এ পরকীয়া মাত্র।
মেধা-স্বেদ-রক্তের উন্মাদ অন্তে ক্লান্তি বশ্যতার
ইচ্ছে সীমায় অক্ষম ভেসে থাকা
এ পরকীয়া তবু...
মুখবন্ধ
পূর্বভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক অসমীয়া-ওড়িয়া-বাংলার। ভাষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য ঐতিহ্যে লিপ্ত এই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষজনেরা। প্রায়ই দেখা যাবে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই এক ভাষার মানুষ অন্য ভাষাটি স্বচ্ছন্দে বুঝে নিতে পারছেন। দক্ষিণা লিপির প্রভাবে ওড়িয়ার লিপিরূপটি যদিবা একটি দেয়াল তৈরি করেছে, যেন প্রাণবঁধুয়ার বিলিতি ঘোমটা, প্রায় একই লিপিরূপের দাক্ষিণ্যে বাংলা/অসমীয়া ভাষীর পক্ষে অপর ভাষাটি সহজে পাঠযোগ্যও। কিন্তু জাগতিক বাধাগুলি না থাকলেই যদি এক গোষ্ঠীর মানুষ অপর গোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতিকে ছুঁতে পারতো, তাহলে তো মানব-ইতিহাসটি এমন জটিল হতোই না, আর আমার মতো ফালতো লোক এতো উন্নাসিক গর্জন-তর্জন করার সুযোগও পেতো না।
যাই হোক, উপরোক্ত জটিলতাটি রয়েছে, এবং, অতএব, বাঙালি সাহিত্যরসিক যতোটা পাশ্চাত্য কবিতার হদিশ রাখেন, এমনকি, এদানীং আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি ভাষার হদিশও রাখেন, ততোটা অসমীয়া-ওড়িয়া সাহিত্যের খেয়াল করেন না। সাংস্কৃতিক দাসের মননে এমনটা অস্বাভাবিক নয় অবশ্য। অথচ, একই চর্যাপদ এই সবকটি ভাষার প্রথম স্মারক। প্রতীচ্যের জাতীয়তাবাদের আদরায় যেদিন আমরা সবাই এক ভাষা - এক সংস্কৃতির সমীকরণে বিশ্বাস করে নিজ নিজ সাহিত্যের একরৈখিক ইতিহাস লিখছিলাম, সেদিন চর্যাপদের প্রকৃত উত্তরাধিকার নিয়ে কাজিয়াও কম করিনি। সেই কাজিয়ার আগে-পরে অসমীয়া-ওড়িয়াকে নিজের ভাষার উপভাষা হিসেবে হজম করে ফেলার চেষ্টাও বাঙালি কম করেনি। এসবের ফলেই প্রকৃত অর্থে অসমীয়া-ওড়িয়া সাহিত্যের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখাটা বাঙালির পক্ষে আর হয়ে ওঠেনি।
এর ব্যতিক্রম যে একদম নেই, তা নয়। আসামের অসমীয়া-প্রধান ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং বাঙালি-প্রধান বরাক উপত্যকার বাঙালিরা নিরন্তর অসমীয়া সাহিত্যের চর্চা এবং অনুবাদ করেছেন। কিন্তু অপরাপর অঞ্চলের বাঙালি আজো তো সাকিন পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ না হলে বাংলা-ভাষীদের বাঙালি বলেই চিনতে পারেন না।
বরাকের বাঙালি হওয়ায় জন্মসূত্রে এমন ক্ষোভ-টোভ তো ছিলই, আর ছিল অসমীয়া কবিতার মাধুর্যে মুগ্ধতা। সেসব কিছু মিলিয়ে তৈরি একটা টানেই অসমীয়া কবিতার অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য দুই 'মলাট'-এর মধ্যে অসমীয়া কবিতার একটা পরিচয় গ্রন্থিত করা, বিশেষ করে বিশশতক ও তার পরবর্তী কালের কবিতার পরিচয়। আর পাণ্ডিত্য-প্রচেষ্টায় ব্যর্থতার ফলে জুটে যাওয়া অবসর তো ছিলই।
অনুবাদ করতে গিয়ে অবশ্য দেখলাম, পাণ্ডিত্যের মতো এ-কাজটাও কঠিন। মাঝপথে কাজটা ছেড়ে দিলেই আমার স্বভাব-মতো হতো, দোস্তরাও খুশি হতেন। কিন্তু কবিতার নেশাতে সুস্থ লোকেরাও পাগলা হয়ে যায়, আর আমি তো নিজ হকে পাগলাটে। অতএব, এই সংকলন। সাহস করে বলে রাখি, এটা আসল সংকলনের আদ্দেকটা মাত্র। বাকিটুকু এখনো পাকঘর থেকে পরিবেশিত হওয়ার মতো হয়ে ওঠেন নি।
আরেকটি নিবেদন, কবিতা বাছাই করেছি মূলত নিজের পছন্দ আর অসমীয়া কাব্যেতিহাসে কবি বা কবিতাটির গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে। অস্যার্থ এই, কবিতাটি পড়ে আপনার যখন মনে হবে যে কবিতাটি ঠিক বাছাই হয়েছে, তখন মনে রাখবেন যে সেটি আমার পছন্দের কবিতা, আর যেটি পড়ে মনে হবে যে একে কবিতা বলে কোন শা..., তখন মনে রাখবেন যে সেটির দায় ইতিহাসের।