এড্মুন্দো দোনাতো-র জন্ম ১৯২৫ সালে ব্রাজিলের সাও পাউল শহরে। সারা জীবন মারকোস রেই ছদ্মনামে লিখেছেন। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সাংবাদিক এবং স্ক্রিপ্ট-রাইটার। ১৬ বছর বয়সে গল্প প্রকাশ করে সাহিত্য জীবনের শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস Um Gato no triângulo বা ত্রিকোণের ভিতর বিড়াল। ব্রাজিলীয় কিশোর সাহিত্যের দিক্পালদের অন্যতম এই মারকোস রেই। ছোটভাই মারিও দোনাতো-ও লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে সাও পাউল শহরে মারকোস রেই-এর মৃত্যু হয়।
সে অনেক বছর আগের কথা। সে সময় আমাদের বাড়িটা অচেনা-অজানা আত্মীয়-স্বজনদের আনাগোনার ঠেলায় ঠিক একটা ধর্মশালায় পরিণত হয়েছিল। এরা সবাই দূর দূর গ্রাম থেকে এই সাও পাউল শহরে বেড়াতে, না হলে কাজের সন্ধানে আসত। এদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের বাড়িতে এসে উঠত, কারণ তারা নাকি কোনো হোটেলেই জায়গা পেত না। অন্যদের অবশ্য কোনো রাখঢাক ছিল না; তারা বলেই দিত তাদের বেশি পছন্দ কোনো পরিবারের মধ্যে থাকা। আমার খুড়তুতো ভাই এমিলিও এদেরই একজন। এমিলিও ওর চিঠিতে (যাতে ওর সাও পাউলু আগমন বার্তা ঘোষিত হয়) খোলাখুলি লিখেছিল যে শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটা সুন্দর ফ্ল্যাট বা নির্জন-শান্ত কোনো এলাকায় একটা বাড়ি ভাড়া নেবার মতো সামর্থ ওর আছে; কিন্তু ওর একমাত্র ভয় যে এতে আমাদের পরিবারের আতিথেয়তার প্রতি অবমাননা করা হবে। এমিলিও চিঠির শেষে লিখেছিল — "পুরোনো আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার জন্যে আমার মনটা আকুলিবিকুলি করছে।"
সত্যি কথা বলতে কি পিওন এর আগে কখনও এমন অদ্ভুত চিঠি আমাদের বাড়ি আনেনি। এর একটা কারণ হল এমিলিও ছিল আমাদের দূর সম্পর্কে ভাই। তার ওপর বহু দিন ওদের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ না থাকায় আমরা ওর কথা পুরোপুরি ভুলেই গিয়েছিলাম। একটা ছবির দৌলতে ওকে চিনতে পারলাম। আমাদের পারিবারিক ছবির অ্যালবামে হলুদ হয়ে যাওয়া একটা ফটোতে দেখেছি। মাথায় বেতের টুপি, গলায় বো-টাই, কোনো একটা চিড়িয়াখানায় বাঁদরের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে। সুন্দর চেহারা। পিওন এসে চিঠি দিয়ে গেল বেলা এগারোটায়, বারোটায় এমিলিও এসে দরজার বেল বাজালো। হাতে স্যুটকেস, মুখভরা প্রীতিমধুর হাসি। ঠিকই তাই, ওর মাথায় তখন আর সেই বেতের টুপি ছিল না, তবে গলায় কালো বো-টাইটা ছিল। ওর গলায় সেটা মানিয়েও ছিল। "আপনাদের সবাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা; আপনাদের প্রিয় এমিলিও এখন হাজির", ভেতরে ঢুকে এমিলিও আমাদের সবাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল।
এমিলিওর দোহারা গড়ন, দেহের তুলনায় মাথাটা ছোট, অনেকটা ডিমের আকার। মাথার দু'পাশে চুলে পাক ধরেছে; তবুও ওর মধ্যে যুবকসুলভ একটা প্রাণোচ্ছাস ছিল। মাসে একবার কলপ লাগাতে হত, এটা যদিও আমি পরে জানতে পেরেছিলাম। ও যখন নিজের পছন্দের পেতি লোনদ্রেস সিগারেট খেত মনে হত যেন সম্মোহিত হয়ে আছে। আমেজে থেকে থেকে হাতে তালু দুটো সজোরে ঘষতে ঘষতে থুতু ফেলত। ওর এই অভ্যেসটা নিয়ে আমরা খুব হাসাহাসি করতাম। আসলে এইভাবে এমিলিও বলতে চাইত, "বেশ, আমার সবকিছু ঠিক আছে" যখন সত্যিকারে ওর সবকিছু ঠিক নেই। আমাদের বাড়িতে এমিলিও প্রথম যেদিন উদয় হল সেদিন দুপুরে টেবিলে ও কেবল মাত্র একটা বিষয় নিয়ে অনর্গল বলে গেল - হোটেলে থাকার প্রতি ওর অনীহা কেন, আর হোটেলগুলো হল যত রকমের পোকামাকড়ের আস্তানা। এর জন্যেই রাতের বেলায় ও নিজেকে নিজের কাছে একলা পাওয়ার যে আনন্দ পায় তাতে ব্যাঘাত ঘটে। আমার মার চোখে প্রায় জল এসে গেল যখন এমিলিও বলল — "আমার কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল না। আমি বলতাম, আমার স্বজনদের মুখ দেখতে বয়ে গেছে। সত্যি বলছি মাসিমা, আমার হাবভাবটা তখন এমনটাই ছিল। কিন্তু জীবনের দুঃখ-কষ্ট আমাকে শিখিয়েছে আত্মীয়-স্বজনের মূল্য কতখানি। তাইতো আমি আজ সব সময় ওদের শ্রীবৃদ্ধি আর কুশল প্রার্থনা করি।"
কথাগুলো শুধু আমার মাকে নয়, আমাদের সকলের মনকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। "তুমি এখানে কি করবে সেসব ঠিক করেই এসেছো?" খেতে খেতে আমার বাবা এমিলিওকে প্রশ্ন করল। "আমি বাড়ি তৈরির কনট্রাক্ট নেব। আপনি জানেন যে সাও পাউল পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠা শহরগুলোর একটা?"
"কনট্রাক্টর?" "ডিগ্রী কোথায়?" "এই ডিসেম্বর মাসেই ডিগ্রী পেয়ে যাব, যদি পাস করি।" "এমিলিও, তুমি কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছো?" "রিউ দে জানেইরুর একটা ইউনিভার্সিটিতে।" "তা তুমি যদি সেখানে না থাকো কি করে হবে?"
এখানে এমিলিও একটু থেমে বিজ্ঞের মতো বলল — "করসপণ্ডেস-এ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি।" "সেটা সম্ভব?"
"আজকাল যারা অকর্মা কেবল তারাই কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে যায়। আমরা তো বিংশ শতাব্দীতে বাস করছি, তাই না মেসোমশাই? এখন সবকিছুর হাতেকলমে শিক্ষা। সেই জন্যেই তো ওরা এসব কোর্সগুলো শুরু করেছে। আমার এক বন্ধু আছে সেতো সার্জারি, অর্থাৎ আপনারা যাকে বলেন শল্যচিকিৎসাতে ডিগ্রী পেল স্রেফ করসপণ্ডেস কোর্সে।
আমার বাবা কেমন যেন হয়ে গেল, একটু ভেবে বলল - "তুমি তোমার পেটটা অপারেশনের জন্যে করসপণ্ডেস কোর্সে পাস করা ডাক্তারের হাতে দেবে?"
"হ্যাঁ, আমি তো দেব..."
আমার এই উদ্যমী খুড়তুতো ভাইটি নিজের প্রতি অবিচার হবে বলে কখনও নিষ্কর্মা বসে থাকত না। সকাল সকাল উঠে দুধ-দেওয়া এক কাপ কফি খেয়েই দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ত। কোনো কোনো দিন আধ ঘন্টা পরেই ফিরে আসত। রাত্রের খাবার সময় যে প্রথমে এসে টেবিলে বসত সে এমিলিও। খাবার পরেই ওই রকম তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেত, ফিরতো প্রায় ভোর বেলায়। আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে ডিগ্রী পাবার আগেই ও বাড়ি তৈরির কাজের কনট্রাক্ট নিয়েছে, কারণ সময় নষ্ট করা ও কোনোভাবেই পছন্দ করত না।
একদিন দুপুরে খাবার টেবিলে এমিলিও ঘোষণা করল — "আগামীকাল আমি শুরু করছি।"
"তোমার তৈরি প্রথম বাড়িটা কোথায় হচ্ছে?" - আমার মা জিজ্ঞেস করল।
"বাড়ি! কি বলছেন, মাসিমা?"
"তা তুমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হবে না?"
এমিলিও মার প্রশ্নটা শুনে প্রাণ খুলে হাসল, "এখানে এর মধ্যেই এত বিল্ডার রয়েছে।"
"তাহলে তুমি কি করবে?" আমার বাবা জানতে চাইল।
এমিলিও নিজের ঘরে গেল। আমাদের বাড়ির পেছনের দিকের ঘরটা ওর। আমাদের বাড়ির কাজের মহিলা সেখানে থাকত, ওকে ওখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে বিজয়ীর হাসি হাসতে হাসতে হাতে বিভিন্ন রকমের কাগজের প্যাকেট নিয়ে ফিরে এল। মনে হচ্ছিল ও যেন সোনার পাউডার নিয়ে এসেছে। তারপর প্যাকেটগুলো যখন খুলে দেখাল, আমরা দেখলাম সেগুলোতে কোনো একরকম পাউডারই রয়েছে।
"এ এক বিশাল লাভজনক ব্যবসা।" "কিসের ব্যবসা?" "আমি নানা রকমের পানীয় তৈরি করব।" "মদ?" "এই হলুদ পাউডারটা হল স্কচ্ হুইস্কি এটা হল সেই অতুলনীয় ভেরমুথ। ওটা হল রিউ গ্রান্দে ওয়াইন। যুদ্ধের আগে এসব সুন্দর সুন্দর পানীয় তৈরি হত। পৃথিবীর সবথেকে লাভজনক ব্যবসা এটাই।"
"আর ডিস্টিল্যারি? তার তো প্রয়োজন আছে, তাই না?" "কি যে বলেন মেসোমশাই।"
পরের দিন ছিল শনিবার। সে দিন সকালে এমিলিওর শিল্প পরিকল্পনার খুঁটিনাটি সম্বন্ধে আমরা অবগত হলাম। ওর কথাটা ঠিকই, কোনো ডিস্টিল্যারির প্রয়োজন ছিল না। সেই বিশেষ ধরনের পাউডার, অ্যালকোহল আর জলই ছিল যথেষ্ট। আর একটা জিনিসের প্রয়োজন ছিল - পুরোনো একটা বাথ-টাব। আমাদের বাড়ির পেছন দিকের বাগানের এক কোনে একটা বাথ-টাব ফেলে দেওয়া হয়েছিল। প্রবল উদ্যমে দু'হাতের তালু ঘষতে ঘষতে কাজ শুরু করে দিল; আমাকে নিযুক্ত করল ওর সহকারী হিসেবে। জলের সাথে পাউডার মিশতে যেই জলের রঙ বদল হল, এমিলিও বড় একটা কাঠের হাতা তাবে ডুবিয়ে একবার মুখে ঠেকাল।
"আরো পাউডার লাগবে রে" - এমিলিও আমার দিকে ফিরে বলল। আমি একটা প্যাকেট নিয়ে এগিয়ে দিতে, সেটা নিয়ে ও পুরোটা টাবের ভেতর ঢেলে দিল। টাবের জলটা যেটা এতক্ষণ নীল দেখাচ্ছিল, হয়ে গেল সবজেটে, তারপর একদম হলুদ, শেষে লাল। "সুন্দর রঙ!" আমার ভাইটি খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল।
পরের ধাপটা ছিল বোতলে ভরা। বেশ কয়েক ডজন খালি বোতল এমিলিও আগেই কিনে রেখেছিল। বোতলে ভরার কাজটা আমার পছন্দ হল, ওকে সাহায্য করলাম সারাদিন। বাকি রইল শুধু লেবেল লাগানো। এমিলিওর কাছে এক বাণ্ডিল রঙিন ইংরেজিতে লেখা দৃষ্টি-আকর্ষণীয় লেবেল তৈরি ছিল। বিজ্ঞ প্রফেসারের মতো ও আমাকে কতগুলো শব্দের মানে শেখাল — "মেড", "ফার্স্ট", "স্কটল্যান্ড" ইত্যাদি আরো অনেক। ওর উচ্চারণ হয়তো সঠিক ছিল না, কিন্তু ওর মনটা ভরে ছিল খুশিতে। দু'মাস ধরে আমি আমার এই খুড়তুতো ভাইটিকে মদ তৈরি, বোতলে ভরা আর লেবেল সাঁটার কাজে সহকারি হিসেবে সাহায্য করলাম। মাঝে মধ্যে পানীয়র চেহারা এমনই অদ্ভুত হত যে বাড়ির কেউ সেটাকে পানীয় বলে চিনতে পারত না। এমিলিও সঙ্গে সঙ্গে তাতে "রাম অব্ ওয়েস্ট ইন্ডিজ" লেবেল সেঁটে দিত। পরে শুনেছিলাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের রামের এখানে চাহিদার কথা।
যাইহোক এমিলিওর শিল্পপতি হিসেবে অন্তত প্রথমে ভাগ্য সুপ্রসন্নই ছিল। সেই টাবটা সব সময়ই ভরা থাকত আর ও শ'য়ে শ'য়ে খালি বোতল কিনে আনত। আমার মনে আছে আমার বাবাকে আমাদের বাড়ির সেই পেছনের ঘরটার জন্য ভাড়া হিসেবে কিছু টাকা দিতেও শুরু করেছিল। বাড়ির সকলের কাছে সেটা ছিল সত্যিই একটা বিস্ময়। রবিবার খাবার টেবিলে এমিলিও এক বোতল ওয়াইন নিয়ে আসত। তবে সেটা নিজের তৈরি নয়; সরকারী দোকান থেকে কেনা। নিজের জামা-কাপড়ের ধরন বদলে গেল; প্রতি রাত্রে গায়ে খুব করে সেন্ট ঢেলে বেরিয়ে যেত। মুখের ভাবটা থাকত যেন একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক।
একদিন এমিলিও বাবাকে বলল — "আমি অন্য জায়গায় থাকার কথা চিন্তা করছি। ভাবছি আরো অভিজাত অঞ্চলে একটা বাড়ি কিনব। কিন্তু আমি সাথে ওই বাথ-টাবটা নিয়ে যাব। অবশ্য এটার জন্যে মেসোমশাই আমি হাজার টাকা দেব।"
"হাজার টাকায় তুমি কয়েকটা নতুন টাব কিনতে পারবে।" - আমার বাবা অবাক হয়ে ওকে বলল।
"আমি তা জানি, মেসোমশাই। কিন্তু আমি ওই টাবটার প্রতি কৃতজ্ঞ; আমি আপনাকে এখনই টাকা দেব।" "এখনই?" "মানে আগামীকাল।"
পরের দিন টুপি মাথায় দু'জন লোক বাড়িতে এসে উপস্থিত।
এমিলিও এগিয়ে দু'হাত বাড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা করতে গেল, কিন্তু তারা পকেট থেকে বার করল আই-কার্ড। তারপর শিল্পপতিকে নিয়ে সেই দু'জন চলে গেল। হ্যাঁ, সঙ্গে এক বাণ্ডিল "রাম অব্ ওয়েস্ট ইন্ডিজ" লেবেল। সবকিছুর উত্তর দেবার জন্যে এমিলিও তিন দিন পুলিশ হাজতে ছিল। নিশ্চিত করে বলা যায় যে পুলিশের বড়কর্তা এমিলিওর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তবে ওকে একটা মুচলেকা দিতে হয়েছে যে কোনদিন আর দেশী বা বিদেশী মদ তৈরির চেষ্টা ও করবে না। এমিলিও বাড়ি ফিরে এল। যদিও আমরা ভেবে ছিলাম যে এতে ও দমে যাবে, তা হল না। এমিলিও সত্যিকারের আশাবাদী মানুষ; মাথা ভর্তি নতুন নতুন পরিকল্পনা। "আমি আর একটা পথ বার করে ফেলব," খাবার সময় নিজের বো-টাইটা ঠিক করতে করতে আমাদের আশ্বাস দিয়ে বলল, "এই পৃথিবীটা একমাত্র সাহসীদের জন্যে"।
একটু পরে ধীরে ধীরে বাড়ির পেছনে গিয়ে সেই বাথ-টবটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এমিলিও।
"আমি টাবটা পুরোনো লোহালক্কড়ের সাথে বিক্রি করে দেব", আমার বাবা জানাল।
"আমি আপনাকে বলেছি ওটা আমি কিনে নেব; আমি কথা দিয়ে ফিরিয়ে নিই না।"
"আবার সেই মদ তৈরির জন্যে? না, না।"
"আমার মাথায় আর একটা প্ল্যান আছে," নিজের ঘরে গিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে যাবার আগে বলে গেল।
পরের দিন এমিলিও বেশ সকাল সকাল বেরিয়ে গেল খুঁজে পেতে একটা হাপর কিনে আনতে। হ্যাঁ, একটা হাপর। সবাই যখন জিজ্ঞেস করছিল হাপরের কি দরকার, ওর কাছ থেকে সঠিক কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। কিন্তু একটা বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ ছিল না যে এমিলিও কোনোভাবেই দমে যায়নি। আমার বাবা আবিষ্কার করল যে ও একটা বড় সাইনবোর্ড তৈরির অর্ডার দিয়েছে - সেটা লম্বায় তিন আর চওড়ায় দু'মিটার। বাথ-টাবটাকে একটু আধটু সারিয়ে নিয়ে, এমিলিও সেটাকে নিয়ে গিয়ে ঢোকাল নিজের সেই ঘরটাতে। তারপর এমিলিওকে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে জলের পাইপ কি ভাবে আছে তা পর্যবেক্ষণ করতে দেখা গেল। বাড়ির কারো সাথে কোনো পরামর্শ না করেই নিজের ওই ছোট ঘরটাতে মিস্ত্রি এনে দেওয়ালে টাইল লাগিয়ে ফেলল। সাথে সাথে ঘরটার জানলার কাঁচগুলোকে বদলে মোটা আর গাঢ় রঙের করে নিল। সবশেষে আমাদের পাড়ায় একটা ছাপাখানা খুঁজে বার করে অর্ডার দিল কয়েক হাজার হ্যাণ্ডবিলের।
বাড়ির সবাই ওর কাজ-কর্ম দেখে একটু চিন্তিত থাকলেও, ওকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করল না।
"এখন আমার প্ল্যানটা প্রকাশ করতে পারি, পার্টনার?" - এমিলিও বাবাকে প্রশ্ন করল। "এর মানে?" "ভালো করে শুনুন, পার্টনার।" "প্রথমে তুমি বল আমাকে কেন 'পার্টনার' বলছ?" "আমি আপনাকে এখন থেকে পার্টনার বলেই ডাকব।"
এমিলিও ঠিক যখন বিষয়টা বাবাকে খুলে বলতে যাবে, দরজার বেলটা বেজে উঠল। কয়েকজন কুলি পাঁচ-সাত হাত লম্বা আর তিন হাত চওড়া একটা সাইনবোর্ড ধরাধরি করে ঘরে এনে ওঠাল। সবাই আমরা উৎসুক, দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম এই ভেবে যে এবার এমিলিও রহস্য উদ্ঘাটন করবে। বাবা খুব অবাক হয়ে সাইনবোর্ডটা পড়ল — "দ্য সুলতান অব্ টার্কিশ বাথ্স -- সব রকমের প্যারালিসিসের ধন্বন্তরী--গেঁটে বাত, মেরুদণ্ডের প্রব্লেম--সর্বাধুনিক এমিলিও-পদ্ধতির পরে ঠাণ্ডা ও গরম জলে স্নান"
"সাইনবোর্ডটা বাড়ির সামনের দরজার ওপর লাগিয়ে দাও", এমিলিও কুলিদের বলল। তারপর বাবার দিকে ঘুরে বলল - "পার্টনার, ওদের একটু বকশিস দিয়ে দেবেন?"
খাবার টেবিলে যখন এমিলিও ফিরে এল, তখন ওকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল। এ ধরনের ঠাণ্ডা-গরম স্নান যাকে বলে টার্কিশ বাথ রক্ত সঞ্চালন বা ব্লাড সার্কুলেসানের ওপর কেমনভাবে কাজ করে সেটা নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিল। এই চরম উষ্ণ আর চরম ঠাণ্ডা স্নান বছরের পর বছর বিছানায় পড়ে থাকা পঙ্গুকেও হাঁটিয়ে ছাড়ে। এমিলিও এও জানাল যে এই বিষয়টা নিয়ে সে বিস্তর পড়াশোনা করেছে আর এর কার্যকারিতা নিয়ে ওর কোনো রকম সন্দেহ নেই। এমিলিও পদ্ধতি সম্বন্ধে ওর কথা হচ্ছে যে এটা শুধুমাত্র শুনতে ভালো লাগে, এছাড়া এটার মধ্যে একটা নতুনত্ব আছে — "এই হাপর দিয়ে রুগীর ঠিক শিরদাঁড়ার ওপর দেওয়া হবে ঠাণ্ডা হাওয়া। তাতে ভালো কিছু না হলেও, কিছু ক্ষতি হবে না।"
"কিন্তু রুগী দেখার জন্যে তোমার চেম্বার বাড়ির পেছনে ওই ছোট্ট ঘরে করবে?" আমার মা জানতে চাইল।
"মাসিমা, রুগীরা আরাম চায় না; চায় শুধু রোগ-মুক্তি।"
"কিন্তু এমিলিও, এ বিষয়ে তোমার তো কোনো অভিজ্ঞতা নেই।"
"হ্যাঁ, তা নেই বটে। তুর্কীদের শত-শত বছরের অভিজ্ঞতা আছে; ওরা এই স্নান রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করেছে। আমাকে বলুন, মাসিমা, আপনারা কি কোনদিন কোনো বেতো তুর্কী দেখেছেন।"
"না; আমি কোনদিন দেখিনি।" - আমার বাবা স্বীকার করল।
"সেটাই কথা। আপনি যদি দেখতেন তাহলে ভুলতেন না।"
এমিলিওর টার্কিশ-বাথের ব্যবসায় যদিও প্রচুর লাভের সম্ভাবনা ছিল, তবুও আমার বাবা আপ্রাণ চেষ্টা করল ওর মধ্যে জড়িয়ে না পড়তে। "আর লাইসেন্স-এর কি হবে, এমিলিও? চেম্বার খোলার তোমার লাইসেন্স আছে?"
এমিলিও খাওয়া শেষ না করেই উঠে পড়ল। ওর মনে পড়েছে ছাপাখানা থেকে হ্যাণ্ডবিলগুলো নিয়ে পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে বিলি করতে হবে। ওর একটা বিষয়ে প্রবল বিশ্বাস ছিল - সেটা হল প্রচার বা বিজ্ঞাপনে। ওকে বলতে শুনেছি - "প্রচারই হল ব্যবসার প্রাণভোমরা"।
এমিলিও বেরিয়ে যেতেই বাড়ির সামনের দরজার কাছে গিয়ে আমি সাইনবোর্ডটা ভালো করে দেখলাম, আমাদের পাড়ায় এটা নিয়ে বেশ কৌতূহল তৈরি হয়েছে। এর প্রধান কারণ আমাদের বাড়িগুলো যে রাস্তায় সেখানে চিরকাল জলের একটা সমস্যা ছিল। যাইহোক সন্ধেবেলায় হ্যাণ্ডবিল বিলি করে ফিরতে দেখা গেল এমিলিওকে, মুখে জ্বলছে চুরুট। নিশ্চয় বেশ উত্তেজিত, কারণ আমরা ওকে কখনো চুরুট খেতে দেখিনি।
পরের দিন এমিলিওকে বেশ ভোরে উঠে (যেটা অবশ্যই ওর স্বভাব বিরুদ্ধ) বাড়ির ভেতর পায়চারি করতে দেখলাম। হয়তো প্রথম রুগীর অপেক্ষা করছিল। সারা দিনটা বৃথাই গেল শুধু পায়চারি করে করে। দুদিন এভাবেই গেল। পরে ওর মনে পড়ল আমাদের পাড়ার মুদীকে, ও খুব কষ্ট করে, পা টেনে টেনে হাঁটতে দেখেছে। এমিলিও আপ্রাণ চেষ্টা করল মুদীকে চেম্বারে এনে একবার চিকিৎসা করার। যদিও প্রতি স্নানের খরচ খুব বেশি নয়, তবুও নিজের পক্ষাঘাতগ্রস্ত পায়ের ওপরেই নির্ভর করাই মুদী শ্রেয় মনে করল। পরে আমরা জানতে পেরেছিলাম এমিলিও এই নিয়ে মুদীর সঙ্গে প্রবল বাক্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। মুদীকে রাজী করতে ও যে ঘুষিঘাষা মারেনি তার কারণ মুদীর কাছে ওর কিছু ধার ছিল।
প্রথম সপ্তাহটা এভাবে কেটে গেল, কোনো রুগীর দেখা পাওয়া গেল না। দ্বিতীয় সপ্তাহে একজন যাও বা হাজির হল শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা হাওয়া দেবার জন্য, বিশাল হাপর দেখেই উদাস হয়ে গেল। একমাস পরে আমরা সবাই ধরেই নিয়েছিলাম ওর এই উদ্যোগটাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এমিলিও তবুও আপ্রাণ চেষ্টা করছিল যাতে সাইনবোর্ডটা খুলে ফেলতে না হয়। ঠিক এরই মধ্যে একদিন বাড়ির দরজায় একটা গাড়ি এসে দাঁরাল, তার থেকে নেমে এল এক বিশাল সম্ভাবনা। নেমে এল, না, নামানো হল। আমি সেটা নিজের চোখে দেখলাম - একজন ছোটখাটো বৃদ্ধ ভদ্রলোককে তার ভাইপো-রা তাদের পেশিবহুল হাতে তুলে নিয়ে এল। ভদ্রলোককে এনে আমাদের হলঘরের একটা হাতলওলা চেয়ারে বসানো হল। সেই প্রাচীনের কম্পিত এক হাতে ধরা এমিলিওর হ্যাণ্ডবিল।
"আমি কি ডাক্তার এমিলিওর সঙ্গে দেখা করতে পারি?"
অসুস্থ বৃদ্ধের অবস্থা দেখে আবার কোনো গণ্ডগোলের আশঙ্কায় আমরা বলতে যাচ্ছিলাম যে ডাক্তার এমিলিও কিছুদিনের জন্যে বেড়াতে গেছেন। ঠিক সেই সময় হঠাৎ হলঘরের মধ্যে এমিলিও এসে দাঁড়াল - ওর মুখের হাসিতে তখন যেন পৃথিবীর সমস্ত পক্ষাঘাতে পঙ্গুদের জন্যে ছিল সম্পূর্ণ নিরাময়ের আশ্বাস। "এই তো আমি এখানে" - এমিলিও প্রায় চেঁচিয়েই বলল। যেন বলতে চাইছে - এখানেই আছেন তোমার পরিত্রাতা।
"আপনার কি কষ্ট? আচ্ছা, আচ্ছা পায়ে! প্যান্টটা একটু গুটিয়ে তুলুন তো, পা দুটো দেখি।"
অল্পক্ষণের পরীক্ষা।
"ডাক্তার কি বুঝলেন?" "এ সোজা কেস।" "সোজা?" "খুব সোজা।"
এমিলিও রুগীকে নিজের কাঁধে ভর দিয়ে নিয়ে যেতে থাকল বাড়ির পেছনের সেই ঘরটাতে, রুগী এক-পা এগোচ্ছে আর যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। ভদ্রলোকের দু'নাতি, আমার বাবা-মা হলঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে তখন ভগবানের নাম জপছে। আমি তখন ওর সেই ঘরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সেই ছোটখাট ভদ্রলোক ডাক্তারের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে প্রথমদিকে সব কিছুই নীরবে সহ্য করল। হয়তো গরমজলে রুগীর যন্ত্রণার কিছু উপসম হচ্ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা আরো গোলমেলে আর খারাপ হয়ে গেল যখনই স্টোর থেকে বিশাল রকমের একটা চাঙড় বার করা হল। সেই বৃদ্ধের গোঙানি তখন ক্রমশঃ উচ্চতর সুর ছুঁতে থাকল। ভয়ের চোটে ভদ্রলোকের এক নাতি দৌড়ে এসে এমিলিওর ঘরের (না, চেম্বারের) দরজায় ঠাক্ ঠক্ করল, ভেতর থেকে ডাক্তারের উত্তর এল - "এটা এরকমই হবার কথা, সব ঠিক হয়ে যাবে।" তবুও বিশাল হাপরের মুখ থেকে অতি শীতল হাওয়া বৃদ্ধের শিরদাঁড়ায় পড়া-মাত্র সেই গোঁঙানি রূপ নিল প্রচণ্ড আর্তনাদে। আমার তখন মনে হচ্ছিল বৃদ্ধের প্রাণবায়ু তখনই বের হয়ে যাবে, স্বর্গারোহণ করল বলে। এটা শুধু আমার মনে হয়নি, পাড়ার সকলের তাই মনে হয়েছিল।
বাড়ির দরজায় যখন অ্যাম্বুল্যান্স এসে দাঁড়াল, এমিলিওর রুগী না গোঁঙাচ্ছে, না চিৎকার করছে। এক টুকরো গাছের গুঁড়ির মতো পড়ে আছে; ঠাণ্ডা, একদম ঠাণ্ডা। আমার খুড়তুতো ভাই তখনও একহাতে হাপর ধরে হতভাগ্য ভদ্রলোকের নাতিকে পুরোপুরি নিরাময়ের জন্যে যে দ্বিতীয় স্নানের দরকার সে কথা বোঝাতে ব্যস্ত। বহু পক্ষাঘাতগ্রস্ত রুগীর বিবরণ দিল যারা ওর ক্লিনিকে এসে সেরে উঠেছে। কিন্তু ওরা এমিলিওর কোনো কথাই শুনতে রাজি ছিল না। শুধু তাই নয়, ওকে ওরা কোনো ফিস দিলতো নাই, বরং যথেষ্ট অপমান করে গেল।
"ঠিক এরকমটাই হয় যখন কেউ এই অজ্ঞানতাপূর্ণ সমাজে কাজ করবে," আমাদের সুলতান অব্ টার্কিশ বাথ দুঃখ করে বলল," ওরা যদি আর আমার কাছে আসে, আমার চিকিৎসা পাবে না।"
যেদিন ওর সাইনবোর্ডটাকে খুলে নামিয়ে রাখা হল এমিলিওর থেকে আরো বেশি দুঃখী কাউকে দেখিনি কখনো। ওর পৃথিবীটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল; শেষ আশাটাও ভেঙে চুরমার। তিক্ত, খুব তিক্ত এমিলিও। গ্রামে ফিরে যাবার জন্যে ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফেলল, কিন্তু গেল না। বাড়িতে থেকেই সারাদিন মাথা ঘামিয়ে বার করতে থাকল আর একটা প্ল্যান। এবার আমার মা ওকে দেওয়া বিছানাটা চেয়ে নিল এর কারণ আমাদের কাজের মহিলা কোচেই শুচ্ছিলো এতদিন। এমিলিও নির্বিকার! বিছানাটা দিয়ে বলল - "আমি বাথ-টাবে শোব।" বাথ-টাবে শোয়া ওর বেশ ভালো লেগেছিল।
আমার বেশ মনে আছে সেটা ছিল বড়দিনের কয়েকদিন আগে। তখন এমিলিও বেশ হতাশ, ডাকে ওর নামে সুন্দর কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট এলো। পিওনের হাত থেকে প্যাকেট নিয়ে আমি এমিলিওর ঘরে গেলাম। আমার সেই ভাইটি তখন একটা কিছু (যেটা এককালে ছিল পায়জামা) পরে বাথ-টাবে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে, চুলগুলো বেশ সাদা হয়ে আছে কারণ পয়সার অভাবে তাতে কলপ পড়েনি অনেক দিন। লক্ষ্ করলাম ওর সেই বেতের টুপিটা ব্যবহার হচ্ছে অ্যাশ-ট্রে হিসেবে। বো-টাইটার ওর সেই রাম অব্ ওয়েস্ট ইণ্ডিজের মতো কোনো সঠিক রঙ ছিল না।
অনেক কষ্ট করে ঘুম থেকে তুলে ওর হাতে প্যাকেটটা দিলাম। চোখে ওর এতই ঘুম যে পরে খুলে দেখব বলে ঘুমিয়ে পড়ল। প্যাকেট নিয়ে আমাদের মনে একটু কৌতূহল ছিল তাই আমরা টেবিলে ওর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এক সময় এমিলিও হাসতে হাসতে আমাদের সামনে এসে উন্মাদের মতো নাচতে লাগল, হাতে ধরা সেই প্যাকেটটা। "এই আমার ডিগ্রী। আমি পাস করে গেছি, পাস করে গেছি। এখন আমি গ্র্যাজুয়েট।"
সার্টিফিকেটটা সুন্দর আর জমকাল দেখতে, ছাপাও ভালো। গথিক স্টাইলে লেখা; শীলমোহর লাগানো আর দুদিকে সই করা। "দেখ, সব ঠিক আছে এতে, পুরো আইনসম্মত। সবসময় যেমনটা ঠিক আমি চাই।" — এমিলিও আমাদের উদ্দেশ্যে বলল।
আমার বাবা যে আমার এই খুড়তুতো ভাইয়ের কথা বা কাজকর্মকে বিশেষ গুরুত্ব দিত না সেও সেদিন ওর কাছে হার মেনেছিল।
— "আমাদের এমিলিও সত্যিই এলেমদার ছেলে। সাহস আছে! গ্র্যাজুয়েট হল করসপণ্ডেস কোর্স করে! কে ভাবতে পারে?"
— "আমি পাস করেছি ভালোভাবেই, নব্বই শতাংশ পেয়ে।"
— "আরে মশাই, নব্বই শতাংশ শুধু মার্কস নয়, আরো কিছু।"
এমিলিওর সেই খুশি আমাদের সেবারের বড়দিনটাকে চিরস্মরণীয় করে রাখল। ছুটে গিয়ে বাজারে একটা টার্কি অর্ডার দিয়ে এল। খ্রিস্টমাস ট্রিও নিয়ে এল হলঘরে সাজানোর জন্যে (অবশ্য আমাদের টাকায়)। হলঘরের কোণে রাখা হল সেই বিশাল খ্রিস্টমাস ট্রি। স্যান্টাক্লজও এত ছোটাছুটি করেনি যতটা আমার এই ভাইটি সেবার করল। ওর সার্টিফিকেটের জন্যে ও একটা দামী ভারি সোনালী ফ্রেম অর্ডার দিয়ে এল। ফ্রেমবদ্ধ সার্টিফিকেটটা বারান্দার এমন জায়গায় টাঙিয়ে দিল যাতে যেতে-আসতে সেটা লোকের চোখে পড়ে। আগে যারা ওর হ্যাণ্ডবিল ছাপিয়ে ছিল তারাই ওর ভিজিটিং কার্ড করে দিল — "ড: এমিলিও সুজা; আর্কিটেক্ট"।
বছরের শেষ কয়েকটা দিন মা-র উপহার দেওয়া একটা ইঞ্জিনিয়ারিং বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে নানান পরিকল্পনা করে কেটে গেল। এমিলিও নিজেকে খুব সাহসী মনে করত। ওর ধারণা স্থাপত্যশিল্পে ও বিপ্লব নিয়ে আসবেই আর সাথে সাথে নিজের ঘরে টাকার বন্যা। এসব পরিকল্পনার দীর্ঘ ও নিখুঁত বর্ণনা আমাদের রোজ শোনাত। এসবের মধ্যে একটা ছিল মধ্যবিত্তদের জন্যে বিশাল হাসপাতাল। ও মনে করে আমাদের সমাজের এই শ্রেণীটাই সবথেকে বঞ্চিত। নববর্ষের নৈশভোজের সময়, যখন রাস্তায় ছেলেরা হইহুল্লোড় করছে, এমিলিও খুব গম্ভীরভাবে নিজের খুব ব্যক্তিগত খবর আমাদের পরিবেশন করল — ও এবার বিবাহবন্ধনের জন্যে প্রস্তুত।
"আপনারা জানেন না যে আমাদের গ্রামের একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। প্রায় কুড়ি বছর সে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে, তার আর ধৈর্য্য নেই। এখন তো আমার টাকা আসতেই থাকবে, তাই আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলাম। জীবনের একটা সঠিক এবং উচিত কাজের এটাই সময়।"
ওর এই খবরে আমাদের সকলের চোখে আনন্দ অশ্রু ঝরতে লাগল। আমার বাবা শুনে বলল এখনই কয়েক বোতল ওয়াইন নিয়ে আসতে, এই শুভ খবরটাকে উপযুক্তভাবে স্বাগত জানানো দরকার।
সেটা ছিল জানুয়ারী মাসের গোড়ার দিকে। খবরের কাগজের শেষ পাতায় যেখানে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের খবর থাকে সেখানে একটা খবর বের হল। বলা হয়েছে যে রিউ দে জানেইরুর এক বেআইনি সংস্থা বিভিন্ন বিষয়ে সারটিফিকেট বিক্রি করছে। এই চক্রের পাণ্ডা অর্থাৎ সংস্থার অধিকর্তা ইতিমধ্যে পুলিশ হাজতে। এই সংস্থা যাদের প্রতারিত করেছে তাদের নামের তালিকা দেওয়া ছিল। আমার খুড়তুতো ভাই এমিলিওর নামও তাতে পাওয়া গেল।
সবার শেষে এমিলিও খবরটা পড়ল। আমাদের কারো সাহস হয়নি খবরটা ওকে দেখানোর। কিন্তু খবরটা ওর জানা প্রয়োজন ছিল কারণ এই সার্টিফিকেট নিয়ে কোনো কন্সট্রাকশন কোম্পানীতে চাকরি করতে গিয়ে জেলে চলে যেত। এমিলিও খবরটায় একবার চোখ বুলিয়েই সব বুঝতে পারল। তারপর ধপাস্ করে পড়ে গেল মেঝেতে। আমাদের কোনো সান্ত্বনাই তখন ওর কানে ঢুকলো না। মূকবধির পড়ে রইল মেঝেতে। পরে উঠে সটান গেল নিজের ঘরে।
"যদি কিছু করে বসে!" আমার মা ভয়ে বলে উঠল।
সত্যি কথা বলতে কি সকলেই আমরা তাই ভয় পাচ্ছিলাম। না, ও কিন্তু আত্মহত্যা করেনি। ঘরের ভেতর খুঁজে নিল একটা সেই রঙিন পাউডারের প্যাকেট আর এক বোতল অ্যালকোহল আর তৈরি করে নিল পানীয়। অবশ্য পানীয়র প্রত্যাশিত ফলও পেল। আমরা যে ঘরে বসেছিলাম সেখানে যখন এমিলিও ফিরে এল তখন ওর পা দুটো কাঁপছে, মনে হল মনটাও কেমন এলোমেলো। আমরা চাইছিলাম ও এক জায়গায় বসুক, কিন্তু ও টেবিলের চারদিকে চক্কর কেটে চললো। চক্কর কাটতে কাটতে পড়ে গেল। পরে কোচের ওপর উঠে বসে বলতে থাকল পেটে যা কিছু আছে উগরে দেবে। ভয়ে আমরা কোচের সামনে মেঝেতে খবরের কাগজ বিছিয়ে দিলাম। না, তবে কিছু করল না। শুধু কফি খেতে চাইল। কফি আনা হল, দেখল কিন্তু খেল না।
— "আমি চললাম, আপনাদের কাছে বিদায় নিচ্ছি।" এমিলিও আমাদের সবাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল।
— "এভাবে তুমি রাস্তা দিয়ে যেতে পারবে না।" — আমরা সবাই ওকে বোঝালাম।
— "এখানে আমাকে ধরে রাখে এমন কিছু নেই। আমি আমার গ্রামে ফিরে যাব, জুয়ানাকে বিয়ে করব।"
— "জুয়ানা?" তখন আমরা জানতে পারলাম এক রুগীর বান্ধবীর নাম।
— "এখানে থাকো।" আমার বাবা বুঝিয়ে বলল।
— "না, এখানে আর থাকব না।" চেঁচিয়ে যখন কথাগুলো বলল, মুখে ভক্ ভক্, করছে সেই 'রাম অব্ ওয়েস্ট ইন্ডিজ'এর গন্ধ।
— "অন্তত কাল পর্যন্ত থেকে যাও।"
— "কাল পর্যন্ত?"
— "হ্যাঁ, কাল তুমি চলে যেও।"
নিজের দোটানা অবস্থা থেকে বের হবার জন্যে এমিলিও কঠিন চেষ্টা করে সফল হল। অনেকক্ষণ নির্বাক বসে থেকে বলল; "আপনারা যখন এত করে বলছেন আজকের দিনটা থাকছি, কিন্তু কাল অবশ্যই চলে যাব।"
এমিলিওর কথার দাম ছিল। সেদিন থেকে গেল, শুধুমাত্র প্রতিজ্ঞার দ্বিতীয় অংশটা ভুলে গেল। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল তাই পরের দিন যাওয়া হল না। এর পাঁচ বছর পর একদিন নিজের বাক্স-প্যাঁটরা বেঁধে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে গেল নিজের গ্রামে। অনেকদিন পর আমরা জানতে পেরেছিলাম যে জুয়ানার আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, এমিলিও ফিরে আসার আগেই। একি নিষ্ঠুরতা! সংসারে এমনটাই হয়।