৩ এপ্রিল ২০১২, রাত এগারোটা এগারো -
এবারের পাড়ি উত্তরবঙ্গের অচেনা কোলাখাম আর চারখোলের খোঁজে।
৪ এপ্রিল সকাল পৌনে ন-টা -
নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে দার্জিলিং মেল হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। গরম তেমন নেই। তবে আকাশবাবুর মেজাজ ভালো নয়। এবার বোধহয় কাঞ্চন-দর্শন কপালে নেই।
সকাল দশটা দশ -
রেলগেট বন্ধ, তায় চা মোমোর গন্ধ — গাড়ি থেকে নামিয়ে ছাড়ল।
সকাল দশটা চল্লিশ -
জীবনে প্রথমবার করোনেশন ব্রিজ (অনেকে বলে বাঘপুল, যদিও পুলের মুখে মূর্তিদুটো স্নো লায়নের) পেরোলাম। এবার উলটোবাগে ছুট।
বেলা সোয়া এগারোটা -
চা বাগানের বুক চিরে ছুটতে ছুটতে ওদলাবাড়ি পেরিয়ে ডামডিম এসে গাড়ি দম নিল। এবার বামপন্থা।
ঠিক দুপ্পুরবেলা -
রাণীছেড়া, সাইলি, রাঙামাটি, ফাগু — দিগন্তবিস্তৃত চা বাগানের পর চা বাগান পেরিয়ে গরুবাথান। অবশ্য তিনটের বেশি গরু চোখে পড়ল না — বোধহয় অন্যত্র চরতে গেছে।
বেলা একটা বাজতে দশ -
অ্যামবিওক চা বাগান ছুঁয়েই গাড়ি পাক মেরে মেরে চড়াই ভাঙতে শুরু করেছিল। এঁকতে বেঁকতে এসে পড়লাম লাভার গুম্বার গা ঘেঁষে। ২০০১-এ দেখা বুনোফুল লাভা আজ কেয়ারি করা মস্ত ফুলবাগান — কালিম্পং বলে ভুল হয়। লাভার গুমোরে বিরক্ত হয়েই বোধহয় গাড়ি হঠাৎ ডাইনে মোচড় মেরে সন্দকফু মার্কা পথ ধরল।
বেলা দেড়টা -
ঘন বনের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে টাট্টু ঘোড়ার মতো লাফাতে লাফাতে নেমে এনে ফেলল কোলাখাম-এ। ঘন বনের বুকে প্রকৃতির খোলা খাম কোলাখাম। স্থানীয় মানুষদের আতিথ্যে বসবাস। এ গাঁয়ের সবাই 'রাই', সবাই ঘোর নিরামিষাশী। তবে অতিথিদের জন্য আমিষের আয়োজন আছে। সবুজ বনের মাঝে সবুজ মনের মানুষদের রঙিন ফুলের মতো সব ঘরবাড়ি। বন জুড়ে ফুল আর পাখির বাড়াবাড়ি — তারা হাওয়ায় দোলে, সুর তোলে। ঝুলবারান্দার নিচের ঢাল এলাচ বন পেরিয়ে ঝাঁপ মেরেছে অতলে। ওখানেই কোথায় ছাঙ্গে ফল্স্। সবুজের ঢেউয়ের পরে ঢেউ গিয়ে ঠেকেছে মেঘের পাঁচিলে। তার ওপারে কাঞ্চনজঙ্ঘার আপাত অজ্ঞাতবাস।
বিকেল পাঁচটা -
দুপুরে 'ভুঁড়িভোজনের' পর পরম আলস্যে প্রকৃতি বীক্ষণ। গতকালের শিলাবৃষ্টিতে বিজলিবালা নিরুদ্দেশ। তাঁকে আনার সাধ্যসাধনা চলছে। আমাদের চলছে চা পর্ব।
সন্ধে ছ-টা -
চারিদিক ছায় মেঘে, খরবায়ু বয় বেগে। এরই মাঝে চাঁদ এসে জানান দিল — রাত আসছে। তারপরই মুখ লুকোলো মেঘের আঁচলে। শীতবাবাজি মোমবাতির আলোয় জাঁকিয়ে বসলেন।
সন্ধে সাড়ে ছ-টা -
অবশেষে অভিমানিনী বিদ্যুৎকুমারীর প্রত্যাবর্তন, মোমবাতি গেল বিশ্রামে।
রাত ন-টা তেত্রিশ -
মেঘের চাঁদোয়ায় ঢাকা কোলাখামে পেটবাবাজি 'কখন খাম কখন খাম' লাগিয়েছেন, কিন্তু খানার দেখা নেই। এখানে কি মেঘ জমলে খেতে দেওয়া বারণ! এট্টু আগে খানিক কেঁদে নিল আকাশ — ওরও কি খিদে পেয়েছে? মিশকালো অন্ধকারে দূরে অসংখ্য বাতির জোনাকি, মাঝেমধ্যে চরাচর ঝলসে বিদ্যুতের ফ্ল্যাশ বাল্বের ঝলকানি — অদ্ভুত আঁধার এক, রোমাঞ্চের আধার। মন্দ লাগছে না নেহাৎ। শুধু পেটে সাতশো ছুঁচোর ডিস্কো ডান্স।
রাত ন-টা উনপঞ্চাশ -
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে — জোছনায় স্নান করছে কোলাখাম। অপূর্ব দৃশ্য। তবে, খালি পেটে আর কতক্ষণ অপূর্ব লাগবে জানি না। নিঝ্ঝুম কোলাখামে এখন শুধু কুকুরের বকুনি। ওরও বোধহয় ডিনার জোটেনি এখনও।
রাত দশটা দশ -
অবশেষে খানা এসেছে থালাবাটি ভরে। অলিম্পিকের রেকর্ড ভাঙা দ্রুততায় বাসনগুলো খালি হয়ে গেল। ভোজনান্তে আরাধনা — নিদ্রাদেবীর।
৫ এপ্রিল, সকাল ছ-টা -
সকাল সাড়ে ন-টা -
দুরন্ত চমক! আমাদের লজের সামনে থমকে দাঁড়ানো গাড়িটায় ওরা কারা? সুরঞ্জন, রুমা, সুরঞ্জনের মা, মানিকদা, গুঞ্জাদি, শিখাদি। বহুদিনের বন্ধুর দল। ওরাও গতকাল এসেছে কোলাখামে। আছে আমাদের মাথার উপরে। এখন চলেছে ছাঙ্গে ফল্স্ দর্শনে। হাসি ঠাট্টায় দুমুহূর্তে মনের কোণের মেঘ উধাও। ঠিক হল সন্ধ্যায় বাঙালির প্রিয়তম কাজে বসা যাবে — আড্ডা। এবেলা দু দল দুমুখো।
সকাল সাড়ে দশটা -
ভবঘুরে পবননন্দন (মারুতি জিপ্সি) আমাদের নিয়ে রওনা হলেন।
দুপুর সোয়া বারোটা -
নির্জন বনপথে বাড়তি সীট এবং টায়ার বাবাজিরা অভিমান করে নেমে পড়েছিলেন। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে খানিক সময় গেল। তারপর লাভা, ছ-মাইল, রিকিসাম হয়ে আলগাড়ায় এসে গাড়ি দম নিল। সৌভাগ্য এমনই, এখানেই লক্ষ্মীলাভ হয়ে গেল। প্রযুক্তির উন্নতি এখন বড় শহর ছাপিয়ে এই আধা শহরেও থাবা গেড়েছে। সমস্যার সমাধান হলেও, কালিম্পং ভ্রমণ জারি রইল। আমাদের 'শৈলশহর' দর্শন ছাড়াও গাড়িবাবাজীবনের ডাক্তার দেখানো দরকার ছিল। অতএব — ফরোয়ার্ড মার্চ।
বেলা একটা পাঁচ -
বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে দেখলাম কালিম্পংয়ে যেমন গরম, তেমনই ভিড়। অফিস টাইমের ধর্মতলা হার মানে এমন ট্র্যাফিক জ্যাম! প্যাঁচে পড়ে কালিম্পংয়ের পাঁচন গিলতে লাগলাম। গায়ে গায়ে বাড়ি, ঘাড়ে ঘাড়ে গাড়ি — একেবারে অচলায়তন।
বেলা একটা পঞ্চাশ থেকে পৌনে তিনটে -
গরম আর বিরক্তিতে ভুলে গিয়েছিলাম খিদের কথা। 'গোম্পু-জ'-এ চাউমিনের প্লেট সামনে আসতেই খিদে মহারাজ ব্যাঘ্রঝম্পনে হাজির। পেট ভরতে শরীর মন দুই-ই ঠাণ্ডা হল। তার ওপর কয়েকজন সন্দেশীর সঙ্গে দেখা! বুকটা হালকা হয়ে গেল। এবার ফেরার পালা।
বিকেল পাঁচটা -
আবার কোলাখাম। আবার বনানী। আবার ফুল, পাখি। আবার শান্তি। আবার ডি. কে. রাই, হেম, কমলা আর রুপ্পলের আদরযত্ন। আমাদের এত সুখ আকাশের সইল না। সে মুখ ভার করল।
'রাত' সাতটা -
রুমা, গুঞ্জাদি, শিখাদির সঙ্গে উচ্চকিত আড্ডায় আমাদের ঘর সরগরম।
রাত সোয়া আটটা -
রুমাদের যাওয়া আর বৃষ্টির আসার সমাপতন।
৬ এপ্রিল, সকাল ছ-টা -
সারারাত বৃষ্টিধারার পতন শেষে সাময়িক বৃষ্টিবিরতি। মেঘেরা শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে সরে বসেছে। এই সুযোগে ছাঙ্গের সঙ্গে মোলাকাত করে আসা যাক।
সকাল সাড়ে আটটা -
গাড়ি গড়ালো। হেমের কাছে জানা গেল একমাত্র এই পাহাড়েই আখরোট গাছ পাওয়া যায়, তাই এই গ্রামের নাম কোলা (আখরোট) খাম। এখানকার আদি বাসিন্দা ছিল লেপচারা, তারাই এই নামকরণ করেছিল। কালে কালে লেপচারা এখানকার পাট চুকিয়ে চলে যায় সিকিমে। তার জায়গায় নেপালী রাইরা এসে জায়গাটাকে আপন করে নেয়।
সকাল ন-টা -
অরণ্যের বুক চিরে ছ'কিলোমিটার গিয়ে একটা বাঁকে এসে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল — এই নির্জনে একটা চায়ের দোকান! জানা গেল, ছাঙ্গের সঙ্গে মোলাকাত করতে চাইলে এবার আধ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে নামতে হবে। তা নাহলে তার শব্দ শুনেই শখ মেটাতে হবে — শ্রবণেন অর্ধদর্শনম্।
সকাল ন-টা দশ -
সকাল ন-টা তেতাল্লিশ -
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছাঙ্গের সঙ্গ ত্যাগ করে উঠে আসতে হল; একে তো অর্ধাঙ্গিনী অশোকবনে, থুড়ি চায়ের দোকানে একা (না, মানে ঠিক একা নয়), তায় আজ আবার চারখোল যেতে হবে।
সকাল সাড়ে দশটা -
বিদায় কোলাখাম। বিদায়বেলায় খাদা পরিয়ে রাইয়েরা ভালোবাসার চিরবন্ধনে বেঁধে ফেলল। পাখিরাও আমাদের বিদায় সংবর্ধনা জানাল।
বেলা পৌনে বারোটা -
আমাদের কোলাখাম ছেড়ে চারখোল যাওয়াটা বোধহয় আকাশের পছন্দ হচ্ছিল না। লাভা ছাড়িয়ে লোলেগাঁওমুখো হতেই তার মুখ গোমড়া হতে শুরু করেছিল, এখন তো রীতিমতো কালো। গুম্বাদাঁড়ার একমাত্র লজের সামনে একটু দাঁড়াতেই তার মুখ কাঁদো কাঁদো। মেঘেরা এসে পথের উপর এমন চেপে বসেছে যে চারদিক থেকে থেকেই 'নেই' হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক মান অভিমানের দৌলতে রাস্তার অবস্থা যাচ্ছেতাই। গাড়ি যেন 'ডান্স বাংলা ডান্স'-এ যোগ দিয়েছে।
বেলা সাড়ে বারোটা -
শুরু হয়ে গেছে কান্না। পান্নাসবুজ বনানীর ফাঁকফোঁকর দিয়ে সে কান্না ঝরছে ঝরোঝরো।
বেলা একটা -
লোলেগাঁওয়ে চা-বিরতি। তাছাড়া ঝাঁকুনিতে আলগা হয়ে যাওয়া হাড়গোড়গুলো ঠিকঠাক করে নেওয়ারও দরকার ছিল। বৃষ্টি এখন মুষলধারা। লোলেগাঁও বাসস্ট্যাণ্ডের দোকানপাট, গাড়ি-টাড়ি, মানুষজন, গাছপালা সবাই অনিচ্ছাস্নান করছে। চারখোল এখান থেকে ১৪ কিলোমিটার, তাও কোলাখাম মার্কা কাঁচাপথে। নেহাৎ গরম চা পেটে পড়েছে, তা নাহলে উৎসাহ-টুৎসাহ জমে কুলফি মেরে যেত।
বেলা দেড়টা -
কান্নার বহর একটু কমেছে। গাড়ি চড়াইপথে গোঁৎ মারল।
বেলা দুটো বত্রিশ -
ঝাঁকুনিভরা কিন্তু অপূর্ব সুন্দর বনপথ বেয়ে এসে পড়লাম ঝকঝকে পিচরাস্তায়। হেম উবাচ — এই পথ ওদলাবাড়ি থেকে বাগরাকোটে পাহাড়ে চড়ে নিমবং ছুঁয়ে এসেছে। ভেজা পিচের কালচে রংটা এখন অপরূপ লাগছে। আকাশের কান্না থামলেও মুখ গোমড়া।
বেলা দুটো চুয়াল্লিশ -
আবার কাঁচাপথ, তবে পাথরে বাঁধানো। মাঝে মধ্যেই পথের ধারে বাড়িঘর, ব্যাকগ্রাউণ্ডে ঘন সবুজবন। চারখোল কি এসে গেল।
বেলা দুটো তিপ্পান্ন -
বেলা তিনটে -
পৌঁছে গেছি আস্তানায়। রীতিমতো আরামদায়ক ব্যবস্থা। সামনেই পথ পাইনবন ঘেঁষে উঠে গেছে ঠংয়ে। আফশোস হচ্ছে, কেন মাত্র একদিনের জন্য এলাম। ডি. কে. রাই আর হেম বিদায় নিল। বিদায়বেলায় আকাশও একঝলক কান্না ঝরিয়ে নিল।
সন্ধ্যা ছ-টা -
রাত আটটা -
বিজলীবালার প্রত্যাবর্তন, বর্ষাদেবীরও।
রাত সাড়ে আটটা -
বৃষ্টিতে ভিজে চুব্বুস হয়ে ঘরে খাবার দিয়ে গেল বিজয়। আতিথেয়তার চূড়ান্ত। এই ভালোবাসার বাঁধন কাটানো ভারি মুশকিল।
৭ এপ্রিল, সকাল সাতটা-
সকাল পৌনে আটটা -
বিদায় চারখোল, বিদায় কোলাখাম। কথা দিচ্ছি, আবার আসব।