সাগর দেখেছো
সাগর দেখেছো? দেখো নি কখনো? আমিও দেখিনি,
শুনেছি তবুও,
নীলিম সলিলরাশি, বাধাহীন ঊর্মিমালা রয়েছে দূর
দিগন্ত ব্যেপে।
আমার এই অন্তরটুকু সাগরের মতো নীল বেদনায়
দ্যাখোনি তুমি?
উথাল পাথাল যতো বাসনার লক্ষ ঢেউ তোমারই
স্মৃতি-সীমা চুমি।
শোনো নি? শোনো নি আমার সাগরে তুমি
উতলা সংগীত?
বোঝো নি? অনুভব করোনি, ফলের বাগানে বসন্তের
কোমল ইঙ্গিত?
দেখেছোতো রামধনু, বর্ষার মেঘে আলোর
মোহন গৌরব,
প্রেমের আলোক-দীপ্ত আমার হৃদাকাশে দ্যাখোনি কি
রঙের উসব?
মাঝরাতে জেগে ওঠে শোনোনি কি কোনোবা কেতকীর
হিয়াভাঙা সুর?
ভাবো নি কি একবারো পাখির গলায় কাঁদে মানুষের
হৃদয়-সংবাদ!
আমি জানি তুমি কী জানো! হে আমার হৃদয়হীনা প্রিয়া!
তুমি শুধু জানো
তুমি তুমি, আমি আমি। তুমিতো জানলে না হায়, কেন ওগো
কেন আমি গাঁথি
ঝরে পড়া মালতীতে জয়ের গৌরব মালা? মিলনের
প্রাসাদ সোনালী
সাজাই কেন পৃথিবীর দুখের কাদায় আমি, হৃদয়ের
রাঙা রক্ত ঢেলে?
প্রতিমার চরণ ধুলাম কেন? তুমি বুঝবে না সখি
কোন বেদনায়
ষষ্ঠীতে প্রতিষ্ঠা করে দেবীকে ভাসাই আমি বিজয়ার
বিফল সন্ধ্যায়!
সন্ধ্যা এসেছে নামি, থাক ওগো হবেনা জ্বালাতে প্রদীপ,
দুটি নয়নের
সহজ প্রভায় আজ নাশিবে তিমির তুমি, অন্ধকার
ঘোর জগতের।
মনোরমা
চোখে তোমার স্বপ্ন-মায়া
মুখে চাঁদের বিমল ছায়া
নিশাহত যেন কোমল ঘাসের
সুরভিতে ভরা, মৃদুল বাতাস।
কালো চুলের গোছা, কে মেখে দিলে
কুয়াশা রাতের সুষমা তাতে?
কখন শেখালে তারে চড়াই পাখিটি
মন কেমন করা নির্জন কথা?
প্রথম বর্ষার হালকা হাওয়া
বাতাসের মতো তোমার হাসি,
আনন্দে তার নাচছে কলং
শালুক মেলছে পাপড়ি
দশটি আঙুল চাঁপা-কলি যেন
পদ্মের মতো দুখানি হাত,
অধীর-স্পন্দ নাভিমূল
নিটোল বুক আর, রক্তিম ঠোঁট
দুসারি দাঁত ডালিমগুটি,
মরুময় মোর জীবনে সই
তুমিই যেন কবিতার খেই।
দেবদাসী
কারে দেবে? কারে? মনের মাধুরী রাশি, শরীরের
শোভা সুকুমার?
দেবতারে? দেবতার মেটে না পিয়াস হায়, অভাগিনী
প্রেমে আমাদের।
দেবতার চাই রক্ত, রাঙা রক্ত শুধু মানুষের
আহত হিয়ার।
তারে দেবে প্রেম? চরণে কাঁদে যার প্রেমাঞ্জলি
রম্ভা মেনকার?
নন্দনের পারিজাতে, মায়াবী হাতে গাঁথা মাদারের
মোহনমালায়
অরুচি যার, তারে দেবে পৃথ্বীর ফুল? সকালে ফুটে
বিকেলে শুকায়
বিলাসী ধনীকে দেবে কেড়ে মুখের গ্রাস ক্ষুধাতুর
দীন-ভিখারীর?
গঙ্গাকে দেবে তুমি পিয়াসার জলবিন্দু তৃষ্ণাতুর
পাড়ের বালির?
মাটির সন্তান মোরা, মাটির বুকেতে ফোটা কন্টকিত
ফুলের সুষমা,
আমাদের জন্য সই, আমাদেরই জন্য কাঁদে যুবতীর
ঠোঁটের লালিমা।
হৃদয় আমাদের তামাসা মাত্র, ভাঙা হিয়া মানুষের
নিজস্ব গৌরব
বিরহের অশ্রুজল মর্তের মন্দাকিনী, প্রেম তার
মন্দার সৌরভ।
সংশয়ের ঝড়ে উত্তাল আমাদের নাও বেদনার
মহাসাগরেতে
সে দুঃখের তুমি নেবেনাকি ভাগ? অলখে চেয়ে
থাকবে দূরেতে?
ভুল, ভুল, হিংসামত্ত ঈর্ষার বেদীতে আমরা
বলিই কেবল;
আদিম যুগের সেই ত্রস্ত মানুষের অন্তরের
ভীত স্পন্দন।
সৃষ্টির দিন থেকে নিয়তির সাথে হে মানুষের
সংগ্রাম অক্ষয়,
মোরা তার স্মৃতি-স্তম্ভ, গাই মানুষের বীর্য আর
নিয়তির জয়।
একটি প্রার্থনা
আত্মদীপ পথ দেখাবে?
হে তথাগত! জোনাকী আত্মায়
আমার বিক্ষিপ্ত প্রহরে হে
কিভাবে দেখাবে পথ?
স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝারে
ক্লান্তি আর মরণের নির্মম আঁধার এই—
কে এড়াবে তারে?
সমগ্র চেতনাব্যাপী মূঢ় জড়তার নাগপাশ;
মুক্তি কোথায় তার থেকে?
ইতিহাস-বিস্মৃত কোন সোনালী ক্ষণে
নবারুণ-উদ্ভাসিত শাণিত অসির মুখে
ডেকে আনা উজ্জ্বল মৃত্যুতে
জীবনকে দিয়েছিল গৌরব;
সে-দিন হে নারী!
হয়তো তোমার প্রেম
মানুষকে দিয়েছিল ঈশারা
মৃত্যুদীপ্ত আত্ম-আলোকের।
আজ এই দেব-দ্বিজ-প্রবঞ্চিত-নচিকেতা মানুষের
বিশ্বাসের প্রদীপে তেল নেই,
নেভানো শলতে।
বিপ্রলব্ধ আজ পুরুষবা।
বৃকাণাং হৃদয়েন্যেতা?
হে ঊর্বশী! নিঠুর বধির হে আজকের ঊর্বশী,
কামিনীর মতো যেনো হৃদয় তোমার?
রক্তাভ সেই ঠোঁটের তলায়
আছে নাকি বিষাক্ত সাপ শুয়ে?
হে বিম্বাধরা! টুকটুকে ঠোঁটদুটি
মেশানো কি লালিমায় তার
প্রেমিকের আহত হিয়ার ভক্ত?
আমি জানি হে বহুবল্লভা
জনভুজ্ঞিত সে দুটি ঠোঁটে
লিপষ্টিক কোন কোম্পানীর।
জ্ঞানমার্গের এই চরম মঞ্জিল,
সভ্যতার এই
দুব্বোভোজী নধর হরিণশিশু কোথা?
চরে সেথা আজ শুধু হিংস্র জন্তুর পাল
প্রাক-পুরানিক দন্তুর, ভয়াল।
নিয়ন-উজ্জ্বল এই তমসায়
আত্মার অক্ষম দীপে কি জ্যোতি দেবে?
হে অমিতাভ! নিরুপায়
নিরুপায় ধর্ম-সঙ্ঘ, নিরুপায়
হে আনন্দও! তুমি আর আমি।
হে রূপসী মারকন্যা, হে মনোরমা।
নিরুপায় তোমার সৌন্দর্য।