রবিবার দিন দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর রুবেল একটা মাদুর, বালিশ আর চাদর নিয়ে বাগানের বড় গাছটার তলায় শুতে গেল। ছুটির দিন ও প্রায়ই এই রকম করে। বাবার নতুন পোস্টিংটা শহর থেকে কিছুটা দূরে। এই নতুন জায়গায় ওদের কোয়ার্টারের বাগানটা ভারি সুন্দর। এখানে বাগানে গাছেদের মধ্যে দুপুরবেলা ঘুমোতে রুবেলের খুব ভালো লাগে। আর আজ তো সারা সকাল প্রচুর ধকল গেছে। দিদির সাথে দিদির এক নতুন বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল রুবেল। সেটা ওদের বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। যাই হোক, সেখানে অনেকের সাথে বিস্তর হুড়োহুড়ি করে খেলাধুলোর পর বাড়ি ফেরার সময় কোন রিকশা পাওয়া গেল না তাই ওদের হেঁটে ফিরতে হল। সেইজন্যে রুবেল এখন বেশ ক্লান্ত। অবশ্য একটু ঘুমিয়ে নিলেই চাঙ্গা হয়ে যাবে। বিকেলে আবার রায়কাকুর ছেলে সাকারের জন্মদিনে যেতে হবে।
গাছের তলায় মাদুর পেতে, বালিশে মাথা দিয়ে সবে শুয়েছে রুবেল এমন সময় টিকলু এসে হাজির!
“এই রুবেল তুই যে বলেছিলি রবিবার দিন দুপুরবেলা খেলবি তার কি হল? এখন ঘুমোচ্ছিস যে বড়!”
“আমায় বিরক্ত করিস না টিকলু! আমি ঘু্মোচ্ছি!”
“তোর এ তো ভারি অন্যায়! আমাকে আসতে বলে এখন তুই ঘুমোবার চেষ্টা করছিস!” টিকলু লাফাতে লাফাতে বলল।
রুবেল তো বেমালুম ভুলে গিয়েছিল টিকলুকে খেলতে ডাকার কথা! তার উপর টিকলুর ওই রকম লাফানি দেখে আরো যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে! উফফ! টিকলু কোথা থেকে যে এত এনার্জি পায়!
এদিকে রুবেলের তো মোটেই খেলার ইচ্ছে নেই। গাছের তলায় ফুরফুরে হাওয়ায় শুয়ে ঘুমোতে চায় সে! কি করা যায়? যা করেই হোক টিকলুকে তাড়াতে হবে এখন! বিকেলে তো সাকারের জন্মদিনে দেখা হবেই, সকাল বিকেল অত দেখা করার কি আছে? ঘুম চোখে ভাবতে লাগল রুবেল কি করা যায়!
নিজের সবুজ জামাটা দেখে ওর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো! মামার কাছে সে গল্প শুনেছে কেমন করে গিরগিটিরা নিজের গায়ের রঙ বদল করে আশপাশের গাছপালার সাথে মিশে যায়। অনেক পোকা আর জন্তুর গায়ের রঙ তাদের সাহায্যে করে লুকিয়ে থাকতে, কেউ ওদের দেখতে পায়না আর দেখতে না পেলে ধরতে পারার তো প্রশ্নই ওঠে না! সেই ভেবে রুবেল চট করে টিকলুকে বলল, “তুই দাঁড়া, আমি এখুনি আসছি।”
বলেই ছুটে বাগানের পিছন দিকে গিয়ে একটা গাছের ঝোপের পিছনে গিয়ে লুকোলো। টিকলু খেয়ালও করল না যে সে বাগানের পিছনের দিকে পালিয়েছে! একটু পরে সে রুবেলকে খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির ভিতর ঢুকল। রুবেলের দিদি রুমি বাইরের ঘরেই বসে কি একটা করছিল, ওকে দেখে বলল, “কি রে টিকলু তুই এখানে যে?”
“আমি রুবেলকে খুঁজছি!”
“রুবেল তো ঘরে নেই ও তো বাগানে ঘুমোতে গেল!”
“না, ও আমাকে বলল একটু আসছি তারপর কোথায় জানি চলে গেল!”
“না, না, ঘরে ঢোকেনি, ঢুকলে আমি তো দেখতে পাবো! আমি তো এখানেই বসে রয়েছি।”
“ও এবার বুঝেছি! ও আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করেছে!” বলে টিকলু এক ছুট্টে আবার বাগানে বেরিয়ে গেল। সামনের দিকে তো ও নিজেই দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে তো লুকোবে না, তার মানে পিছনের দিকে লুকিয়েছে!
ব্যাস, তারপর আর বেশিক্ষণ লাগল না রুবেলকে খুঁজে বার করতে!
“কি রে লুকিয়েছিলি কেন? লুকোচুরি খেলবি?” টিকলু জিজ্ঞেস করল।
রুবেল মুখ হাঁড়ি করে বলল, “না!”
বাগানের এক ধারে মা একটা বড়সড় প্লাস্টিকের গামলা উপুড় করে রেখেছেন সেটা দেখে রুবেলের মাথায় আবার একটা আইডিয়া এলো।
“ঠিক আছে আমার জন্যে ভিতর থেকে এক গেলাস জল নিয়ে আয় তারপর খেলব।”
টিকলুর কোন ক্লান্তি নেই, সে লাফাতে লাফাতে জল আনতে ভিতরে চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এলো জলের গেলাস হাতে নিয়ে কিন্তু ততক্ষণে রুবেল চট করে বড় গামলাটার তলায় লুকিয়ে পড়েছে। ঠিক যে ভাবে কচ্ছপ নিজের খোলসের ভিতর লুকিয়ে পড়ে! যাক এবার টিকলু ওকে খুঁজে না পেয়ে বাড়ি চলে যাবে তখন রুবেল নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে!
জলের গেলাস হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকাল টিকলু। নাহ, রুবেল তো কোথাও নেই। গেলাসটাকে নামিয়ে রেখে বাগানের পিছন দিকে দেখে এলো। না, এবার তো সেখানেও নেই, তাহলে গেল কোথায়?
কি করবে ভাবছে টিকলু এমন সময় ওর মনে হল বাগানে রাখা কমলা রঙের বড় গামলাটা একটু যেন নড়ে উঠল! আর বুঝতে বাকি রইল না টিকলুর! ঝাঁ করে ছুটে গিয়ে গামলাটা তুলে ফেলতেই তলায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা রুবেলকে দেখতে পেয়ে গেল সে!
“তোর লুকোচুরি খেলার এত ইচ্ছে তো বলছিস না কেন! জিজ্ঞেস যখন করলাম তখন খেলব না বলে এখন সর্বত্র লুকিয়ে বেড়াচ্ছিস!”
“না, আমি খেলব না!”
“যাহ বাবা!”
“খেলব না বলেছি তো খেলব না!” বলে রুবেল গিয়ে মাদুরে শুলো।
টিকলু এসে ওকে ঠেলাঠেলি করেতে লাগল, “এই রকম কেন করছিস রুবেল চল না একটু খেলি!”
এবার ভীষণ রেগে গেল রুবেল, ঝাঁঝিয়ে উঠল, “একবার যখন বলে দিয়েছি খেলব না তখন খেলবই না! তুই কি কানে শুনতে পাস না নাকি? যা এখান থেকে বলছি! সব সময় শুধু ঘ্যান ঘ্যান! তোর তো পৃথিবীর সবার চেয়ে বেশি খেলনা আছে! যা দুনিয়ার সব খেলনা নিয়ে বাড়িতে বসে খেল! আমার মাথা খাচ্ছিস কেন?”
টিকলু আহত মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল।
চাদর গায়ে দিয়ে মাদুরে টানটান হয়ে শুল রুবেল কিন্তু ঘুম আর কিছুতেই এলো না! বার বার টিকলুর দুঃখ পাওয়া মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। মনে পড়ে গেল ওরা যখন এখানে নতুন নতুন এসেছিল তখন রুবেলের কোন বন্ধু ছিল না। টিকলুই যেচে এসে ওর সাথে আলাপ করেছিল স্কুলে আর ওর বন্ধু হয়েছিল। ভারি ভালো ছেলে টিকলু, রুবেলের সব কথা শোনে সে। বাগানে রাখা জল ভর্তি গেলাসটা দেখতে পেল রুবেল। ওর জন্যে জল পর্যন্ত নিয়ে এলো বেচারা আর সেই টিকলুকেই কিনা মনে আঘাত দিয়ে ভাগিয়ে দিল রুবেল!
নাহ, টিকলুর সাথে ওই ভাবে কথা বলাটা রুবেলের মোটেই উচিত হয়নি। টিকলুর অনেক খেলনা আছে বটে কিন্তু সে মোটেই স্বার্থপর বা খেলনা আঁকড়ে বসে থাকা ছেলে নয়! নিজের সব খেলনাই সে রুবেলকে খেলতে দেয়, অন্য বন্ধুদেরও দেয়। ওকে ওই ভাবে বলাটা খুব ভুল হয়ে গেছে! রুবেলের ঘুম ছুটে গেল। উঠে পড়ল সে। পাশে রাখা চটিটা পায়ে গলিয়ে এক দৌড়ে টিকলুদের বাড়ি গিয়ে হাজির হল।
কলিং বেল বাজাতে টিকলুর মা এসে দরজা খুলে দিলেন।
“টিকলু আছে মাসি?”
“হ্যাঁ, এই তো কোথা থেকে টো টো করে ঘুরে এসে ঘরে ঢুকল। টিকলু, এই টিকলু, রুবেল এসেছে,” বলে ওর মা ভিতরে চলে গেলেন।
একটু পরেই বেরিয়ে এলো টিকলু।
“আমি সরি টিকলু! তোকে ওই ভাবে বলাটা আমার ঠিক হয়নি! আসলে আজকে সারা সকাল এত এদিক ওদিক করেছি যে আর খেলতে ইচ্ছে করছিল না। বিকেলে তো আবার সাকারের জন্মদিনে যেতে হবে।”
টিকলু থমথমে গম্ভীর মুখে ওর দিকে তাকাল। রুবেলের বুক ধুকপুক, টিকলু রেগে গেল নাকি? তাহলে তো খুব মুশকিল হবে! টিকলু তো কোনদিন এমন করে রাগে না! ছি ছি কি বাজে কাজটাই না করে ফেলেছে রুবেল!
ঠিক তক্ষুনি ফিক করে হেসে ফেলল টিকলু! রুবেল আনন্দে জড়িয়ে ধরল বন্ধুকে তারপর বলল, “তবে এখন আমার ঘুম চলে গেছে, এখন খেলবি তো চল!”
টিকলু মাথা চুলকে বলল, “হুঁ! অত ছুটোছুটি করার পর আমি ক্লান্ত, আমার আর খেলতে ইচ্ছে করছে না!”
একটু পরে রুবেলের মা ওর দিদি রুমিকে বললেন, “রুমি একবার দেখে এসো তো বাইরে ওরা দুজন কিছু দুষ্টুমি করছে না তো?”
রুমি বাগানে গিয়ে দেখল গাছের তলায় চাদর মুড়ি দিয়ে দুই বন্ধু অঘোরে ঘুমোচ্ছে!