হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্যে অতীব জনপ্রিয় এক লেখক। ১৯৪৮-এ জন্ম এই লেখক সম্প্রতি লোকান্তরিত হওয়ায় বাংলাদেশে তাঁর অসংখ্য পাঠক পাঠিকা শোকনিমগ্ন। একসময় তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক। তার পর অধ্যাপনা ছেড়ে চলে আসেন চলচ্চিত্রনির্মাণে — বানিয়ে ফেলেন — আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামল ছায়া - ছবি বানানোর ফাঁকে ফাঁকে টিভির জন্য নাটক বানানো। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক ছাড়াও পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পদক, ওসমানী পদক, হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার। কিশোর সাহিত্যে অবদানের জন্য তাঁকে দেওয়া হয়েছে অগ্রণী ব্যাঙ্ক শিশু সাহিত্য পুরস্কার। দেশের বাইরেও তাঁকে নিয়ে আছে প্রবল আগ্রহ। জাপান দূরদর্শন NHK তাঁকে নিয়ে তৈরি করেছে পনের মিনিটের ডকুমেন্টারি। অবসরে ম্যাজিক প্র্যাকটিস করেন, ছবি আঁকেন, আড্ডা দেন। তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন গায়িকা অভিনেত্রী। অনেক টি. ভি. প্রযোজনায় তাঁর একান্ত সহযোগী।
বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কেটেছে তাঁর শৈশব। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাক সেনাবাহিনী। লেখালিখির শুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে।
অসংখ্য উপন্যাস লিখেছেন, শিশুসাহিত্যও কম নয়। আপাততঃ কয়েকটি বই নিয়ে কিছু কথা বলি।
সত্তরের দশকে নন্দিত নরকে (১৯৭২) এবং শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩) নিয়ে উপন্যাস জগতে তাঁর আগমন। এখানে যে নরক তা কিন্তু রাজনীতি দ্বারা উত্তপ্ত, অর্থনৈতিক বৈষম্য দ্বারা ক্ষুব্ধ জগৎ নয়। রাবেয়ার অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে পারিবারিক জীবন, অন্যদিকে ভালোবাসার দুর্মর প্রত্যাশা, রাবেয়ার আকস্মিক অস্বাভাবিক মৃত্যু, অবৈধ মাতৃত্বের কলঙ্ক, মাস্টার কাকাকে মন্টু কর্তৃক হত্যা, ফাঁসি এসবই আছে। একদিকে প্রেম ও শুশ্রুষার আকাঙ্খা অন্যদিকে সীমাহীন শূন্যতা, সামাজিক অচলায়ন এসবই উপজীব্য। এগুলো কিন্তু বৃহত্তর জীবনের রূপক নয়। 'শঙ্খনীল কারাগার' নাকি সোমেন চন্দের 'ইঁদুর' গল্প পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা। কিন্তু সোমেন চন্দের নিরাসক্ত জীবনবোধ, বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি হুমায়ুনের ছিল না — একথা বলেছেন রফিকউল্লাহ খান তাঁর 'বাংলাদেশের উপন্যাস: বিষয় ও শিল্পরূপ' বইতে। (পৃ. ২৬৯) ফলে এখানে আছে আগের বইটির মতই 'ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশা, অপ্রাপ্তি ও যন্ত্রণা'। যুদ্ধকালীন সময়ের বিবিধ প্রসঙ্গ থাকলেও বহির্বাস্তবতার ফ্রেমেই থেকে যায়। চারজন মুক্তিযোদ্ধা কথা বলছে প্রথমটিতে কিন্তু রাজনৈতিক সামাজিক বাতাবরণ তুচ্ছ হয়ে যায়। 'সৌরভ' উপন্যাসেও যুদ্ধ উপজীব্য নয়, আত্মমগ্ন চেতনাই মুখ্য হয়ে ওঠে। '১৯৭১' উপন্যাসে হানাদার সৈন্যপ্রসঙ্গ এলেও যুদ্ধের বীভৎসতা এলেও যৌনতা বড়ো হয়ে ওঠে। সোমেন চন্দ প্রীতি তাই আপাতদৃষ্টিতে কোনো দায়বদ্ধতার প্রশ্নে লেখক-মানসকে প্রাণিত করে না। এরপর তিনি বহু উপন্যাস লিখে গেছেন, বহু ধরনের লেখালিখি করেছেন, জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, কিন্তু দেশ ও সমাজ যখন আপাত ঔজ্জ্বল্যের অন্তরালে ক্রমবর্ধমান তিমিরে তখন তাঁর ভূমিকা চরিত্রবিলাসে, প্রেম ও কিছু বিষাদ ভাবনায়, সমাজ সংকটের জটিলতাতে নয়। ফলে কি বার্তা তিনি তুলে ধরছেন দেশ ও বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে সে প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে।
হুমায়ূন আহমেদ এর প্রতি বাংলাদেশী একশ্রেণীর পাঠক পাঠিকার প্রেমের অংশভাগী হওয়ার চেষ্টায় বিভিন্ন বই থেকে সংগৃহীত তাঁর কিছু প্রেমের গল্প পড়ে ফেলা যাক। 'রূপা' গল্পের ন্যারেটর স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষমান এক যাত্রীকে একটি ইন্টারেস্টিং গল্প শোনাতে চান। তা হল — একসময় তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার ছাত্র, রসায়নের একটি মেয়েকে তার ভীষণ ভালো লেগে যায়। কিন্তু ঘটনাচক্রে ভুল ঠিকানায় অন্য মেয়েকে চিঠি দিয়ে জানায় — আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। তাকে রাজি হতেই হবে। ড্রাইভার ভুল ঠিকানা দিয়েছিল। সে এমন একটি মেয়ের বাড়ির দরজায় চলে আসে যে রসায়নের ছাত্রীটি নয়। সকাল নটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত এই মেয়েটির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, ঢালাও বর্ষণেও অবিচল। একসময় জানা যায় মেয়ে তার অবস্থা দেখে কাঁদছে, মেয়ের বাপ পুলিশ আনতে উদ্যত। শেষপর্যন্ত মেয়েটি তাকে বাড়িতে ডেকে নেয়, হাত ধরে খাবার টেবিলে নিয়ে যায়। এই মেয়েটির সঙ্গেই তার বিয়ে হয়। এটাই তার ইন্টারেস্টিং গল্প। রোমান্টিক ইচ্ছাপুরণের বিভ্রান্তির গল্প। 'একটি নীল বোতাম' গল্পের ন্যারেটর এশা বলে একটি মেয়েকে ভালো বেসেছিল। এই বর্ণক রঞ্জু এশার বাবার সঙ্গেই গল্প করে, মেয়ের সঙ্গেও। রঞ্জু একটি অ্যাড ফার্মের সামান্য কর্মী। স্বপ্ন মশগুল রঞ্জু তার হোস্টেল ঘরে ফুল, ছবি দিয়ে সাজায়, দেওয়াল চুনকাম করে। বন্ধুরা এসে ঠাট্টা করে। ইচ্ছে করে ঘর নোংরা করে। গল্পের ক্ল্যাইম্যাক্স হল — এশার বিয়ে ঠিক হয় ব্যারিস্টারের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। রঞ্জু একটি নীল বোতাম পেয়েছিল এশার। এটাকেই সে অপরাজিতা ফুল মনে করে। এ হল প্রেম ব্যর্থতার, ধনী দরিদ্রের মনোকষ্টের সনাতন গল্প। 'কল্যানীয়াসু' গল্পে আছে প্রেমে ব্যর্থতায় দীর্ঘশ্বাস, পূর্বতন স্ত্রীকে ফিরে পাবার আকুতি, রুশ চিত্র গ্যালারি, ডস্টয়েভস্কি নেহাৎই বাহ্যিক উপকরণ। জয়ী যে কেন বয়স্ক স্যারকে ভালোবেসেছিল, কেন সে শিল্পী স্বামীর প্রেম প্রত্যাখ্যান করল, কেন এ 'শূন্যতা বুকের ভেতরে হা হা করে' তার কারণ সন্ধানে তৎপর নন লেখক। 'দ্বিতীয়জন' গল্পের নববিবাহিত প্রিয়াংকা-র অসুখ, পাগল বোধ, অস্থিরতা, পাশের ঘরে কিসের যেন শব্দ, এ কেন 'ভয়ঙ্কর কোনো অসুখ' এ প্রশ্ন উঠবে। এ গল্প, প্রিয়াঙ্কা ও জাভেদ এর গল্প পাঠককে জড়াবে কোন সূত্রে? 'চোখ' গল্পে মনস্তত্ত্ববিদ মিসির আলির কাছে আসে টেক্সাসের গণিত অধ্যাপক রাশেদুল করিম, যে তার দাম্পত্যের কথা, স্ত্রী জুডির ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার কথা, রাশেদুলের আঁকা ছবি ইত্যাদি। চরিত্রদ্যোতক গল্প - খারাপ নয়। 'একজন ক্রীতদাস' গল্পের আমি ব্যবসায়ী, তার বিয়ে হবে পারুলের সঙ্গে, বিয়ের দিনই সে ফোনে বলে মাস্টারি পেয়েছি, বিয়েটা পিছিয়ে দাও, তারপর অন্য জায়গায় বিয়ে, গল্প শেষে আমির উপলব্ধি 'প্রেম নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার'। এ গল্প কিভাবে 'প্রিয়' গল্প হয় তা বুদ্ধির অতীত, না জীবনবোধ, না চরিত্রায়ন, না ভাষা ব্যবহার কোনোদিক থেকেই গল্প পদবাচ্য নয়, গল্পের নামটি হাস্যকর। এর পরের গল্প 'সঙ্গিনী'তে বলা হয় 'প্রেমের ক্ষমতা যে কি প্রচণ্ড হতে পারে প্রেমে না পড়লে বুঝা যায় না।' মিসির আলি গল্প বলে চলে, স্বপ্নের, মনের কথা বলে — কিন্তু আজকের দিনে এ গল্প কোন দিক থেকে গণ্য হতে পারে? 'শঙ্খমালা' গল্পে উপলব্ধি - 'আমরা খুব দুঃখ পুষে রাখি। হঠাৎ হঠাৎ এক একদিন আমাদের কত পুরানো কথা মনে পড়ে।' ঠিক আছে, কিন্তু এই রোমান্টিক গল্পে জানা যায় অভিমানী দাদা পরী-বঞ্চিত হয়ে আত্মহত্যা করেছিল, বাবা মাকে সান্ত্বনা দেয় — 'কাঁদে না, কাঁদে না।' আর নায়ক আকাশভরা জ্যোৎস্নার দিকে চেয়ে পরী আপাকে ক্ষমা করে দেয়। এই অভিমানের গল্পকেও বিষাদমণ্ডিত শিল্পরূপ দেবার জন্য যে রীতিকুশলতা দরকার ছিল, দুঃখের বিষয়, তা এখানে নেই। 'অচিনবৃক্ষ' চরিত্রদ্যোতক গল্প, যাতে তিনি হেডমাস্টার চরিত্রটিকে সাধ্যমতো নির্মাণ করেন। 'নিশিকাব্য' দাম্পত্য প্রেমের স্নিগ্ধ গল্প, চলনসই, তবে হুমায়ুনের গল্পে বড্ড বেশী পরী, জ্যোৎস্না, সুখদুঃখের সাথী চাঁদ এসে ভিড় করে। 'ভালোবাসার গল্প' রঞ্জু, নীলুর প্রেমের মিষ্টিমধুর গল্প, কিন্তু অন্যত্র বিয়ে ঠিক হওয়ায় দুঃখে শেষ হয় গল্প। 'নন্দিনী' গল্পে মুক্তিযুদ্ধের আবহ আছে শুধু বহিরঙ্গ সজ্জায় নয়। নন্দিনীর বাবাকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে, আজিজ দালাল বলে মুক্তিবাহিনীর হাতে মরেছে, যদিও নন্দিনী তারই বউ, সে ইণ্ডিয়া পালাতে চেয়েছিল। এই একটি গল্পে তীব্র সামাজিক প্রসঙ্গ চরিত্রগুলিকে আলোড়িত করে। 'লিপি' এক আমেরিকান দম্পতী প্রেম ও বিষাদের সুন্দর গল্প, যাতে একটু বুদ্ধিজীবীত্বের 'টাচ' দেওয়া আছে। সেটা হল লুপ্ত ভাষার পাঠোদ্ধার, যদিও গল্পে তার গুরুত্ব প্রযুক্ত হয় নি। কিন্তু তবুও স্ত্রীর সঙ্গে ঝটিতি প্রেম, অল্প দিনেই তার মৃত্যু গল্পটির সংহতি তৈরি করেছে। 'পিশাচ' গল্পে আছে পিশাচ সাধকের কথা, যে ভালোবাসার সমুদ্র ধারণ করে পিশাচ হবার সাধনা করে যাচ্ছে। 'বিভ্রম' গল্পে মিলি ও সুজাতের রেস্টুরেন্টে আলাপচারিতা, পারস্পরিক যাচাই, পছন্দ ও বিয়ে। যে সংকলনটির গল্প এগুলি, তার নাম — 'প্রিয় পদরেখা'। লেখক বলেছেন এগুলো প্রেমের গল্প, প্রেম শুদ্ধ ও পবিত্র বিষয়, প্রেম ব্যাপারটার অনুধাবন কঠিন কর্ম ইত্যাদি। পাঠক বুঝবেন এ বইয়ের গল্পগুলির বিষয়বস্তু দেশকালাতীত রোমান্টিক লঘু চিত্ত প্রেম। আর গল্পের ক্র্যাফট আশানুরূপ নয়।
হুমায়ুন আহমেদ কিশোরদের জন্যও প্রভূত লিখেছেন, কিশোর সমগ্রে একাধিক মুদ্রণের উল্লেখ থেকে বোঝা যাচ্ছে তাঁর কিশোর রচনাও যথেষ্ট জনপ্রিয়। তিনি বলেছেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় দুটি জিনিস — জ্যোৎস্না রাত ও শিশু। আমরা যে খণ্ডটি পড়বার সুযোগ পেয়েছি তাতে আছে চারটি উপন্যাস, একটি রহস্য উপন্যাস, ষোলটি গল্প, একটি নাটিকা। 'বোতল ভূত' উপন্যাসের বিষয় — স্কুলের ছেলেদের মনে ভুতের প্রভাব। বাচ্চা ভূত ও বোতল ভূত অনেক অসম্ভব কাণ্ড ঘটিয়ে দেয়, এমনকি অঙ্ক স্যার-ও ভূত গিলে ফেলে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বিশ্বাস করে বসেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে লোকটা ভূত দিয়েছিল, সে স্বীকার করে, একসময় তার মাথা খারাপ ছিল তাই এসব করেছে, কিন্তু এখন সুস্থ হয়েছে। ভূত বলে কিছু নেই, বিজ্ঞানের এই অগ্রগতির দিনে ভূত-চিন্তা হাস্যকর। 'মানুষের অসীম ক্ষমতা। অসাধ্য কাজের জন্য মানুষের ভূতের দরকার হয় না। সে নিজেই পারে।' এই রচনাটি নানা কৌতুকপ্রদ পরিস্থিতি সৃজনের জন্য উপভোগ্য। এর পরের উপন্যাস - 'সূর্যের দিন'। এখানে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংঘর্ষ পটভূমি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। সেইদিক থেকে উপন্যাসটির নামটি লাগসই হয়েছে। খোকন, রাস্তার গণ্ডগোল উপেক্ষা করেও এখানে ওখানে যায়। বিত্তশালী বাড়ির ছেলে। বড়কাকা কঠোর শাসনপন্থী, ছোটকাকা ফূর্তিবাজ, বাবা নরমপন্থী, মা রীতিমত অসুস্থ, শয্যাশায়ী। আর আছে খোকন ও তার বন্ধুদের ভয়াল ছয় দল যারা আফ্রিকা যাবার স্বপ্ন দেখে। আফ্রিকার গহীন অরণ্য দেখবে, পৃথিবী ঘুরে দেখবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জয়, শেখ সাহেবের ভাষণ ও শাসন, ভুট্টোর পলায়ন, ইয়াহিয়ার আস্ফালন, রাস্তায় গুলি, মিছিল আছে। খোকন এসব উপেক্ষা করে ঘুরে বেড়ায়, বাড়িতে মিথ্যে বলে, রাত জেগে মুণ্ডহীন লাশ পড়ে। বড়োরা দেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে, বড়োকাকা মুজিব শাসন চান না, বাবা মনে করেন ছোটদেরও রাজনীতিতে অংশ নেওয়া উচিত। এর মধ্যে খোকনের বন্ধু নীলু, দাদুমণির 'মিথ্যা খাতা', দাদুমণির শোষক শোষিত ব্যাখ্যান, ছোটকাকার মেয়ের সৈন্য দেখার আগ্রহ, পুলিশের তাড়া, কবিরের তাড়া খেয়ে রাস্তায় পড়ে যাওয়া, ২৫শে মার্চের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, মুজিবের প্রেস কনফারেন্স, চতুর্দিকে আতঙ্কের ভাব ইত্যাদি আছে। উপন্যাসটিতে ছোটদের নানান স্বপ্ন ও রাজনৈতিক সংকট এ দুয়ের দ্বন্দ্বটি সমাধিত হলে আরও উৎকৃষ্ট হত। পরের উপন্যাস - পুতুল। এ গল্পের পরিবেশ স্বাধীনতা পরবর্তী কাল। অসুস্থ পুতুল স্বপ্নপ্রিয়, রেনট্রির তলায় বসে বই পড়ে, মা বকুনি দেয় জামা কাপড় ময়লা হয়ে যাবে বলে। একসময় পুতুল নিখোঁজ, থানা পুলিশ, সংবাদপত্রে পুরস্কার ঘোষণা আর পুতুল ঘোরে এখানে ওখানে, বিচিত্র মানুষ ও পরিস্থিতিতে তার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি বাড়তে থাকে। ছোটখাটো ট্রেন যাত্রাও আছে। পরের উপন্যাস - নুহাশ এবং আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ। নুহাশ এক অসুস্থ ছোট্ট মেয়ে, তার বাবা খুব আমুদে, পরোপকারী, অধ্যাপক, মা অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ মানুষ। প্রতিদিনই বাবা মার বিরোধ লাগে। শেষপর্যন্ত রেবেকা অর্থাৎ মা মিনহাজ অর্থাৎ বাবাকে উকিলের চিঠি ধরিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যত্র চলে যায়। মেয়ের মনে খুব দুঃখ, কারণ সে ভালোবাসে বাবাকেই বেশী মাত্রায়। শেষপর্যন্ত আলাদীন তার আশ্চর্য চেরাগ এনে বাবা মার মিলন ঘটায়। শিশুর দর্পণে পিতা মাতার দ্বন্দ্ব ছাড়াও কিছু মজা, কিছু গরীব-দরদ এসবও উপন্যাসটির সৌন্দর্য বর্ধন করেছে। এর পরেরটি - অন্যভুবন। এর বিষয় - অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব। ময়মনসিংহের বরকতের মেয়ে তিন্নি অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের অধিকারী, যে মানুষের মনের কথা, অনেক গণিত ও সাধারণ জ্ঞানের বিষয় বলতে পারে। সে অদ্ভুত ধরনের গাছের ছবি আঁকে একের পর এক। রেগে গেলে মানুষের ক্ষতি করে দেয়। মিসির আলি মনস্তত্ত্ববিদ, ময়মনসিংহে গিয়ে মেয়েটিকে, তার পরিপার্শ্ব অনুসন্ধান করে। এই অনুসন্ধান প্রসারিত হয় দেশবিদেশে বিজ্ঞানীদের কাছে জিজ্ঞাসার মারফৎ। শেষপর্যন্ত ব্যবসায়ী বরকত ময়মনসিংহের বাড়িটা মিসিরকে দিয়ে যায়। এই অলৌকিক ভুবনের দিকে হুমায়ুনের একটা আগ্রহ আছে। কিন্তু এটি কতখানি কিশোর উপযোগী তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
এবার কিশোরদের জন্য লেখা কয়েকটি গল্পের কথা তোলা যেতে পারে। 'গোবরবাবু' বেশ মজার গল্প। স্কুলের ব্যায়াম শিক্ষক ইয়াকুব ব্যায়ামের ওপর বই লিখেছেন, ছাত্রদের ব্যায়াম করান কবিতায়। হেডমাস্টার বিরক্ত, একদিন তিনি ইয়াকুবকে সাসপেণ্ড করলেন। বিপত্নীক ইয়াকুব মনের দুঃখে যখন খিচুড়ি রাঁধছে তখন এক ভুত এসে তার দুর্বল ছেলেটিকে সবল করার প্রার্থনা করল। এই বাচ্চা ভুত চাঁদের আলো খায়, তাকে চিবিয়ে খেতে বলা হল, জোনাকি ধরে নিয়ে আসে ইয়াকুব এর জন্য। ভুতের বাচ্চা তার কাছে থাকে। একদিন সে হেডমাস্টারকে, অন্যদিন এক ওসিকে গাছের ওপর তুলে দিয়েছিল। গোবর হল এ ভুতের নাম। কিন্তু তাকে কোনো স্কুল কলেজ ভর্তি করতে চায় না। এ গল্পে ২/১টি নীতিকথা আছে, যেমন - জগতের সমস্ত ভালমানুষ সরল ধরনের হয়ে থাকেন, অথবা স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল বা এ যুগের পড়াশোনার মান খুব নীচে নেমে গেছে (এটি অবশ্য নীতিকথা নয়, মন্তব্য)। কিছু মজার সিচুয়েশান অবশ্য আছে। কিন্তু গল্পত্বের মজা ছাড়া গল্পশৈলীর আর কি বা আছে। 'নিউটনের ভুল সূত্র' গল্পের মুখ্যচরিত্রও এক শিক্ষক যিনি বিজ্ঞাননিষ্ঠ, কিন্তু একদিন তিনি শূন্যে উঠে গেলেন, সিলিং-এ ঝুলন্ত অবস্থায় কিছু লিখলেন। সবাই ভাবল মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এক বিজ্ঞানী তো তাকে মনোচিকিৎসকের কাছে যেতে পরামর্শ দিল, লোকে ঠাট্টা করে। শেষ পর্যন্ত নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র বোঝাতে লাগলেন শীতের রাতে বানরদের। এক সময় এ অঞ্চল ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। মাঝে মাঝে তিনি একটি চরিত্রকে কেন্দ্রে রেখে তার অবস্থা, কৌতুককর পরিস্থিতি সৃজনের চেষ্টা করেন। ঝঞ্ঝাট-ভীরু মতিনউদ্দিনকে কেউ পছন্দ করে না, পাত্তা দেয় না, শেষপর্যন্ত কল্পজগতের শিশুরা তাকে ঘিরে রাখে। এখানে তিনি বিজ্ঞানবুদ্ধির প্রয়োগ করেন। স্মরণীয়, তিনি অনেকগুলি সায়ান্সফিকশন রচয়িতা। (নিমধ্যমা) আর এক গল্পে ফেল করা বড়মামা সঙ্গীত ও নাটকের আগ্রহী, কিন্তু তার খেয়ালপনার জন্য বাড়ির লোকে তাকে গাধা বলে। মামা ও নববিবাহিতা মামীর বিরোধ গল্পের শেষে আছে। মামীকে রাজকুমারী সুবর্ণরেখার সঙ্গে তুলনা করলে সে কাছে সরে আসে। (বড়মামা এবং রাজকুমারী সুবর্ণরেখা) রূপকথার আবহ আছে। 'কানা ডাইনী' গল্পে, তবে ভাবের গভীরতা কম। রূপকথার ঢং 'রাণী কলাবতী' গল্পেও। আলাদীনের প্রদীপ আবার ফিরে এল 'আলাউদ্দিনের চেরাগ' গল্পে। দৈত্যের কৃপায় শিক্ষক নিশানাথ সোনার বালতি পায়। কিন্তু তাতে চরিত্র মাহাত্ম্য কোনো দিকেই বিকীর্ণ হয়ে না উঠে গল্প শেষ হয়ে যায়। রূপকথা ও বাস্তবের মেলবন্ধন আছে 'বনের রাজা', 'হলুদ পরী', 'নীল হাতি', 'আকাশ পরী' প্রভৃতি গল্পে। 'জাদুকর' গল্পে আবার ফিরে এল অ্যাডভেঞ্চার। 'স্মৃতিচিহ্ন' একটি কিশোর নাটিকা - যাতে শিশুর করুণা, পিতা মাতার কাব্যপ্রিয়তা এক চমৎকার আবহ নির্মাণ করে। হুমায়ূন প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন শিশুদের জগৎ বুঝতে, শিশু ও বড়োদের মনোজগতের ভিন্নমাত্রাকে ধরতে। তিনি চান রূপকথা, ফ্যান্টাসি থেকে বাস্তব — নানা কিছুর মধ্য দিয়ে শিশুর সুস্থ সূক্ষ্ম মনের উন্মোচন ও ক্রমবিকাশ।
তাঁর একটি ভ্রমণ কাহিনীর বই পড়ার সুযোগ হয়েছে। বইটির নাম — দেখা না-দেখা। এই বইতে পাঁচটি দেশ ভ্রমণের কথা আছে। তা হল — চীন, ত্রিপুরা, সুইজারল্যাণ্ড, আমেরিকা, শ্যামদেশ। লেখক ভূমিকায় বলে নিয়েছেন — 'আমি ভ্রমণ বিলাসী মানুষ না।' সাধারণভাবে ভ্রমণকাহিনী থেকে আমরা কি প্রত্যাশা করি? ভ্রমণকারী যে দেশে যাচ্ছেন সেই দেশের ভৌগোলিক-সহ সামগ্রিক বিবরণ, কিছু মানুষজনের কথা, ভ্রমণ করা দেশ ও সেই দেশের মানুষ সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়ার কথা। কিছু ছবি এই ধরনের রচনার উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে থাকে। হুমায়ূনের এই বইটিতে এ সবই আছে, আবার নেই-ও বটে। ছবি আছে প্রচুর, দেশের দ্রষ্টব্য স্থানের সামনে দাঁড়ানো দলের মানুষের ছবি। কিন্তু দেশ অপেক্ষা দলের মানুষ এখানে বড়ো হয়ে উঠেছে। সফরসঙ্গী, তাদের পরিচয় যথেষ্ট দীর্ঘ। গিয়েছেন কখনও নাটকের দল নিয়ে, কখনো কনডাকটেড ট্যুরে। চীনের মতো বিরাট ঐতিহ্যসম্পন্ন দেশে গিয়ে তিনি কি দেখেছেন — নিষিদ্ধ নগরী, দীর্ঘতম কবর, ভেষজ বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রীষ্মপ্রাসাদ, কিউমিং লেক, স্বর্গ মন্দির, মহা প্রাচীর ইত্যাদি। কিন্তু বর্ণনায় দেশ মাহাত্ম্য অপেক্ষা আত্মমাহাত্ম্যই বেশী। মানুষজন, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য এসবের কোনো কথা কি আছে? আছে বিত্তবৈভবের প্রদর্শনী, আত্মম্ভরিতা, স্থূল মজা ইত্যাদি। তুষারপাত দেখে হঠাৎ রবার্ট ফ্রস্টের একটা গোটা কবিতা তুলে দেওয়ার কোনো সার্থকতা নেই। চীনে তুষারপাত নিয়ে অনেক কবিতা আছে সেসব দিলে উপযুক্ত হত। ফ্রস্টের কবিতার একটা বঙ্গানুবাদ থাকলেও হত। ত্রিপুরা ভ্রমণে ভগ্নহৃদয় প্রসঙ্গে মহারাজ বীরচন্দ্রমাণিক্যের অভিভূত হবার কথা বলেছেন, কিন্তু ভগ্নহৃদয় কাব্যের দেড় পৃষ্ঠা তুলে দেওয়ার সার্থকতা কি? এ ছাড়া আছে জীবনস্মৃতি ইত্যাদির উদ্ধৃতি। মনে রাখতে হবে এটি ১৯ পৃষ্ঠার লেখা, তাতে ১০টি বিরাট ছবি, ২টি পৃষ্ঠা ব্যাপী ছবি, তাহলে ভ্রমণকাহিনীর কি রইল পাঠক অনুমান করে নিন। সুইজারল্যাণ্ডে গেছেন, লেখকের ভাষায় — 'নাটক নাটক খেলা' করতে। বার্ণ শহরের বিজ্ঞান গুরুত্ব, আইনস্টাইন নিয়ে ইয়ার্কি (আমি বললাম, আইনস্টাইন সাহেবের খবর কী?), জুয়া খেলা, নাটকের সংলাপ আর পাতায় পাতায় ছবি — অপ্রাসঙ্গিক ছবি ভ্রমণ কাহিনীর গুরুত্ব বাড়ায় না এটি লেখক ভুলে গেছেন। আমেরিকা গেলেন স্ত্রী পুরস্কার নেবেন বলে। কিন্তু অ্যাটলান্টিক সিটি, জুয়াঘর, ভুতুড়ে বাড়ি, crystal cave প্রভৃতি নিতান্তই নামোল্লেখ থেকে গেছে। শ্যামদেশের প্রসঙ্গও এই ঐতিহ্য অনুসারী। এ বই পড়ে পাঠক উক্ত পাঁচটি দেশ সম্পর্কে কিছুই জানবেন না।
ঢাকার বাংলা একাডেমীর পি.এইচ.ডি. র স্বীকৃত একটি বইতে (বাংলাদেশের ছোটগল্পের শিল্পরূপ - চঞ্চল কুমার বোস) হুমায়ূন আহমেদের গল্প সম্পর্কে, বিশাল বইটিতে মাত্র ২টি ছোট্ট অনুচ্ছেদ আছে। অথচ আমি জানি বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদ অতি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। চঞ্চল বোসের বক্তব্য হল — তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প জীবনের ক্ষুদ্র সূক্ষ্ম আনন্দবেদনা, স্বপ্ন ও ব্যর্থতার শব্দরূপ। নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবন, তার বিচিত্র আকাঙ্খা ও অনুভূতি, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির নিভৃত উন্মোচন ঘটেছে হুমায়ূন আহমেদের গল্পে। ব্যক্তি জীবনের অম্লমধুর অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ের জীবন যন্ত্রণার অন্তরঙ্গ রূপটিকে সরল বর্ননার মাধ্যমে তুলে এনেছেন গল্পকার। খণ্ড ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা এক বিপুল জীবনসত্যের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে তাঁর গল্পে। মানুষের ক্ষুদ্র চাওয়া পাওয়া, সুখ দুঃখ, মিলন বিষাদই তাঁর গল্পের উপজীব্য।' কিন্তু পাঠক যদি হুমায়ূন এর লেখা পড়েন তাহলে তার চোখে পড়বে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ের জীবন যন্ত্রণার ছবি হুমায়ূনের কথাসাহিত্যে প্রথাগতভাবে অনুপস্থিত। মুক্তিযুদ্ধকালীন ব্যক্তিগত ভয়াবহ স্মৃতি থেকে সম্ভবত হুমায়ূন উত্তীর্ণ হতে চান তাঁর নিজের মাতো করে এবং সেই কারণেই তিনি মোটেই মধ্যবিত্ত জীবনের রূপকার নন। বিপুল জীবনসত্যের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয় শিল্পনির্মাণের বিস্ময়কর নৈপুণ্যে। তাঁর লেখায় সরলতা আছে, লোকচলতি কথা আছে, মজা আছে, স্বপ্ন কল্পনা আছে, ফ্যান্টাসি আছে কিন্তু পৃথিবীর ছোটগল্পের ইতিহাসের কথা বাদ দিচ্ছি, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের রচনায় যে জীবনসত্যের আশ্চর্য শিল্প নৈপুণ্যের সঙ্গে আমরা পরিচিত, দুঃখের বিষয় তা হুমায়ূনের রচনায় অতি সামান্য। প্রশ্ন উঠবে, তিনি এতো জনপ্রিয় কেন? এর উত্তর স্পষ্ট জানি না। তবে অনুমান করতে পারি। যেসব পাঠক সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গকে সযত্নে এড়িয়ে একধরনের মিঠা গল্পে স্বর্গ আবিষ্কার করতে চান, এই লেখক তাঁদেরই আদর্শ। তাঁর রচনা থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো আইডিয়া করা অসম্ভব। বরং কিশোর-গল্পে তাঁর কৃতিত্ব, কিশোর মনের স্বপ্নিল আনন্দ ও বিষাদে তিনি বৃহত্তর পাঠক পেতে পারেন, কিন্তু সিরিয়াস কথাসাহিত্যে তিনি উপভোগ্যতা দিয়েছেন, কিন্তু বারংবার পাঠযোগ্যতা দিতে পারেন নি।