রভাস দাস। এই রাস্তার ওপরেই বাড়ি। সাইকেল রিকশায় এখান থেকে দশ মিনিট। চল্ না, এই শনিবারে গিয়ে বিয়ের লুটিস দিয়ে আসি।
আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর গঙ্গা—মিনমিন করে ধ্রুব। মা এখন হাত পা নাড়তে পারে না। তুই ওই ঘরে গেলে তোরই কষ্ট হবে।
আবারও হাসল গঙ্গা। একটু এগিয়ে এসে ধ্রুবর শরীরে একবার নিজের শরীর ঠেকিয়ে দিল। তুই একটা বুড়বাক্। তোর মা কবে মরবে তার নেই ঠিক—আর তুই নিজের জওয়ানি বরবাদ করছিস। বলছি আমার সঙ্গে সিনেমা চল্ তাও যাচ্ছিস না।
ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়াল গঙ্গা। বলল, আসি এবার ওপরে যাই। দোতলার দরজা খোলা আছে। কোন মরদ যদি এই ফাঁকে ওপরে উঠে যায় তাহলে আমার নোকরি খতম হয়ে যাবে।
আলো অন্ধকারে মিলিয়ে গেল গঙ্গার কালো শরীর। ধ্রুব হুইসিলে একটা ফুঁ দিল। তারপর আবার লাঠি ঠুকে ঠুকে হাঁটতে লাগল।
দারোয়ানের বেঁটে ঘরের সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল ধ্রুব। অনেকবার চক্কর দিয়েছে—এখন একটু বসা দরকার। তাছাড়া এই নিশুতি রাতের শুনশান, গম্ভীর রূপটাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে ধ্রুব। বারোটা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত রাতগুলোর চেহারা একরকম। সামনের রাস্তা থেকে আওয়াজ আসে—মাতাল পথচারীদের সশব্দে কথা বলার আওয়াজ, বেশি রাতের সওয়ারি নিয়ে দ্রুত সাইকেল রিকশার পেডাল চালানো রিকশাওয়ালার অসহিষ্ণু হর্নের প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ। এপাশ ওপাশের বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার আওয়াজ আসে—দু-এক সময় আসে তীব্র রাগে বাসন মেঝেতে ছুঁড়ে মারার ঝন্ঝন্ শব্দ।
কিন্তু ওই সময়টার পর আস্তে আস্তে রাতের চেহারা বদলায়। রাস্তা নিঝুম হয়—প্রতিবেশি দম্পতির ঝগড়ার শেষ হয় তাদের রতিক্রিয়ায় এবং তারপরে শান্তির গভীর ঘুমে—দূরে ট্রেনলাইন থেকে বারোটা সাতচল্লিশের শেষ লোকাল ট্রেন চলে যাবার ধাতব এবং যান্ত্রিক খটাখট শব্দ ক্ষীণ হয়ে ধ্রুবর এই রাত পাহারার ঘরে পৌঁছয়, তারপর তাও মিলিয়ে যায়। বর্ষাকাল না হলে নির্মেঘ আকাশে তারারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, শুক্লপক্ষের চাঁদ ডুবে যায়, কৃষ্ণপক্ষে। সে দূরের একটা কোন থেকে ছোট করে মুখ বাড়ায়। গরমকালে এই সময় হাওয়া উঠতে শুরু করে—কখনো সে জোরালো, কখনো খুব মোলায়েম। গাছের নিচে সব ঝরে পড়া পাতাগুলো সে খেলায় সাড়া দেয়—এদিক ওদিক উড়ে ছড়িয়ে পড়ে—সিরসির সরসর করে আওয়াজ হতে থাকে, ধ্রুব এসব দেখে, শোনে, তারপর ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু অভ্যেসমতো ওর চটকা আবার ভেঙে যায়। ও উঠে টহল দিতে বেরোয়। ওর একহাতে লাঠি, একহাতে টর্চ—জামার পকেটে হুইসিল।
বিশ্রামের পর আবার চক্কর মারতে বেরোবার জন্যে উঠবে উঠবে করছিল ধ্রুব। পায়ের শব্দ শুনতে পেল। চামড়ার চপ্পল দিয়ে নরম ঘাস মাড়ানোর মুচমুচে হিস হিস শব্দ। অফিসবাড়ির দিক থেকে আসছে। এটা অমূল্য। ও মাঝে মাঝেই এরকম রাত করে বাড়ি যায়। যেদিন এত দেরি করে সেদিন বঙ্কিমের সঙ্গে ভাগ যোগ করে ডাল ভাত খেয়ে নেয়। বঙ্কিম ওর চায়ের দোকানের ঝাঁপ ফেলে ওর রোগা ডিগডিগে বৌটার সঙ্গে বিছানা পাতবার তোড়জোড় শুরু করলে অমূল্য উঠে পড়ে। বাড়ি যাবার পথে ধ্রুবর সঙ্গে একটু আড্ডা দিয়ে যায়। ওর বাড়ি কাছেই—হাঁটা রাস্তা। বিয়ে করে নি—কাজেই রাত করে বাড়ি ফিরলে হাঙ্গামা করার কেউ নেই।
ধ্রুবর পাশে বেঞ্চিতে বসল অমূল্য। একটা বিড়ি ধরাল আর একটা ধরিয়ে ধ্রুবকে দিল। সেটা নিয়ে বেশ কয়েকটা টান দিল ধ্রুব। আঃ—এই সময়টায় বিড়িটার খুব দরকার ছিল। তারপর অমূল্যকে জিজ্ঞেস করল—অফিসে কি করছিলি এতক্ষণ?
অমূল্য তক্ষুনি কোনো উত্তর দিল না। নিজের বিড়িটায় কয়েকটা লম্বা লম্বা টান মারল—তারপর সেটাকে মেঝেয় ফেলে চপ্পল দিয়ে ঘষে নেভাল। ধ্রুবর দিকে তাকাল—যেন মন ঠিক করে দিচ্ছে কথাটা বলবে কি বলবে না। দারোয়ানের ঘরের বেঁটে ছাদ থেকে ঝুলছে একটা টিমটিমে ইলেকট্রিক আলো। তাতে অমূল্যর মুখের একটা পাশের ছায়া পড়েছে এই ঘরের ছোট্ট দেয়ালে। ওর নাকটা একটু লম্বা—দেয়ালের ছায়াতে সেটাকে আরও লম্বা দেখাচ্ছে।
ধ্রুবর দিকে ঝুঁকে এল অমূল্য। যদিও এখানে ওদের কথাবার্তা শোনার কেউ ধারেকাছে নেই, ও গলা নামিয়ে বলল, হিসেবের খাতা আর ভাউচারগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। ঘাপলাটা কিভাবে হচ্ছে সেটা বার করতে হবে।
ধ্রুব আর অমূল্য একই সঙ্গে চাকরিতে ঢুকেছিল। ক্লাস এইট পাশ—চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। অমূল্য পেয়েছিল অফিসে পিওনের কাজ। ধ্রুব ওয়াচম্যান। ধ্রুবর আর পড়াশোনা হয়নি। কিন্তু অমূল্যর এলেম আছে। প্রথমে মাধ্যমিক পাশ করল—তারপর উচ্চ মাধ্যমিক। এখন প্রাউভেটে বি কমে ঘষছে। এতদিন ধরেও বড়বাবুর কাছে কাছে ঘুরেছে—অফিসের হিসেবপত্র ও মোটামুটি বোঝে। কিছুদিন হয় এই হোমে একটা কেলেঙ্কারি শুরু হয়েছে। অমূল্য চুপি চুপি সেটা ফাঁস করেছে ধ্রুবকে। এই হোমে মেয়েদের জন্যে যে কাপড় আসে তা মেয়েদের কাছে পৌঁছয় না। অনেক আগেই বিক্রীবাটা হয়ে যায়। মেয়েগুলো ছেঁড়া, ফুটিফাটা কাপড় পরে থাকে—তাতে মেয়েদের লজ্জা ঢাকা পড়ে না। কোনো কোনো মেয়ে আবার সেই ছেঁড়া কাপড় খুলে ফেলে একেবারে উদোম হয়ে ঘোরে। আয়ারা দেখতে পেলে চড় চাপড় লাগায়—তখন আবার সেই ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় তুলে গায়ে জড়ায়। অমূল্যটা একটু আদর্শবাদী, তায় আবার একরোখা। ওর মাথায় ঢুকেছে এই চক্রটা ও ভাঙবে। ও স্থানীয় লোক—পাড়ার ছেলেরাও ওর হাতে আছে। কিন্তু অপরাধী কে বা কারা সেটা অমূল্য ধরতে পারছে না।
আর একটা বিড়ি ধরাল অমূল্য। এবার আর ধ্রুবকে দিল না। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, বড়বাবু একটি দুর্ধর্ষ ঘাঁগ। হিসেবে কোন কিছু বোঝার উপায় নেই। বুঝলি ধ্রুব, মালগুলো ডেলিভারিই হচ্ছে না, নাকি ডেলিভারির পর হাওয়া হয়ে যাচ্ছে তাও বুঝতে পারছি না। বড়বাবু সাজানো হিসেব তৈরী করতে একেবারে ওস্তাদ।
একটু থেমে আবার বলল, তবে একদিন বেরোবে ঠিকই। অডিট যদি হিসেবের খাতা আর স্টকের খাতা একসঙ্গে ভাল করে পরীক্ষা করে তাহলে বেরোতেও পারে। আমি তো আর স্টকের খাতার নাগাল পাই না। সে তো আলাদা ডিপার্টমেন্ট। তবে অডিট যদি কিছু বার করতে পারেও, তাহলেও বড়বাবুর গায়ে আঁচ লাগবে না। ফাঁসবে কে জানিস তো? ওই লতিকাদি। মোটাসোটা, ভালমানুষ মহিলা—বারোটায় আসে, তিনটেয় চলে যায়—কিছুই তো বোঝে না। সবাই সামনে খাতা খুলে ধরে সই করিয়ে নেয়। যা-আ-আ শালা, মহিলা মরলে মরবে, আমার কি?
অমূল্য থামল। বিড়িটা শেষ করে বাড়ি যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। তখন ধ্রুব সাহস করে কথাটা জিজ্ঞেস করে ফেলল, হ্যাঁরে ওই যে একটা অল্পবয়েসী মেয়ে—খালি ফিক ফিক করে হাসে—বাঁ গালে একটা বড় কালো আঁচিল—ওর নাম কিরে?
অমূল্য অফিস স্টাফ। মেয়েদের নাম, ঠিকানা, ইতিহাস লেখা খাতা ওকে প্রায়ই নাড়াচাড়া করতে হয়। কোন মেয়ের কি নাম, কে কবে এখানে এসেছে—সব ওর জানা।
ধ্রুবর কথা শুনে অমূল্য চোখ নাচিয়ে একটা শয়তানির হাসি হাসল। ওরে শালা—তোমার নজর পড়েছে মেয়েদের ওপর। খবরদার ধ্রুব। ওদিকে নজর দিসনি। ধরা পড়লে ধনে-প্রাণে মারা যাবি।
ধ্রুব হাত নেড়ে ব্যাপারটাকে হাল্কা করে। বলে—আরে দূর, ওসব কিছু নয়। একদিন চোখে পড়েছিল। তাই তোকে নাম জিজ্ঞেস করলাম।
অমূল্য ধ্রুবর বেঁটে ঘরের হুকে ঝোলানো চাবি নিয়ে গেটের তালা খুলল। বেরোবার আগে বলল, গালে আঁচিল ছুকরিটা তো? ওর নাম বোধহয় সীমা—ঠিক মনে নেই। মাথার ভালরকম অসুখ—সিরিয়াস কেস।
অমূল্য চলে যেতে গেটে আবার তালা লাগাল ধ্রুব। ওর নাম সীমা। কিম্বা মিনু। মিনু নামটাই ভাল।
মাটিতে লাঠি ঠুকে ঠুকে টহল দিচ্ছিল ধ্রুব। আজ সন্ধেবেলা দাদা বৌদির সঙ্গে বেশ একচোট হয়ে গেছে। দাদা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছিল। প্রথমে রিকশা তুলে রেখে হাত মুখ ধুয়ে এল। তারপর ওর ঘর থেকে ধ্রুবকে ডাকল।
ধ্রুব ঢুকল ওর দাদার ঘরে। দাদা ততক্ষণে গামছা দিয়ে হাত-পা মুছে বিছানার ওপর পা তুলে আরাম করে বসেছে—সিঁটকে বৌদিও এসে তক্তপোষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ধ্রুব বুঝল ওর দাদা আর বৌদি মিলে আগে পরামর্শ করেছে—তবেই ধ্রুবকে ডেকেছে দাদা। দাদা একবার বৌদির দিকে তাকিয়ে নিল—তারপর বলল, হ্যাঁরে সংসারে আরও কিছু না দিলে তো চালানো মুশকিল হয়ে পড়ছে। তুই মাসে আরও পাঁচশো টাকা করে দে।
এ মাসে ধ্রুবর ডি এ বেড়েছে—বাংলা খবরের কাগজে আজই তা ছেপে বেরিয়েছে। দাদা নিশ্চয়ই সেটা পড়েছে—পড়ে এখন টাকা চাইছে। আহ্লাদটা দ্যাখো। ধ্রুবই বাড়তি টাকা দেবে—ওর দাদা কিছু দেবে না। আরে বাবা, তোরাও তো রিকশা ভাড়া বাড়িয়ে যাচ্ছিস, তুইই বা বাড়তি টাকা কিছু দিবি না কেন?
এই নিয়ে তর্কাতর্কি। তারপর ঝগড়া। আজ বাড়িতে খায় নি ধ্রুব। অখিলের দোকানেই চা পাঁউরুটি খেয়ে সেরেছে। ধ্রুব টাকা না দিলে কি করবে দাদা? ও যদি মাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যায় তাহলে তো দাদা আর তার রোগা বৌ অথৈ জলে পড়বে।
একটা জালের ফোকরের নিচে থেমে গেল ধ্রুব। ফোকরে একটা মুখ। এক সেকেণ্ডের জন্যে ধ্রুবর বুক ধড়াস করে উঠেছিল। গঙ্গা নয়তো? নাঃ—গঙ্গা নয়। গালে কালো আঁচিলওয়ালা একটা মুখ। সীমা। বা মিনু।
মেয়েটাকে ধ্রুব প্রথম দেখেছিল মাস ছয়েক আগে। এরকমভাবেই জালের ফোকরে মুখ লাগিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ধ্রুব দাঁড়িয়ে পড়ে মুখ তুলে তাকিয়েছিল ওপরে। চোখাচোখি হতেই ফিক করে একটা হাসি। তারপর মুখটা ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল।
একনজরে খুব চেনা চেনা লেগেছিল মুখটাকে। ঠিক ওই হাসি—ওই আঁচিল। আর কিছু নয়। চট করে কিছু মাথায় আসে নি ধ্রুবর। তারপরই খেয়াল হল। মিনুর ঠিক ওইরকম হাসি ছিল। আর গালে ছিল আঁচিল।
মিনুর বিয়েটা বেশ জাঁকজমক করে দিয়েছিল ধ্রুব। ধ্রুব দিয়েছিল বলাটাই বোধহয় ঠিক। কারণ দাদা ছোটো বোনের বিয়ের জন্যে হাজার পাঁচেক দিয়েই হাত গুটিয়েছিল। বাকিটা সবই দিয়েছিল ধ্রুব। অফিসের কো-অপারেটিভ থেকে যতটা ধার পাওয়া যায়। এদিক ওদিক বন্ধুদের থেকেও ধার। বরপক্ষের ছিল নানা আবদার। এতটা সোনা দিতে হবে—আর এত টাকা ক্যাশ। এই এই আসবাব। সবই মিটিয়েছিল ধ্রুব। বিয়ের দিন পনেরো পরে খবর এল বরের একটা মোটর সাইকেল দরকার। ঠিকেদারির কাজ—কোথায় কোথায় ঘুরতে হয়। একটা মোটর সাইকেল না হলে চলবে কি করে?
সেটা আর জোগাড় করে উঠতে পারে নি ধ্রুব। কো-অপারেটিভ থেকে ঝেড়ে মুছে ধার নেওয়া হয়ে গেছে—হাতের যা দু পাঁচ টাকা জমানো ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে। বরপক্ষের পাড়ার সূত্রে খবর চলে এল—মিনুকে মারধোর করা হচ্ছে। মাথার চুল খাটের মশারির ছত্রীতে বেঁধে দাঁড় করিয়ে রেখে মার।
দাদাকে বলেছিল ধ্রুব। কিছু একটা করার দরকার। দাদা উদাসীন, নির্বিকার। উত্তর দিয়েছিল বৌদি। বরের ঘরে গেলে প্রথম প্রথম অমন একটু হয়। সব মানিয়ে যাবে। মিনু বাড়ির গিন্নী হয়ে বসে রাজত্ব করবে।
আরও সাতদিন গেল। খবর এল মিনু আগুনে পুড়ে গেছে। ধ্রুব সেখানে পৌঁছবার আগেই বডি পুড়িয়ে শেষ। ধ্রুব থানায় ডায়েরী করতে চেয়েছিল। এ খুনের কেস—শয়তানগুলোকে জেল খাটানোর দরকার। আবার বাধা দিল সেই দাদা, আর তার বৌ। থানা, পুলিশ, কোর্ট-কাছারি—এসব ছুঁলে আঠারো নয়, ছত্রিশ ঘা। আর বরপক্ষের পয়সাকড়ি অনেক বেশি। যেখানে যা ঢালবার সেখানে তা ঢেলে ওরা ঠিক বেরিয়ে যাবে। এসব ঝামেলায় গিয়ে কোনো লাভ নেই। মিনু তো আর ফিরে আসবে না।
দাদার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল ধ্রুব। তীব্র হতাশা আর ক্ষোভ ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। কিন্তু কিছু করার নেই। বাবা বেঁচে নেই—দাদাকেই এ বাড়ির কর্তা বলে মানতে হবে। পাশের ঘরে মা মরা মেয়ের জন্যে শোক করছে—গেঙিয়ে গেঙিয়ে মড়াকান্না কাঁদছে। দোহার দিচ্ছে মাকে ঘিরে বসা পাড়ার মহিলারা। মিনু আর ফিরবে না। দুনিয়ার সব লোক চাঁদে পৌঁছে যেতে পারে—দুনিয়া শেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু মিনুকে আর পাওয়া যাবে না। সেই ছোট্ট মিনু। কি দুষ্টু ছিল। সুযোগ পেলেই ছোড়দার কাছে নানারকম বায়না করত। ছোড়দা বন্ধুদের সঙ্গে মামলেট খাবো—টাকা দে। ছোড়দা, আমাদের ইস্কুলের মিলি সালোয়ার কামিজ পরেছে—আমাকেও কিনে দে। ছোড়দা, বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা যাবো—টাকা দে। সেই মিনু। তার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। আগুন তাকে ছাই করে মিলিয়ে দিয়েছে জল মাটি আকাশের সঙ্গে। মাঝে মাঝে নিজের ওপর রাগ হয় ধ্রুবর। কি দরকার ছিল মিনুর বিয়ে দেবার? মেয়েদের বিয়ে করতেই হবে কেন? বাল বাচ্চা লেণ্ডি গেণ্ডি নিয়ে ঘর করতেই হবে এমন কি কথা আছে? আসলে ওই মা। মা একেবারে ধ্রুবর পেছনে পড়ে গিয়েছিল। সমানে ঘ্যান ঘ্যান—মিনুর বিয়ে দে। মিনুর বিয়ের খোঁজ খবর কর। মিনু যখন ছোটো তখন ওদের বাড়ির কাছে কালিমন্দিরে এক সাধু এসেছিল। মা ঐ সাধুকে মিনুর হাত দেখিয়েছিল। সাধু বলেছিল তাড়াতাড়ি বিয়ে না দিলে এ মেয়ে স্বৈরিণী হবে। যত্ত সব ভেকধারী ভণ্ড জোচ্চোর। আর সত্যিই যদি তাই হত, মিনু লাইনে নামত, কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? আজ হয়তো মিনুর বরটাই ওর কাছে যাওয়া আসা করত। টাকার জন্যে ওর বর মিনুকে খুন করেছে—উল্টে ওই লোকটাই আজ মিনুকে টাকা দিত।
মেয়েটা জালের ফোকরে মুখটা চেপে ধরে আছে। আস্তে আস্তে নিচু গলায় ডাকল, এই লোকটা—এই লোকটা।
তোমাকে বলেছি না আমাকে দাদা বলবে—একটু শাসনের সুরে বলল ধ্রুব।
মেয়েটা হাতের নখ দিয়ে জাল আঁচড়ায়। বলে, লোকটা না দাদা? দাদা না লোকটা? তারপরেই আবার ফিক করে একটু হাসি। একেবারে মিনুর হাসি—একেবারে তাই।
ফোকর থেকে মুখ একটু পেছনে সরাল মেয়েটা। গায়ের থেকে আঁচল খসিয়ে ফোকরে মেলে ধরল। বলল, দ্যাখো না, কত বড় বড় ছেঁড়া আর ফুটো। শীতকালে খুব শীত করে। আয়াদিদিদের বললে কান মুলে দেয়—গালে চড় মারে। তুমি দেবে আমাকে কাপড়?
ধ্রুব মিনুকে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিল। ওর আঠেরো বছরের জন্মদিনে। সাবালিকা হয়েছে। এবার ভোট দেবে। ওর পছন্দমত চিহ্নে বোতাম টিপবে—ডানহাতের আঙুলের নখের নিচে পড়বে ছোট্ট গোল কালির দাগ। সেই শাড়ি পরে মিনু রতনের সঙ্গে সিনেমা গিয়েছিল। রতনের বাবা মালদার পার্টি। পাড়াতে ওদের মনিহারি দোকান—ওষুধের দোকান। রমরমিয়ে চালু। রতন তখন মিনুর জন্যে ঘাড় গুঁজড়ে পড়েছিল। সিনেমা যাওয়া—রেল স্টেশনের পাশে গোপালের রেস্টুরেন্টে পর্দাঢাকা কেবিনে পাশাপাশি বসে খাওয়া। গোপালের দোকানের চিকেন কবিরাজী কাটলেট এ-তল্লাটে খুব চালু। রতন বলেছিল বিয়ে করবে। ওর বাপ চোখ রাঙিয়ে বলল, ওসব হবে না। মেয়ের বাপ নেই—এক দাদা সাইকেল রিকশার হর্ন বাজায়, আর এক দাদা লাঠি ঠোকা হুইসিল ফোঁকা দারোয়ান। ওদের বোনকে ঘরে আনা, এ বিলকুল নামঞ্জুর। তারপরও রতন কিছুদিন ঘুরঘুর করেছিল মিনুর ধারেকাছে। মায়ের ভেতর ভেতর সায় ছিল। যদি রতন আর মিনু একসঙ্গে পালিয়ে যায় তাহলে আর কি করবে রতনের পয়সাওয়ালা বাপ? ওই মেয়েকেই তো ছেলের বৌ বলে ঘরে নিতে হবে। একদিন রতন দুপুরবেলা ওদের বাড়ি এসেছিল। মিনু বাড়ি ছিল—ওর ইস্কুলে তখন গরমের ছুটি। দাদা, বউদি, ধ্রুব সবাই বাইরে। মা ওদের বাড়িতে একা রেখে কাজের বাড়ি যাচ্ছে এই ছুতোয় বেরিয়ে গিয়েছিল। রতন ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মিনুকে জড়িয়ে ধরেছিল। মিনু ওকে গালে থাপ্পড় মেরে বাড়ি থেকে বার করে দেয়। বাড়ি ফিরে ধ্রুব সব শুনেছিল মিনুর থেকে। সব কথা তো ছোড়দাকে বলা চাইই মেয়েটার। ধ্রুব হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ঠিক করেছিস। আর বাড়ি ঢুকতে দিবি না ও শালাকে।
এই দ্যাখো না-এই-এই লোকটা। আবার বলল মেয়েটা।
ধ্রুব বাস্তবে ফিরে আসে। মেয়েটা মেলে ধরেছে ওর গায়ের ছেঁড়া কাপড়—মেয়েটার আঁচলের নিচে কোনো জামা নেই। একটা অনাবৃত নারী শরীর—সেখানে ধ্রুবর চোখ পড়ল ও তাড়াতাড়ি মুখ নামিয়ে নিল।
একটু আওয়াজ করেই হেসে উঠল মেয়েটা। হে হে লোকটা লজ্জা পেয়েছে। কি মজা—কি মজা।
কিন্তু তক্ষুনি মেয়েটার মুখ ফোকর থেকে সরে গেল। ধ্রুবর মনে হল ওকে কেউ পেছন থেকে ভেতর দিকে টেনে নিল। আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চলে গিয়ে পুরো জায়গাটা অন্ধকার হয়ে গেল।
ধ্রুবর মাথায় একটা চিন্তা এল। মেয়েটাকে যে ভেতরে টেনে নিল ও নিশ্চয়ই একজন আয়া। ও যদি ধ্রুবকে নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থাকে তাহলে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্প করে অন্যান্যদের কাছে। এই নিয়ে একটা বিরাট ঘোঁট হতে পারে। তবে ধ্রুবর সঙ্গে অমূল্যর ভাব আছে। অমূল্য চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের একজন নেতা। ও নিশ্চয়ই ব্যাপারটাকে বাড়তে দেবে না। ধ্রুব একবার ভাবল অমূল্যকে ঘটনাটা বলে রাখবে। তারপরেই ও ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিল। এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার দরকার নেই। ঝামেলা যদি লাগে তখন দেখা যাবে।
দুটো কাপড় কিনে ফেলল ধ্রুব। ঠিক যে ধরনের কাপড় ওর হোমের মেয়েদের দেওয়া হয়। মিলের সাদা রঙের মোটা কাপড়—নীল পাড়। অবশ্য খুব টানাটানি করে কিনতে হয়েছে ওকে। আজকাল হাতে একটা পয়সা থাকে না। সেই মিনুর বিয়ের সময় কো-অপারেটিভ থেকে যে ধার নিয়েছিল তার কিস্তি মাইনে থেকে মাসে মাসে এখনও কাটছে। বাড়িতে মার চিকিৎসার খরচ বেড়েছে। সংসার খরচার জন্যেও কিছু বাড়তি টাকা দিতে হয়। দাদা বৌদির ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান শোনার চাইতে কিছু বেশি টাকা বৌদির হাতে ফেলে দেওয়া ভালো। তবুও ও ম্যানেজ করেছে। দু মাস ধরে একটু একটু করে বাঁচিয়ে কাপড় দুটো কিনে ফেলেছে। মেয়েটার কথা চিন্তা করলে কষ্ট হয়। মাথাটা খারাপ বলে লজ্জা ঢাকার কথাটা বলে নি—শরীরে শীত করে, সে কথা বলেছে। একেবারে ছোটো বাচ্চাদের মতো। কিরকম একটা মায়ায় জড়িয়ে গেছে ধ্রুব। হোমে তো কত পাগল মেয়েই থাকে। কিন্তু এই মেয়েটার গালে একটা আঁচিল আছে—আর আছে গালের আঁচিল পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া হাসি। এ দুটো যদি না থাকত—
আজ বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে অনেকক্ষণ। মাঝরাতের আগে আসবে বলে মনে হয় না। ধ্রুব টর্চ জ্বেলে টহল দিতে বেরোল। কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ। নতুন কেনা কাপড় দুটো যে ভাবে দোকান থেকে পেয়েছিল সেভাবেই আছে। ভাঁজ করা শাড়ি গোল করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। নিচে থেকে ওপরে ছুঁড়ে দিতে সুবিধে হবে। গত তিনদিন ধরে ধ্রুব ঘুরছে। মেয়েটা ফোকরের ধারে কাছে আসে নি। আজ আবার আলো নেই। আজ ওর আসার চান্স আরও কম।
একটু দূর থেকেই দোতলার বারান্দায় একঝলক আলো ফেলল ধ্রুব। আছে—আছে। আজ এসে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। তারপরই একটা সন্দেহ হল। সত্যিই ঐ মেয়েটা তো? নাকি অন্য কেউ? দোতলায় দু-এক সেকেণ্ডের বেশি একটানা টর্চ মারা যাবে না। কোনো আয়া দূর থেকে আলো দেখে ফেললে ঝামেলা আছে। ফোকরটার ঠিক নিচে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। ছোটো এক টুকরো চাঁদ রয়েছে আকাশে। আবছা আবছা আলো ছড়িয়ে আছে চারধারে। ওপরদিকে তাকিয়ে ভাল করে দেখল ধ্রুব। হ্যাঁ—ওই মেয়েটাই।
মেয়েটা প্রথমে কথা বলল। এই লোকটা—লোকটা। জানো, আজ আমাকে খেতে দেয় নি। আয়াদিদি দু গালে থাপ্পড় মেরেছে।
ধ্রুবর একটু খারাপ লাগল। কিন্তু ওর তো কিছু করার নেই। কেন, তোমাকে মারল কেন?—ও জিজ্ঞেস করল।
আমি পাতের পাশে মাটিতে বেড়ালের জন্যে ভাত রাখছিলাম। আয়াদিদি এসে আমাকে মারল। হাত ধরে টেনে তুলে দিল। তারপর করুণ মুখ করে বলল, আর খেতে দিল না, জানো? আমার খুব খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দেবে আমাকে?
ধ্রুব কথাটা ঘোরাবার চেষ্টা করে। পাগলিকে একটু ভুলিয়ে দিতে পারলেই হবে। বলে, শোন, তোমার পরার জন্যে কাপড় এনেছি। নতুন আস্ত কাপড়—কোনো ছেঁড়া নেই। পরলে তোমার আর শীত করবে না।
মেয়েটা ফিক করে হেসে দেয়—ওর মুখে মিনু উঁকি মারে। ফোকরের ভেতর দিয়ে হাত বাড়ায়। বলে, কই, দাও।
হ্যাঁ দিচ্ছি—ধ্রুব বলে। তুমি ধরতে পারবে না। হাত ভেতরে ঢুকিয়ে নাও। আমি ছুঁড়ে দিচ্ছি নিচের থেকে।
বেশ তাক করে একটা কাপড় ছুঁড়ে দেয় ধ্রুব। কিন্তু আবছা আলো অন্ধকারে ফোকরটার ঠিক হদিশ পায় না। জালে লেগে ফিরে আসে সেই কাপড়। নিচে ঘাসজমির ওপর এসে পড়ে। একবার, দুবার। ধ্রুব দাঁতে দাঁত চাপে। নিজের মনে বিড় বিড় করে, শালা—বার বার তিনবার। এবার এটা যাবেই।
তিনবারেও গেল না। আবার ঘাসের ওপর কাপড়টা পড়ার একটা থপ করে আওয়াজ হল।
হি হি করে হাসে পাগলি। বলে, পারছে না, পারছে না—কি মজা—পারছে না। আমি ছুঁড়লে ঠিক যাবে—এই দ্যাখো।
ধ্রুবর চোখ বড় বড় হয়ে যায়—মুখ হাঁ হয়ে যায়। সর্বনাশ—পাগলি করছে কি?
গায়ের কাপড়টা পুরো খুলে জালের ফোকর গলিয়ে নিচে ছুঁড়ে দিয়েছে পাগলি।
ও এখন একেবারে উদোম—বারান্দার রেলিং-এর গরাদের ফাঁক দিয়ে চাঁদের টুকরোটার মলিন আলো। একটা রোগা কিন্তু সদ্য যুবতী শরীরে রহস্য আবছা আবছা মেলে ধরেছে।
ধ্রুব হিসিয়ে ওঠে, ধমক দেবার চেষ্টা করে—একি কাণ্ড করছ তুমি? গায়ের কাপড় খুলেছো কেন?
মেয়েটা আবার হি হি করে হাসে। বলে, তুমি ছুঁড়তে পারো নি—আমি পেরেছি।
ধ্রুব ওকে বোঝাবার চেষ্টা করে। শোন, আমি তোমার পরা কাপড়টা তোমাকে ফেরৎ দিচ্ছি। ওটা চটপট গায়ে জড়িয়ে নাও।
ঘাসজমির ওপর কয়েকটা ভাঙা ইটের টুকরো পড়ে আছে। ধ্রুব তার একটা কুড়িয়ে নেয়। ওর পরা ছেঁড়া কাপড়টার একটা কোণ ইটের টুকরোটার ওপর জড়িয়ে একটা ফসকা গেরো দিয়ে বাঁধে। তারপর ফোকরটার দিকে তাকিয়ে মনঃসংযোগ করে। কাপড়ের এই কোণটা একবারে ছুঁড়ে ভেতরে পাঠিয়ে দিতেই হবে। তারপর পাগলিকে বলবে বাকি কাপড়টুকু টেনে ওপরে তুলে নিতে।
একটা জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ল ধ্রুবর ওপর। সেই সঙ্গে ও শুনতে পেল বেশ কয়েকজন লোকের এদিকে ছুটে আসার আওয়াজ। ও চকিতে ওপর দিকে তাকায়। পাগলি নেই—ফোকরে অন্য একটা মুখ। গঙ্গা চেঁচিয়ে ঐ লোকদের বলছে—ধর ব্যাটা হারামিকে। রাতদুপুরে হোমের লেড়কির সঙ্গে নটখট করে—মার ব্যাটাকে।
ধ্রুবর দুই হাত পিছমোড়া করে ধরল কয়েকজন লোক। ধ্রুব অমূল্যর গলার আওয়াজ পেল—শালাকে ধর্, ভাল করে। পালাতে না পারে।
ধ্রুব বলতে গেল—অমূল্য, আমার কথা শোন্ —
হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার কথা সবাই শুনবে। থানাতে পুলিসে শুনবে। কোর্টে জজসাহেব শুনবে। অনেক লোকজন পাবে তোমার কথা শোনাবার জন্যে।
একটু থেমে অমূল্য আবার বলল, আমরা তোকে কিছুদিন থেকে ওয়াচ করছিলাম—গঙ্গা তোর সব খবর দিচ্ছিল আমাদের। আজ হাতেনাতে ধরেছি।
পকেট থেকে মোবাইল বার করল অমূল্য। ফোনটার বোতাম টিপল—তারপর মুখ বাঁকিয়ে বলল, দুস্ শালা—থানার নম্বরটা অফিসে রয়ে গেছে।
তোরা পাহারায় থাক—সাকরেদদের বলল অমূল্য। আমি অফিস থেকে পুলিসে একটা ফোন করে আসি।
অফিসে বসে বড়বাবুর লেখা রিপোর্টটা পড়ছিলেন লতিকা সেন। আজ সকালে অমূল্যর ফোন পেয়ে সকাল সকাল অফিসে হাজিরা দিয়েছেন। বড়বাবু ও আরও কিছু কর্মচারীও তাড়াতাড়ি অফিসে পৌঁছে গেছে। আজ বাড়ি থেকে বেরোনর আগেই ফোনে কর্তার সঙ্গে কথা বলে নিয়েছেন লতিকা। গুরুতর একটা ঘটনা। খবরটা তো মিডিয়াতে ফাঁস হবেই—আর সঙ্গে সঙ্গে ওপরওয়ালার ফোন আসবে। তার থেকে ভালো হচ্ছে নিজের থেকেই রিপোর্ট তৈরি করে পাঠিয়ে দেওয়া। তাতে ওপরওয়ালাদের ও মিডিয়ার লোকদের সঙ্গে কথা বলতে সুবিধে হবে।
ধ্রুব দাস নামে একটি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হোমের ওয়াচম্যান হিসেবে কর্মরত ছিল। দীর্ঘদিন থেকে সে হোমের আবাসিক মানসিক রোগী মেয়েদের কাপড়চোপড় বাইরে চালান করছিল। গতকাল রাতে কাপড় পাচার করার সময় সে বামাল সমেত হাতে নাতে ধরা পড়ে। ধ্রুব দাসকে পুলিস গ্রেপ্তার করেছে। এই অফিসও তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে। পরবর্তী সব ঘটনা নিয়মিতভাবে ওপর মহলে জানানো হবে।
বড়োবাবুর লেখা রিপোর্টটা পড়ে লতিকা খুশি হলেন। বড়োবাবু পাকা লোক—কাগজপত্র লেখালেখির ব্যাপারে ওস্তাদ। রিপোর্টে সই করলেন লতিকা। টেবিলের উল্টোদিকে বসা বড়োবাবুর হাতে সই করা কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন—এটা এক্ষুনি স্পেশাল মেসেঞ্জার দিয়ে ওপরমহলে পাঠিয়ে দিল। একেবারে বড়োকর্তার পি. এ.-র হাতে দিয়ে আসবে। আর হ্যাঁ—অমূল্যকেও একটা সার্টিফিকেট অফ কমেণ্ডেশন দেয়ার ব্যবস্থা করুন।
বড়োবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে খানিকক্ষণ দম নিলেন লতিকা। তারপর টেবিলে রাখা জলের গেলাসটা তুলে নিয়ে ঢাকাটা বাঁহাতে তুলে গেলাসে চুমুক দিলেন। আজকের এই ঝামেলায় অফিসে আসার পর রোজ যে একটু জল খান সেটা আজ এখনও খাওয়া হয়নি।
জলটা পুরো খেয়ে গেলাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন লতিকা। হাঁপিয়ে গেছেন তিনি। এই সকালবেলায় অফিসে আসা কি সহজ কথা? এ সময় বাসে ট্রেনে যা ভিড়। স্বামীর সঙ্গে কথা বলে নিয়েছেন লতিকা। এই ঝামেলাটা একটু থিতিয়ে যাক্, তারপর কলকাতার কাছাকাছি আর কোনো একটা জায়গায় বদলির জন্যে চেষ্টা করা যাবে।