হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। জনপ্রিয়তার সাথে সাহিত্যমানের কোন রেষারেষি আছে বলে আমার মনে হয় না। তাঁর প্রথম দিকের লেখাগুলিতে মধ্যবিত্তের জীবন যাপন অনেক খানি স্থান করে নিয়েছে। তাই বলে তিনি শুধু মধ্যবিত্তের লেখক নন।
অনেক সামাজিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেখি তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ থেকেই। রাবেয়ার মৃত্যুদৃশ্য মনে পড়ছে। পারিবারিক সম্মান বাঁচানোর জন্য ঘরেই গর্ভপাত করানো হয় তার। ঘরময় নষ্ট রক্তের গন্ধে দম আটকে আসছে, তার মধ্যে নিস্তেজ রাবেয়া বলে উঠছে ‘আমার বুকটা খালি খালি লাগছে কেন?’ কিছুক্ষণ পর শীতকালের ঝকঝকে আলোময় একটা দিনে তাদের পলাতক কুকুর পলার কথা বলতে বলতে চুপচাপ মারা গেল রাবেয়া। ঠিক তখনই খোকার মনে পড়েছিল তার বড় খালার সন্তান সম্ভবা মেয়ের কথা। তিনি প্রসন্ন গর্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে অনাগত সন্তানের নাম ঠিক করছিলেন। শুধুমাত্র একটা সামাজিক সনদের কারণে একই পরিস্থিতি কখনো গর্বের কখনো অপমানের। পাশাপাশি এই দুটি বর্ণনার মাধ্যমে কি লেখক একটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্নও রাখেননি পাঠকের কাছে?
খোকা আর তার বাবা মায়ের ঘরের মাঝখানে একটা বাঁশের বেড়ার ব্যবধান। খোকা ইনসমনিয়াক। গভীর রাতে তার ঘরে ভেসে আসে বাবা-মায়ের আদরের শব্দ। সেই শব্দে একই সাথে খোকার অস্বস্তি, উত্তেজনা ও পাপ বোধের কথা বলা হয়েছে খুব স্বাভাবিক ও নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত একটা বইয়ে, এই রকম বর্ণনা নিঃসন্দেহে সাহসী।
হুমায়ূন আহমেদের যে উপন্যাসটা প্রথমে পড়েছিলাম, তার নাম ‘শংখনীল কারাগার’। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। এর আগে ‘এইসব দিনরাত্রি’ র মাধ্যমে তিনি পরিচিত নাম হয়ে উঠছিলেন আমার কাছে। প্রথম বাক্যটাই নিয়ে গেল আরেক দুনিয়ায় – “বাস থেকে নেমেই হকচকিয়ে গেলাম। বৃষ্টিতে ভেসে গেছে সব। রাস্তায় পানির ধারাস্রোত। লোকজন চলাচল করছে না, লাইটপোস্টের বাতি নিভে আছে।”
ছোটছোট বাক্যগুলি বয়ে আনলো বৃষ্টি মেশানো মফস্বলের রাত। নটার মধ্যেই চায়ের দোকান বন্ধ।বৃষ্টির কারণেই পারিপার্শ্বিক রহস্যে ঘেরা। দশ বছরের মন্টু অপেক্ষা করছে বড় ভাইয়ের জন্য। এতক্ষণে মায়ের ভয়ে বাড়ি যেতে পারছিল না, তাকে নাকি বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার সময় মা বলেছেন ভিক্ষা করে খেতে। মন্টু আর খোকার জগতে ঢুকে গেলাম আমিও। ওদের সাথেই প্রায় জনমানবশূণ্য অন্ধকার রাস্তায় হেঁটে ঘরে ফিরলাম। সেই প্রথমবারের পড়ায় বইটা তেমন করে না বুঝলেও খোকা, রাবেয়া, মন্টু, রুনু, ঝুনু, নিনুর পৃথিবীটা খুব নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল আমাকে। কি রহস্যময়ী আর দুঃখী মনে হয়েছিল ওদের মাকে! ছাপোষা বোকাসোকা বাবার জন্য মন খারাপ হয়েছিল, সেই সাথে আবিদ হোসেনের একাকীত্বও কিছুটা অনুভব করেছিলাম হয়তো।
এখানেও মধ্যবিত্ত পরিবারের বয়ান হলেও খোকার মা শিরিনের চরিত্র নিয়ে এসেছিল অন্য আঙ্গিক। এই পরিবারে তিনি ছিলেন বেমানান। তার বিত্তশালী অতীতের ছিঁটেফোঁটা খোকা ও তার ভাইবোন টের পেত মামা ও খালাকে দেখে – যাঁদের মনে হতো অন্য জগতের মানুষ। শিরিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন আবিদ হোসেনকে। কয়েক বছর পরে সে বিয়ে ভেঙে গেছে, ততদিনে জন্ম হয়েছে রাবেয়ার। খোকার বাবা তাঁর দ্বিতীয় স্বামী, এক সময় আশ্রিত ছিলেন শিরিনদের বাড়িতে। এতগুলি সন্তানের পরেও কখনো সহজ হতে পারেন নি স্ত্রীর কাছে, তাঁদের মধ্যে থেকে গেছে শ্রেণীবৈষম্য।
মেলবোর্নে এক বিকালের ট্রেনে বাসায় ফিরতে ফিরতে পড়ছিলাম ‘নির্বাসন’। মফস্বল শহরের একান্নবর্তী পরিবারের একটা মেয়ে ‘জরী’, তার বিয়ের দিনের গল্প। মায়া আর বিষন্নতা কুয়াশার মতন জড়িয়ে আছে গল্পটাকে – সেই ভোরবেলায় বড়চাচার বাজানো বিসমিল্লাহ খাঁ’র মিঞা কি টৌরীর মতনই যেন। একটা দিনের স্বল্প পরিসরে কি নিখুঁত ধরা দেন শান্ত, সম্ভ্রান্ত, কোমল প্রাণ বড় চাচা, জরীকে ঘিরে প্রজাপতির মতন বান্ধবীরা, জরীর মা, ব্যতিব্যস্ত বাবা, একটু বোকাসোকা কিন্তু ভীষণ সুন্দরী বড় বোন পরী, বুদ্ধিমান এবং হৃদয়বান দুলাভাই হোসেন সাহেব, মুক্তিযুদ্ধে মেরুদন্ডে গুলি লেগে পঙ্গু হয়ে যাওয়া আনিস – এক সময় যার সাথে জরীর বিয়ের কথা ছিল আর এই আসরে বেমানান, অনাহুত আনিসের মা।
একেকটা সম্পর্কের হয়ে ওঠা, ফুরিয়ে যাওয়া অথবা তার নামহীন রেশটুকু করুণ সুন্দরভাবে এসেছে এখানে। আনিসের বাবার মৃত্যুর পর আনিসের মা আবার বিয়ে করেছেন। তাঁর ছেলে আনিস বড় হয়েছে চাচাদের সংসারে। অনেকদিন পর তিনি এসেছেন ছেলেকে দেখতে। ছেলে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবে এই কারণেই খবর দেয়া হয়েছিল তাঁকে। কাকতালীয় ভাবে তিনি এসে পৌঁছালেন জরীর বিয়ের দিন, যখন সারা বাড়ী জুড়ে হৈ চৈ। তিনি একসময় এই বাড়ির দৈনন্দিনতার অংশ ছিলেন, আজ তাঁকে দেখেই সবার অস্বস্তি। বাড়িটার সবকিছু তাঁর পরিচিত, তিনি একা একা ঘুরে ঘুরে দেখছেন কোথায় কি কতটুকু বদলাল, অনভ্যাসে তলিয়ে যাওয়া ‘আতর-বৌ’ নামটা উঠে এল স্মৃতিতে। সামাজিক সম্পর্কের সুতা কি অবলীলায় ছিড়ে যায়, সব কি শেষ হয় তারপরেও?
হুমায়ূন আহমেদের গল্পে ফিরে ফিরে এসেছে প্রকৃতির পুণরাবৃত্তি। যেমন নির্বাসনে আছে পরীর মেয়ে পান্না পানিতে ডুবে যাচ্ছিল, তাঁকে তুলে আনার পরও জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদছে পরী। তখন বড়চাচার মনে পড়লো পরীও একবার ডুবে যাচ্ছিল । ‘কৃষ্ণপক্ষ’ শুরু হয়েছে অরু আর মুহিবের বিয়ের দিনে। মুহিব একটা কটকটে হলুদ রঙের সিল্কের পাঞ্জাবী পড়ে এসেছিল। অরু চেয়েছিল সেই রাতেই পাঞ্জাবীটা পুড়িয়ে ফেলতে। আর শেষ হয়েছে অরুর মেয়ের বিয়েতে জামাইয়ের হলুদ পাঞ্জাবী পোরানোর ঘটনায়। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এ এক বৃষ্টির রাতে একদিন শিরিন যে হাসির গল্প বলেছিলেন সবাইকে, তাঁর মৃত্যুর পর ঠিক সেরকম আরেক বৃষ্টির রাতে একই গল্প একই রকম ভঙ্গিতে শোনায় রুনু। শুরুতে যা থাকে আনন্দের, তা তীব্র বেদনা নিয়ে ফিরে ফিরে আসে। যেন একই মঞ্চে একই নাটক অভিনীত হচ্ছে বারবার, পাত্র-পাত্রী বদলাচ্ছে শুধু।
মিসির আলী আর হিমুর কথা উঠলেই শুনি লজিক আর অ্যান্টি-লজিক। এরকম অবশ্য হুমায়ূন আহমেদ নিজেও লিখেছিলেন তাঁর কিছু বইয়ের ফ্ল্যাপে। আমি এদের মধ্যে মিল খুঁজে পাই বেশি। এরা দু-জনই একা আবার দু-জনেই খুব নৈর্ব্যক্তিক, নিরাসক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বারেবারেই মায়ায় জড়িয়ে পড়েন। যুক্তি এবং যুক্তিহীনতার পথে ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত যে বিন্দুতে এসে মেলেন তা ব্যাখ্যাতীত এবং রহস্যময়।
শেষের দিকে হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য বইগুলির মতই মিসির আলী হারিয়ে ফেলছিলেন তাঁর বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা আর হিমু হারাচ্ছিল চমকে দেবার ক্ষমতা। দুই শব্দের মাঝের শূন্যস্থানের সাথে সাথে কমে আসছিল পাঠকের বিচরণভূমি।এ বিষয়ে নিজেও বুঝতেন। সাজ্জাদ শরীফ আর ব্রাত্য রাইসুর নেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন – “আমি যদি ঠিকঠাক মতো একটি হিমু লিখতে পারতাম, তাহলে চারটা-ছয়টা হিমু লিখতে হতো না। নিজের লেখা সম্পর্কে আরেকটা ব্যাপার আমাকে কষ্ট দেয়। সেটি হলো, একটা লেখা লেখার জন্য যে পরিমাণ প্রস্তুতি আমার থাকা দরকার, যে পরিমাণ পড়াশোনা নিয়ে আমার একটা লেখা লিখতে যাওয়া উচিত, ঐ জায়গাটা আমি অবহেলা করি। আমি মনে করি এটার দরকার নেই। হঠাৎ করে মনে হলো আর লেখা শুরু করলাম। কোনো রকম চিন্তাভাবনা নেই, কোনোরকম পরিকল্পনা নেই, কিচ্ছু নেই। ব্যস, লিখতে বসে গেলাম। যদি একটু পরিকল্পনা থাকতো, তাহলে অনেক ভালো হতো।”
একজন লেখক হয়তো সারাজীবনে একটাই গল্প বলেন। আমরা ঘটনাগুলি ভুলে যাই, অনুভুতিটুকু থেকে যায়। হুমায়ূন আহমেদের গল্পের মানুষেরা ছড়িয়ে আছে আশেপাশে। লাস্ট ট্রেন ছেড়ে গেলে চাঁদের আলোয় স্যান্ডেলের শব্দ তুলে হাঁটতে হাঁটতে যে ছেলেটা হঠাৎ আমার বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে পড়ে মুখ তুলে হেসেছিল, তাকে হিমুর মতন দেখতে। আমার আধপাগলা আধবুড়ো লেকচারার কেন গর্ডন ছিলেন অবিকল সুখী নীলগঞ্জ মামা। আমার বন্ধু সুনিতাকে মুনার মতন মনে হয় আর চলন্ত ট্রেনের জানালায় চশমা পড়া উদাস ছেলেটা ঠিক শুভ্রর মতন।
খুব নিরব একলা কোন দুপুরে কৈশোরের স্মৃতি হয়ে ফিরে আসবেন হুমায়ূন আহমেদ – যেদিন একলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোকা, রাবেয়া, মন্টু, রুনুদের জন্য খুব মন খারাপ লাগছিল, আর সেই দুইটা লাইন ঘুরপাক খাচ্ছিল আমাকে ঘিরে –
‘দিতে পারো একশো ফানুস এনে
আজন্ম সলজ্জ সাধ – একদিন আকাশে কিছু ফানুস ওড়াই...’