• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৩ | ফেব্রুয়ারি ২০১৩ | গল্প
    Share
  • গণ্ডারের শিং : অরুণ কাঞ্জিলাল


    মাড়োয়ারী ভোজনালয়। শুদ্ধ শাকাহারী ভোজন। বাইরের দরজাটা আলতো করে ভেজানো। ভিতরে মোমবাতির আলোয় রাতের খাবার খাচ্ছি। তিনদিন যাবৎ সার্বভৌম অসমের দাবিতে আলফা-র বন্‌ধ। বন্‌ধ যে এমন তীব্র হতে পারে জানা ছিল না। এমন স্তব্ধ, নিশ্চল নগরীর দৃশ্য দেখার জন্য অন্য দেশে গৃহযুদ্ধ অথবা সুনামির মতো ভয়ানক সব ঘটনার অপেক্ষায় থাকতে হত। শুনেছি পার্ল-হারবারে জাপানী হানার দিন স্তব্ধ হয়েছিল হাওয়াই দ্বীপ। উজান অসমের নিশীথের এই স্তব্ধতা যেন তাকেও ছাপিয়ে যায়। ঘিয়ে ভাজা রুটি, উরদকা ডাল আর দহি। জোড়হাটের জল ভালো। খিদেটা দিব্যি হয়। সবে রুটিতে হাত দিয়েছি, এমন সময় লাডিয়া বলল,
    'আপনি কাজিরাঙা যাবেন না?'

    লাডিয়া আমাদের পান্থনিবাসের মালিক। পুরো নাম যুগল কিশোর লাডিয়া। বাংলাটা ভালো বলে। বলতে বাধ্য হলাম কাজিরাঙা যাবার মতো সঙ্গী-সাথী না থাকায় এবারকার মতো ওটা বাদ দিতে হল। লাডিয়া বলল,
    'অক্টোবর মাসে কাজিরাঙার পরিবেশ খুব মনোরম। বারোশোর উপর গণ্ডার আছে এই জাতীয় উদ্যানে।'

    আমি স্মিত হেসে বললাম 'লোভ দেখাচ্ছেন? ওখানে গেলেই গণ্ডার দেখা যাবে তার কি নিশ্চয়তা আছে?'

    লাডিয়া বলল, 'ইউ ক্যান নট মিস ইট। জঙ্গলে দুটো জন্তু, হাতি আর গণ্ডার, এরা সবসময় একে অপরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। ওদের মধ্যে লড়াই ও মৃত্যুর ঘটনাও বিরল। কিন্তু মানুষ হাতিকে পোষ মানিয়ে তার পিঠে চড়েই বন্য গণ্ডার দেখতে বেরোয়। অন্য অভয়ারণ্যের কথা জানি না। আপনি হয়তো সারাদিন ঘুরে একটা বেজী অথবা খরগোশ ছাড়া কিছুই দেখতে পেলেন না, কিন্তু হাতির পিঠে চড়ে কাজিরাঙায় গেলে আপনি কৃষ্ণের বর্ম পরা এই প্রাণীটির সাক্ষাৎ অবশ্যই পাবেন।'

    লাডিয়ার কথায় কৌতুহল বেড়ে গেল। বললাম, 'কৃষ্ণের বর্ম? এরকম কথা তো শুনিনি।'

    লাডিয়া তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে আরাম করে বসল। বলল, 'ব্যাপারটা এই যে শ্রীকৃষ্ণ একবার ঠিক করলেন হাতির বদলে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি গণ্ডার ব্যবহার করবেন। কারণ শত্রুপক্ষের ধনুকধারীরা খুব সহজেই মাহুতকে মেরে ফেলে আর মাহুত মারা গেলে দিশেহারা হাতি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। কৃষ্ণের নির্দেশে তাঁর সৈন্যরা বন থেকে একটা গণ্ডার ধরে নিয়ে এল। তার সারা গায়ে বর্ম পরিয়ে তাকে যুদ্ধবিদ্যার কৌশল শেখাবার চেষ্টা শুরু হল। কিছুদিন বাদে গণ্ডারটিকে কৃষ্ণের সামনে হাজির করা হল। বিচক্ষণ কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন যে গণ্ডার বুদ্ধিতে বড়ই খাটো। তার স্মৃতিশক্তি এত হ্রস্ব যে সে কিছুই মনে রাখতে পারে না। এরপর সে একটু গোঁয়ার গোছের। ক্রুদ্ধ কৃষ্ণ তখন গণ্ডারটিকে তাড়িয়ে দিতে বললেন। সৈন্যেরা বর্ম পরা গণ্ডারটিকেই বনে তাড়িয়ে দিয়ে এল। তাই যুদ্ধ না শিখেও গণ্ডার আজও কৃষ্ণের বর্ম পরে আছে।'

    ভোজনালয়ের আর এক প্রান্তে বসে নিঃশব্দে ভোজন সারছিলেন ভুজঙ্গধর গোঁসাই। লাডিয়া পান্থনিবাসে আমার রুমমেট। বয়স আমারই সমান হবে। বেশ মজবুত পেশীপুষ্ট দেহ। মুখে একজোড়া নাৎসী গোঁফ মুখখানাকে অনাবশ্যক রকম হিংস্র করে তুলেছে। চোখের দৃষ্টিতে বিশ্বসংসারের যাবতীয় অবিশ্বাসের নিষ্ঠুর সতর্কতা। সব শুনে মন্তব্য করলেন,
    'লাডিয়া পয়লা নম্বরের গল্পবাজ। কোথায় দ্বারকা আর কোথায় প্রাগ্‌জ্যোতিষ। মহাভারতের কোথাও নেই, কৃষ্ণ গণ্ডারকে যুদ্ধবিদ্যার কৌশল শিখিয়েছিলেন।'

    প্রত্যক্ষ মন্তব্যে লাডিয়া প্রথমে একটু দমে গেলেন। এত সুন্দর একটা লিজেণ্ড বলেও কোনো প্রশংসা পেলেন না। একবার ক্ষীণকণ্ঠে বলল, 'মহাভারত কতবার লেখা হয়েছে আপনি জানেন? কমসে কম পঁচ্চিশবার। আপনি যেটা পড়েছেন তাতে ওই এপিসোডটা নেই।'

    ভুজঙ্গধরবাবু কিছু না বলে হাত ধুয়ে উঠে গেলেন। আগেই বলেছি লাডিয়া পান্থনিবাসের আমরা অস্থায়ী বাসিন্দা। ভোজনালয়ের লাগোয়া বিশ্রামস্থল। আমি এক নামকরা প্রকাশক সংস্থার ভ্রাম্যমান ক্যানভাসার। এসেছি ডিব্রুগড়, শিবসাগর হয়ে যাব নগাঁও। সেখান থেকে গৌহাটি। ব্রহ্মপুত্রের ভাঁটার টানে। এখানে এসে বন্‌ধের মুখে পড়লাম। জোড়হাটে হোটেল কম। সরকারি ডাকবাংলোয় জায়গা না পেয়ে শেষটায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শহরের উপকণ্ঠে এই বাবুপট্টিতে লাডিয়া পান্থনিবাসে উঠেছি। এখানকার নিয়ম ভিন্ন। প্রথম দিন এসেই সঙ্গে টাকা পয়সা যা আছে, হোটেল মালিককে জমা দাও। উনি তার পরিবর্তে একটা চিরকুট লিখে দেবেন। পান্থনিবাস ছাড়বার আগে ওই ছেঁড়া কাগজটা দেখিয়ে পুরো টাকা ফেরত নিতে হয়। একই ঘরে দুজন অপরিচিত ও অচেনা বোর্ডারকে স্থান করে দেওয়ার এক অভিনব পদ্ধতি। তাতে অবশ্য আমার আক্ষেপের কিছু নেই। অসুবিধা হল আমার রুমমেট কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন তা এখনও খুলে বলেননি। জনশূন্য রাস্তাঘাট। গোটা শহর জুড়ে যেন এক দমবদ্ধ ঘোর। আমরা দুজনে পায়ে হেঁটে ঘোরাফেরা করছি। গতকাল সকালে গিয়েছিলাম রেলস্টেশন দেখতে। ভদ্রলোককে একরকম জোর করেই পান্থনিবাস থেকে বের করেছিলাম। জোড়হাটে দুটো রেলস্টেশন--জোড়হাট জংশন ও জোড়হাট টাউন। একটা মিটারগেজ সিঙ্গল লাইন মরিয়নীর সঙ্গে ফরকাটিং জংশনকে যুক্ত করেছে।

    ভুজঙ্গধরবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, 'রেলস্টেশনে আবার দেখার কী আছে?'

    'আছে, আছে। রেলগাড়িই তো ভারতীয়দের যোগাযোগের প্রধান বাহন--জীবনের অবলম্বন। বিলাসবহুল বাসে এসেছেন বলে রেলকে অবজ্ঞা করবেন না।'

    বন্‌ধের কারণে রেলকর্মী কিংবা যাত্রী না থাকলেও চা-এর স্টলটি কিন্তু খোলা রয়েছে। আসামে ক্যানভাসিং-এ আসার পর থেকে চা-এর দোকানে বসার সুযোগ পাইনি। হাঁটতে হাঁটতে সেখানেই আসি। তরুণ দোকানদারটি অসমীয়া, সে আমাদের নমস্কার করে বসতে বলে। তার নমস্কারের ভঙ্গিটি আমার দারুণ লাগে। আমি বলি, দু-কাপ চা দিন। ভুজঙ্গধরবাবুর দিকে লক্ষ্য করে দেখি ভদ্রলোক ক্ষণে ক্ষণে গজগজ করে উঠছেন আর অধৈর্য হয়ে পায়চারি করছেন। বন্‌ধের দিন নিছক সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে রেলস্টেশনে আসা। কিন্তু ভুজঙ্গধরবাবু দেখলাম বেশ বিরক্ত। এত অধৈর্য হলে কী চলে? আসলে দুর্নিয়তি যখন মানুষের সঙ্গ নেয়, তখন মানুষ তাকে বন্ধু বলেই ভুল করে।

    রাত সাড়ে ন'টার সময় খাওয়া শেষ করে লাডিয়া পান্থনিবাসের দোতলার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে প্রায় জনশূন্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভুজঙ্গধরবাবু বললেন, 'ভারতীয় রাজারা প্রাচীনকালে যুদ্ধক্ষেত্রে শিক্ষিত গণ্ডার ব্যবহার করতেন। তখন সারা ভারতে গণ্ডার পাওয়া যেত। ১৩৯৮ খ্রীস্টাব্দে তাইমুর লঙ কাশ্মীরে গণ্ডার মেরেছিলেন।'

    এই প্রথম আমার সন্দেহ হল, ভদ্রলোক ছিটগ্রস্ত নন তো। ওর সঙ্গে আমার আলাপ মাত্র তিনদিনের। তিনি নিজে যা বলেছেন, তার বাইরে তার সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। লাডিয়ার গল্পটা শুনে তিনি যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, এখন প্রকারান্তরে সেটাকেই মেনে নিচ্ছেন। একটু থেমে ভদ্রলোক আবার বলতে থাকেন, 'গণ্ডারের শিং খুব মূল্যবান মশাই। আন্তর্জাতিক বাজারে এক পাউণ্ডের দাম পাঁচ হাজার ইউ এস ডলার। এর এই শিং-এর জন্য চোরা শিকারিদের গণ্ডারের উপর এত লোভ।'

    'গণ্ডারের শিং-এর এত দাম কেন?'
    'দ্রব্যগুণ, আশ্চর্য দ্রব্যগুণ। গণ্ডারের শিং-এ পুং-যৌন-উদ্দীপক পদার্থ আছে। তাতে নষ্ট পুরুষত্ব উদ্ধার হয়।'

    ভদ্রলোক এখন যে ধরনের কথা বলছেন তাতে মনে হল, ইতিহাসটা তাঁর ভালোভাবেই জানা আছে। আর বন্যপ্রাণী সম্বন্ধেও তাঁর জ্ঞান ভালো। আমি বললাম, 'কাল সকাল থেকে বন্‌ধ উঠে যাচ্ছে। এমনিতেও কাল সকালে কোনো প্রোগ্রাম নেই। চলুন না কাজিরাঙাটা ঘুরে আসি। মাত্র তেইশ কিলোমিটার রাস্তা।'

    আমার প্রস্তাবে দেখলাম ভুজঙ্গধরবাবু কোনো আপত্তি করলেন না। গত তিনদিনের অভিজ্ঞতায়, যখনই কোথাও যাবার প্রস্তাব করেছি উনি গররাজি হয়েছেন। কাজিরাঙা যাবার প্রস্তাবে এককথায় রাজি হলেন। সম্ভবত কাজিরাঙা বেড়ানোর উদ্দেশ্যেই ওনার জোড়হাটে আসা।

    কুয়াশায় ঢাকা অস্পষ্ট শীতল ঊষালোকের ভিতর দিয়ে আসাম সরকারের বাস হু হু করে এগিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকালয় ছাড়িয়ে এলাম। পথের দু-পাশে চা-বাগান। বুক সমান উঁচু সবুজের সারি। কিছু বড় গাছ তাদের মাথার উপর ডালপালার চন্দ্রাতপ ছড়িয়ে রেখেছে। চারিদিকে শুধুই সবুজ। প্রভাত সূর্যের আলোয় চারিদিক আলোকিত। ডাইনে-বাঁয়ে যেদিকেই তাকাচ্ছি, দু-চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মেয়েরা সারি বেঁধে কাজ করছে। বাগানের প্রান্তে চা-বাগানের সাইন বোর্ড। টাটা টি, উইলিয়াম্‌স্‌ অ্যাণ্ড মেগর, ইউল আরো কত কি! তারই ভিতর প্রসারিত মসৃণ পিচ-ঢালা পথে অসম সরকারের বাস এগিয়ে চলেছে এক ধূসর পাহাড়ের দিকে। না, পাহাড় পর্যন্ত যেতে হল না। তার আগেই পথটা বাঁক নিল। বাঁকের মুখে একটা সাইন বোর্ড। তাতে লেখা, 'কাজিরাঙা ওয়াইল্ড লাইফ সোসাইটি'।

    মাঠের পরে বন। সেই বনের ধারেই এ্যালিফ্যান্ট পয়েন্ট। হাতির পিঠে চড়ার স্থায়ী সিঁড়ি রয়েছে। বিরাটকায় হাতিও রয়েছে একটা। হাতি শুধু বিরাটকায় নয়, বেশ সুসজ্জিত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুঁড় নাড়ছে, কান নাড়ছে আর ফোঁস ফোঁস শব্দ করছে মাঝে মাঝে। মাহুতের নাম মদন কলিতা। ডানলোপিলো দেওয়া চমৎকার চারটে সিট তৈরি রয়েছে হাতির পিঠে। মাহুত বলল, 'হাতি রেডি স্যার'।

    হাতিটা সিঁড়ির ধার ঘেঁসে দাঁড়াল। আমি ও ভুজঙ্গধরবাবু তাতে চড়ে বসলাম। আরও দুজন পর্যটক ছিলেন। তাঁরাও উঠলেন। জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওনারা এসেছেন গুজরাট থেকে। রাতে ছিলেন জঙ্গল লাগোয়া কোহরা লজে। ভুজঙ্গধরবাবু জানালেন 'কোহরা মানে কুয়াশা'।

    ঘাসবনের মধ্য দিয়ে হেলে দুলে হাতি চলেছে। ঘাসবন কোথাও কোথাও হাতির চেয়ে উঁচু। জল কাদায় স্যাঁতস্যাঁতে বনের পথ। হাতির পায়ে বেধে ঘাসের শব্দ হচ্ছে। আর শব্দ উঠছে হাওয়ার। পাগল হাওয়ায় ঘাসবনে ঢেউ খেলছে। চারিদিকে একটা ভয়ঙ্কর নীরবতা। বনের ভিতর পর্যটকদের কথা বলা নিষেধ। কিন্তু বুড়ো মাহুতটা ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। যারা পর্যটক নিয়ে কাজ করে, তারা যেন এক একটা দ্বিভাষী অভিধান। মাহুতের দুই ভাষায় বলা গল্পটা এই রকম—

    'কাজিরঙ্গা সম্বন্ধে এক আনন্দদায়ক গল্প আছে। কাজি নামের কার্বিয়াংলং-এর একজন যুবক ছিল। পাহাড়ি এই যুবক প্রেমে পড়েছিল সমতল বসতি করা রঙ্গা নামের এজনী সুন্দরী অসমীয়া গাভরুর (যুবতী)। ওরা প্রায়ই লোকচক্ষুর আড়ালে মিলিত হত, এই অরণ্যে। ক্রমান্বয়ে এই অরণ্যই হয়ে উঠল ওদের প্রেমের তীর্থভূমি। কিন্তু একদিন ওরা অরণ্যে গেল আর ফিরে এল না। ওদের বাবা-মা, প্রতিবেশীরা অনেক খুঁজল কিন্তু তাদের কোনো সন্ধান পেল না। ওদের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনায় সবাই মনে ব্যথা পেল। পরের সময় সেই নিরুদ্দেশ হওয়া ডেকা-গাভরুর (যুবক-যুবতীর) স্মৃতিতেই অরণ্যখণর নাম হৈল - কাজিরঙ্গা।'

    ফরেস্ট রেঞ্জার অফিস থেকে আমাদের কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাহুত এত কথা বলছে কেন? কিন্তু যাদের জন্য কাজিরাঙায় আসা, তারা কোথায়? সেই স্থূলচর্ম অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী। এখনও যে তাদের সঙ্গে দেখা হল না। এদিকটায় ঘাস-বন কম। বড় বড় গাছই বেশি। তবে গাছগুলো খুব একটা ঘন নয়। ঝোপঝাড়ও কম। মাঝে মাঝে পথের পাশে ছোট ছোট জলাভূমি। হাতি গতিপথ পরিবর্তন করল। নিজের খেয়ালে শুঁড় দিয়ে গাছের ডালপালা ভেঙে পথ পরিষ্কার করতে করতে এগিয়ে চলল বনের ভিতর। আকস্মিকভাবে ভুজঙ্গধরবাবু আমার হাতে চাপ দিলেন। তাড়াতাড়ি তার দিকে ফিরি। তিনি ইশারা করেন ডানদিকের জঙ্গলে। হ্যাঁ দেখতে পেলাম তাকে। সেই স্থূলচর্ম একশৃঙ্গীকে। যাকে দেখতে কাজিরাঙায় এসেছি। তার একটু বর্ণনা করি। দেহের তুলনায় পা চারখানা সরু। এমন চারখানি পা দিয়ে অতবড় দেহটাকে কেমন করে বয়ে বেড়ায় প্রাণীটা? চোখদুটো বেজায় ছোট। সে এদিকটায় মুখ করে গাছপালা চিবুচ্ছিল। তাহলে সে দেখতে পেয়েছে আমাদের। আর তাই বোধহয় খানিক খাওয়া দাওয়া থামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। তার মতলবটা কি? এখুনি খড়গ বাগিয়ে তেড়ে আসবে না তো?

    মাহুত আবার কথা বলে, 'কাজরঙার গঁড়বিলাকে (গণ্ডাররা) জানে, মানুহ (মানুষ) তাদের শত্রু নহয়। মানুহ কেবল তাদের চাবহে (দেখতে) আহে'।

    মাহুতের নির্দেশে হাতি এগিয়ে যায়। গণ্ডারের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব কমে আসছে। সে কিন্তু এক ঠায় দাঁড়িয়ে। লক্ষ্য করলাম ওর সারা গায়ে কাদা। কয়েক জায়গায় স্থূল চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছে।

    মাহুত বলে, 'এইটা বন-বিবাগী বুড়া গঁড়। অন্য গঁড় তাক আঘাত করি খেদি (তাড়ানো) পঠাইছে। দেখছেন না, ওর সারা দেহে আঘাতের চিহ্ন। দেহ থেকে তেজ (রক্ত) বের হচ্ছে। মার খেয়ে এখানে আশ্রয় লৈছে। মন রাখিব, মানুহ বুড়া হলে বনবাসী হয় আর বনবাসী গঁড় বুড়া হলে জনবসতিলৈ আহে।

    'এটা লোকালয় নাকি?'

    'হ্যাঁ, আচল অরণ্য আরু ভিতরত আছে। দুখন কাঠর দলং (সাঁকো) পার হব লাগিব। এটা (একটা) ডাঙর (বড়) জলাশয় আছে সেইফালে। জায়গাটা ওদের খুব প্রিয়। শরীর ঠাণ্ডা করিবলৈ গঁড়বিলাকে জলাশয়ে পছন্দ করে। দিনের বেশির ভাগ সময় দেহত বোকা (কাদা) লগাই ভালপায়।'

    আমি চিড়িয়াখানায় গণ্ডার দেখেছি। কিন্তু এত কাছ থেকে বনচারী গণ্ডার দেখিনি। তার চেহারাটা ভয়ঙ্কর হলেও আচরণ মোটেই তেমন নয়। সে আক্রমণের চেষ্টা না করে চুপচাপ চেয়ে রয়েছে--এরকম তো কখনও শুনিনি। হঠাৎ ডানলোপিলোর সিটগুলো একটু হেলে গেল। এরপর যে কাণ্ডটা হল তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ভুজঙ্গধরবাবু হাতির থেকে লাফ দিয়ে নেমে বিদ্যুৎগতিতে আহত গণ্ডারটার দিকে এগিয়ে গেল। ওর হাতে একটা ধারালো অস্ত্র। ওর অগ্রগতিতে গণ্ডারটা এবার বিরক্ত হল। তার পর পুরু জিভ দিয়ে তার অধর লেহন করে ঘুরে দাঁড়াল। ভুজঙ্গধরবাবু ছাড়বার পাত্র নয়। অস্ত্রটা শানিয়ে গণ্ডারটার মুখোমুখি হলেন। একটা বিশ্রি আশঙ্কায় দিশেহারা হয়ে চিৎকার করে উঠলাম, 'আপনি করছেন কী? ওকে ছেড়ে দিয়ে উঠে আসুন হাতিতে।'

    ভদ্রলোক উল্লাসের সঙ্গে চেঁচিয়ে বললেন, 'ওর শিংটা আমার চাই।'

    মাহুত হাঁ করে বিস্ফারিত চোখে ওদের দিকে চেয়ে আছে। একটা অসম লড়াই চোখের সামনে। প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী বনাম লোভী মানুষ। কিন্তু মাহুত কিছু বলবার আগেই গণ্ডারটা পিছু হটে গেল। লক্ষ্য করলাম ওর একটা পা ভাঙা। সেই ভাঙা পা নিয়েই সে উঁচু ঘাসবনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। মানুষ যখন নিজের চোখে কোনো ঘটনা দেখে, তখন তার অক্ষিপটে একটা ছবি তৈরি হয়ে যায়। ঘটনাটা সরে গেলেও ছবিটা কিছুক্ষণ তার মাথায় থেকে যায়। এই কিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পর ভুজঙ্গধরের উল্লাসধ্বনি আঘাত করল মাহুতের বিবশ অনুভূতিকে। সে চেঁচিয়ে উঠল, হৈ হৈ কোতগলি, নজাবি, নজাবি। আরও আধঘন্টা পর কর্তব্যভ্রষ্ট প্রহরীদের ঘুম ভাঙল। তারাও অকুস্থলে পৌঁছে ঘাসবনে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাহুত আমাদের এ্যালিফ্যান্ট পয়েন্টে পৌঁছে দিল।

    লাডিয়া হোটেলে ফিরে এসে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকলাম। তারপর জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেরবার তোড়জোড় শুরু করলাম। রাতের বাসেই গৌহাটি ফিরে যাব। পান্থনিবাসের 'অভ্যর্থনা' ঘরে দুধসাদা বিছানায় তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবির মোড়কে লাডিয়া আধশোয়া হয়েছিলেন। চিরকুটটা হাতে দিতেই আমার টাকার প্যাকেটটা ফেরত দিলেন। ইতস্তত করে বললাম, 'একা হাতে গণ্ডারের মোকাবিলা করা যায়?'

    লাডিয়া একটু আশ্চর্য হল। এরপর পুরো ঘটনার বিবরণ শুনে বলল, 'গুপ্তবিদ্যা সম্বন্ধে কোনো ধারণা আছে?'

    অকপটে স্বীকার করলাম, না কোনো ধারণাই নেই। স্মিত হেসে লাডিয়া বলল, 'অসমে একসময় তন্ত্র-মন্ত্র-বশীকরণ ও গুপ্তবিদ্যার অনুশীলন হত। আমাদের শরীরের ভিতর আরও একটা শরীর আছে। তার চেহারা হাত-পা সব আমাদের জড় দেহের মতোই তবে সেটা আধিভৌতিক আর অলৌকিক জগতের মাঝামাঝি এক সত্ত্বা। এই সত্ত্বার শক্তি অনেক বেশি। আপনার বন্ধু নিঃসন্দেহে এই দ্বিতীয় সত্ত্বা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

    ভুজঙ্গধরবাবু থাকলে হয়তো মন্তব্য করতেন--যত গাঁজাখুরি গল্প মশাই। তন্ত্র-মন্ত্র, গুপ্তবিদ্যার অনুশীলন। আমি অবশ্য তেমন কিছু বলতে পারলাম না। লাডিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিঃশব্দে বাসস্ট্যাণ্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।


    সাম সম্বন্ধে একটা কথা চালু আছে--আসাম ইজ্‌ এ স্টেট অফ্‌ লাহে লাহে। লাহে অর্থ ধীরগতি, মন্থর। কিন্তু আসামে রাতের বাসে চড়ে, এই কথাটা মনে আসতেই মনে হল প্রবাদটায় অতিরঞ্জন আছে। আসাম ট্রাঙ্ক রোড ধরে যখন 'নাইট সুপার' গুলো চলে তখন ভিতরে শুধু একটা গুমগুম আওয়াজ ওঠে। যাত্রীরা ঘুমের আড়ে ঢলে পড়ে। সজাগ শুধু ড্রাইভার আর কণ্ডাক্টর। বাইরে নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার। বাস ছুটে চলে দুরন্ত গতিতে। কোনো বাসের সঞ্চালক ব্লু-হিল, কোনোটার বা নেটওয়ার্ক। প্রত্যেক বাসের উইণ্ডস্ক্রীনে একটা দু-লাইনের শ্লোক। আমার বাসের সামনের কাঁচে লেখা—

           'আপকি জিন্দেগী হ্যায় বিস্কিট আউর কেকসে
           হামারি জিন্দেগী হ্যায় স্টিয়ারিং আউর ব্রেকসে।'

    নেটওয়ার্কের বাস যখন গৌহাটির পল্টন বাজারে পৌঁছালো তখন ঝাঁঝালো রোদ উঠেছে। বাস ঠিক সময় পোঁছালে কামরূপ এক্সপ্রেসটা পেয়ে যেতাম। ট্রেনটা গৌহাটি ছেড়ে যায় সকাল সাতটায়। নগাঁও পার হওয়ার পর থেকেই কোনো অজানা কারণে বাসের গতি শ্লথ হয়ে যায়। পল্টনবাজার আর পানবাজার, এই দুইয়ের মাঝখানে গৌহাটি রেলস্টেশন। ফুট-ওভার ব্রিজটা পার হতে গিয়ে, ভুজঙ্গধরবাবুর সঙ্গে দেখা। উনি আমাকে দেখেননি। ব্রিজের মাঝখানে অসম রাইফেল্‌স্‌-এর পুলিশ ওনাকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে! অবিন্যস্ত চুল, খালি পা, ধুতি-পাঞ্জাবি শতচ্ছিন্ন, সারা গায়ে কাদা। এমন চেহারা দেখেই হয়তো পুলিশ আটক করেছে। ওর হাতে একটা প্লাইউডের চৌকো বাক্স। অতি সন্তর্পণে পেরেক দিয়ে বন্ধ। পুলিশ বার বার ওটা খোলবার জন্য জেদ করছে। উনিও খুলবেন না। আমি ওদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতেই ব্যাপারটা একটা সমাধানসূত্র বের হল। বাক্সটার গায়ে লেখা 'ইউল স্পেশাল টী'।

    আমি বললাম, 'চা-য়কা বক্সা। ছোড় দিজিয়ে।'

    মঙ্গলয়েড মুখাবয়ব। লোকগুলো সন্দিগ্ধ। বেয়নেট উঁচিয়ে চেরা চোখে বলল, 'খোলিয়ে, ওপেন দ্য বক্স'।

    'খোলনেসে খারাব হো যায়েগা, ফ্লেভার উড় যায়েগা'।

    অত্যন্ত বিরক্তি সত্ত্বেও ওরা ভুজঙ্গধরবাবুকে ছেড়ে দিল। আমরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম স্টেশনের প্রতীক্ষালয়ে। প্রতীক্ষালয়ে পৌঁছে একটা কথা তাকে না বলে পারলাম না। 'গণ্ডারটা যখন আহত, আর ও যখন আপনার কোনো অনিষ্ট করেনি তখন ওর পিছনে ওভাবে তাড়া করলেন কেন?'

    ভদ্রলোক নিজের কুকীর্তি সমর্থন করে বললেন, 'নেপালের রাজা এই জাতীয় অরণ্যে একমাসে সাতানব্বইটা গণ্ডার মেরেছিলেন।'

    আগেই লক্ষ্য করেছি ভদ্রলোকের বন্যপ্রাণী সম্বন্ধে ভালো পড়াশুনো আছে। এর সাথে ইতিহাসটাও চর্চা করেছেন। কিন্তু আজ গলাটা যেন একটু ঘড়ঘড়ে শোনাচ্ছে। আমি হেসে বললাম, 'আপনি কোথাকার রাজা?'

    উনি একথার কোনো উত্তর না দিয়ে প্রতীক্ষালয়-সংলগ্ন শৌচাগারে ঢুকে পড়লেন। ফিরে যখন এলেন তখন তাঁর প্রায় উদোম শরীর। আণ্ডারওয়ার ছাড়া পরনে কিছুই নেই। লক্ষ্য করলাম ওনার শরীরের উপরিভাগ বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট, গায়ের চামড়া পুরু, বিরল কেশ, কাঁধের পুরু মাংসের মাঝে কয়েকটা ভাঁজ। পেটের কাছে একটা ক্ষত। সেখান থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে। কিন্তু এইসময়টা লড়াইয়ের পূর্ণ বিবরণ নেওয়ার সময় নয়। কামরূপ এক্সপ্রেস ধরতে পারিনি। পরের ট্রেন ব্রহ্মপুত্র মেল। তিনসুকিয়া থেকে গত রাতে ছেড়ে আসছে। বেলা এগারোটা নাগাদ গৌহাটি পৌঁছাবে। এরপর নমনি অসমের পথ ধরে তিনটি রাজ্য পার হয়ে দিল্লি পৌঁছাবে। এই ট্রেনে আমি মালদহ পর্যন্ত চলে যেতে পারব। ভুজঙ্গধরবাবুকে বললাম, 'আপনি তৈরি হয়ে নিন। আমি দুটো জেনারেল টিকিট কেটে আনি।'


    ট্রেন যখন গৌহাটি ছাড়ল তখন কামরায় লোকজন বিশেষ নেই। তিনসুকিয়া থেকে যারা এসেছিল তারা গৌহাটি নেমে পড়েছে। ভুজঙ্গধরবাবু কাঠের বাক্সটা বগলদাবা করে একটা বাঙ্ক দখল করে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরেই তাঁর অস্বাভাবিক নাসিকাধ্বনি সমস্ত কামরায় প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। কেমন যেন পশু পশু চেহারা মানুষটার। মুখ একটু হাঁ হয়ে আছে। সেই হাঁ করা মুখের ভিতর কালো কুচকুচে জিহ্বা। আমার বুকের ভিতর ধক করে উঠল। নাকে ঝাঁঝালো গন্ধও এসে লাগল। বিশ্রী গন্ধ। ঘোড়ার আস্তাবলে গেলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায়। গা গুলিয়ে উঠল। এই অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যেই ট্রেন রঙ্গিয়া স্টেশনে ঢুকে পড়ল। রঙ্গিয়া স্টেশনে আর. পি. এফ-এর একটা দল উঠল। পুলিশ ফোর্সটার সঙ্গে বেল্টে বাঁধা স্নিফার ডগ। ল্যাব্রাডর জাতীয়, পাকা ধানের মতো গায়ের রঙ। এই কুকুরের ঘ্রাণশক্তি খুব প্রবল। রেলে নাশকতা ঠেকাতে, বিশেষ করে বিস্ফোরক সনাক্ত করতে, এর জুড়ি মেলা ভার। ভুজঙ্গধরবাবুর কাঠের বাক্সের গন্ধ শুঁকেই তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দিল। তাকে ধরে রাখাই কষ্টকর। ততক্ষণে ভুজঙ্গধরবাবুর ঘুম ভেঙে গেছে। উনি প্রবল আক্রোশে কুকুরের দিকে তাকিয়ে গলা দিয়ে অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ করলেন। কুকুরটা অদ্ভুত শব্দ শুনে চেঁচানো বন্ধ করল। পুলিশ ফোর্সের একজন জিজ্ঞাসা করল, 'কেয়া হ্যায় বক্সামে?'

    আমি বন্ধুর হয়ে উত্তর দিলাম, 'চা-য়কা বক্সা'।

    এদিকে কুকুরটা দেখি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে আর কেঁউ কেঁউ করে ডাকছে। রেল পুলিশের দলটা ফিরে গেল। ব্রহ্মপুত্র মেল ছুটে চলল উত্তর-পশ্চিমে।

    ভুজঙ্গধরবাবু লোকটা স্বভাবতই একটু খামখেয়ালি ও ছিটগ্রস্ত। এখন যেভাবে উনি চায়ের বাক্সটা আঁকড়ে ধরে আছেন, মনে হচ্ছে ওর মধ্যে মহামূল্য কিছু আছে। বরপেটা-নলবাড়ি-নিউ বঙ্গাইগাঁ। বঙ্গাইগাঁ আসতেই আরেকপ্রস্থ রেলপুলিশের খানাতল্লাশি শুরু হল। যাত্রীদের স্যুটকেস, রুকস্যাক, অ্যাটাচি, হোল্ডল, বাঙ্কের উপর-নিচ, ট্রেনের সিলিং ফ্যান এমনকি শৌচাগার গুলোও বাদ গেল না। খানাতল্লাশি চলল কোঁকড়াঝাড় পর্যন্ত। ট্রেন ছুটে চলেছে বোড়ো ল্যাণ্ডের বুক চিরে। একটা দেশের মধ্যে যেমন অনেকগুলো দেশ থাকতে পারে, তেমন একই রাজ্যের মধ্যে অনেকগুলো আঞ্চলিক রাজ্য থাকতে পারে। কোঁকড়াঝাড়-বাসুগাঁও-গোসাইগাঁও, রেলপুলিশের টহলদারি চলতেই থাকে। ভুজঙ্গধরবাবুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। বাঙ্কে গা এলিয়ে কখনও ডান পাশ, কখনও বা বাঁ পাশ করে ঘুমোবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সেও আর হবার নয়। সম্ভবত ওনার জ্বর হয়েছে, হাই-ফিভার। কিছুতেই যেন ওনার অস্বস্তি কাটছে না। আমি উলটো দিকের বাঙ্কে বসে ওনাকে ভালো করে লক্ষ্য করছিলাম। আরে ওটা কী? এতক্ষণ তো লক্ষ্য করিনি। লোকটার পায়ের আঙুলের নখ কালচে ধরনের। নখের মাথা বাজপাখির মতো ছুঁচালো।

    ঘোর লাগা চোখে আমি কিছুক্ষণ বসে রইলাম। সন্ধ্যা আসন্ন--ডুবে আসা সূর্যের আলোয় রেল লাইনের দু-ধারে গোলাপি ও লাল রঙের খেলা। পশ্চিম আকাশে রক্তিম ছটা আমার চোখ এড়ায় নি। কিন্তু সে সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো মানসিক অবস্থায় আমি নেই। আমার সামনে এক অপার্থিব রহস্যময় চরিত্র শুয়ে আছে। আমি যা দেখছি তা এতই অস্বাভাবিক যে, সত্যিকারের কোনো সুস্থ মানুষ তাকে প্রকৃত ঘটনার মর্যাদা দিতে চাইবে না। গাড়িতে যে কয়েকজন যাত্রী ছিল তারা বিহারি সম্প্রদায়ের, ভোর রাতে কিষাণগঞ্জ নামবে। ওরা পাশের কূপে গলা মিলিয়ে ঈশ্বরের নামগান করছিল। অস্বাভাবিক তীব্র গতিতে ব্রহ্মপুত্র মেল ছুটে চলেছে। দিগন্তের নিষ্প্রভ সূর্যের সামান্য অংশ এখনও দেখা যাচ্ছে। ভুজঙ্গধরবাবু চিৎ হয়ে শোবার একবার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে পরিবেশ থেকে সমস্ত রঙ পলকে অদৃশ্য হল। এক দ্রুত কাঁপুনি দিয়ে ট্রেনের গতি শ্লথ হয়ে এল। পাশের কূপ থেকে একজন বিহারি বলে উঠল, 'আলিপুরদুয়ার আ গয়া, বঙ্গাল ঘুঁষ গয়া।'

    দুয়ার অর্থাৎ দরজা। ভুটান যাওয়ার দরজা। অদূরেই জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান। ওখানে ভালুকা নদীর পাড়ে শিশুমারা জঙ্গলে একশৃঙ্গীর বাস। কিন্তু আমার চিন্তা ভাবনা এই জাতীয় ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ রাখলে চলবে না। কারণ ট্রেনের দরজা দিয়ে উঠে আসছে আরও এক দল সশস্ত্র পুলিশ। আমি কালবিলম্ব না করে ভুজঙ্গধরবাবুকে জাগিয়ে দিলাম। বললাম, 'আবার পুলিশ আসছে'। অসীম বলে ভদ্রলোক নিজের শরীরটাকে গড়িয়ে ধীরে ধীরে চিৎ হয়ে শুলেন। এরপর এক অপার্থিব চাপা হাসিতে ফেটে পড়লেন। সে হাসিতে কিছুটা হিংস্র ছাপ আমার নজর এড়াল না।

    'কোনো পুলিশই আমার কাছে আসার সাহস করবে না।'

    আমি বললাম, 'তার মানে?'

    ভুজঙ্গধরবাবু আবার হাসলেন। কিন্তু পরমুহূর্তে বিদ্যুৎঝলকের মতন উঠে দাঁড়ালেন। তার চোখ দুটো ছোট হয়ে এল। ক্ষুদ্র চোখে অদ্ভুত সম্মোহন। গলা থেকে এক অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে শব্দ উঠে এল, 'গণ্ডার নিশাচর প্রাণী।'

    ভদ্রলোক কি নিজেকে গণ্ডার মনে করছেন! কিন্তু তার সম্মোহনী চোখ ও অদ্ভুত কথার মধ্যে নিঃসন্দেহে অলৌকিক কোনো রহস্য আছে। কিন্তু ওর দাঁড়ানোর অদ্ভুত বন্য ভঙ্গী আমাকে মুগ্ধ করল। কী ম্যাজেস্টিক? কী রাজকীয়।

    আলিপুরদুয়ারের রেলপুলিশ কিন্তু আমার কোনো ওজর-আপত্তি শুনল না। বেয়নেটের এক চাপে কাঠের বাক্স খুলে ফেলল। চায়ের বাক্সে চা নেই, আছে কেটে নেওয়া এক গণ্ডারের শিং। পুলিশ অফিসার বললেন, 'পোচার চোরাশিকারি, অ্যারেস্ট হিম।'

    ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। ভয়ংকর ঘটনা। কামরার যে জায়গাটা এক সেকেণ্ড আগেও ভুজঙ্গধরবাবু দাঁড়িয়েছিলেন, এখন সেখানে দাঁড়িয়ে এক প্রকাণ্ড নগ্ন মানুষ। দৈত্য বলা চলে। লম্বা হাত-পা, গায়ের রঙ কালচে, কাঁধে ও জঙ্ঘাদেষে কয়েকটা ভাঁজ, বৃহৎ মস্তক। দৈত্যের পেটের কাছে একটা কুৎসিত ক্ষত, সেখান থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। তাহলে কি এই সেই লাডিয়া বর্ণিত মানুষের দ্বিতীয় সত্ত্বা যার শক্তি অনেক বেশি!

    অনিচ্ছাসত্ত্বেও পুলিশের দলটা পিছিয়ে গেল। একজন পিছোতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছিটকে পড়ল। জীবনে এমন এক-একটা মুহূর্ত আসে যেখানে আতঙ্ক বাঁক নেয় সক্রিয় আচরণে। আমি এই সুযোগে, হয়তো বা আত্মরক্ষার তাগিদে, গণ্ডারের শিং সমেত বাক্সটা জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলাম। গাড়ি তখন গতি নিয়েছে।

    প্রচণ্ড হুঙ্কার ছেড়ে বিকারগ্রস্ত মানুষের মতন দানবটি আমাকে অনেক কিছু বলে গেল। সে ভাষা আমি বুঝি না। তবে নির্ঘাৎ বলতে পারি লোকটা আমাকে গালিগালাজ করছিল। এরপর বিস্ময়কর ক্ষিপ্রতায় রেললাইনের পাশের ঝোপটায় লাফ দিয়ে পড়ল। এরপর যেন চোখের সামনে বাতাসে মিলিয়ে গেল।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments