অস্তিত্বের সংকট কিম্বা সংযোজন – বিষয়টা নিয়ে ভাবার অবকাশ থাকলেও সন্ধের পর থেকে আটষট্টি বছরের মিথিলেশ শাসমল কিন্তু সপ্তদশী মিশা। প্রত্যেক সন্ধ্যা আটটায় আছোঁয়া জগতের আলোর ফুল এবং অদৃশ্য দুনিয়াদারিতে যত মাকড়ার জাল বোনাবুনি, সেই চমৎকার জগতে তিনিও আসন পাতেন। ছোটঘরে মিথিলেশের কম্প্যুটার বইয়ের র্যাক, সরু ডিভান। বনলতা এটাই জানেন যে তাঁর পতিদেবতা অবসরোত্তর কোনো বিশেষ সাম্মানিক বৃত্তিতে যুক্ত, যেটা হয়ত সে অর্থে বিশেষ অর্থকরী নয়। বনলতা অবশ্য তা নিয়ে মাথাব্যথা দেখান না। স্বভাবগতভাবে তিনি বেশ নিশ্চিন্ত, নির্লিপ্ত ও নিঃসংশয়। ওইঘরে অদেখা কোণে মিথিলেশ এক মেকআপ বাক্স লুকিয়ে রেখেছেন। তাঁর দ্বিধা আছে বলে লুকোচুরি, অন্যথায় তিনি সোজাসাপটা এক কথার লোক।
সাড়ে সাতটা নাগাদ মিথিলেশ গা ধুয়ে মেয়েলি গন্ধের বিখ্যাত পাউডার মাখেন, বিরলকেশ মাথা সযত্নে আঁচড়ান, পাতলা আদ্দির পাঞ্জাবী ও চুড়িদার পায়জামা পরেন। তারপর হাল্কা প্রসাধন, ফেস মেকআপ। বিষয়টা কেউ জানেনা বলে জবাবদিহি করতে হয়না এমন কি নিজের কাছেও। মিশাকে আজ বেশ দেখাচ্ছে। প্রোফাইলের ছবিটাও বদলে দিল। ষাটের দশকের বিখ্যাত বলিউড নায়িকার ছবি ছিল এতদিন। স্যামি সংযোগরেখায় এলেই ভারী আপত্তি করত, “হেই মিশা এই দাদি-কাটিং ফোটো হঠাও। নিজের ফেস দাওনা কেন?” স্যামি বা সমীর বেনারসের ছেলে, বাপের বিরাট ব্যবসা। ছেলেটা বি-কম পাশ করতে পারেনি দুবারেও। “পড়ালিখা আমার হবে না, বুঝলি মিশা?” এখন ব্যবসায় মন দিয়েছে তাই। চ্যাটবাক্সে আজ প্রায় কেউ নেই, প্রলয় আর শিল্পীর নামের পাশে সবুজ সংকেত। মিশা একবার “হাই” করল দুজনকেই, সাড়া পেলনা। এরা অবশ্য তার তেমন ঘনিষ্ঠ নয়। একটু বিমনা হয়ে হাতের শাসনে ঘোরাচ্ছিল ইঁদুরটাকে হঠাৎ “হাই মিশা! কেমন আছো?” অণু, অন্বেষা মানে জ্ঞানদা! “বাপরে” লিখে ফেলছিল প্রায়। বদলে, “কেমন আছো? রেজাল্ট কিরকম?” লিখতেই হল। “ওই... মোটামুটি।” নম্বর ও পার্সেন্টেজ লিখে দিল অন্বেষা। মিশা লিখল, “আরিব্বাস, দারুণ তো... খারাপ কোথায়?” অন্বেষা ছোট্ট লিখল, “নাঃ এন-আই-টিও হলনা। প্রাইভেট কলেজ দেখতে হবে, ব্যাডলাক। খাটছিস তো? নেক্সট ইয়ার তোর।” “নাঃ বাবা,” সুট করে নিজেকে সরিয়ে নিল সাময়িক। অন্বেষা শুরু হলে পৃথিবীতে যতক্ষণ যত জ্ঞান আছে...। কাজের কথা এই, ওর হাজিরা নিয়মিত থাকে না। কারোরই প্রায় থাকে না, সকলেই তো মিশা নয়। খানিক এদিকওদিক...ন’টা বাজবে প্রায়, বন্ধ করার আগে আর একবার চ্যাটবাক্সে মিশা উঁকি দিল। বাঁচা গেছে, জ্ঞানদা’ সটকেছে। “হাই মিশু মিশু মিশু... কেমন আছিস ডিয়ারি? লভ ইয়্যু সো মাচ।” ঝাঁপিয়ে পড়েছে টোপাজ, একটা অখাদ্য অনামা ফ্যাশন ইন্সটিট্যুটে পড়ছে। বন্ধুত্বের অনুরোধ পেয়ে মিশা লিখেছিল, “টোপাজ! কেন?” “কেন মানে কি? আমার নাম,” স্মাইলি দিয়েছিল মেয়েটা, “মেরা নাম... চণ্ডীগড় সে হুঁ।” প্রোফাইলে যা একখানা ফোটো, আয়তনয়ন স্ফুরিতাধর রসে টৈটম্বুর। বুকের মধ্যে ঝমাঝম মিশার, মিশার বা অন্যজনের। সাহসের বলিহারি। মিশার প্রোফাইল দেখে লিখল, “এটা বেটার। কিন্তু আমার ফোটো আমার নিজের। সো আনকমন নেম ইয়্যু হ্যাভ... কে দিয়েছে নাম? এনিওয়ে নিজের ফোটোটা দাও। নট গুড।” “আর তুমি যে তোমার নাম লুকোচ্ছ, সেটা কি?” কুটুস করে দিল মিশা। “ওয়েল, মাই নেম টোপাজ... দিয়েছিল ওয়ান অব মা’ বয়ফ্রেনজ,” সে শুরু করতেই থামাল মিশা, “মানে? অনেক বুঝি?” “নিশ্চয়ই, দিয়েছিল একজন... লাস্টলি মুভড অন। বাট দ্য নেম আই লভ। তুমি বুঝবে না বচ্চী। আমি এখন টোয়েন্টিওয়ান।” লিখল টোপাজ, সাথে দুটো বিটকেল স্মাইলি ফ্রি। “বেশতো নাই বুঝলাম, তুমি লোলিটা পড়েছ নভোকভের?” মিশার টাইপিং স্পিড বাড়ছে দ্রুত। হঠাৎ সে অনেক কিছু লিখছে, যেগুলো বার্ধক্যে পৌঁছানো প্রৌঢ়ের নিরুচ্চার কর্দমাক্ত স্রোত। টোপাজ যখন হতভম্বপ্রায়, লেখা এল, “তোমার জামার গলাটা আর সামান্য বড় হলেই ক্লিভ...।” “ওয়েট মিশু, কিসব লিখেছ? ওয়াচিং ব্লুজ? অলরেডি এক্সপিরিয়েন্সড?” বলতেই মিশা আড়ালবাসিনি। এতক্ষণ পরে এসেছে দ্বৈপায়ন, “আজো তুমি নেই মিশা? মিস করছি... ভীষণ ভীষণ।” এইমাত্র মিথিলেশ কম্প্যুটার বন্ধ করেছেন।
।। ২ ।।
বনলতা রোজ ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে বাসিপাট সেরে কাচা তাঁত পরে ঠাকুর জাগান। দোতলায় দুটো ঘরের জানালা খুলে দিয়ে হাওয়া খেলান। ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাছাকাছি বলতে রুনা শুধু সল্টলেক, নাতনী দিশারি প্রায় ছুটিতেই তাই এখানে দাদু-দিদার কাছে। যতক্ষণ বারান্দায় রোদ্দুর লুটিয়ে পড়ে, বনলতা চায়ে শেষ চুমুক। একতলা থেকে ঝন্টুর নিরীহ মিসাইল সুঁই করে এসে পায়ের কাছে পড়লে বনলতা খুঁটিয়ে দেশের খবরাখবর পড়েন। সামনের মাঠে স্বাস্থ্যসচেতনদের ধুন্ধুমার, ছেলেপিলেদের খেলাধুলো। মিথিলেশকে অনেকবার বলেছেন যাবার জন্যে। তিনি আবার ঘুমবিলাসী, “আমি? কি জন্যে? দেখেছ বাইসেপস?” পাকসেটে লম্বা নীরোগ শরীর। রাত্রে উদ্গ্রীব, পরাক্রমী এখনো। বনলতার বড় যাতনা – কাউকে বলতে পারেন না। একী অসুখ! ডাক্তার দেখানোর ভাবনা স্থগিত হয়ে থাকে। চাটুকু শেষ, পাশে এসে বসলেন মিথিলেশ। “তুমি এত সক্কালে? হাঁটতে যাবে?” উৎসুক বনলতাকে থামালেন মিথিলেশ, “পাগল! রাত্তিরে অতটা পাঁঠার মাংস খাওয়াতে অম্বল, ঘুমটা জমেনি।” “ওবাবা! বীটনুন লেবুজল খাও তাহলে। বললে তো রাগ হও, এবয়সে সব কিছু মানায় না সহ্য হয়? কাকে যে বলা!” বাষট্টির রেখায়িত মুখে লাল আভার বদলে কষ্ট, অস্বস্তি। সব বোঝেন মিথিলেশ, “তবে কি করব, লুকিয়ে বেপাড়ায়?” কথাটা মনে গুঁজে রাখলেন, মুখে আনা যায় না বলে উচ্চারণ করলেন না। “তাহলে আজ পেঁপে-কাঁচকলার শুক্তো, জিরে আদাবাটা দিয়ে মাছের ঝোল – যাই ফর্দটা দিয়ে আসি গে চুনীকে।” তাড়াহুড়োয় উঠে গেলেন বনলতা, আর একটু বসলে ভালো লাগত মিথিলেশের। চালিয়াত সমীরণ পাত্র সেদিন ওইরকম কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল নাকি? “তোমার ইয়াং থাকার সিক্রেটটা কি মিথিলেশদা? আমার চেয়ে তো তিনবছর সিনিয়র ছিলে ইস্কুলে... তা যাই করো, বৌদিকে জানিয়ে কোরো। বয়সটা ভালো নয় কিনা।” তেতো মস্করা। শালা আড়ালে বলিস “টেকো খচ্চর।” বাকিরা হ্যাহ্যা করে মোসায়েবী তাল ঠুকছে। সব প্রতিবেশী, হাফপ্যান্টের বন্ধু। “তোদের তো কেবল লেগপুলিং পরচর্চা নিজের ঢাকপেটানো আর বুকনি ঝাড়া।” বলতে পারলে খালাস হতেন মিথিলেশ, পারলেন না।
দ্বিপ্রাহরিক হাল্কা আহার। শেষ ভাদরের ভ্যাপসা - ঝরঝর বৃষ্টিতে পারা নেমে অস্বস্তি কমেছে। মিথিলেশ দুপুরে নিশ্চিন্দি ঘুম মেরেছেন। “নাঃ সামলে চলতেই হবে লতার জন্যে। শান্ত ভেজা ন্যাতা, আগুন-টাগুন নেই।” ভাবতে ভাবতে চা নিয়ে হাজির বনলতা। শিথিল মুখে তৃপ্তি, “এখন ভালো লাগছে? চাটা খাও। পাতলা করে করলাম।” চায়ের গন্ধ ভালো, সুড়ুত সুড়ুত আরাম চুমুক। বনলতা বললেন, “সন্ধের পরে শ্যামলীর বাড়ি যাব একবার। হিয়াকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। একগুঁয়ে মেয়ে তো, মা টেনশনে মরে। চলোনা তুমি, কত খুশি হবে ওরা। যেতেই চাওনা, এত বলে সবসময়ে।” বলেনা শুধু, কতবার আসে শ্যামলী আর মনোজ, তাঁর তুতো শালী আর ভায়রা। কাছেই থাকে। “বেশ তো চলো।” বলে উদারতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আশ্বস্ত করতেই একমুখ শিউলি ফুটল, “ওমা! আমি তাহলে শ্যামাকে ফোন করি গে একটা। তার আগে...।” কত সামান্য স্বীকৃতি যে মানুষকে সুখী করে, ভাবলেন মিথিলেশ। সন্ধেনাগাদ গা ধুতে গিয়ে আশিরপদ ডলে ডলে সাবান লাগাতে লাগলেন, যেন এভাবেই মোছে আদ্যিকালের দ্বিধা অস্বস্তি সংস্কার। কিন্তু কেন এসব কেন? সূক্ষ্ম অধরা খুঁতখুঁতুনি, গোপনীয়তা? উদারহাতে পাউডার ঢেলে ধোপদুরস্ত আদ্দির পাঞ্জাবিটা গলাতে গিয়ে অদৃশ্য জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছটফট করছেন, তখন মিশা উঁকি দিল, “ এটা ঠিক হচ্ছে তোমার, এই এখন যাওয়াটা? টোপাজ আসবেই। দ্বৈপায়ন যে অপেক্ষা করে কেন, বোঝোনা নাকি?” বিড়বিড় করলেন মিথিলেশ, “যাওয়া উচিত, কথার খেলাফ করব?” “ভেবেই দেখো! নোতুন কতজন আসতে পারে... ওখানে ভ্যাজানো, বুড়োটে আড্ডা, বসে বসে বোর হবে। তুমি বুড়ো বুঝি?” চিমটি কাটছেই মিশা। জমা কাদাজলে টুপটাপ ঢেলা। “ওম্মা, বাবু তৈরি হননি এখনো? এইরকম তোয়ালে আর পাঞ্জাবীতে গেলে শ্যালিকা তোমায়... তাড়াতাড়ি করো গো।” চমৎকার ঝলকাচ্ছেন বনলতা আজ খুশিতে, সাজগোজে। জঘন্য অপরাধীর সাজানো অনুরোধ, আত্মপক্ষ সমর্থন, “পেটটা আবার গুড়গুড়... ওদিকে খেয়াল হল একটা আর্জেন্ট রিপোর্ট তৈরি করা বাকি... আমি বরঞ্চ অন্য একদিন... তুমি আজ চুনীকে নিয়ে যাও যদি?” ছোটোঘরের দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে চোখের সামনেটা ক্ষণিকের জন্যে অন্ধকার লাগল, বনলতার নিবার্পিত মুখের মত।
।। ৩ ।।
মিথ, সবটাই মিথ। এমনটা হতে পারে কখনো? বনলতার সঙ্গে ক্ষীয়মান হচ্ছে কথাসূত্র, দিনগত আদানপ্রদান। মিশা নয়, মিথিলেশ ধোঁয়াটে নীলাভ বীতংসে আচ্ছাদিত। নিছক কৌতূহলে খেলার মত শিখেছিলেন দিশারির কাছ থেকে। ছড়িয়ে দেওয়ামাত্রই অজস্র কথা, মতামত, অনুরোধ আহ্বান। ইপ্সিতা, কণাদ, শুভার্ঘ্য, ভিশাল, সেলিনা – মিশার পৃথিবী ষোল থেকে চব্বিশের অলীক নির্মাণ। চেনে কিম্বা চেনে না... চেনা হয়, চিনে যায়। স্যামি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পারিবারিক ব্যবসায়। ওই সংক্রান্ত কথাই সারাক্ষণ। “তুমি বুডঢা হয়ে যাচ্ছ কিন্তু স্যামি। আনইন্টারেস্টিং।” মুখ বেঁকানো স্মাইলি দিয়ে লিখেছিল মিশা। “রিয়েল্লি? আয়্যাম টুয়েন্টিথ্রি। পাপা রিস্তা দেখছে। আয়েগী মেরি শাদী মেঁ?” “পশতাওগে,” মিশা নাক সিঁটকায় মনে মনে, জবাব লেখেনা। মাঝে মাঝে দ্বৈপায়ন উঁকি দেয়। তার জন্যে প্রেম প্রেম ভাবটা ঘুচে গেছে। শৈবলিনীর প্রেমে হাবুডুবু এখন। প্রথম যেদিন জানল, অনেক দূরে কোথাও শাটার বন্ধ করার আওয়াজ মিশা শুনেছিল, মিথিলেশ শাসমল নয়। “শৈবলিনী? এমন আদ্যিকালের নাম!” লিখেছিল মিশা। “শী’জ মাই শৈ... ।” হৃদয়চিহ্ন এঁকেছিল দ্বৈপায়ন। মিশা আর প্রতিপ্রশ্ন করেনি। তার বন্ধুসংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। পুরোন অনেকে নেই। টোপাজ আসেনা কতদিন। খালি খালি লাগে মিথিলেশেরও। অবিকৃত সেই প্রোফাইল ফোটো... বুড়ো শকুন বেঁকা ঠোঁটে ঠোকরালে কদর্য গালি খায় মিশার কাছে, “ঘাটের মড়া, নিলর্জ্জ বুড়ো ভাম, চোখ গেলে দেব।”
অভ্রনীল-তিয়াস-পিউ – ত্রিকোণ তৈরি হয়েছে, শুরু থেকেই টের পেয়েছিল মিশা পিউ হেরে যাবে। ওকেই সরে যেতে হবে। মিশা ইঙ্গিত দিয়েছিল। মফঃস্বলের লাজুক মেধাবী সাধারণ পিউ, “সব বুঝিরে। জানিস মিশা, সেমেস্টার খুব খারাপ হয়েছে। মন বসছেনা। বাড়িতেও বলতে পারিনা। বাবার কত আশা।” মিশার মুখের মধ্যেও তেতোভাব, কি-ই বা করার আছে? ওলটপালটগুলো চুপিচুপি গুঁড়ি মেরে ঢোকে একদলা শ্লেষ্মা হয়ে। হৃদয়, পাকস্থলী রক্তবহা নালী ছেয়ে যায় মাদকের আস্বাদ। ভাষাহীন মুখের সারি, হাসিভরা কঠিন নির্মোক। মন ভালো নেই মিশার। এলোমেলো ঘুরছিল সেদিন হঠাৎ, “হাই মিশু, কি খবর?” টোপাজ, এতদিন পরে! ছবিটা পাল্টালো কখন? সাদাকালোয় ঝিমোনো আবছামত। “মিসিং ইয়্যু ডিয়ার... ভেরি ভেরি ভেরি মাচ।” মিথিলেশ শাসমলকে আঁচড়াচ্ছে একটা হিংস্র বনবেড়াল। সম্ভব নয় বলেই ইচ্ছেগুলো পায়ের তলে পিষে মারা। “কি হয়েছিল? কি হয়েছিল তোমার?” একসঙ্গেই জানতে চায় মিশা ও মিথিলেশ। “কি হল?” “বলবে না?” একের পর এক অনুরোধ যায়, ওপক্ষ বোবা হয়ে আছে অনেকক্ষণ। “আয়্যাম শ্যাটারড... লাইফের অনেক ফেজ দেখতে হল মিশু।” আবার চুপ। একের পর এক অদ্ভুত স্মাইলি দিয়ে চলেছে। মিথিলেশ গর্জে উঠলেন, “বলো।” সময় কী দীর্ঘ! “আই ওজ এ্যাবর্টেড... এখন নজরবন্দী। সব বারণ, নেট করাও। অনেক লুকিয়ে আজ... যাইরে, বাই।” বোমায় সবুজ সংকেত নিভে গেছে। মিশার চোখে বাষ্প, মিথিলেশের বুকে দামামা। সবকিছু কঠিন, জটিল ততোধিক। “ভালো থেকো টোপাজ, উজ্জ্বল হয়ে ওঠো আবার।” মেসেজটা পাঠিয়ে দিল মিশা, মিথিলেশও হয়তো বা। তিয়াস লিখছে, “কেমন আছিস রে?” “ভালো। আসছ না অনেকদিন চ্যাটে... ভাবছিলাম।” মিশা আন্তরিক। “ভালো নেই রে অভ্র।” টাইপ চলছে। মিশা উদ্বিগ্ন “কি হয়েছে তিয়াস? পিউ কেমন?” অনেক লিখে চলেছে তিয়াস। কালো ইঁদুরটা হাতের মুঠোয় ছটফট। “অভ্র ডিপ্রেশনে ভুগছে আমার আর শঙ্খর এনগেজমেন্টের পর থেকে। ট্রিটমেন্টে আছে। কষ্ট পেয়েছে খুব। বল কি করতাম? ও ভালো ছেলে নিশ্চয়ই, কিন্তু আমার ফ্যামিলি স্টেটাস... মানত নারে কেউ। কানাডা চলে যাচ্ছি বিয়ের পরেই। আর ওর যে দাঁড়াতেও অনেকটা দেরি!” মিশা দ্রুত লিখছে, “আর পিউ?” “খুব আপসেট..., অথচ সেমেস্টারের জন্যে খাটছেও। আমি জানি শী হ্যাজ সফট কর্নার ফর অভ্র। আমাকে কংগ্রাটস করেছে, থ্যাংক্সও বলেছে। কেন কে জানে! লড়াকু। ঠিক সামলে নেবে জানিস? ওর মধ্যে কি একটা জোর আছে, আমার নেই।” স্বীকারোক্তি লিখে যাচ্ছে মেয়েটা। মিশা নিশ্চিন্ত শ্বাস ফেলে লিখছে, “এই ভালো। ও ঠিক সুস্থ করে আনবে অভ্রকে, দেখো। তুমি খুব ভালো থেকো তিয়াস।” “সত্যি তুই সব বুঝিস এত ছোটো হয়ে।” অবাক স্মাইলি দিয়েছে তিয়াস, “তোর নামের মানেটাও জানা হয়নি। একবার দেখা করবিরে? আমি সল্টলেকে থাকি।” সুন্দর একটা হাসিমুখ দিয়েছে তিয়াস। মিশা এবার সুতোটি কেটে দিল।
।। ৪ ।।
শুগার বেড়েছে খুব। বনলতা প্রায়শঃই ক্লান্ত থাকেন আজকাল, উৎসাহ নেই কিছুতেই। ছোটো ছেলে রঙ্গনের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। কাজকর্ম করছেন বনলতা, মিথিলেশও আছেন কিছুটা অমনোযোগী ছাত্রের জোর করে মন বসানোর মত। কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লে মিশা চুপ থাকেনা, উথালিপাথালি করে। বেশ কয়েকদিন ব্যস্ত ছিলেন, গুমড়ে ছিল মিশা। ঠাণ্ডা পড়েছে ভালোই। আজ শালমুড়ি দিয়ে মিথিলেশ ঢুকেছেন ছোটঘরে। গা ধোয়া হয়না আজকাল, পরিপাটি সাজসজ্জার সময় পাওয়া যায়না। অনিয়মিত কোনোরকমে খানিকটা সময় বের করা। জাল ছড়াতেই অসংখ্য অভিযোগ, অনুযোগ ফোটো, মন্তব্য... আহা এই তরতরে... এরই তো নাম বেঁচে থাকা। ঝিমিয়ে নেতিয়ে আধমরা গাছ বুড়িয়ে যাবে না? আজ মিশা থাকবে এখানে অনেকক্ষণ ধরে। দেখল একগাদা বন্ধু হওয়ার অনুরোধ জমে গেছে। মিশা ধীরেসুস্থে পড়তে লাগল। চেনা বন্ধুর সূত্র ধরে কেউ কেউ, একেবারে অচেনাও আছে। একটা ব্যক্তিগত মেসেজ এসেছে, “হ্যালো মিশা, দারুণ নাম তোমার! রাশিয়ান? আমার বি-এফ সমিধ কমন ফ্রেন্ড। তাছাড়া নামেও মিল, তুমি মিশা আমি দিশা, দিশারি। তাছাড়া আরো মিল, কি বলো? আমার দাদুর বাড়িও উত্তরপাড়ায়। একদিন দেখা হবেই হবে।” দুটো স্মাইলি এল। বনলতা লক্ষ্মীপুজো করছেন, শাঁখের আওয়াজ পাচ্ছে মিশা। হঠাৎ মিথিলেশের দম আটকে আসছে, নাকেমুখে জড়িয়ে পাকিয়ে যাচ্ছে জাল। আঃ আঃ। দরজায় ঠুকঠুক, ছোটছোট টোকা, “হ্যাঁগো শুনছ! সমীরণবাবুর বাড়ি থেকে ডাকতে এসেছে, এ্যাটাক হয়েছে ওনার। বাড়িতে এখন নেই যে কেউ, একবারটি যেতে হবে।” মিথিলেশ জাল ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টায় ছটফট করে চলেছেন। মিশা কৌতুকে হাততালি দিচ্ছে, “পারবেনা, পারবেনা। উনি রেগে গিয়ে ধমকাচ্ছেন, “পাগল করে দিবি আমায়? আর আসবি না, টানাটানি করবিনা। আমার বয়স আটষট্টি পেরোচ্ছে, আর তুই ষোল তো ষোলই।” চেষ্টা করছেন প্রবল একটা নিরক্ত খুনের পরে দরজা খোলার। হয়না, এদিকওদিক থেকে উঁকিঝুঁকি মারছেই মিশা নামের সেই... “কেন চেষ্টা করছ! অত সোজা নয়গো।” ছটফট করছেন মিথিলেশ শাসমল ঘরের বাইরে বেরিয়ে ভালো করে শ্বাস নেবার জন্যে। বুকের বাঁদিকটায় চাপচাপ ব্যথা জমে আছে তাঁরও।