• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫১ | জুন ২০১২ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • সতীর্থের শ্রদ্ধাঞ্জলি : প্রবুদ্ধ বাগচী


    রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন; ক্ষিতিমোহন সেন; পুনশ্চ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১১, ISBN 978-81-85479-61-5

    ১৯০৭ সালে সাতাশ বছরের এক তরুণ যুবার কাছে এসে পৌঁছেছিল তাঁর চিঠি। তরুণটি তখন অনেক দূরে হিমালয়ের কোলে এক নির্জন শহরে সম্পূর্ণ অন্য এক প্রেক্ষিতে প্রস্তুত করছেন নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের রূপরেখা। আর ভিন্ন এক অক্ষাংশে-দ্রাঘিমাংশে বোলপুর শান্তিনিকেতনে ঠিক তার আগেই শুরু হয়েছে বৃহত্তর এক কর্মযজ্ঞ। সেই মহত্তর কর্মসূচীর ঋত্বিক হিসেবেই রবীন্দ্রনাথ সহযোগিতা চাইলেন ওই প্রবাসী যুবাপুরুষের। প্রাথমিকভাবে তিনি কুণ্ঠিতই ছিলেন এই অজানা এক দায়ভার বহনে। তাছাড়া, তাঁর সেই সময়কার বন্ধু সহচরদের কেউ কেউ তাঁকে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ একজন অভিজাত ধনাঢ্য পুরুষ, তাঁর বিলাসী জীবনচর্যার সঙ্গে তার মতো সাধারণ মানুষের তাল মেলানো কঠিন। তবু যে কোনও ইতিহাসের মধ্যে কিছু ব্যাখ্যাহীন মুহূর্ত থাকে যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে কল্পান্তরের ভ্রুণ। এও ঠিক তেমনই। সংকোচ আর কুণ্ঠার দ্বৈরথ পেরিয়ে যুবা ক্ষিতিমোহন অবশেষে এসে দাঁড়ালেন একদিন বোলপুর স্টেশনে। সেটা ১৯০৮ সনেরই আষাঢ় মাসের এক বৃষ্টিভেজা সকাল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেদিন স্টেশনে এমনকী কোন গরুর গাড়িও নেই। অগত্যা বৃষ্টি মাথায় করেই তিনি হেঁটে চললেন শান্তিনিকেতন আশ্রমের দিকে। সেই বর্ষণসিক্ত সকালে আবারও তৈরি হচ্ছিল ইতিহাস। কেননা আগামী অর্ধশতকেরও বেশি সময় এই শান্তিনিকেতনই হয়ে উঠবে তাঁর আশ্রয় ও আবাস। একজন যুগপুরুষের কর্মবৃত্তের একান্ত সহচর হিসেবে এরপর আমরা পাব তাঁকে। তাঁর শিক্ষণ, মনন, বৈদগ্ধ্য আলোকিত করবে শান্তিনিকেতনের পথ ও প্রান্তর - কর্মী থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বরণ করে নেবেন আচার্যের আসনে।

    শান্তিনিকেতন গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন অথবা যাঁরা একেবারে গোড়ার দিকে ছাত্র হিসেবে এসেছিলেন সেখানে, তাঁরা প্রায় সকলেই তাঁদের বর্ণময় অভিজ্ঞতার কথা লিখে রেখে গেছেন নানাভাবে। তাঁদের সেই অভিজ্ঞতার সমস্ত মানচিত্রের কেন্দ্রে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁকে ঘিরে আবর্তিত আশ্রমিক জীবন। যে জীবনের বৃত্তে কোথাও একটা বৃহত্তর স্বপ্ন ছিল, সংকল্প ছিল, ছিল একটা অবিচল আদর্শের প্রতি সম্মাননা - আর, এই সমগ্রতাটাকে পক্ষীমাতার মতো দু-ডানার আড়ালে আগলে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সৃজনে, যাপনে আর ধ্যানে। শান্তিনিকেতন-পর্বে কর্মী রবীন্দ্রনাথের যে আদল তা যদি সত্যিই কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় তা এইসব লেখালেখির মধ্যেই আমরা খুঁজে পাব। ক্ষিতিমোহন সেনের নানা রচনাতেও সেইসব অভিজ্ঞতার নির্যাস, যার মধ্যে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের অবয়ব, আশ্রমজীবনের নানা খুঁটিনাটি। যে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তিনি শুনেছিলেন বিলাসী জীবনযাপনের কথা, শান্তিনিকেতনে পৌঁছে তিনি দেখলেন 'দেহলী' নামের অতি-সংকীর্ণ এক বাড়িতে কেমনভাবে দিন কাটাচ্ছেন এক কবি। সেই বিশেষ সময়ে রবীন্দ্রনাথের সংসারে অর্থাভাব; মাত্র কয়েকটি পোশাক নিয়মিত ধুয়ে-শুকিয়ে পরতে হচ্ছে তাঁকে, কিন্তু এ নিয়ে তাঁর কোনও সমস্যা নেই। একজন মানুষের প্রতি আরেকজনের শ্রদ্ধা ঠিক কেমনভাবে উদ্গত হয় তার কোনও সাধারণ সমীকরণ নেই, কিন্তু তার কতগুলো ধাপ নিশ্চয়ই আছে, যে-পথ দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারে যে-কোনও মানবিক অনুভব। সেই সূত্রগুলো আপাত-তুচ্ছ হলেও গুরুত্বের বিচারে অনেকটাই ভারী।

    তবে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের বাইরেও রবীন্দ্রনাথের সৃজনসম্ভার নিয়েও বেশ কিছু রচনা সংকলিত হয়েছে এই বইয়ে। মোট ছেচল্লিশটি নিবন্ধের মধ্যে কয়েকটি রচনা রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালেই প্রকাশিত হয়েছিল 'প্রবাসী' 'দেশ' প্রমুখ পত্রিকায়। বাকি লেখাগুলি রবীন্দ্র-প্রয়াণ পরবর্তী সময়ে লেখা, যা প্রকাশিত হয়েছিল 'ভারতবর্ষ', 'দেশ', 'আনন্দবাজার' ইত্যাদি খ্যাত পত্র-পত্রিকায়। উল্লেখ করা যেতে পারে আনন্দবাজার পত্রিকার ছোটদের পাতার সম্পাদক বিমল ঘোষ (মৌমাছি) একসময় নিয়মিত ক্ষিতিমোহন সেনকে আমন্ত্রণ করে তাঁর বিভাগে লিখিয়েছেন। ছোটদের জন্য তাঁর রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক কিছু লেখাও স্থান পেয়েছে এই সংকলনে। স্বল্প পরিসরে রবীন্দ্রজীবনের মহত্বকে ছোটদের কাছে তুলে ধরায় এই রচনাগুলির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

    অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গানের বিষয়ে ক্ষিতিমোহনের মূল্যায়নভিত্তিক আলোচনাগুলিও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। বিশেষত, আমরা জানি, প্রাচীন ভারতের সন্ত-সাধক ও বাউলদের বিষয়ে তাঁর ছিল এক বিশিষ্ট অভিনিবেশ ও সেইসব সাধকদের জীবনদর্শন বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল অপার। অন্য দিকে, বৈদিক শাস্ত্র ও শ্রুতি-স্মৃতি-সাহিত্য-ব্যাকরণ-অলঙ্কারশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ক্ষিতিমোহন তাঁর এই মেধার আলোয় বিচার করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে। মহৎ সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে গুণিজনরা নানান পথের পথিক হয়ে উঠতেই পারেন, নানা আলোয় দেখতে পারেন রবীন্দ্রনাথের সৃজনভাণ্ডারকে। তবে আচার্য ক্ষিতিমোহনের মেধা ও মনস্বিতাকে সম্পূর্ণ সম্মান জানিয়েও এই কথা বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের কবিতা-গল্প-নাটক-গান-উপন্যাসের মধ্যে যে আনকোরা আধুনিকতার স্পর্শ ঐতিহাসিকভাবে সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে তার সমস্তটাকেই বৈদিক বা বৈষ্ণবীয় দর্শন কিংবা লোকায়ত দর্শনের দিক দিয়ে ব্যাখ্যা করতে গেলে কোথাও একটা একপেশে ঝোঁক পড়ে। আধুনিক সাহিত্য-সমালোচনার তত্ত্ব বরং একজন স্রষ্টার মধ্যে সমস্ত ধরনের ভাবনার সমাহারকেই খুঁজে পেতে পছন্দ করে। রবীন্দ্রভাবনার স্তরে স্তরে এমন অনেক উপাদান রয়েছে যার সবটাই বিশেষ কোনও একটা দর্শনের অনুগত বলে ভেবে নিতে আমাদের আপত্তি থাকতে পারে। তবে তাঁর জীবনচর্যা ও জীবনবীক্ষার মধ্যে মূল সুর হিসেবে উপনিষদের দর্শনের একটা ভূমিকা ছিল এটা মেনে নিতে কোনও বিতর্ক নেই। একইভাবে দ্বন্দ্বহীনভাবে মেনে নেওয়া যায় তাঁর গ্রহিষ্ণু মন নানান সূত্র থেকে আহরণ করেছে ভাবনা ও প্রণোদনার সূত্র। সেইসব ভাবনা-অনুভাবনার অভিক্ষেপ ছড়িয়ে আছে তাঁর পরিব্যাপ্ত লেখালিখির ভিতর।

    তবে ক্ষিতিমোহন সেনের সংকলিত রচনাগুলি মূলত একটি নির্দিষ্ট সময় সীমানার মধ্যে লিখিত এবং ১৯৬০ সালে তাঁর প্রয়াণ ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশ-দুনিয়া-সময়-দীক্ষা এবং দেখবার চোখ অনেকটাই পাল্টে গেছে। নতুন শতাব্দীর নাগরিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে আমরা নব নব রূপে নিরন্তর আবিষ্কার করে চলেছি। তাই একটা ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকেই এইসব লেখাগুলোকে বিবেচনা করলে আমাদের সুবিধে ও স্বস্তি। বরং গোটা সংকলনটির প্রধানত দু-ধরনের রচনা থেকে নিবিড় করে পাওয়া ও একান্ত ঘরের মানুষ রবীন্দ্রনাথের যে-ছবি নানাভাবে এসে পড়ছে পাঠকের কাছে সেগুলোই আমাদের প্রাপ্তি। এই আন্তরিক ছবি অন্য কোনও সূত্রে আমাদের পাওয়া সম্ভব ছিল না। তারই দু-একটা উদাহরণ ভাগ করে নিতে চাইব পাঠকদের সঙ্গে।

    যেমন, প্রতি সন্ধেবেলা শান্তিনিকেতনে ছোট ছেলেদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জমজমাট গল্পগুজবের মধ্যে আলাদা করে একটি ন-দশ বছরের ছেলে কবির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল, 'তুমি নাকি কবিতা লেখো?' কবি বললেন, 'লিখি বই কি ভাই?' ছেলেটি বলল, আমিও লিখি। কবি তখন তাকে আদর করে বললেন, তাই নাকি? বেশ তো! এবার আমরা দুজনে মিলে কবিতার বই বার করব। এই পৃথিবীতে আর কখনও তারা একসাথে কবিতার বই বার করতে পারেননি। অল্পদিন পরেই ওই ছেলেটি যার ডাক নাম ছিল গুলু, মারা যায়। 'ডাকঘর' লিখবার সময় এই ক্ষণজন্মা বালকেরই ছবি এসে পড়েছিল কবির মনে। আবার, নিজের গান নিয়ে তাঁর যে আজীবন আগলে রাখা এক প্রত্যয় ও স্বাতন্ত্র্য তার এক দৃষ্টান্ত পাই তাঁর এক বয়স্য আত্মীয়ের জবানিতে। 'রবিকাকা যখন বিলাত হইতে ফিরিলেন তখন তাঁহার সব দামি দামি বিলাতি স্যুট বৃথা ঘরে পড়ে রহিল। তাই সেগুলি একদিন তাহার কাছে চাহিলাম। কিন্তু তা দিতে তিনি রাজি হইলেন না। আর কোনো উপায়ে আদায় করিতে না পারিয়া এক উপায় ঠাওরাইলাম। তাঁহার সব প্রিয় গান আমার কণ্ঠে দারুণ বেসুরে গাহিতে লাগিলাম। তিনি একেবারে ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। বাধ্য হইয়া আমাকে সবগুলি স্যুট দিয়া নিবৃত্ত করিলেন।' মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

    তবে একেবারে শেষে সবিনয়ে একটা কথা বলতে চাই। রবীন্দ্র-অনুরাগী বৃত্তের একেবারে ভিতরে থেকে যাঁরা পরবর্তী সময় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখালিখি করেছেন তাঁদের সকলের চোখেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গুরুদেব - অর্থাৎ যিনি একই সঙ্গে গুরু এবং একই সঙ্গে দেব। এরকম একটা দেবত্বের জায়গা থেকেই তাঁরা কবিকে বিচার করেছেন। শেষ বয়সে কবি সকালে যখন লেখার টেবিলে বসে লিখছেন তখন মাঝে মাঝেই একজন করে এসে তাঁকে প্রণাম করে চলে যেতেন। বেশিরভাগই মহিলা। লোকে যেমন মন্দিরে ঢুকে ঠাকুর প্রণাম করে। এই দৃশ্য দেখে অস্বস্তিতে পড়েছিলেন সাহিত্যিক বনফুল, যা তিনি লিখেও গেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। আচার্য ক্ষিতিমোহনকে একটুও অশ্রদ্ধা না করে বলা দরকার, এইসব স্মরণীয় লেখাগুলির মধ্যেও এইরকম ভক্ত-ভগবানের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময়ই চোখে পড়ে। আমরা যাঁরা একজন কবিকে তাঁর রক্ত-মাংস-স্নায়ুর অবয়বেই দেখতে চাই তারা এই বিচারের সামনে কিছু আড়ষ্ট বোধ করব, যদিও তাতে লেখাগুলির ঔজ্জ্বল্য কিছু ম্লান হয় বলে মনে করছি না। তবু এইটুকু পাঠকদের জানিয়ে দেওয়া ভাল।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments