১.
আমি কখনো ফরিদপুর যাই নি। একবার চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে বাসে ঢাকা আসার পথে ফরিদপুর স্পর্শ করেছিলাম মাত্র। অথচ এই ফরিদপুরেই আমার এক বোন দীর্ঘদিন বসবাস করেছিলেন। কিন্তু কেন যেন সেখানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সেখানে অন্তত চারজন মানুষ আছেন, যারা দীর্ঘ ২০-২৫ বছর ধরে আমার পরিচিত। দেখা-সাক্ষাৎ কম হলেও তারা আমার আত্মার স্বজন।
মফিদ ইমাম মিলন ভাইকে পেয়েছিলাম মধ্য আশির দশকে ঢাকায়। ফরিদপুরের এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমাদের কাব্যবিকাশের কালে সহযোগী ছিলেন। ঢাকায় কবিকণ্ঠ কেন্দ্রীয় সাহিত্য আড্ডা ও তৎপরতার তিনি ছিলেন অন্যতম প্রাণ-পুরুষ। আমার প্রথম কবিতার বই 'আমার সামনে নেই মহুয়ার বন' প্রকাশের নেপথ্যেও জড়িয়ে আছেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার পেশায় আমি চট্টগ্রামে আর তিনি ফরিদপুরে চলে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমাদের যোগাযোগের ছেদ ঘটে। তারপরও ঢাকার কোনো কোনো সেমিনার-আলোচনায় তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কখনো তিনি আমার কোনো লেখা পড়ে বা টক শো দেখে ফোন করেছেন। কবি জসীমউদ্দীনের উপর কোনো স্মারক করার সময় তিনি আমার লেখা নিতে ভোলেন নি। একই উত্তাপ ও আন্তরিকতায় আমার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিনি।
নাসির আলী মামুনের ফরিদপুরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও তিনি বাংলা আলোকচিত্র শিল্পের আন্তর্জাতিক আইকন-ক্যামেরার কবি। আমেরিকা যাওয়ার আগেই তার সঙ্গে পরিচয়। বিদেশ থেকে ফিরে এলে আবার যোগাযোগ। আজিজে, শাহবাগে, গ্রিন রোডে তার বাসায়, ছফা ভাই বা হুমায়ূন আজাদ স্যারের সঙ্গে আমরা বহু সময় একত্রে কাটিয়েছি। চট্টগ্রামে গেলে তিনি দেখা করেন আমার সঙ্গে। শেষ দেখা জাতীয় জাদুঘরে। মানিকগঞ্জ সমিতি নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনকে সম্বর্ধনা দেওয়ার সময় সেখানে এসেছিলেন। আমাদের নোবেলজয়ী ড. ইউনূসও ছিলেন সেখানে। দুই নোবেল বিজয়ীর সঙ্গে আমার একটি ছবিও তুলে ফেলেন এক ফাঁকে। দেখা-অদেখার মামুন ভাই বসবাস করেন আমার মনের ভেতরে।
অধ্যাপক এম. এ. সামাদ ফরিদপুরের সামাজিক ও জনকল্যাণকর কাজের একনিষ্ঠ একজন। প্রাণখোলা মানুষ তিনি। বয়সে প্রবীণ। কিন্তু তারুণ্যে উদীপ্ত। নানা লেখার ভিত্তিতে তার সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতা অমোচনীয়। অধ্যাপক কাকলীও এখন ফরিদপুরে। ফরিদপুরেরই মেয়ে সে। আশির দশকের শুরুতে আমরা সহপাঠী ছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওর বাংলা আর আমার সরকার ও রাজনীতি। কিছুদিন আগে মারণব্যধির আঘাতে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হলে সেখানে গিয়ে দেখেছিলাম সেই আগের মতোই বিরাট এক হৃদয়ের কাকলীকে। এমন স্বজনদের ফরিদপুরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই, এমন কথা আমি কখনোই বলতে পারব না। ফরিদপুরের মানুষও তেমন বলেন বা ভাবেন না। তার প্রমাণ, নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূনকে নিয়ে ফরিদপুরে উৎসবের সময় উদ্যোক্তারা আমাকে স্মরণ করেছেন। হুমায়ূনের মৃত্যুকালীন সময়ে 'মানবজমিন' পত্রিকার প্রথম পাতায় আমার পর পর কয়েকদিন লেখা ছাপা হয়। সেটা তাদের নজর এড়ায় নি। হুমায়ূনকে নিয়ে ফরিদপুরে যে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী অনুষ্ঠান হচ্ছে, সেখানে প্রকাশের জন্য আমার লেখাটি সঙ্গত কারণেই সেই অমর কথাকারকে ঘিরে আবর্তিত।
২.
২০১২ সালের ১৯ জুলাই বৃহস্পতিবার রাত ১১:৪৫ মিনিটে মোবাইল ফোনে কবি ও আবৃত্তিশিল্পী ভিখারুন্নেসা রেইনির এসএমএস পেলাম: 'নিউ ইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন'। আমি তখন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনী-কুমিল্লার কাছাকাছি। 'সিয়াম পরিবহন' নামের একটি নাইট কোচে চট্টগ্রাম থেকে কিশোরগঞ্জের পথে। বাসটি কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ হয়ে ময়মনসিংহের নান্দাইল চৌরাস্তার ওপর দিয়ে যাবে তাড়াইল উপজেলা সদর পর্যন্ত। নান্দাইল চৌরাস্তা থেকে বাসটি যখন ডানে মোড় নেবে, তখন বাম পাশে রেখে যাবে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোণার সীমান্ত সংলগ্ন হুমায়ূন আহমেদের জন্মস্থান কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রাম। সারা রাস্তায় আমি নিউ ইয়র্ক থেকে নেত্রকোণার কুতুবপুরের কথা ভাবতে ভাবতে হুমায়ূন আহমেদে মগ্ন হয়ে থাকি।
২০ জুলাই কিশোরগঞ্জে অস্থির সময় কাটে। ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া জুড়ে হুমায়ূন আহমেদ। শুক্রবারের সকল পত্রিকায় তার মৃত্যুর সংবাদ পূর্ণভাবে আসতে পারেনি। 'মানবজমিন'-এর জন্যে আমি লিখলাম 'হুমায়ূনের মায়াবী প্রস্থান'। চট্টগ্রামের 'দৈনিক পূর্বকোণ' থেকে ফোন এল। সেখানে পাঠালাম 'অনন্ত নক্ষত্র বীথির পথে হুমায়ূন'। কানাডার অন-লাইন সাপ্তাহিক 'বেঙ্গলি টাইমস'-এ আমি নিয়মিত 'ঢাকার চিঠি' নামে একটি কলাম লিখি। সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মিন্টুর তাগাদায় সেখানে পাঠালাম 'হুমায়ূনের মহাযাত্রা'। আমার লেখার মূল বিষয়টুকু এখানে উল্লেখ করি:
... মহাকালের 'অনন্ত নক্ষত্র বীথি'র পথে চিরদিনের জন্যে চলে গেছেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। ভাটীবাংলার জলমগ্ন হাওরের 'লিলুয়া' বাতাসে ভেসে। অপরূপ জোছনার স্মৃতিতে ভিজে ভিজে 'শ্রাবণ মেঘের দিনের' অন্বেষায়। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু এমনই এক চলে যাওয়া, যার অন্য নাম 'মায়াবী প্রস্থান'। বাংলাদেশের মানুষ আর প্রকৃতির যাবতীয় সত্ত্বাস্পর্শী সেই চিরযাত্রাপথ। ক্ষণিকের এ প্রস্থান কখনোই বিদায় নয়। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ক্যানভাস জুড়ে তিনি আছেন তার অঝর লেখনীর মাধ্যমে।
গোড়ার দিকে নগণ্য সংখ্যক অতি-আঁতেল ধরনের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ছিলেন তাঁর সমালোচক। সমঝদার ছিলেন বৃহত্তর পাঠকশ্রেণী। তিনি পাঠ-বিপ্লবের প্লাবনে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তুচ্ছ বিরোধিতা। পরিণত হয়েছিলেন অখণ্ড-বাংলার কথসাহিত্যের এক ও অনন্য আইকনে। 'জীবন্ত কিংবদন্তি' বলতে সত্যি সত্যিই যদি কাউকে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে তিনি অবধারিতভাবে হুমায়ূন আহমেদ। ঈর্ষণীয় পাঠকপ্রিয়তার জাদুকরি ছোঁয়ায় তিনি বাংলা সাহিত্যের মরা গাঙে প্রাণের বন্যা জাগিয়েছেন।
জন্মেছিলেন হাওর জনপদের উত্তর-পশ্চিম তীরের বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোণায়। বেড়ে উঠেছিলেন হাওরের পূর্বপার্শ্বস্থ সিলেটের মীরাবাজারে। তারপর বৃহত্তর বরিশালের শ্যামল পিরোজপুরে এবং বাংলাদেশের আরও কিছু চমৎকার স্থানে। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও উত্তর আমেরিকার নর্থ ডাকোটায়। কর্মসূত্রে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্পকালীন শিক্ষকতার পর বহু বছর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মাণে পূর্ণকালীন আত্মনিয়োগের প্রয়োজনে এক সময় ছেড়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা। তাঁর জন্যে নিরাপদ পেশা ছেড়ে সাহিত্যাঙ্গনে চলে আসার প্রয়োজন ছিল। কেননা প্রবল পাঠক প্রত্যাশার কারণে তাঁকে অবিরাম লিখতে হয়েছে। একুশের মেলায় তার বই বের হলে একাধিক সংস্করণ হয়েছে। একেকটি সংস্করণ ২০-২৫ হাজারের কম হয়নি। লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে হুমায়ূনের একেকটি বই। অটোগ্রাফের ভিড় সামলাতে তাঁর আশেপাশে নিয়োজিত করা হতো নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের। তুঙ্গস্পর্শী, বিরল ও অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তিনি।
গল্প-উপন্যাস লেখা, নাটক রচনা, চলচ্চিত্র নির্মাণ - যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন তিনি। 'শঙ্খনীল কারাগার', 'নন্দিত নরকে' দিয়ে শুরু। তারপর স্রোতধারার মতো তাঁর সোনালি কলম ছুটে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে '৭১', 'জোসনা ও জননী'। প্রেমের, বিরহের, বেদনার শত শত গল্প-উপন্যাস হুমায়ূন আহমেদের হাত দিয়ে পাঠকচিত্তে স্থায়ী আসন করে রেখেছে। তাঁর ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে অধুনালুপ্ত 'পাক্ষিক শৈলী' একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। সেখানে আমাকে একটি মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ দিতে হয়। সেই প্রবন্ধে আমি হুমায়ূন আহমেদের 'মেঘ বলেছে যাব যাব' থেকে মেঘমন্দ্রিত হিমালয়ের আবহ থেকে কিছুটা উল্লেখ করার পর টের পেলাম, কখন যেন আমার নিজের চোখ দুটি ভিজে গেছে। আনন্দও ও বেদনার এমনই এক শিহরণের নাম হুমায়ূন আহমেদ।
শেষ দিকে তিনি 'কবি', সম্রাট হুমায়ূনের জীবনালেখ্যের ভিত্তিতে 'বাদশাহ নামদার', ঊনসত্তরের প্রেক্ষাপটে 'উতাল হাওয়া' ইত্যাদি ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে মানবীয় দুঃখ-বেদনা সঙ্কটের অপূর্ব বিন্যাস নির্মাণ করেছেন। আনিস, শাহানা, বাকের ভাই, নীরা, পরী, বিনু, হিমু, মিসির আলীর মতো শত শত চরিত্র তিনি তৈরি করেছেন, যাদেরকে নিত্য দেখা যায়, কখনো চারপাশের জগতে, কখনো আমাদেরই সমান্তরালে।
চলচ্চিত্রে অদ্ভুত জাগরণ এনেছিলেন তিনি। মনে পড়ে 'আগুনের পরশমণি' দেখতে প্রফেসর শেখ জহির আহমেদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল অধ্যাপক সপরিবারে বন্দর নগরীর আলমাস সিনেমা হলে গিয়েছিলাম। বহু বছর পর প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবিটি দেখে তৃপ্তি ও আনন্দে অভিভূত হয়েছিলাম সকলেই। আরো মনে পড়ে ২০০১ সালের দিকে এক নিঝুম অপরাহ্নে ঢাকার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে 'উত্থানপর্ব' অফিসে আহমদ ছফা ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছি। অকস্মাৎ সেখানে পশ্চিমবঙ্গের কবি জয় গোস্বামীর আগমন; সঙ্গে ছত্রধারি হিসাবে আমাদের প্রয়াত বন্ধু কবি ত্রিদিব দস্তিদার। জয়কে রোদ থেকে বাঁচাতে ত্রিদিব আক্ষরিক অর্থেই ছাতা নিয়ে ঘুরছিলেন। জয় গোস্বামী আমাদের সঙ্গে বইয়ের দোকানগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে বাংলাদেশের তিনজন লেখকের বই যা পাচ্ছিলেন, সবগুলোই কিনে নিচ্ছিলেন। জয়ের সংগ্রহ-তালিকাভুক্ত বাংলাদেশের এই তিনজন লেখক ছিলেন আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার এবং হুমায়ূন আহমেদ। এ তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানানো দরকার যে, অতি রক্ষণশীল ও গোঁড়া আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর 'দেশ' ম্যাগাজিন তাদের ঢাউস সাইজের পুজা সংখ্যার জন্যে হুমায়ূন আহমেদের লেখা প্রার্থনা করতো - কখনো পেত, কখনো পেত না। বাংলাদেশের অন্য কোনো লেখকের লেখার জন্যে তাদেরকে বিচলিত হতে দেখা যায় নি। অথচ হুমায়ূন আহমেদ কখনো কলকাতা নিয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে তাঁর কোনো লেখা বা বক্তব্য থেকে জানা যায় না। যদিও বাংলাদেশের অনেক কবি বা গল্পকার মনে করেন, কলকাতার কল্কে পেলে তারা 'অমর'(!) হয়ে যাবেন। হুমায়ূন আহমেদ মানুষকে বিশ্বাস করতেন; পাঠককে সম্মান করতেন; কোনো মোড়লকে গ্রাহ্য করতেন না। বাংলাদেশের হৃদয় থেকে লিখতেন। মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি অবস্থান করতেন। বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষী মানুষের হৃদস্পন্দের সঙ্গে ছিল তাঁর সংযোগ। মানব মনস্তত্ত্বের অদেখা ভুবনের উন্মোচনে তিনি ছিলেন এক বিস্ময়কর ও কুশলী কারিগর। আশা ও আশাভঙ্গের মেরুকরণে ব্যক্তিক আর্তি আনন্দ-বেদনায় প্রাণ পেয়েছে তাঁর অলৌকিক কলমে।
জীবনকে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। সেন্ট মার্টিনে 'সমুদ্রবিলাস' বানিয়েছেন। ভাওয়ালের উপান্তে তৈরি করেছেন নান্দনিক 'নূহাশ পল্লী'। কুমির মার্কা প্রতীকের প্রার্থী কবি নির্মলেন্দু গুণের পক্ষে নির্বাচনের জন্যে চলে গেছেন বারহাট্টা-মোহনগঞ্জে। কেউ যখন এগিয়ে আসেনি তখন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দারা-পুত্র-পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রবল ঝুঁকির মধ্যেও বসে গেছেন সিলেট হযরত শাহজালাল (রহ.) বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে। ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-বেদনার হলাহল পান করে নীলকণ্ঠের মতো তিনি অপেক্ষা করেছেন। প্রিয় কন্যা, প্রিয় পুত্রের জন্যে। ভালোবাসার সন্ধানে কাটিয়েছেন তিনি তাঁর আস্ত একটি জীবন। লেখক বা ব্যক্তি-মানুষ হিসাবে তিনি একজন আটপৌরে কেউ ছিলেন না। সর্বার্থেই তিনি ছিলেন বিশিষ্ট; অন্য সকলের চেয়ে ভীষণভাবে আলাদা। এ রকম বড় মাপের এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ একজন মানুষ, শিল্পী, লেখক বহু বহু বছর পর পর আসেন।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে (১৯ জুলাই) জন্মভূমির সুদূরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদ যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন, তখন বাংলাদেশের মানুষ রমজান মাসের নতুন চাঁদের অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আজ কিংবা কাল সে চাঁদ উঠবে। চাঁদের হাত ধরে আসবে প্রিয় জোছনা। তখন আবশ্যিকভাবেই জ্বলজ্বল করে উঠবে একটি অমোঘ নাম - হুমায়ূন আহমেদ; অনন্ত নক্ষত্র বীথির পথে চলে যাওয়া এক জ্যোর্তিময় নক্ষত্র ...।
রাতে চ্যানেল আই-এর আজকের সংবাদপত্রে অতিথি হয়ে এলেন সাংবাদিক ও হুমায়ূনবন্ধু সালেহ চৌধুরী। বললেন সত্তর-আশি দশকের হুমায়ূনের শুরুর দিনগুলোর কথা।
৩.
২১ জুলাই শনিবার আমার পাঠানো লেখাগুলো স্ব স্ব পত্রিকায় ছাপা হলো। 'মানবজমিন' সম্পাদক মতি ভাই ফোন করলেন। বললেন, ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক ভারসাম্যে হুমায়ূনের মূল্যায়ন হওয়া দরকার। সাহিত্যে ও কর্মে তিনি যে চিরদিন বেঁচে থাকবেন, সেটা উঠে আসা প্রয়োজন। আমার মনে হলো, ব্যক্তি হুমায়ূনের মৃত্যু হলেও লেখক, নির্মাতা হুমায়ূন মারা যান নি। আমি তার কীর্তির মূল্যায়ন করে লিখলাম 'চিরঞ্জীব হুমায়ূন'। লেখাটি ছাপা হওয়ার পর দেখলাম, অনেক পত্রিকা ও চ্যানেল 'চিরঞ্জীব হুমায়ূন' বিশেষণটি ব্যবহার করছে। রাতে 'আজকের সংবাদপত্র'-এর অতিথি ড. আসিফ নজরুল পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় হুমায়ূন প্রসঙ্গ উপেক্ষিত হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।
এদিন 'মানবজমিন'-এ প্রকাশিত আমার লেখাটির কিয়দংশ:
... মৃত্যুর কফিনে জীবনের সিম্ফনি গাইতে গাইতে আসছেন চিরঞ্জীব হুমায়ূন আহমেদ। কাল সোমবার তিনি নিউইয়র্ক থেকে আরো সঙ্গে নিয়ে আসবেন 'হিমুর হাতের কয়েকটি বেদনার্ত নীলপদ্ম'। ভালোবাসার মহানায়কের এই বিষাদসিক্ত প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় এখন সমগ্র বাংলাদেশ এবং বিশ্বের সকল বাংলাভাষী মানবমণ্ডলী। আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ হুমায়ূন আহমেদ এক বছর আগে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনিবার্য মৃত্যুর সামনে। কিন্তু তিনি মৃত্যুর অপেক্ষায় ছিলেন না। ছিলেন জীবনের উচ্ছ্বাসে ও প্রত্যাশায় ব্যাকুল। অবিরাম জীবনের জন্যে যুদ্ধ করে গেছেন; উজাড় করে দিয়েছেন নিজেকে আর নিজের ভালোবাসাকে। গড়তে চেয়েছেন ক্যান্সার হাসপাতাল। উত্তরাধিকারীদের হাতে নুহাশ পল্লীর বিভাজন তিনি সহ্য করতে পারেন নি। সেখানে যোজনা করতে চেয়েছেন সাংস্কৃতিক-মানবিক বহুত্ববাদ ও নান্দনিক সম্মিলনের বাতাবরণ। রোগশয্যায় থেকেও নিউইয়র্কের ভাড়াবাড়িতে রোপণ করেছিলেন জীবনের প্রতীক সবুজাভ উদ্ভিদ-গুল্মের ঝাড়। এমন একজন জীবনবাদী মানুষ হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে মৃত্যুর উপমা যেন মিলতে চায় না। মৃত্যুকে পরাজিত করে জীবনই জেগে থাকে তার চারপাশ ঘিরে। এমন কি, ব্যক্তিক মৃত্যুকে অতিক্রমী তার কর্ম ও কীর্তির চিরঞ্জীব সত্ত্বা ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয় সকলের সামনে; বিশ্বভুবন জুড়ে। যে স্বীকৃতির প্রতিধ্বনি ঢাকা, কলকাতা, নিউইয়র্ক, টরোন্টো হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়াতে ছড়াতে এখন স্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের সোনালি পাতায়।
ইতিহাস হুমায়ূন আহমেদকে যেভাবে বুকে টেনে নিয়েছে, হুমায়ূনও তেমনিভাবে সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের শহীদ পিতার একদল মেধাবী সন্তানের একজন এই হুমায়ূন। দারিদ্র, রাজনৈতিক সঙ্কট, আর্থ-সামাজিক ঝড় পেরিয়ে হুমায়ূন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন, সেটা বিশ্বজয়ের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। বিজ্ঞানের কঠিন ভূমি থেকে তিনি সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অঙ্কন করেছেন নিজের সাফল্যচিহ্ন। গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ও গীত রচনা এবং অবশেষে চিত্রপ্রদর্শনীর মাধ্যমে তিনি জানিয়ে গেছেন তাঁর বহুমাত্রিক দ্যুতিময় প্রতিভা ও কৃতিত্বের জগত সম্পর্কে। যোগ্যতা, শ্রম আর অধ্যবসায়ের মেলবন্ধনে তিনি সকল বিঘ্নের প্রাচীরকে চূর্ণ করে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন সাফল্যের শীর্ষতম বিন্দুতে। জনপ্রিয়তা আর হুমায়ূন আহমেদ পরিণত হয়েছিল এক ও অভিন্ন সত্ত্বায়।
জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে উৎকৃষ্ট সৃষ্টিশীলতার সংমিশ্রণ হুমায়ূন আহমেদের প্রধানতম কৃতিত্ব। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের কথা বললে, সবচেয়ে আগে আসে হুমায়ূন আহমেদের নাম। হুমায়ূন সকলের জন্যে লিখেছেন; নাটক করেছেন। কাজের লোক থেকে পণ্ডিত পর্যন্ত সকলেই তার পাঠসঙ্গী। মানবিক আবেগ ও সূক্ষ্ম অনুভূতির মানুষ মানেই হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত-অনুরাগী। যুক্তি বা আধিভৌতিক - উভয়বিদ জগতের মধ্যেই তিনি স্বাচ্ছন্দে কাজ করেছেন মিসির আলী বা হিমু বা শুভ্রকে নিয়ে। বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে অপু, দুর্গা, নন্দিনী, অপলা কিংবা ফেলুদা, প্রোফেসর শঙ্কু বা কর্নেলের মতোই হুমায়ূনের চরিত্রগুলো স্থায়ী আসন পাবে।
বাংলার আধুনিক সাহিত্যধারায় নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্কট ও অবদমন ফেটে বেরিয়েছে তার কলমে। তিনিই দূর মফস্বলের একটি অদ্ভুত, বিচিত্র মানব বা মানবীয় মনোজগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় ইংলিশ মিডিয়ামে অধ্যয়নরত পাঠিকাকে। আবার গ্লোবালাইজেশন তাড়িত বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী বাংলাদেশীদেরকে পরম্পরায় আবদ্ধ করেন। তিনি তার নাটকে বাংলার মরমী, আউল, বাউল, বিচ্ছেদের গানগুলোকে নবতর আবহে তুলে ধরেছেন, ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করেছেন। পূর্ব মৈমনসিংহ, ভাটি বাংলা, হাওরের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, বৃহত্তর সিলেটের লোকসঙ্গীতের অপরূপ জগতকে তিনি নতুনভাবে উন্মোচিত করেছেন। শাশ্বত বঙ্গের চিরায়ত ও লোকজ সংস্কৃতির আধুনিক ভাষ্যকারও হুমায়ূন আহমেদ। তার মতো করে সেসব কথা আর কেউ লিখে যেতে পারেন নি।
হুমায়ূন আহমেদ নশ্বরতা থেকে অবিনশ্বরতার দিকে যাত্রা করেছেন। রেখে গেছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা; প্রজন্মের পর প্রজন্মের পাঠক। ব্যক্তিক অস্তিত্ব অতিক্রমী হুমায়ূন বাংলা সাহিত্যের মহাকালিক মহাসড়কের চিরঞ্জীব প্রতিভূ। ...
৪.
২২ জুলাই রবিবার নিউইয়র্ক থেকে হুমায়ূনের মরদেহ ঢাকায় আসার কথা থাকলেও আসতে পারে নি। এদিকে প্রিয় লেখকের জন্যে লাখো মানুষের উন্মুখ অপেক্ষা। রাজ্যহারা মুঘল সম্রাট হুমায়ূন যখন বিজয়ীর বেশে ফিরে আসছিলেন, দিল্লি তখন যেভাবে অপেক্ষা করছিল, সাড়ে ছয়'শ বছর আরেক হুমায়ুনের জন্য ঢাকা তখন তেমনি অপেক্ষার উত্তেজনা ও রোমাঞ্চে দোলায়িত। সেই দৃশ্যপটকে চিত্রিত করে আমি লিখলাম 'হুমায়ূনের প্রত্যাবর্তন': হাজার মাইল পেরিয়ে আটলান্টিকের ওপার থেকে আসছেন তিনি। হিমশীতল মৃত্যুর মায়াবী-রহস্য চাদরে আবৃত হয়ে। তবুও তিনি আসবেনই। প্রিয় দেশ ও প্রিয়তম মানুষের কাছে। আজ সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টায়। স্বদেশের সবুজে-শ্যামলে-স্মৃতিতে-সত্ত্বায় ফিরে আসছেন তিনি। আজ অনিন্দ্যসুন্দর সকালে অশ্রু ও পুষ্পের মেলবন্ধনে নিজস্ব মৃত্তিকা ও শেকড়ে প্রত্যাবর্তন করছেন চিরঞ্জীব কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। হৃদয়ের রক্তক্ষরণে প্রিয় হারানোর বেদনায় মানুষ অপেক্ষা করছে হুমায়ূনের 'ঘরে ফেরা'র।
হুমায়ূন আহমেদের ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় আজ সমগ্র বাংলাদেশ। অপেক্ষায় রাজধানী ঢাকা। শহীদ মিনার। মাতা, পুত্র, কন্যা, পরিজন। কোটি কোটি দর্শক, পাঠক। অখণ্ড-জনতা অপেক্ষায় বেদনাহত, শেষ ঠিকানা নুহাশ পল্লী। দক্ষিণা হাওয়া। কেন্দুয়ার কুতুবপুর। সোহাগী রেল স্টেশন। অচিনপুর। সুখী নীলগঞ্জ প্রজেক্ট। অসংখ্য হলদে জামার হিমু। শুভ্র। ভাসমান মেঘ ও বর্ষণের স্মৃতি। সবাই অপেক্ষমাণ। বাংলাদেশের মানুষ এমন বুকভরা অপেক্ষা করতে পারে শুধুমাত্র তারই জন্য।
অপেক্ষা করেছিল দিল্লি। সাড়ে ছয়'শ বছর আগে। রাজ্যহারা মুঘল সম্রাট নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ূনের জন্য। বাংলাদেশ আজ অপেক্ষা করছে আরেক হুমায়ূনের। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে একচ্ছত্র সম্রাট হুমায়ূন আহমেদ। হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বরপুত্র এই রাজন্য কোনো দেশ বা জনপদ দখল করেন নি। জয় করেছেন বাংলাভাষী মানুষের হৃদয় এবং বাংলা ভাষার অসীমান্তিক ভূগোল।
বাংলা কথাসাহিত্য, সংস্কৃতির জগৎ, প্রকাশনা শিল্প, পাঠক মনন জেগে উঠেছিল তার অলৌকিক স্পর্শে। জাগরণের একটি উতুঙ্গ ঢেউ নেচে উঠেছিল তাকে ঘিরে। পাঠ-বিপ্লবের ঘোরতর আন্দোলনে কেঁপে উঠেছিল বইপাড়া, ছাপানো অক্ষর, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, স্বর আর ব্যঞ্জন বর্ণসমূহ। পূর্ব বা পশ্চিম নয়, তার হাত ধরে আমরা গভীর অভিনিবেশে আমাদেরকেই পাঠ ও অধ্যয়ন করেছিলাম। আমাদের পারিপার্শ্ব, জীবন-যাপন, মানব মন, মনস্তত্ত্ব, আনন্দ-বেদনা, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বপ্ন ও সম্ভাবনাগুলো হার্দিক স্বরে কথা বলেছিল তারই জাদুকরি কলমে। স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষের সাহিত্যরুচি, চিন্তা ও ভাবনার জগতের বন্ধন মুক্তি ঘটেছিল তারই হাতে। অনেক দিন পর বাংলাদেশ সনাক্ত করতে পেরেছিল যে, প্রকৃত অর্থে এদেশের সাহিত্য কেমন হতে হবে; কেমন হওয়া উচিত। সাহিত্যের একদম নতুন ও অগ্রসর ঘরানার জন্মদাতা তিনি। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের একটি সার্বভৌম যুগ; একটি উন্মুক্ত কাল তিনি রচনা করে দিয়েছেন আমাদের জন্য; বাংলাদেশের জন্য; আন্তর্জাতিক বাঙালির জন্য।
ব্যক্তি-মানুষের ক্ষেত্রে মৃত্যু যদি মূল্যায়নের জন্যে একটি বিরতি হয়, তাহলে আজ তার পুনরাগমনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে হুমায়ূন বীক্ষণ। শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রেম ও ভালোবাসার নৈবেদ্যের পুষ্পাঞ্জলি, অশ্রুবিন্দু ও মানবিক আবেগ ছিন্ন করে তিনি বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার তূল্যমূল্যে প্রতিস্থাপিত হবেন; তিনি সগৌরবে ঠাঁই করে নেবেন বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-নান্দনিকতার ইতিহাসের হিমালয়-শীর্ষে।
তার জাগতিক মৃত্যুর পর একটি হুমায়ূন যুগের অবসানে আমাদের সামনে সূচিত হবে আরেকটি নবতর হুমায়ূন যুগ। যেখানে কাল-কালান্তরে, যুগ-যুগান্তরে, প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে তিনি ক্রমে ক্রমে অপরিহার্য হয়ে উঠবেন আমাদের মননে, পঠনে, পাঠনে, চিন্তনে ও বিশ্বাসে। হুমায়ূন আহমেদের জৈবিক মৃত্যু হয়েছে বটে। কিন্তু আজ যে হুমায়ূন মায়ের কোলে, মাটির গভীরে, পাঠকের হৃদয়ে ফিরে আসছেন সুদূর আমেরিকা থেকে; তার মৃত্যু নেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাঙালি জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের মানুষ আর প্রকৃতি যতদিন পৃথিবী নামের এই ঠিকানায় বেঁচে থাকবে; ঠিক ততদিনই জীবন্ত থাকবেন চিরঞ্জীব কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
রাতে 'আজকের সংবাদপত্র' অনুষ্ঠানে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু জানালেন হুমায়ূন বরণের নানা দিক নিয়ে। আগে জানিয়ে রাখার দরকার ছিল। সারা দেশ ছিল হুমায়ূন-বরণের অপেক্ষায়। আগাম দিক-নির্দেশনা থাকায় লক্ষ মানুষের অংশগ্রহণে পরদিনের আয়োজন সুসম্পন্ন হওয়া সহজ হয়েছিল।
৫.
২৩ জুলাই সোমবার সকালে ফিরে আসেন নিথর হুমায়ূন। বিমানবন্দর থেকে শহীদ মিনার হয়ে জাতীয় ঈদগাহ পর্যন্ত জনতার সমুদ্র। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে কোনো লেখকের জন্যে এমন আকুলতা সর্বসাম্প্রতিককালে দেখেছে বলে কেউ জানাতে পারলেন না। অভূতপূর্ব বরণ ও বিদায়ের জনউচ্ছ্বাসে আগলে রাখা হলো জ্যোর্তিময় নক্ষত্রতুল্য জীবন্ত কিংবদন্তিকে। 'মানবজমিন'-এ আমি লিখলাম 'পুষ্প ও অশ্রুসিক্ত অভিষেক'। চট্টগ্রামের 'পূর্বকোণ' থেকে লেখা চাওয়া হলে সেখানে পাঠালাম 'অভিষিক্ত নক্ষত্র': ... এ যেন শবানুগমন নয়। নয়নের জলে বরণের-বিদায়ের সমারোহ। পুষ্প ও অশ্রুসিক্ত অভিষেক। বরণের। বিদায়ের। শেষকৃত্যের আবহে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় একদিকে বরণের ডালি আর অন্যদিকে চিরবিদায়ের আয়োজন। জনউচ্ছ্বাসের বাধভাঙা বেদনার্ত-কুসুমিত দ্যোতনায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের চিরঞ্জীব মহাপুরুষ হুমায়ূন আহমেদ এভাবেই ফিরে আসেন স্বদেশে। স্বজনের প্রিয় প্রাঙ্গনে। প্রিয়তম বাংলাদেশে। তিনি এসেছেন চিরপ্রস্থানের মহাপথে চলে যাবার জন্যে। ট্র্যাজেডির রাজপুত্রের মতোই তার আসা আর যাওয়ার পথরেখা নীল জোছনার মায়াবী উথাল-পাথালে ভাসিয়েছে সবাইকে।
সমগ্র জাতির অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় গতকাল সোমবার সকাল ৯টায়। ঢাকার মাটি স্পর্শ করে নিথর হুমায়ূন আহমেদকে বহনকারী বিমান। লাখো ভক্তের হাহাকার ও রোদনে ভারী হয় চারপাশের বাতাস। বুকচাপা কান্নায় তখন পুরো দেশ।
বিমানবন্দর থেকে শহীদ মিনারের পথে ঐতিহাসিক শবানুগমন। মৌন, তাপিত মানুষের আদিঅন্তহীন পদধ্বনি। রমনার সবুজে বিষাদের নীলজলে স্নাত লাখো মানুষের মাঝে জাতির সাংস্কৃতিক আত্মার প্রতীক শহীদ মিনার। জনতাসাগরের ঊর্মিমালায় সফেদ দ্বীপের মতো স্নিগ্ধ, শান্ত, সমাহিত হুমায়ূন। তারপর জাতীয় ঈদগাহ ময়দান। সর্বজনীন মানুষের সম্মিলিত প্রার্থনায় শেষতম বিদায়ের করুণতম সুর। মাটির গভীর টানে তখন এ মৃত্তিকার আদি, অকৃত্রিম ও শ্রেষ্ঠতম সন্তান। শ্রাবণের রাত নেমে এলে সঙ্গে আসে হিমঘরের সযতন অপেক্ষা। বাংলাদেশের হৃদয়ের ঠিকানায় চলে যাওয়ার অপেক্ষা হুমায়ূনের। আর হুমায়ূনের জন্যে মানুষের অপেক্ষা। দেশ ও বিদেশের তিরিশ কোটি বাংলাভাষীর অন্তহীন অপেক্ষা।
ইতিহাস কি কখনো দেখেছে মানুষের উন্মাতাল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কষ্টের এমনই বরণ আর বিদায়? নিয়তির নির্মম ইঙ্গিতে হুমায়ূনকে বরণ করা হয়েছে বিদায় জানানোর জন্যেই। পৃথিবীর বুকে নিজের কয়েকটি শেষঘন্টা তিনি বরণ আর বিদায়ের মেরুকরণে জনসমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে কাটিয়ে দিলেন। বাংলাদেশের মানব-হৃদয়ে বিষাদের মগ্ন-সুরে তিনি যাপন করলেন তার অন্তিম যাত্রা। পুরো যাত্রাপথটিকেও অঙ্কন করে রাখলেন ইতিহাসের বুকে। জীবনের মতোই মৃত্যু ও বিদায়ের কালেও তিনি ইতিহাসের জনক। অখণ্ড বাংলা সাহিত্যে আর কাকে নিয়ে রচিত হয়েছে এমন বিষাদের-বিদায়ের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস? মাইকেল মধুসূদনের অন্তিম যাত্রা হয়েছিল নীরবে, অলক্ষ্যে। সত্যজিতের শেষযাত্রাপথ নিজের শহরকে স্পর্শ করলেও তার পুরো দেশবাসীকে নাড়াতে পারে নি। হুমায়ূন একটি আস্ত জাতিসত্ত্বাকে আন্দোলিত করে চলে গেলেন। চলে গেছেন মানবসত্তার হৃদয়ে একটি কোমল পরশের ব্যাথা-জাগানিয়া মরমী সঙ্গীত হয়ে। তুলনারহিত রবীন্দ্রনাথের কথা আনা যাবে না স্থান, কাল, প্রেক্ষাপট ও অতিমানবীয় আবেগের স্পর্শকাতরতার কারণে। কিন্তু মানুষ রবীন্দ্রনাথকেও প্রকৃতি ও অগ্রযাত্রার শর্ত মেনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিক্রমের পথ করে দিতে হয়। উত্তরণের দিশা জাগাতে হয়। মানব ইতিহাস একজন থেকে আরেকজনে উত্তীর্ণ হতে হতে গড়ে তোলে নতুন ইতিহাস। এভাবেই সভ্যতার মুকুটে যুক্ত হয় নতুন নতুন সোনার পালক। হুমায়ূন সোনার পালক নয়, কোহিনূর-খচিত আস্ত একটি হীরকদীপ্তিমান মুকুট সমকালীন বাংলা সাহিত্যের শিরে স্থাপন করে গেছেন। বাংলা সাহিত্যের আদি থেকে অন্তের সামগ্রিক ইতিহাসে তিনি হয়ে আছেন বহুমাত্রিক জ্যোতির নান্দনিক বলয়; দ্যুতিমান নক্ষত্র।
রাতে মতিউর রহমান চৌধুরীর 'আজকের সংবাদপত্র'-এ অতিথি হয়ে এসে নায়ক রিয়াজ খুলে বললেন অসাধারণ মানবিক সত্ত্বার ব্যক্তিত্ব হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে। হুমায়ূন আহমেদের গোপন পরহিত, মানব-কল্যাণের নানাদিক আবেগী উচ্চারণে প্রকাশ করেন রিয়াজ। ভাবতে কষ্ট হয়, এত লোকপ্রিয়, মিডিয়ার কেন্দ্রবিন্দুর মানুষটির ভেতরের কষ্ট, একাকীত্ব, মানবসেবার বিষয়গুলোকে কী অসীম প্রচারবিমুখতায় লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি নিজেই! জনপ্রিয়তার সঙ্গে প্রচারবিমুখতার মহৎ সম্মিলন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।
৬.
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটানা ছয়-সাত দিন লিড শিরোনাম থাকার মতো ঘটনা হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কাকে নিয়ে হয়েছে? অদূর ভবিষ্যতে কাউকে নিয়ে এমনটি হওয়ার কারণও দেখতে পাচ্ছি না। বাংলাদেশের ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন প্রতিটি মানুষ নিউ ইয়র্ক থেকে ঢাকার শেষ বিশ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত মানসিকভাবে হুমায়ূনের শবানুগমন করেছে। মানুষের আত্মা ও মননের সঙ্গী হয়ে তিনি সবাইকে তার সহযাত্রী করেছেন। যারা বেঁচে আছেন, তাদের সামনে কর্ম-কীর্তি ও ভালোবাসার এক মহারাজপথ উন্মুক্ত করে দিয়ে গেছেন। আবেগের জলোচ্ছ্বাস শেষে বাস্তবের কঠিন মাটিতে এসে তার পদচিহ্ন ধরে আমাদের যেতে হবে সৃষ্টি ও নির্মাণের আরো দীর্ঘতম পথে। সেই যাত্রাপথে হুমায়ূন বাংলার ভাবসম্পদের আলো-ছায়ায়, লোকান্তরের মরমীয় মায়ায় সঙ্গী হবেন সমগ্র জাতির।