প্রতিবেশী ভাতৃপ্রতিম কুণাল তালুকদারের সঙ্গে সকালবেলা গল্প করছিলেন দিব্যেন্দু নিজের বাড়িতে। দুজনেই রিটায়ার্ড, তাই আড্ডার সময় অসময় নেই, সকাল বিকাল যখন হোক হলেই হল। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা দিব্যি জমে উঠেছে এমন সময় এষা ভেতর থেকে এসে দিব্যেন্দুকে বললেন, ‘চা খাবে তোমরা?’
দিব্যেন্দু মৃদু হেসে এষার দিকে তাকালেন, বললেন, ‘বাবা আজ যে দেখি মেঘ না চাইতেই জল।’
এষা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই কুণাল বলে উঠলেন, ‘এই এক মুশকিল আপনাকে নিয়ে দাদা। কখন যে কি বলেন কোনো ঠিক নেই। বৌদি চায়ের কথা জানতে চাইছেন আর আপনি মেঘ বৃষ্টি কত কিছু বলে ফেললেন।’
দিব্যেন্দু কিছু বললেন না, শুধু মুচকি হাসলেন আর এষা কোনোরকম হাসি সামলে ভেতরে চলে গেলেন।
দিব্যেন্দু বছর পাঁচেক হল রিটায়ার করেছেন। চাকরিজীবনে প্রায় সারা ভারত ঘুরে অবসরের পর নিজের পুরোনো শহরে যেখানে জন্মেছেন, বড় হয়েছেন সেখানে থিতু হয়েছেন। যদিও ছোটবেলার শহরকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, অনেক নতুন লোকজন আশেপাশে তবুও অনেক আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এখনো আছে। ইচ্ছে ছিল তাদের মধ্যেই বাকী জীবন কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু এখানে এসে অবধি দেখছেন ঠিক যেন সুর মিলছে না, কোথায় যেন কেটে গেছে, তিনি জোর করে লাগাবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু কোথায় যেন ওয়েভ লেংথে মিলছে না। শুধু যে তাঁর সমবয়স্কদের সঙ্গেই এটা হচ্ছে তা নয়, নেক্সট্ জেনারেশনের সঙ্গেও ঠিক মিলিয়ে উঠতে পারছেন না। হয়তো এর জন্যে তাঁর মানসিকতাই দায়ী, ভাবেন তিনি। বহু বছর বাইরে বাইরে কাটানোর ফলে তাঁদের অ্যাটিটিউড মেন্টালিটি অনেকটাই আলাদা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসব ব্যাপারকে পাত্তা দিতে একেবারেই নারাজ দিব্যেন্দু আর তাঁর স্ত্রী এষা। পাড়ার বেপাড়ার সবার সঙ্গেই সহজ সুন্দরভাবে মেশেন তাঁরা। সবার জন্যেই অবারিত দ্বার তাঁদের। এই চেষ্টার ফলেই হয়তো পরিচিত মহলে মিশুকে এবং অত্যন্ত ভদ্র বলে তাঁদের নাম আছে।
শুধু মাঝে মাঝে মুশকিল হয় দিব্যেন্দুর। তিনি একটু অন্যরকম, তাঁর সেন্স অব হিউমারও অন্যদের থেকে আলাদা। সঙ্গীত ও সাহিত্যের অত্যন্ত অনুরাগী দিব্যেন্দুর কথাবার্তায় মাঝে মাঝেই গানের বা কবিতার লাইন এসে পড়ে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই কেউ তার মর্মোদ্ধার করতে পারে না, অগত্যা তাঁকে চুপ করে যেতে হয়। আবার তিনি যদি সাহিত্য বা গান বাজনার কথা তোলেন তাহলেও যোগ্য সহযোগী খুব কম মেলে ফলে তাঁকেও বাধ্য হয়ে সেই বাজারদর, ক্রিকেট আর রাজনীতির কচকচিতে ফিরে যেতে হয়।
এই যেমন কদিন আগে এক বিকালবেলা বাড়ির সামনে পায়চারি করছিলেন দিব্যেন্দু। বর্ষাকাল, আকাশে কালো মেঘ, যেকোনো মুহূর্তে ঝেঁপে বৃষ্টি আসবে। দেখলেন সামনের বাড়ির পরিতোষবাবুর ছেলে পরাগ বাইক বার করছে।
দিব্যেন্দু বললেন, ‘নীল নবঘন আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে, ওরে আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’
পরাগ একটু দাঁড়াল, তারপর বলল, ‘বাঃ কাকু, বেশ ছড়া বানান তো আপনি, লিখে রাখুন না-হলে পরে ভুলে যাবেন,’ বলেই বাইক নিয়ে সে প্রায় উড়েই বেরিয়ে গেল।
দিব্যেন্দু হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিলেন।
আরেকদিনের কথা। সেদিন পোস্টঅফিস থেকে কাজ সেরে বেরোতে বেরোতেই বেলা হয়ে গেল, বাইরে বেরিয়ে দেখলেন সন্ধের আঁধার নেমে এসেছে, সূর্য মুখ লুকিয়েছে কালবৈশাখীর ঘন কালো মেঘের আড়ালে। তিনি জোরে পা চালালেন। একটু এগিয়ে দেখলেন তাঁর এক প্রতিবেশী রাস্তার ওপারে একজনের সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁকে দেখে চেঁচিয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি যান দিব্যেন্দুবাবু, ঝড় আসছে।’
দিব্যেন্দুও হাঁটতে হাঁটতেই গলা তুলে বললেন, ‘হ্যাঁ, আজ মধ্যদিনের রক্ত নয়ন সত্যিই অন্ধ হয়েছে।’
‘না, না, চোখে কিছু হয় নি। আমি বলছি ঝড় আসছে, ঝড়, ঝড়!’
দিব্যেন্দু আর কিছু না বলে জোরে হাঁটা লাগালেন। কয়েকদিন পরে শুনলেন তাঁর ওই প্রতিবেশী জনান্তিকে বলেছেন, ‘দিব্যেন্দুবাবু বোধহয় কানে কম শুনছেন। সেদিন আমি ওনাকে ঝড়ের কথা বললাম আর উনি কিসব অন্ধ টন্ধ বললেন।’
একদিন দিব্যেন্দু কয়েকজনের সঙ্গে এক পুরোনো প্রতিবেশী তাপসের নতুন বাড়ি দেখতে যাচ্ছেন। এই তাপস আবার দিব্যেন্দুরই আরেক পরিচিত কমলের আত্মীয়।
‘কি রকম বাড়ি তৈরি করেছে তাপসদা দেখলে বুঝবেন দিব্যেন্দুবাবু। একেবারে তাজমহল,’ বললেন কমল।
দিব্যেন্দু আস্তে আস্তে বললেন, ‘কিন্তু আমি যতদূর জানি তাপসবাবু একবারই বিবাহ করেছেন এবং ওনার স্ত্রী এখনো বেঁচে আছেন।’
‘তাপসদার বাড়ি করার সঙ্গে বৌদির বেঁচে থাকার কি সম্পর্ক?’ কমল আকাশ থেকে পড়লেন।
এই রকম করেই দিব্যেন্দুর দিন কাটছিল। তিনি এষাকে সব বলেন আর এষা হাসেন, ‘কি আর করবে যদি কেউ বুঝতে না পারে। এদের সঙ্গেই তো থাকতে হবে। বরং ওনারা যা বোঝেন না তা বোলো না। ফল তো দেখছো, সবার ধারণা হয়েছিল যে তুমি কানে কম শোনো। মধ্যদিনের রক্ত নয়নের ভাব সম্প্রসারণ করে কি তুমি জনে জনে বোঝাতে যাবে?’
দিব্যেন্দু অল্প হাসলেন, কিছু বললেন না। কিন্তু খুব ভালো ভাবেই জানেন তাঁর স্বাভাবিক পরিহাসপ্রিয়তা, কথা বলার ঢং এই বয়েসে আর বদলাবে না।
দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। দিব্যেন্দুদের পাড়ার পুজো শহরের পুরোনো পুজো, একশো বছরে পা দিল। কাজেই ধুমধাম খুব বেশি। পুজো কমিটি সিদ্ধান্ত নিল এই উপলক্ষ্যে একটি স্মরণিকা প্রকাশের যেখানে অন্যান্য লেখার পাশাপাশি শহরের বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের লেখা প্রকাশিত হবে। তা সে ছোটো গল্প, কবিতাই হোক কি প্রবন্ধ বা স্মৃতিচারণাই হোক। অন্যান্যদের সঙ্গে দিব্যেন্দুর কাছেও আমন্ত্রণ এল লেখার জন্যে।
শুধু তাই নয় কুণাল আবার বাড়িতে এসে বলে গেলেন, ‘দিব্যেন্দুদা আপনার লেখা কিন্তু চাই। আপনার কথাবার্তাই তো অন্যরকম, কত কিছু তো বলেন টলেন। আপনার লেখা না হলে কিন্তু চলবে না।’
দিব্যেন্দু প্রথমে ঠিক রাজী হচ্ছিলেন না। কিন্তু এষাই জোর করতে লাগলেন।
দিব্যেন্দু একটু অবাক হলেন, ‘তুমি লিখতে বলছো?’
‘জানি তুমি অবাক হোচ্ছ। কিন্তু তাও বলছি যা হোক একটা কিছু লিখে দাও না। হালকা কোনো লেখা, নাহয় নিজের জীবনের কোনো ঘটনাই লেখো। শুধু তো আর এরা পড়বে না, কত লোকই তো পড়বে,’ এষা বললেন।
দিন কয়েক দোনামনার পর দিব্যেন্দু কলম ধরলেন, লিখলেন নিজের জীবনের কথা ‘প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে।’ কিভাবে বন্ধুর পাড়ার ফাংশানে এক অষ্টাদশীর গান শুনে প্রথম ভালো লাগা, অভিভাবকদের চোখ এড়িয়ে কলেজের সামনে দেখা করা, তারপর একদিন দুজনেরই সংসারে প্রবেশ, সাংসারিক কর্তব্য পালন করতে করতে এতগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়া, পুরোনো সেই সব দিনের সম্বল শুধু স্মৃতি আর অল্প কয়েকটা হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠি যা তিনি এত বছর ধরে যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। জীবনের এই শেষবেলায় তিনি চান যে সে আবার তার যৌবনের উচ্ছলতা নিয়ে আসুক তাঁর সামনে, একবার অন্তত তিনি তাঁর সেই প্রথম যৌবনের লাবণ্যময়ী প্রেমিকাকে দেখতে চান।
লেখাটা শেষ করে এষাকে পড়ালেন। পড়তে পড়তে এষাও ডুবে গেলেন অতীতে, বললেন, ‘তোমার সব কিছু এত সুন্দর মনে আছে? আমি তো কত কিছু ভুলেই গেছি। সত্যি কেমন সব দিন ছিল আমাদের জীবনেও না? এখন ভাবলেও অবাক লাগে, কত বদলে গেছি। তবে একটা কথা মানতেই হবে, তুমি কিন্তু সেই দিব্যেন্দুই আছ। সেই একই রকম কথা, একই রকম সেন্স অব হিউমার। এতগুলো বছর তোমাকে বদলাতে পারে নি।’
‘তাহলে এর সঙ্গে আরো একটা কথা স্বীকার করো যে ভাগ্য আমার থেকে তোমার প্রতি বেশি প্রসন্ন। তুমি তো সেই দিব্যেন্দুকেই পাচ্ছ,’ হেসে বললেন দিব্যেন্দু।
এষাও হেসে উঠলেন।
লেখা গেল স্মরণিকায় প্রকাশিত হওয়ার জন্যে, যথাসময়ে প্রকাশিতও হল। পঞ্চমীর দিন সবাই হাতেও পেয়ে গেল। দিব্যেন্দুরা পুজোর আগে কয়েকদিনের জন্যে বাইরে গেছিলেন, ফিরলেন সপ্তমীর সকালে। এসে দেখলেন বাড়িতে স্মরণিকা এসে গেছে। এষা আরো একবার লেখাটা পড়লেন। সন্ধেবেলা দুজনে একসঙ্গে মণ্ডপে গেলেন। তাঁদের দেখামাত্রই পরিচিত অপরিচিতদের মধ্যে যেন একটু চাঞ্চল্য দেখা দিল। দুজনেই সেটা লক্ষ করলেন, একে অপরের দিকে তাকালেন।
কুণালই এগিয়ে এলেন, পেছনে আরো কয়েকজন, ‘আরে দিব্যেন্দুদা আসুন, আসুন। বৌদি আসুন। কেমন মণ্ডপসজ্জা হয়েছে বলুন। প্রতিমাও তো দর্শন করেন নি। চলুন আগে প্রতিমা দর্শন করে আসুন।’
দুজনে প্রতিমা দর্শন করলেন, লক্ষ করলেন সবার দৃষ্টি তাঁদের দিকেই, যেন আজ দ্রষ্টব্য তাঁরাই। সুন্দর নয়নাভিরাম প্রতিমা। দশভুজা দেবী দূর্গা মহিষাসুর বধ করে প্রসন্ন নয়নে তাকিয়ে আছেন। দুপাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ। দর্শন করে তাঁরা মণ্ডপের বাইরে এসে বসলেন, অন্য সবাইও সেখানে আছেন।
কুণালই আবার কথা শুরু করলেন, ‘যা একখানা লেখা লিখেছেন না দিব্যেন্দুদা, সবাই আপনাকে দেখতে চাইছে।’
এষা অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন দেখতে চাইছে কেন সবাই? কি এমন আছে লেখায়?’
দিব্যেন্দুও যথেষ্ট অবাক।
‘বলেন কি? কি এমন আছে মানে? আপনি পড়েন নি? কি দিব্যেন্দুদা বৌদিকে পড়ানই নি? পুরোটাই লুকিয়ে লুকিয়ে?’ চটুল হেসে উঠলেন কুণাল।
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান কি বলছেন আপনি আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। লেখাটা আমি পড়েছি, যখন লিখেছে তখনই পড়েছি, পরেও পড়েছি। কি এমন অস্বাভাবিক জিনিস লেখা হয়েছে? এরকম তো কতই হয়, হচ্ছে, হবেও,’ বললেন এষা।
‘কতই হয়? আশ্চর্য করলেন আপনি ম্যাডাম,’ বলে উঠলেন তাপস, ‘এই বয়েসে আবার যৌবনের প্রেমিকাকে দেখতে চাওয়া, তার সব প্রেমপত্র যত্ন করে রেখে দেওয়া। সবথেকে বড় ব্যাপার এই সব কথা প্রকাশ্যে লেখা, আপনার বর্তমানে। না দিব্যেন্দুবাবু আপনি তো মশাই বোমা ফাটিয়েছেন, মানতেই হবে।’
‘দারুণ ক্যালি মশাই আপনার। আমাদের তো সাহসই হত না। নয়তো অল্প বয়েসে আমরাও কি আর একটু আধটু প্রেম ট্রেম করি নি! কিন্তু তাই বলে স্ত্রীর সামনে এই বয়েসে…………’ মন্তব্য আরেকজনের যাকে দিব্যেন্দু চেনেনই না।
‘আচ্ছা আন্টি আপনার একটুও রাগ হয় নি লেখাটা পড়ে?’ এবার পরাগের স্ত্রীর প্রশ্ন, ‘আর ওইসব লাভ লেটারগুলো এত বছর রাখতেই বা দিয়েছেন কেন? পুড়িয়ে দেন নি কেন?’
‘তাকে যে দেখতে চাইছেন ফোন নম্বর টম্বর আছে কাছে? যোগাযোগ করবেন কি করে? নাকি ফেসবুকে আসেন তিনি?’ প্রশ্ন উড়ে এল একপাশ থেকে চটুল হাসির সঙ্গে।
এতক্ষণ এষা, দিব্যেন্দু কথা বলারই কোনো সুযোগ পান নি।
এবার এষা বললেন, ‘আপনারা কি লেখাটা আদৌ ভালো করে পড়েছেন?’
কেউ কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই দিব্যেন্দু আস্তে করে এষাকে বললেন, ‘বাড়ি চলো।’
সদাহাস্যময় দিব্যেন্দু এই প্রথম যেন গম্ভীর। বাড়ি ফিরে এসে দুজনে চুপচাপ বসে রইলেন।
কিছুক্ষণ পরে এষা বললেন, ‘আমারই দোষ। আমিই তোমাকে লিখতে বলেছিলাম। কেউ তো কিছু বুঝল নাই, উলটে পুরো ব্যাপারটাকে এত খেলো করে দিল।’
দিব্যেন্দু কোনো উত্তর দিলেন না, চুপ করে রইলেন।
এষা আবার বললেন, ‘তোমার খুব খারাপ লাগছে আমি বুঝতে পারছি। কি লিখলে আর কি মানে হল।’
একটু চুপ করে থেকে দিব্যেন্দু বললেন, ‘ছোটবেলায় একটা কথা পড়েছিলাম, অরসিকেষু রসস্য নিবেদনং শিরসি মা লিখ মা লিখ। কোনো এক অজ্ঞাত কবি ভগবানের কাছে পার্থনা জানিয়েছেন যে বেরসিকের কাছে রস নিবেদনের বিড়ম্বনা আমার কপালে লিখো না। সত্যিই যে কি বিড়ম্বনা আজ মর্মে মর্মে বুঝলাম।’
মণ্ডপে মণ্ডপে তখন দেবীর সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে।