'আগামী চব্বিশ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে যে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। আকাশ সকাল থেকেই মেঘাচ্ছন্ন থাকবে। সন্ধ্যার পর বঙ্গোপসাগরের উপকূলে সৃষ্ট নিম্নচাপটির ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা আছে। ...' ইত্যাদি ইত্যাদি।
অর্থাৎ, আমরা কল্পনা করে নিতে পারি যে সন্ধ্যার পর আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যাবে— মাঝে মাঝে বইবে দমকা হাওয়া—আর শুরু হবে প্রবল বৃষ্টি—তার মাঝে ঘন ঘন বজ্রপাত... ইত্যাদি ইত্যাদি।
অর্থাৎ, শহরতলীর সেই পরিত্যক্ত ছোট বাড়িটিতে—যেখানে দীর্ঘকাল বসবাস করেছিলেন শঙ্কর আর প্রতিমা— যেখানে নিতান্তই অবহেলায় পড়ে আছে তাঁদের অসংখ্য তুচ্ছাতিতুচ্ছ স্মৃতি-সম্বলিত জিনিসপত্র, তাঁদের ইহলোক ত্যাগ করার পর, বিগত কয়েক বছর ধরে— সেগুলি সব আচ্ছন্ন হয়ে যাবে সেই অতিরিক্ত অন্ধকারে— এলোমেলো হয়ে যাবে দমকা হাওয়ায়— সিক্ত হয়ে উঠবে অবিরাম বর্ষণে— কখনও বা মুহূর্তের জন্য আলোকিত হয়ে উঠবে ক্ষণিকের বিদ্যুতাভাসে...
অর্থাৎ, সেই দারুণ কারুকার্য করা চীনেমাটির ফ্লাওয়ার ভাসটি, যেটি বরাবর রাখা থাকত শঙ্করের ছোট্ট টেবিলটার উপর, সেটি হয়তো টাল খেয়ে পড়ে যাবে ওই দমকা বাতাসের ধাক্কায়...
কিংবা সেই কবেকার পুরনো তবলাটি, যেটি তুলে রাখা হয়েছিল কাঠের আলমারিটার মাথায়, সেটির উপর হয়তো বৃষ্টির জল পড়বে চুঁইয়ে চুঁইয়ে সিলিং থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে— অদ্ভুত আওয়াজ সৃষ্টি করে...
কিংবা সেই কোন্ কালের বাঁধানো ছবিটি— শঙ্কর আর প্রতিমার বিয়ের পরেই সদ্য সদ্য তোলা— যেটি টাঙানো থাকত একতলার বসার ঘরের ঢোকার মুখের দেওয়ালটায়, হয়তো ওই গহন অন্ধকারেও মুহূর্তের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে সহসা বিদ্যুতের ছটায়...
অর্থাৎ এইসব আপাত স্পর্শাতুর কিংবা নিতান্তই সাধারণ ঘটনাগুলি আজ সন্ধ্যার ভবিতব্য হিসেবে আমরা কল্পনা করতেই পারি।
কারণ এইটুকু না হলে তো কোনও গল্পই লেখা যাবে না এ বিষয়ে।
আসলে বলার মতো, মনে রাখার মতো কোনও ঘটনাই ঘটেনি তাদের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে। কেবল শুরুটা ছাড়া।
হ্যাঁ, শুরুটা হয়েছিল অত্যন্ত নাটকীয় ভাবে। প্রতিমা বলেছিল, 'তুমি পারবে কিনা বলো'। এবং শঙ্কর কাপুরুষের মতো পালিয়ে যায়নি। বরং প্রতিমার চোখে চোখ রেখে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল, 'তাহলে চলো আজই।'
তাই সেইদিন থেকেই শুরু হয়েছিল তাদের একসঙ্গে চলা। অবশ্যই অন্যপথে। প্রতিমা ছিল বড়লোকের মেয়ে। শিক্ষিতা। সুন্দরী। অতএব তার উপযুক্ত পাত্রের মানমর্যাদা প্রত্যাশিতভাবেই অনেক উঁচুতে। অন্তত প্রতিমার বাড়ির লোকেদের কাছে। অথচ শঙ্কর এই মাপকাঠিতে যথেষ্টই খর্ব। সে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বংশমর্যাদা অতি সাধারণ। সাধারণ মেধা। সাধারণ শিক্ষাগত যোগ্যতা। আর্থিক সংকুলানও অবশ্যই সাধারণ। তাই সর্বাথেই অতি সাধারণ একটি ছেলের সঙ্গে এক সোনার প্রতিমা সবার অলক্ষ্যে ভেসে গেলে এক মাঘী পূর্ণিমার রাতে। নিঃশব্দে। আজন্মের উজ্জ্বল ও উচ্ছল লোকালয় থেকে বহু দূরে শহরতলীর প্রান্তে 'দাশরথি আলয়ে'।
'দাশরথি আলয়' নামটার যেমন বাহার, বাড়িটিতে তার আদৌ কোনও চিহ্ন নেই। বহুকাল আগে শঙ্করের বাল্যবন্ধু মিহিরের বাবা বানিয়েছিলেন বাড়িটা। বরং বলা উচিত বানানো শুরু করেছিলেন। তিনি ছিলেন ক্ষ্যাপাটে ডাক্তার। তাই হয়তো এই পাণ্ডববর্জিত জায়গাটাই তাঁর পছন্দ হয়েছিল। কলকাতায় প্রচুর সম্পত্তি করেছিলেন। শহরতলীতেও একটি মনের মতো বাড়ি বানানোর ইচ্ছা হয়েছিল। তাই তৈরি করতে শুরু করেছিলেন চুপিচুপি। বানাচ্ছিলেনও খুব যত্ন করে। নাম দিয়েছিলেন 'দাশরথি আলয়'। বাড়ির সদর সামনে ভারী চমৎকার এক পাথরের ফলকে। কিন্তু বাড়িটি উনি পুরো তৈরি করে যেতে পারেননি। একতলাটি ছবির মতো বানানো হয়েছিল। দোতলায় কাজ সবে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই সময়েই ঘুমের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। আর এই অসমাপ্ত 'দাশরথি আলয়' পড়ে থাকে জনমানবহীন হয়ে।
আবালবন্ধু মিহিরের দাক্ষিণ্যে এই ভয়ঙ্কর দুর্দিনে 'দাশরথি আলয়'ই স্থান হল শঙ্কর ও প্রতিমার।
এই ভাবেই শুরু। গোপনে। সন্ত্রস্ত হয়ে। দারিদ্র্যে। নিত্য অভাবে। প্রতিমা অনায়াসে বিসর্জন দিয়েছিল তার বড়লোকি চলনবলন। শঙ্কর প্রতিনিয়ত চেষ্টা করত তার সামান্য কর্মক্ষেত্রে নিজেকে নিংড়ে দিতে কঠোর পরিশ্রমে ও নিষ্ঠায়। এইভাবে কাটতে লাগল তাদের একটি একটি করে দিন। কিংবা দাম্পত্য জীবন। আর এর মাঝে প্রকৃত পূর্ণিমা যে তাদের জীবনে কখনও আসেনি তা নয়। কিন্তু কোনও কুসুমিত ভোরে তার পরিণতি হয়নি। শঙ্কর আর প্রতিমার নিঃসন্তান দাম্পত্যজীবন কাটছিল এইভাবেই। পরস্পর পরস্পরের অবলম্বন হয়ে। একান্তে। নিস্তরঙ্গে। এ এক কাহিনিহীন দীর্ঘযাত্রা। কিন্তু কখনোই ক্লান্তিকর নয়। অন্তত শঙ্কর ও প্রতিমার কাছে। কারণ প্রৌঢ়ত্বের কোঠায় এসেও তারা পরস্পর কণ্ঠাশ্রিত হত ঘনঘোর বৃষ্টির রাতে। আবার বার্ধক্যের প্রান্তস্থ হয়েও তারা পরস্পরের নিশ্চিন্ত সান্নিধ্যে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা শীতের স্বাদু রৌদ্রে। অতএব তাদের প্রায় পঞ্চাশ বছরের দাম্পত্যজীবন এক গল্পহীন নির্ভরতার দিনলিপি বিশেষ। কিন্তু তারও শেষ পৃষ্ঠা আছে। তাই—
— তাই সময়ের নিয়মে এক শীতের সকালে অশীতিপর শঙ্কর গতায়ু হলেন। এর মাসখানেক বাদেই প্রতিমাও তাঁকে অনুসরণ করলেন। 'দাশরথি আলয়' পড়ে রইল নির্জন নিস্তব্ধ হয়ে।
এরপরেও আরও কটা বছর কেটে গেল। শঙ্কর ও প্রতিমার স্মৃতিচিহ্নগুলি ধূসর হয়ে গেল। 'দাশরথি আলয়' আরও জীর্ণ হয়ে গেল। ঠিক এই সময়েই নির্ধারিত হয়ে গেল এই সমূহ জীর্ণতার ভবিতব্য। 'দাশরথি আলয়' এর বর্তমান আইনী মালিক মিহির গাঙ্গুলির ভাগ্নে সাত্যকি রায় এটিকে বেচে দিয়েছেন স্থানীয় নেতার হাতে। অতএব কাল সকালেই ধূলিসাৎ হবে এই স্তূপীকৃত স্মৃতি ও সত্তা। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এক গল্পহীন সুদীর্ঘ কাহিনী।
কিন্তু আগামী চব্বিশ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে যে আকাশ প্রধানত মেঘাচ্ছন্ন থাকবে, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ অথবা বজ্রবিদ্যুৎ সহ প্রবল বর্ষণের সম্ভাবনা... ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঠিক এই জায়গা থেকেই আমরা কল্পনা করে নিতে পারি—সন্ধ্যার শুরুতেই আকাশ ঢেকে যাবে ঘন মেঘে—শুরু হবে দমকা হাওয়া আর প্রবল বৃষ্টি—মাঝেমাঝে বিদ্যুতের ঝলক... ইত্যাদি ইত্যাদি। নয়তো গল্প তৈরি হবে কী করে?
অতএব গল্পের স্বার্থে শুরু হল আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুতের চমক—ঝোড়ো হাওয়া আর মুষলধারে বৃষ্টি। যত রাত বাড়তে থাকল তত বাড়তে থাকল এই দুর্যোগের তীব্রতা। এতদিনের বন্ধ হয়ে থাকা 'দাশরথি আলয়'-এর অন্ধকার ঘরগুলি, দেওয়ালগুলি, ইতস্তত পড়ে থাকা ধুলো-পড়া বহু ব্যবহৃত জিনিসগুলি পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগে।
আর এরই মাঝে হঠাৎ এক প্রবল ঝোড়ো হাওয়ার ধাক্কায় খুলে গেল দোতলার উত্তর দিকের ঘরের জানালার সেই কমজোরি পাল্লাটা। একটা প্রকাণ্ড হাওয়ার ঢেউ আছড়ে পড়ল ঘরটাতে। আর সঙ্গে সঙ্গে সশব্দে মেঝেয় পড়ে চুরমার হয়ে গেল শঙ্করের টেবিলে রাখা সেই চীনে মাটির ফুলদানিটা—টুকরো টুকরো হয়ে অন্ধকারে ছড়িয়ে গেল তার কারুকার্য করা দেহটি। এতকাল বাদে। হ্যাঁ এতকাল বাদে।
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে এটাকে আছড়ে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিল শর্মিষ্ঠার। অথচ শর্মিষ্ঠাই কিনেছিল এটাকে। নিউমার্কেট থেকে। নিজে পছন্দ করে। তার রাণুপিসি অর্থাৎ প্রতিমার জন্য। তার রাণুপিসি বাড়ির অমতে বিয়ে করে বহুদিন ধরে বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কহীন। শর্মিষ্ঠা প্রতিমার বড়দার মেয়ে। প্রতিমার চেয়ে বছর সাতেকের ছোট। সম্পর্কে পিসি হলেও প্রতিমা ছিল শর্মিষ্ঠার কিশোরীবেলার পরমবন্ধু। শর্মিষ্ঠা জানত প্রতিমা ও শঙ্করের ঘনিষ্ঠতার কথা। মিত্রবাড়ির অন্যান্যদের মতো সেও শঙ্করকে কখনওই প্রতিমার জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি।
প্রতিমার এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া এবং বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত হওয়া তাকে মর্মাহত করেছিল। আর তার অবচেতন মনে শঙ্করের প্রতি তৈরি হয়েছিল এক তীব্র ঘৃণা ও আক্রোশ। এর বছর সাতেক বাদে হঠাৎই সে খোঁজ পায় তার রাণুপিসির বাসস্থানটির। এবং সঙ্গে সঙ্গে মনস্থির করে তার সঙ্গে দেখা করার। তখন সঙ্গে করে নিয়ে আসে নিউমার্কেট থেকে কেনা ওই ফুলদানিটি। প্রতিমা অবাক হয়েছিল। খুশিতে উচ্ছল হয়েছিল। চোখের জল নেমে এসেছিল দু'গাল বেয়ে। বাড়ির কথায়। পুরোনো কথায়। এরপর নিজের কথা বলতে গিয়ে খুব আস্তে করে প্রতিমা বলেছিল, 'আমি ভালো আছি রে। বেশ ভালো আছি। কেন জানিস? এত কিছু ছেড়ে দিয়ে যে মানুষটাকে আমি পেয়েছি সে মানুষটা কিন্তু ষোলো আনা খাঁটি।' শর্মিষ্ঠার মনে হয়েছিল চীৎকার করে বলে ওঠে—'খাঁটি? কিসের খাঁটি? কী গুণ আছে ওর? কী দিতে পেরেছে তোমাকে এতদিন? এত কষ্টের মধ্যে, এত অভাবের মধ্যে থেকে কী মহামূল্যবান জিনিস তুমি পেলে?'
শর্মিষ্ঠা কিন্তু কিছুই বলতে পারেনি। শুধু তাকিয়েছিল তার রাণুপিসির মুখের দিকে। যে রাণুপিসি অনর্গল বলে যাচ্ছিল তার স্বামীর কথা—অতি সাধারণ এক মানুষের গল্প কথা। যা কিনা রাণু পিসির চোখে অসাধারণ কিংবা ষোলো আনা খাঁটি। শেষের দিকের এইসব কথাগুলো কিছুই কানে ঢুকছিল না শর্মিষ্ঠার। যে শর্মিষ্ঠা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাশ করার পর বিয়ে করেছে বিলেত ফেরত এক ডাক্তারকে। যদিও ডাক্তার স্বামীটির সঙ্গে তার দিনে কটা কথা হয় হাতে গোনা যায়—তাই যে শর্মিষ্ঠার বিকেলগুলো কাটে নিউমার্কেটের দোকানে দোকানে, সন্ধেগুলো কাটে ফিল্ম ম্যাগাজিনের পাতায় পাতায়, আর রাত্রিগুলো কাটে বিনিদ্রায় কিংবা কখনও কখনও নিয়মমাফিক শরীর সংসর্গে—সেই শর্মিষ্ঠার মাথার ধমনীপ্রান্তগুলি প্রবলভাবে স্পন্দিত হচ্ছিল তার রাণুপিসির এইসব বিপুল তুচ্ছ কথায়—'কী সুন্দর জিনিস রে! কী দারুণ কাজ করা। কিন্তু আমাদের এই ভাঙা বাড়িতে এই অন্ধকার ঘুপচিতে কি মানাবে? ঠিক আছে, তবুও রেখে দেব—ওই টেবিলটার উপর। জানিস তো এই টেবিলটা তোর পিসেমশাইয়ের খুব প্রিয়—অনেক কষ্ট করে কিনে এনেছিল আমার জন্য—এক পুরোনো আসবাবের দোকান থেকে, তারপর নিজে হাতে করে রঙ লাগিয়ে...।'
শর্মিষ্ঠা আর শুনতে পাচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল এক্ষুনি এই মুহূর্তেই আছড়ে চুরমার করে দেয় এই ফুলদানিটিকে।
এতদিনে এতক্ষণে চুরমার হল সেই ফুলদানিটা। এতকাল বাদে।
প্রতিমা আর শঙ্কর তো বহুদিন হল চলে গেছেন এসব কিছু ছেড়ে। শর্মিষ্ঠা, শর্মিষ্ঠা তুমিও কি কোনও ধূসর জগতে বসে আছো আজ রাতে?
অন্ধকারে হঠাৎ ঘরের কোণ থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ শোনা গেল। আওয়াজটা মন দিয়ে শুনলে বোঝা যায় যে এটি জলের ফোঁটার শব্দ। পড়ছে অনেক উঁচু থেকে। কোনও বাদ্যযন্ত্রের উপর। তবলার বাঁয়া।
এই প্রবল বৃষ্টির রাতে ঘরের ছাদ থেকে চুঁইয়ে জল পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা করে শঙ্করের অতিপ্রিয় বাঁয়া তবলাটার উপর—ঢ্যাবঢ্যাব—ঢ্যাবঢ্যাব—ঢ্যাবঢ্যাব।
'কিগো শঙ্কর—আর বাজাও টাজাও না বুঝি—কী অবস্থা করেছ বাঁয়াটার!' বলেছিল সুকুমার। অর্থাৎ সুকুমার বোস। শঙ্করের কলেজ লাইফের বন্ধু। একসঙ্গে তবলা শিখত ধীরুবাবুর কাছে। শঙ্করের হাতটা ছিল ভারী মিষ্টি। কিন্তু বেশিদিন শিখতে পারেনি। অবশ্যই আর্থিক কারণে। সুকুমার অবশ্য অনেকদিন ধরে তালিম নিয়েছিল। সুকুমার সওদাগরী অফিসে চাকরি করত। যথেষ্ট সচ্ছল অবস্থা। এখনও নিয়মিত মিউজিক কনফারেন্সে হাজির হয়। ফাংশানে বাজিয়ে বেড়ায় যত্রতত্র। এই সূত্রেই এই মফস্বল শহরের প্রান্তে সুকুমারের আসা। এবং শঙ্করের বাড়িতে হাজির হওয়া। শঙ্করের ঠিকানা অপরিবর্তিত রয়েছে গত ত্রিশ বছর ধরে। শঙ্করের বিয়ের ঘটনাটা তার বন্ধুরা অনেকেই জানত। সুকুমারও তাদের মধ্যে একজন। শঙ্কর যেহেতু যোগাযোগ রাখেনি আর কারও সঙ্গে, তাই সুকুমারের সঙ্গেও সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুকুমারের মনে ছিল জায়গাটার নাম। তাই একটু খোঁজাখুঁজি করতেই বেরিয়ে গেল শঙ্করের বাসস্থান। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তভাবেই দরজায় কড়া নেড়েছিল সুকুমার। দরজা খুলেছিল শঙ্কর নিজেই। সুকুমার দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল—সেই একই রকম রোগাপাতলা চেহারা, উজ্জ্বল দুটো চোখ, মুখে ম্লান হাসির ছোঁয়া। কেবল চুলগুলো একটু পাতলা হয়ে গেছে এই যা। সেই তুলনায় সুকুমার মোটা হয়েছে দু'গুণ। মাথার চুলগুলো সব ধবধবে সাদা। একটু দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে বলেছিল—'চিনতে পারছো? আমি সুকুমার।' শঙ্কর সঙ্গে সঙ্গে সেই একই রকম অমায়িকভাবে হেসে বলেছিল, 'এসো! এসো! কতদিন বাদে! কীভাবে চিনে এলে?'
অত্যন্ত অন্তর্মুখী কিংবা অমিশুকে লাজুক প্রকৃতির মানুষ শঙ্করের হাতে গোনা কয়েকটি বন্ধুর মধ্যে সুকুমার ছিল অন্যতম। অতএব পুরোনো কথার স্রোতে ও স্মৃতিতে ভেসে গেল শঙ্করও।
'ইস! কী অবস্থা করেছো তবলা দুটোর। অনেকদিন বাজাও-টাজাও না বুঝি?' সুকুমারের কথায় নিঃশব্দে ম্লান হাসে শঙ্কর। সুকুমার আবার বলে ওঠে, 'বুঝতে পারছি অসুবিধে আছে অনেক, তবুও এতদিনের শেখা বিদ্যে—আসলে তোমার হাতটা বড়ো তৈরি ছিল—ধীরুবাবু বলতেন...'। 'জানি'—সুকুমারকে থামিয়ে দিয়ে খুব আস্তে করে বলে উঠল শঙ্কর। তারপর চুপ করে রইল। 'তাহলে? তাহলে বলো, তুমি কী তোমার ট্যালেন্ট-এর উপর অবিচার করলে না?' —বলে উঠল সুকুমার। শঙ্কর একটু চুপ করে থেকে বলল,—'তুমি প্রতিমার বাজনা শোনোনি না?' সুকুমার অবাক হয়ে বলল, —'না তো! কই কখনও বলোনি তো?' শঙ্কর একই রকম ম্লান হেসে বললে, 'পিয়ারসন সুরিটার কাছে শিখত। উনি বলতেন, 'প্রতিমা আমার বেস্ট স্টুডেন্ট।' আমার সঙ্গে এখানে এসে কোথায়ই বা পিয়ানো—কোথায়ই বা পিয়ারসন সুরিটা। সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বরাবরের মতো। কিন্তু এ নিয়ে কোনওদিন অভিযোগ তো দূরের কথা দুঃখ পর্যন্ত করেনি পাছে আমি কষ্ট পাই।' একটু থেমে শঙ্কর আবার বলল, 'সেখানে আমি কী করে তবলায় হাত দিই বলো তো?' ফের একটু চুপ করে থেকে বলল, 'সারাদিন চেষ্টা করি খাটতে। যাতে ওকে খুব কষ্ট পেতে নাহয়। বিরাট বড়ো ঘরের মেয়ে। বরাবর প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ। কিছু তো পেল না এখানে এসে...।' সুকুমার কোনও কথা না বলে মাথাটা নীচু করে থাকে। নিজের মনে বাঁয়া তবলাটায় আনমনে টোকা দেয়। আওয়াজ ওঠে 'ঢ্যাবঢ্যাব ঢ্যাবঢ্যাব।' সুকুমার ভাবে—অ্যাতো বেসুরো বিকৃত আওয়াজের মধ্যেও তুমি ভালো আছো শঙ্কর—বিরাট জিনিস পেয়েছ তুমি জীবনে।'
সুকুমার—সওদাগরী অফিসের বড়বাবু সুকুমার—দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পাড়ার বাসিন্দা সুকুমার—বিখ্যাত মঞ্চশিল্পী অরুণিমা সান্যালের ডিভোর্সড হাজব্যাণ্ড সুকুমার—সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক হয়ে ওই বাঁয়া তবলায় আবার টোকা মারতে গিয়ে, নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
'ঢ্যাবঢ্যাব—ঢ্যাবঢ্যাব—ঢ্যাবঢ্যাব...'। এক নাগাড়ে হয়ে যেতে থাকে শব্দটা। অন্ধকারে। নির্জনে। শঙ্কর আর প্রতিমা এই শব্দের শ্রুতির বাইরে চলে গেছেন বহুকাল।
আর সুকুমার? সুকুমার কি শুনতে পাচ্ছেন এই শব্দটা?
ঠিক এই সময়েই প্রচণ্ড বিদ্যুতের ঝলক যেন কালো আকাশটাকে ফালাফালা করে দিল। সেই তীব্র আলোর ফলা জানালাটার কাঁচ ভেদ করে আছড়ে পড়ল 'দাশরথি আলয়'-এর এক তলার বসার ঘরে—দক্ষিণের দেওয়ালটায়—সেই কবেকার কাঠের কারুকার্য করা ফ্রেমে বাঁধানো ছবির উপর। এই হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ক্ষণিকের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ফ্রেমের ভিতরকার সেই বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছবিটা। মুহূর্তের জন্য সেই ছবিতে দেখা গেল ম্লান হাসি মুখে পাশাপাশি দু'জন সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন—হয়তো খানিকটা অপ্রস্তুতভাবে কিংবা অস্বস্তিতে—যেভাবে তাকিয়েছিলেন তাঁরা—অর্থাৎ শঙ্কর ও প্রতিমা—বিয়ের ঠিক এক বছর পর—স্টুডিওতে—ছবি তুলতে গিয়ে—
—'কী ইডিয়টিক'—বলেছিল ঋদ্ধি।
—'চুপ চুপ! শুনতে পাবে'—উত্তর দিয়েছিল বৃন্দা।
—'এইভাবে সেজেগুজে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে স্টুডিওতে একগাদা আলোর সামনে হাসিহাসি মুখ করে সো সিলি...' ঋদ্ধি বলে যাচ্ছিল।
—'কেন'?—বৃন্দা প্রশ্ন করেছিল।
—'কেন নয়? হয়তো একটু আগেই ঝগড়া করে এসেছে বাড়ি থেকে কিংবা বাড়ি গিয়েই ঝগড়া লাগাবে জমিয়ে...' উত্তর দিয়েছিল ঋদ্ধি।
—কী করে বুঝলি?
—আরে চেহারা দেখে বুঝছিস না? না খেতে পাওয়া হাংরি লুক।
—হতে পারে—বাট ইট লুকস দে আর হ্যাপি।
—হ্যাপি? ইন হুইচ ওয়ে? দু'বেলা খাওয়া জুটতো না ঠিকমতো। অন্যের বাড়িতে থেকে দিন কাটানো বছরের পর বছর ধরে—ভাগ্যিস ছেলেপুলে হয়নি।
—স্টিল দে আর হ্যাপি। দেখ না বুড়োবুড়ি কেমন গুঁড়িশুঁড়ি মেরে পাশাপাশি বসে আছে রোদ্দুরে—চল চল যাওয়ার আগে আরেকবার ওদের সঙ্গে একটু বকবক করে আসি—বলতে বলতে বৃন্দা এগিয়ে গিয়েছিল শঙ্কর আর প্রতিমার দিকে।
শীতের দুপুরে আধভাঙা দুটি বেতের চেয়ারে পাশাপাশি বসেছিল শঙ্কর আর প্রতিমা। ঋদ্ধি শঙ্করের বন্ধু মিহিরের ভাগ্নের ছেলে। ক্লাস টুয়েলভ্-এ পড়ে। বৃন্দাও ঋদ্ধির সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। কোন্ ফিকিরে কোন্ ধান্দায় কীভাবে তারা এই শহরতলীর দাশরথি আলয়ে এসে হাজির হল পুজোর মধ্যে সপ্তমীর সকালে কে জানে। ঋদ্ধি আবছা আবছা কিছু জানে শঙ্কর আর প্রতিমার সম্পর্কে। বৃন্দা জেনেছে ঋদ্ধিরই মুখ থেকে। মিহিরের ভাগ্নে অনিমেষ মাঝে মাঝে আসতো এই দাশরথি-আলয়ে। ঋদ্ধিকে নিয়ে এসেছিল যখন তার বয়স বছর আটেক। এরপর বছর দশেক কেটে গেছে। সেই আট বছরের শিশু এখন আঠারো বছরের ঋদ্ধি। হঠাৎ করে হাজির হয়েছে দাশরথি আলয়ে। তার গার্লফ্রেণ্ডকে নিয়ে। নির্দ্ধিধায়। নিঃসঙ্কোচে।
বরং সংকুচিত হয়েছে প্রতিমা ও শঙ্কর। যতই হোক মিহিরের উত্তরাধিকারী। পরোক্ষে হয়তো বা দাশরথি আলয়ের ভাবী মালিকও। প্রতিমা ও শঙ্কর দু'জনেই এখন যথেষ্ট বৃদ্ধ। শঙ্কর তো এবছর আশিতে পড়ল। প্রতিমাও এখন ছিয়াত্তর। বয়সের ভারে দু'জনেই জবুথবু। অর্ধেক কথা শুনতেই পায় না। আর যা শোনে তার কিছু বোঝে আর কিছু বোঝে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে একে অন্যের দিকে। কথা বলতে গিয়ে মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে যায়। কিংবা বলতে থাকে অনর্গল ও অবান্তর যত কথা। মিনিটের পর মিনিট ধরে।
ঋদ্ধি আর বৃন্দা অবশ্য এইসব ব্যাপারগুলোকে গ্রাহ্যই করছিল না। তারা নিজেদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল সর্বত্র। হই হই করে। হাসিঠাট্টায় ঢলে পড়ছিল পরস্পরের উপর। শঙ্কর আর প্রতিমা চুপটি করে বসে দেখে যাচ্ছিল তাদের দৌরাত্ম্য। এইভাবে হই হই করতে তাদের চোখে পড়েছিল কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো সেই ছবিটি। একতলার বসার ঘরে টাঙানো। দক্ষিণের দেওয়ালে।
—'এরা দু'জনেই ছিল পারফেক্ট ইডিয়ট। এই মহিলা তো বিরাট ফ্যামিলির মেয়ে ছিলেন। কী দেখে এই নিন্কমপুপ পুরুষটাকে পছন্দ করেছিলেন কে জানে। তাও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে। বরাবরের মতো।'—বলছিল ঋদ্ধি।
—'দেন ইটস গ্রেট! গ্রেট স্যাক্রিফাইস'।—উত্তর দিয়েছিল বৃন্দা।
—'ইয়া। ফর অ্যান ইডিয়ট। লোকটাও সারাজীবন মাথা নীচু করে এই ভার বয়ে গেল।'
—'দেন ইউ শ্যুড লার্ন সামথিং ফ্রম ইট।'
—'নেভার! ওয়ান শ্যুড নো হিজ লিমিটেশন। নিজের দৌড় বুঝে এগোনো উচিত। নয়তো তোমার জীবনটা গেল। এই এদের মতো। শুধু ইমোশন দিয়ে সবকিছু হয় না ডার্লিং। বলতে বলতে ঋদ্ধি বৃন্দার গলাটা জড়িয়ে ধরলেন।
&mdash'কী হচ্ছে কী? দেখছিস না সামনেই বসে রয়েছে!'
—'তো? কী বা দেখছে কী বা মানছে। আর তাতেই বা কী এসে যায়—আমি তো আর তোর সঙ্গে...'
—'শাট আপ'।
—'আরে অতো রাগ করছিস কেন? দ্যাখ্ দ্যাখ্। ছবিটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখ। মনে হচ্ছে আগের দিন রাতেই—হি হি—'
ওরা দু'জনে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে, আরও ঢলাঢলি করতে করতে আবার এসে দাঁড়িয়ে ছিল ওই ছবিটার দিকে। শঙ্কর আর প্রতিমা চেয়ারে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। দেওয়ালের ছবিটা দ্রুত ঢেকে যাচ্ছিল পড়ন্ত বেলার অন্ধকারে।
কিন্তু সত্যিই কি তাই হোলো?
সত্যিই কি তাই হবে?
কেননা আকাশ এখনও নির্মেঘ। বাতাস এখনও মৃদুমন্দ। চারিদিকে কোথাও দুর্যোগের চিহ্নমাত্র নেই। অতএব—
অতএব—এসব আমাদের জল্পনা মাত্র। রাত আরও গভীর হবে। আকাশ জুড়ে তারারা ঝিকমিক করবে। তারপর একটি একটি করে মিলিয়ে যাবে পরদিনের প্রথম আলোর ছোঁয়ায়। ভোরের নরম আলো দ্রুত প্রকট হয়ে উঠবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই। তখন ক্রমাগত কোদাল, শাবল আর গাঁইতির আঘাতে সহজেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে এই 'দাশরথি-আলয়'। দিনের প্রখর উজ্জ্বলতায়। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে শঙ্কর ও প্রতিমার সমূহস্মৃতি। এক নগণ্য দম্পতির তুচ্ছ জীবন। যা বিভিন্ন সময়ে কারও কারও দ্বারা ঈর্ষিত, ধিক্কৃত কিংবা উপহাসিত হয়েছিল। সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সহজেই। দিনান্তের সুন্দর আলোয়।
যাদের নিজেদের জীবনের কোনও গল্প ছিল না—কোনও কাহিনীর বর্ণমাত্র ছিল না, —তার শেষগতি বর্ণহীন না হলেই আশ্চর্যের। বিস্ময়ের।
আজ, শঙ্কর আর প্রতিমা নিতান্তই অতীত হয়ে গেছেন নিজেদের মতো করে।
আজ, এই ঝড়বৃষ্টি বজ্রপাত আবহাওয়ার পূর্বাভাস মাত্র।
তাই আজ, এই এতক্ষণের কথাসম্ভার ক্রমশ অবশ্যই নিছক এক গল্পের জন্য।
প্রাসঙ্গিক রচনাঃ দহন থেকে ফেরা পাণ্ডুলিপি