—কুমার! স্নিগ্ধ সম্ভাষণ ধ্বনিত হলো কম্বুকণ্ঠে। কুমার দৃষ্টি সম্মুখে স্থাপন করলেন। চম্পকবৃক্ষের উদ্গম এবং চত্বরমধ্যস্থ শিল্পকর্মের মধ্যে দণ্ডায়মান আর এক শিল্পকর্ম। শালপ্রাংশু মহাভুজ এই পুরুষপ্রবরের সর্ব অবয়বে সুদুর্লভ মহিমা। নবীন মেঘের মতো কান্তি। কটিতে সুবর্ণপীত বসন। বাহুতে সুবর্ণ অঙ্গদ। কণ্ঠে স্বর্ণহার। কর্ণে স্বর্ণকুণ্ডল। সুকুঞ্চিত ভ্রমরকৃষ্ণ কেশগুচ্ছ। বিশাল করুণাঘন দুই নয়ন। অঙ্গে অগুরু, ললাটে কুঙকুম চন্দন। চরণে সুবর্ণবর্ণ পদপ্রাণ। এই চন্দনচর্চিত দীর্ঘোন্নত শ্যাম তনুর শিরে, স্কন্ধদ্বয়ে সদ্যবর্ষিত সুবর্ণপুষ্পের অর্ঘ্য। রক্তোৎপলের মতো দুই ওষ্ঠাধরে কী যে অপরূপ স্মিতি!
কুমার স্বপ্নাচ্ছন্ন কণ্ঠে বললেন — দানবাধিপতি না দানবারি?
সেই গিরিচূড়ার মতো উন্নত পুরুষ এগিয়ে এসে দুই হস্তে ধারণ করলেন কুমারের দুই হাত। প্রসন্ন মমতায় গাঢ় কণ্ঠে বললেন — সখা।
দানবপতির সুন্দর মুখ সলজ্জ হল - কুমার! আমিও উপবাসী। তোমার সঙ্গে দিবসের প্রথম জলগ্রহণ করার বাসনায় ব্রাহ্মমুহূর্ত হতে অপেক্ষারত।
কুমার সচমকে ঋজু হয়ে দাঁড়ালেন - ব্রাহ্মমুহূর্ত হতে প্রতীক্ষারত? এখন বেলা কত প্রহর? আমি এই সময় এইখানে উপস্থিত হব সে বিষয়ে অবগতি হল কী ভাবে?
দানবাধিপ কুমারের দুই করতলে মৃদু চাপ দিয়ে স্মিতমুখে বললেন - তৃতীয় প্রহর সমাপ্তপ্রায়। অন্যান্য জিজ্ঞাসার যথাসাধ্য শান্তিবিধান করার চেষ্টা করব। আগে উপবাস ভঙ্গ কর। তৃপ্ত হই আমরা।
কুমার উৎসুক আগ্রহে প্রশ্ন করলেন — 'আমরা'? একি গৌরবার্থে বহুবচন?
দানবকুলপতির স্মিতপ্রসন্ন আনন কৌতুকোজ্জ্বল হয়ে উঠল - কুমার! আমার রাজ্য অভিমুখে যাত্রা করেছিলে, সে কার কমলাননখানি মানসপটে এঁকে?
সপ্তাশ্ববাহন রুদ্ধশ্বাসকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন — কমলিনী!
অভিরাম ভঙ্গিতে সম্মুখ হতে পার্শ্ববর্তী হলেন দানবকুলাধিপতি — তোমার জয়লক্ষ্মী।
দানবপ্রধানের শিখরসদৃশ আকৃতির অন্তরালে পশ্চাৎপট আচ্ছন্ন হওয়ায় রাজপুত্র দেখেননি এতক্ষণ। এইবার দেখলেন স্বর্ণপুষ্পের বৃক্ষকাণ্ডের দুই পার্শ্বে আবির্ভূতা দুই অভিনব বল্লরী। যেন স্থিরবিদ্যুৎ দ্বিধা হয়ে বিরাজ করছে দুটি অনন্যা রূপসীর রূপ নিয়ে। সমবয়সিনী, সমান বেশভূষা, কবরীবিন্যাস। শুধু দৃষ্টিবিনিময়ের পর প্রথমবার সুকুমার মুখপ্রীতি প্রসন্ন আভার দ্যুতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো আর দ্বিতীয়ার চম্পকবর্ণ মুখে দেখা গেল রক্তোচ্ছ্বাস। সপ্রতিভ অথচ সলাজ আনন নত হয়ে এল তার।
দানবাধিপ কুমারের বামস্কন্ধে বামহস্ত স্থাপন করলেন — বিদ্যুৎ, আমার অনুজা। আর - কমলিনী।
কুমার অপলকে চেয়ে রইলেন প্রাণময়ী দুই প্রতিমার দিকে। কিয়ৎক্ষণ চিত্রবৎ থাকার পর আবার তাঁর মধ্যে সঞ্চার হল চেতনার। পাশরজ্জু আকর্ষিত হল। আর একবার পুষ্পবৃষ্টি হল সমস্ত পরিপার্শ্ব জুড়ে। কুমার কমলিনী; বজ্র, বিদ্যুৎ — সকলেই অভিষিক্ত হলেন সেই বর্ষণে। কয়েকটি সুবর্ণবর্ণ পুষ্প আবদ্ধ হয়ে রইল বিদ্যুৎ এবং কমলিনীর কবরীতে।
বিদ্যুৎ কমনীয় দ্যুতিতে দ্যুতিময়ী হলেন - কুমার! অগ্রজকে সখা ক'রে নিলে, আমায় সখী হতে পারার সৌভাগ্যে বঞ্চিত করবে না তো?!
কুমার প্রীতিবশ হয়ে বললেন - সাধ্য কী!
বজ্র হেসে ফেললেন - তাহলে শুধুমাত্র সাধ্যের অভাববশতই সখা হতে সম্মত তুমি?
কুমার অসহায়ভাবে বললেন - তাই। তোমরা আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা সম্মতি-অসম্মতি আমার থাকতে দাওনি আর। তোমাদের অধিকারে নিয়ে নিয়েছ।
বজ্রের মুখ কৌতুকহাস্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, - না নিও - সাধ্য কী! তা নাহলে এতক্ষণে যে উদ্ধারকারী রাজপুত্রের খড়্গাঘাতে দুরাচারী দানবের মুণ্ডচ্ছেদ হয়ে যেত!
দুই সখী কলস্বরে হেসে উঠলেন।
লজ্জায় অধোবদন হলেন রাজপুত্র। তাঁর মুখ, কর্ণমূল রক্তিম হয়ে উঠল।
বিদ্যুৎ এগিয়ে এসে রাজপুত্রের হাত ধরলেন। পরম মমতায় বললেন - ছি! অতিথিকে কি এমন অপ্রতিভ করে! অগ্রজের রসবোধ ক্ষেত্রবিশেষে এমন মাত্রা অতিক্রম করে! সখা! তুমি ওদের কথায় কর্ণপাত কোরো না তো! এসো আমরা আহার করি আগে।
রাজপুত্র লজ্জা ভুলে অবাক হয়ে বললেন - কেউ আহার করোনি তোমরা!
বিদ্যুৎ হেসে ফেললেন। রমণীয় ভঙ্গিতে গ্রীবা হেলিয়ে বললেন - তাইতো। কারো-কারো আহারপর্ব সমাধা হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, তাই না? তা, সে ব্যাপারে ত্রুটি যখন হয়েই গিয়েছে, তখন সমবেত প্রচেষ্টায় তার প্রতিকার ক'রে ফেলাই তো ভালো। তাই নয় কি? - তারপর মিনতির সুরে বললেন - এখন কথা বাড়িও না আর। আগে চলো। বড়ো ক্ষিদে পেয়েছে।
কুমার অপ্রতিভভাবে বললেন - কোথায়... কিভাবে...
বিদ্যুৎ মৃণাল-বাহু দিয়ে কমলিনীর কটি বেষ্টন ক'রে ভঙ্গি ভরে ফিরে দাঁড়ালেন - অনুসরণ করো।
স্বর্ণচম্পকের পশ্চাতে যত্ননির্মিত পথরেখা। সর্পিল গতিতে পথ এগিয়েছে। দুপাশে সারিবদ্ধ জনতার মতো ক্রমোচ্চ শিলাশ্রেণী। মধ্যে নিয়মিত ব্যবধানে বৃক্ষরাজি। ফলবান অথবা পুষ্পিত। গিরিপথ উচ্চে উঠতে লাগলো। কয়েকটি নয়নাভিরাম বাঁক। অবশেষে - নয়নরঞ্জন অধিত্যকা।
চতুর্দিকে ক্রমাবনত হয়ে নেমে গেছে শিলাস্তর। মধ্যভাগে এক শৈলপ্রাসাদ। মেঘবরণ স্ফটিকনির্মিত, ভাসমান একখণ্ড মেঘ যেন। চতুর্দিকে অলিন্দ। উড়ন্ত মরালের মতো শীর্ষদেশ।
সপ্তাশ্ববাহন তন্ময় হয়ে দেখছিলেন। তন্ময়তা ভঙ্গ হল বজ্রের মৃদু আকর্ষণে - শোভাসন্দর্শনের সময় থাকবে। আগে অন্নাহার।
কুমার অপ্রতিভ হয়ে অন্যদের সঙ্গে প্রাসাদের সপ্তসোপান অতিক্রম করলেন।
পঞ্চম দিবসে অন্নের স্বাদ সমস্ত শরীর-মনের ক্লেশ দূর করে দিল। আচমনের পর বজ্র তাকালেন সপ্তাশ্ববাহনের দিকে। সপ্তাশ্ববাহন হেসে ফেললেন। বজ্র উৎসুক হলেন - হাসি কেন?
সপ্তাশ্ববাহন বললেন - এইবার এইসব প্রশ্ন ক্রমান্বয়ে উচ্চারিত হতে যাচ্ছে - আমি তৃপ্ত হয়েছি কিনা, বিশ্রাম করতে ইচ্ছুক কিনা ... এই সবই তো?
বজ্র অট্টহাস্য করে উঠলেন। মুহূর্তে তাঁর 'বজ্র' নামের সার্থকতা বোঝা গেল। ধ্বনিত হয়ে উঠল প্রাসাদ। প্রতিধ্বনিত হল পর্বত। দীর্ঘ-দীর্ঘক্ষণ ধরে।
হাসি থামলে বজ্র বলললেন - বেশ। তবে তোমার প্রশ্নগুলি বিষয়ে দু-একটি কথা বলি?
কুমার সোৎসুক প্রশ্ন করলেন - শুনি!
বজ্র কিছুসময় স্থির হয়ে রইলেন। কৌতূকোজ্জ্বল আনন ক্রমশঃ শান্ত, প্রসন্ন, উদাত্ত দেখালো। মন্দ্রস্বরে বললেন - তোমার প্রথম প্রশ্ন - প্রাসাদ এমন নীরব নির্জন কেন? আগমন হতে এত সময় পর্যন্ত এই চারজন ব্যতীত আর কারো দর্শন তো দূরস্থান, আভাস পর্যন্ত পাওয়া না যাওয়ার কারণ কী?
রাজপুত্র মুগ্ধ হয়ে বললেন - যথার্থ।
বজ্র বললেন - তাহলে আমার অনুচ্চারিত প্রশ্নক্রমের অন্তত একটির উত্তর দিতে হচ্ছে তোমায়।
কুমার বললেন - কী?
বজ্র - আমরা অবশ্যই ধারণা করতে সক্ষম যে এই প্রশ্নোত্তর, কথোপকথন, আলাপচারী দীর্ঘসময় চলবে। ভোজনশেষে দণ্ডায়মান অবস্থায় নিশ্চয়ই আমরা তা হতে দিতে পারিনা। তুমি এবং আমাদের প্রিয়বান্ধবী কমলিনী আমাদের দুই ভাইবোনের অতিথি। সখী অতিথি হলেও সপ্তদিবানিশি এখানে তার অবস্থিতি। সাধ্য এবং জ্ঞান অনুসারে তার যত্নের ত্রুটি হতে দিইনি। অপরপক্ষে তুমি সদ্য আগত। বিগত সপ্তদিবস অসামান্য শ্রম করেছো। সময় যত এগিয়েছে, তত তা কঠিন হয়েছে। শুধুই শারীরিক নয়, মানসিকও। তাই শয়নকক্ষে বিশ্রাম না নিলেও কোথাও সুখপ্রদ উপবেশন প্রাথমিক প্রয়োজন নয় কি?
কুমার প্রীতভাবে বললেন - প্রয়োজন। আমার নিদ্রাকর্ষণ না হলেও বিশ্রামের ইচ্ছা প্রবল হয়েছে। বিশেষতঃ প্রিয়বান্ধবীর নির্বন্ধাতিশয্যে আমি সাধ্যের অতিরিক্ত অন্নগ্রহণ করেছি। তা শরীরকে শিথিল করেছে। কিন্তু কৌতূহল প্রবলতর হয়ে আমাকে সজাগ থাকতে বাধ্য করছে।
বজ্র বললেন - তবে এসো। তুমি যাতে পূর্বদিগন্তের শোভা অবলোকন করতে পারো, ভোজনকক্ষে সেজন্য পূর্ব অলিন্দ অভিমুখী আসনে বসতে দেওয়া হয়েছিল তোমায়। এখন বরং পশ্চিম অলিন্দে গিয়ে বসি আমরা।
পশ্চিমদিকের অলিন্দে তখন দিনান্তরবি ক্রমশঃ অস্তরাগলীন। মায়াময় কিরণে মেঘমালা সদৃশ প্রাসাদ, উড়ন্ত মরালপংক্তির মতো অলিন্দ - সবই এক মায়াতরণীর মতো পর্বতের কোলে ভাসমান। সেই আশ্চর্য আলোকে অভিষিক্ত হতে-হতে সপ্তাশ্ববাহন বজ্র-বিদ্যুৎ ও কমলিনীর সঙ্গে এসে উপস্থিত হলেন অলিন্দে।
কিছুক্ষণ সেই অনৈসর্গিক নিসর্গশোভা স্তব্ধ করে রাখলো সবাইকে। তারপর বজ্র কথা বলে উঠলেন - সখা! এই যে প্রাসাদ তুমি দেখছো, এই হর্ম্যের নাম - 'মেঘকেতন'। এটি মূলপ্রাসাদ নয়। দানবপতির বিশ্রামভবন। তুমি এতক্ষণে লক্ষ্য করে থাকবে, এর প্রতিটি বিন্যাস পরিকল্পনা ক্লান্ত চিত্তকে স্বপ্নময় শান্তিপ্রদান করার লক্ষ্যে। পুর্বস্থিত অংশ - 'পূর্বাচল', পশ্চিমাংশ - 'অস্তাচল', উত্তর ও দক্ষিণের অংশ - 'উত্তরায়ণ', 'দক্ষিণায়ন'। আমরা এই মুহূর্তে অবস্থান করছি 'অস্তাচল'-এ। এই যে পর্বত, এর নাম 'মেঘকিরীট'।
কুমার মুগ্ধস্বরে বললেন - এমন স্বপ্নিল নামকরণ কে করেছিলেন? অবশ্যই কোনো মহাকবি?!
- পিতৃদেব - দানবপতি মেঘ। তাঁর অপ্রতিম অধিকার - শস্ত্রে এবং শাস্ত্রে, কাব্যে এবং কলায়। আমাদের দুই ভ্রাতা-ভগ্নীর যা কিছু শিক্ষা, তা তাঁর আর মাতৃদেবী বর্ষার পাদপীঠে। সেকথা এই সময় থাক, প্রসঙ্গান্তর হয়ে যাবে। যা বলছিলাম - পার্বত্যপথ অবলম্বনে পাদদেশ হতে 'মেঘকিরীট'-শীর্ষ সপ্তযোজন। তুমি জানো - পার্বত্যপথ সরাসরি দূরত্ব নির্ণয় করেনা। সমতলভূমি হতে পর্বতশীর্ষ এই পরিমাণ উচ্চ নয়। যাইহোক, মূলপ্রাসাদ 'বলাহক' পর্বতশীর্ষে নয়, অধিত্যকায়। ঐ অধিত্যকা সমতল হতে চতুর্যোজন। আবার 'বলাহক' হতে 'মেঘকেতন' দুইযোজন নিম্নস্থ অধিত্যকায় অবস্থিত। অর্থাৎ সমতল হতে দুই যোজন। কিন্তু পথ পরিহার করে তোমার মতো গিরিগাত্র অবলম্বনে উঠে এলে তা অর্ধযোজন মাত্র।
কুমার বললেন - এতক্ষণে আমি ধাতস্থ হলাম।
বজ্র সপ্রশ্ন হলেন - হেতু?
কুমার - লিপিচিত্রে দানবপুরীর যে অবস্থান দেখেছিলাম, 'মেঘকেতন' তার চেয়ে নিম্নতর অঞ্চলে অবস্থিত। চিন্তিত হচ্ছিলাম - আমার ভ্রান্তি কোথায় ঘটল। এখন তার অর্থ বুঝতে পারছি। কিন্তু তাহলে 'মেঘকেতন'-এর চিত্র অঙ্কিত না করে 'বলাহক'-এর চিত্র ...
বজ্র অর্ধপথে বললেন - সহজ কারণ 'বলাহক'-এর দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে মনে করে যাত্রা করলে 'মেঘকেতন'-এর দূরত্ব অতিক্রম সহজ হয়। এমনকি অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির আনন্দ অতিরিক্ত লাভ হয়। কিন্তু 'মেঘকেতন'-এর দূরত্ব অতিক্রম করার প্রস্তুতি নিয়ে যাত্রা করলে শেষ পর্যায়ে শ্রান্তি এসে যাওয়ারই সম্ভাবনা।
কুমার হেসে বললেন - তুমি মনস্তত্ত্ববিদ্ বটে।
বজ্র বললেন - অন্য হেতুও ছিল। উপস্থিত সে কথা থাক। এই বিশ্রামভবন যাতে জনরব ও অন্যান্য অনেক কিছুর দ্বারা ভারাক্রান্ত না হয়, সে কারণে এখানে বা এর এক যোজনের মধ্যে জনসমাগম বর্জিত। এর উপর তোমার আগমন উপলক্ষ্যে পূর্বব্যবস্থাক্রমে কর্মকুশলী এবং রক্ষীদের পর্যন্ত দানবজনপদেই অবস্থিতি করতে নির্দেশিত করা হয়েছে।
কুমার বললেন - সে তো তখনই অনুমান করেছি যখন দেখেছি প্রিয়সখী স্বহস্তে আমাদের অন্ন বিতরণ করছেন।
বজ্র বললেন - বিতরণই শুধু নয়, প্রস্তুতও করেছেন তিনিই।
বিদ্যুৎ সাগ্রহে প্রশ্ন করলেন - সখা! অন্নব্যঞ্জন অরুচিকর হয়নি তো?!
রাজপুত্র বললেন - রহস্য করেও তোমার রন্ধনশৈলীর অপ্রশংসা করতে পারি না। তোমরা দুইজনই আপাদমস্তক শিল্পী। কিন্তু সখি! তুমি আমার প্রিয় ব্যঞ্জনগুলির বিষয়ে অবগত হলে কী করে? একটি-দুটি পদের যোগাযোগ কাকতালীয় হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে প্রতিটি তা হতে পারে না। এর রহস্য আমার কাছে বিবৃত করো।
বজ্র, বিদ্যুৎ এবং কমলিনীর মুখে হাসির ছটা লাগলো। বজ্র বললেন - চলো, সভাকক্ষে গিয়ে বসি।
প্রশস্ত সভাকক্ষে প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে মধ্যভাগে গিয়ে দণ্ডায়মান হলে সম্মুখে সমতুল চারটি সিংহাসন। দ্বিস্তর সভাকক্ষগাত্রে, স্তম্ভে, শীর্ষে - পীত, হরিৎ ও কপিশবর্ণের অলংকরণ। সিংহাসন চতুষ্টয়ের সম্মুখে এক প্রশস্ত আধার। তার উপর অজ্ঞাতপরিচয় বস্তুসম্ভার বৃহৎ চীনাংশুকে আবৃত। সবাই নিকটবর্তী হলে বজ্র চীনাংশুক অপসারিত করলেন। সযত্নরক্ষিত সপ্তাশ্ববাহনের সতত সহচরবৃন্দ - দেবাশিস, আয়ুষ্মান, কূর্মাবতার, কৃতান্ত, বিশ্বত্রাস, অনন্ত, উবলয়, বলদেব।
কুমার সস্নেহ আবেগে স্পর্শ করলেন, সকলকে। তারপর কটিদেশ হতে মহাকালকে স-কোষ মোচন করে স্থাপন করলেন তাদের পাশে।
বজ্র বললেন - একি!
কুমার বললেন - এখন আমার যাবতীয় দায় এবং দায়িত্ব আমার প্রিয়বান্ধব এবং প্রিয়বান্ধবীর। তাই অবকাশযাপনের অবসর দিলাম আমার বাহিনীকে।
কমলিনী বিহ্বল আবেগে বললেন - চমৎকার!
বজ্র-বিদ্যুৎ উভয়পার্শ্ব হতে কুমারের উভয় কর স্পর্শ করলেন।
- কুমার! তুমি মায়াবিদ্যার কথা শুনেছো?
- শুনেছি।
- কোথায়?
- রূপকথায়।
- এসো। আজ তোমাকে মায়ামুকুর প্রত্যক্ষ করাই।
সিংহাসনের কাছে এসে বজ্র বললেন - কুমার! শাস্ত্রকুশল ব্যক্তিরা আচরণবিধি নির্ণয় করতে গিয়ে সভায় উপবেশন সম্পর্কে কী বিধান দিয়েছেন?
- বিধান এই, যিনি প্রধান, তিনি অবস্থান করবেন দক্ষিণে কনিষ্ঠ বামে। অসমসংখ্যক হলে প্রধান অবস্থান করবেন মধ্যে। অন্যেরা জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠভেদে দক্ষিণে ও বামে। কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠের অপেক্ষা উচ্চে অবস্থান করবে না। সম্ভবক্ষেত্রে নিম্নে অবস্থান করবে। জ্যেষ্ঠ উপবেশন না করলে কনিষ্ঠও তা করবে না।
- সাধু! তুমি এবং সখী 'মেঘকেতন'-এ অতিথি। অতএব সম্মাননীয়। তোমরা অবস্থান করবে মধ্যভাগে। আমি জ্যেষ্ঠ, অতএব দক্ষিণ আসন আমার প্রাপ্য। বিদ্যুৎ থাকবে বামে।
সবাই সিংহাসনে আরোহণ করলেন। সূর্য এতক্ষণে অস্তগমন করেছেন। ছায়াচ্ছন্ন হয়ে উঠতে শুরু করেছে দিগ্মণ্ডল। সভাকক্ষেও লেগেছে তার ছোঁয়া। কুমার আলোকের অভাবের কথা উল্লেখ করবেন কিনা চিন্তা করছেন, বজ্র রহস্যঘন কণ্ঠে বললেন - সখা! সম্মুখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করো।
কুমার সাশ্চর্যে লক্ষ্য করলেন - সভাকক্ষের প্রধান প্রবেশদ্বারের উপরস্থ ভিত্তিগাত্র ক্রমশঃ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ক্রমে ক্রমে তা এত উজ্জ্বল হয়ে উঠলো যে সমগ্র কক্ষ চন্দ্রাতপের মতো স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। সেই আলোকোজ্জ্বল ভিত্তিগাত্রে ফুটে উঠলো চলচ্ছবি। দর্পণে প্রতিবম্ব যেন। এক খরস্রোতা নদী। তার তীরে এক অশ্বারোহী। সুবিশাল শ্বেত অশ্ব, অশ্বারোহীর পরনে যোদ্ধৃবেশ, হাতে একখানি পট। একবার পটখানি দেখছে। আবার মুখ তুলে নিরীক্ষণ করছে নদীকে। কুমার অস্ফুটে বললেন - আমি।
দীর্ঘক্ষণ ধরে বয়ে চললো মায়ামিছিল। নদী অতিক্রমণ, প্রথম রাত্রিবাস, অরণ্য অতিক্রমণ, মৎস্যশিকার, হরিণের শুশ্রুষা, অরণ্যে শেষ রাত্রিযাপন, পর্বতারোহণ, ঘনবর্ষণ, শিলাস্খলন, শৈলশিরা অতিক্রমণ ...। শিলা চত্বরে এসে কুমারের বিহ্বল হয়ে দণ্ডায়মান হওয়ার মুহূর্তটিতে এসে মায়ামুকুর স্তব্ধ হয়ে গেল।
সংবিৎ ফিরে পেয়ে কুমার দেখলেন - মায়ামুকুর ক্রমশঃ নিষ্প্রভ হয়ে আসছে। কক্ষ প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে - চন্দ্রালোকে এবং মণিকুট্টিম হতে তার প্রতিফলনে। অলিন্দপথে অবারিত স্নিগ্ধ পবনবীজনে কখন তিরোহিত হয়েছে কঠিন পর্বতারোহণের ক্লান্তি। যদিও ক্ষীণ বেদনা আহত স্থানগুলিতে তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।
বজ্র হাত রাখলেন কুমারের পিঠে - সখা!
কুমার সাগ্রহে তাঁর দিকে ফিরলেন - সখা! এ কী করে সম্ভব?
রহস্যঘন হাসি হাসলেন বজ্র - দানবী মায়া।
বিদ্যুৎ বললেন - আমার প্রস্তাব যদি রুচিস্কর হয়, চলো প্রাসাদশীর্ষে বসি গিয়ে।
কুমার এবং কমলিনী একযোগে বললেন - চমৎকার।
সিংহাসন চতুষ্টয়ের পশ্চাতে সভাকক্ষের বায়ুকোণ হতে প্রাসাদশীর্ষে আরোহণের সোপানশ্রেণী। সেই অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার পূর্বমুহূর্তে বিদ্যুৎ সখীর গ্রীবা বেষ্টন করে কর্ণকুহরে কী বললেন। কমলিনী সলজ্জে গ্রীবা হেলিয়ে সম্মত হতে হেসে কুমারের দিকে চাইলেন - সখা! পাষাণ সোপানে আরোহণ করার আগে এই শিল্পসোপানে আরোহণ করো।
সকলে পশ্চিমদিগস্থ সভাকক্ষগাত্রের নিকটে এসে দাঁড়ালেন। সম্পূর্ণ কক্ষগাত্রকে আবরণ করে উজ্জ্বল পীত পটাবরণ। বিদ্যুৎ অগ্রসর হয়ে একপ্রান্ত হতে আবরণপট আকর্ষণ করলেন। আবরণ অপসৃত হলো। সিংহাসন চতুষ্টয়ের পশ্চাতে, তাঁদের শীর্ষপ্রমাণ উচ্চতা হতে অসামান্য ভিত্তিচিত্র। অবিকল সিংহাসন, একই অনুক্রমে উপবিষ্ট তাঁরা চারজন। চিত্র অতি প্রাণবন্ত। যেন মায়ামুকুরের প্রতিফলন।
কুমার আপ্লুত স্বরে বললেন - এই রূপশিল্প .. একি..
বিদ্যুৎ এবং বজ্র, দুজনে দুই বাহু ধারণ করে সলজ্জ কমলিনীকে কুমারের সম্মুখে স্থাপন করলেন - এই সেই গুণবতী, মহারাণী কমলার প্রথমতমা শিষ্যা।
এক প্রস্ফুটিত শ্বেত কমল যেন চন্দ্রকিরণে স্নাত এই সদ্যতরুণী। কুমার নিষ্পলকে চেয়েছিলেন। বজ্রের স্নিগ্ধগভীর কণ্ঠ শ্রুত হল - কুমার! কষ্টস্বীকার সার্থক তো? আমাদের প্রিয়তমা সখী বীর্যশুল্কে অর্জনের যোগ্যা তো?
কুমার নতশির হলেন। সশ্রদ্ধ মমতায় গাঢ়স্বরে বললেন - আমার সৌভাগ্য, যদি অর্জন করতে পেরে থাকি।
কানের পাশে বীণা বেজে উঠলো - এই কারুকর্ম সম্পন্ন করেছে এই দুটি চারু কর। - কুমার ফিরে দেখেন, পট পরিবর্তিত হয়েছে। এখন লজ্জাবনতমুখী বিদ্যুতের মুখ তুলে ধরেছেন কমলিনী।
- এসো! - বজ্রের আহ্বানে অগ্রসর হলেন কুমার। দক্ষিণ অভিমুখী যুগলমরাল বেদিকায় আসন নিলেন সকলে। কিছুক্ষণ সুখস্তব্ধ নীরবতা। তারপর বজ্র বললেন - কুমার! আমাদের প্রথম সাক্ষাতের সময় তুমি এমন স্বপ্নাবিষ্ট ছিলে যে শস্ত্রধারী রাজপুরুষ অপেক্ষা কবি বলেই মনে হচ্ছিল তোমায়। আমার আবির্ভাবও যেন অনপেক্ষিত ছিল না তোমার কাছে। আমার ধারণা কি অভ্রান্ত?
কুমার বললেন - অভ্রান্ত।
বজ্র - অথচ তুমি যখন নদী অতিক্রম করে অরণ্যমধ্যে প্রবেশ করলে তোমার হাবভাব ছিল সতর্ক। অরণ্যে বিভিন্ন সময়ে তোমার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে। আবার অন্যান্য সময়ে তোমাকে দেখিয়েছে চিন্তারহিত। অরণ্যে তৃতীয় রাত্রির তৃতীয় প্রহরে নিদ্রাভঙ্গের পর অস্ত্রাদি অপহৃত দেখে তুমি সেই নিশ্চিন্তভাব বজায় রাখতে পারোনি। বস্তুতঃ এই সময়ই তোমায় সর্বাপেক্ষা সতর্ক, এমনকি - এই শব্দ ব্যবহারে যদি তোমার আপত্তি না থাকে - চঞ্চল দেখিয়েছিল। ঠিক?
বজ্র - তাহলে তুমি আশেপাশে আমার উপস্থিতি অনুমান করেও চঞ্চল হলে না কেন? সতর্কতা, চঞ্চলতা যেন তোমায় চিরকালের জন্য ত্যাগ করে গিয়েছিল। এই সবের কারণ কী, তা আমাদের পূর্বাপর ব্যাখ্যা করে বলবে কি?
- অবশ্যই। কিন্তু আমার মনেও কৌতূহল আছে। আছে জিজ্ঞাসা। তার শান্তিবিধান করবে তো? প্রতিশ্রুত আছো, স্মরণে আছে?
- আছে বৈকি। আমি তখনই তোমার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম। চাইনি। কারণ তোমার শ্রান্ত, ক্ষুধায় আর্ত মুখচ্ছবি ছিল আমার দৃষ্টির সম্মুখে, যা তোমার সম্মুখে ছিল না। এখন যখন তোমার স্বাভাবিক যৌবনদৃপ্ত সপ্রাণতা ফিরে এসেছে, তখন তা অনায়াসে করা যাবে। আরম্ভ কর। আমরা সবাই এক হয়ে অংশ নিই শ্রবণে, কথনে।
কুমার আরম্ভ করলেন - পিতা প্রথম যখন চিত্রিত লিপি আমার হাতে তুলে দিলেন, আমি তার রচনাশৈলী ও সুষমায় চকিত ও অভিভূত হয়ে পড়লাম। সেকথা প্রকাশ করতেও দ্বিধা করিনি। দেখা গেল পিতৃদেব ও মাতৃদেবীও তদ্রুপ। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া যেতে পারে যে পদ্মনাভপুরে উপনীত হলে মহারাজ পদ্মনাভ এবং মহারাণী কমলাও আমাদেরই মতো মনোভাব পোষণ করেন বলে জানতে পারি। তখন মনে দ্বিধা রয়ে গেল একটিই - লিপিকরের উদ্দেশ্য নিয়ে। যে আহবান সে জানিয়েছে, তা কি প্রতিদ্বন্দ্বিতার, না পরীক্ষার?
বজ্র - একথা মনে হল কেন?
সপ্তাশ্ববাহন - কারণ লিপির মধ্যে সাহস, মেধা, বুদ্ধি বিবেচনা এবং বোধের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এও প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তবে কেবলমাত্র শস্ত্রেরই নয়, নয় শাস্ত্রেরও শুধু। ব্যক্তিবিশেষের ধীশক্তি এবং রহস্যের গ্রন্থিমোচনের ক্ষমতারও পরখ। অতএব পরীক্ষা।
আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলে মনে হওয়ার কারণ বীরোচিত দর্প, সাহসের উল্লেখ, একাকী আসতে বলা ...
বজ্র - আচ্ছা, একাকী আসতে উদ্দীপ্ত করার পিছনে অন্য উদ্দেশ্য নেই, একথা মনে হওয়ার কারণ?
কুমার - এই প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য : প্রাপককে পরীক্ষা করা - লিপির অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য সে লক্ষ্য করেছে কিনা। করেছি। কিন্তু তখন তখনই তা প্রকাশ করিনি।
বিদ্যুৎ হাসিমুখে বললেন - শুনি কী?
কুমার - আমার নামের আগে 'কুমার' এবং পত্র শেষে ক্রিয়াপদের অন্তে সম্মানসূচক 'ন' ব্যবহার। ক্ষতি করার মতো হীন মানসিকতা থাকলে এ বৈশিষ্ট্য থাকতো না। ঠিক?
বিদ্যুৎ - এমনও তো হতে পারতো যে ওটি ইচ্ছাকৃত নয়। অনবধানতাবশতঃ ওরকম হয়ে গিয়ে থাকবে।
কুমার - তাহলে পত্রের লিপি বা চিত্রের অন্যত্রও অনবধানতার চিহ্ন থাকার সম্ভাবনা ছিল। তাছাড়া, তেমন হলে তো আরো ভরসার কথা। কারণ, অনবধানতাবশতঃ যা প্রকাশ পায়, তা স্বভাবের মূল বৈশিষ্ট্য।
বজ্র সাহ্লাদে জড়িয়ে ধরলেন কুমারকে। কমলিনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন - প্রিয়বান্ধব! এই মেধা পরীক্ষায় আমাদের প্রিয়বান্ধব উত্তীর্ণ তো?
কমলিনী বিদ্যুতের পৃষ্ঠদেশে মুখ লুক্কায়িত করে বললেন - উত্তীর্ণ।
কুমার স্মিত মুখে বলে চললেন - আমার এই ধারণা পরিপুষ্ট হলো, যখন সিক্ত চিত্রলিপিখানি রৌদ্রতাপে তার আর্দ্রতা হারালো অথচ লাভ করল সুকৌশলে অঙ্কিত, অপরের নিকট অদৃশ্য, মানচিত্রখানির সুবর্ণ রেখা। অবশ্য এই প্রসঙ্গেও কূটতর্ক তোলা যেতে পারে - চিত্রকরের উদ্দেশ্য, পথপ্রদর্শনের ছলে, বিপথে চলনা করে অভিযাত্রীকে বিপদগ্রস্ত করা। কিন্তু চতুর্থ দিবসে নদী অতিক্রম করার সময়ই আমি আমার ধারণার সমর্থন পেলাম। যে সপ্তদ্বীপ অবলম্বনে আমি নদী অতিক্রম করেছিলাম, তারা ছিল সহজে অধিগম্য। সেইসব দ্বীপ নদীগর্ভ হতে ক্রমান্বয়ে মসৃণভাবে মাথা তুলেছিল। জলমগ্ন কঠিন প্রস্তরময় ভূমিতে পদস্থাপন করতে পেরে আমার প্রিয়বাহন তুরঙ্গপ্রধান যখন সন্তরণের পরিবর্তে পদচালনা করতে-করতে উচ্চ দ্বীপভূমির দিকে উঠে আসছিল, তখনও স্রোতের বেগ অনুভব করা যাচ্ছিল। দ্বীপগুলি তৃণাস্তৃত ছিল। তাতে আমার অশ্বের পরিশ্রমের ফলে উৎপন্ন ক্ষুধার শান্তি হচ্ছিল। দ্বীপ সমতল হওয়ায় সে ইতস্ততঃ ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছিল। একাধিক দ্বীপে মধ্যম আকারের বৃক্ষ থাকায় স-অশ্ব আমি ছায়ায় বিশ্রাম লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
নদী অতিক্রম করার পর তীরভূমিতে নির্দিষ্ট অবতরণ স্থানে পৌঁছেও সুবিধাপ্রাপ্ত হই। শুধু সেই রাত্রে এক ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। আমার প্রিয় সঙ্গী তুরঙ্গপ্রধানকে হারাতে হয় সিংহের আক্রমণে। ভ্রমক্রমে বৃক্ষের যে স্থানে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম এবং যে স্থানে সে অবস্থান করছিল, এই দুইয়ের মধ্যে শাখাপ্রশাখা ইত্যাদির বিস্তর বাধা থেকে যাওয়ায় আমি তাকে রক্ষার উদ্যম করতে পারিনি। তার আগেই সিংহ তাকে আকর্ষণ করে নিয়ে যায়। অথচ অশ্বকে আকর্ষণ করে নিয়ে গেলে এবং তাকে হত্যা করলে স্থানে স্থানে তার চিহ্ন থাকা উচিত। কিন্তু কোথাও অতবড় অশ্ব বা তার সজ্জার চিহ্নমাত্র দেখিনি পঞ্চম দিন প্রাতে।
কমলিনী আবার বিদ্যুৎ-এর পিঠে আত্মগোপন করলেন। বিদ্যুৎ মাথা নত করে মনোভাব গোপন করলেন। শুধু বজ্র সেই রহস্যপূর্ণ হাসি হেসে বললেন - অতঃপর?
কুমার - স্নানাদির পর অরণ্যভূমি অতিক্রম করার সময় লক্ষ্য করলাম চিত্র-নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে প্রচুর ফলবান বৃক্ষ এবং প্রাকৃতিক সুমিষ্ট জলের কুণ্ড পাওয়া গেল। একে আহ্বায়কের সহৃদয় পৃষ্ঠপোষকতার লক্ষণ বলে অনুমান করা গেল এবং লিপির যে আহ্বানকে আগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মনে হয়েছিল, তা যেন এখন চাপা কৌতুক বলে মনে হতে লাগল। তবু এত শীঘ্র কোনো ধারণা করে নেওয়া প্রাজ্ঞতা না হতে পারে ভেবে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত গঠন করলাম না। ষষ্ঠ দিবসে মনে হল সঠিক কাজ করেছি। কারণ পথে যে কয়টি ফলের বৃক্ষ পাই, সবই ছিল আশ্চর্যরকম ফলশূন্য। বানরকূলের সাড়া দূর বনমধ্যে পেয়েছিলাম। কিন্তু একটি বানরযূথের পক্ষে যাবতীয় ফল ক্রমান্বয়ে আত্মসাৎ করতে করতে চলা সম্ভব কি? যদি হয়ও, ভুক্তাবশিষ্ট কিছু ফলের চিহ্ন ছড়িয়ে থাকা উচিত। যখন তা নেই, তখন নিশ্চয়ই এ কোনো সুপরিকল্পিত ঘটনা। সজাগ হলাম। খাদ্যের অভাব সৃষ্টি করে আমার বলহীন করা বা করতে চাওয়ার কথা মনে এল।
এই সম্ভাবনা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিল, যখন কটিবন্ধের অসি এবং পাশ ভিন্ন বৃক্ষশাখায় রক্ষিত যাবতীয় অস্ত্র নিশিরাত্রে নিঃশব্দে অপহৃত হল। অন্যান্য ঘটনার ইতিবাচক বা নেতিবাচক - উভয়প্রকার ব্যাখ্যা সম্ভব। কিন্তু এই ঘটনার কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত লক্ষ্য করা গেল না। এই প্রথম আমি আমার চতুপার্শ্বে প্রতিপক্ষের কৌশলী উপস্থিতির আভাস পেলাম। সে আমার খাদ্যের সঞ্চয়ও অপহরণ করেছিল। আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পেলাম - অতি সুসময়ে নিদ্রাভঙ্গ হওয়ায় নিঃশব্দে অগ্রসর হতে থাকা প্রতিপক্ষকে আত্মগোপন করতে হয়েছে। এই মুহূর্তে সে বা তারা যে কোনো এক বা বহু দিক হতে লক্ষ্য করে চলেছে আমায় অথচ আমি তার বা তাদের অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। তারা সশস্ত্র, আমি নিঃশস্ত্র প্রায়। আমি দ্রুত অরক্ষিত অবস্থা হতে পূর্ব অবস্থানে ফিরে গিয়ে সম্পূর্ণ যাত্রার মধ্যে এই প্রথম পূর্ণমাত্রায় সজাগ এবং মনস্কভাবে, প্রস্তুত অবস্থায় কাটাতে লাগলাম।
ভাগ্যক্রমে গুরুপরিশ্রম অন্তে গুরুভোজনের পর গাঢ় নিদ্রা সমস্ত ক্লেশ হরণ করেছিল। তাই রাত্রির শেষপ্রহর অতিক্রান্ত হওয়ার জন্য আমায় কাতরভাবে অপেক্ষা করতে হয়নি।
সপ্তম দিবসে অর্থাৎ আজ ঊষার আলোক সুপরিস্ফুট হওয়ার পর আমি স্থৈর্য ফিরে পাই। অপহৃত অস্ত্র এবং আক্রমণহীন রাত্রির পরস্পর যোগ কল্পনা করে আবার ভাবার চেষ্টা করি এই কৌতুকের অর্থ কী।
গিরি আরোহণ পর্বে ক্ষণবর্ষণ আমায় স্নিগ্ধ করেছিল। কিন্তু আকস্মিক ভূস্খলনে আমি অল্পের জন্য রক্ষা পাই। এ যাত্রা সর্বাধিক বিপদে আমি ঐ সময়েই পড়েছিলাম। ঐ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার পরমুহূর্তেই যখন সুমসৃণ শিলাবেদীর উপর পাষাণে পুষ্পিত শিল্পকর্ম চাক্ষুষ করলাম - তখন সমস্ত শ্রম এবং সংশয় আমায় চিরতরে ত্যাগ করে গেল। আমি নিঃসংশয়ে বুঝলাম - এই সমস্ত কিছু যার দ্বারা পরিকল্পিত, সে আমার ধৈর্য এবং সাহসিকতার পরীক্ষাই প্রকৃতপ্রস্তাবে নিতে চেয়েছিল এবং এখন সে যে তার পুরস্কার দিতে উদ্যত, তাও সে এই সুন্দর স্বাগত সম্ভাষণের মধ্য দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছে। ঠিক এই সময়েই তোমার কণ্ঠে 'কুমার' শব্দের উচ্চারণ আমার কানে মৃদঙ্গধ্বনির মতো বেজে উঠেছিল। সখা! তাই তোমায় দেখে আশ্চর্য হইনি। হইনি চমকিত।
কুমার নীরব হলেন। তাঁর তরুণ কণ্ঠের রেশ মিলিয়ে গেল দিগন্তপ্লাবী জ্যোৎস্নার নিঃসীমতায়। এবার শোনা গেল দানবপতির মৃদুস্নিগ্ধ কম্বুকণ্ঠ - বন্ধু! তোমার ভাষণ যে কী পরিমাণ অভিনন্দনযোগ্য হয়েছে, তা তুমি সকলের মুখ দেখলেই অনুমান করতে সক্ষম হবে। আমি তোমার বিবৃতির কুহেলিকাচ্ছন্ন অংশগুলিতে আলোকসম্পাত করবার উদ্যম করি —
তোমার লিপিচরিত্র বিশ্লেষণ মনোগ্রাহী হয়েছে। তার পুরস্কারস্বরূপ জানাই তোমার প্রিয়সহচর তুরঙ্গপ্রধান সিংহের আক্রমণে নিহত হয়নি। পর্বতের পাদদেশে তোমার অপেক্ষায় রয়েছে দানবসেনার অশ্বপালকদের সযত্ন পরিচর্যায়।
কুমার সচমকে হাত চেপে ধরলেন বজ্রের - তাহলে আমার সংশয় অযথা নয়! কিন্তু আমি সিংহের গর্জন স্বকর্ণে শুনেছিলাম। অশ্বকে আকর্ষণ করার শব্দও আমার কানে ভেসে এসেছিল।
বজ্র হাসলেন - দানবকুল বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিদ্যা আয়ত্ত করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার চর্চা করে আসছে। এর মধ্যে পশুপক্ষীর ভাষাচর্চা অন্যতম। রাজ অশ্বপালকের সঙ্গে সৈন্যবিভাগের যে সমস্ত সেনানী অশ্বহরণপর্বে জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে একজন এই বিদ্যায় পটু। তোমায় বিভ্রান্ত করার জন্য এবং অশ্বনিধন বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য সে ঐ সময়কার সন্দেহ উদ্রেককারী শব্দ চাপা দিয়ে গর্জন করেছিল। সেই গর্জন ধ্বনির অন্তরালে অশ্বকে গোপন স্থানে আকর্ষণ করে নিয়ে যায় অশ্ববিশারদেরা যার আভাস তুমি পেয়েছিলে। অক্ষত অবস্থায় যে অশ্ব সযত্নে নীত হয়েছে, তার চিহ্ন তুমি পাবে কী করে?
কুমার প্রশ্ন করলেন - কিন্তু আমি বাণ বর্ষণ করতে পারতাম! তুরঙ্গপ্রধান অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে যেতে সম্মত হল কেন, সে প্রশ্ন করছি না। রাজ অশ্বপালক এবং অন্যরা নিশ্চয়ই অশ্বকে বশ করার বিদ্যায় বিশেষ দক্ষ!
বজ্র - তুমি এখনও অনুধাবন করোনি কি - প্রতি মুহূর্তে তোমার উপর দৃষ্টি ছিল আমাদের! তুমি যদি এমন স্থানেও আশ্রয় নিতে, যেখান থেকে তীর নিক্ষেপ সম্ভব হত, তাহলে অশ্বকে এমন স্থান দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হত, যেখানটি তোমার পক্ষে অনায়ত্ত থাকত।
কুমার হাসলেন - তাহলে আমাকে বিপাকে ফেলা এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করাই তোমার উদ্দেশ্য ছিল?
বজ্র - কিছুটা। অশ্বারোহণে অভ্যস্ত তুমি কী কর, কত সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় অথবা সন্তপ্ত থাকো এবং তা তোমার কর্মপন্থা, কর্মদক্ষতা, উদ্যম ইত্যাদির উপর কী প্রভাব ফেলে, এসব দেখাই উদ্দেশ্য ছিল।
কুমার - কী দেখলে?
- দেখলাম, তুমি প্রাতঃকালে বৃক্ষ হতে অবতরণের পর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে। তোমার ভ্রু কুঞ্চিত হল। কিন্তু নিস্ফল চিন্তায় কালক্ষেপ না করে স্বাভাবিকভাবে প্রস্তুত হলে এবং এমন সাবলীলভাবে পদব্রজে অগ্রসর হলে যেন এইরকমই পরিকল্পনা ছিল।
কুমার - তোমার অন্য উদ্দেশ্য কী ছিল?
বজ্র - অশ্বারোহণে তুমি অরণ্যপথে দ্রুত অগ্রসর হতে পারতে না। অনেক সংক্ষিপ্ত পথ তোমায় ত্যাগ করতে হত। রাজভবনের সুখ-বৈভবে লালিত তুমি কতখানি শ্রমসহিষ্ণু, কৃতসংকল্প তার পরীক্ষা হত না। অশ্বারোহণে বহুদিন ধরে অগ্রসর হলে তোমার এবং তোমার জন্য অনঙ্গপুরী এবং পদ্মনাভপুরে অপেক্ষারতদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারতো। ফলে ঐ দুই রাজ্যের সৈন্যবাহিনী যুদ্ধযাত্রা করলে ব্যাপার গুরুতর হয়ে দাঁড়াতো।
কুমার বললেন - তুমি প্রাজ্ঞ। তারপর?