টুসির সঙ্গে সেদিন আমার আড়ি হয়ে গেল। কারণটা গুরুতর। ঘটনাটা বলি।
রোজ বিকেলবেলা যে-সময় ওকে নিয়ে বেড়াতে যাই ঠিক সেই সময়ই সেদিন আমার কলেজের এক ভদ্রলোক এসে হাজির। তারপর চা খেতে খেতে রাজা-উজির-মারা গল্প হাসি-ঠাট্টায় বেশ জমে গেলাম। মাঝে মাঝে অস্বস্তি হচ্ছে এই ভেবে যে টুসি যদি এখন এসে পড়ে তাহলেই মুশকিল। টুসিকেও অসম্মান করতে পারি নে, ভদ্রলোককেও তাড়াতে পারি নে। দোটানায় পড়ে যাব যে।
এমন সময় যা ভেবেছি তাই, টুসি এসে উপস্থিত। মা তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে, গালে পাউডার মাখানো, মিষ্টি গন্ধ বেরুচ্ছে, মাথায় ঝুঁটি করে চুল বাঁধা।
আমি তখন গল্পে মশগুল, একটা সিগারেট ধরিয়েছি, হাতে চায়ের কাপ, পায়ের ওপর পা তোলা, লুঙ্গির মতো করে ধুতি পরনে, গায়ে হাত-কাটা গেঞ্জি, এখুনি উঠব আমার ভঙ্গিতে এমন কোনো লক্ষণ নেই। টুসি পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল, চলার ছন্দে ছন্দে মাথার ঝুঁটিটা অল্প অল্প লাফাচ্ছে, হাতে কাচের চুড়ির রিনিরিনি, সব মিলিয়ে ভারি মিষ্টি দেখতে লাগছে। চোখের কোনায় দেখলাম আমার অবস্থা দেখে মুখটা একটু কালো হয়ে গেল। হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে দু’হাতের তালুর মধ্যে মুখ রেখে পাশের ডিভানটার ওপর বসে পড়ল। দেখতে পাচ্ছি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে, চোখে স্পষ্ট অভিমান। বুঝতে পারছি কোনো অঘটন ঘটবে, অজানা আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে আছি। এদিকে ভদ্রলোকও সহজে উঠবেন বলে মনে হচ্ছে না, আমিও উস্খুস্ করছি।
ঢংঢং করে ঘড়িতে ছ’টা বাজল, ঘণ্টার সঙ্গে সঙ্গে আঙুলের কড় গুনল টুসি। ছায়াভরা বর্ষার দিন। বাইরে তখনই বেশ অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। টুসি একবার ঘড়িটার দিকে চাইল, আমার কাছে সদ্য-শেখা বিদ্যেটা কাজে লাগিয়ে মনে মনে বোঝার চেষ্টা করল যন্ত্রটা কি বলছে। পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে আবার আমার মুখের ওপর চোখ রাখল। কী অভিজাত তার সৌজন্যবোধ, শুধু নির্বাক ইঙ্গিতে আমাকে কেমন লজ্জিত করে তুলল! কিন্তু না, এখন আর অভিমান নয়, মেঘ ভেঙে বুঝি বৃষ্টি নামার উপক্রম করছে, টুসির চোখ যেন ছল্ছল্। এদিকে আমি নিরুপায়, ভদ্রলোক তখন তাঁর আজকের বাজারের ফর্দ শোনাচ্ছেন।
সাড়ে ছ’টার একমাত্র ঘণ্টাটা বাজল। ভদ্রলোক তখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। উনি একটু খেয়ালি হলেই টের পেতেন যে আমি কেবলই অনেকক্ষণ থেকে অন্তঃসারশূন্য ‘হ্যাঁ’ ‘হুঁ’ করে যাচ্ছি। ডিভানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম টুসির মুখ ফের গম্ভীর হয়ে উঠেছে, চোখে আর জল নেই, মাথাটা অল্প নিচের দিকে নামানো, চোখের দৃষ্টি মাটির দিকে। তার হাবভাবের নাড়িনক্ষত্র আমার জানা; বুঝলাম, খেপেচে।
ভদ্রলোক যখন উঠলেন তখন ঘড়িতে সাতটা বেজে ষোল মিনিট, এবং যাবার পথে ভদ্রলোক আমার বারোটা বাজিয়ে গেলেন। দেয়ালে হেলানো তাঁর ছাতাটা হাতে নিয়ে পায়ে কর্দমাক্ত চটিটা গলাতে গলাতে তাঁর বাড়ির মোড়ে কেমন জল জমেছে আর তাতে কর্পোরেশনের অসার্থকতা কেমন টল্টল্ করছে সে-বিষয়ে মন্তব্য করতে করতে হঠাৎ থেমে গেলেন।
আজ মনে হচ্ছে ট্র্যাজেডির চরম মুহূর্তে যেন রঙ্গালয়ে সমস্ত বাজনা থেমে গিয়েছিল, সমস্ত আলো নিভে গিয়ে একটি আলো থমকে দাঁড়িয়েছিল, নিবিষ্ট হয়েছিল একটি জায়গায়, চূড়ান্ত আঘাতটা নামবে বলে।
উনি টুসির দিকে ফিরে আমায় বললেন, - আচ্ছা বিলাসবাবু, এই মেয়েটিকে তো চিনলাম না।
আর আমিও আমার জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক ভুলটা করে ফেললাম।
টুসিকে আমি ওর সাক্ষাতে অসাক্ষাতে সকলের কাছে পরিচয় দিই ‘আমার মেয়ে’ বলে। কিন্তু এতোক্ষণ টানা বক্বকে আর সরব টুসির নীরব প্রতীক্ষায় আমার মাথা গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, তাই সমস্ত ভুলে গিয়ে বলে ফেললাম, - এটি নিচেরতলার ভাড়াটের মেয়ে। ওকে নিয়েই রোজ বিকেলে বেড়াতে বেরোই। আজ হল না, হেঁ হেঁ –
বলেই বুঝলাম কিছু একটা গোলমাল করে ফেললাম।
ভদ্রলোক চলে গেলেন। আমি গেট বন্ধ করে যখন ফিরে আসছি দেখলাম টুসি সিঁড়ি বেয়ে নামছে ওদের ঘরের দিকে। ওর চুলের ঝুঁটিতে আল্তো টান দিয়ে ধরে রাখলাম। হাত ধরে নিয়ে এলাম আমার ঘরে। হাত ছাড়িয়ে নিল না, বাধ্য মেয়েটির মতো মাথা হেঁট করে এল।
ঘরে এসে আমি অপরাধীর মতো ওর দিকে চাইলাম। ও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়াল।
আমি আবার ওর হাত ধরলাম।
এবারে ও মুখ ঘুরিয়ে চিবুক উঁচু করে বলল – জ্যেঠু, তুমি বললে কেন নিচেরতলার মেয়ে, বললে না কেন এটি আমার মেয়ে?
বুঝলাম তার সমস্ত অভিমান আহত হয়েছে আমার ওই একটি কথায়, আর বাধ মানতে চায় নি।
দেখলাম তার টিকলো নাকের দু’পাশ দিয়ে জলের ধারা নামছে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কড়ে আঙুল দেখিয়ে রুদ্ধকণ্ঠে বলতে বলতে গেল – আজ থেকে তোমার সঙ্গে আড়ি, জ্যেঠু, আজ থেকে তোমার সঙ্গে আড়ি।
সিঁড়িতে তার হাল্কা পায়ের নেমে যাওয়ার শব্দ শুনলাম।
সেই ভদ্রলোক সব দিক থেকেই আমার সর্বনাশটি ঘটিয়ে গেলেন। আমার যতো রাগ গিয়ে পড়েছে তাঁর ওপর।
বাগান থেকে কিছু বেলফুল কুড়িয়েছি টুসির জন্যে। কাচের পাত্রে জলে ভিজিয়ে তাদের তাজা রাখবার চেষ্টা করেছি; তার চুলে গুঁজে দেব। আর বাজার থেকে কিনেছি কিছু কাচের চুড়ি আর কালো রঙের টিপ – তার হাতে আর কপালে শোভা পাবে। দেখা যাক্, এই নজরানা দিয়ে আমার প্রিয় বন্ধুটিকে ফের বশে আনা যায় কিনা।