গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহর। ভয়ঙ্কর আবহাওয়া। সদ্য কৈশোরের সীমা ছাড়ানো দুই মফসস্লি যুবক, রুমাল দিয়ে কান-মাথা-মুখ ঢেকে লেভেল ক্রসিংটা পার হয়ে গেল। মাথার উপর গনগনে সূর্য, বাতাসে গরম হলকা, রাস্তার পিচ গলে থকথকে। রেলগেটের ওপারে 'মুক্তি' হলে আজ সাড়ম্বরে মুক্তি পেতে চলেছে - গাইড। রাস্তায় লিথো-র পোস্টার। এক বিশাল হোর্ডিং-য়ে সাড়া-জাগানো এই ছবির ভগ্নাংশ এঁকে দেওয়া আছে।
ফ্রন্ট স্টলের দর্শকদের জন্য একটা সুড়ঙ্গ। দেড় ফুটের এক দমবন্ধ গলির দুপাশে সাড়ে সাত ফুট উঁচু পাঁচিল। মাথার উপর অ্যাসবেসটসের ছাদ। মাঝ বরাবর এয়ার হোল—গভীর খনিতে যেমন থাকে বাতাস প্রবাহের সংকীর্ণ পথ। লম্বায় প্রায় পনেরো ফুট সুড়ঙ্গটার শেষে একটা বাঁক, লাইন যেখানে সাপের মতো বাঁক খেয়েছে। বাঁকের শেষে টিকিট কাউন্টার, গ্রীলগেট বা নিষ্ক্রমণের রাস্তা। একবার এই সুড়ঙ্গে ঢুকতে পারলে নিশ্চিন্ত—যাবে ছবি দেখার রঙিন ছাড়পত্র। কিন্তু গলির ভেতর যেখানে কুড়িজনের দাঁড়ানোর ব্যবস্থা, সেখানে আজ ঢুকে পড়েছে পঞ্চাশ জন। সামনে পিছনে প্রচণ্ড চাপ। প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মতন ভয়াবহ অবস্থা। পাঁচিলের সংকীর্ণ ফোকরে হাঁ করে ফুসফুসে প্রাণবায়ু ভরে নিতে হচ্ছে। এখান থেকে বেরোনোর সব রাস্তা আজ বন্ধ।
প্রায় আড়াই ঘন্টার মতো অমানুষিক কষ্ট সহ্য করে কাউন্টারের সামনে পৌঁছে সুবিমল আশা ছেড়ে দিল। গলির মুখে ব্ল্যাকারদের জমাট ভিড়। এমন কায়দা করে ওরা হঠাৎ গণ্ডগোল বাঁধিয়ে দিল যে পুলিশ এলোপাথাড়ি লাঠি চালাতে বাধ্য হল। ভদ্র-অভদ্র, ব্ল্যাকার-বায়ার কিছুই মানল না। এদিকে সুযোগ বুঝে গোটা তিরিশেক টিকিট দিয়ে কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেল। সর্বাঙ্গে জবজবে ঘাম, ডানহাতের মুঠোয় সাড়ে সাত আনা, গুহামুখ থেকে মুখ চুন করে বেরিয়ে এল দুই বন্ধু সুবিমল ও অমিত। বেকায়দায় ছিঁড়ে গেছে সুবিমলের জামাটা। লাইনে দাঁড়িয়ে পা টনটন করছে।
'সাত কা বারাহ্, সাত আনে কা বারাহ্ আনা, বারাহ্ কা দেড়—একেবারে দ্বিগুণ।'
ব্ল্যাকারদের চাপা গর্জনে হলের সামনেটা গমগম করছে। অন্য ব্যবসার মতো এ ব্যবসাতেও বাঙালি কম। সুবিমলের মামাবাড়ি দক্ষিণ কলকাতায়। সেখানের 'প্রিয়া' হলে একজন ব্ল্যাকারের সঙ্গে সুবিমলের সম্প্রতি আলাপ হয়েছে। দ্বারভাঙার ছেলে, কলকাতায় এসেছে রুটি-রোজগারের জন্য। আগের ছবিতে সে জমি কিনে ফেলেছে। ছবিটা একটানা পনেরো সপ্তাহ চলেছিল। গাইড যদি ঠিকমতো চলে তাহলে সে একটা ছোটখাটো বাড়ি করবার পরিকল্পনা করেছে।
সুবিমলের বন্ধু অমিত। বাবা ভারতীয় সেনায় কর্নেল। সপ্রতিভ ছেলে। বয়সোচিতভাবে সিনেমা মুগ্ধ। অ্যালবার্ট করা চুল, অনর্গল হিন্দি বলার ঝোঁক, কাঁধ ঝুঁকিয়ে হাঁটার ভঙ্গি—এ সব ম্যানারিজম সে দীর্ঘ অভ্যাসের মাধ্যমে রপ্ত করেছে। দেবসাহেব তার আইডল—দ্য ইণ্ডিয়ান গ্রেগরি পেগ্। পকেট থেকে ঝাঁ চকচকে একটা পাঁচ টাকার নোট বার করে সুবিমলের মুখের দিকে তাকায়। বলে,
'ক্যা বিচার দোস্ত, দেখনা য়া লৌটনা?'
'তা বলে কালোবাজারে টিকিট কাটবো?'
'গর্মীমে ইতনা ওয়াক্ত লাইনমে খড়া রহা .....'
'তা হোক। ব্ল্যাকারকে প্রশ্রয় দেব না।'
তখন ওদের বয়স সতেরো পার হয়ে আঠারো। শরীরে বাহ্যিক প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে, আরও একটা অদৃশ্য জিনিস অনুভূত হচ্ছিল—আত্মসম্মান। কালোবাজারে সিনেমা না-দেখা হয়তো এরই অনুষঙ্গ। কিন্তু অমিত গজগজ করে।
'পহেলা দিন পহেলা শো। মহল্লা মে যা-কর মু-দিখানেকে কাবিল নহি রহেঙ্গে।'
'ফিরে চল অমিত।'
সবে মাত্র শুরু হয়েছে ইণ্ডিয়ান নিউজ রিল। অথবা লাইফবয় সাবানের বিজ্ঞাপন। সুবিমলের একটা ইঙ্গিতেই অমিত কিনে ফেলতে পারে জীবনের দুটি বিজয়োল্লাস। সোজা দৌড়ে পৌঁছে যেতে পারে ফ্রন্টস্টলের ফ্রন্ট-রোতে। কিন্তু কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে। ওরা পিছু হটল। ছবিটা দেখা হল না। নিষ্ফল একটা দিন ওদের কালপঞ্জিতে লেখা হয়ে গেল।
বাংলা হিন্দী মিশিয়ে দু-চারটে বায়োস্কপ দেখা ছাড়া সুবিমলের জীবনে আর বিশেষ কোনো বিনোদন নেই। গল্পের বই সে ধৈর্য ধরে পড়তে পারে না। কখনো কখনো পর্দার বাস্তবতা, জীবনের বাস্তবতা থেকে তাকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। প্রেক্ষাগৃহের মায়াবী আলো-আঁধারে একা একটা সিট দখল করে টানা আড়াই ঘন্টা বসে থাকার মধ্যে সে এক অন্য আনন্দ আবিষ্কার করেছে। এক নিষিদ্ধ গোপন উত্তেজনার মতো।
প্রথম দিনে সিনেমাটা দেখতে না পাওয়ার বেদনাটা সে ভুলতে পারছিল না। একটা গম্ভীর অনুনাসিক স্বরধ্বনি অলস মধ্যাহ্নে প্রতিবেশীর রেডিওতে বেজে চলেছে। 'ওঁহা কৌন হ্যায় তেরা মুসাফির যায়েগা কাঁহা'। রাজু গাইডের অজানা জীবনের হাতছানি যেন তাকেই সম্মোহন করেছে। খুব স্থির মনে গানটা শোনা যাচ্ছে না। একটা ক্লান্তি, একটা অজানা উত্তেজনা, দুটো দুর্লভ টিকিটের জন্য দুঘন্টা লাইনে দাঁড়ানো, কাঁধের সামনে থেকে পিছন পর্যন্ত ছেঁড়া জামা—সব মিলিয়ে এক অপমানকর স্মৃতি।
জৈষ্ঠ্য পার হয়ে আষাঢ় মাসের চার-পাঁচটা দিন গড়িয়ে গেল। অথচ এখনো বৃষ্টির দেখা নেই। এবার কি খরা হবে? একফোঁটা বৃষ্টির জন্য কি মাঠ-ঘাটের বুক ফেটে উতরোল কান্না উড়ে যাবে মেঘহীন আকাশের দিকে? শহরের রাস্তায়, আনাচে-কানাচে লিথোয় ছাপা পোস্টার। গাইড 'মুক্তি'তে পঞ্চম সপ্তাহ। ফিটন গাড়ির চারিদিক ঘিরে নায়ক-নায়িকার ফ্রেমে আঁটা রঙিন প্ল্যাকার্ড। ভিতরে ব্যাটারির মাইকে গান। 'আল্লা মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে'। মাঝে মাঝে গান বন্ধ করে বিজ্ঞপ্তি—আপনার শহরে গাইড পঞ্চম সপ্তাহ। ফিটন গাড়ি এগিয়ে যায়, দরজার ফাঁক দিয়ে লিফলেট উড়ে আসে—লাল, হলুদ, সবুজ, নীল। বাচ্চারা দৌড়োচ্ছে সেই কাগজ সংগ্রহ করতে। প্রচার ব্যবস্থাটা অভিনব লাগে সুবিমলের। কিন্তু সে অদ্ভুত নির্লিপ্ত। ফেভারিট হিরোর ছবি সে পাঁচ সপ্তাহ দেখে উঠতে পারেনি। ইচ্ছে করলে ব্ল্যাকারদের সঙ্গে দরদস্তুর করে ছবিটা সে সেদিনই দেখতে পারত। কিন্তু তার ধাত অন্য কিসিমের। জীবনে একটা আদর্শ নিয়ে বেঁচে থাকা।
দিন কয়েক পর বৃষ্টি শুরু হল। কী দুর্যোগ! যেমন ঝড়, তেমনই বৃষ্টি—তার কোনো বিরাম নেই। রাস্তায় যানবাহনের চিহ্ন নেই। সুবিমলের মনে হল, আজকের দিনটা ব্যবহার করলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমনই কাজ। পিতৃদেবের একটা বাম্বু-স্টিকের ছাতা ছিল, হাতলটা বাঁকানো। সেটা সংগ্রহ করে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। অনেক কষ্টে ছাতা ও মাথা বাঁচিয়ে সে যখন প্রেক্ষাগৃহে পৌঁছোয়, তখন সেখানে জনমানবশূন্য। বৃষ্টির জল হলের পোর্টিকোয় উঠে এসেছে। যে সুড়ঙ্গটায় সেদিন পঞ্চাশজন সেঁধিয়েছিল, আজ সেখানে মাত্র একজন। এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক সুড়ঙ্গের প্রথমে। সুবিমলের সাথে আলাপ হয়। সিনেমা দেখা ছাড়া অন্য কোনো নেশা নেই। খবরও রাখেন বিস্তর। তবে একটু মাস্টারমশাই গোছের। গাইড তিন বার দেখা, এই নিয়ে চতুর্থ বার। সম্বোধনের উপসর্গ-অনুসর্গে তিনি সুবিমলকে বেঁধে ফেললেন
'গাইড দেখতে এসেছো ভাই? উপন্যাসটা কার লেখা বলো তো?'
অন্য সময় হলে সুবিমলের রাগ হত। কিন্তু এখন এই সুড়ঙ্গে অনন্যোপায় হয়ে কিছুটা আপস করতে হল। এদিকে বাইরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। হাবেভাবে সে বুঝিয়ে দেয় যে বিষয়টিতে তার কোনো আগ্রহ নেই। ভদ্রলোক নিজেই বললেন,
'আর. কে. নারায়ণ। ওনার এক কাল্পনিক শহর আছে - মালগুড়ি। এই শহরকে কেন্দ্র করেই ওঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলো লেখা।'
সুবিমলের সামান্য কৌতূহল জাগে। বলে,
'গান আছে ছবিতে? আমি গান দেখতে এসেছি।'
'একেবারে সঙ্গীতবহুল ছবি। তবে গান কি কেউ দেখে নাকি ভাই?'
'আমি দেখি। ভালো লাগে। এর আগে একদিন ফিরে গেছি।' এই বলে সেদিনকার ঘটনা সবিস্তারে বিবৃত করে সুবিমল। ভদ্রলোক কেমন যেন দার্শনিক হয়ে গেলেন। পকেট থেকে লবঙ্গ জাতীয় কিছু মুখে পুরে চিবোতে লাগলেন। তারপর বললেন,
'ছবি দেখাও একরকম ভাগ্য, বুঝলে ভাই। একবার এ সুযোগ হাতছাড়া হলে আর ফেরে না। ঠিক তোমারই বয়েসে আমি দেবদাস দেখতে এসেছিলাম। প্রমথেশ বড়ুয়া আর যমুনার দেবদাস। ওরে বাবা—সে ছবি কলকাতায় রেকর্ড ভেঙেছিল। দেখতে পারিনি। শুনেছি সে ছবির প্রিন্টও নষ্ট হয়ে গেছে।'
একটু থেমে গম্ভীর হয়ে বললেন,
'বেশ, আমরা দুজনে আজ এই ছবিটা দেখবোই।'
দেখতে দেখতে বৃষ্টি থেমে গেল। পিলপিল করে মানুষজন আসতে লাগল। ঠাণ্ডা পানীয়র দোকান, ওজন নেওয়ার মেশিনের আশেপাশে সর্বত্র লোক। এত লোক কোথায় ছিল, হয়তো বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। এদিকে সাড়ে সাত আনার সুড়ঙ্গটা ভরে উঠেছে। সুবিমল লাইনের প্রথমে। তাকে পাহাড়ের মতো আড়াল করে রেখেছে তার মধ্যবয়স্ক বন্ধু। গ্রিলগেটে তখনও তালা। সেই একফালি গ্রিলগেট দিয়ে তেরছা করে হলের লোকজন দেখা যাচ্ছে। আকস্মিক সেই জনসমাগমে স্কুলের ইংরাজী শিক্ষককে আবিষ্কার করে ফেলল সুবিমল। আপার ক্লাসের টিকিট কেটে পায়চারি করছেন। স্কুলের শেষ বছর। খারাপ ছেলে হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যাবার ভয়। সুবিমল গেটের দিকে পিছন রেখে প্রায় নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গেল।
সুড়ঙ্গে সামান্য উত্তেজনা। একজন মস্তান কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে লাফিয়ে পড়েছে প্যাসেজে। প্রথমে দুই দেওয়ালে পা দিয়ে, মানুষের মাথার উপর চড়াও হয়ে, খেচর প্রাণীদের মতো কিছুক্ষণ শূন্যে ডানা মেলে ভেসে থাকা। এরপর সুযোগ সুবিধা বুঝে ঝুপ করে কারো ঘাড়ে, কারো মাথায় পা রেখে ভিড়ে নিজের অবস্থান ঠিক করে নেওয়া। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে মফঃস্বলের ছেলেরা মস্তান নামের পরিভাষার সাথে পরিচিত হয়ে যায়। এই বক্রোক্তির প্রাপকরা সদম্ভে তাদের সাহসের বাহাদুরি প্রদর্শন করে থাকে। তবে কটুবাক্য প্রয়োগ, জামা ছেঁড়াছেঁড়ি, আর্তনাদ সবই ওই গভীর খাতে। মুখ তুলে মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া, হাত তোলার উপায় নেই।
ছোট লাঠি হাতে দারোয়ান এসে দাঁড়াতেই সুবিমল বুঝতে পারে এবার টিকিট দেবে। প্রাণে বুঝি জল এল। প্রথম টিকিটটাই তার প্রাপ্য। টিকিট হাতে নিয়ে এক ছুটে হলের বাইরে। ভুলেও ইংরাজী স্যারের সামনা-সামনি হতে চায় না সে। কিছুক্ষণ হলের বাইরে ঘোরাঘুরি। ফার্স্ট বেল, সেকেণ্ড বেল, থার্ড বেলের সঙ্গে সঙ্গে হলের জোরালো আলো নিভে গেল। লাইফবয় সাবানের বিজ্ঞাপন চলছে। ফ্রন্ট গেট দিয়ে ঢুকে থমকে দাঁড়ায় সুবিমল। নিকষ কালো অন্ধকার। অন্ধকার থেকে একটা সদ্য পরিচিত কণ্ঠস্বর।
'ভাই এদিকে এসো, সিধে এদিকে।'
হাতড়ে হাতড়ে, কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে দু-তিনবার হোঁচট খেয়ে ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়ে সুবিমল। ছবি শুরু হয়।
একটা লোক জেল থেকে ফিরছে। শরীর বিধ্বস্ত। মন দোটানায়। কোন পথে ঘরে ফিরবে সে? একটি পরিচিত পথ যেখানে অপেক্ষায় আছে তার মা, বন্ধু ও প্রেয়সী। অন্য পথটি অনিশ্চয়ের পথ। যে পথ তার কাছে সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা। দ্বিতীয় পথটাই বেছে নেয় সে। পথকষ্টে জর্জরিত লোকটা কখনও গাছের তলায়, কখনও মন্দিরের চাতালে। পর্দায় কলাকুশলীদের নাম ভেসে উঠছে। এক জাদু ভরা নেজাল টোনে আবহসঙ্গীত। 'ওঁহা কৌন হ্যায় তেরা মুসাফির যায়েগা কাঁহা।'
সুবিমল ডুবে যাচ্ছে। গল্পের মধ্যে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে নিজের অজান্তে। চকিতে হলের মধ্যে প্রচণ্ড শব্দে বোমা ফাটল। পর্দার একটা দিক দাউ দাউ করে জ্বলছে। ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারিদিক। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরোবার হুড়োহুড়ি। মহিলাদের ক্রন্দন রোল, শিশুর চিৎকারে মুহূর্তে আবদ্ধ স্থানটির অবস্থা হল নরকপ্রমাণ। সুবিমল ওঠার উদযোগ করছিল, ভদ্রলোক সুবিমলের হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। বললেন,
'বসে থাক উঠবে না।'
'কেন?'
'এখন বেরোলে দরজার সামনে পদপিষ্ট হয়ে যাবে। স্ট্যাম্পেড।'
একটু পরে অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন,
'ভয় নেই আর বোমা পড়বে না। যারা মেরেছে, তারা এতক্ষণে পালিয়েছে। ওরা তো কাপুরুষ।'
কিছুক্ষণ পর দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হল। বাইরে, করিডরে, রাস্তায় মানুষের ভিড়, সকলের মুখ চাওয়া-চাওয়ি, অচেনা-অজানাকে জিজ্ঞাসাবাদ,
'কারা মারল বোমাটা দাদা? বেশ শক্তিশালী বোমা।'
ফেরার পথে বড় রাস্তায় সুবিমলের চোখে পড়ল এখানে ওখানে জটলা। দোকানে দোকানে ভিড়, আলোচনা। লেভেল-ক্রসিং পর্যন্ত ভদ্রলোক সঙ্গে এলেন। দার্শনিকদের মতন ভ্রু কুঁচকে বললেন,
'আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখেছি। জগৎটা ঈশ্বরের সৃষ্টি কিনা জানিনা, তবে এখানে সবটাই মানুষের হাতে নয়। তবে জীবনে একটা চ্যালেঞ্জ থাকা ভালো। একবার অকৃতকার্য হলে আবার সেটা করতে হবে। তুমি রবার্ট ব্রুসের নাম শুনেছ?'
ভদ্রলোক উত্তরের অপেক্ষা না করে লাইনের ধার ধরে চলে গেলেন। সুবিমল ওর প্রায় অপসৃয়মান শরীরের দিকে তাকিয়ে রইল। সারা মনে অসীম শূন্যতা।
গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে-র মতন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন যারা কাছাকাছি থাকে তাদের কাছে খবর পৌঁছে গেল যে সিনেমা হলে শো চলাকালীন কারা যেন পর্দায় বোমা ছুঁড়েছে। আর সেই অকুস্থলে সুবিমল উপস্থিত ছিল। সুবিমলদের পারিবারিক অবস্থানটা একটু বলা প্রয়োজন। সংসারে কিছু মানুষ আছে যারা সব ব্যাপারেই উদাসীন। সংসারের দায়িত্ব তারা হয়তো পালন করেন, পরে কিন্তু নিজের সংসারের জন্য কিছুই ভাবেন না। তাদের মধ্যে একটা সমর্পণের ভাব। নিস্পৃহ বা উদাসীন বলতে যা বোঝায়—সুবিমলের বাবা হলেন তাই। সুবিমলের অধিকাংশ দায়িত্বই বাল্যকাল থেকে তার ছোটকাকার ওপর সমর্পিত। ছোটকাকাই ওর পালক ও শুভার্থী। মাঝে মাঝে চড়-চাপড়ও দেন। একান্নবর্তী বৃহৎ পরিবারের চরিত্র। পরিবারের কোনো সন্তানই তার মা-বাবার একার নয়, সকলের।
সুবিমলের উদাসী বাবা কয়েকদিন ধরে তাঁর বাঁকানো হাতলের ছাতাটা খোঁজাখুঁজি করলেন। যখন পেলেন না তখন কেমন যেন নিস্পৃহ হয়ে গেলেন। এদিকে একটা কাণ্ড হল—সেটা বলি,
একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই সুবিমল দেখল ছোটকাকা গায়ের জামা খুলে রেখে বারান্দায় পায়চারি করছে। সুবিমল প্রমাদ গুনল। চেনা ছবি। হঠাৎ ছোটকাকা গর্জন করে উঠলেন,
'তুমি মুক্তিতে গাইড দেখতে গিয়েছিলে?'
পায়ের তলা থেকে মাটি যেন সরে গেল। আমতা আমতা করে সে বলে,
'আর. কে. নারায়ণের গল্প, বিখ্যাত লেখক, ইঙ্গ-ভারতীয় ভাষায় লেখেন।'
'চুলোয় যাক। ভদ্দলোকের একরত্তি ছেলে, সাড়ে সাত আনার লাইনে দাঁড়িয়ে গাইড? স্পয়েল্ট বয়। দিস গাইড উইল মিসগাইড ইউ।'
এই কথা বলেই সুবিমলের কান ধরে এক চড় কষালেন। চড়টা কানের পাশেই আঘাত করেছিল। সেটা ধর্তব্যের নয়। কিন্তু 'মিস গাইড' কথাটা তার মরমে বিঁধে গেল।
এরপর কেটে গেছে কুড়িটা বছর। দুই দশকে দিন বদল হয়েছে অনেকটা। শহর হয়েছে গতিময়। মেট্রো রেল, সার্কুলার রেল, এক্সিকিউটিভ বাস, উড়াল পুল-এর শহর। আরও আছে। ইন্টারনেট, ফ্যাক্স, প্রোমোটার, ডেভলপার, রিয়েল-এস্টেট। এদিকে প্রেক্ষাগৃহগুলো তাদের জৌলুষ হারিয়েছে। একের পর এক শহর থেকে হারিয়ে গেছে স্মৃতিমাখা ছবি-ঘর গুলো। যে লাইটহাউসে এক সময় চার্লি চ্যাপলিনের লঘু-পদ সঞ্চরণে গমগম করত, সেই লাইট হাউস উঠে গিয়ে সেখানে একটা প্রকাণ্ড শপিং মল হয়েছে। নতুন নতুন মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখার পরিবেশটা বদলে গেছে। মিস-গাইডেড এক যুবক এখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত, সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। রাজপথের ধারের প্রেক্ষাগৃহগুলি এখনও তাকে হাতছানি দেয়। এখনও অন্ধকারে টানা আড়াই ঘন্টা একটা সীট দখল করে বসে থাকার মধ্যে সে এক অদৃশ্য উত্তেজনা বোধ করে। বিশ্ব জুড়ে নগরায়নের সাথে সাথে দ্রুত পালটে গেছে ছায়াছবির পরিবেশ। শ্বাসরোধ করা দৃশ্য, বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথন, উৎকৃষ্ট পটভূমি সবই আছে—কিন্তু গল্প বলে কিছু নেই। সেই দৈন্যে ভরা প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে যেই সে রাস্তা পার হতে চায়, অমনি বাসের হর্নে চমকে ওঠে। ফুটপাথে তেড়েফুঁড়ে থাকা পাথর, মাতাল কুকুর—এসব কিছুর সঙ্গে আগের মুহূর্তের ছেড়ে আসা গোলাগুলি ভরা অবাস্তব জগতের একটা সংঘাত তৈরি হয়। তখন তার সব হাস্যকর মনে হয়।
কলকাতা শহরের উড স্ট্রীট এক ঐতিহ্যবাহী রাস্তা। ওখানে নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই গড়ে উঠেছে এক আধুনিক মাল্টিপ্লেক্স। একই আবাসনে জিম, বিউটি পার্লার, রেস্টুরেন্ট, পিৎজা-প্যাটিসের দোকান, পোশাক-আশাক, অন্তর্বাস, ডেন্টিস্ট চেম্বার, সভাকক্ষ, সেলুন থেকে সিনেমা হাউস পর্যন্ত। ব্যবস্থাটা এমন, স্বাস্থ্য-সচেতক কোনো নাগরিক যদি প্রত্যূষে এই আবাসনে প্রবেশ করে ক্ষৌরকর্ম সমাধা করে, স্নান-আহারাদি সম্পন্ন করে সিনেমা দেখে সারাটা দিন কাটিয়ে আইসক্রিম খেয়ে সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরতে পারেন। এমনকি আইসক্রিম খেয়ে যদি তার ওয়াল-ভাঙা দাঁতটা কনকন করে ওঠে, তবে ডেন্টিস্ট দেখিয়ে সিলিং করিয়ে ঘরে ফিরতে পারেন।
সিনেমা হলটির সামনে অনেকগুলো পোস্টার সাঁটানো। অফসেটে ছাপানো ঝকঝকে পোস্টার। কোনো এক হলিউড ছবির রাজ্যাভিষেক। তাই নিয়েই তোড়জোড়। তেল চুপচুপে পেশি, শরীর ঘিরে বুলেটের ঝাঁক, হাতে একটা বিদঘুটে বড় মাপের আগ্নেয়াস্ত্র, মাথায় বাঁধা ফেট্টি। সিলভেস্টার স্ট্যালোনের গলায় গাঁদা ফুলের মালা। এসবের মধ্যেও একটা পোস্টার দেখে থমকে দাঁড়ায় সুবিমল। রাজু-গাইড। মাত্র দুপুরের শো। কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। কাউন্টারে একটি মাত্র ছেলে। বাইশ-তেইশ বছরের তরুণ। কালো চোখের তারা। কাঁচা সোনার মতো গায়ের রঙ। চুলগুলো সোনালি রঙ করা। ঠিক যেন কোনো গ্রীক দেবতার মতো রূপবান। এই ছেলেটা সিনেমার নায়ক না হয়ে কাউন্টারের কেরানি হয়েছে কেন?
'একটা টিকিট। ফ্রন্ট রো।'
'কোন শো?'
'নুন শো।'
কম্পিউটারাইজ্ড টিকিটিং ব্যবস্থা। ছেলেটি কম্পিউটারে একটি বোতাম টিপল। প্রেক্ষাগৃহের আসনবিন্যাসটি পর্দায় ভেসে উঠল। কিছু একটা ভেবে সে ভিতরে চলে যায়। ফিরে আসে কিছুক্ষণ পর। বলে,
'রিল আসেনি স্যার। ছবিটা দেখান যাবে না।'
সুন্দর মুখে কপটতার ছাপ। সুবিমল চিন্তিতভাবে তার মুখের দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে জেরা করার স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
'কখন রিল আসবে?'
'এখনো আসেনি। কাল আসুন।'
সুবিমলের জিদ চেপে যায়। মধ্যবয়স্ক মানুষটার কথা মনে পড়ে যায়। 'একবার অকৃতকার্য হলে আবার সেটা করতে হবে। জীবনে একটা চ্যালেঞ্জ থাকা ভালো।' পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে সুবিমল আবার ফিরে আসে। স্ট্যালোনের গলার গাঁদা ফুলের মালা শুকিয়ে গেছে। কোথাও কোনো উচ্ছাস নেই। কিছু রোমিও আছে এদিকে সেদিকে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু সেসব মস্তানরা গেল কোথায়? সুন্দর ছেলেটি কাউন্টারে।
'একটা টিকিট, ফ্রন্ট-রো, নুন শো'।
কাউন্টারের ছেলেটি অভ্যাসবশত কম্পিউটারের বোতামে হাত দেয়। আসনবিন্যাস ভেসে ওঠে পর্দায়। ছেলেটি ভিতরে চলে যায়। সুবিমল অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর টাই-পরা এক ভদ্রলোককে নিয়ে ফিরে আসে। গরমে টাই, সম্ভবত ইনিই ম্যানেজার। ম্যানেজার ভদ্রলোক কোনরকম ভণিতা না করে বললেন,
'ছবিটা আমরা চালাবো না স্যার।'
'কেন বাইরে পোস্টার দিয়েছেন, নুন শো।'
'হ্যাঁ দিয়েছি, অস্বীকার তো করছি না। নুন শো-র স্লটটাও গাইডের জন্য রাখা আছে।'
'তবে টিকিট দিতে অসুবিধা কোথায়?'
'অসুবিধা আছে। কোনো প্রেক্ষাগৃহের আসন-ক্ষমতার তিরিশ শতাংশ ভর্তি না হলে আমরা ছবিটি চালাতে বাধ্য নই। আপনাকে নিয়ে এই পর্যন্ত মাত্র তিন জন ইনকোয়ারি করেছে।'
'কিন্তু ছবিটা যে আমার দেখা প্রয়োজন, অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি। আপনি রবার্ট ব্রুসের গল্পটা শুনেছেন?'
ম্যানেজার ভদ্রলোক একটু থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন,
'রবার্ট ব্রুস হওয়ার দরকার নেই। আপনি সিডি বা ভিসিডিতে দেখে নিন না, ধর্মতলায় পেয়ে যাবেন।'
'না না ওভাবে নয়। আমি চাই দর্শকের ভিড়ে উপচে পড়া এক পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ। উত্তেজনা ও উষ্ণশ্বাসে ভরপুর। ক্রিং ক্রিং ক্রিং, থার্ড বেলের সঙ্গে সঙ্গে হলের সব জোরালো আলো নিভে যাবে। জমাট দৃশ্যে শিশুর ক্রন্দন। গা ছমছম করা অন্ধকারে একা একটা সিট দখল করে আড়াই ঘন্টা। সে এক নিষিদ্ধ গোপন উত্তেজনার মতো—সে সব এখন কোথায়?'
হতাশা বড় ছোঁয়াচে রোগ। ম্যানেজারটিকে ছুঁয়ে গেল। উনি বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লেন, বললেন,
'জীবনটা বুঝি এইরকমই, স্যার। আজ যা নিয়ে এত উচ্ছাস,—কাল তার আর কোনো চিহ্ন থাকবে না।'