হঠাৎ দেওয়ালে জানলার মাপের দুটো পাল্লা খুলে গেল। হাওয়ামোরগ মুখ বাড়িয়ে বললঃ
—আপনার সঙ্গে একজন দ্যাখা করতে এসেছেন।
—ভিতরে পাঠিয়ে দাও।
ঘরের ভিতর এক কাঠবিড়ালি হাজির হলো:
—গুড মর্নিং স্যার।
—হ্যাঁ বলুন কি ব্যাপার?
—আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন স্যার?
—আপনি? আপনাকে তো আমি চিনিনা!
—আমি ব্রিজ কন্ট্রাক্টর। মানে সেতু-টেতু বাঁধি আর কি।
—আপনার ক্রিডেন্সিয়ল?
— আমি পূব-পশ্চিমে সেতু বাঁধার অদ্বিতীয় ঠিকেদার। জানেন হয়তো দ্বিতীয় হুগলি সেতু আমিই বানিয়েছি। টার্নকি প্রজেক্ট, মানে ডিজাইন থেকে সবটাই আমার। হরিদ্বারের কাছে আপনার ভাইএর নামে যে সেতুটা আছে, আমারই বানানো। তবে এবারে দড়িগুলো বেশ পোক্ত দিয়েছি, মোটা মোটা, ব্রিজটাও অনেক প্রশস্ত করেছি, যাতে অনেক বেশি পারাপার সম্ভব হয়। পৃথিবীর যত পূব-পশ্চিম সেতু সবই আমার বানানো। তবে কি জানেন, উত্তর-দক্ষিণ সেতুর ব্যাপারে ততটা দক্ষ নই। কেন জানেন, দক্ষি্ণটা উত্তরের প্রতিবিম্ব। দেখুন উত্তরে যখন গ্রীষ্ম, দক্ষিণে তখন শীত, প্রতিবিম্বে যেমন বাঁ-টা ডান হয়ে যায়, ডান-টা বাঁ। বিষুবরেখা একটা আয়না কি না। আসলে উত্তর দক্ষিণে একটাই মেরু, অন্যটা প্রতিফলন। কিন্তু পূব পশ্চিমে দুটো মেরুই বাস্তব। তাই উত্তর দক্ষিণ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে পূব-পশ্চিমেই হাত পাকিয়েছি।
—বুঝলাম। তা দ্বিতীয় হুগলি সেতু আপনার নামে না হয়ে বিদ্যাসাগর সেতু হল কেন?
—হ্যাঁ এই প্রসঙ্গটা ইনটেলিজেন্ট-এর সাথে সাথে ইন্টারেস্টিংও বটে। শুনুন স্যার বলিঃ
—হুগলি কেন হুগলি সে তো আপনি জানেন। সবই ওই সেতুর স্বল্পতা, অপ্রশস্ততা হেতু একমুখি যান গতি, মানে পশ্চিমি কারসাজি। ডিরোজিও, রামমোহন এমনকি ঈশ্বরচন্দ্রকেও হাইজ্যাক করে পূবে নিয়ে গিয়ে ফেলল। হয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর। ব্যস এক এক করে বন্ধ হতে লাগল সতীপ্রথা, পর্দাপ্রথা। শুরু হয়ে গেল স্ত্রীশিক্ষার চল। শেষ-মেশ সূর্যটাকেও বাধ্য করল পূবে উঠতে। সবই ফরেন হ্যাণ্ড। এই নামকরণটাও তাই। দ্বিতীয় সেতু হওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা শুধরোলো, এমুখো যানও চলতে শুরু করল। পশ্চিম-পাড়ে শপিং মল হল, বিউটি পার্লার হল। তবে একটা অসুবিধেও আছে, যদিও এখনও পর্যন্ত পশ্চিম-পাড় আমরা সুন্দর আলো-আঁধারিতে ঢেকে রাখতে পেরেছি, যেখানে রোদ্দুর, ধুধু রোদ, যেখানে অন্ধকার কালো নিকষ, যেন পায়ের নিচে সারা জমি আলো ছায়ার ম্যুরাল, সৃষ্টির প্রথমের মাটির কাঁচা অবস্থা থেকে গাঁথা আছে ফ্রেস্কোর মতন। ওইসব সেতু-টেতু হয়ে সেটাও নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। তবে কি জানেন, ধর্ম বলেও তো একটা কথা আছে, কোরাপশন ধর্ম মহা ধর্ম। যা বলি তা বিশ্বাস করিনা, যা বিশ্বাস করি তা পয়সা পেলে বিক্রি করে দিই। তা আপনি যখন চাইছেন তখন হোক না আরও একটা সেতু।
—দেখুন আপনার বক্তৃতা পরে শুনব, আগে আপনার নামটা বলুন।
—আজ্ঞে অধমের নাম কাঠবিড়ালি, সংক্ষেপে কেবি বলবেন। সবাই কেবি নামেই চেনে, ডাকে।
—দেখুন এই মুহূর্তে আমার হাতে একটা পূব-পশ্চিম সেতুর কাজ আছে। তবে শুধু এই ভগীরথের খালের ওপর দিয়েই নয়, সেতুটা অনেক দীর্ঘ পূব-পশ্চিম প্রসারী।
—কোনো অসুবিধে নেই স্যার। আমি সব রকম পূব-পশ্চিম সেতুরই বিশেষজ্ঞ।
—আমি বনবাস থেকে এই প্রজেক্টের ব্যাপারে সার্ভে করতে কদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি, খালের পশ্চিম-পাড়েই ক্যাম্প করেছি। সময় হাতে খুবই কম, চলুন বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে আপনার বিদ্যাসাগর সেতুটাই দেখি। রাতটা ওপাড়ে পার্ক হোটেলে কাটিয়ে নেব।
কেবি চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মেঝের দিকে তাকায়।
—চিন্তা করবেন না খরচা আমিই দেব, মানে প্রজেক্ট এখন সার্ভে স্টেজে তো তাই। কাল সারাদিন ধরে সার্ভের কাজ সেরে আবার এই ক্যাম্পে ফিরে আসব। পাবলিক যানবাহনেই যাব, বুঝতেই পারছেন, বনবাসী আমি, আর আপনারও গাড়ি নেই, চার পায়ে লেজ উঁচিয়ে চলেন। আপত্তি নেই তো?
—না স্যার, ঠিকেদারের আবার আপত্তি কিসের?
আজকাল হাওড়া কোলকাতার মধ্যে বিদ্যাসাগর সেতু দিয়ে অনেক দিলখোলা বাস চলে, লো ফ্লোর, সেমি লো ফ্লোর, ভলভো, স্কাইলাইন, ভাইকিং, স্টারবাস। রঘুপতিরা একটা হোয়াইট লাইন বাসে চড়লেন, অনেক সময়ে এই রুটে বাস ফাঁকা পাওয়া যায়, তবে এই বাসটায় বেশ ভিড়। রঘুপতি একটা সিট ফাঁকা পেয়ে গেলেন, কেবি বসল রঘুপতির কাঁধে। সামনের সিটে বসে আছে উর্বশী ও সিংহ। ওদের কথাবার্তা স্পষ্টভাবেই শোনা যাচ্ছে। দুজনের বাড়ি নলপুরে, ট্রেনে সাঁতরাগাছি পর্যন্ত, এখন চলেছে সিটিজেন পার্কে নিভৃত সান্ধ্যবাসরে। উর্বশী বোরখা পরিহিতা। ওদের কথোপকথন থেকে প্রতীয়মান, উর্বশী বিবাহিতা, সিংহ ওর স্বামী নয়। সিংহ মাঝে মাঝে কেশর ঝাড়া দিচ্ছে। রঘুপতির কোলের ওপর এসে পড়ছে খুশকি ও প্রেম নিবেদক কবিতা, গুঁড়ো গুঁড়ো। ভগীরথের খালে এখন জোয়ার, বক্ষে অসংখ্য উত্তল আয়না। ইডেন স্টেডিয়মের ফ্লাডলাইট জ্বলছে, শুধু একটা টাওয়ারে। সচিনের হুক করা বলের মত মাঠের বাইরে এসে ঝুলছে, জলের বুকে প্রতিবিম্বিত হয়ে আছে ফ্রিজশট হয়ে। বাসে ভিড় বেড়েই চলেছে ক্রমাগত। এরই মধ্যে এক স্বনিযুক্ত কিশোর গলার চেন বিক্রি করে চলেছে। চেনগুলি বাঁধা আছে বাসের রডে। চেন বিক্রেতা চেনের ধাতুবিদ্যা বলে চলেছে। তামা, ব্রোঞ্জ, পিতল, কাঁসা...। ক্রমাগত মৌলিক উপাদানের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, সাথে সাথে চেনের দ্যুতি শুদ্ধ তাম্রের মূলসুর থেকে উপসুর-ঋদ্ধ হয়ে খাদের দিকে চলেছে। বাসে দণ্ডায়মান যাত্রী পরস্পর বিমুখ দুটি সারিতে। দুটি সারির মাঝখানে এক স্ত্রীলোক, এক হাতে হাতল ধরা, অন্য হাত আবদ্ধ, কোলে একটি শিশুকন্যা।
মহিলাটির পরনে একটি জ্যালজ্যালে কামিজ ও সালোয়ার। হুক-খোলা অন্তর্বাস স্পষ্ট অনুধাবনযোগ্য। বয়স বছর ত্রিশ অনুমেয়। মুখমণ্ডলে অকাল ক্লেশের ছাপ। পোশাকের মলিনতা জ্ঞাপন করছে, কৃচ্ছ্রসাধ্য জীবনযাপন। ভয়ানক শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয়ে গভীর ফাটগুলি সস্তা লিপস্টিকের অলুক্ত চর্চাতেও কিঞ্চিৎমাত্র চ্ছ্বাদিত নয়। প্রায়শই অস্ফুটে শোনা যাচ্ছেঃ
—দাঁড়াতে পারচিনি গো বাবু, কি করে যাব গো। সে হাঁসপাতালে আছে গো, দেকতে যাচ্চি, নইলে ঘর থিঞে আমি কক্ষুনো একা বেরুইনি।
শিশুটির চোখ স্থিরনিবদ্ধ ঝোলানো চেনগুলির দিকে। মাঝে মাঝে হাত বাড়াচ্ছে চেনের দিকে। যা এই মুহূর্তে নাগালের মধ্যে না থাকলেও একদিন অলভ্য থাকবে না।
বাসের ঝাঁকুনির সাথে সাথে মহিলার বক্ষদেশ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষদের পিঠে ক্রমাগত ঘর্ষিত হচ্ছে। ক্রমাগত দলিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছে স্তনদ্বয়। সামনের সারিতে তিন পুরুষ ক্রমাগত মহিলার গাত্র-সংশ্রবে আসছেন। তিন জনেরই মাথায় গোল টুপি, ঢিলে কামিজ। পাজামা হ্রস্ব, গোড়ালির কিছুটা ওপরে অবসিত। একজনের থুতনিতে লম্বা দাড়ি, তিন জনেরই গোঁফ নিরঙ্কুশ করে কামান। মহিলা ভারসাম্য না রাখতে পেরে মাঝে মাঝেই ডাইনে বাঁয়ে পতনের সম্মুখীন হচ্ছেন, বিশেষত বাসের গতি যখন অকস্মাৎ মন্দীভূত হচ্ছে।
একবার মুখ ফেরাল পুরুষদের একজন, তার চোখে মুখে কৌতুকের ঝিলিক। রঘুপতি বনবাসী, বেশক চেনেন অরণ্যের কোন
অগ্নিশিখায় ভেষজ পুড়ে মরে, স্বেচ্ছায় ডানা মেলে পতঙ্গের মতো, কোন শিখা স্বেচ্ছাচারী দাবানল। বনরক্ষা বনবাসীর ইনস্টিংক্ট। রঘুপতি উঠে দাঁড়ালেন, কয়েক জনের কাঁধ টপকে মহিলার কাঁধে অল্প টোকা দিয়ে বসতে ইঙ্গিত করলেন। এক এক করে অবরোধ অতিক্রমণ করে মহিলা সিটে এসে বসলেন। একাধিক পুরুষ কন্ঠ সরব হয়ে উঠলঃ
—গায়ে হাত দিল।
—সব হিন্দু দাদা-পার্টি এইরকম।
—মেয়েছেলেটাও তো তেমন, আবাদা থেকে রোজ ওঠে, নাসিরের শালি। মরদটা কোন চুলোয় কি করে কে জানে।
—বেশরম মেয়েছেলে, হিজব বলে কিছু নেই। মুলুক ঠিকঠাক হলে কাজির ফয়সলায় গাঁয়েই সাজা হয়ে যেত।
না ব্যাপার কোনো সাম্প্রদায়িকতার দিকে যায়নি। বাস ততক্ষণে পূব-পাড়ে এসে পৌঁছেছে। ফোর্টের চৌহদ্দির মধ্যে মসজিদ দৃশ্যমান। সূর্য অস্ত গেলেও পশ্চিমের আকাশে এখনও আলো। মগরীব নমাজের আজান শোনা যাচ্ছে।
এত ডামাডোলেও উর্বশী ও সিংহের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। রঘুপতির মনে হল উর্বশির হিজব-এর থেকেও গাঢ় ও অস্বচ্ছ এক ছায়া ঢেকে দিয়েছে লাঞ্ছিতার অবয়ব, দুর্ভেদ্য হিজব হয়ে। রঘুপতির মনে পড়ে যায় ডন জুয়ানঃ
“Like a veil,
Which if withdrawn, would but disclose the frown
Of one who hates us, so the night was shown
And grimly darkled o’er their faces pale
And hopeless eyes.”
ডামাডোলে চেন বিপণনও প্রভাবিত হয়। শুরুতে ছিল একটা কুড়ি টাকা। টাকার অঙ্কটা ধ্রুব থাকছে, লভ্যতার সংখ্যা ইনফাইনাইট সিরিজে বেড়ে চলেছে, দুটো, তিনটে, চারটে...। রঘুপতি দেখলেন শিশুটির চোখ ক্রমাগত আয়ত হচ্ছে। রঘুপতি শিশু ও তার মায়ের চোখের অন্তর্বর্তী আরও এক জোড়া চোখ দেখতে পেলেন। আসন্ন কিশোরীর চোখ দেখছে, তারের কশিদা গুলি বুখারার কোনও মকবারার দেওয়ালে খচিত জাফরি, রন্ধ্রপথে দেখা যায় দিগন্তপ্রসারী স্তেপ। ধুলো উড়িয়ে ছুটছে এক তুর্কি ঘোড়া, পিঠে দৃপ্ত ঘোড়সওয়ার। রঘুপতির মনে পড়ে কবি বিষ্ণু দেঃ
“হে প্রিয় আমার, প্রিয়তম মোর!
আয়োজন কাঁপে কামনার ঘোর,
কোথায় পুরুষকার?
অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার?”
রবীন্দ্রসদন স্টপেজ এসে গেল। রঘুপতি নামলেন, নামল উর্বশী ও সিংহ আর নামল সেই লাঞ্ছিতা। রঘুপতির গন্তব্য স্থির নয়, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলেন, মহিলা সাবধানে রাস্তা পার হচ্ছেন, হেঁটে যাচ্ছেন এসএসকেএম হাসপাতালের দিকে।
বাসে উঠে থেকে কেবি চুপ করেছিল, ডামাডোলের সময় সিঁদিয়ে গিয়েছিল রঘুপতির জামার ভিতরে। এবার বেরিয়ে এল, কিন্তু কাঁধ ছাড়ল না।
রঘুপতি আরম্ভ করলেন:
—এখনও পর্যন্ত আমার প্রজেক্টটা সঠিক কি আমি নিজেও জানিনা। তবে ওটা কোনো সেতুর ধাঁচেরই হবে। এই ভেবেই আপনাকে ডেকেছি। কনস্ট্রাকশনটা সঠিক কি জিনিষের হবে সেটা এই জরিপের কাজ শেষ হলে, তবেই ঠিক করা যাবে। আপনি সঙ্গেই আছেন। প্রথমে প্রজেক্টের ফিলোজফিটা আপনার ভালো করে বোঝা দরকার, আরো বেশি করে যেহেতু আপনি টার্নকি প্রজেক্টের এক্সিকিউটর ও কন্সাল্টান্ট দুটোই। একটা ব্যাপার হোলো নীতিগত ভাবে আপনি রোদ্দুরের থেকে ছায়ার, আলোর থেকে আঁধারের বেশি প্রত্যাশী। আপনার মত সাকসেসফুল ব্যবসায়ীর পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। তবে এই প্রজেক্টের আমি ওনার, আমার কাছে কাজ করতে গেলে আপনার ব্যক্তিগত নীতিবোধ শিকেয়ে তুলে রাখতে হবে, বলুন রাজি?
—কি যে বলেন স্যার। আমার পয়সার সঙ্গে মতলব, ওসব নীতি-ফিতি কেন টেনে আনতে যাব? তা ছাড়া বলেইছি তো আমি ধর্মনিষ্ঠ লোক, কখনও, মহাধর্ম, করাপশন ধর্ম, তা থেকে বিচ্যুত হইনা—যা বলি তা বিশ্বাস করিনা, যা বিশ্বাস করি তা পয়সা পেলে বিক্রি করে দিই।
—তবে শুনুন। আমি রোদ্দুরকেই ছড়িয়ে দিতে চাই। সর্বত্র সমান ভাবে, ওসব ছায়া-টায়া চাইনা।
—হ্যাঁ, ঠিকইতো। আমাদের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এও স্যার ইক্যুলিব্রিয়ম বলে একটা বিষয় আছে। সর্বত্র সমানভাবে ছড়ালে তবেই না ভারসাম্য বজায় থাকবে। আসলে স্যার আপনি যখন ওই মেয়েছেলেটাকে বসতে দিলেন, এই ভারসাম্যের কথাটা ভেবেই আমার ভালো লেগেছিল, মেয়েছেলেটা একদম ভারসাম্য রাখতে পারছিল না কিনা!
রঘুপতি ভাবতে থাকেন ভারসাম্য তো অন্ধকার ছড়িয়েও বজায় রাখা যায়, লোকটা যুক্তি না ধরেই তেল মারছে। যুক্ত করলেন:
—আর অগ্রগতি, সেটাও বজায় রাখা দরকার।
—হাঁ স্যার সে আর বলতে। দেখুন না বিদ্যাসাগর সেতু দিয়ে কি রকম সাঁই-সাঁই যানগুলো দৌড়চ্ছে, ব্রিজটা চওড়া করেছি বলেই না!
রঘুপতি বুঝতে পারেন না লোকটা চাটুকারিতা করছে, না সত্যিই তাঁর প্রজেক্টটা বুঝতে আগ্রহী। তিনি বলতে থাকেন:
—দেখুন সেতু বাঁধা হল বলেই তো পশ্চিম-পাড়ে বড়ো হাসপাতাল হয়েছে, আগে হাওড়া-ব্রিজের জ্যাম ঠেলে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পৌঁছোন তক কত মুমূর্ষুই না টেঁসে যেত।
না: লোকটার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, চিঁড়ে ভিজছে না। রঘুপতি ওর মগজ ধুতে আর একটা শ্যাম্পু প্রয়োগ করলেন—
— ও-পাশের জমিজমার দামও বাড়ছে।
কেবির প্রতিক্রিয়া কিছুটা বিমর্ষ:
—বাড়ার মুখেই তো সব ঝেড়ে দিলাম বেকুফের মতো, এখন কিনতে চাইলেও আগুন-দাম, কমলেই ভালো হয়।
ভবি ভোলবার নয়। অথচ প্রজেক্টের ফিলোজফিকাল মেরুদণ্ডটার এনাটমি কেবিকে বোঝাতেই হবে, কারণ ডিজাইন ওর মাথা থেকেই বেরোবে। রঘুপতি এবার শ্যাম্পুর শেষতম ব্র্যাণ্ডটি প্রয়োগ করলেন—
— রোদ্দুরের ব্যাপারটা দেখুন হাওড়ার দিকে ঠিকমতো ছড়াতে পারলে কিইনা হত। ধরুন ফুটবলার শৈলেন মান্না। অত বড় ডিফেণ্ডার। মনে পড়ছে তাঁর দুর্দান্ত ফ্রি কিকের কথা? তাঁর ডিফেন্স এন্টিসিপেশন? বুদ্ধিদীপ্ত কভারিং? অলিম্পিকে খেলেছেন। অথচ সেই ফুটবলারের নাম পৃথিবীতে কজন জানে, সেইরকম সেতু হলে ওনার নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ত। ওনার কি ছিল না? পাঁচ ফুট দশ এগারো ইঞ্চি হাইট ছিল। উরুর কোয়াড্রিসেপ্স্, থাই-এর হ্যামস্ট্রিংস, পায়ের কাভ্স্, পাছার ফ্লেক্সর মাস্ল্স, মানে পেশীর বলিষ্ঠতা আন্তর্জাতিক স্তরের কোনো ডিফেণ্ডারের থেকেই কম ছিল না। হেক্টর শাম্পিতাস বা মেরিয়াস ত্রিসুর-এর মতো খ্যাত হওয়ার জন্যে যা যা দরকার সব কিছুই ছিল, দুটো জিনিষ ছাড়া, সম্ভবত আন্তর্জাতিক টেকনিক আর পাবলিসিটি।
ইদানিং বিশ্বায়ন বলে এক নতুন মাকড়সা জন্মাল বলেই না জাল সর্বত্র ছড়িয়েছে। পূর্ব আর পশ্চিম মেরুও বাঁধা পড়েছে সেই জালের সুতোয়, নাহলে ষাট সত্তর আশির দশকে কজন আন্তর্জাতিক কোচ কোলকাতার মাঠে দেখা যেত? সেতু না হলে কি সম্ভব ছিল, আপনি বলুন! সেতু হলো তেমনি এক সুতো। জ্ঞান বলুন, কুশলতা বলুন ভিতর থেকে যেমন তৈরি হওয়া দরকার তেমনই আমদানি করাও দরকার। আবার রফতানি হলেও ক্ষতি নেই। এ সব বিনিময়ে বাড়ে, সেতুই বলুন, সুতোই বলুন, একটা পরিবাহীর দরকার আছে।
কেবির চোখ দূরপ্রসারী হল। একটি গোলোক মাটির রঙে রঞ্জিত, মাটি ও আকাশ দুয়ের মধ্যে সর্বদা বিচরণশীল, পৃথিবীরই সংকুচিত রূপ। ভালো রিসিভার হতে গেলে উড়ন্ত বলকে নির্ভুলভাবে দেখা দরকার, ওর ত্বকের ওপর সেলাই চিহ্নগুলি, মহাদেশগুলির বিভাজন রেখা, ভরকেন্দ্রের অবস্থান স্পষ্ট জানলে তবেই বলকে রিসিভ করে স্ট্রেট শটে ডেলিভারি দেওয়া যায়। বিপক্ষের গোল-এরিয়ায় এমনকি পেনাল্টিবক্সে পাঠানো যায় অথবা সোয়ার্ভ করে গোলে শট নেওয়া যায়, চাইলে নির্ভুল শটে সেমসাইডও করা যায়। যা খুশি, ধাবমান ফুটবলের ওপর নিয়ন্ত্রণ মানে পৃথিবীর ওপর নিয়ন্ত্রণ, অথচ রক্ত ও অশ্রু কোনোটাই ফেলার দরকার নেই, শুধু কিছুটা ঘাম ছাড়া।
কথাবার্তা চলছে, হাঁটতে হাঁটতে ওরা এখন রেড রোডে, রঘুপতি বসে পড়েছেন গড়ের মাঠে ঘাসের ওপর। কেবি অনেক্ষণ স্থির হয়ে শুনছে, অদূরের কাঠবাদাম গাছটার দিকে যায়নি। ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ, কিছুক্ষণ ভেবে বলল:
— তা হলে তো পূব-পশ্চিমে কেবল সেতু বাঁধলেই হবে না, দুই মেরুর মাঝে কত জনপদ তাদের কথাও তো ভাবতে হবে।
রঘুপতি উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, শ্যাম্পুতে কাজ হয়েছে। আনন্দে কেবির পিঠে একবার হাত বুলিয়ে ফেললেন। সেই দিন থেকে কাঠবিড়ালির পিঠে তাঁর আঙ্গুলের দাগ রয়ে গেল। কেবি সেদিকে খেয়াল না করে বলে চলল:
—তা হলে ব্রিজ নয়, ফ্লাইওভার করতে হবে।
এই প্রথম কেবির দিক থেকে একটা সাজেশন এলো, রঘুপতি বেশ খুশি। কেবি বলে চলল:
—আর নির্দিষ্ট দূরত্বের পরে পরে থাকবে ফিডার রোড, এতে যানজট এড়িয়ে দ্রুত পরিবহণও হবে আবার সব জায়গার মানুষই এই সুবিধে পাবে।
—রঘুপতির মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো:
—ব্রাভো এই তো চাই।
এতটা চিন্তনক্রিয়া সম্পাদনের পর, কেবির একটু স্নায়ু-বিশ্রাম দরকার হয়ে পড়ে। কেবি চলে গেল ওয়াটগঞ্জের দিকে। ওখানে থানার আশেপাশে বাংলার একটা ঠেক আছে, গলাটা ভিজিয়ে নেওয়া দরকার। যেতে যেতে অবশ্য বলে গেল এক্ষুনি ফিরবে।
সন্ধে অতিক্রান্ত। রঘুপতি চিৎ হয়ে শুয়ে ঘাসে। পেট্রলিং পুলিশ কনস্টেবল একটু আগে এসেছিল। ওর সকাল ছ’টা পর্যন্ত ডিউটি।
দুটি একশো টাকার নোট ওর হাতে গুঁজে দিয়েছেন রঘুপতি। এখন সারা রাত এই ঘাসে শুয়ে থাকলেও অন্তত পুলিশী উৎপাতের আশংকা নেই। কেবি ফিরে আসুক, পার্ক হোটেলে ডবলত-বেড স্যুট বুক করতে হবে এক রাতের জন্য। চেক-ইন রেজিস্টারে গে-কাপল লিখলেই হবে। তা ছাড়াও কেবি বিশ্বখ্যাত ঠিকেদার, ওর কোম্পানির নামে ওকে লোকে চেনে। রঘুপতি নিজেও আইকার্ড হোল্ডার, বনবাসী হলেও নামজাদা এক ঢপের কেত্তন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় গাল ভরা পদনামের প্রোমোটি আধিকারিক। নজর পড়ল ও-পাশে আর একজন কে শুয়ে আছে। গাড়ির হেডলাইট মুখে পড়তেই দেখা গেল লোকটা পাড়ার ঘটা-পাগলা। সারাদিন নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্বরে ঘোরাঘুরি করে এখন গড়ের মাঠের ঘাসে শুয়ে আছে। ঘটাদা এক সময়ে প্রতি সপ্তাহে দেশে কবিতা পাঠাতেন, কিন্তু এমন কাউকে পাওয়া যায়না যে বলতে পারে ঘটাদার কবিতা প্রকাশিত অবস্থায় দেখেছে। রাস্তার ওপারে কোনো একটা ক্লাবের টেন্ট, শুয়ে শুয়ে ভালো বোঝা যাচ্ছে না।
এই সেই রেড রোড, রঘুপতি তিরিশ বছর আগে দুবেলা এই পথে যাতায়ত করতেন, বারোর-এ বাসে ঝুলতে ঝুলতে। তখন রঘুপতি উনিশ কুড়ি বছরের সদ্য যুবক। খিদিরপুর ডকে এপ্রেন্টিসশিপ করতেন। বাড়ি, হাওড়া স্টেশন থেকে আবার অফিস টাইমের ভিড়-বাসে মিনিট পঁয়তাল্লিশ। যেতে আসতে দিনে চার ঘন্টা। প্রচুর সময় ও এনার্জি নষ্ট হত, বাড়ি ফিরে পড়াশুনো বিশেষ কিছুই হত না। এই জন্যেই রঘুপতি বয়সকালে লেখাপড়া করতে পারেননি। এপ্রেন্টিসশিপ শেষ করে রঘুপতি পশ্চিমবঙ্গেই একটা কারখানায় চাকরি করতেন, কিন্তু বছর দুই পরে সে কারখানা উঠে গেল। কারখানাটা শোনা যায় আর খোলেনি। রঘুপতি ছাব্বিশ বছর হলো বনবাসে আছেন, পিতৃআজ্ঞায় নয়, অর্থার্জনের তাগিদে। তবে বনবাস বনবাসই, ভিটেমাটি ছাড়া। গন্ধমার্দন-এর পূবে দণ্ডকারণ্যের উত্তরে সেই বনবাস। বিশুদ্ধ বনের নিজস্ব এক আলো থাকে। কিন্তু শিল্পায়নের নামে অর্থলোলুপ হাতে সেই বন্য ছায়াতপ নষ্ট হয়ে যায়। এদিকে অনধিগম্যতার কারণে নাগরিক উন্মুক্ত চেতনার আলোও সেখানে পৌঁছয় না। এই পীড়াই রঘুপতির সেতু নির্মাণের অনুপ্রেরণা। কোথায় এক ছন্দিত গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। কান পেতে শুনলেন,
ঘটাদা স্বরচিত আওড়াচ্ছেন:
ফ্যালানির মা বুকের ভেতর লুকিয়েছিলি তিল।গড়ের মাঠের এই টেন্টগুলোতে হাওড়া থেকে প্রচুর ছেলে আসত ক্রিকেট প্র্যাকটিস করতে, হাওড়া স্টেশন হয়ে ঘুরে আসার ফলে প্রায়ই লেট হয়ে যেত। সেদিন আর ব্যাটিং কিংবা বোলিং প্র্যাকটিস করা যেতনা, সারাদিন ফিল্ডিং দিতে হত, নয়তো মাঠের বাইরে থাকতে হত। কবি দেবী রায়ের একটা অনুবাদ মনে পড়ে গেলঃ:
ফ্যালানির মা তোকে কিলোয় চিড়িয়াখানার কিল।
ফ্যালানির মা আলতো ছুঁলেও কাঁটা বিঁধে যায়।
ফ্যালানির মা ফেলতে গেলেই বাঁশপাতারা চায়।
............................................................................
ফ্যালানির মা ঘায়ের আগুন ঢাকবে সে কোন ছাই।
ফ্যালানির মা ফুরিয়ে যেতেও রাস্তা জানা চাই।
“হাফিজ।:তখন এই বিদ্যাসাগর সেতুটা থাকলে এই অসুবিধে হতনা। সেতু অনেক কিছু জুড়ে দেয়।
তুমি কোণঠাসা ভিখিরি ছাড়া—:
আর কিছুই নও!:
চুপচাপ থাকো।:
রাজনীতির গুঢ়তত্ব একমাত্র রাজারাই জানেন।”:
খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকতে থাকতে নক্ষত্র গ্রহগুলি দেখতে দেখতে রঘুপতি হঠাৎ ছায়াপথ আবিষ্কার করে ফেললেন, অনেকটা আলোর ধোঁয়ার মতো কিন্তু চলমান নয়। যেন এক আলোক-চাদর। ওপাশে ঘটাদা চাদর মুড়ি দিয়েছেন, শীত করেছে হয়তো। ঘটাদা চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। দুই পা হাঁটুর কাছে মোড়া, মাথা ছাড়া সর্বাঙ্গ চাদরে আচ্ছাদিত। দুই জানুর মধ্যবর্তী স্থান চাদরে ঢাকা, সেখানে সেতুর রেপ্লিকা। মনে পড়ে ঠাকুমা ইন্দুমতী শীততকালে চাদর ঢাকা দিয়ে এই মুদ্রায় শুয়ে থাকতেন।
রঘুপতির প্রথাগত শিক্ষা বেশি নেই। তবে শুনেছেন দৃশ্যমান ছায়াপথের বাইরেও নাকি ছায়াপথ আছে। মানে এক চাদরেই সব ঢাকা পড়েনা। এণ্ড্রোমিডা ছায়াপথ আয়াস-সাধ্য হলেও কখনো কখনো খালি চোখেও দেখা যায়। সে নাকি এ রকমই আর এক চাদর যা এই চাদর থেকে আলাদা।
ধুস এসব ছায়াপথ-টথের কম্ম নয়। একটাই চাদর চাই একমেবাদ্বিতীয়ম, যা দিয়ে ঢাকা যায় নিখিল মনুষ্যত্ব।
এরপর রঘুপতি হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দালানে। ব্রহ্মবেদীর পাদদেশে। বাংলা হরফে লেখা স্পষ্ট দৃশ্যমান:
অসতো মা সদ্গময়।আরো এক পংক্তি শ্লোক লেখা দেওয়ালের ওপর দিকে, রঘুপতি সংস্কৃতজ্ঞ নন, মানে বুঝতে পারলেন না। হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে এলেন বারবাড়ির লনে। সেখানে একটা ম্যাজেন্টা রঙের আধতেল ঘুড়ি কেটে পড়ছে হাফতা সমেত। হেলেদুলে পড়ছে অথচ কেউ আসছেনা ঘুড়ি লুটতে। ডাগর-ডোগোর টগর গাছের ডালে এক বুলবুলি বসে আছে। রঘুপতি হাঁটতে হাঁটতে ওর খুব কাছে চলে এলেন অথচ বুলবুলিটা ত্রস্ত হয়ে উড়ে গেল না, শুধু অহংকার কিংবা অবজ্ঞায় অথবা কৌতুকে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল। ওর লেজের তলা দিয়ে যেতে যেতে গোচর হল পুচ্ছের লাল পালক। রঘুপতি ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলেন রবীন্দ্র সরনির ওপর ঠাকুরবাড়ির ফটকের সামনে। রাস্তার উলটো দিকের বাড়িটা কেন যেন ভাঙা পড়ে আছে। এখন বিকেল। পশ্চিম আকাশ লাল, ফটক লালিমায় উদ্ভাসিত। রঘুপতির মনে হল রহস্যময় বুলবুলির লাল পুচ্ছ-পালক ক্রমশ বিছিয়ে যাচ্ছে পূব থেকে পশ্চিমে, চরাচর ঢাকা পড়ছে।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়।
তিনি আজকেই হাওড়ার বাড়ি থেকে দুপুর গড়িয়ে যেতে বেরিয়েছিলেন, ঠাকুরবাড়ি দেখবেন বলেই। বিকেল সাড়ে চারটেয়ে
ঠাকুরবাড়ির মিউজিয়ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ির ভিতরেই ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিলেন। তারপর এসব কি কাণ্ড, কোন সেতু, কোন গড়ের মাঠে রাত কাটানো? তিনি কি স্বপ্ন দেখছিলেন? কিন্তু দিনের বেলায় চলতে চলতে এরকম স্বপ্ন দেখা সম্ভব? তিনি তো গাঁজা, মারিহুয়ানা, চরস, আফিম এমন কি মদও খান না। একমাত্র সিগারেট ছাড়া কোন নেশাই তাঁর নেই। তা হলে এটা কি করে সম্ভব? নাঃ সিগারেট কম্পানি নিশ্চই আজকাল তামাকের সঙ্গে পাঁচ মিলিগ্রাম করে হাশিশ মেশাচ্ছে। কনজিউমার কোর্টে একটা কেস ঠুকে দিতে হবে। মোবাইলে ডেট আর সময় দেখলেন। ঠিকই আছে। তবে স্বপ্নই দেখছিলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল একটা অস্বাভাবিক লাল আভা চাদরের মতো, ঢেকে নিচ্ছে সব কিছু। কিন্তু যদি প্রজেক্ট, সেতু, ফ্লাইওভার, চাদর, বাস্তব হয়?
মোবাইলে রিং টোন বাজছেঃ
শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাকি আশ্চর্য! তাঁর মোবাইলে রিংটোন টাইমার নিয়ন্ত্রিত, এই সময় কোনো কল এলে কল্যাণ ঠাটে ভূপালী রাগ বাজার কথা! পকেট থেকে ফোন বার করে দেখলেন: ওয়ান মিস কল। সিলেক্ট-কি প্রেস করে দেখলেন কোনো নম্বর ডিসপ্লে হচ্ছে না।
আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থুঃ,
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি
নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়।
এ সব কি পাগলামি চলছে?
তা হলে কেবি, কেবি কোথায়? ওর তো ফিরে আসার কথা।
পশ্চিম আকাশ থেকে একটা লম্বাটে আকারের ছাইরঙা মেঘ ভেসে আসছে। ওর সরু দিকটা ধাবমান কাঠবিড়ালির লেজের মতো, প্রশ্নসূচক। মেঘটা মাথার ওপর এসে থেমে গেল, লেজটাও আকার পাল্টে সরল রেখা হয়ে গেল।
হঠাৎ নজর গেল শার্টের ডানদিকের কাফের দিকে। লিপস্টিকের ছাপ। সস্তা লিপস্টিকের এই রংটাই তো ছিল বাসের মহিলার ঠোঁটে। লিপস্টিকের ছাপ তো আর কোথা থেকেও লাগার সম্ভবনা নেই। রঘুপতি সোনাগাছি যাননি, কোনদিনই সে তাগিদ বোধ করেন নি।
না: একবার নিউরোলজিস্ট দেখানো দরকার। কিন্তু কি করে দেখাবেন? কালই বনবাসে ফিরতে হবে। ছুটি এক্সটেণ্ড তো হবেই না উল্টে গহনতর বনে ট্রান্সফার হতে হবে। বসের ওয়ার্নিং দেওয়াই আছে।
রঘুপতি দেখলেন, রাস্তায় একটা টানা-রিকশ যাচ্ছে। ঠুনঠুন করে বিগতকালের পেতলের ঘন্টি বাজছে, ভোজপুর আগত রিকশওলা আনে-বালে ফিল্মের গানা গাইছেঃ
রাজমিস্তিরি বোলস্ ঘর-উর নাহি বনাইব্
জুলহা বনকে চাদর বনাইব্।