আমার ভালবাসার কোন জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না
কেন না আমি অন্য রকম ভালবাসার হীরের গয়না শরীরে নিয়ে জন্মেছিলাম”
রোজকার মত আজ সকালেও (অক্টোবর ২৩, ২০১২) ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে উঁকি দেওয়ার বদ অভ্যাসটা করতে গিয়ে দেখতে পেলাম খবরটা! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর নেই! কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব করলাম বুকের মাঝে! শৈশবের অনেক ভাললাগার সাথে ওই নামটা জড়িয়ে রয়েছে। ছোটবেলায় গোগ্রাসে গিলেছিলাম ওনার কিশোরদের জন্যে লেখা কাহিনিগুলোকে। কাকাবাবুর সাথে সবুজ দ্বীপের রাজা, মিশরের পিরামিড, বিজয়নগরের হীরের সন্ধানে হারিয়ে ছিলাম দুর্ধর্ষ উত্তেজনায়। বারবার পড়েছি বইগুলোকে পড়ার বইয়ের তলায় লুকিয়ে! একদিন ঘরোয়া অনুষ্ঠানে এক কাকিমা একটি কবিতা পাঠ করেছিলেন ‘কেউ কথা রাখেনি’। কি ভীষণ ভাল লেগেছিল কবিতাটা কি বলব! মুখস্থ করে নিজে আবৃত্তি করার চেষ্টা করেছিলাম। তারপর বড় হয়ে পড়েছিলাম নীরাকে নিয়ে লেখা কবিতা। “এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ, এই হাতে কি আমি কোন পাপ করতে পারি?” হা পিত্যেস করে বসে থাকতাম কখন দেশ পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যাটা হাতে পাবো সেই অপেক্ষায় সেই সময় আর প্রথম আলো বেরোবার সময়। শুধু আমি নয় গোটা সাহিত্য জগতটাকে নিজের লেখনীর জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন তিনি।
১৯৩৪ সালে বাংলেদেশের ফরিদপুরে জন্ম এবং দেশভাগের আগেই কলকাতায় আসা। ওই কলকাতা শহরেই প্রতিভার বিকাশ। উনি নিজেই বলেছেন, “আমার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পর বাবা আমাকে টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করতে বলতেন, তখন আমি ভাবলাম আমি নিজেই তো কিছু কবিতা লিখতে পারি।” ওনার প্রথম কবিতা একটি চিঠি বের হয় ১৯৫০ সালে। ১৯৫০ সালেই জন্ম হয় কৃত্তিবাসের। প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ বের হয় ১৯৬৫ সালে দেশ পত্রিকায়। উপন্যাসটি বেশ আলোড়ন তোলে। তার পর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ছয় দশক ধরে কত কবিতা গল্প উপন্যাস আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন তিনি।
ওনাকে প্রথম দেখেছিলাম নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটের একটি বই মেলায়। মুক্তধারার প্রযোজনায় অনুষ্ঠিত এই মেলাটিতে কিছু নাচগান আর বই বিক্রির আয়োজন ছিল। সুনীলবাবু যে আসবেন সেটা জানতামই না আমি। শুধুই বিদেশে বাংলা বই দেখতে পাওয়ার আনন্দে গিয়েছিলাম সেখানে। হঠাৎ দেখি অন্ধকারে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন উনি! একটু যেন অবহেলিত মনে হল। লোকজন মনে হয় নাচগান দেখতেই বেশি ব্যস্ত! তখন আমি বাংলা লেখা শুরু করিনি। এত বড় একজন প্রতিভাকে চাক্ষুষ দেখতে পেয়ে কেমন যেন বিহবল হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু কিছুই করিনি! লজ্জায় দ্বিধায় ওনার সাথে কথা বলতে বা ওনার সইটুকু নেওয়ার সাহস করিনি। সেই অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। এটুকুও বলতে পারিনি যে আপনার লেখা মুগ্ধ করে আমাকে! সরস্বতীর যোগ্য সন্তান আপনি! আমরা বাঙালিরা আপনাকে নিয়ে অসম্ভব গর্বিত! পরে ভেবেছি ছি ছি ওনার একটা বইতে ওনার সই তো অন্তত নিতে পারতাম। আর কিছু না হোক সেটা তো থেকে যেত আমার কাছে।
যাই হোক ওনার সাথে আরেকবার দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। বাল্টিমোরে বঙ্গ সম্মেলন ২০১১তে। ওনাকে সম্মান জানিয়ে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার পর উনি স্টেজে ওনার কিছু দুঃখের কথা বলেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের প্রতি লোকের আকর্ষণ কমে যাচ্ছে, এখনকার প্রজন্ম আর বাংলা বই তেমন পড়ছে না এই ছিল ওনার দুঃখ। সত্যি তো শাড়ি গয়নার স্টলে যে রকম ভীড় সেই রকম ভীড় বই কেনার জন্যে তো দেখা যায়নি! সভাঘর থেকে বেরিয়ে একটা বইয়ের স্টলে দেখতে পেলাম ওনাকে। এবার আর সেই ভুল করব না বলে ছুটে গেলাম ওনার সাথে কথা বলতে। এত দিনে আমি টুকটাক বাংলা লেখা শুরু করেছি আনন্দ থেকে বই বেরিয়েছে দু একটা সেটাই ওনাকে গিয়ে বললাম। খুব ভাল করে কথা বললেন উনি (নাম করতে চাই না কিন্তু কলকাতা থেকে আসা অন্য আরো কয়েকজন সেলিব্রিটির কাছে কিন্তু ভাল ব্যবহার পাইনি)। দুয়েকটা বই লিখতেই আমার কালঘাম ছুটে যাওয়ার দশা আর ওনার চারপাশে ওনার নিজের লেখা অসংখ্য বই! ২০০র উপর বই আছে ওনার! এদিকে বিকেল হয়ে গেছে আর সারা দিন ছবি তুলে তুলে আমার বরের ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ তাই সেল ফোনের দুর্বল ক্যামেরায় আমার সাথে সুনীলবাবুর একটা ছবি তোলা হল! আমি আবার ওই সব ফোন টোন সামলানর ব্যাপারে বড়ই অপটু! তাই ফেরার পথে ছবিটাকে ইমেল করতে গিয়ে ডিলিট করে ফেললাম! তারপর কি ভয়ানক আফসোস! প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা! অনুষ্ঠান সূচি খুঁজে দেখলাম পরদিন সকালে ওনার একটা লেখার ওয়ার্কশপ আছে।
সকাল সকাল সেটাতে ছুটে গেলাম। কিন্তু না, ওখানে উনি একা নন। আরো অনেকে ডায়াসে বসে আছে ওনার সাথে। বেশ কিছু লোক নিজেদের লেখা পড়ল আমি আবার দ্বিধায় কিছুই পড়তে পারলাম না। লোকে ঘিরে রয়েছে ওনাকে ছাড়ছেই না দেখে হতাশ হয়ে বেরিয়ে এলাম। আর কি সু্যোগ পাব? সারাদিন এটা সেটা অনুষ্ঠান দেখে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি এমন সময় দেখি সেই বইয়ের দোকানে আবার সুনীলবাবু! পড়ি কি মরি ছুটে গেলাম। আজকে ক্যামেরায় ব্যাটারি আছে! ওনার মনে ছিল আগের দিনের আলাপের কথা। হেসে আমার সাথে ছবি তুললেন। আমাদের ছবি ও কবিতার বই উপহার দিলাম ওনাকে। সেই ছবি আজ আমার কাছে অমূল্য সম্পদ। যদিও আমার হাজব্যান্ড ওনাকে ইমেল করে ছবি পাঠিয়ে তার কোন উত্তর পায়নি কিন্তু সে ঠিক আছে। ঊনি ব্যস্ত মানুষ ইমেলের উত্তর ওনার কাছে আশা করাও যায় না।
সেই শেষ দেখা সাহিত্য অ্যাকাডেমির প্রেসিডেন্টের সাথে। উনি বলেছিলেন “ভারতের সাহিত্য সব এক শুধু লেখা হয় বিভিন্ন ভাষায়। যারা নাগা বা মণিপুরি ভাষায় লেখেন তারা যেন নিজেদেরকে একলা না মনে করেন! আমরা তাদের মূলস্রোতে আনার চেষ্টা করছি” এবং বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যকে অনুবাদের মাধ্যমে অন্য ভাষাভাষীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রচুর প্রয়াস করেওছিলেন উনি।
নবমীর দিনে মারা গেলেন সুনীলবাবু বলে কলকাতার সব কাগজ সেদিন বন্ধ! ইংরাজিতে পড়তে হচ্ছে ওনার মৃত্যুর খবর! ওনার ফেসবুকের অগুন্তি বন্ধু এবং ফ্যানরা অবশ্য তাদের প্রোফাইল কালো করেছে ওনার প্রয়াণের শোকে। একজন লিখেছে ‘একসাথে অনেক আত্মীয়র বিদায় ঘটল, যেন একই পরিবারের অনেক লোক একসাথে চলে গেলেন। কাকাবাবু, সন্তু, জোজো, নীলমানুষ, গুটুলি, নীরা, অসীম, সঞ্জয়, হরি, নরেন্দ্র ভার্মা... এবং আরো অনেকে...’
সাহিত্যিক ইন্দ্রনীল স্যান্যালের লেখাটা ভাল লাগল “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ঃ Never born, never died. Just visited our planet from 1934 to 2012”
“তিনটে চারটে ছদ্মনামে
আমার জন্ম মর্তধামে”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেলেন কিন্তু ওনার অমর সৃষ্টি চিরকাল থেকে যাবে আমাদের মধ্যে। ওনার মতন সাহিত্যিকদের মৃত্যু হয় না, তারা অমর।