• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫১ | জুন ২০১২ | গল্প
    Share
  • কোনো এক জলকন্যা : হাসান জাহিদ


    ই জীবন।

    এরকম অদ্রব্য জীবন। ওষুধ আর মৃত্যুর গন্ধমাখা জীবন। সুবিশাল ওয়ার্ড আর এমার্জেন্সি তাড়িত জীবন। সিস্টার নলিনী আর সিস্টার আনজু, ওয়ার্ডবয় জহির, মোটা চশমা-পরা প্রফেসর বর্মণ পরিবেষ্টিত অ্যান্টিবায়োটিকময় জীবন। ওর সমস্ত শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের গন্ধ, স্নানেও তা দূর হয় না। মনে হয় মৃত্যুপথযাত্রী রোগির মতো ওর প্রাণটা জীবাণুনাশক প্রতিষেধকের কৃপায় যায় যায় করেও যাচ্ছেনা। সন্দেহের দোলায় দুলছে সে। ওর কুলীন মনটা কিছু একটা তৈরি করতে চাচ্ছে। মনের ভিতরে চলতে থাকা মল্লযুদ্ধটা থামছে না তাই।

    আদীলা ওর স্বভাবজাত চাঞ্চল্য হারিয়ে কোনোক্রমে যেন জীবনযাপন করছে ওর সাথে। আদীলার নির্লিপ্ত বাক্য, চোরা চাহনি ওকে যেন ক্রমেই ঠেলে দিচ্ছে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। তাকে নিয়ে আদীলার এমন বিচিত্র খেলা কেন!

    ‘খেলাটা তো চলছে। কিন্তু কেন এই খেলা সেটাই তো জানা হলো না।’ বিড়বিড় করে বলল সে।

    আরবী আদীলা নামের অর্থ অনেককিছু। ন্যায়ানুগ, সৎ, সাম্যবাদী, সোজাসাপ্টা। কিন্তু আদীলা এসবের কোনোকিছুই না! ছিঁটেফোঁটা যা কোনো এককালে আদীলার মধ্যে ছিল সেসব বিসর্জন দিয়ে আদীলা দোকানে সাজানো ম্যানিকিন সেজেছে। কিন্তু কেন!

    সঙ্কীর্ণ কুঠুরিতে বসে থাকা ডা. রাফির ঠোঁটে বক্র হাসি খেলে যায়। তার এরকম হাসি আর একাকী সংলাপে নলিনী বোধহয় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই জিজ্ঞেস করল না ডাক্তার হাসছে কেন। শুধু বলল, ‘নিয়ে যাব ডিউটি চার্টটা?’

    ‘নিয়ে যান।’ ডাক্তার এলোমেলো চোখে তাকাল। নলিনীর চেহারায় তাতে কোনো পরিবর্তন খেলে গেলনা। ডাক্তার-নার্সরা রাত জেগে ডিউটি করে। রোগি কাটাছেঁড়া করে। এদের বোধহয় আনন্দ-হাসি-কান্না নিষেধ। রাফি তার দম বন্ধ করা কক্ষে বসে ভাবছিল ডা. কমরের কথা। কমর আসছে না। আকস্মিকভাবেই তার আসাটা বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ খারাপ আবহাওয়া, কাজ, সব উপেক্ষা করে কমর হাজিরা দিত। কেন এই রহস্যময় অন্তর্ধান! কমর, আদীলা আর সে একসাথে কত বেরিয়েছে। বহুবার কমর ওর আতিথ্য গ্রহণ করেছে। বহুদিন ওরা গালগল্পে কাটিয়েছে। সেই দিনগুলোতে আদীলা খুব মুখরিত থাকত। রাফি নিজে উপভোগ করত হাসিঠাট্টা আর কৌতুক। কমর হাসাতে পারত খুব।

    বারান্দায় পায়চারি করে সে। আদীলার কৃত্রিমতায় আর কমরের অকস্মাৎ ডুব দেবার কারণে সে পরিণত হয়েছে যেন কোনো বোধহীন প্রাণিতে। এতবড় ওয়ার্ডের ধকল, অন্যদিকে হিসেবের খাতা মেলানোর প্রাণপাত ধ্বস্তাধ্বস্তিতে এখানকার সার্জন রাফি অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে।

    কতদিন আগেরই বা ঘটনা। মেয়েটি অ্যাপেন্ডিসাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মরতে মরতে কী আশ্চর্যজনকভাবেই না মরল না! হাসপাতালে আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছিল মেয়েটি। ডা. রাফির ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত আর দক্ষ অপারেশনে নবজীবন পেল সে। মেয়েটির রোগোত্তর মুখে ছিল স্নিগ্ধতার প্রলেপ। ডা. রাফি মুগ্ধচোখে দেখছিল মেয়েটিকে। মনে হলো, এমন কোনো মোহিনী নারীকেই বুঝি সে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এরপর তো নিবিড় পর্যবেক্ষণে পুরোপুরি সারিয়ে তুলল মেয়েটিকে। মেয়েটি চলে যাবার দিন ডা. রাফি মন খারাপ করেছিল। ভেতরটা কী এক আকুলতায় যেন উন্মুখ হয়ে ছিল। অথচ আদীলা কেমন হাসতে হাসতে চলে গেল। ডা. রাফি একদিন উপযাচক হয়েই প্রস্তাবটা রাখল। মেয়ের বৃদ্ধ বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিতে একমুহূর্ত বিলম্ব করেননি। ডা. রাফির জীবনে কখনো কাব্য ভর করেনি। কিন্তু অনিন্দ্যসুন্দর এক রোগিনীর সেবা করার সময় সে মনে মনে মেয়েটার নাম দিয়েছিল ‌‘বনলতা’, আর বনলতা সেন ছাড়া অন্য কোনো কাব্য তার জানা না থাকায় সে বিচরণ করে বেড়ালো নিজস্ব এক কাব্যভুবনে। তারপর তো সানাই’র সুরে, অজানা কোনো কাব্যলোকে আপ্লুত হয়ে পড়েছিল এমার্জেন্সির ব্যস্ততম ডাক্তার। কমর তখন বিদেশে অবস্থান করছিল কী একটা ট্রেনিংয়ে।

    এমন একটি প্রাণবন্ত মেয়ে কেমন নিরস আর নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল। মেয়েটার নিরুত্তাপ দৃষ্টি রাফিকে জানান দিল‒এ অন্য কেউ। তবু নিজকে ব্যস্ততায়-উদ্বেলতায় ভরে রাখল রাফি। ভাবল, ঠিক হয়ে যাবে। যে স্বপ্নটাকে, বিশ্বাসকে লালন করেছে সে শুরুতেই তা ভেঙ্গে দিতে মন সায় দিল না। রাফি সমাধান খুঁজতে জিজ্ঞেস করেছিল একদিন ‘তুমি কি সুখি নও আদীলা?’

    ‘আমি সুখি, খুব সুখি।’ উত্তরটা কেমন স্বাদহীন ছিল। আদীলা লুকোতে পারেনি নিজকে। আশ্চর্য! আদীলা রাফির শুন্য কোয়ারটার ভরে দিতে এসে রাফিকে আরো দেউলিয়া বানিয়ে ফেলল। না, অর্থকড়ি উড়িয়ে না। সেটা হলে রাফি নিজকে তৃপ্ত মনে করত। আদীলা তাকে দেউলে করল মনের দিক থেকে। অনেক নেড়েচেড়ে দেখল রাফি। কোনো সদুত্তর খুঁজে পায়নি। অনেকবার মনে হয়েছে মেয়েটা বোধহয় ডিপ্রেশনের শিকার। মেয়েদের জীবনে বিয়ে একটি অলংকার, আর পুরুষদের কাছে সেটা অহংকার। আদীলা ওর অহংবোধ এক লহমায় গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

    আরো এমনি কল্পনা-বাস্তবতা-সংশয়-সন্দেহ আর দ্বিধাজড়িত ভাবনা হিংস্র বাজপাখির মতো রাফির মনের আকাশে ডানা মেলে থাকে।

    কমর একদিন ফিরল বিদেশ থেকে। বিস্ময় প্রকাশ করল সে। যেন রাফির মতো ডাক্তারের বিয়ে করার কথা না! রাফি অবাক হয়েছিল কমরের এরকম বেমানান প্রতিক্রিয়ায়। তবে কমর একদিন গায়ে পড়ে ডিনারের আতিথ্য নিল। তিনজনের সেই রাতের ডিনার একটুও জমেনি।

    মনোভূমির দৃশ্যপটে নিজকে যাচাই করে সবকিছুর হিসেব নেয়া সম্ভব হয়নি। রাফি নিজের কাছ থেকেই যেন পালিয়ে বেড়াতে লাগল। নলিনী এসে ওর কাছ থেকে কেড়ে নেয় মদের বোতল। কোনো এক ভুলের সিঁড়ি বেয়ে আজ সে তলিয়ে যাচ্ছে পঙ্কিলতায়। আদীলা কেন আগে থেকে বলল না! কেন বলেনি এ বিয়েতে মত নেই তার! ওকে নিয়ে খেলবার এত শখ হলো কেন তরলমতি মেয়েটির! অনেকদিন পর একটা সত্য জানতে পারে রাফি। ততদিনে বিরাট ওলোটপালট হয়ে গেছে।

    ক’দিন ধরে জোর বৃষ্টি। বৃষ্টির সময়টায় আদীলা জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখত। তার সাথী হতো রাফি, বুকভরে গন্ধ নিত জলোহাওয়ার। রাফি জানালার কাচের ওপারে দুরন্ত বালকের মতো ছুটোছুটিরত বৃষ্টি দেখে। এমার্জেন্সি ও কোয়ারটার। মাঝখানে উঁকি দেয় আদীলাদের বাসভবন। আদীলা ওর বাবা-মা’র সাথে অবস্থান করছে। রাফিই একদিন ওকে চলে যেতে বলেছিল। কথাটা তাড়িয়ে দেবার মতো করে বলেনি। বলেছিল, ‘তুমি বিষণ্নতায় ভুগছো। তোমাকে অবসাদ গ্রাস করেছে। আমার মনে হয় তুমি তোমার চেনা গণ্ডিতে ভাল থাকবে।’ একমুহূর্তও ব্যয় করেনি আদীলা। সিডেটিভ নিয়েছিল। তারপর মড়ার মতো ঘুমলো। সেদিকে চেয়ে কাটিয়ে দিল রাফি একটা রাত। জানালা গলে চাঁদের আলোয় আদীলার হলুদ শরীর রহস্যময় পবিত্র লাগছিল। যেন নিটোল জলে ভাসছে কোনো জলকন্যা। রাফি ভাবল, যে মেয়েটি আগে ঘুমের ওষুধ খেত না, সে কেন কথায় কথায় সিডেটিভ নেয়। রাফির চেতনায় খেলে যায় ক্লেদাক্ত ভাবনা। লজ্জায়-ঘেন্নায় সে এতটুকুন হয়ে গেল। নিজের কাছেই লজ্জা আর ঘেন্না।

    পরদিন চলে গিয়েছিল আদীলা। আদীলাদের বাসায়। মানে শ্বশুরবাড়ি! মধুর হাঁড়ি! শব্দ করে হেসে ওঠে রাফি। তারপর ঝিমোতে শুরু করল মেঘমেদুর হাওয়ায়। ঠক ঠক হিলের শব্দে বুঝল নলিনী আসছে।

    কিন্তু সে নলিনী নয়, আনজু। বোর্ডফাইল রাফির দিকে এগিয়ে দিয়ে ডিউটি চার্ট টেনে নেয় আনজু।

    ‘ডা. কমর আসেনি, না?’

    ‘আজও তো...।’ আনজু ইতস্তত করে, সে জানে ক’দিন ধরে হন্যে হয়ে ডা. কমরকে খুঁজছে ডা. রাফি। আনজু কিছুক্ষণ রাফির আনত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ক্ষিপ্তকন্ঠে বলে উঠল, ‘এরকম একটা পাথরের মতো স্ত্রীর জন্য আপনি কেন আপনার জীবনটা নষ্ট করছেন?’

    ‘সে পাথর না আনজু, সে আসলে কুহকিনী।’

    ‘আমি শাদা মনে যা বুঝেছি, তাই বললাম। অত ভারি উপমা আমার মাথায় ঢোকেনা স্যার। আপনি তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন।’

    ‘ডিভোর্স? সেটা যদি সমাধানের একমাত্র পথ হয় তবে তাই করতে হবে আমাকে।’ উঠে দাঁড়ায় রাফি। ওয়ার্ডবয় বৃদ্ধ জহিরকে ডেকে বলল, ‘আমি যাচ্ছি। দরকার হলে ফোন করবেন।’

    স্যুয়িংডোর ঠেলে প্যাসেজে এল রাফি। তারপর গেটের দিকে আগাতেই অ্যাম্বুলেন্সটাকে দেখতে পেল। বিরক্তিতে ছেয়ে যায় মন। কুঠুরিতে এসে বসল আবার। রিপোর্ট হাতে জহির ঢুকল। ঢুকল আনজু। প্যাসেজ, বারান্দা, ওয়ার্ড কর্মচঞ্চল হয়ে উঠল। যন্ত্রে পরিণত হলো রাফি। জ্বলে উঠল সবক’টা বাতি। ক্ষিপ্রতার সাথো এগিয়ে গেল ডা. রাফি। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে ৮৮’র গোল্ড মেডালিস্ট অ্যানাস্থেটিস্ট কমর। ডান পা থেঁতলে গেছে উরু পর্যন্ত। মুখের বাম পাশ জখম হয়েছে বিপজ্জনকভাবে। জহিরের হাতে টিটি ইঞ্জেকশন। গ্লাভসে হাত গলিয়ে গ্যাসের ফ্লানেল নিয়ে এগিয়ে এল ডা. রাফি। অক্সিজেন, স্যালাইন, ব্লাড এহাত-ওহাত করছে আনজু আর একজন আয়া।

    অন্যগ্রহে জৈববিবর্তন নিয়ে তর্ক বেঁধেছিল কমরের সাথে। মৃত্যু কী? এই বিষয়টি নিয়েও তর্ক হয়েছিল বন্ধুর সাথে। একবার একটা অদ্ভুত কাজ করেছিল কমর। চেম্বারে তার টেবিলের ওপর একটা করোটি রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সেটার দিকে। নার্স আর রাফিকে ডেকে বলেছিল, ‘এই খুলিটি মৃত্যুর প্রতীক। এর দিকে তাকিয়ে থাকলে যে অনুভূতিগুলি হবে, সেটাই মৃত্যু।’ ‘বাজে কথা’, রাফি বলেছিল‒‘‌মৃত্যু কোনো অনুভূতির ব্যাপার না। কোনো জৈব পদার্থের বা জীবের সোম্যাটিক মৃত্যু হলে জীবমন্দিরের পরিসমাপ্তি বা মৃত্যু ঘটে...।’ কমর রাফির কথায় কেমন বিজাতীয় ভঙ্গিতে তাকিয়েছিল রাফির দিকে।

    ...কমরের মধ্যে চেতনার আশ্রয়ের কোনো লক্ষণ দেখা দিল না। পাল্‌স থিতিয়ে যাচ্ছে। মরিয়া হয়ে ওঠে রাফি। চেতনার পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের পুরু বর্মকে বর্জন করে নিঃশেষিত হলো কমর। নিদারুণ এক অব্যক্ত অক্ষমতাবোধে অসাড় হয়ে যায় রাফি।

    ডেথ সার্টিফিকেট আর রিপোর্ট লিখতে গিয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকে আঙুল। বৈদ্যুতিক সংকেতের ভেতর প্রায় চেনা কোডের মধ্য দিয়ে একটা মন‒সুন্দর, স্বাভাবিক, ধীর-দ্রুত, অনেকদিনের সুহৃদ‒অ্যানাস্থেটিস্ট কমর জগৎসভ্য’র বিশাল মহানুভবত্বের বায়োকারেন্টের গতি ছাড়িয়ে নিষ্ক্রমণিত হয়ে গেল। কাগজপত্র আর একটা পার্স নিয়ে ঢোকে জহির। ‘স্যার এগুলো কমর সাহেবের।’ ওর মাকে লেখা একটা চিরকুট পাওয়া গেল। গাড়ি নিয়ে সে বেরিয়েছিল এয়ারপোর্টের দিকে। নিজেই স্টিয়ারিং-এ। ‘মা, চলে যাচ্ছি আমি। কোথায় যাচ্ছি জানবার দরকার নেই। বাবা’র নীল রক্ত চায়নি আদীলাকে। তুমি তো চিনতে মা ওকে। তুমি পারোনি বাবা’র সামনে দাঁড়াতে। আদীলার বিয়ে হলো আমার বন্ধু ডাক্তার রাফির সাথে। বন্ধু, আদীলা আর তোমাদের পরিমণ্ডল থেকে দূরে সরে যাওয়াই ভাল মনে করি। গাড়িটা আর এই চিরকুট কাস্টমসের আমার এক বন্ধু তোমাদেরকে পৌঁছে দেবে।’

    গাড়িটা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেতে পারেনি। কমর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। দুমড়েমুচড়ে গেল গাড়িটা...। স্তব্ধ হয়ে থাকে রাফি। আবিদউদ্দিন চৌধুরি এসে পাশে দাঁড়ালেন। রাফি বলে উঠল, ‘আপনিই দায়ি এই মৃত্যুর জন্য।’

    ‘বলো কী! আমি পিতা।’ কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক হাউমাউ করে উঠলেন।

    ‘আপনি খুনি পিতা।’ রাফি কাঁপছে। অজান্তেই ভদ্রলোকের শার্টের কলার চেপে ধরেছিল সে। ‘আপনারা, জড়বুদ্ধিসম্পন্ন অভিভাবক...।’ খেই হারিয়ে ফেলে রাফি। আবিদউদ্দিন চৌধুরি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেকরাতে কোয়ারটারে ফিরে আসে রাফি। একটা টেলিফোন এল। বোধহয় হাসপাতাল থেকে। ফোনটা রিসিভ করল সে। ওপাশ থেকে কেউ কাঁদছিল। ‘আমি খুব ক্লান্ত আদীলা। কিছু বলতে চাও?’

    ‘বিয়ের সময় আমি জানতাম না কমর তোমার বন্ধু।’

    'না-ই বা জানলে এমন একটা বিষয়। কিন্তু কমর তোমার কামনার ধন ছিল, সেটাও জানতে না নাকি!’

    ‘আমি ওকে ভুলে গিয়ে নিজকে তোমার কাছে সঁপে দিতে চেয়েছিলাম।’

    ‘মধ্যরাতের নাটক, আদীলা।’ রাফি তিক্ত কন্ঠে বলল।

    ‘কিন্তু যখন জানতে পারলাম কমর আর আমার বিষয়টা তুমি জেনে গেছ, তখন থেকে আমার সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। আমি অনেকদিন তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম। তুমি শোনোনি। বলতে চেয়েছিলাম, তুমি আমার যখের ধন। আমার জীবনে আর কোনো পুরুষ নেই...। কিন্তু তুমি আমাকে সরিয়ে দিলে। আমাকে চলে যেতে বললে।’

    ‘এখন তো ও নেই আদীলা। যাকে ঘিরে এত কিছু, সে অভিমান করে চলে গেল। আর আমি হয়ে গেলাম অপাঙ্‌ক্তেয়।’

    ‘তোমাকে কিছু আর বলার নেই আমার। যা বলব, সব নাটকীয় শোনাবে।’

    ‘জীবনটাতো নাটক। তোমাকে কিচ্ছু বলতে হবেনা। নাটকটা বিয়োগান্তক হবে কি মিলনাত্মক হবে সেই সুতো তোমার হাতে ছিল।’

    ‘তোমার ঘুম পাচ্ছে সোনা? আমি এসে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব? আমি তো তোমার বউ।’ আদীলা কাঁদতে লাগল আবারও।

    ‘এখন আমি ঘুমোব। তোমার সাথে মধ্যরাতের সংলাপটা ঝুলে পড়েছে। তুমি পারতে দিনরাত হাসপাতালে ডিউটি করে, মধ্যরাতে ফোনে সংলাপ চালিয়ে যেতে?’ রাফি ফোন রেখে দিল।


    দুইহাতে মুখ গুঁজে বসে ছিল রাফি।

    ‘স্যার’, আনজু এসে কখন নরমস্বরে ডাকল।
    ‘কিছু বলছিলে?’
    ‘আপনি দিনকয়েক বিশ্রাম করুন।'
    ‘বিশ্রাম?’ বিষণ্ন হাসে রাফি। সে অপলক চোখে দেখে শুভ্র-সুন্দর আনজুকে।
    ‘আমি উঠি।’ দুলে উঠল আনজু।
    ‘না, আনজু। তুমি উঠবে না।’
    ‘আপনি ভীষণ বিপর্যস্ত।’

    ‘হ্যাঁ, ভীষণভাবে পরাজিত।’ রাফি বলে যায়, ‘যেদিন থেকে বুঝলাম আমি ঠকে গেছি। ভেতরটা জ্বলেপুড়ে গেল। আনজু, ওকে ডিভোর্স দিব আমি।’

    ‘ম্যাডাম এখানে এসেছিলেন। আপনি ওয়াইন ধরেছেন জেনে কাঁদতে লাগলেন।’

    ‘এখানে এসেও সে নাটকের মহড়া দিয়ে গেছে নাকি!’

    ‘নাটক হবে কেন? জীবন জীবনই। জীবনের গুরুভার বইতে হয় সবাইকেই।’ সিস্টার নলিনী এসে বলল, ‘আদীলা সব ভুলে আপনাকে বিয়ে করেছিল। ডাক্তার রাফি, ওকে আপনি গ্রহণ করুন। নইলে মরে যাবে মেয়েটা। আরেকটি ডেথ সার্টিফিকেট আপনাকে লিখতে হবে।’ নলিনীর চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু। সেদিকে নির্বোধ চাহনি মেলে চেয়ে থাকে রাফি।

    ‘রিচার্ড সেলজার নামে এক শল্য চিকিৎসকের একটা বই পড়েছিলাম।’ রাফি বলে চলে নিরুত্তাপ স্বরে’, সেলজারের ডাক্তারি অনুভূতিকে সম্বল করে কমরকে কাটাছেঁড়া করলাম। মনটাকে অসাড় করে নিয়েছিলাম। যেন ওর যন্ত্রণাদগ্ধ কম্পন আমাকে আন্দোলিত না করে। কিন্তু লেখক সেলজার অ্যানেস্থাইজ্‌ড ছিলেন না। তিনি তাই অতন্দ্র, ছুরির আগে চক্ষুষ্মান হয়ে রয়েছেন। রোগির দেহকে তিনি খুলছেন, জুড়েও দিচ্ছেন। আমি তো সেলজার নই, তবুও তাঁর মতো সজ্ঞানে আমাকেও সেই কাজটা করতে হলো। কী কঠিন পরীক্ষায় আমি সেটা করলাম।!’

    ‘আপনি বাসায় গিয়ে রেস্ট করুন।’

    ‘সিস্টার নলিনী, আমি ট্রান্সফার অর্ডার নিয়েছি। পাখির গান আর নদীর ঢেউয়ের শব্দ শুনে দিন কাটবে আমার। আমি অনেকদূরের এক সদর হাসপাতালে বদলি নিয়েছি। সেখানে সুন্দর একটি নদী আছে।’

    ‘আপনার সেই ট্রান্সফার অর্ডার বর্মণ স্যার বাতিল করেছেন আবার।’ নলিনী বলল, ‘আপনি এখানেই থাকবেন। আপনাকে দুই সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর করা হয়েছে।’ এসময় ওয়ার্ডে এক রোগির চিৎকারে নলিনী সেদিকে ছুটে গেল।

    রাফি বোকা বোকা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখল ছুটন্ত নলিনীর শুভ্র কাঠামো। খানিকবাদেই ফিরে এল আবার নলিনী। তার মুখমণ্ডলজুড়ে প্রশস্ত হাসি। বলল, ‘আদীলা ম্যাডাম আপনার কোয়ারটার গোছাচ্ছে। বর্মণ স্যার বললেন আজ থেকেই আপনার দুই সপ্তাহের ছুটি শুরু।’ ফিক করে হেসে ফেলল নলিনী।

    রাফি বলল, ‘এরকম করে হাসবেন না তো।’ স্টিলের ট্রে হাতে ডিউটি করার ভান করে আশেপাশে ঘুর ঘুর করছিল আনজু। সে-ও রাফির দিকে চেয়ে ফিক করে হেসে দিল। রাফি কটমট করে তাকাল। আনজু ভেংচি কাটল। রাফি মাথা নুয়ে ঠোঁটের কোণের হাসিটা লুকল।

    সে রওনা দেয় কোয়ারটারের দিকে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)