• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৩ | ফেব্রুয়ারি ২০১৩ | গল্প
    Share
  • জুন কিংবা সৈকতের গল্প : হাসান জাহিদ


    ।। ১ ।।

    ই বুড়ো বয়সে পড়াশোনা কি মানায়? তা-ও যে সে সাবজেক্ট নয়, একেবারে জার্নালিজম। স্মরণশক্তি কমেছে, এনার্জি আর আগের মতো নেই। তবুও পড়তে এল বদরুদ্দিন, মানে সে নিজের পায়ে কুড়াল মারল। না পড়লেও কুড়াল মারাই হতো। এখানে সবকিছু এমন বেকায়দা গোছের যে কিছু করলেও কুড়াল মারা হয়, না করলেও তাই। অতএব একটা কিছু করেই কুড়ালের আঘাত খাওয়া ভালো। অনেক বছরের অনভ্যস্ততায় ভেজালের জালে জড়িয়ে গেল বদর। ক্লাসে ঝিমোতে লাগল সে আর শৈশব-কৈশোরের স্কুল, তারুণ্যের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে লাগল।

    ওদের ব্লকে মোট তিনজন প্রৌঢ় আছে, ৪৫ থেকে ৪৮ যাদের বয়স। বদর, কলিম আর একজন হোয়াইট নারী, নাম অ্যালিস। অ্যালিস আবার এদেশীয় একজন কবি। কলিম বদরের চেয়ে সামান্য সিনিয়র আর অ্যালিসের সমান। কলিম আর অ্যালিসের মধ্যে কিছু একটা চলছে, যা বদর খেয়াল করেছে। অন্যরা খেয়াল করেনি। কিংবা খেয়াল করেছে হয়তো। এই অন্যদের বয়স ২৬ থেকে ৩০, যারা প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, লেখাপড়া আর জীবনকে উপভোগ করার সময় তাদের। কলিম আর অ্যালিস কী করছে আর এই ‘কী করছে’ নিয়ে কী ভাবছে বদর, তা নিয়ে ওদের মাথাব্যথা নেই। এই কারণে যে প্রথমত ওরা তরুণ, উদার ও কলুষতাহীন আর দ্বিতীয়ত ওরা এমন দেশের বাসিন্দা যারা অন্যের বিষয়ে নাক গলায় না। ওরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তিন বুড়োকে বাদ দিয়ে ওদের সংখ্যা ২৬, এর মধ্যে ১৭ জন ফিমেল আর ৯ জন মেল।

    এইদেশে আগমনের পর একটা রেস্তরাঁয় কাজ নিয়ে বদরের মনে হয়েছিল এরচেয়ে হাজতবাস অনেক ভালো ছিল। শেষে এক বাঙালি হিতৈষী তাকে পরামর্শ দিল সরকারের আর্থিক সহায়তা নিয়ে পড়াশোনায় ডুবে যেতে। বাড়তি ডিগ্রি হবে, সংসারও চলবে। পরবর্তীতে ডিগ্রি প্রাপ্তির বদৌলতে দশাসই কোনো চাকরি জুটেও যেতে পারে। বদর ভেবে দেখল, মন্দ কী? সে তরুণ বয়সের মতো আবার পড়াশোনায় যাবে, ফের তারুণ্যের ঝলকানিতে জীবনটাকে রঙিন ফানুসের মতো উড়াতে থাকবে!

    শেষে বদর লেখাপড়াতেই মন দিল। কিন্তু এরা অল্প কয়েকটি জ্ঞানের শাখাকে এমন কঠিনভাবে সাজিয়ে জটিলতম করে তুলেছে যে বদরের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হবার জোগাড় হলো। এর চেয়ে রেস্তরাঁর গাধার খাটুনি ঢের ভালো ছিল। তবুও লেখাপড়ায় মন দিতে চাইল বদর কিন্তু মনোযোগ বারবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সে ভগ্নচিত্তে দেখল যে কোনো এক জাদুবলে কলিম কাব্য রচনাও করছে আবার লেখাপড়ায়ও তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। অ্যালিসবিষয়ক কাব্য রচনা করে, ক্যাফেতে সময় পার করেও কলিম দিব্যি ভালো করে যাচ্ছে পরীক্ষায় ও অ্যাসাইনমেন্টে। কিন্তু বদর উতরাতে পারছেনা। অথচ সে তো রীতিমতো পড়ছে আর ক্লাস কামাই করছেনা। কলিমের ব্রেইন কি তারচেয়ে বেশি সচল?

    ‘না। তুমি ট্যালেন্টেড কিন্তু এস্কেপিস্ট।’ নিউজ রিপোর্টিং অ্যাসাইনমেন্টে ওর পার্টনার জুন বলল।

    ‘আমি মোটেও ট্যালেন্টেড না। অ্যাসাইনমেন্টে ভালো মার্কস পেয়েছি তোমার কারণে। আশা করছি বাকি অ্যাসাইনমেন্ট ক’টিতে তোমাকে পার্টনার হিশেবে পাব।’

    'নিশ্চয়ই।' জুন হেসে বলল।

    ‘আমার সাথে অ্যাসাইনমেন্ট করতে তুমি বোর ফিল করো?’

    ‘তোমার কনসেপ্ট ভাল, ইংরেজিও বেশ।’ বদরের প্রশ্নের ইনডিরেক্ট উত্তর দিল জুন, ‘আমি এদেশিয় হবার সুবাদে উপস্থাপনায় উতরে যাই। মনে হয় সামনের গ্রুপ ওয়ার্কগুলো ভালই করব।’

    'নিশ্চয়ই', খুশি হয়ে উঠল বদর।

    ।। ২ ।।

    দর নিশ্চিত হলো জুন থাকবে ওর সাথে। পরের দু’টি অ্যাসাইনমেন্ট উপস্থাপনা ভালো হলো, মার্কসও মিলল আশানুরূপ। কিন্তু এটা যে কলিমের গাত্রদাহ হয়ে উঠবে তা ভাবেনি বদর।

    ওর ব্লকের অপর বাঙালি কলিম বলল, ‘বদর, এখানে আপনার দেখি খুব কদর। আমার কপালে গোল্লা আর লাড্ডু জুটবে টার্ম টেস্টে।’
    ‘আমারও তাই, জুন ভালো স্টুডেন্ট, তাই ওর সাথে অ্যাসাইনমেন্টে ভালো গ্রেড পেয়েছি। টার্ম টেস্ট তো নিজেকেই সামলাতে হয়। সেখানে তো আর জবরদস্ত পার্টনার থাকেনা।’ বদর তারপর যোগ করল: ‘আপনি তো মিয়া গোল্লাছুট খেলতেছেন। আবার নাম্বারও ভাল পাচ্ছেন। অ্যালিসের সাথে বসেন আর কুইজের ফটাফট উত্তর মেরে দেন। কেমনে ম্যানেজ করেন? টেকনিকটা কী?’
    'আপনিও তো জুনের সাথে বসে উত্তর মেরে দিতে পারেন।'
    ‘আমি সেটা পারছিনা দেখতেই তো পাচ্ছেন। জুন মনে করে কুইজে ওর হেল্প আমার দরকার নেই। ওর এই ধারণাটা ভাঙ্গাতে পারছিনা। সেদিন বলেছিলাম যে আমি কুইজে দুর্বল, ওর সাথে বসে উত্তর দেখব। শুনে জুন এমনভাবে হাসল মনে হলো গালে একটা থাপ্পর কষিয়ে দিই। ও সিরিয়াসলি নেয়নি বিষয়টা। অ্যালিস আর আপনি সমবয়সি, গোল্লাছুট খেলে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ঝালিয়ে নিয়েছেন।’

    ****

    প্রথম সেমিস্টার পার হয়ে দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়ল বদরদের ব্লক। পাঁচ কোর্সের একটাতে ডাব্বা মারল বদর। এই কোর্সটা পরে আবার করতে হবে। ক্যাফেটারিয়ায় বসে কফির পর কফি ধ্বংস করেও বদর কারণ উদঘাটন করতে পারল না। অথচ...অথচ কলিম কেমন করে উতরে গেল! কোন্‌ জাদুর বলে!

    ক্যাফের টেবিলে কফির মগ নিয়ে কাচের বাইরে তাকিয়ে বসে ছিল বদর। একটা কিছুর নড়াচড়া টের পেয়ে তাকাতেই দেখল কলিম ফ্যা ফ্যা করে হাসছে। মাথা গরম হয়ে গেল বদরের। বলল, ‘গোল্লাছুট খেলার বিষয়টা ভাবিকে জানিয়ে দেব, বুঝলেন?’

    কলিম বলল, ‘আমি একলাই গোল্লাছুট খেলতেছিনা, আপনিও খেলতেছন।’

    আকাশ থেকে পড়ল বদর, ‘আমি খেলছি!’
    ‘আলবত খেলছেন। জুনের সাথে আপনি ফস্টিনস্টি করছেন, এটা আমিও ভাবিকে জানিয়ে দেব।’
    ‘জুনের সাথে প্রেম! কী আশ্চর্য, কবে প্রেম করলাম! আরে ও তো একটা পুঁচকে মেয়ে! এরকম ডাহা মিথ্যে আমার ওয়াইফ বিশ্বাস করবে না।’
    ‘আমার ওয়াইফ যদি বিশ্বাস করবে বলে আপনি মনে করেন, তবে আমার কথা ভাবি, মানে আপনার ওয়াইফ কেন বিশ্বাস করবে না? এখানে এসে আমাদের বাঙালি গৃহবধূরা সবসময় স্বামীদের সম্পর্কে অন্যের বলা কথা বিশ্বাস করার জন্য মুখিয়ে থাকে। মানে, আগে তারা বিশ্বাস করবে। তারপর সেটা ভালো কি মন্দ পরে যাচাই করবে।’

    বদর ভাবছিল কফির পেয়ালাটা কলিমের মুখে ছুড়ে মারবে কিনা। কিন্তু কলিম তারপর বন্ধুভাবাপন্ন স্বরে, খানিকটা হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘বদর, শুরু করেন প্রেমের খেলা। গোল্লাছুট খেললে মাথাটা খুলে যাবে।’
    ‘আপনি বলছেন?’ বদর নিরক্ষর চাহনি মেলে তাকাল।
    ‘বলছি,’ কলিম বলল।
    ‘কিন্তু জুন যদি রাজি না হয়? ওর রাজি হবার কোনো কারণও তো দেখছিনা।’
    ‘এইরে সেরেছে, জুনের কথা আসছে কেন! আর কোনো মেয়ে নেই!’
    ‘চিনি তো এক জুনকেই, হাতের কছেই তো আছে। তাই। কিন্তু কীভাবে উপস্থাপন করব?’
    ‘আপনি কি বলে-কয়ে প্রেম করবেন নাকি। প্রেম একটা আর্ট। বিমূর্ত চিত্রের মতো। নানা ছলাকলা করে ভাও করে ফেলবেন। আপনার মতো ঝুনা নারকেলকে কীভাবে প্রেম করতে হয় আমার শিখিয়ে দেয়া সাজে না।’

    ****

    কিন্তু কেন এমন হলো? বদর ভাবছিল--যেখানে দু’জন বাঙালি আছে, আলোচনা করে, সিদ্ধান্ত নিয়ে পড়াশোনাটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু উল্টো হলো কেন? পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ দু’জনকেই অসহিষ্ণু করে তুলেছে? নাকি এইসব চাপ উজিয়ে কে কেমন করে পার পেয়ে যাবে, তার একটা দৃশ্যমান প্রতিযোগিতা পরস্পরকে শত্রুভাবাপন্ন করে তুলল?
    কলিমের মধ্যে একটা যুদ্ধংদেহি ভাব আছে। বদর বলেছিল যে, একটু চেষ্টা করলেই ভালো রিপোর্ট তৈরি করে ভালো নাম্বার পেতে পারি, কী বলেন? কলিম মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিল। কিন্তু জার্নালিস্টিক সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি ও গ্লোবাল জার্নালিজম দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে কলিম কিছুতেই একমত হলোনা। শেষে পর্বতের মুষিক প্রসবের মতো দু’জনে মিলে যে প্রোডাকশন টিচারের হাতে তুলে দিল সেটা দেখে যুবক টিচার দুই প্রৌঢ় ছাত্রের দিকে ব্যঙ্গ দৃষ্টিতে তাকাল।

    ****

    শালা কলিম কি কিছু টের পেল নাকি? মনে হয় না। তবে, অ্যালিস বোধহয় কিছুটা সন্দেহ করেছে। করিডোরে সেদিন দেখা হতেই অ্যালিস জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাডার, তুমি আমাদের ছবি তুলেছিলে নাকি?’ স্রেফ অস্বীকার করে গেল বদর। বলল, ‘আরেনা, আমার সেলফোনটা ভাইব্রেট করছিল, তাই পকেট থেকে বের করে দেখছিলাম কে কল করল। আমি তোমাদেরকে না বলে ছবি তুলতে যাব কেন?’ অ্যালিস লজ্জা পেয়ে বলল, ‘আই অ্যাপোলোজাইজ, ব্যাডার।’ একটা উদার হাসি দিয়ে বদর বলল, ‘ইট’স ওকে অ্যালিস।’ বদরের ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে হলো। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় চলমান বিয়ার ফেস্ট-এ যোগ দিল। কুপন নিয়ে, তারপর দুইরকম বিয়ারের গ্লাস হাতে গাছের নিচে পিকনিক টেবলে বসে বিয়ার সেবন করতে করতে আনন্দঘন পরিবেশটুকু উপভোগ করতে লাগল। কড়া ঠাণ্ডা থাকলেও বাইরেটা রৌদ্র করোজ্জ্বল। কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে দু’দিন ধরে বিয়ারের উৎসব চলছে। তাতে যোগ দিচ্ছে সবাই। শুধুই বিয়ার। ওয়াইন উৎসব নয়। তবুও কর্তৃপক্ষ দু’জন সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ করেছে। ওদের এই ক্রিয়েটিভ কমিউনিকেশন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন শাখার অসংখ্য শিক্ষার্থী, স্টাফ ও কয়েকজন টিচারও যোগ দিয়েছে।

    বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে বদর আপনমনে বলল, ‘এবার টের পাবে বাছাধন। ভাবি নাকি বিশ্বাস করবে না! করবে না আবার। ছবিটা দেখিয়ে দেব।’ বদর হৃষ্টচিত্তে ভাবছে: বলাটা শেষ করার আগেই কলিমের বউ বিশ্বাস করে বসবে। তায় এতবড় প্রমাণ তার হাতে আছে। তারপর কলিম প্রতিশোধ হিশেবে বদরের বউকে বদর সম্পর্কে উল্টোসিধে বলবে। বদর তখন প্রমাণ দিতে বলবে। কলিম প্রমাণ দিতে পারবেনা। কিন্তু বদর কলিমের কেইসটার হাতেনাতে প্রমাণ দিতে পারবে। ভাগ্যিস সেদিন লাইব্রেরিতে ঢুকেছিল!

    জার্নালিজম এথিক্‌স বইটা খুঁজতে বদর লাইব্রেরিতে ঢুকেছিল। পার্টিশনের আড়ালে, একেবারে নিভৃত কোণে কলিম আর অ্যালিসকে বিশেষ একটা দৃশ্যে ধারণ করে ফেলল বদর তার স্মার্টফোনের ৮ মেগাপিক্সেল ক্যামেরায়। অ্যালিস-এর স্বামী বিয়োগ হয়েছে তিনবছর আগে। কোনো সন্তান নেই তার। বাকি জীবনটা সে নাকি স্বামীবিহীন কাটিয়ে দেবে। তাই আপাতত সে পতিহীন। এমনিতে কবি-মহিলা, রোম্যান্টিক ভাব ভরে করে। মাঝেমধ্যে কামনা মাথাচাড়া দেয়। এইসব সাতপাঁচ ভেবে অ্যালিস সহজ শিকার কলিমকে ঘুরাচ্ছে নাকে দড়ি দিয়ে।

    বিয়ার হাতে কলিম এসে সামনে দাঁড়াল। বেশ হর্ষোৎফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে। বদর বিয়ারে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার পার্টনার কই? মানে আপনার প্রেমিকা।’
    ‘প্রেমিকা বিয়ার খাবেনা বলল, বিয়ার তার পছন্দ নয়। তা আপনার জুন কোথায়, আসেনি বুঝি?’
    ‘আসবে না কেন, এতক্ষণ তো আমার সাথেই ছিল।’ উদার হেসে বদর বলল, ‘এতটুকুন মেয়ে এত বিয়ার খেতে পারে!’
    ‘কই দেখলাম না তো!’ কলিম কেমন ভেবড়ে গিয়ে চারদিকে এলোমেলো চোখে তাকাল।
    ‘ভিড়ের মধ্যে আপনি খেয়াল করেননি। আমরা ওই গাছটার পেছনে ছিলাম। মেয়েটা আজকে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড করে বসল।’ বদর খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে।
    ‘মানে! যাচ্ছেতাই কাণ্ডটা কী?’ কলিমের চোখেমুখে কৌতুহলের ঢেউ খেলে গেল।
    ‘পাগল মেয়েটা হুট করে...মানে, চুমু খেয়ে বসল। বিয়ারের প্রভাবে কিনা কে জানে। এখন পালিয়েছে।’ পরপর দুইবার বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিল বদর।

    শতকরা সাত ভাগ অ্যালকোহলের প্রভাবে লালচে হয়ে যাওয়া কলিমের মুখটা বিবর্ণ রূপ ধারণ করল। ঢোক গিলল সে, বিড়বিড় করে বলল, ‘আপনার প্রেমিকা আপনাকে চুমু খাওয়া শুরু করল। আর এদিকে আমার প্রেমিকা আমার কাছ থেকে কয়েকদিন যাবৎ দূরে দূরে থাকছে।’
    ‘ও কিছু না। এটা অভিমান। একটা বড়সড় গিফ্‌ট দিয়ে দেন ঠিক হয়ে যাবে সব। এতদিন তো শুধু কফি খাইয়ে মহিলাটার সাথে প্রেম করে গেছেন। শুধু কফির ওপর ভর করে প্রেম টেকে না। কিছু খরচাপাতি করেন।’
    ‘তাই করতে হবে মনে হয়,’ কলিম উদাসীন স্বরে কথাটা বলে অন্যদিকে চলে গেল।
    ‘রোসো বাছাধন। আমার দূরপাল্লার মিশাইলটা আপাতত অস্ত্রাগারে রেখে দিয়েছি, সেটা সময়মতো নিক্ষেপ করব।’ বিড়বিড় করে বলল বদর।

    এসময় জুনকে দেখা গেল ওর দিকেই আসছে। রোদ ঝলোমলো পরিবেশে সবুজ ঘাসের পটভূমিকায় যেন বিশাল কোনো প্রজাপতি উড়ে আসছে। বদর মুগ্ধচোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। জুন সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। সে যেন অনেক কথা নিয়ে এসেছে কিন্তু একটা কথাও বলতে পারছে না। বদর বিস্তৃত হাসি দিয়ে বলল, ‘তোমার জন্য বিয়ার নেব?’ জুন বলল, ‘না, ব্যাডার, মানে তোমাকে একটা কথা বলতে এলাম।’ জুন চঞ্চল চোখে চারপাশে তাকাল, ‘তোমার বন্ধু কোথায়? মানে কলিম?’
    ‘কলিম এখন এখানে নেই। বোধহয়, লাইব্রেরিতে অ্যালিসকে খুঁজতে গেছে।’
    ‘তোমাকে একটা কথা জানাতে এলাম। আমি বলেছি সেটা বলোনা। মানে তোমার কয়টা কোর্সে যেন ডেফিসিয়েন্সি আছে?’
    ‘আমার? কয়টা হবে কেন জুন!’ বদরের আঁতে ঘা লাগল। বলল, ‘একটা। সেটা আমি সময়মতো করে নিতে পারব। আসলে ফাঁকি দিয়েছি বলে একটু খারাপ হয়ে গেল।’
    ‘আর কলিমের কয়টা জানো? দুইটা। আমি বলেছি বলো না, ঠিক আছে?’

    বদরের বলতে ইচ্ছে করল, নিশ্চয়ই সোনা, আমি বলব না। মেয়েটা ওকে নিয়ে ভাবছে। ও জানে, বদর রেজাল্টের বিষয়ে ভীষণ টেনশন করছিল। একটা খবর এনে দিয়ে সে বদরের টেনশন দূর করতে চাইছে! বদর ওর দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকাতেই মেয়েটা চোখ নামিয়ে নিল। বদর জুনের কাঁধে হালকাভাবে হাত রেখে বলল, ‘ধন্যবাদ জুন, তুমি আমার জন্য ভাবছ।’
    ‘আমি যাই,’ বলে জুন রীতিমতো দৌড়ে পালাল স্থানটা থেকে। প্রেম! ভালবাসার প্রথম ধাপ! হাতে ধরা অর্ধেকটা বিয়ার একবারে গলাধঃকরণ করে বদর আরো দুই গেলাসের একটা কুপন নিল। তারপর, ঝিমঝিমে আবেশে বলে উঠল, ‘আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাব।’

    ।। ৩ ।।

    বি বলল, ‘এই রবিবারে তো তুমি ফ্রি আছো, তাইনা? আমরা ওয়াসাগা বিচে বেড়াতে যাব। মুন্নি আপার সাথে কথা হলো। বাসেদ ভাইয়ের ডিউটি নেই। তাদের গাড়িতে যেতে পারব, যাবে?’
    ‘হুম, যাওয়া যায়। কিন্তু তোমার তো বিকিনি মানে বক্ষবন্ধনী আর প্যান্টি নাই।’ বদর হালকা চালে বলল।
    ‘মানে! বিচে সবাই যায় শুধু বিকিনি পরার জন্য?’ ছবি উষ্ণস্বরে বলল।
    ‘মোস্টলি তাই। বলছিলাম একা একা প্রোগ্রাম ফাইনাল করে ফেললে, ভাবলাম বোধহয় আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছ।’
    ‘সেটা করলে যদি তুমি খুশি হও, তাহলে তা-ই করব।’
    ‘তোমার বাসেদ ভাইয়ের সাথে কথা পাকা করেছ? মানে সে যেতে রাজি তো?’
    ‘আমার বাসেদ ভাই আবার কী! তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ। সে এখানে আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর হাজব্যান্ড। আমার একার বাসেদ ভাই হতে যাবে কেন?’ ছবি বদরের ঘাড়ের ওপর পড়ে আর কি, ‘দিন দিন সীমা লঙ্ঘন করছ তুমি। ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পর থেকে তোমার মধ্যে বাজে অভ্যাস দেখা দিয়েছে। কোনো মেয়েকে কায়দা করেছ নাকি।’
    ‘হুম। খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই। তুমিই আজকাল পাত্তা দিতে চাও না। তা এখনকার কচি খুকিরা আসবে আমার সাথে প্রেম করতে!’ বদর ভাবুক গলায় বলল।
    ‘মুন্নি আপাকে তবে না করে দিই, তারা আজকেই কনফার্ম করতে বলেছিল।’
    ‘না করবে কেন। বলো, আমরা যাচ্ছি।’

    মধ্য অগাস্টের এক সকালে দুই ফ্যামিলি রওনা দিল ওয়াসাগা বিচের উদ্দেশ্যে। মুন্নি আপা ও বাসেদ ভাই সন্তানবিহীন। অন্যদিকে বদর আর ছবি তাদের একমাত্র সন্তান প্রিয়াঙ্কাকে কোনোভাবেই রাজি করাতে পারল না। প্রিয়াঙ্কা নাইন্থ গ্রেডে পড়ে আর ইতোমধ্যেই তার একটা নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়ে গেছে।

    টরোন্টো ছাড়িয়ে সিমকো কাউন্টিতে প্রবেশ করল ওরা। টরোন্টো থেকে প্রায় দুইঘন্টা লাগে বিচে পৌঁছুতে, ডাউনটাউন থেকে এর দূরত্ব ১৩০ কি.মি. বা ৮১ মাইল। পৃথিবীর দীর্ঘতম ফ্রেশওয়াটার সী-বিচ ওয়াসাগা। যাকে বলে চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন। এই প্রথমবারের মতো নিজচোখে কানাডার প্রকৃত গ্রাম আর গ্রামীণজীবন দেখল বদর। পুরো সিমকো কাউন্টিজুড়ে একই দৃশ্য--দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, র‌্যাঞ্চ, ভুট্টাখেত, গোরুছাগল, ঘোড়া আর খামারবাড়ি।

    বাসেদ ভাইয়ের ডজ ক্যারাভানে চড়ে চারটি প্রাণি--বদর ও ছবি এবং বাসেদ ভাই, মুন্নি আপা বিচে এল। সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। বিচ জুড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে বিচভক্তরা। বাসেদ ভাই আগেও একবার এখানে এসেছিল। বলল, বিকেলের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে মাতামাতি, উল্লাস, মদ্যপান, সঙ্গীত-নৃত্য। আর নৃত্যের তালে-তালে আলিঙ্গন ও চুর হয়ে পড়ে থাকা।

    বিচটাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে হোটেল, মোটেল, ইন ও দোকানপাট। বাসেদ ভাই ক্যানাডা-ডেতে একবার এসে নাকি মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে পিঠটান দিয়েছিল। সেই অবস্থাটা কল্পনা করে বদর আগমনের সময়টাতে ছড়ানো-ছিটানো স্বল্পসংখ্যক সাগর-বিলাসীদের দেখে খুশি হয়েউঠল। অগাস্ট মাসটা সরব থাকবে বিচ। তারপর থেকে সাগর অনুরাগীদের সংখ্যা কমতে থাকবে। বাংলাদেশে শীতের শুরুতে সবাই যায় কক্সবাজারে, আর এখানে সবাই যায় গ্রীষ্মে। কারণ এখানকার ঠাণ্ডার সময় ভূতেরাও পারতপক্ষে সমুদ্রচারী হতে চায় না।

    সিমকো কাউন্টির ওয়াসাগা বিচ একটি শহর। শহরটা মূলত গড়ে উঠেছে সী-বিচকে কেন্দ্র করেই। বদর প্রকৃতিপ্রেমিক। সে রীতিমতো মাতোয়ারা হয়ে উঠল।

    বোর্ডে দেয়া তথ্যগুলো পড়তে লাগল বদর: ১৪ কি.মি. দীর্ঘ শাদা বালিময় এই বিচটি নটাওয়াসাগা বে আর সর্পিল আকৃতির নটাওয়াসাগা নদীজুড়ে অবস্থিত। আন্তর্জাতিক পরিবেশগত মানমাত্রা বজায় রেখে শোরলাইনের দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য ওয়াসাগা বিচ প্রভিন্সিয়াল পার্ক কানাডার ব্লু ফ্ল্যাগ মর্যাদা পেয়েছে।

    রাস্তাঘাট, পার্ক, রিসোর্টস--সব আয়নার মতো পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। আর এই সাগরের (ইনল্যান্ড সী) পানি তো একদম বোতলজাত পানির মতো স্বচ্ছ।

    গাড়িতে খাবার, বিচ চেয়ার, কাঁথা-বালিশ সবই নিয়ে এসেছে দলটা। আর নিয়ে এসেছে পোলাও, রোস্ট, চিকেন টিকিয়া, গোরুর গোশত, বিস্কিট, কোল্ড ড্রিংকস প্রভৃতি। পার্কের উঁচু স্থানে, গাছের ছায়ায়, জঙ্গলের পাশে চাদর-বালিশ-চেয়ার পেতে পেটপুরে দুপুরের খাবার খেল চারজনে।

    অজস্র ছবি তুলল, সেলফোনে, ডিজিটাল ক্যামেরায়। খাওয়াদাওয়ার পর পানিতে নামল তিনজন। বদর একটা শর্টস নিয়ে গিয়েছিল। সে সাগরের অনেকটা গভীরে চলে গেল। বাসেদ ভাই পানিতে নামেনি। ছবি ও মুন্নি আপা কিনারের দিকে খানিকটা নেমে হাত-পা ভিজিয়ে তারপর উঠে এল। ছবি বদরের খুব কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি তো বলেছিলে। এখন কি জামাটা খুলে ফেলব? নিচে ব্রেসিয়ার আছে। বাসেদ ভাই আর মুন্নি আপার সামনে গিয়ে দাঁড়াব, কেমন?’ বদর গম্ভীর হয়ে বলল, ‘সে তোমার ইচ্ছে।’ তারপর গম্ভীর ভঙ্গিতে অন্যদিকে চলে গেল।

    বদর একটা রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার নিয়ে গিয়েছিল। সত্যিকার হেলিকপ্টারের মতোই দেখতে। এটার মোট চারটি রোটর ব্লেড। প্রথম দু’টো ব্লেডের ওপর আরো দু’টো, সবচেয়ে ওপরে একটা ব্যালান্স বিম। রিমোটের বিভিন্ন অপশন টিপে এটাকে আকাশে উড়ানো যায়, নামিয়ে আনা যায়।

    পানিতে, বিচে, শুয়ে ছিল সংক্ষিপ্ত পোশাক-পরা (কোনোভাবে লজ্জা নিবারণ করার মতো) অসংখ্য নারীপুরুষ ও শিশু। একই পোশাকে, শুধুমাত্র সংক্ষিপ্ত ব্রা আর প্যান্টি-পরা অসংখ্য তরুণী-কিশোরী, এমনকি বুড়িরাও ঘুরে বেড়াচ্ছিল রাস্তায়, দোকানপাটে, বিচে।

    বদরের মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। ছবির কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছে বদর। ওদেরকে দেখা যাচ্ছে না অনেক মানুষের ভিড়ে। হয়তো ছবি ব্রা পরে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছে আর বাসেদ ভাই ফটাফট ছবি তুলে যাচ্ছে। বদর আনমনে হেলিকপ্টার উড়িয়ে দিয়ে সেদিকে চেয়ে ছিল। একসময় বাটন থেকে হাত সরে যেতেই টুপ করে সেটা বালিতে পড়ল।

    বদর ধীরপায়ে কপ্টারটা কুড়িয়ে আনতে গেল। এক তরুণী বিকিনি পরে, গায়ে আচ্ছামতো বালি মেখে শুয়ে ছিল। তার পায়ের কাছে নিথর হয়ে পরে ছিল খেলনাটা।

    ‘সরি, তোমার গায়ে লাগেনি তো,’ বলে কপ্টারটা কুড়িয়ে নিতে গিয়েই চমকে ওঠে বদর। এ যে জুন!
    ‘জুন, তুমি!’
    ‘আমিও তো তাই ভাবছি, তুমি এখানে!’ জুন বলল, ‘আগে থেকে প্রোগ্রাম ছিল, না হঠাৎ করেই এলে? তোমার সাথে আর কে আছে?’
    ‘অনেকটা অনির্ধারিতভাবেই আসা হলো।’ বদর জুনকে সবটা খুলে বলল জগাখিচুড়ি ভাষায়--তার মধ্যে মিশ্র অনুভূতির ঢেউ খেলছে জুন ও ছবিকে ঘিরে।

    ...ছবি কী এখন কী করছে? এখনও কি সে ব্রা’র মহড়া দিয়ে যাচ্ছে? বাসেদ ভাই কি এই সুযোগে ক্লান্তিহীন ছবি তুলে যাচ্ছে? সে কি মুন্নি আপাকে অন্য কোনো দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে? হয়তো বউকে বলেছে, গাড়ি থেকে কি আমার পানিতে নামার ড্রেসটা নিয়ে আসবে? আমি পানিতে নামব।

    ‘তুমি কি কিছু ভাবছ, ব্যাডার?’ জুন বলে উঠল।
    ‘এ্যাঁ! না, না। কিছু ভাবছিলাম না।’ বদর দেখল জুন একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর বিকিনির নীল সবুজ কালো রেখাগুলো রোদে ঝকঝক করছে। জুনের পাশে দাঁড়ানো একজন তরুণ। তরুণের মুখে হাসি, চোখে আগ্রহ আর সে তাকিয়ে আছে বদরের দিকে। তার পরনে শর্টস। লম্বা ফর্সা ধবধবে শরীরটা যেন মোমের তৈরি। জুন বলল, ‘ব্যাডার, মিট মাই ফ্রেন্ড।’
    ‘হাই,’ কোনোক্রমে বলতে পারল বদর। জুন তার ছেলে বন্ধুকে বলল, ‘মার্ক, ব্যাডার আমার সাথে পড়ে।’ মার্ক বিরাট থাবা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘নাইস মিটিং ইয়্যূ।’
    ‘নাইস মিটিং ইয়্যূ।’ বদর বলল অনেকটা ঘোরের মধ্যে।

    ****

    জুনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বদর বিস্রস্ত ভঙ্গিতে পা টেনে টেনে ছোট্টো দলটার কাছে পৌঁছুল। ছবি কীসব বলে যাচ্ছিল। সেসব কথা অর্থহীন শব্দসমষ্টির মতো বদরের মস্তিষ্কে বিজাতীয় ঝঙ্কার তুলছিল।

    একসময় ফিরে চলল সবাই। ওদের গাড়িটা তরতর করে এগিয়ে চলল। বাসেদ ভাই গান ছেড়ে দিয়েছে। গাড়ির সবাই শব্দহীন। বদরের চোখে ভাসছে সৈকতের চিত্রবিচিত্র দৃশ্য। হঠাৎ মনে পড়ে, সে তার সাধের হেলিকপ্টারটা ফেলে এসেছে সৈকতে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)