• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫১ | জুন ২০১২ | গল্প
    Share
  • জামানত : সুবীর বোস


    মি বেশ ছোটবেলা থেকেই জানতাম যে, ইংল্যান্ডের জর্জ বেস্ট বিশাল মাপের ফুটবলার ছিলেন। এও জানতাম যে, অত বড় মাপের ফুটবলার হওয়া সত্বেও জর্জ বেস্টকে কখনও বিশ্বকাপ ফুটবলের আঙিনায় দেখা যায়নি। বহুদিন পর্যন্ত বেস্টের এই “বিশ্বকাপ” এর বাইরে থাকা ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল “অমন তো কতই হয়” গোছের কিছু একটা। কিন্তু মাঝে একদিন ইউ টিউবের দৌলতে জর্জ বেস্টের পুরোনো দিনের ফুটবল স্কিলের কিছু চমকপ্রদ ভিডিও দেখে মনে হল, জর্জ বেস্ট কেন বিশ্বকাপের বাইরে এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে, হবেই। তো সেই খোঁজ নিতে গিয়ে প্রথমেই জানতে পারলাম যে, জর্জ বেস্টের “বিশ্বকাপ”এর বাইরে থাকার বেশ বড় একটা কারণ ছিল রঙিন জল। তাঁর নাকি অত্যাধিক আসক্তি ছিল রঙিন জলে। কিন্তু তাতে কী? এই একই আসক্তি তো “মহাজীবনের মণিকণা” ঘাঁটলে অনেকের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে। মনে হল, তার মানে মূল সমস্যাটা নিশ্চয়ই আরও গভীরে আছে। ফলে আরেকটু বিশদে জর্জ বেস্টকে নিয়ে পড়লাম। এবারে জানা গেল যে, উনি পোশাক বদলানোর মতো বান্ধবী বদলাতেন এবং কথাবার্তাতেও এই প্রবাদ প্রতিম খেলোয়াড় সেই রিদমটা মেনটেন করে বলে গেছেন, পেলে আমার মতো দেখতে সুন্দর হলে কিছুতেই বড় ফুটবলার হতে পারতেন না। হুম্‌ম্‌, এ ক্ষেত্রে ইঙ্গিতটা, বলাই বাহুল্য, বেশ স্পষ্ট হয়েই ধরা দিল আমার কাছে।

    এবং এই স্পষ্ট ইঙ্গিতটাই আমাকে বেশ বিমর্ষ করে দিয়ে গেল। পেলে দেখতে খারাপ কিনা জানি না। তবে আমি খুব খারাপ দেখতে। জর্জ বেস্টের মন্তব্য পেলের কানে যাওয়ার পর তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন কিনা জানা নেই। অন্য দিকে আমি ফুটবলার হতে পারলাম কিনা সেটা নিয়েও আমার তেমন মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু ওই বান্ধবী এবং পোশাকের জায়গাতে এসেই আমি মন খারাপের রাজত্বের বাসিন্দা হয়ে যাই। আসলে যিনি বান্ধবীর সঙ্গে পোশাকের তুলনা করেছেন – তিনি না জেনেই পোশাক বা জামা নিয়ে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা আর ধারণাটাকেই আরও পোক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

    বহুবার প্রত্যাখ্যাত আমি স্কুল জীবনে কিছুতেই তেমন কোনো জামার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পারিনি বলে কলেজে ভর্তি হয়েই বন্ধুবান্ধবদের দেখানোর মতো একটা জামার খোঁজে ছিলাম। মিথ্যে বলে লাভ নেই, চাইতাম জামাটা যেন সাদা হয়। আমি চাইতাম সেই জামাটা পরে আমি কলেজে যাব, ক্যান্টিনে আড্ডা মারব, সুযোগ পেলে -সিনেমা হলের অন্ধকারে সে জামার শরীরের গন্ধ নেব। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক না কেন - আমি কলেজ জীবনেও কিছুতেই তেমন কোনো জামার কাছাকাছি পৌছতে পারছিলাম না। তার উপরে যে দিন থেকে রাজু এসে আমাদের কলেজে ভর্তি হল, জর্জ বেস্ট যেন আমার নাগালের মধ্যে এসে গেলেন আর তারপর থেকেই জামা বৃত্তান্ত আরও বিচ্ছিরি একটা শেপ নিয়ে নিল।

    রাজু কলেজে ভর্তি হবার কিছু দিন পর থেকেই লক্ষ্য করলাম সুদর্শন রাজুর গায়ে কয়েক দিন পর পরই নতুন জামা শোভা পাচ্ছে। রাজুকে দেখতাম, আজ এই জামা পরে কলেজের মাঠে গিয়ে বসছে তো দিন কয়েক পরে পুকুর পাড়ের চাঁপা গাছের নিচে যে বসে আছে সে সম্পূর্ণ অন্য রাজু – গায়ে অন্য জামা। দেখে হিংসে হত, কষ্ট হত, রাগ হত। আমার কাছে তখন ও জর্জ বেস্ট, আমার কাছে তখন ও “জামাখোর”।

    রাজুর জামাগুলোর মধ্যে খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিল একটা সাদা জামা। সময়-সুযোগ পেলেই খুব করে তাকিয়ে থাকতাম ওই সাদা জামাটার দিকে। মনে মনে সে জামার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আমি কত রাত যে প্রায় না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি তার সাক্ষী আছে কেবল আমার কম দামি তক্তপোশটা। রাজু বোধহয় আমার এই প্রায় লজ্জাহীন “পরিদর্শন” লক্ষ্য করেছিল। ফলে যা হবার তা হল। একদিন কলেজ ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছি – রাজু এসে সরাসরি আমাকে চার্জ করল, তোর ব্যাপারটা কী বল তো বাবলু?

    রাজুর মুখ দেখে বুঝেছিলাম যে, আমি গণ্ডগোলটা ভালোই পাকিয়েছি। তবু কিছুই জানি না এমন একটা ভাব করে বললাম, কেন আমি আবার কী করলাম?

    —কী করেছিস, তুই জানিস না? রাজু চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
    —না, জানি না তো। আমি মিনমিন করে বলি।
    —আমি যখনই সাদা জামাটা পরে ঘুরি, তুই অমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকিস কেন বল তো?
    —- আমি তোর দিকে তাকিয়ে থাকব কেন বল তো? দেখ...সম্পর্কটা...ইদানিং সরকার স্বীকৃতি দিলেও...আমি ঠিক ও রকম নই। তুই মনে হয় ভুল করছিস। আমি ব্যাপারটা গুলিয়ে দেবার চেষ্টা করি।

    রাজু দেখলাম আমার উল্টো-পাল্টা কথায় একটুও প্রভাবিত না হয়ে বলল, তুই যে আমার দিকে তাকাস না সেটা আমি ভালো করেই জানি। আমার প্রশ্ন, তুই আমার সাদা জামাটার দিকে অমন হাভাতের মতো তাকিয়ে থাকিস কেন?

    বুঝতে পারছিলাম, ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে উঠছে। তবু কী করে যেন আমার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল, আসলে ওই সাদা জামাটা তোর বড় হয়। ওই জামাটা ঠিক মানায় না তোকে।

    আসলে এ রকম দুমদাম কিছু কথা আমার মুখ দিয়ে আমার অজান্তেই বেড়িয়ে যায়। এর কয়েক দিন আগেই একদিন শিয়ালদা ষ্টেশনের চারের এ প্ল্যাটফর্ম থেকে তাড়াহুড়োয় ভুল করে চলন্ত ট্রেনের লেডিজ কামরায় উঠে পড়েছিলাম। ব্যস, আর যায় কোথায়। একজন মোটা গোঁফওয়ালা পুলিশ সোজা আমার দিকে এগিয়ে এসে হুঙ্কার দিল, এটা লেডিজ কামরা। এখানে উঠেছেন কেন? আমার মুখ দিয়ে সেদিনও বেড়িয়ে গিয়েছিল, আসলে আপনাকে দেখে বুঝতে পারিনি যে এটা লেডিজ কামরা। আমার উত্তর শুনে মনে হল জোঁকের মুখে নুন পড়েছে। সেদিন সেই গোঁফওয়ালা আমাকে এরপর খুব গম্ভীরভাবে বলেছিল, পরের ষ্টেশনে নেমে কামরা বদলে নেবেন।

    এখানে তেমন কিছু ঘটল না। উলটে আমার কথা শুনে রাজু ব্যাপক রেগে গেল। বলল, আমাকে কী মানায় আর মানায় না, সেটা তোকে দেখতে হবে না। ভবিষ্যতে তুই এ সব নিয়ে সাবধানে থাকিস।

    রাজু চলে গেল। কিন্তু সেদিনের ঘটনাটার অল্প কিছুদিন পরেই লক্ষ্য করলাম রাজু তার সাধের সাদা জামাটা ত্যাগ করেছে। অন্তত এক মাস ভালো করে রাজুকে ফলো করে দেখলাম, অন্য সব জামাগুলো থাকলেও আমাদের “জর্জ বেস্ট”এর সাদা জামাটা হঠাতই উধাও।

    রাজুর এই “ত্যাগ” দেখে তো আমার মনে তখন ব্যাপক আনন্দ। তবে সে আনন্দটা স্থায়ী হয়েছিল মাত্রই কয়েকদিন। কারণ দিন কয়েক পরেই দেখি আমার ক্লাস মেট সন্দীপ ওই সাদা জামাটা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক এই জায়গাটাতে এসেই আমি পুরো ঘেঁটে গেলাম। কারণ জর্জ বেস্টের ছেড়ে যাওয়া জামা কে পরত অনেক ঘেঁটেও সে তথ্যটা কিছুতেই জোগাড় করতে পারলাম না। এও জানতে পারলাম না যে ওই দ্বিতীয় ব্যক্তিটিও ঘন ঘন পোশাক বদলাতেন কিনা। মানে যদি দ্বিতীয় ব্যক্তি জর্জ বেস্টের অনুসারী না হন তো, আমার আশা এখানে শেষ। ফলে সন্দীপ এবং সাদা জামা এই দৃশ্যটা দেখার পর থেকেই, মাইরি বলছি, লাইফটা একদম ভারতীয় দু’ টাকার নোটের মতো হয়ে গেল। মানে আমার অস্তিত্ব আছে কিন্তু আমি থেকেও নেই। যে জামাটা আমি অমন গভীরভাবে চেয়েছিলাম, তা কিনা সন্দীপের গায়ে। নাহ্‌, একদমই মেনে নিতে পারছিলাম না ব্যাপারটা।

    এরপর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো আরও একটা সমস্যা আমার দিকে ধেয়ে এল। আমার কেন জানি না মনে হল, আমি নই, রাজুর অন্য জামাগুলোই আমার উপর নজর রাখছে। বুঝতে পারলাম এ ব্যাপারে আসল কলকাঠি নেড়েছে রাজু নিজেই। মানে আমার “পরিদর্শন” সুখটাও গেল আর কী!

    ভারতীয় দু’টাকার নোট হয়ে যাওয়া আমি তাই মনের দুঃখে একদিন কলেজের ফুচকাওয়ালাকেই জিজ্ঞেস করে বসলাম, ভাই, তোমাদের ওখানে নিশ্চয়ই জামা জোগাড় করা খুব সহজ।

    বিহারবাসী সে ফুচকাওয়ালা তার হাসিতে প্রজাপতি উড়িয়ে বলল, দেখুন বাবলুদা, আমরা গরিব মানুষ। আমরা বেশি জামা কোথায় পাবো? তাই আমাদের গাঁয়ে অনেক বাড়িতে একটা জামা-ই তিন-চার জন ভাগ করে পরে।

    ফুচকাওয়ালার উত্তর শুনে আরেকটু হলে গলায় ফুচকা আটকে মারা পড়ছিলাম! বুঝতে পারলাম জামা নিয়ে পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন জামানত প্রথা রয়েছে।

    ঠিক এই সময়েই আমাদের বাড়ির একতলায় একজন নতুন ভাড়াটে এলেন, নাম কাজল মিত্র। একা মানুষ এবং বেজায় রসিক। আমার সঙ্গে কাজলদার প্রথম পরিচয়ের দিনে আক্কেল দাঁতের ব্যাথায় কাবু আমি ভালো করে কথা বলতে পারছিলাম না। স্বভাব রসিক কাজলদা আমার অবস্থা দেখে বললেন, দেখ বাপু, দাঁতে যদি ব্যথা হয় – আর হাতে যদি টাকা না থাকে – দুটোই খুব চাপের ব্যাপার। তোমার অবস্থাটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। থাক, আজ আর বেশি কথা বলতে হবে না। আমি তো রইলাম। কথা হবে, অনেক কথা হবে।

    ব্যস, সে দিন থেকেই কাজলদা আমার খুব পছন্দের লোকের তালিকায় ঢুকে পড়লেন। কাজলদার সঙ্গে এরপর আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ল এবং দু’চারদিন পরেই কাজলদাকে আমার “জামা সমস্যা”র ব্যাপারটা খুলে বললাম। কাজলদা শুনে বললেন, তুমি শুধু জামা নিয়ে ভাবছ বলেই এত সমস্যা। তুমি একদম ভুল রাস্তা নিয়েছ। আরও বড় জায়গায় হাত বাড়াও, জামা সমস্যা এমনিতেই মিটে যাবে। কাজলদার কথা শুনে আক্ষরিক অর্থেই কনফিউজড আমি বললাম,

    —ব্যাপারটা একটু ভেঙে বললে ভাল হয় কাজলদা।
    —ঠিক আছে, খুব সোজা করে বলি। ধর তুমি নোবেল পুরস্কার পেলে। তারপর? —তারপর কী? —আরে তারপর তো পদ্মবিভুষণ, পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী এগুলো তো এমনিতেই এসে যাবে তাই না?

    কাজলদার হেঁয়ালিপূর্ণ কথায় আমি আরও ঘেঁটে যাই। তাই খুব সরাসরি বললাম,

    —আপনিই বলুন না ঠিক কী করা উচিত আমার? —দেখ তোমার এই অ্যাসাইনমেন্টের প্রথম ধাপে ঠিক কী করা উচিত, কী ভাবে করা উচিত, এগুলো বলতে গেলে তোমাকে মহাভারতের যুগে ফিরে যেতে হবে। কাজলদা ফের হেঁয়ালি করে বলেন।

    —মহাভারতের যুগে? আমার জামা প্রেমের মধ্যে আপনি মহাভারত টেনে আনছেন দেখে বেশ চাপে পড়ে যাচ্ছি কাজলদা। আজ ছেড়ে দিন। পরে একদিন এ সব নিয়ে আমরা আলোচনা করব। আমি বেশ কেটে কেটেই বললাম কথাগুলো।

    —বেশ তুমি যখন চাইছ না, তবে আজ থাক ও সব আলোচনা। কাজলদা আমার সামনে শাটার নামিয়ে দিলেন।

    কাজলদার “মহাভারত” শোনার অপেক্ষা না করে কেন জানি না একদিন সন্দীপকে বলেই ফেললাম, অ্যাই, রাজু তোকে ওর সাদা জামাটা দিয়ে দিল কেন রে? কোনো ভূমিকাহীন এমন একটা সরাসরি প্রশ্নে সন্দীপ বেশ বিরক্ত হয়ে বলল,

    —তোকে কে বলেছে যে ওটা রাজুর জামা? —সে আমি দেখেই চিনতে পেরেছি। আমি বেশ আত্মবিশ্বাসী গলায় বললাম। —তা কী দেখে চিনলি? বুক পকেট, নাকি ঘাড়?

    সন্দীপের প্রশ্নে আমি যেন একটু বিদ্রুপের ছোঁয়া পেলাম। তবু একটুও না দমে আমি বললাম, হ্যাঁ, জামাটার ঘাড় দেখে আমি চিনতে পেরেছি।

    —ঘাড় দেখে? সন্দীপের অবাক প্রশ্ন। —হ্যাঁ, ঘাড় দেখে। রাজুর সাদা জামাটার ঘাড়ের দিকে আমি লক্ষ্য করেছি একটা তিল দাগ ছিল। সেটা দেখেই... সন্দীপ আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল, শালা, ভালোই তো নজর। তো - আর কী কী লক্ষ্য করেছিস শুনি।

    প্রশ্নটা সন্দীপ এত বাজে ভাবে ছুঁড়ে দিয়েছিল যে একটু উত্তেজিত হয়েই উত্তর দিয়েছিলাম, তুই যা ভাবছিস, ব্যাপারটা তা নয়। এ কথা সত্যি যে, ওই সাদা জামাটা আমার খুব পছন্দ। আর পছন্দ বলেই জামাটাকে আমি সময় সুযোগ পেলেই দেখতাম, খুব করে দেখতাম। আর জেনে রাখ, আমি রাজুকে বলেছিলাম – সাদা জামাটা ওর পক্ষে বড়, ওকে ওই জামাটা পরে মানাচ্ছে না। সে জন্যেই আমার ধারণা রাজু জামাটা ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছে।

    আমার এত বড় বক্তৃতা শুনে সন্দীপ ফের গলায় বিদ্রুপ এনে বলল, আরে বাবলুবাবু তো জামা নিয়ে ডক্টরেট করেছেন। তা, এরপর কি আমাকেও বলবি যে, জামাটা আমায় মানাচ্ছে না?

    সন্দীপ এর মধ্যেই কলেজ ইউনিয়নের বেশ ভালো জায়গায় পৌছে গেছে। সব ঠিক থাকলে কলেজে আগামি জি.এস. ও-ই। এ ছাড়া ও রগচটা বলে কলেজে একটা বদনামও আছে। ওকে চটানো ঠিক হবে না ভেবে নিয়ে বললাম, তোকে ব্যাপক মানিয়েছে জামাটায়।

    —বলছিস? —হ্যাঁ বলছি। আমি ফের হাসিমুখে বলি।

    এরপর খুব ধীরে কিন্তু নিশ্চিন্তে আমার জামা প্রেম এবং তার মূল্যায়নের কথা আরও বেশি করে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং আমি একটা “খোরাক”এ পরিণত হই। মনে মনে আরও ভেঙে পড়া সে দিনগুলোতে আমি রোজ নিয়ম করে জর্জ বেস্টকে গাল পাড়তাম।

    একদিন এমন গাল পাড়তে পাড়তেই মনে হল, যাই একবার কাজলদার কাছে। গেলাম। কাজলদাকে সব ঘটনা জানিয়ে বললাম, এবার কি আপনার সময় হবে “মহাভারত” শোনানোর। কাজলদা বললেন,

    —তুমি শুধু শুধু এত চিন্তা করছ। দেখ না, ক’দিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। —কাজলদা, আমি ছোটবেলা থেকেই ঠোক্কর খেতে খেতে বড় হয়েছি। ফলে লোকে আমাকে নিয়ে ঠিক কী ভাবল, সেটা নিয়ে আমি অতটা চিন্তিত নই। —তবে তোমার চিন্তা কী নিয়ে? —জামা, কাজলদা জামা। আমার দোষ বলতে তো একটাই। আমি দেখতে খারাপ। তাই তো? কিন্তু সে জন্যে...

    আমার কথা শেষ হবার আগেই কাজলদা আমাকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, আমি আজ অফিসের কাজে দিল্লী যাচ্ছি। ফিরব মাস খানেক পর। ফিরে এসে তোমাকে “মহাভারত” কথা শোনাব।

    —আজ হয় না কাজলদা? আমি অনুনয় করি। —সে বেশ জটিল ব্যাপার। একটু রয়ে-সয়ে বলতে হবে। বলছি তো, দিল্লী থেকে ফিরেই...

    আমার তখন রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল। কেন যে সেদিন কাজলদাকে বাধা দিলাম। তবু বললাম, কিন্তু কাজলদা, এই এক মাস তো আমার কাছে খুব চাপের হয়ে যাবে।

    —কোনো চাপের ব্যাপার নেই। মাথা ঠান্ডা রাখো। —কিন্তু... —কোনো কিন্তু নেই।

    কাজলদা দিল্লী চলে যাওয়ার পর দিন থেকেই কলেজে নির্বাচনের ঘন্টা বেজে উঠল। কলেজে তখন অন্য রঙের খেলা। সন্দীপ তখন সারা কলেজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ভাবলাম সন্দীপের ঘনিষ্ঠ হলে আগামিতে আমার শিকে ছিঁড়লেও ছিঁড়তে পারে। ফলে তোষামোদের রাস্তা নিলাম। একদিন সন্দীপকে বললাম, ওই দেওয়াল লেখা আর পোস্টার লাগানোর দায়িত্বটা আমাকে দে না সন্দীপ।

    —তোকে? খেপেছিস নাকি? সন্দীপ সটান জবাব দিল। —প্লীজ সন্দীপ, আমাকে একটা সুযোগ দে’। শুধু ওই কাজগুলো নয়, সঙ্গে তুই আরও কাজ দে’ আমি ঠিক নামিয়ে দেব।

    আমার কথা শুনে সন্দীপের ভুরু জোড়া দেখলাম একবার কুঁচকে গিয়েই আবার সোজা হয়ে গেল। তারপর বলল, আচ্ছা সে না হয় দিলাম। কিন্তু বদলে তোকে কী দিতে হবে?

    আমি ঠিক ওই প্রশ্নটার অপেক্ষায়ই ছিলাম। বললাম, আমাকে যদি ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ...

    আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সন্দীপের ধমক, তুই থাম। তোর মতো থান ইঁটকে সি.আর. বানালে আমাদের ইউনিয়নই উঠে যাবে। যা যা, তোকে কিস্‌সু করতে হবে না।

    খুব কষ্ট হয়েছিল কথাগুলো শুনে। তবু হাল ছাড়িনি, সন্দীপের পিছু ছাড়িনি। ঠিক পরদিনই ফের সন্দীপকে কলেজ ক্যান্টিনে একা পেয়ে বললাম, সন্দীপ আমাকে একটা সুযোগ কি দেওয়া যায় না?

    এবার সন্দীপ আমার কথা শুনে ব্যাপক রেগে গেল। তারপর চিৎকার করে আরও কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে ওর কাছাকাছি ডেকে নিয়ে বলল, মিট দিস গাই। উনি সি.আর. হতে চান। ওনার যোগ্যতা বলতে – খুব ভালো জামা চেনেন। খুব খুঁটিয়ে দেখেন জামার দোষ-ত্রুটি এবং কার গায়ে কোন জামা ফিট করে, এটা উনিই সবচেয়ে ভালো বলতে পারেন এই কলেজে। তা, বন্ধুগণ, এখন এই রত্নটিকে নিয়ে কী করা হবে আপনারাই বলুন।

    চারদিকের প্রবল বিদ্রুপ আর হাসির মধ্যে ডুবে গেলাম আমি। চারদিকের টুকরো টুকরো মন্তব্যের ভিড়ে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা আমি এক সময় টের পেলাম আমি একদম একলা বসে আছি কলেজ ক্যান্টিনের কোণের দিকে একটা চেয়ারে। মনে হচ্ছিল, আর বাড়ি ফিরতে পারব না।

    ঠিক সেই সময় সন্দীপের বিরোধী দলের নেতা শঙ্কর তার দলবল নিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম, আবার বুঝি শুরু হল নতুন যন্ত্রণা।

    কিন্তু আমাকে অবাক করে শঙ্কর দেখলাম বলল, বাবলু, আমি জানি, সন্দীপটা খুব বাড় বেড়েছে। তুই চিন্তা করিস না, আমরা তোর সঙ্গে আছি।

    ওই সামান্য প্রশ্রয়ী কথাগুলো শুনে আমার চোখে জল চলে এল। শঙ্কর ফের আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, আজ থেকে তুই আমাদের দলের হয়ে কাজ করবি। আর হ্যাঁ, তোকে আমরা সি.আর. এর নমিনেশন দেব।

    আমি বুঝতে পারছিলাম যে, ও গুলো ছিল রাজনীতির কদর্য খেলার একটা দিক। শঙ্কর জানতো যে, ওরা সীটটা এমনিতেই পাবে না। তবু, শুধু রাজনীতির চালে অন্তত একটা ভোট বাড়িয়ে নেবার জন্য শঙ্করের ওই খেলাটা কেন জানি না, আমার খারাপ লাগল না। মনে হল, অন্তত একটা সাপোর্ট তো পাওয়া গেল।

    সেই সাপোর্টের জন্যেই কিনা জানি না, পরের দিন থেকেই আমার ভিতর থেকে মিনমিন করা মানুষটা অনেকটাই উধাও হয়ে গেল। বুঝতে পারছিলাম শঙ্করের দলের হয়ে দেয়াল লেখা, পোস্টারিং, এমনকি প্রয়োজনে ছোট-খাট বক্তৃতা দেওয়া আমাকে দেখে সন্দীপ এবং তার দলবলও বেশ অবাক হচ্ছিল।

    এর মধ্যে একদিন শুনলাম সন্দীপও “সাদা জামা” ত্যাগ করেছে। নির্বাচনের মুখে এমন একটা ভালো খবর পেয়ে বেজায় খুশি আমি শঙ্করকে অন্তত ওই সাদা জামা থেকে দূরে রাখার জন্য একটা ডাহা মিথ্যে বলে ফেললাম। বললাম, সন্দীপ তো ইদানিং ওই সাদা জামাটা নিয়ে যা তা বলে বেড়ায়।

    —কী বলে? শঙ্কর অনুসন্ধানী। —কী আবার বলবে। বলে, ওই জামাটার বুক পকেট নাকি ওর খুচরো পয়সার চাপে প্রায় ছিঁড়ে গেছে...

    আমার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দেখলাম শঙ্কর উঠে দাঁড়াল। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, শালা, বহুত বেড়েছে। একটা, শুধু একটা সুযোগ পেলে...

    শঙ্করের শেষ কথাটা আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আসলে ওটা তো আমারও কথা। সুযোগ তো আমিও খুঁজছিলাম।

    এবং কলেজ ইউনিয়নের ভোটের দু’দিন আগে সে সুযোগ এসে গেল। সেদিন কলেজের গেটে আমি আর সন্দীপ মুখোমুখি। আমাকে দেখেই উত্তেজিত সন্দীপ বলল, আমার কাছে খবর আছে তুই আমার নামে অনেক উল্টো-পাল্টা বলে বেড়াচ্ছিস।

    আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম কলেজের অনেক ছাত্র-ছাত্রী বেশ কিছুটা দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। দেখলাম এই সুযোগ। আমি মাথা নিচু করে খুব আস্তে আস্তে বললাম, এ আর কী দেখেছিস, তোর আরও অনেক কিছু দেখার বাকি আছে।

    আমার কথা শুনে স্পষ্টতই স্তম্ভিত সন্দীপ চীৎকার করে বলল, তোর সাহস তো কম না।

    সন্দীপের চীৎকার শুনে অন্য ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। আমি ফের মাথা নিচু করে হাত জোড় করে ফিসফিসিয়ে বললাম, আজ সত্যি কথা বলি, ওই সাদা জামাটা তোকে মানাত না আর কলেজের জি.এস. এর পদেও তুই একই রকম বেমানান। জানিস তো, ছ’ নম্বর পায়ে ন’ নম্বর জুতো পরলে জুতোটা কেমন ঢলঢল করে...

    সন্দীপ আমাকে আর একটাও কথা বলতে না দিয়ে কলার চেপে ধরল। আমি তখনও মাথা নিচু, করজোড়ে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছি, তোর জি.এস. হবার সাধ এবার আমি ঘুচিয়ে দেব। এরপরই কিল, চড়, ঘুষির বন্যার মধ্যে আমি টের পেলাম দূর থেকে অন্য ছাত্র-ছাত্রীরা দৌড়ে আসছে। ওরা কাছে আসা মাত্র আমি আমার পরিকল্পনা মতো কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমি তোকে হাতজোড় করে বললাম, আমাকে আর প্লীজ যেখানে-সেখানে এভাবে অপমান করিস না। আমি জানি যে, আমি দেখতে খারাপ। তার জন্য তুই আমাকে যখন যেখানে পাবি অপমান করবি – এটা তো হতে পারে না।

    আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র আরেকটা ঘুষি আছড়ে পড়ল আমার নাকে। আমি অজ্ঞান হবার আগে শুনতে পেলাম শঙ্কর আর তার দলবল চীৎকার করে বলছে, সন্দীপের এটা খুব অন্যায়। ওর বাবলুর গায়ে হাত তোলার কোনো অধিকার নেই। আমরা আজ এর একটা হেস্তনেস্ত চাই।

    আমার জ্ঞান ফিরল একটা ওষুধের দোকানে। বেশ খানিকটা রক্তক্ষরণে খুব দুর্বল আমি দেখলাম আমার সামনে কলেজের অনেক ছেলে-মেয়ে ভিড় করে আছে। ওদের কথাবার্তাতে টের পেলাম সন্দীপ খুব ভালো মতো ফেঁসেছে এবং এই মারধোরের ব্যাপারটা অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে।

    ঠিক সেই সময়ে ওষুধের দোকানের এক কর্মচারি যে আমাকে ইঞ্জেকশন দিয়েছিল, বলল, এটা কিন্তু পুলিশ কেস হওয়া উচিত।

    ভদ্রলোকের কথায় আমি কেঁপে উঠলাম। সত্যি বলতে কী, সন্দীপের অমন বিপদ দেখে আমি কেন জানি না ঠিক আনন্দিত হতে পারছিলাম না। তাই তাড়াতাড়ি আমাকে ঘিরে থাকা ভিড়কে উদ্দেশ্য করে বললাম, না, না, পুলিশকে জানানোর মতো ব্যাপার নয় এটা। এই তো আমি ঠিকই আছি।

    আমার মনে হচ্ছিল, সন্দীপ আমাকে মেরেছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি আর কেউ না জানুক আমি তো জানি যে, আমি কী ভাবে প্ররোচিত করেছি ওকে সে কাজটা করতে। আমার এই মানসিক পরিবর্তনে, আমি নিজেও বেশ অবাক হচ্ছিলাম।

    ঠিক তখনই ওই ওষুধের দোকানে সন্দীপ ঢুকল মাথা নিচু করে। চারপাশে গুঞ্জন। শঙ্কর এবং দলবল ফুঁসছে। সন্দীপ দেখলাম কোনো কিছুতে ভ্রুক্ষেপ না করে আমার পাশে বসে বলল, বাবলু, আমার অন্যায় হয়ে গেছে, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি চাইলে তোর বাড়িতে আলাদা করে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু যে অন্যায় আমি করেছি তাতে সবার সামনে ক্ষমা না চাইতে পারলে আমার নিজেরও ভালো লাগত না।

    এই সন্দীপকে আমি চিনি না। সন্দীপের এই আত্মসমর্পণ আমাকে যেন মানসিক দিক দিয়ে বেশ খানিকটা দুর্বল করে দিয়ে গেল। বললাম, এ কী কথা বলছিস সন্দীপ? অপরাধী তো আমিও। ভাই, সত্যি বলছি তোর উপর আমার কোনো রাগ নেই। তুইও পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমাদের এই আন্তরিক কথোপকথনে টের পেলাম আমাদের ঘিরে থাকা ভিড়ের মধ্যে একটা অন্য ধরণের গুঞ্জন তৈরি হল।

    আমার কথা শুনে সন্দীপ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ফের খুব আস্তে আস্তে বলল, আমি আমার দলের ছেলেদের বলে দিয়েছি তোকে ভোট দিতে। জানি না, আজ আর ওরা আমার কথা শুনবে কিনা। তবু আমার ইচ্ছেটা তোকে আর এখানে জড় হওয়া সব্বাইকে বলে গেলাম।

    কথা শেষ করে সন্দীপ চলে গেল। সন্দীপ চলে যেতেই বোঝা গেল জনতা জনার্দন ফের বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে সন্দীপকে নিয়ে। আশপাশ থেকে গুঞ্জন উঠল, সত্যি মানতেই হবে সন্দীপ ইজ এ রিয়েল লীডার।

    পরদিন শুনলাম, নির্বাচনের ঠিক আগে এমন একটা কাণ্ড ঘটানোর জন্য সন্দীপের দলের এক বড়কর্তা সন্দীপকে ডেকে ব্যাপক ধমকে দিয়েছেন। মূলত সেই নেতার কথাতেই সন্দীপ অমন নেতিয়ে পড়েছিল এবং আমার পক্ষে সহানুভূতির ভোট গুঁজে দেওয়ার বুদ্ধিটাও সেই নেতারই মস্তিক প্রসূত। কারণ সে নেতা নিশ্চিত ছিলেন যে, প্রয়োজনে আমাকে তিনি ওঁদের দলে নিয়ে নিতে পারবেন। সব শুনে আমার মনে হয়েছিল, কারণ যাই হোক না কেন, আমি তো এক ধাপ এগনোর সুযোগ পেয়ে গেলাম!

    নির্বাচনের আগের রাতে বাড়ি ফিরে খুব ক্লান্ত লাগছিল। তখনও গা-হাত-পায়ের ব্যথা কমেনি। শুয়ে ছিলাম বিছানায়। হঠাতই শুনতে পেলাম কাজলদার গলা, বাবলুবাবু বাড়ি আছ নাকি? যন্ত্রণা ভুলে আমিও বেশ জোরেই জবাব দিলাম, হ্যাঁ, কাজলদা ভিতরে আসুন, আমি ঘরেই আছি।

    কাজলদা ঘরে ঢুকে আমার অবস্থা দেখে কিছু একটা আন্দাজ করলেন। তারপর বললেন, কী হয়েছে বলো তো তোমার?

    —না কাজলদা, তেমন কিছু গুরুতর ব্যাপার নয়। কিন্তু আপনার তো এক মাস পরে ফেরার কথা ছিল। আজ তো সবে পনের দিন হল। কী ব্যাপার বলুন তো? আমি হাসতে হাসতেই বললাম।

    —আরে কাজ মিটে গেল, তাই ফিরে এলাম। কিন্তু তোমাকে তো বেশ কাহিল দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা কী একটু খুলে বলো তো ভায়া।

    এরপর কাজলদাকে গোটা ঘটনাটা বর্ণনা করলাম। আমার কথা শেষ হবার পর দেখলাম কাজলদা মুচকি মুচকি হাসছেন। আমি ওই হাসি দেখে বেশ বিরক্ত হলাম। মনে মনে ভাবলাম, শালা, আমি মরছি নিজের যন্ত্রণায়, আর উনি হাসছেন। শেষে বলেই ফেললাম, কাজলদা, আমার কথা শুনে আপনার হাসি পেল?

    —না, আমি হাসছি কারণ ভাবছি তোমাকে মহাভারতের গল্পটা এখনও বলা হয়নি তাতেই এই। কাজলদা হঠাৎ যেন রহস্যময় হয়ে যান। —কী বলছেন কাজলদা, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

    কাজলদা দেখি তাও মুচকি মুচকি হাসছেন। এবার আমি চেপে ধরলাম কাজলদাকে। বললাম, আজ আপনার মহাভারত না শুনে আপনাকে ছাড়ছি না। উত্তরে কাজলদা বললেন, আমিও তো বলতে চাই গল্পটা। আর আজকের দিনে এই গল্পটা না বললে এই গল্পটারই আর কোনো মূল্য থাকবে না। তারপর কাজলদা বলা শুরু করলেন –স্বর্গের পথে থুড়ি মহাপ্রস্থানের পথে চলেছেন যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব এবং দ্রৌপদী। এ ছাড়া সারা রাস্তা তাঁদের সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে একটি সারমেয় অর্থাৎ একটি কুকুর। এবং স্বশরীরে স্বর্গে পৌঁছনোর বহু আগেই দেখা গেল একে একে সহদেব, নকুল, দ্রৌপদী, অর্জুন, ভীম রাস্তায় দেহ রাখলেন।

    —আরে ধুর এগুলো তো আমি জানি। বেশ বিরক্ত হয়েই বললাম কথাটা। —বাবলুবাবু, একটু ধৈর্য ধরে শোনো। মাঝে বাঁধা দিও না। —ঠিক আছে বলুন।

    কাজলদা ফের বলা শুরু করলেন, স্বর্গের খুব কাছাকাছি গিয়ে একসময়ে যুধিষ্ঠিরকেও থেমে যেতে হল। যুধিষ্ঠির বুঝতে পারলেন যে, তিনিও আর এগোতে পারছেন না। হতাশ যুধিষ্ঠির যখন স্বশরীরে স্বর্গে যাবার আশা প্রায় ত্যাগ করেছেন, সে সময় দৈববাণী হল, বৎস যুধিষ্ঠির, থামলে কেন, দ্রুত এস, আমরা তোমার অপেক্ষায় আছি।

    —কী করব প্রভু, আমি তো আর এগোতে পারছি না। এ ছাড়া আমি পথও চিনি না। যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন।

    —বৎস, তোমার ঠিক সামনে যে সারমেয়টি আছে, সে স্বর্গের রাস্তা চেনে। তুমি ওকে অনুসরণ করো। ফের দৈববাণী হল।

    যুধিষ্ঠির সামনে তাকিয়ে দেখলেন, কুকুরটি আছে, কিন্তু তার নড়াচড়ার কোনো ইচ্ছে আছে বলে মনে হচ্ছিল না। তাই যুধিষ্ঠির ফের বললেন, প্রভু, এ সারমেয় তো নড়াচড়ায় ইচ্ছুক নয় বলেই মনে হচ্ছে।

    —বৎস, তুমি ওই সারমেয়র পশ্চাতের পদযুগল সবলে চেপে ধর। ওই সারমেয়ই তোমাকে স্বর্গে পৌঁছে দেবে। স্বর্গ থেকে উত্তর এল।

    যুধিষ্ঠিরও উপায়ন্তর না দেখে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে কুকুরের পিছনের পা’ দু’টোকে আঁকড়ে ধরেন। এখানেও বিপত্তি। কুকুর এক পাও নড়ে না। যুধিষ্ঠির করুণ কন্ঠে ফের বলেন, প্রভু, এই সারমেয় সম্ভবত আর এগোতে ইচ্ছুক নয়।

    —ভুল বৎস, ভুল ধারণা তোমার। তুমি বরং একটা কিছু দিয়ে সারমেয়টির পশ্চাতে সামান্য আঘাত কর। দেখ সে দৌড়বে আর তুমিও স্বর্গে পৌঁছে যাবে।

    —কিন্তু প্রভু আমার দু’ হাত তো ব্যস্ত। আঘাত করব কী ভাবে? —ভাবো, বৎস ভাবো।

    শেষ বাক্যটা যুধিষ্ঠিরকে চিন্তায় ফেলে দেয়। তবু, যুধিষ্ঠির বলে কথা। উপায় একটা বেরল। যুধিষ্ঠির তাঁর জিভ দিয়ে হালকা করে কুকুরটার পিছনে সুড়সুড়ি দিলেন। ব্যস, কুকুর দিল দৌড় এবং যুধিষ্ঠির স্বর্গে। স্বশরীরে।

    কাজলদা থামলেন। সবটা শুনে প্রচণ্ড বিরক্ত আমি বলেই ফেললাম, কাজলদা এটা কী হলো? এই গল্পের শেষটুকু মনে হচ্ছে আপনার অবদান। তবে মূল কাহিনি মানে যুধিষ্ঠিরের স্বশরীরে স্বর্গে গমনের ব্যাপারটা তো সব্বাই জানে...

    কাজলদা আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, বৎস, গল্পটা সবাই জানে। কিন্তু গল্পের গভীরে লুকিয়ে থাকা আপ্তবাক্যটা সবাই বোধহয় জানে না।

    —আপ্তবাক্য? এখানে আপ্তবাক্য তো একটাই। সারাজীবন সৎ থাকলে স্বশরীরে স্বর্গে যাওয়া যায়।

    এখানেই মজাটা লুকিয়ে আছে। তুমি গল্পটা যে দিক থেকে দেখেছ বা ভেবেছ, তা থেকে ওই আপ্তবাক্যটাই পাওয়া যায়। আমি কাহিনিটাকে দেখেছি অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে। কাজলদা বেশ আত্মবিশ্বাসী ঢঙে কথাগুলো বলল।

    —সেই আপ্তবাক্যটা কি এখন বলা যাবে, নাকি এটাও মাসখানেক পর? আমি অভিমানী গলায় বললাম।

    হা,হা, হা, বাবলুবাবুর দেখছি ফের অভিমান হয়েছে। না, না, এখনই বলছি। শোনো তাহলে। আপ্তবাক্যটা হল, তুমি যদি নেতাদের পা’ ধরে থাকো তো তোমার কোনো উপকারই হবে না। হবে, তোমার সব হবে, যদি তুমি সে নেতার পিছনে কাঠি দিতে পারো।

    কাজলদার ব্যাখ্যায় স্তম্ভিত আমি পুরো চুপ করে গেলাম। ফের কাজলদা বললেন, বাছা বাবলু, তুমি এই আপ্তবাক্যটা না জেনেও কী সুন্দর সামলেছ সন্দীপকে।

    কাজলদার কথা শুনে আমিও ভেবে দেখলাম, সত্যিই তো, ব্যাপারটা তো সেরকমই ঘটেছে। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল সাদা জামার কথা। বললাম, কিন্তু কাজলদা, ওই সাদা জামাটার কী হবে? ওটা নিয়ে যদি কিছু একটা আপ্তবাক্যের সন্ধান দেন তো ভালো হয়।

    আমার কথা শুনে কাজলদা হাসেন। তারপর চোখ দুটো বড় বড় করে বলেন, ওখানে আবার ওই একই ফর্মুলা প্রয়োগ করতে যেও না যেন বাবলুবাবু।

    —আরে না, না। কিন্তু একটা উপায় তো বলুন। আমি কাতর গলায় বলি।

    —বাছা বাবলু, ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ হওয়া মানে তো একধাপ এগিয়ে যাওয়া। তাই না? খেয়াল করলে দেখবে অবিক্রিত বহু বিশ্বকর্মা মূর্তিই কয়েক দিন পরে বদলে গিয়ে কার্তিক ঠাকুর হয়ে গেছে। সবই সময়ের ব্যাপার বাছা, সবই সময়ের ব্যাপার।

    —এর গভীরেও কোনো আপ্তবাক্য আছে নাকি কাজলদা? আমি শুধোই।

    —আছে তো বটেই। তবে তা আজ নয়, অন্য দিন, অন্য কোনো দিন। কাজলদা আমার সামনে এবার খুব বড় করে শাটার নামিয়ে দেন।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)