তখন আমি ক্লাস সিক্সের ছাত্রী। বই পড়ার নেশাটা কেবল জমে উঠেছে। ফেলুদা পেলে গোগ্রাসে পড়ি। কাকাবাবু ও শঙ্কুর সাথে সবে পরিচয় হয়েছে। কিন্তু ফেলুদা বা নতুন কাকাবাবুকে বছরে একবার মাত্র পাই, পূজোসংখ্যায়। সারাবছর নতুন বই এর জন্য হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। তাছাড়া আশির দশকে মরুর ঐ দেশটাতে তেমন বেশি বাংলা বই পাওয়াও যেত না। বলা হয়নি, বাবার কর্মসূত্রে আমার শৈশবটা মধ্যপ্রাচ্যে কেটেছে। আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম কে কবে দেশ থেকে আসবে। হয়তো স্যুটকেসে দুই/একটা বাংলা বই সাথে নিয়ে আসবে। আমাদের স্কুল লাইব্রেরিতে দস্যু মোহন বা যখের ধন জাতীয় পুরোনো কিছু বই ছিল। কিন্তু তাতে ঠিক মন ভরতো না। এমন সময়ে বার্ষিক পরীক্ষার পরে লাইব্রেরিয়ান আমাকে ৩টা নতুন বই দিলেন। তিনটির লেখক হুমায়ূন আহমেদ। কে এই হুমায়ূন আহমেদ? এর লেখা তো কখনো পড়িনি। নতুন লেখক নাকি? বইগুলোর নামও অভিনব, 'আমার আছে জল', 'শঙ্খনীল কারাগার', এবং 'নন্দিত নরকে'। আমি কিছুটা দোনামোনা করে ঠিক করলাম - 'আমার আছে জল' দিয়েই শুরু করব।
'আমার আছে জল'-এর নায়িকা তেরো বছরের একটি মেয়ে, দিলু। বাবা-মা, বড়বোন ও কিছু আত্মীয় বন্ধুর সাথে সিলেটে বেড়াতে যাচ্ছে। আহ্লাদী ও প্রগলভ দিলুর মধ্যে আমি যেন আমার নিজেকে দেখতে পেলাম। দিলু একদম আমারই বয়সী। সেও বাবার কাছে প্রশ্রয় পায়, মা সে তুলনায় কড়া। দিলু সারাক্ষণ কথা বলতে থাকে এবং হঠাৎ প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়। আমি মোটামুটি যখন দিলুকে ভালোবেসে ফেলেছি তখন দিলু পানিতে ডুবে মারা যায়। আমার মনে আছে সে রাতে আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলাম। আজও যখন 'আমার আছে জল' পড়ি, আমার চোখের কোনা ভিজে উঠে।
তারপরে 'শঙ্খনীল কারাগার', 'নন্দিত নরকে', 'নির্বাসন', 'বাসর', 'সবাই গেছে বনে' ...... একের পর এক হুমায়ূন আহমেদ পড়েছি। সাহিত্য-বোদ্ধারা অনেকে হয়তো লেখক হুমায়ূন আহমেদ বা তাঁর সাহিত্য কীর্তির সমালোচনা করবেন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করবেন। আমি একজন সাধারণ পাঠক। আমি শুধু আমার ভালো লাগা বা মন্দ লাগার কথাগুলই বলবো।
হুমায়ূন আহমেদকে লেখক হিসেবে চিনে উঠছি তখন ঢাকা থেকে VHS-এ এলো 'এই সব দিন রাত্রি'। আশির দশক, তখনও স্যাটেলাইট টিভি বা কেবল্ আসেনি। আমরা মধ্যপ্রাচ্যে বসে বাংলাদেশের কোনো অনুষ্ঠান দেখতে পেতাম না। মাঝে মাঝে দেশ থেকে ভিডিও ক্যাসেটের মাধ্যমে পেতাম বাংলাদেশ টিভির কিছু নাটক বা ঈদ অনুষ্ঠান। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে সেই নাটক নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। 'এইসব দিন রাত্রি' বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)-এ ১৯৮৬-তে প্রচার হয়েছিল। আমরা হাতে পেলাম ১৯৮৭-এর মধ্যভাগে। আমরা শুনতাম প্রতি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকার রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত কেননা ঐ দিন ধারাবাহিক নাটক 'এইসব দিন রাত্রি' প্রচারিত হয়। নাটকের গল্পটা খুব সহজ। ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত এক পরিবারে দৈনন্দিন টানাপোড়েন, সুখ-দুঃখ ও হাসি-কান্নার গল্প। কিন্তু গল্পটা বলা হয়েছে এমন ঢঙে যে দর্শক চুম্বকের টানের মতো আকর্ষিত হয়। টানা দুদিন দুরাত ভিসিআর-এ সবকটি পর্ব দেখে শেষ করলাম, নীলু ভাবী, টুনি, চিলেকোঠার বেকার যুবক আনিস, তরুণী শাহানা, বাড়ির রাগী মা — সবাই যেন আমাদের আশে পাশের মানুষ। নাটকের প্রতিটি পর্ব, প্রতিটি ঘটনা মন ছুঁয়ে যায়।
ততদিনে আমি সবাইকে জিজ্ঞেস করছি নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ-ই কি 'শঙ্খনীল কারাগার', 'নন্দিত নরকে' বা 'আমার আছে জল'-এর হুমায়ূন আহমেদ? আমাদের বাড়িতে ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক বিচিত্রা (অধুনালুপ্ত) আসতো। সেখানে একবার হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কভার স্টোরি হল। হুমায়ূন আহমেদকে বিচিত্রার প্রতিবেদক ১০০০টি প্রশ্ন করেছেন, '১০০০ প্রশ্নে হুমায়ূন আহমেদ'। সে সাক্ষাৎকার পড়ে ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ, তাঁর লেখালেখি ও পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর ময়মনসিংহের নেত্রকোনায় নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ফয়জার রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশের ইন্সপেক্টর, সিলেট শহরে সে-সময়ে কর্মরত। মা আয়েশা ফয়েজ তাঁর প্রথম সন্তান হুমায়ূনের জন্মের সময় টাইফয়েডে আক্রান্ত হন। সে যুগে টাইফয়েড ছিল মারাত্মক ব্যাধি, কোনো ঔষধ ছিল না, আয়েশার বাঁচার আশা সবাই ছেড়ে দিয়েছে। তরুণ বাবা ফয়জার রহমান স্ত্রীর মৃত্যুকে অবশ্যম্ভাবী ধরে নিয়ে ছেলের নাম রাখলেন 'কাজল'। 'অপুর সংসার'-এর কাজল, যেখানে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে তরুণী মা মারা যায়। শেষ পর্যন্ত আয়েশা সুস্থ হন এবং পরবর্তীতে আরো পাঁচটি সন্তান--দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জননী হন।
হুমায়ূন আহমেদের লেখায় প্রায়ই তাঁর শৈশব ও পরিবারের কথা উঠে এসেছে। তিনি বেশ কিছু আত্মজৈবনিক বই লিখেছেন। 'আমার ছেলেবেলা', 'আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই', 'কিছু শৈশব'—এই বইগুলোতে তাঁর ছোটবেলা যেন আঁকা। তাঁর লেখা এতই স্বচ্ছন্দ ও মনোগ্রাহী যে একবার কোনো বই ধরলে শেষ করার আগে উঠা যায়না। তাঁর এই বইগুলো আমার নিজস্ব সংগ্রহে আছে এবং বহুবার পড়া।
ফিরে যাই হুমায়ূন আহমেদের শৈশবে। তিনি তাঁর শৈশব বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় কাটিয়েছেন। তাঁর বাবা পুলিশের চাকুরীর সুবাদে প্রায়ই কর্মস্থল বদলাতেন। সেই সাথে তার পরিবারও স্থানান্তরিত হত। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় তাই ফুটে উঠেছে সিলেটের মীরাবাজার, বান্দরবান, জগদ্দল, বগুড়া, পিরোজপুর ও আরও অনেক জায়গা। হুমায়ূন আহমেদ ছোটবেলায় অতি দুরন্ত ছিলেন। লেখাপড়ার একদম মন ছিলনা। সেই তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান পান। এরপরে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চোখ ধাঁধাঁনো রেজাল্ট করে আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়নে পি. এইচ. ডি লাভ করেন (আমার নিজের কেমিষ্ট্রি ডিগ্রিটাও কিছুটা হলে এর দ্বারা প্রভাবিত)। লেখালিখির শুরু অবশ্য ছাত্রাবস্থায়ই। প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ১৯৭০ সালে। তারপরে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তাঁর বাবা ফয়জার রহমান আহমেদ তখন পিরোজপুর-এর এস ডি পি ও। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার 'অপরাধে' পাকিস্তান আর্মি তাঁকে গুলি করে হত্যা করে ধলেশ্বর নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়। এরপরের নয়মাস এই শহীদ পরিবারটি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সারা দেশে ছুটে বেড়ায়। বাবাকে হারানোর বেদনা লেখকের লেখায় বার বার উঠে এসেছে।
১৯৭০ থেকে ২০১২, এই চার দশকে হুমায়ূন আহমেদের লেখার এক বিরাট পাঠক শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে। আমার আগের এবং পরের প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে তাঁর লেখার সাথে। প্রতি বইমেলায় তাঁর ৪/৫ টি বই বের হতো। দুই/তিন দিনে লক্ষ কপি বই বিক্রি হয়ে যেত। লোকে লাইন ধরে হুমায়ূন আহমেদের বই কিনছে এই দৃশ্য একুশের বইমেলার খুবই সাধারণ একটি দৃশ্য। লোকে প্রিয় গায়ক, নায়ককে দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ নেবার জন্য বইমেলায় যে ভিড় হয়, তা সামাল দিতে পুলিশ বাহিনী রাস্তায় নামে। লেখালেখির সাথে সাথে তিনি নাটক, গান রচনা করেছেন; বেশ কিছু সিনেমা বানিয়েছেন। আগেই বলেছি 'এই সব দিন রাত্রি' বিটিভির নাটকের ধারা একদম বদলে দেয়, তাঁর আর একটি নাটক 'কোথাও কেউ নেই' তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এই নাটকের প্রধান চরিত্র বাকের ভাই-এর শেষ পর্বে ফাঁসি হয়। এই পর্বটি যেদিন বিটিভিতে প্রচার হয় তার আগে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী শহরে তরুণের মিছিলে নামে। স্লোগান ওড়ে —
"বাকের ভাই-এর হইলে ফাঁসি--জ্বালানো হয় হুমায়ূন আহমেদের কুশপুত্তলিকা। লেখক তাঁর পরিবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু বাকের ভাই-এর মৃত্যুর ঘটনাটিও লোকে গ্রহণ করে, গ্রহণ করে সাহিত্যের করুণ রস।
লাশ পড়বে রাশি রাশি।"
আমি কলেজে-পড়া অবস্থায় হুমায়ূন আহমেদকে একটি চিঠি লিখেছিলাম, ফ্যান লেটার যাকে বলে। অবশ্যই কোনো উত্তর পাইনি। বস্তাভর্তি চিঠির মধ্য থেকে (তাঁর এক ইন্টারভিউ থেকে জেনেছি তিনি রোজ বস্তাভর্তি চিঠি পেতেন) আমার চিঠিটা নিশ্চয়ই খুব একটা আলাদা ছিলনা। তবুও প্রিয় লেখককে চিঠি লিখছি এই আনন্দেই লিখেছিলাম।
হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার সরাসরি দেখা হয় ২০০৯-এর বঙ্গসম্মেলনে। সেবার বঙ্গসম্মেলন ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান হোজে শহরে অনুষ্ঠিত হয়। সুনীল, সমরেশ ও গৌতম ঘোষের সাথে ঢাকা থেকে হুমায়ূন আহমেদও এসেছেন। আমার কাছে মিডিয়া পাস ছিল। আমি বঙ্গসম্মেলনের তিন দিন মোটামুটি লেখক ফোরামে কাটিয়ে দিলাম। প্রিয় লেখকদের চোখে দেখা, তাঁদের কথা শোনা, অটোগ্রাফ নেয়া আমাকে অন্য ভুবনে নিয়ে গিয়েছিল। আমার অবস্থা দেখে স্বামী ভদ্রলোক বলেছিলেন, "তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি মাইকেল জ্যাকসনের দেখা পেয়েছো!" আমি ওকে কিভাবে বোঝাই এঁরাই যে লেখালেখির জগতের মাইকেল জ্যাকসন!
লেখক ফোরামে বসে বুঝতে পারলাম হুমায়ূন আহমেদ শুধু ভালো লেখেনই না, দারুণ গল্প বলতে পারেন। তিনি আড্ডার ছলে অনেক কিছু বলেছিলেন। সে কথাগুলো আমি সহ শ'তিনেক মানুষ হাঁ করে শুনেছিল। একটি রসিকতা প্রায়ই মনে পড়ে। তখন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসেছে। এসেই তোড়জোড় করছে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম কিভাবে বদলানো যায়। জিয়া হলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, যিনি আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ দল বি এন পি র প্রতিষ্ঠাতা। এর আগে আওয়ামী লীগ আরও কিছু নাম বদলেছে। যমুনা সেতু হয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু, মীরপুর জাতীয় স্টেডিয়াম হয়েছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী কেন্দ্র হয়েছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় অডিটোরিয়াম, পিজি হাসপাতাল হয়েছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় হাসপাতাল ইত্যাদি। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, "আমাদের দেশে এখন চালু হয়েছে সাইনবোর্ড রাজনীতি। এদল ক্ষমতায় এলে এদের নাম, অন্যদল এলে তাদের নাম। কিচ্ছু চিন্তা করবেন না বি এন পি ক্ষমতায় এলে এয়ারপোর্টের নাম আবার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে যাবে।"
ফোরাম শেষে আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার ও হুমায়ূন আহমেদের কাছে বই নিয়ে গেলাম। অটোগ্রাফের জন্য। হুমায়ূন আহমেদ বইতে সই দিতে দিতে বললেন, "সারাজীবন এত অটোগ্রাফ দিলাম, এক টাকা করে নিলেও তো আমার টাকার পাহাড় হয়ে যেতো।" আমার হাতে তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই 'মধ্যাহ্ন', মধ্যাহ্নের পাতা উল্টে যে পৃষ্ঠায় বই এর নাম ও লেখকের নাম আছে সে পৃষ্ঠা খুলে নিজের ছাপা অক্ষরে লেখা নামটা কেটে দিলেন। আমি আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনার নামটা কেটে দিলেন কেন?" তিনি কাটা নামের তলায় সই দিতে দিতে বললেন, "একজন বলেছে নিজের লেখা বই-এ এভাবে সই দিতে হয়।" পাশে দাঁড়ানো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও তাঁর কথায় সায় দিলেন। আমি তবুও প্রশ্ন করে চলেছি, "কেন?" তিনি উত্তর দিলেন, "কি জানি কেন, আমিও ঐভাবেই দিচ্ছি আর কি।"
হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটি বই-এর সাথে জড়িয়ে আছে কত স্মৃতি। সে সব লিখতে গেলে বিরাট কাহিনী হয়ে যাবে তবুও দুই একটা না লিখে পারছি না। ১৯৮৯-এর শুরুর দিকে আমাদের স্কুলের একটি মেয়ে স্কুলে এসে ঘোষণা করল সে সদ্য বাংলাদেশ থেকে ঘুরে এসেছে এবং সঙ্গে করে দশটি নতুন হুমায়ূন আহমেদের বই নিয়ে এসেছে। তখন তার কদর আর দেখে কে? ছাত্রীমহলে সে সবচেয়ে জনপ্রিয়। সবাই তার কাছে যেয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে অনুরোধ করে অন্তত একটি বই পড়তে দেবার জন্য। অনুরোধ অগ্রাহ্য না করতে পেরে ভালোমানুষ সেই মেয়েটি সবাইকে বই ধার দেয়। মাস দুয়েক পরে জানা গেল বেচারার সব কটি বই লাপাত্তা। কে প্রথমে নিয়েছে, তার হাত বদলে কার কাছে গেছে কিছুতেই আর খুঁজে পাওয়া গেল না। আমিও তাকে বলতে পারিনি হুমায়ূন আহমেদের 'বৃহন্নলা' তখনও আমার বুকসেলফ্দ-এ। আমি প্রাণে ধরে এই বইটা ওকে ফেরত দিতে পারলাম না। 'বৃহন্নলা'তেই আমার মিসির আলীর সাথে প্রথম পরিচয়। মিসির আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারাসাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি মানুষের মনের গহিনে ঢুকে বহু রহস্যের সমাধান করেন। 'বৃহন্নলা' পড়ে আমি মুগ্ধ। মিসির আলীর মতো সত্যসন্ধানী হব এরকম ভাবছি। সেই সঙ্গে নিজেকে বার বার বলছি, "বই কখনো চুরি হয়না, কেবল স্থানান্তরিত হয়"। দুঃখের ব্যাপার আমার বুকসেলফ্ থেকেও 'বৃহন্নলা' একসময় কেমন করে জানি স্থানান্তরিত হয়ে গেল, টেরই পেলাম না।
আরেকটি ঘটনা ১৯৯৫-এর। আমি তখন মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হয়েছি। গ্রীষ্মের ছুটিতে ইউনির্ভাসিটি বন্ধ, আমি ঢাকায় বেড়াতে গেছি। ঢাকার আগারগাঁও-এ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর নতুন উদ্বোধন হয়েছে। আমি ও আমার বন্ধুরা মিলে জাদুঘর দেখতে গেলাম, বিরাট ভবন, অনেকগুলো প্রদর্শনী। একটা বিভাগে ঘুরতে ঘুরতে কোনো একটি বিষয় ভালোভাবে বুঝতে না পেরে উপস্থিত গাইড-এর কাছে গেলাম। তিনি তাঁর চেয়ারে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে একটি বই পড়ছেন। আমাদের প্রশ্ন শুনে খুব বিরক্ত হলেন এবং বললেন, "যান যান, ঐ বোর্ডে সব লেখা আছে, পড়ে নেন।" তারপরে আবার বই-এ মাথা নামালেন। আমি খুব কৌতূহলী হয়ে দেখলাম, তাঁর হাতে ধরা বইটি হুমায়ূন আহমেদের 'আশাবরী'। আমি রেগেমেগে 'মন্তব্য খাতায়' একগাদা অভিযোগ লিখে এলাম। সরকারী কর্মচারীর একি ব্যবহার! কাজের সময় গল্পের বই পড়ে, ভিজিটারদের কোনরকম সহযোগিতা করেনা ... ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপরেই বই-এর দোকানে গিয়ে 'আশাবরী' কিনলাম। আরে, এই বইটা তো আগে পড়িনি!
হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশে এক বিশাল পাঠকশ্রেণী তৈরি করে গেছেন। এ শ্রেণীতে সব ধরনের মানুষ আছেন। ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গৃহবধূ, বৃদ্ধ, রিটায়ার্ড প্রৌঢ় সবাই। হিমু, পরি, মিসির আলী, রূপা, কুসুম এরা সবাই আমাদের আশেপাশের মানুষ। তিনি আমাদের নতুন করে শ্রাবণ মেঘের দিনের গান, বৃষ্টির ধারা, চান্নি পসর রাত, জোছনাকে ভালোবাসা শিখিয়েছেন। আমার মার কাছে শুনেছি এক রিকশাওয়ালা তাঁকে খবর দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। আমার মা অবাক হয়ে বলেছেন, "তুই হুমায়ূন আহমেদকে চিনিস?" রিকশাওয়ালা বলেছিল, "চিনুম না? তার কত নাটক টিভিতে দেখছি। বড় ভালো মানুষ ছিলেন। আমার মা চোখের পানি মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরেছেন। কে এই হুমায়ূন আহমেদ?
ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদকে না চিনলেও লেখক হুমায়ূন আহমেদ, নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ, চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদকে বাংলাদেশের সবাই চেনে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি। দেশের মানুষ শহীদ মিনারে খালি পায়ে হেঁটে গিয়ে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে, সে দিন ছিল এক শ্রাবণ মেঘের দিন।
আমি যদি লেখক হতাম তাহলে হয়তো আরো গুছিয়ে লিখতে পারতাম। হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে তাঁকে প্রতি প্রার্থনাতে স্মরণ করতাম, তাঁর আরোগ্য কামনা করতাম। ১৯শে জুলাই যখন মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি তখন আমি অফিসে। মনটা বিকল হয়ে গেল। কিউবিকলে বসে চোখের পানি ফেলাটা খুবই বিসদৃশ। তাই বিল্ডিং এর বাইরে চলে গিয়েছিলাম। আমার মতো এক অজানা পাঠক চোখের জলে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছিল।