১.
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের (১৯৩৪-২০১২) মৃত্যুতে সেতু ভাঙার শব্দ শুনতে পেলাম। কেন, সেটা ব্যাখ্যা করি। বাংলা সাহিত্য ছাড়া একদার অখণ্ড এবং আজকের দুই রাজনৈতিক বাংলার মধ্যে সংযোগ বলতে আর কিছুই নেই; থাকার কথাও নয়; চিন্তায়, দর্শনে, ধর্মে, সংস্কারে, বিশ্বাসে পথ আলাদা হয়ে গেছে ৬৫ বছর আগে। সেই পথের একটি চলে গেছে কলকাতা থেকে দিল্লির দিকে। আরেকটি ঢাকা থেকে সারা বিশ্বের অভিমুখে। ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে শেষ সেতুর মতো ছিলেন সাহিত্যাঙ্গনের কয়েকজন লেখক; যারা দুই বাংলাকেই তাদের কাজের ভেতরে ধরতে পেরেছিলেন। সুনীল তাদের অন্যতম। অন্যতম বলবো না শেষতম বলবো, বুঝতে পারছি না। সুনীলের পর কলকাতার আর কজনই আছেন, ঢাকা যাদের গ্রাহ্য করবে? হুমায়ূন আহমেদের পর আর কজনই বা আছেন, যাদেরকে কলকাতা কুর্নিশ করবে। দুই বাংলা মিলে যে অক্ষণ্ড বাংলাসাহিত্য, সেখানে কেরামতি দেখানোর সাধ্য অনেকেরই নেই। যাদের ছিল, তারা ক্রমেই চলে যাচ্ছেন। প্রবাসে বিরহী প্রলেপে হুমায়ূনের প্রস্থানের পর হেমন্তের নিশীথ রাতে সুনীলও চলে গেলেন।
এ কথা আমরা সবাই জানি যে, একই ভাষার লেখক হলেও সবার দাপট সর্বত্র সমান থাকে না। ঢাকায় হাজার হাজার লেখক আছেন। তাতে কলকাতার বিশেষ কিছু যায় আসে না। কলকাতায় হাজার হাজার লেখক আছেন। তাতে ঢাকায় বিন্দুমাত্র স্পন্দন নেই। সব লেখক সর্বত্র গ্রাহ্য হবেন, এমনও নয়। সব লেখকের সীমানা সমান হয় না। হুমায়ূন বা সুনীল সীমানা ভেঙেছিলেন। নিজের মতো করে তারা সীমানা বানাতে পেরেছিলেন।
সুনীল সীমানা ভেঙে নিজের বিশাল সীমান্ত রচনা করেছিলেন। কিংবা দুই সীমানার মধ্যে তিনি সেতুর মতো নিজেকে বিছিয়ে দিয়েছিলেন। এর অবশ্য ঐতিহাসিক কারণও ছিল। সুনীল কলকাতায় লিখলেও তার লেখায় উপজীব্য হয়েছে ভূতপূর্ব পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ। মাদারীপুরের কালকিনির মাইজপাড়ার জন্মের টানেই তিনি সেটা করেছেন। এই করতে গিয়ে বাংলার দুই পারের মানুষকেই তিনি তার সাধ্যমতো ধরতে চেষ্টা করেছেন। কখনো সফল হয়েছে; কখনো হন নি। তাতে বিশেষ কিছু সমস্যাও হয় নি। সুনীলের প্রচেষ্টা মূল্য পেয়েছে। পাঠককে আগ্রহী করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো বাংলাদেশেও, এমন কি বিশ্বব্যাপ্ত অভিবাসী বাংলাভাষী সমাজেও।
অতএব সুনীলের মৃত্যু একটি সেতু ভাঙার প্রকট শব্দে আমাদের সচকিত করে; বাংলা সাহিত্য বা কলকাতার সাহিত্যের একটি বহুমুখী যুগের সুস্পষ্ট অবসান ঘটাবে। তার পরের যারা আছেন, তারা সুনীলের মতো কতটুকু দিগন্তবিস্তারী হতে পারবেন, এখনই সেটা বলা মুস্কিল। নিজের স্মৃতি, চঞ্চলতা, সম্পৃক্ততা, সজ্জনতা নিয়ে সুনীলের চেয়ে অগ্রসর হতে আর কে পারবেন, জানি না। সুনীলের আগের সাহিত্যসাধকদের বেলায় অভিযোগ ছিল, বাঙালি-হিন্দু লেখকেরা মুসলিম সমাজকে এড়িয়ে চলেন। স্পষ্ট ক্ষোভ ছিল, পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা পূর্ববঙ্গের মানুষ ও সমাজকে নিয়ে কাজ করেন না। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র পর্যন্ত সেসব অভিযোগের তীরে বিদ্ধ হয়েছিলেন। সুনীল বলতে গেলে একাই সেইসব অভিযোগের জবাব দিয়েছেন নিজের রচনাবলির মধ্য দিয়ে। তার রচনার কতটুকু পশ্চিমবঙ্গ আর কতটুকু পূর্ববঙ্গ দখল করেছে, সেটা নির্ধারণ করা শক্ত। এক সময় মনে হয়, আহা! এতো ফরিদপুর/মাদারীপুরের বামুনের পোলা। আবার মনে হয়, কঠিন কলকাতায় ছন্নছাড়া এক যুবক তিনি কবিতার সন্ধানে উদভ্রান্ত। দুপাশই 'আমাদের' হয়ে থাকে; অন্তত শারীরিকভাবে না হলেও লেখকসত্ত্বায়, সেটাই সুনীলের সবচেয়ে বড় জাদুকরী প্রতিভা। বিষয়কে ধরতে পারা, ভাষাকে নাচিয়ে দেওয়া সুনীলের এক মহৎ গুণ। এ কারণেই তিনি ঈসা খাঁ বা লালনকেও ছাড়েন নি। রানু আর ভানুকেও নিয়ে এসেছেন। যদিও ইতিহাসের সত্য আর সাহিত্যের সত্য এক নয়, তথাপি সুনীল সত্য ও সাহিত্যের মাঝখান দিয়ে নিজের কথা বলে গেছেন। কোনো কোনো পক্ষের প্রতি পক্ষপাত করেছেন বটে; কিন্তু চরমভাবে একপক্ষীয় হয়ে যান নি। এখানে এসেই সুনীলকে সাম্প্রদায়িকতা আর আঞ্চলিকতা থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়; তাকে মনে হয় সর্বজনীন। এই দূরত্ব দিয়েই তিনি সকলের কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছেন।
এ কথা বিলক্ষণ বলা যায় যে, ভবিষ্যতে কলকাতাকে ঘিরে যে বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস রচিত হবে, তাতে অনেকের নাম থাকবে। আবার ঢাকাকে ঘিরে যে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস রচনা করা হবে, সেখানেও বহুজনের নাম আসবে। উভয় পাশেই সমান কৃতিত্বে নিজের নাম রাখতে পারবেন, এমন জন খুব কমই হবেন। সুনীল দুই পাশেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। সাবলীল গতায়ত করেছেন দু পাশেই। এজন্য বলেছি যে, তার মৃত্যুতে সেতু ভাঙার শব্দ শুনছি।
২.
সোমবার রাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন মারা যাচ্ছেন, আমি তখন শারদীয় দেশ-এ প্রকাশিত তার উপন্যাস 'সরস্বতীর পায়ের কাছে' পড়ছি। সকালে মৃত্যুসংবাদ পড়ে আমি বিমূঢ়। আবার চোখ বুলালাম তার সর্বশেষ উপন্যাসটিতে। ঔপনিবেশিক আমলের প্রেক্ষাপটে মাদারীপুর অঞ্চলের আবহে এক ব্রাহ্মণ-পরিবারের বিদ্যার্থীর জীবন-সংগ্রামের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে উপন্যাসটিতে। আগেও তিনি মাদারীপুর-ফরিদপুর অঞ্চল এবং প্রাচীন ব্রাহ্মণসমাজের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন। এ উপন্যাসে তিনি জ্ঞানের প্রতি আগ্রহের যে প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেটা অনন্য। একটি বাড়ি পালানো নব্য-যুবক ম্যাট্রিক পাস করার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহায্য চায়। গ্রামে গ্রামে ঘুরে অবশেষে সেই সাহায্য মিললো কলকাতার বেশ্যাপল্লীর একটি প্রায়-বন্দি জীবনে। অধ্যবসায় শেষে ছেলেটি তার গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাস হিসাবে গণ্য হল। শিক্ষার সংগ্রামে সে হারালো পুরোনো প্রেমিক, যৌবনের দাবি এবং ভোগের উপাচার। তবু সে সার্থক, তৃপ্ত। উপন্যাসের এক পর্যায়ে পালানোর পথে স্টিমারের অন্ধকার একটি প্রকোষ্ঠে একটি ভাঙা মূর্তির পা চেপে ধরেছিল ছেলেটি। সে তখন বুঝতে পারেনি, সেটি লক্ষ্মী না সরস্বতী। কিন্তু না বললেও বোঝা যায়, পুরো উপন্যাস জুড়েই সুনীল সরস্বতীরই আরাধনা করেছেন। তিনি নিজেও তাই। দেশভাগের ক্ষত ও ক্ষতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া বাঙাল বা রিফিউজি সুনীল এবং আরো অনেকেই, যেমন শীর্ষেন্দু, সঞ্জীব প্রবল বিরূপ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে জীবনের সাফল্য অর্জন করেছেন। সাইকেলে চেপে টিউশনি, লজিং, কেরানি, শিক্ষকতা — হেন পেশা নেই যে, তারা বেছে নেন নি। সুনীলের 'আত্মপ্রকাশ' বা 'একা এবং কয়েকজন' নামের শুরুর দিকের লেখাগুলো যারা পড়েছেন, জানেন কী প্রচণ্ড কষ্টসহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে জীবন তাদেরকে চালিত করেছে। এমন পরিশ্রমে সবাই টিকতে পারে না। ছিটকে পড়ে। আটপৌরে জীবনে মিশে যায়। সাধারণের একজন হয়ে যায়। সুনীল সেটা করেন নি। লড়াই চালিয়ে গেছেন। সেটা লক্ষ্মীর পথে নয় সরস্বতীর পথে। বাংলাভাষার একজন প্রধান লেখক হয়েছেন তিনি। সমকালীন সাহিত্যে বিশেষ জায়গাও করে নিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতার জন্য বৃত্তি পেয়ে পড়তে গেছেন। সখ্য গড়েছেন অ্যালেন গিন্সবার্গ প্রমুখ প্রথাবিরুদ্ধ কবিকুলের সঙ্গে। একটি সময় তিনি পরিণত হন জনপ্রিয়তম সাহিত্যিক চরিত্রে। কলকাতার শেরিফের পদও লাভ করেন। একজন অভিবাসী ও উদ্বাস্তু লেখকের জীবন-সংগ্রামের এমন অনবদ্য, হৃদয়গ্রাহী, সংগ্রামী সাফল্যের উপাখ্যান দেশান্তরী কমিউনিস্ট বা ফিলিস্তিনি লেখক ছাড়া বিশ্বসাহিত্যে সচরাচর দেখা যায় না। তিনি যে আগাগোড়াই জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর আনুকূল্য নিয়েই থাকতে চেয়েছিলেন, অর্থ-বিত্ত নয়, বিদ্যা ও সুকুমার কলাই ছিল তার উপাস্য, শেষ উপন্যাসে বিধাতা তাকে দিয়ে সেই জীবনসত্যটিই ব্যক্ত করালেন। বিদ্যাদেবী ভক্ত সুনীলকে মরণেও পায়ের কাছেই ঠাঁই দিলেন।