• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫২ | অক্টোবর ২০১২ | গল্প
    Share
  • নিজের আড়ালে : সংহিতা মুখোপাধ্যায়


    রাতটুকুই কেবল মানসীর নিজের। তাও কেড়ে নেয় ঘুম। না ঘুমোলে দিন কাটানো কঠিন। তাছাড়া অধিকাংশ রাতে জেগে থাকার ইচ্ছে হেরে যায় দিন যাপনের ক্লান্তির কাছে। ক্রমে মানসীর রাতগুলো ভাগ হয়ে গেছে ঘুম আর রাতটুকুকে একান্তে কাটানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষার মধ্যে।

    নিজের শর্তে রাত কাটাবে বলে মানসী কখনো বই পড়েছে। কিন্তু তাতে অধিকাংশ সময়েই বইয়ের চরিত্ররা তার অস্তিত্বে ছেয়ে থাকত। এইভাবে বইয়ের বিষয়ের মধ্যে সে ধুলো ধুলো হয়ে মিশে যেত। রাতটুকুকে নিজের ইচ্ছে মতো পেতে কখনো মানসী গিটার সেধেছে। তাতে মাথার ভিতর সুরের অনুরণনে ঘুম ফালাফালা হয়ে গেছে। কখনও বা ছাদে বেড়াবার চেষ্টা করেছে। ঘেমে-নেয়ে বিরক্ত হয়ে গেছে। মোদ্দা কথাটা হলো নিজের সাথে নিজে কিছুটা সময় কাটাবার এতোরকম চেষ্টায় সে নিজেই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে, ক্ষত-বিক্ষত হয়ে হারিয়ে গেছে নিজের থেকে দূরে। ক্রমশঃ তার ভাবনা, তার বুদ্ধিমত্তা, তার নিজের চেতনা সম্পর্কে সে উদাসীন হয়ে পড়ছে। অথচ আত্মবিশ্বাস আর গুছুনেপনার লোকদেখানো আড়ম্বরে সজাগ, সদা সচেতন চেহারাটা তার অমলিন থেকে গেছে। তাই অনবরত আয়না দেখলেও সে নিজে টেরটি পায় নি ভিতরের ভাঙন।

    কতো দেরি করে সে-খবর তার গোচরে এলো জানে না মানসী। একদিন স্টেকহোল্ডার মিটিঙের পরে, টয়লেটে ঢুকে মানসী শুনল, শময়িতা, তাদের প্রজেক্টের কমিউনিটি মেন্টর, প্রজেক্ট বিশ্লেষণ করছে, ফোনে। ওপারে যেই থাক, আলোচনাটায় প্রকাশযোগ্য নয় এমনসব তথ্য থই থই করছিল। শুনে মানসী দ্বন্দ্বে জেরবার হয়ে গিয়েছিল যে শময়িতা বোকা না শয়তান। কারণ শময়িতাকে সেদিন অবধি সে বুদ্ধিমতী, সৎ স্বতঃস্ফূর্ত, বলেই জানত। ফলে সে যে টয়লেটের মতো হট্টমেলায় বেফাঁস কথা বলবে তা মানসীর কল্পনাতীত। তারপর সত্যিকারের সজাগ হয়ে মানসী জানতে চেষ্টা করে আপিসের আর কে কে শময়িতার মতো। তাতে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার দাখিল হয়েছিল। এই সব অসময়ের বাছ-বিচারে আসল কাজও প্রায় বরবাদ হওয়ার যোগাড় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু নতুন করে চোখ-কান খোলা রাখার অভ্যেস তৈরি হলো বলেই, সে হঠাৎ শুনতে পেল, সেই শময়িতার মুখেই, “কেউ খারাপ বললে যখন মানি না আমার কাজটা খারাপ, তখন কেউ ভালো বললেই বা গলে যাই কী করে?” মেয়েটাকে খোদ একাউন্ট ম্যানেজার ডেকে পারফরমেন্স নিয়ে কিছু বলেছিলেন সেদিন। মেয়েটার কথাগুলো শুনে মানসীর মনে পড়ে গিয়েছিল যে অনেকগুলো বছর আগে সে নিজেও এমনটাই বেপরোয়া ছিল। জীবনের অসংখ্য আপসে সেদিনের বেপরোয়া বিবেচনা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? এতোদিন ধরে নিজেকে গড়ার চেষ্টায় একটু একটু করে সে কি নিজেকে আসলে নষ্টই করেছে?

    একসময় প্রশ্নগুলো অফিসের চৌহদ্দী থেকে বেরিয়ে চব্বিশ ঘন্টার সঙ্গী হয়ে মানসীকে কুরে কুরে খেতে থাকে। চানঘরে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে হতাশার নোনা ঢেউয়ে, গলায় জমা বাষ্পে যখন দুচোখে অন্ধকার তখনই জলের কলকল শব্দের ভেতর বেজে ওঠে,

    অনমিতা, শুচিস্মিতা, মন্দীভূতা পথ
    জলেই যদি যাবে তবে টানছ কেন রথ?

    মানসীর চেতনা ফিরে আসে এক ধাক্কায়। যতদূর মনে পড়ে তার দশ বছর বয়স থেকে সে আপন চৌহদ্দিতে সেরা হওয়ার লড়াই করে যাচ্ছে। এমনকি যে রূপ তার সৃষ্টি নয়, সেই রূপকেও সে মেজে ঘষে ঝকঝকে আর ধারালো করে তুলেছে, ক্রমশঃ। সফলও হয়েছে সে, কিন্তু রাতারাতি নয়। অনেক নির্ঘুম রাত কাটিয়ে, অনেক সাধনায় শরীর পাত করে, লক্ষ্য ছুঁয়েছে। সবই তার নিজের বানানো লক্ষ্য; কেউ তার সামনে শিকারের জন্য পাখি সাজিয়ে দেয় নি। তার শিকার তাকে নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়েছে বারবার। তবু কেন কে জানে সাফল্যের প্রদর্শনী দেখে দর্শকরা “আহা” না বললে মানসীর মন খারাপ হতো খুব এককালে। সে কথা এখন ভাবলেই হাসি পায় তার। তারপর একসময় সে আর ‘আহা’-র তোয়াক্কাও করত না। এতোগুলো মানুষের মধ্যে সামাজিক বসবাসের ফলে একদিন সে টের পেয়ে গিয়েছিল যে প্রদর্শনীতে “বাহ্‌!” বলা দর্শকমাত্রই সত্যিকারের অভিভূত গুণমুগ্ধ মানুষ নাও হতে পারে, হতে পারে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক কিংবা শত্রুপক্ষের নজরদার। অবশ্যই এই শেষ পর্যায়ের মানুষজন মানসীর ক্রিয়াকলাপে খুশি হয় না মোটেই; খুশি তারাই হয় যারা মানসীর সাফল্যে লাভবান হয়। আসল কথাটা হলো পৃথিবীসুদ্ধু সক্কলকে একটা যে কোনো কাজে খুশি করে দেওয়া যায় না। আপন আপন স্বার্থবুদ্ধি দিয়ে মানুষ খুশি কিংবা অখুশি হয়। আপন আপন বিবেচনায় ঘটনা কিংবা অঘটন নির্ণয় করে। আপন আপন দৃষ্টিকোণে তকমা লাগায় ভালো আর খারাপের। সেই জন্যই পৃথিবীর কে কী বলবে তার অপেক্ষা না রেখে, শুধুই নিজের খুশির জন্য মানসী খপখপ করে পাখি ধরে, মটমট করে সেগুলোর ঘাড় মটকায়, নানা পদ্ধতির পটুতায়।

    এইভাবেই অনেকদিন মাপা কথা, চাপা তথ্য, যথাযথ সাজ-গোজে যথাযথ অভিনয়--যখন যেমন দরকার, এই নিয়েই চলছিল তার অগুনতি মুখোশের আড়ালে বাস। মুখোশের স্বাচ্ছন্দ্যে সারাদিনে এক এক সময়ে এক এক ভূমিকা সে পালন করে যেত অবলীলায়। মুখোশের ওপর ভরসা তার এতই বেশি হয়ে উঠেছিল ক্রমে যে সে মুখোশের আড়াল নিয়েছে তখনও যখন মুখটুকু মেলে রাখা ভীষণ জরুরী ছিল। এভাবে তার আত্মবিশ্বাস যে ঢাকা পড়ে গেছে অহমিকায় সে কথা মানসী টেরটি পায়নি মোটে। এখন তার মনে হচ্ছে যে সে চুর হয়েছিল লুকোচুরি খেলার নেশায় কিংবা তাকে গিলে ফেলেছিল যথেচ্ছ মুখোশ ব্যবহারের অভ্যেস। সেই জন্যই হয়তো কখনো কখনো মুখ ভেবে সে আঁকড়ে ধরেছিল আরেকটা মুখোশ। কিন্তু এভাবে মুখোশের আড়ালে নিজস্ব মুখ তার হারিয়ে গিয়েছিল ক্রমে, নিজের অজান্তে, নিজের তৈরি খেলার ঘোরে। সে প্রায় ভুলতে বসেছিল কী তার আসল চেহারা।

    অথচ মানসী ক্ষয় নয়, জয় চেয়েছে জীবনে। সেই জয়ের নেশায় তার সত্ত্বাটুকু একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছে, ধূলো হয়ে মিলিয়ে গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে। এখন তাই জয়ের থেকে আত্মবিশ্বাসের আকর চিনতে পারে না, ক্ষয়ে যাওয়া অস্তিত্ব জুড়ে কেবল টের পায় পরাজয়ের ভয় আর ঠকে যাওয়ার গ্লানি। এতো যুদ্ধ জিতে গিয়েও তাই জয় অর্থহীন। তাই নিজের সাথে একলা হতে চাওয়া; নিজের মধ্যে নিজের খোঁজ। অবশেষে খোঁজ মিলল চানঘরে।

    ***

    দিনান্তের স্নানটুকু মানসীকে যেন ফিরিয়ে দেয় তার অকৃত্রিম অবয়ব। স্নান শেষে খুঁটিয়ে দেখে সে নিজেকে আয়নাতে।

    প্রতিবিম্বে সন্তুষ্ট হলে তবে দিনের গ্লানি কাটে। ঘনিয়ে আসে স্বপ্নময় ঘুম। নতুন প্রত্যয়ে জাগে প্রতিদিন, উদ্যমে বাঁচে। দিনশেষের চান তাই তার জীবনে নিতান্ত আবশ্যিক হয়ে ওঠে। এদিকে সারা দিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘন্টাটাক সময় ঠায় দাঁড়িয়ে চানঘরে কাটানো কষ্টকর হয়ে উঠতে থাকে মানসীর। তাই অতি প্রয়োজনীয় স্নানটুকুকে আরামের করে নিতে বাথরুমে পেতে ফেলে বাথটব, তার পাশে দেওয়াল জুড়ে টাঙায় আয়না।

    রাতের খাওয়া মিটলে, বাকি সাংসারিক চাহিদাগুলো একে একে ঘুমোতে যায়। বাড়ির সব আলো নিভিয়ে, সব সম্পর্কের থেকে ছুটি নিয়ে শোবার ঘরের লাগোয়া চানঘরে বাথটবের জলে নিজেকে নিরাবরণ মেলে ধরে মানসী। শাওয়ার থেকে ছড়িয়ে পড়া জলের আদর শরীর জুড়ে আরাম দেয়। আনাচে-কানাচে, অজানা খাঁজে। ধুয়ে যায় সারাদিনের নানা পোষাক থেকে জমা ধূলো, ময়লা, নোংরা, সংক্রামিত জীবাণু।

    স্নানের সুবাদেই মানসী টের পায় সামাজিক যাপন কী বিরাট নাটক। সারাক্ষণই সেখানে অঙ্কের পর অঙ্কে, অগ্রন্থিত সংলাপে, স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় চলে। অভিনেতা অনেক, চরিত্র অনেক। নাটকের নিজস্ব নিয়মে একাধিক অভিনেতা একই সময়ে এবং আলাদা আলাদা সময়েও, আলাদা আলাদা মঞ্চে নাটকের খাতিরে একই চরিত্রে অভিনয় করে। নাটকের খাতিরে চরিত্রচয়ন, চরিত্রায়ন সবই বাধ্যতামূলক এবং বাধ্যতামূলকভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত। ফলে একই পোষাক ঘুরে ফিরে পরে অনেকেই। আর ছড়িয়ে যায় ত্বক থেকে ত্বকে নানা অসুখের বীজাণু।

    রোজ রাতে স্নান সেরে জল জল গায়ে একটা নরম জামা পরে ঘুমিয়ে পড়ে সে। বাথটব থেকে বিছানায় চারিয়ে যায় জীবনদায়ী স্বপ্নগুলো।

    কোনো কোনো দিন জলে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেই মানসী একটা বনে পৌঁছে যায়। সেখানে সব গাছে উজ্জ্বল সবুজ পাতা। পাতার ফাঁক দিয়ে বলয়ের ধারা বানিয়ে নেমে আসছে সূর্যের আলো। গাছের ভিড় চিরে কুলকুলিয়ে বয়ে চলেছে এক সরু অগভীর নদী । তার বুকের মধ্যে, দুধারেও জমে উঠেছে মসৃণ নুড়ির রংবাহার। থেকে থেকে আলো পড়ে ঝলসে ওঠে নুড়িতে হোঁচট খেয়ে ঠিকরে ওঠা জল। পাখির ডাকে ডাকে মুখর সেই বনটাকে নিয়ে মানসী বাথটব থেকে পৌঁছয় বিছানায়। অস্তিত্বময় ছেয়ে থাকে কৈশোর। সে নদীর থেকে ভেসে আসে ঘুমপাড়ানি,

    জল জল জল,          ছলছলিয়ে চল
    রঙিন নুড়ি ধুয়ে,          শ্যাওলার বীজ রুয়ে
    জল সোহাগে চুর,          মাতাল উছল সুর
    ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হিম,          ডাইনোসরের ডিম
    ডাইনোকথা যাক,          জলের আদর থাক
    জল জল জল,          তোর সাথে যাই চল।

    ***

    কৈশোর মানে যৌবনের স্বপ্ন দেখা। যৌবন মানে স্বপ্ন ভাঙার শুরু। কিন্তু নিজের জীবনে কৈশোর যৌবনের সহবাসে মানসী সব মঞ্চে সেরা অভিনেত্রী হয়ে গেল আবার। তার বার বছরের ছেলে খ তো বলেই ফেলল, “মা যেন আমার ক্লাসমেট”। বর সুতীর্থ একদিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী নতুন কোনো রিলেশনশিপ...” আগে হলে মানসী বিশ্রীভাবে খেঁকিয়ে উঠত, “আমাতে পোষাচ্ছে না, ডিভোর্স চাই, সোজা বলতে পার না? মেনিমুখো মিন্‌সে!” কিন্তু এখন সে নতুন মানুষ। তাই রহস্য করে বলল, “হয়তো”। তারপর সুতীর্থর গাল টিপে আলতো চুমু দিল চিবুকে। দুজনের মধ্যে জমা পুরোন বরফ গলে গেল, অন্তত কিছু দিনের জন্য। শাশুড়ি ভাবলেন তাঁর সব দুর্ব্যবহার মানসী মাফ করে দিয়েছে বুঝি। মা ভাবলেন, মানসীর সব অভি্যোগ মুছে গেছে আপিসে তার লাগাতার উন্নতিতে। আপিসে সে উদাহরণ হয়ে গেল বয়সের সাথে সাথে উদ্যমকে ধরে রাখার জন্য। এমনকি তাকে তো এইচ-আর বলেই ফেলল মাসে একদিন করে মোটিভেশনাল ট্রেনিং করাতে। মানসী ভাবছে তার অবিরাম সাফল্যের কৌশল নিয়ে একটা বই লিখবে। অবশ্যই মুখোশের আড়াল থেকে, বিভিন্ন পোষাকে, কিন্তু একেবারেই কেউ টের পাবে না মুখোশ আছে কিনা বা লেখার সময় সে কোন পোষাকে ছিল।

    খ-এর গরমের ছুটি মে মাসে। তখন দিন দশেকের ছুটি নিয়ে কোথাও বেড়াতে যেতে চায় সুতীর্থ। মানসীর আর খ দুজনেই সমুদ্রের ধারে যেতে চাইল। সুতীর্থর ইচ্ছে ঠাণ্ডা কোথাও যাওয়ার। তখন দক্ষিণ গোলার্ধে শীতকাল, তাই মরিশাস গেল ওরা। সেখানে সমুদ্র উত্তাল নয়। লেগুন-বন্দী শান্ত, স্বচ্ছ জল, নীল থেকে সবুজ, ঘন কিংবা হালকা। লেগুনের গভীরের প্রবাল রাজ্যে হেঁটে, প্যারাগ্লাইডিং করে আকাশ থেকে পাখির চোখে লেগুন আর দ্বীপ দেখে, মরা আগ্নেয়গিরি আর তার জ্বালামুখ জোড়া হ্রদ কিংবা পাইন বন দেখে, সাত রঙা জমি, লেগুনের সীমা আর আনারস ক্ষেত দেখে বেশ কেটে গেল ছুটি। তার মধ্যে একরাতে স্বপ্ন এলো। মানসী লেগুনের জলে ভাসতে ভাসতে ক্রমশ দিগন্তের দিকে যাচ্ছিল সমুদ্রের কাছে। তীরে বসেছিল খ আর সুতীর্থ। মানসী যখন প্রায় মিলিয়ে যাচ্ছিল দৃষ্টিসীমার বাইরে, তখন খ চীৎকার করে উঠল, “ফিরে এসো মা। মা-আ, মা-আ। যদি তুমিও ফেলে রেখে যাবে তো কুড়িয়ে আনলে কেন আমাকে?”

    ঘুম ভেঙে গেলো মানসীর। সিধে চলে গেল স্নানে। বেড়াবার ঝোঁকে সে ভুলেই গিয়েছিল স্বামী-পুত্রের সাথে একান্ত অবকাশ কাটানোর সময়েও সামাজিক নাটক চলতে থাকে, মুখোশ পরতে হয়। তার ওপর তার আর খ-এর মধ্যে ছেয়ে আছে সীমাহীন মিথ্যে। সে মিথ্যের বোঝা তাকে বইতে হবে আরও ছবছর, খ-এর আঠার বছর বয়স পূর্ণ হওয়া অবধি। খ-এর মা খকে ফেলে রেখে গিয়েছিল হাসপাতালে।

    নিঃসন্তান মানসী ঠিক করেছিল সদ্যজাত কোনো বাচ্চাকে আপন করে নেবে। সুতীর্থর সম্মতি ছিল না। সচরাচর মানসীর কোনো সিদ্ধান্তেই তার সমর্থন থাকত না সে সময়ে। যদিও পরস্পরের ব্যক্তিত্বের টানেই তারা দুজনে বিয়ে করেছিল এবং অবশ্যই মানসী সন্তানও চেয়েছিল সুতীর্থর থেকে, তবুও বিয়ের পর থেকেই সুতীর্থ মানসীকে শুধুই অবিমৃশ্যকারী বলতে শুরু করে, মানসীর পরিবারের প্রতি সাংঘাতিক অশ্রদ্ধা দেখাতে শুরু করে, আর মানসীর সাথে সম্পর্কটা ক্রমশঃ সংক্ষিপ্ত করে ফেলে। আসলে সুতীর্থর জীবনে যেকোনো নতুন ঘটনা, সম্পর্ক বা জিনিস খুব জলদি পুরোনো হয়ে যায়। আর সব কিছু নতুন করে নেওয়ার ব্যবস্থা জানলেও, সম্পর্ককে নতুন করে নিতে হয় কী করে তা সুতীর্থ জানে না। এদিকে বিয়ে করা সত্ত্বেও নতুন সম্পর্কের হাতছানি সে এড়াতে পারছিল না। আবার মুখে চুনকালি পড়ার ভয়ে মানসীকে ছেড়ে যেতেও পারছিল না, কিংবা মানসী তাকে ছেড়ে যেতে পারে এমন কিছুও করে উঠতে পারছিল না। বিয়ের পাঁচ বছর পর দুজনে একবাড়িতেই থাকত এক অভূতপূর্ব অযৌন দাম্পত্যের উদাহরণ হয়ে।

    খকে বাড়ি নিয়ে এসে মানসী সুতীর্থকে তালাকনামা ধরিয়েছিল। কিন্তু সুতীর্থ বিয়েটা ভাঙে নি। আসলে সে নিজে কিছু গড়ে না, কিছু ভাঙার জোরও তার নেই। সে শুধু ঝুরঝুরে ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের মরা শরীরে নতুন রঙ লাগিয়ে ঝকঝকে করে রাখতে জানে, তাতে পৃথিবীর কৌতূহল এবং গায়ে পড়া সহানুভূতি, সাহায্য থেকে বাঁচা যায়। আপসের দুর্দান্ত দক্ষতায় বার বছরে সে খ-এর বাবা হয়ে উঠেছে। হয়তো ছবছর পরেও খ-এর থেকে সত্যি কথাটা চেপে গেলেই সে আরাম পাবে বেশি। হয়তো সুতীর্থর ভয় আছে যে সমাজে তার দুর্নাম হয়ে যাবে, তার পিতৃত্বের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ জাগবে, তার পালিত পুত্র তাকে ত্যাগ করলে। ঠিকই, অযোগ্য লোকেরই যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ হয়–-অন্যের যোগ্যতা নিয়ে, নিজের যোগ্যতার মূল্যায়ন নিয়ে। তাছাড়া সে কোনো দিনই কোনো সম্পর্কের দায় নেয় নি, সুখটুকু, সুবিধেটুকু নিয়েছে শুধু। তাই মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের প্রতি তার বিশ্বাস নেই। মানসীর আছে। সে জানে খ তার আপন সন্তান, যা কেউ দেয় নি, একান্তই তার। গর্ভে ধারণ না করেও সে যখন খ-এর মাতৃত্বের সুখ এবং দায়িত্ব নিয়েছে, তখন সত্যের অজুহাতে তাদের মা-ছেলের সম্পর্কে কোনো দিনই চিড় ধরবে না।

    কিন্তু এসব বিতণ্ডা আসতই না যদি মানসী তার নিজের বাথটব, আয়না এসবের সাথে রাতের খানিকটা কাটাতে পারত। মন জুড়ে তখন অন্য এক খোঁজ,

    জল, জল, জল, কোথায় গেলি তুই?
    তো্র গহীনে দু দণ্ড পা ডুবিয়ে রই।

    ***

    বাড়ি ফিরে এসেও স্বপ্নটা বিভীষিকা হয়ে হানা দিতে লাগল মানসীর একলা অবসরে। বেড়ানোর ছুটিটা একটু বাড়িয়ে নিয়েছিল সে বইটা লিখতে শুরু করবে বলে। মরিশাস থেকে ফিরে রোজই সে বই লেখার জন্য ট্যাবলেট নিয়ে বসে সকাল সকাল। কিন্তু একটা শব্দও লিখে উঠতে পারেনা। কেবল হাত নিশপিশ করে উঁকি মারে বাপ-ব্যাটার সোশাল নেটওয়ার্কিং পেজে। বাপেরটায় মাস ছয়েকের পুরোনো খবর। ছেলেরটায় ভূতপ্রেত গেমসের রিকোয়েস্ট। নিজেরটায় গায়ে পড়া লোকজনের কথোপকথন, “তোর দিশি বাথরুমটা নাকি বিলিতি করে ফেলেছিস?” মনে মনে বলে, “শালা, কুড়ি বছরে আমার বদলের খবর রাখে না, আমার বাথরুমের খবর রাখে!” জবাবে একটা সাদামাঠা হাসিমুখ ইমোট আইকন পাঠায়।

    কিন্তু এতো গোয়েন্দাগিরিতেও এমন কাউকে পাওয়া গেল না যে সুতীর্থকে নতুন করে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। এমন কোনো আশঙ্কাই কোথাও ঘনায় নি যে খ টের পেয়ে যাবে মানসী কে, সে কে, মানসী বলার আগেই। তারপর দু-পাঁচটা শব্দ নেড়ে চেড়ে কয়েকটা লাইন খাড়া হলেও সেগুলো বই হয়ে উঠতে অনেক দেরি বোঝা যায়। অমনি হাই উঠতে শুরু করে, দুপুর হওয়ার অনেক আগেই। টিভি, মুভি কালেকশন এসব নিয়ে বসলেও মন গিয়ে পড়ে বইয়ের ওপর। কিন্তু লিখতে গেলে শব্দগুলো ঠিকঠাক গোছানো যায় না।

    মানসী বাড়িতে থাকায় খ-এর আব্দার কিছু বেড়েছে। অবশ্য ছেলেটা বাড়ের মুখে। ভালো-মন্দ খাবারে লোভ তো কিছু থাকবেই এখন। ছেলের ফিরিস্তি মতো জলখাবার বানাতে লেগে পড়ে মানসী দুপুর একটু ঘন হলেই। সুতীর্থ ফোন করে এরকম সময়ে। মানসী রান্না করছে শুনে সেও তার নিজের ফরমাশ জানায়। মন গুনগুনিয়ে ওঠে,

    বহু দূরে দূরে
    অচেনা শহরে শহরে
    ঘুরে ফিরে এসে তবু
    বোর লাগে চেনা রান্নাঘরে
    ---
    ---
    ঘোর কেটে যায় একা স্নানঘরে।

    ব্যস অমনি হাতের কাজটুকু কোনো রকমে সেরে দৌড় চানঘরে। বাথটবে ডুব। স্বপ্নের খোঁজে তন্ন তন্ন করে স্মৃতি ঘাঁটতে থাকা। তারপর বইয়ের শব্দগুলো জমাট বাধে। আর মানসী শান্তভাবে জল থেকে উঠে পড়ে। ঝটপট জামা কাপড় পরে নিয়ে বসে পড়ে লিখতে। তারপর কে এলো, কে যে গেলো সে বিষয়ে খুব হুঁশ থাকে না। বইয়ের ঘোরেই ইস্কুল ফেরত খকে খেতে দেয়। তার জিনিসপত্র জায়গায় গুছিয়ে রাখতে বলে, খিটখিট করে না। সুতীর্থকে চা বানিয়ে দেয়; শাশুড়ি মাকে রাতের ওষুধ দেয়; নিঃশব্দে। তারপর মাঝরাত পার করে বই লেখা চলতে থাকে। কিন্তু ঘুমোতে যাওয়ার আগে স্নানঘর বাঁধা। ফলে স্বপ্নে প্রজাপতি, গুবরে পোকা, গুপি-বাঘা, ঘ্যাঁঘাসুর, দ্রিঘাংচু, বারান্দার উল্টোদিকের রুদ্র পলাশ গাছে লক্ষী পেঁচার আনাগোনা লেগে থাকে। কিংবা মায়ের সাথে ঝগড়া হলে, স্বপ্নে মা রেল লাইনে বসিয়ে ভাত খেতে দেন এমনটাও দেখে সে। কখনও কখনো ভাইয়ের সাথে ঘুড়ি ওড়ায় ছাদে। আর আকাশটা ভরে মোজেক তৈরি হয় নানা রঙের নানা চেহারার ঘুড়ির।

    ***

    ইয়ের খসড়াটা ছুটির মধ্যে হয়ে গেলো। তারপর আপিস চালু হয়ে গেলো। রাজনীতি, মুখোশ জাগলিং, পোষাক নিয়ে টানাটানি-ও শুরু হয়ে গেলো। ফলে বাড়ি ফিরে বইটার গায়ে নতুন নতুন রঙের প্রলেপ পড়তে লাগল। প্রাথমিক খসড়া প্রায় পুরোটাই বদলে একটা নতুন বই তৈরি হয়ে চলল রোজ।

    যথারীতি আপিস-সংসার-বই তিনের টানে ঘোরের মধ্যে চলতে লাগল যাবতীয় আবশ্যিক নিত্যকর্ম। রুটিন থেকে হারিয়ে গেলো গেমস, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং। খ কিংবা সুতীর্থকে নিয়ে আশঙ্কারা নানা খাঁজেখোঁজে, ফাঁকে-ফোকরে লুকিয়ে পড়ল। অবস্থাটা চলল একটা পাবলিশার জুটিয়ে লেখাটা তাদের আপিসে জমা পড়া অবধি।

    তারপর আবার একরাতে খাটের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল মানসীর। সুতীর্থ মাস্টারবেশানে ব্যস্ত। সতের-আঠার বছর আগে এরকম কোনো কোনো রাতে মানসী সুতীর্থর সাথে মিলিত হতে চাইত। সুতীর্থ মানসীর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করত; মাস্টারবেশানে বাধা পেয়ে বিরক্ত হতো, ঠেলে সরিয়ে দিত দূরে। আবার কোনো কোনো রাতে মানসীকে প্রত্যাখ্যান করার আধঘন্টাটাক পরেই শুরু হতো সুতীর্থর লীলা। অন্য অনেক সময়ে আবেগঘন ঘনিষ্ঠতায় মানসী প্রশ্ন করেছে, “স্বমেহনে তুমি কার কথা ভাব সখা?” মিষ্টি হেসে সুতীর্থ এড়িয়ে গেছে প্রশ্নটা। এই জীবনে মানসী কাটিয়ে দিল আঠার বছর!

    পরের দিন সারাক্ষণ মেজাজ খারাপ থাকবে তার, যদিও সে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় চলে গেলো। আবার চানেও সমাধান নেই। সমাধান নেই এই ধাঁধার। তাকে যদি চাইই না যৌনতায় তবে তার সঙ্গের কিছুকালের যৌন সম্পর্কটা কেন সামাজিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল সুতীর্থ? কেন সেই সম্পর্ক সে টিকিয়ে রাখল এতোকাল? তাকেও বিয়েটা ভাঙতে দিল না কেন?

    পায়ে পায়ে খ-এর ঘরে এসে মানসী দেখল ছেলেটা ডাইরির ওপর উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। কারো ডাইরি না দেখার নীতি মেনে কোনোদিনই মানসী সুতীর্থর ডাইরিও দেখেনি, খ-এরটাও দেখেনি। খুব ইতস্তত করে খ-এর ডাইরিটা তাকে রাখার জন্য তুলে নিল মানসী। খোলা পাতাটায় লেখা আছে, “ডাইরি লিখি ঠাঠাম মানে মিসেস রত্না রায় পড়বেন বলে”। হাসি খেলে গেল মানসীর ঠোঁটে। নাতি আর ঠানদির টিপিক্যাল খুনসুটি দেখে। তারপর লেখা, “হাহা”। আরও মজা লাগল মানসীর। মনটা হালকা হয়ে গেল বলে সে ডাইরিটা নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল। প্রথম পাতায় লেখা, “আঠার বছর বয়স হলে এই খাতাটা মাকে দিয়ে দেব”। মনে মনে মানসী ভাবল, “কেন রে?” পরের পাতায় লেখা, “আমি জানি আঠার বছর বয়সে মা আমাকে কিছু দেবে। আমি তো সাবালক হয়ে যাব, আমারও মাকে কিছু দেওয়া উচিৎ। তাই আমি এই খাতাটাই দেব মাকে। মা জানতে পারবে আমি মায়ের পাশে আছি। হয়তো তখনই মাকে বলতে পারব না যে তুমি আর অফিসে যেও না, কিন্তু ইচ্ছে হলে মা আমার সাথে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে পারে। আসলে মায়ের কথা কেউ শোনে না, অথচ মা সবার কথা শোনে”। এইবারে খুব হাসি পেল মানসীর, সে যে নিজেও তার মা সম্পর্কে এমনটাই ভাবত!

    একটা পাতায় লেখা, “আজ খুব দুঃখ হলো। স্কুল থেকে স্কেচ করতে নিয়ে গিয়েছিল বিদ্যাসাগর সেতুর নীচে। দেখলাম অনু আন্টি বাবাকে খুব মারছে, আর ‘লায়ার’, ‘কাওয়ার্ড’ এসব বলে চেঁচাচ্ছে। বাবা খানিক্ষণ হাসল, তারপর খুব ভেঙচি কাটল অনু আন্টিকে। দুজনেই আমাকে দেখল কিন্তু চিনতে পারল না। বাড়িতে ফিরে বাবা আমাকে রোজকার মতই মাথায় বিলি কেটে দিল যখন পড়ছিলাম। বাবা কী বাড়ির বাইরে আমায় চিনতে পারে না? জিজ্ঞেস করে দেখব?” মানসীর মনে অস্বস্তিগুলো ফিরে এলো। কয়েকপাতা পরে “অনু আন্টি” লেখায় চোখ আটকে গেল। পাতাটা খুঁটিয়ে পড়তে লাগল মানসী, “অনু আন্টির বিয়েতে দারুণ সানডি করেছিল। বাবা চারটে খেয়েছে, আমি দুটো। অনু আন্টি যখন জানতে চাইল ভালো করে খেয়েছি কিনা, আমি বললাম সানডির কথাটা, আন্টি কেমন রেগে গেল, আমি আর জিজ্ঞেসই করতে পারলাম না বাবা তাকে কি মিথ্যে বলেছে, বাবা কেন ভীতু। বিয়ে বাড়িতে বাবার অন্য বন্ধু শ্রীরাধা আন্টিও এসেছিল। আমি ওকে একদম দেখতে পারি না। ও একদিন আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে ঘরে বন্ধ করে দিয়েছিল। মা ছিল না, ঠাঠামকে নিয়ে ঠাঠামের বোনপোর বিয়েতে গিয়েছিল। ফলে সারা দিন আমি ঘরে বসে একলা কেঁদেছি”। কেঁদে ফেলল মানসী। ছেলেটা অভাগা বলেই কী এতো সহ্য করতে হলো ওকে? তারপরই মনে হলো অভাগা কেন হবে। দিব্যি তো মা পেয়েছে, বাপও পেয়েছে, ঠাকুমা পেয়েছে। এরপর কয়েক পাতা জোড়া লেখা, “আজ আমি বুঝেছি ঠাঠাম, না মিসেস রত্না রায় কেন আমাকে দেখলেই ‘কুহু’, ‘কুহু’ করে ডাকেন। আমার মা নাকি কাকের মতো কর্কশ, ষাঁড়ের মতো তেজী, তাই এজন্মে বাবা মাকে সন্তান দেয় নি। আমি আজও বুঝি না কেন কীভাবে পুরুষ নারীকে সন্তান দেয়। শুধু বুঝি এটা একটা প্রাকৃতিক ঘটনা, যেমন লেখা আছে নেচার স্টাডি বইতে। তাতেই খেয়াল করলাম ছোটবেলায় পড়া কাক কোকিলের সম্পর্কটা। আশ্চর্‌য! মা তেজী বলেই কী রত্না রায় মায়ের সামনে আমাকে ‘কোকিলছানা’ বলে ডাকেন না কখনও? ডাকতে সাহস করেন না। মায়ের সামনে কখনো বলেন না যে মা নাকি জলের মতো হলেই রত্না রায়কে কোকিলছানার সাথে একছাদের তলায় থাকতে হতো না, তাঁর আপন নাতি আসত চাঁদপানা ফুটফুটে। মা তেজী বলেই আমি আজ মায়ের ছেলে। মা তেজী বলেই আমার পড়াশোনা হচ্ছে, না হলে হয়তো কোনো বস্তিতে বোমা বাঁধতাম! কিন্তু রত্না রায় যা জানেন না তা হলো আমি কোকিলছানা নই, কোকিলছানা উড়তে শিখলেই কাকের বাসা ছেড়ে পালায়, কিন্তু আমি কখনও মাকে ছেড়ে যাব না। সাধ্য হলেই সুতীর্থ রায়, রত্না রায়কে এই বাড়িতে ফেলে রেখে মাকে নিয়ে চলে যাব। আমাদের দরজা কোনোদিন ওদের জন্য খোলা থাকবে না। সে অবধি রত্না রায়কে ঠাঠাম বলেই ডাকব সামনে, সুতীর্থ রায়কে বাবা। রত্না রায় কারো ডাইরি ছাড়েন না। আমারটাও পড়বেন। অথচ সব জেনে আমাকে সহ্য করতে বাধ্য হবেন। সুতীর্থ রায়কে যদি জানান, তাহলে তাঁরও একই হাল হবে। আমার মুখোশ খুলতে গেলে যে ওঁদের নিজেরটাও খুলতে হবে .........”।

    একসাথে দুঃখ, আনন্দ, কান্না চেপে ধরছে মানসীকে। ডাইরিটা যেমন ছিল তেমনই রেখে দিল খ-এর মাথার কাছে। তারপর আবার বাথরুমে ঢুকে পড়ল, বাথটবে জল ভরে এলিয়ে দিল শরীর। স্বপ্নে দেখল, হাত, পা, মুখ ঘষে ঘষে মুখোশের আঠা, ময়লা, ছাঁচের দাগ সব তুলতে তুলতে তার হাত দুটো যেন জলের হয়ে গেছে। মুখ থেকে চোঁয়ানো জলের ফোঁটা হাতের চামড়ার স্বচ্ছ সমুদ্রে মিশে যাচ্ছে। আয়নার দিকে ফিরে দেখে মুখখানাও এপার ওপার দেখা যাচ্ছে, আয়না-দেয়াল-মুখের ছায়ার ওপর ছায়ায় তৈরি হওয়া অসংখ্য প্রতিবিম্বের ঝাপসা কোলাজ ভেদ করেও! মন্ত্রের মত বাজছে,

    জল, জল, জল, একলা আমার সই
    ইচ্ছে করে আমি যেন তোরই মতো হই।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments