ইতিহাসের প্রারম্ভে, প্রায় ৫০০০ বছর আগে, সেখানে ছিলো একটি ছোট্ট গ্রাম। উঁচুনীচু মরুভূমির অভ্যন্তরে একটি সবুজ উপত্যকার মধ্যে খেজুর ও জলপাই গাছে ঢাকা গ্রামটিতে ঠিক কী ছিলো যা মোজেস, আব্রাহাম, যিশুখ্রিস্ট থেকে মহম্মদ পর্যন্ত সবাইকে আকর্ষণ করে এসেছে? এখানকার মাটিতে কী আছে যা তিন-তিনটে বিরাট ধর্মের জন্ম দিয়েছে?
স্বর্ণসৌধ -- ডম অফ দ্য রক
|
শহরের গা ঘেঁষে উঁচু টিলা--'মাউন্ট অফ অলিভ'; এখান থেকে সারা জেরুসালেম দেখা যায়। দেখা যায় পাথরে গাঁথা ৫০০০ বছরের পুরোনো শহর (Old City) ও তার মধ্যমণি সোনার পাতে মোড়া Dome of the Rock, সকালের সূর্যের আলোয় ঝকমক করছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্ক হয়ে যাই। যিশুখ্রিস্টও ঠিক এখানে থেকে ২০০০ বছর আগের জেরুসালেমকে দেখেছিলেন। কেমন ছিলো শহরটা তখন? গির্জার চূড়া ও মসজিদের মিনার হতে তখনো অনেক দেরি।
পুরোনো শহরের আশেপাশে তখন ছিলো শুধু কাঁটাঝোপ। আজকের মতো রাস্তাঘাট, অট্টালিকার চিহ্নও ছিলো না। তখনও কি যিশু জানতেন নিয়তি তাঁকে কোথায় নিয়ে যাবে? ওই জেরুসালেমের মধ্যে দিয়েই ভারি ক্রস পিঠে চাপিয়ে যিশুকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।
ভিয়া ডলোরোসা, যে-পথে যিশুকে নিজের ক্রস বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিলো
|
তাঁর যাওয়ার রাস্তাটি--Via Dolorosa--সযত্নে সংরক্ষিত। পথের ধারে নম্বর দেওয়া ফলকে লেখা কোথায় যিশু একটু বিশ্রামের জন্যে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, বা কোথায় তিনি হোঁচট খেয়ে পরেছিলেন বা কোথায় কেউ তাঁকে খাবার জল দিতে যাওয়ায় রোমান রক্ষীদের হাতে গঞ্জনা সয়েছিলেন।
৬-নং 'স্টপ'-এ ভেরোনিকা তৃষ্ণার্ত যিশুকে জল দিতে চেয়েছিলেন
|
এই পথে প্রতিদিন পুণ্যার্থীরা প্রার্থনা করেন। ইস্টারের সময়ে অনেকেই রক্তাক্ত গায়ে পিঠে ক্রস বেঁধে সারা রাস্তাটা পরিক্রম করেন।
চার্চ অফ হোলি সেপালক্র
|
রাস্তাটি শেষ হয়েছে খ্রিস্টানদের সবথেকে শ্রেষ্ঠ পুণ্যভূমি Church of the Holy Sepulchre-এ। গির্জাটিতে বেশি চারুচিক্য নেই। এটার অবস্থান পুরোনো দেয়ালের ঠিক বাইরে। এইখানেই নাকি তাঁর মৃত্যুর পর যিশুর মরদেহ আনা হয়েছিল। এখানে তাঁর দেহটি পরিচ্ছন্ন করে কবরস্থ করা হয় এবং এখানেই তাঁর পুনর্জন্ম (Resurrection) হয়।
যিশুর সমাধিস্থল ও তাঁর মরদেহ যে টেবিলে রাখা হয়েছিলো
|
গির্জার বড়ো হলটির নীচে মাটির গভীরে একটি পাথরের টেবিলের মতো জিনিসের উপরে যিশুর দেহটি পরিষ্কার করা হয়। আমি দাঁড়িয়ে অভিভূত হয়ে দেখলাম সবাই ওই পাথর ছুঁয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছে, যেন এইমাত্র এক অতিপ্রিয় স্বজনকে চিরবিদায় দিয়ে এল। আসল কবরটির বা দেহর তো কোনো চিহ্ন নেই কিন্তু কবরস্থানের বিরাট পাথরের চাঁই দেখা ও ছোঁয়া যায়। গির্জাটি পরে এই কবরস্থানের উপরেই গড়ে তোলা হয়।
এ তো গেল খ্রিস্টানদের কথা। এ-ছাড়াও পুরোনো শহরে আছে ইহুদী ও মুসলমানদের ধর্মের ইতিহাস। প্রায় ২০০ একরের মতো ছোট্ট জায়গা--পুরোনো জেরুসালেম--কিন্তু এই তিনটি বিরাট ধর্মের রক্তাক্ত ইতিহাস তার প্রত্যেকটি পাথরে লেখা। জায়গাটি গলির গলি, তস্য গলিতে ভরা। গাড়িঘোড়া বিশেষ ঢোকে না, তার উপায়ও নেই, কাজেই পায়ে হেঁটেই আসে সবাই। এবড়ো-খেবড়ো পাথরে আধো-অন্ধকার গলির পথগুলি বাঁধানো--হাজার বছরের পায়ে পায়ে এখন মসৃণ। নীচের তলায় রাস্তার ধারে সার বেঁধে দোকান--জামাকাপড়, সুগন্ধী সেঁকা-রুটি ও অন্যান্য খাবার, সুরভিত মশলাপাতি--যা হাজার বছর ধরে দূর-দূরান্তের দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে; হয়তো চীন ও ভারতের সিল্ক-রুট দিয়েই এসেছে এগুলো।
পুরোনো শহরে মুসলমান পাড়ায় মশলাপাতির দোকান
|
দোকানের ওপরে বসতবাড়ি--অনেক প্রজন্ম এখানে পুরাকাল থেকে বসবাস করে এসেছে। ধর্ম অনুযায়ী পুরোনো শহরটি খ্রিস্টান, ইহুদী, মুসলমান ও আর্মেনিয়ান কোয়ার্টারে বিভক্ত কিন্তু নীচে রাস্তায় ভেদ বোঝা মুশকিল। সেখানে সবাই এক। সবার ধর্ম--বাজার ও রোজগার। হাজার বছর ধরে গ্রীক, রোমান, অটোমান, ক্রুসেডার ইত্যাদির দ্বারা আক্রান্ত হলেও আমার চোখে এখন তো বেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বলেই মনে হোল। কিন্তু জেরুসালেম একটি জটিল শহর। পৃথিবীর সবথেকে পুরোনো এই শহরের পরতে পরতে ইতিহাস। সামান্য কয়েকদিন মাত্র ওপর ওপর দেখলে অনেক কিছুই অবোঝা, অজানা থেকে যায়।
১৩১৪ সালে তুর্কি সুলতান বিরাট পাথরের দেয়াল দিয়ে সারা শহর ঘিরে দিয়েছিলেন
|
জেরুসালেম পুরোনো শহরটি প্রায় পাঁচশ' বছর আগে অটোমানদের সময়ে পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা হয়েছিল। এখন এই দেয়ালটিই পুরোনো ও নতুন জেরুসালেমকে ১৯৪৮-এর পর থেকে ভাগ করে রেখেছে। একদিকে ঝাঁ-চকচকে নতুন বাড়ি, হাইওয়ে, বিরাট বিজ্ঞাপন, বাস ট্যাক্সির ব্যস্ততা, আর অন্য দিকে জীবন চলে মন্থর গতিতে, পায়ে হেঁটে, ব্যস্ততাহীন প্রার্থনায় মাথা ঝুঁকিয়ে। শহরের চারদিকে গেট বা দরওয়াজা--পশ্চিমে জাফা গেট--বেশিরভাগ ট্যুরিস্টরা এটাই ব্যবহার করেন। উত্তরে দামস্কাস গেট, দক্ষিণে জায়ন (Zion) গেট, এবং পূর্বে লায়ন (Lion) গেট। দক্ষিণপূর্ব কোণে আছে ডাং (Dung) গেট, সেখানে বোধহয় শহরবাসীরা আবর্জনা ফেলত।
সিঁড়ি-বসানো, পাথর ঢাকা রাস্তা
|
পুরোনো শহরটা ঠিক পুরোনো দিল্লীর মতো--ঐতিহাসিক, ঘিঞ্জি, বাঁকাচোরা রাস্তা ও গলি যার বাইরে নতুন শহরের চাকচিক্য। আমার বার বার চাঁদনি চক-এর কথা মনে পড়ছিলো। কিন্তু পুরোনো দিল্লীর ইতিহাসের শুরু ১১০০ খ্রিস্টাব্দে। আর পুরোনো জেরুসালেমের ইতিহাস ৩০০০ খ্রিঃপূঃ থেকে! তবু পুরোনো দিল্লী থেকে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন ও সংরক্ষিত।
পুরোনো ইহুদী মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে
|
পুরোনো শহরের ভিতরেও ইহুদী সরকার প্রত্নতত্ত্বের খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছে--কোনো মসজিদের নীচে ইহুদী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ অথবা কোনো গির্জার নীচে দেখা গেলো মসজিদের চিহ্ন। এরকম উদাহরণে সারা শহর ভর্তি। জেরুসালেম (বা ইজরায়েলেও) থাকতে গেলে ধর্ম বা ইতিহাসকে উপেক্ষা করা অসম্ভব।
পুরোনো শহর, আর্মেনিয়ান পাড়া
|
ট্যাক্সিওয়ালা থেকে জমাদার পর্যন্ত প্রত্যেকেরই এক প্রশ্ন "তোমার কী ধর্ম?" নাম বা দেশের থেকেও ধর্মটাই সবাই প্রথমে জানতে চায়। যেন ধর্ম অনুযায়ী তারা মনে মনে ঠিক করে নেয় কীভাবে কী বিষয়ে কথা বলা যায়। স্বভাবতই আমাদের হিন্দু ধর্ম শুনে সবাই একটু থমকে যায়। তার পরেই অবশ্য হাজার প্রশ্ন ছুটে আসে--"এখানে কীসের আকর্ষণ?", "ইহুদী সম্বন্ধে কী ধারণা?", "শুনি নাকি ভারতেও অনেক মুসলমান?" ইত্যাদি ইত্যাদি। সবই ধর্ম নিয়ে। পুরো শহরটাই মনে হয় যেন ধর্ম নিয়ে ব্যস্ত। আমেরিকায় থেকে ও ধর্ম-নিরপেক্ষ হওয়ার দরুণ আমার কখনো কখনো দমবন্ধ মন হোত যেন। বুঝতাম এই কারণেই অনেক আধুনিক উদার খ্রিস্টান ও ইহুদীরা জেরুসালেমে যেতে অনিচ্ছুক। অনেক মুসলমানেরও আফশোষ--ইহুদী রাজ্য বলে তাঁরা জেরুসালেমে যেতে পারেন না। বেশিরভাগ ট্যুরিজ্ম ব্যবসা খ্রিস্টান ও ইহুদী পুণ্যার্থীদের জন্যে।
Via Dolorosa ও Sepulchre গির্জা ছাড়াও জেরুসালেমের খুব কাছেই পড়ে যিশুর জন্মস্থান বেথলেহেম--যা এখন উঁচু দেয়াল ঘেরা ওয়েস্ট ব্যাংক-এর আওতায়; কিন্তু ভ্রমণকারীরা নিরাপদে বেড়িয়ে আসতে পারেন। অন্য দিকে নাজারেথ--যেখানে যিশু তাঁর বাণী প্রচার শুরু করেছিলেন। একটু দূরে মাউন্ট সিনাই এবং আরও অনেক পুণ্যস্থান সারা ইজরায়েলে ছড়িয়ে আছে।
এই দেশটা কতো শতবার হাত বদল হতে হতে এখন ইহুদীদের দখলে। পুরো জেরুসালেমও তাদের হাতে। ইতিহাস খতিয়ে দেখলে এদেশে প্রথম অবস্থান ইহুদীদেরই। এখানে প্রায় সাড়ে পাঁচ-হাজার বছর আগে আব্রাহাম একটি পাথরের ওপর --যাকে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা বলে 'টেম্পল মাউন্ট'--তাঁর পুত্রকে বলি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন, শেষ মুহূর্তে স্বয়ং ভগবান তাঁকে নিরস্ত করেন। সেই পুণ্যের দেশই মোজেসকে আকর্ষণ করে, যিশুও এখানে দাঁড়িয়ে তাঁর বাণী প্রচার করেছেন। ওই পাথরের ওপর অন্তত চারটি ঐতিহাসিক মন্দির তৈরি করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটি রোমান বা মুসলমানদের হাতে ধ্বংস হয়েছে।
ইহুদীরা সবথেকে পুরোনো বাসিন্দা হলেও খ্রিস্টান ক্রুসেডার বা মুসলমান অটোমানদের মতো তাদের অত সৈন্যবল ছিলো না তাই বার বার মার খেয়ে তারা দেশত্যাগ করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
দেয়ালের পাথরের খাঁজে গুঁজে দেন ছোট্ট কাগজে লেখা প্রার্থনা
|
ইহুদীদের কাছে সবথেকে পুণ্যস্থান হোল Western Wall বা Wailing Wall. ওই কয়েক ফুট লম্বা দেয়ালটা দ্বিতীয় মন্দিরের বাইরের দেয়ালের এক টুকরো। এখানেই সব ইহুদীরা প্রার্থনা করেন। পুরোনো দেয়ালের পাথরের খাঁজে গুঁজে দেন ছোট্ট কাগজে লেখা প্রার্থনা। সকাল সন্ধ্যা গোঁড়া ইহুদীরা দল বেঁধে প্রার্থনা করেন। সামনে একটু খোলা চত্বরে নানারকম ধর্মানুষ্ঠান করা হয়। দেয়ালটা সেই আব্রাহামের পাথরের (Dome of the Rock) খুব কাছেই। বিধ্বংস মন্দিরটি ওই পাথরের ওপরেই ছিলো, অটোমানের সৈন্যরা সেটা ভেঙে মসজিদ বানায়। Wailing Wall-এ এক সন্ধ্যায় আমিও বিশ্বশান্তির প্রার্থনা লেখা এক কাগজ গুঁজে এলাম, আহা যেন সত্যিই সত্যি হয়। ভাবতে দোষ কী?
পাহাড়ের চূড়ায় মাসাদা দুর্গের ধ্বংসাবশেষ
|
জেরুসালেম থেকে ঘন্টা-খানেক দূরে আছে মাসাদা। দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় তৈরি দুর্গ যেখান থেকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ইহুদী রোমান সৈন্যদের অনেকদিন রুখতে পেরেছিলেন। পরে পরাজয় আসন্ন দেখে সবাই আত্মহত্যা করেন। ইহুদীদের সংগ্রামী মনোভাবের প্রতীক হিসেবে মাসাদা অতি প্রসিদ্ধ। আগে পায়ে হেঁটে উঠতে হোত এখন 'কেবল কার' চালু হয়েছে আমার মতো সংগ্রামী মনোবলহীন ট্যুরিস্টদের কথা ভেবে।
মাসাদা ছাড়াও দেখেছি ডেড সী স্ক্রোল-এর (Dead Sea Scroll) গুহাগুলি। বেশ খাড়া পাহাড়ের গায়ে এই গুহা। যাওয়ার কোনো রাস্তাই নেই। নীচে থেকে দেখলাম। এইখানে বড়ো জালার মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল চামড়ায় লেখা ধর্মগ্রন্থ ও ইতিহাস। এগুলি সবথেকে পুরোনো বাইবেল (১৫০ খ্রিঃপূঃ) ও অন্যান্য তথ্যের পুঁথি। আপাতত গুহাগুলি খালি। পুঁথিগুলি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। নতুন জেরুসালেম ও তেল আভিভে অনেক বিখ্যাত মিউজিয়াম দেখার আছে। কিন্তু আমি সেসন কিছুই দেখিনি। আমি সারাক্ষণ পুরোনো জেরুসালেমের নেশাতেই বুঁদ হয়ে ছিলাম।
জর্ডন নদীর পশ্চিম প্রান্তে ডেড সী বা মৃত সাগর
|
জেরুসালেমের একটু দক্ষিণে, জর্ডন নদীর পশ্চিম প্রান্তে ডেড সী বা মৃত সাগর। এলাকায় ৮০x১০ কি.মি. একটি হ্রদের মতো কিন্তু এর জলে নুনের ভাগ প্রায় ৩০% (অন্য সমুদ্রে নুন ৩%) তাই জল শুকিয়ে পাড়ে নুনের পাহাড়। ঘনত্ব বেশি বলে এই জলে নাকি দিব্যি ভেসে থাকা যায়। আমি কিন্তু চেষ্টা করেও ভাসতে পারিনি, শুধু শুধু চোখে-নাকে নুন জলের জ্বালানিতে অস্থির হয়েছি। মৃত সাগরের এলাকাটাও পৃথিবীর সব থেকে নীচু জমি--সমুদ্র থেকে ৪০০ মিটার নীচে। এখানে নুন ও অন্যান্য রাসায়নিকে ভরা কাদা নাকি স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব উপকারী। হাজার বছর ধরে লোকেরা চর্মরোগের জন্য এই কাদার ব্যবহার করে এসেছে, এখন তো এই কাদা নিয়ে কতো রকমের প্রসাধনী ব্যবসা। কম বায়ু-চাপও হয়তো স্বাস্থ্যের উপকার করে।
নতুন জেরুসালেমের অন্যতম দ্রষ্টব্য হোলোকস্ট (Holocaust) মিউজিয়াম। কয়েক বছর আগে মিউনিখে বেড়াবার সময়ে আমি Dachau-এর কনসেনট্রেশন ক্যাম্প দেখেছিলাম। দেখে বেশ কয়েকদিন ডিপ্রেশ্যন-এ ভুগেছিলাম। পশ্চিম আফ্রিকায় ক্রীতদাসদের দুর্গ দেখেও ওই অবস্থা। এত ব্যথা আমার সহ্য হয় না। তাই এবার ওই মিউজিয়ামও আমি বাদ দিলেম। পাঠকজন ক্ষমা করবেন।
যিশুর জন্মস্থান - চার্চ অফ এ্যানান্সিয়েশন (বেথলেহেম)
|
জেরুসালেমের বাইরে আরো দুটি খ্রিস্টিয় পুণ্যস্থান আছে। প্রথমটি নাজারেথ। এখানে জোসেফ ও মেরীর বাড়ি (এখন গির্জা)। কোথায় যিশু বড়ো হয়েছিলেন, কোথায় বাণী প্রচার করতেন ইত্যাদি দেখার আছে। কাছেই জর্ডন নদী যেখানে ডুব দিয়ে ব্যাপটিজ্ম করা হয়। দলে দলে পুণ্যার্থীরা আসে এই নদীতে ডুব দিতে।
দ্বিতীয় জায়গাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হোল বেথলেহেম-এ যিশুর জন্মস্থান। কিন্তু ওটা প্যালেস্টাইনে বা জর্ডন নদীর পশ্চিম তটে--ওয়েস্ট ব্যাংক-এ।
ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মাঝখান দিয়ে উঁচু পাঁচিল চলে গেছে সীমান্ত সুরক্ষার জন্য, মাঝে লোহার গরাদ দেওয়া গেট। খুব জেরার পরে ঢুকতে বা বেরোতে দেওয়া হয়। অবশ্যই প্যালেস্টাইনের মুসলমানদের পক্ষে এসব অতি অপমানজনক। তাই নিয়ে বিক্ষোভও চলছে।
ওয়েস্ট-ব্যাংক-এ ঢোকার রাস্তা
|
এত কাণ্ড করে একটা ধর্মস্থান দেখতে যাওয়াটা খুবই দুঃখের, কিন্তু কী আর করা। আমাদের মুসলমান গাইডকে যেতে দিল না, যদি কিড্ন্যাপ্ড হয়ে যান! ভিতরে ঢুকে নতুন গাইড নিতে হোল।
বেথলেহেম শহরটি ছোট্ট। মা মেরী যেখানে যিশুর জন্ম দিয়েছিলেন তার উপর খুব সুন্দর এক চার্চ অফ নেটিভিটি (Church of Nativity) তৈরি হয়েছে।
ঠিক এখানেই যিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন
|
আস্তাবলটি এখনো নাকি সেই আগের মতোই আছে। দেয়ালে ও ছাদে হাজার বছরের ধুলো-কালির পলেস্তারা। মেঝের মাঝখানে একটি লোহা-বাঁধানো তারা। এইখানেই যিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন।
জাফা গেট দিয়ে জেরুসালেমে ঢুকলে সোজা সামনে পড়ে মুসলমান পাড়া। ইহুদী বা আর্মেনিয়ান পাড়ার তুলনায় বেশ সরগরম। কাতারে কাতারে লোক আসছে, যাচ্ছে, কেনাকাটা করছে। আরবী, হিব্রু ও ভাঙা ইংরেজির জগাখিচুড়ি। সব দোকানগুলি সব ধর্মেরই জিনিসপত্র বিক্রি করে (বাজার ধর্মনিরপেক্ষ)। একই দোকানে আপনি পাবেন আরবিতে লেখা মুসলমানদের জপের মালা, হিব্রুতে লেখা মেনরা আর জলপাই কাঠের তৈরি যিশুর ক্রস। কেনাবেচায় ধর্মের কোনো নিষেধ নেই।
স্বর্ণসৌধের চত্বরে প্রার্থনার আগে হাত-পা ধোয়ার ব্যবস্থা
|
মুসলমানদের কাছে সবথেকে পুণ্যের জায়গা হোল সেই সোনার পাতে মোড়া ডোম অফ দ্য রক। আরবী নাম--আল-হারাম আল-শরীফ। সেই আব্রাহামের পাথর ঘিরে চারটি ইহুদী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর তৈরি এই মসজিদ। এটাই জেরুসালেমের মধ্যমণি। সবার পরিচিত সোনার সৌধ। মসজিদটির গায়ে নীল সবুজ পাথরের কারকার্যও চোখ ঝলসানো সুন্দর। চার পাশে প্রসস্ত চত্বর, ভিড়হীন, শান্তিপূর্ণ, পরিচ্ছন্ন। ইসলাম ধর্মানুযায়ী ওই আব্রাহামের পাথর শুধু ইহুদীদেরই পুণ্যভূমি নয়, মুসলমানদেরও। কোরানের ১৭ নম্বর সুরা অনুযায়ী দেবদূত গাব্রিয়েল স্বপ্নে মহম্মদকে বলেন মদিনা থেকে ঘোড়ায় চড়ে জেরুসালেমে আসতে। মহম্মদ বুরাক (Buraq) নামে সাদা ঘোড়ায় চেপে প্রথমে আসেন কাছেই আল আকসা মসজিদে এবং তারপর ওই পাথরে চড়ে স্বর্গারোহণ করেন। স্বয়ং আল্লার বাণী নিয়ে পরদিন সকালে আবার মর্ত্যে ফিরে আসেন।
স্বর্ণসৌধের দেয়ালে পবিত্র কোরানের বাণী
|
অতএব আল আকসা মসজিদ ও ডোম অফ দ্য রক মসজিদ তৈরি করা হোল। আল আকসা স্বর্ণ সৌধের চত্বরেই। একটি সাধারণ, ছোট্ট মসজিদ, চোখে পড়ার মতো নয় মোটেই, কিন্তু সেটাই নাকি মক্কা অ মদিনার পরে তৃতীয় মহৎ পুণ্যস্থান। আমার দুর্ভাগ্যবশত দুটি জায়গাতেই শুধু মুসলমানদের ঢুকতে দেওয়া হয়। কাজেই আমার যেটুকু দেখা সেটা বাইরে থেকেই সারতে হোল।
বাইরের চত্বরে ঢোকাও মোটেই সহজ কাজ নয়। সারা শহরটা ইহুদীদের অধিকারে হলেও স্বর্ণসৌধটি জর্ডনের মুসলমান রাজার দখলে। মুসলমানদের জন্য নয়টি গেট সবসময় খোলা, কিন্তু অ-মুসলমানদের জন্যে একটি গেটই খোলা, তাও কেবলমাত্র সকালে দু-ঘন্টার জন্য। ফলে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়ানো। কঠিন সুরক্ষা--পাসপোর্ট দেখিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ছাড়া পেতে লাগলো অনেকক্ষণ। অবশেষে সাকুল্যে আধ-ঘন্টার জন্য মাত্র দেখার অনুমতি মিললো। তার পরেই প্রার্থনার ঘন্টা বাজলো ও সব অ-মুসলমানদের কড়া নির্দেশ দেওয়া হোল তক্ষুণি বেরিয়ে যাবার জন্যে। অন্তত আমরা তো তবুও বাইরে দর্শন পেয়েছিলাম কিন্তু ইহুদীরা একেবারেই ঢুকতে পারেন না।
জেরুসালেমে আমি বেশিরভাগ সময়ই পুরোনো শহরে কাটিয়েছি। খাওয়াদাওয়া, কেনাকাটাও সব ওখানেই। যদিও জায়গাটা ছোটো, কিন্তু সব গলিঘুঁজি প্রদক্ষিণ করতে অনেকদিন সময় লাগবে। তিনটি ধর্মের সম্মিলন আমাকে একরকম মোহিত করে রেখেছিলো। উদ্দ্যেশ্যহীনভাবে উলটো-পালটা ঘুরতে এখানে বেশ মজা। জেরুসালেম ও সারা ইজরায়েলেও একলা ঘোরাঘুরি করতে কোনো আপদবিপদের সম্ভাবনা নেই। সব জায়গাই খুব সুরক্ষিত ও নিরাপদ। ঘুরতে ঘুরতে খিদে পেয়ে গেলে যে-কোনো পাড়ায় দেশীয় টাটকা খাবারের সুগন্ধ পাবেন--আর্মেনিয়া পাড়ার পিৎজা, বা ইহুদী পাড়ার টাটকা গরম হালা-রুটি অথবা মুসলমান পাড়ায় ভেড়ার মাংসের কাবাব।
ইহুদী পাড়ায় মুখরোচক গরম রুটি
|
সব দোকান, কাফে, রেস্টুরান্টেই মধ্যপ্রাচ্যের পরিচিত হুমাস (সেদ্ধ কাবুলি ছোলা-বাটা), ফেলাফল (ডালবড়ার মতো), নানারকম রুটি, নান, হরেক রঙ ও সাইজের অলিভ এবং ইয়া বড়ো বড়ো রসালো মিষ্টি খেজুর। ব্যাগভর্তি খেজুর ছিলো আমার দৈনিক জলখাবার।
হাঁটতে হাঁটতে হাঁফ ধরে গেলে (পাথর-বাঁধানো রাস্তা বেশ উঁচুনীচু, আর সারা রাস্তায় ছোটো ছোটো ধাপের সিঁড়ি) যে-কোনো জায়গায় বসে পড়ুন। হারিয়ে গেলেও কোনো ভয় নেই--একটু পরেই চেনা রাস্তায় এসে পড়বেন। আর বসে বসে খেজুর খাওয়া ও পাড়ার লোক দেখাও বেশ আনন্দের। আপনার পায়ের নীচে মসৃণ পাথরটাকেই দেখুন। কতো শত বছর আগে সেটা তৈরি হয়েছিলো, কতো যুদ্ধের সাক্ষী সে। কতো ঘোড়ার খুর ঠিকরে উঠেছিলো এর উপরে, কতো সৈন্য, কতো পুরোহিত, কতী সাধারণ বাসিন্দার রক্তে হয়তো পিছল হয়েছিলো এই পাথার তার হিসেব নেই, ভাবতে গেলেই মাথায় ঘোর এসে যায়।
তার চেয়ে বরং এখানকার ট্যুরিস্টদেরই দেখতে থাকুন। ওই তো একদল কুচকুচে কৃষ্ণবর্ণ আফ্রিকানরা দোকানে হানা দিচ্ছে। সকলের পরনে একই রকমের চোখ-ধাঁধাঁনো রংচঙে শার্ট বা ড্রেস। হয়তো এটা বোঝাতে যে তারা একই দলের, যাতে কেউ না ভিড়ে হারিয়ে যায়। সকলের হাতে একটি সদ্য-কেনা স্যুটকেস-- হয়তো তাতে উপহার ভর্তি করে নিয়ে যাবে নিজের দেশে।
সবার পুণ্যভূমি জেরুসালেম, সবাই এখানে আসেন অন্তত একবার তীর্থ-পর্যটনের জন্যে। মক্কায় হজ-এর মতোই, মুসলমানের আজকাল পূর্ব-ইয়োরোপ, উত্তর-আফ্রিকা এমনকী সুদূর ইন্দোনেশিয়া থেকেও দলে দলে আসছেন এখানে। খ্রিস্টানরা আসেন, Via Dolorosa-তে যিশুর পায়ে পায়ে চলতে চলতে অনেকেই চোখের জল মোছেন। ইহুদী পাড়ায় ও পুণ্য পশ্চিম দেয়ালের চারপাশে গোঁড়া ইহুদীদের চেনা যায় অতি সহজেই। গায়ে তাঁদের কালো আলখাল্লার মতো লম্বা কোট, মাথায় কালো উঁচু টুপি, মুখে দাড়ি-গোঁফ (অবশ্যই পুরুষদের), ও কানের পাশে লম্বা, পাকানো জুলফি। মহিলাদেরও কালো ড্রেস, মাথায় রুমাল--খুবই রক্ষণশীল পোষাক।
টহলদাররত সৈন্য, পশ্চিম দেয়ালের কাছে
|
টিন-এজ ছেলেমেয়েরাও একইরকম কালো পোষাক পরে বাইরে বেরোয়। কোনো জিন্স, শর্টস, বা হাত-কাটা গেঞ্জির দেখা পাবেন না এখানে। এছাড়াও দেখবেন এখানে-ওখানে খাকি পোষাকে ইহুদী শান্তিরক্ষী সৈনিকদের জটলা। সুরক্ষা সম্বন্ধে এরা সদাই সচেতন। ইজরায়েলে সব ছেলেমেয়েরা মিলিটারিতে যোগ দেয়। সদ্য কচি-দাড়ি গজানো তরুণ সৈনিকদের দেখতে বেশ কিন্তু ভয়ও হয় এদের মধ্যে কজন জানিনা সন্ত্রাসবাদীদের হাতে মারা পড়বে। এদের বাবা-মারা কতো দুশ্চিন্তায় রাত কাটান!
একটু যদি খুঁটিয়ে দেখেন তাহলে আপনি স্থানীয় বাসিন্দাদের ট্যুরিস্টদের থেকে আলাদা করে চিনতে পারবেন। লম্বা কালো স্কার্ট-পরা খুব গম্ভীর মুখে ইহুদী মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। একই বয়সের একটি মুসলমান ছেলে (হয়তো আরব-ইজরায়েলি বা প্যালেস্টিনিয়ান) ভিড়ের মধ্যেই সুকৌশলে গরম চায়ের কেটলি নিয়ে ছুটছে--দু'চার পয়সা রোজগারের ধান্দায়। এখানে সবাই হিব্রু ও আরবী ভাষায় দক্ষ।
মুসলমান পাড়ায় কৌতূহলী শিশু
|
পোষাক ছাড়া বোঝা মুশকিল কে মুসলমান বা কে ইহুদী। ইজরায়েলের মতো দেশে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে আমি ভয় পাই। কে-জানে বাবা কী মনে করবে। কিন্তু এমনি কথাবার্তায় আমি আঁচ পেয়েছিলাম যে সাধারণ মুসলমানেরা ইহুদীদের উপর কোনো অসদ্ভাব পোষণ করেন না। ওদের ধারণা ইহুদীরা এখানে এসে পড়েছে -- এরা এখন থাকবেই। জোর করে দের হটানো যাবে না। বরং এদের উপস্থিতিতে আরবী প্রতিবেশিদের উপকারই হচ্ছে। অনেক ফলমূল, খাবার, হাতে-গড়া জিনিস ইজরায়েলে এরা বেশ ভালো দামে বিক্রি করে। অন্য কোনো প্রতিবেশি-দেশ এত দাম দেবে না। তাছাড়াও বৈজ্ঞানিক, ডাক্তারি বা অন্যান্য শিল্পেও ইজরায়েল যে-কোনো আরব দেশের তুলনায় অনেক উন্নত। তাই তার সুফল ও অনেকরকম সুযোগসুবিধাও এরা পাচ্ছে। আরবী মুসলমানদের আপাতত সবচেয়ে বড়ো ভয় (আমি যে সময়ে গিয়েছিলাম--ফেব্রুয়ারি ২০১২) ইরানকে নিয়ে। ইরানীরা পার্শি, আরবী নয়, ওদের ধর্ম ইসলাম হলেও আলাদা সিয়া সম্প্রদায়ের (অন্যরা সুন্নি)। আরবীরা ওদের বিজাতীয় মনে করে এবং একদম বিশ্বাস করে না। সবাইয়ের মত ইরান সাম্রাজ্য বাড়াবার চেষ্টায় আছে।
ইজরায়েলে একটু লক্ষ করলেই দেখা যায় যে বেশিরভাগ দৈনিক কম-রোজগেরে কাজগুলিতে প্যালেস্টাইন মুসলমান লোকেরাই নিযুক্ত। আমি একজন মুসলমান দোকানিকে জিগ্যেস করেছিলাম। তাঁর উত্তর--প্যালেস্টাইন মুসলমানদের শিক্ষা কম, তাই তারা উঁচু পদের চাকরি পায় না। কম শিক্ষার কারণ--এরা ইজরায়েলে থাকা সত্ত্বেও ইহুদী ছেলেমেয়েদের মতো বিনা বেতনের স্কুলে পড়তে পারে না। কেন? না, সেই সুবিধে পেতে গেলে এদের ইজরায়েলি মিলিটারিতে নাম লেখাতে হবে এবং বেশিরভাগ ইজারায়েলি মুসলমানেরা তাতে অনিচ্ছুক, পাছে অন্য মুসলমানদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। এভাবেই একই দেশের নগরিকরা ধর্মানুযায়ী দুই দলে ভাগ হয়ে পড়েছে। মুসলমানদের দলটা গরিব, অল্পশিক্কিত এবং তাই বিদ্বেষপূর্ণও। এর সমাধানটা কোথায় কে জানে।
আসলে মধ্যপ্রাচ্যের ধর্ম ও রাজনীতি ভীষণ কুটিল ও প্যাঁচালো; হাজার বছরের ইতিহাস, বর্বরতা, আগেকার যুদ্ধে জয়-পরাজয় এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কারুর সঙ্গে কথা উঠলেই শোনা যাবে ২০০ বছর আগে কী অনাচার হয়েছিলো তার কাহিনি--এমনভাবে কথা বলা হচ্ছে যেন গত সপ্তাহের খবরের আলোচনা! এদের মনের কথা জানা আমার সাধ্যের বাইরে।
তবুও যান, এই কারণেই যান। দেখে আসুন পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর, পশ্চিমী ধর্ম ও সভ্যতার শুরু যেখানে। প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস থেকে সাম্রতিক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি সবই জট পাকানো এখানে। এমন শহর পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। আজকাল দেশটাও মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। তাই দেখে আসুন চট করে।