• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫১ | জুন ২০১২ | প্রবন্ধ
    Share
  • ‘ফেমিনিজম’: কিছু বিভ্রান্তি, কিছু সংশয় : দূর্বা বসু


    ভালোবাসার তাগিদেই বিপ্লবের জন্ম—কতকটা এরকমই দাবী করেছেন পাওলো ফ্রেরী (Paulo Freire), বিখ্যাত শিক্ষাবিদ তাঁর সুপরিচিত বই Pedagogy Of the Oppressed-এ। বলেছিলেন চে গুয়েভারারাও—প্রকৃত বিপ্লবের উত্‍স জীবনকে, মানুষকে ভালোবাসায়। ‘ফেমিনিজম’-ও বিপ্লব। এটি এমন বিপ্লব বা অঙ্গীকার যা সেই ভালোবাসাকেই কানায়-কানায় ভরে নিতে চায়। অথচ এই ‘ফেমিনিজম’ নিয়ে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তির, ভীতির সীমা নেই আজও। সংশয় আরও বাড়ে যখন কোনো শিল্পী, বুদ্ধিজীবী নিতান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে ঘোষণা করে বসেন “আমি তো ‘ফেমিনিস্ট’ নই”। আসলে, নারীবাদ-সংক্রান্ত সমস্ত আলোচনা সীমিত বুদ্ধিজীবী মহলে, কলেজ-ইউনিভার্সিটির সেমিনার ইত্যাদির গণ্ডিতে। তাই প্রত্যেকদিনের জীবনে তার প্রাসঙ্গিকতা অধরা থেকে যায়, বিষয়টির চরম অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে।

    একথা ঠিক যে ‘ফেমিনিস্ট’ মতাদর্শ উঠে এসেছে মেয়েদের জীবনের এক বিশেষ সামাজিক-ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে। কিন্তু নারীবাদ তো সীমিত নয় কেবল মেয়েদের ব্যক্তিগত সমস্যার মোকাবিলায়, বরং অন্য যেকোনো আন্দোলনের, আদর্শের তুলনায় ফেমিনিজম-এর মূল বার্তা অনেক বিস্তৃত—একথা স্পষ্ট করে বলার সময় এসেছে। এ যেন এক মস্ত ছড়ানো শামিয়ানা যার তলায় আজ মানবাধিকারের প্রায় সবকটি মূল প্রশ্ন দাঁড়িয়ে, কারণ সবরকম সামাজিক শোষণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারীবাদ। তাই বলা যেতে পারে নারীবাদ এক বিশ্ববোধ। আজ, যখন পৃথিবী জুড়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় মৌলবাদ, বিশ্বায়নের নামে উগ্র ভোগবাদের মধ্যে দিয়ে ঔপনিবেশিকতাই নতুন খোলসে জাঁকিয়ে বসছে তখন প্রয়োজন এমন বিশ্ববোধ যা মানুষের অজস্র পার্থক্যগুলিকে, সীমারেখাগুলিকে অগ্রাহ্য না-করেও অখণ্ড মানব অস্তিত্বের হদিস দিতে পারে—“নারীবাদ” সেই উদার আহ্বান। এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে এমন দাবীর ভিত্তিটা কী। এ বিষয়টি ওপর-ওপর বুঝতে গেলেও ‘ফেমিনিজম’-এর ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। ইতিহাসের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে দেখে নেওয়া যাক বিষয়টি কোথায় স্বতন্ত্র। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে নারীবাদ সব রকম সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে যে যেকোনো সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে মার্ক্সবাদই তো যথেষ্ট। তাহলে আলাদা করে ফেমিনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন হল কেন? অনেকদিন পর্যন্ত ধরে নেওয়া হয়েছিল শোষণ-চক্র, যে ধাঁচেরই হোক না কেন শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত জীবনের বাইরের (external) অভিজ্ঞতা। পরিবারের ভিতরটি শোষণহীন। নারীবাদ এই ‘স্বতঃসিদ্ধ’ ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। পারিবারিক পরিবেশও যে প্রায়শই অগণতান্ত্রিক, মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী—সব সম্পর্কের ভিতরেই মেয়েদের আসন পুরুষের নীচে। এ বিধান আদৌ প্রকৃতির নয়, বরং এক দীর্ঘ সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতি—এমন উপলব্ধি পুরোনো সমস্ত হিসেব-নিকেশকে আমূলে বদলে দিয়েছে। নারী-পুরুষের একেবারে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্কের ভিতরের বৈষম্যকে চিহ্নিত করার মধ্যে দিয়ে পিতৃতন্ত্রের গোড়ায় আঘাত হেনেছে। শুধু মেয়েরাই নয়, ক্ষমতাবান পুরুষও এর শিকার। ‘ক্ষমতার’ একটা নিজস্ব ভার আছে বৈকি! পুরুষরাও তাদের ‘বীরত্বের’, ‘পৌরুষের’ ভার বইতে-বইতে ক্লান্ত, তাই এই মরচে পড়া খাঁচা থেকে মুক্তি পুরুষেরও কাম্য—এই চেতনা অবশ্যই ফেমিনিজম-এর দান।

    “পশ্চিমী অনুকরণ”: প্রাচ্যের নারী-আন্দোলন, নারীবাদ সংক্রান্ত আলোচনার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হল এই সব উদ্যোগই নাকি পশ্চিমী-অনুকরণ। ইতিহাসকে টুকরো করে দেখার সহজ অভ্যাস থেকে এই ধারণা। আসলে, ঔপনিবেশিক যুগের পরবর্তী অধ্যায়ে ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞানের আসরে ‘পশ্চিমী দাপট’ (western hegemony) এক বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেকোনো নিরপেক্ষ আলোচনাকে প্রায় অসম্ভব করে দিয়ে। একদিকে পশ্চিমের ধনতান্ত্রিক, প্রগতিশীল দুনিয়া, আর, অন্যদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার ‘তৃতীয় বিশ্ব’—পশ্চিমী ঘরানার এই অতি-সরলীকরণের ঝোঁক ইদানিং একটু ধাক্কা খেলেও আজও অনেকাংশেই অব্যাহত। আমরা ভুলে যাই যে ইতিহাস কেবল দু-এক শতকের নয়, অনেক বেশি পুরোনো। আর, যেকোনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, তা সে যত প্রাচীনই হোক না কেন, নিয়ত চলমান, পরিবর্তনশীল। আমরা মনে রাখি না যে কো্নো একটি বিশেষ অঞ্চলের সভ্যতা-সংস্কৃতি স্বয়ম্ভু বা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বিভিন্ন সভ্যতা-সংস্কৃতি একে অপরের সঙ্গে জড়িয়েই এগিয়েছে ক্রমাগত লেনদেনের মধ্যে দিয়ে। অর্থাৎ, বিশ্বায়ন একবিংশ শতাব্দীর ঘটনা নয়, এ প্রক্রিয়া চলছে একেবারে সভ্যতাবিকাশের আদি থেকে। তাই মানবিক বোধ, বুদ্ধি কিংবা যুক্তি প্রয়োগের দক্ষতা কোনও একটি বিশেষ সংস্কৃতির একচেটিয়া নয়। আচার-বিচারের পাশাপাশি প্রতিবাদের স্রোত একই সঙ্গে বয়ে চলে সব সমাজেই। একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে, যেখানে হাজার-হাজার বছর ধরে নানা সভ্যতার স্রোত এসে মিলেছে-মিশেছে। আর তা না হলে আমাদের প্রাচীন মহাকাব্যে ধর্মীয় আচার-বিচারের সঙ্গে চার্বাক মুনির নাস্তিকতার সহবাস সম্ভব হতো না, কিংবা মেয়েদের প্রতি পুরুষের/সমাজের অন্যায়ের পাশাপাশি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে পেতাম না দ্রৌপদীকে।

    আধুনিক কালে মেয়েদের অধিকারের প্রসঙ্গটি প্রায় সব সমাজেই সামনে চলে এসেছে সেই অঞ্চলের বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে। ভারতবর্ষে নারী-আন্দোলন দানা বাঁধে উনবিংশ শতাব্দীতে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় থেকে। মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অধিকার, পর্দা-বিরোধী আন্দোলন—এ সবই শুরু হয়েছিল ওই সময়। গ্রেট ব্রিটেন, কী আমেরিকাতে তখনও নারী-আন্দোলন পাকাপাকি ভাবে শুরু হয়নি। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার সময় জওহরলাল নেহরু আর তাঁর সহকর্মীদের নেতৃত্বে নতুন ভারতের যে গণতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হয় তাতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকের সমান রাজনৈতিক-সামাজিক অধিকারের বিষয়টি স্পষ্ট ভাষায় মেনে নেওয়া হয়, সেই ১৯৫১ সালেই, হাজার বছরের পুরোনো বর্ণাশ্রমের রীতিকে বর্জন করে। আমেরিকায় তখনও Equal Rights Amendment পাস করা যায়নি, তখনও তা স্বপ্ন মাত্র। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে কুসংস্কারের পাশাপাশি প্রতিবাদের ঐতিহ্য কেবল তথাকথিত হিন্দুসমাজেই নয়, এই ধারা ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়েরও। ফেমিনিস্ট রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের “সুলতানার স্বপ্ন”-এর (Sultana’s Dream) একটি চরিত্র দাবী করে বসে: "পর্দার আড়ালে পুরুষকেই বন্দী করে রাখা উচিত কারণ তারাই সমস্যার উত্‍স,” (Nussbaum 45)।

    এবার সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। পশ্চিমী সমাজগুলিতে আধুনিক ধনতন্ত্রের দৌলতে ব্যাক্তিকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নারী-পুরুষের সম্পর্কের বৈষম্যের প্রশ্নটিও সামনে এগিয়ে এসেছিল। আমেরিকায় একেবারে শুরুতে গৃহযুদ্ধের সময়, আবার ষাটের দশকে সিভিল রাইটস আন্দোলনের সময়, সে সমাজের মধ্যবিত্ত, সাদা মেয়েরা স্পষ্ট গলায় বলতে শুরু করেন যে সবরকম সামাজিক শোষণের মূলে রয়েছে sexism, অর্থাৎ নারী-পুরুষের সামাজিক ভূমিকার ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত বৈষম্য। মূলস্রোত ফেমিনিস্টরা নিজেদের সামাজিক অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পুরুষকেই তাঁদের মূল শত্রু হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড় করলেন। দাবী করে বসলেন মূল লড়াইটা হওয়া উচিত পুরুষের আর পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। প্রত্যেকবারই এগিয়ে আসেন ‘কালো’ মেয়েরা, মধ্যবিত্ত মেয়েদের দাবীর অসম্পূর্ণতাকে ধরিয়ে দিতে। ঘরের বাইরে দাসত্বের বোঝা, আর ভিতরে বেকার কিংবা হতোদ্যম পুরুষটির দাপট কুড়োতে-কুড়োতে আফ্রো-আমেরিকান মেয়েরা সামাজিক শোসনের খাঁচাকলটির প্রকৃতি ও চেহারাটা আরেকটু স্পষ্ট করে দেখতে পেলেন। তাঁদের চোখে ধরা পড়ল আরেকটি মস্ত সত্য: যে শোষিত সে নিজেও আবার শোষকের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে (যেমন, দাস মহিলার সঙ্গে তার সাদা মালকিনের সম্পর্ক)। তাঁরা বুঝেছিলেন যে সমস্যাটি শুধু ‘নারী-পুরুষ’ স্তরেই নয়, আরেকটু জটিল। যেকোনো দলিত বা প্রান্তিক গোষ্ঠীর ভিতরেও আবার মেয়েদের স্থান পুরুষের নীচে। অর্থাৎ, দলিত মেয়েদের ক্ষেত্রে শোষণ চলে দুটি স্তরে, একবার ‘নীচু-তলার’ মানুষ হিসেবে, আবার আরেকবার স্রেফ মেয়ে হিসেবে। তাঁদের দাবী পিতৃতন্ত্রের খাঁচায় শুধু মেয়েরাই নয়, পুরুষও বন্দী। ঊনবিংশ শতাব্দীর পরে আবার বিংশ শতাব্দীতে, ষাটের দশকে মার্টিন লুথার কিং-দের নেতৃত্বে সিভিল রাইটস আন্দোলনের সময় নতুন উদ্যমে শুরু হল নারীমুক্তি আন্দোলন। আগের মতই কালো মেয়েরা তাঁদের সঙ্গে মূলস্রোত মেয়েদের অভিজ্ঞতার পার্থক্যটিকে স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করতে পিছপা হলেন না। ‘কালো’ মেয়েদের সঙ্গে গলা মেলালেন ‘তৃতীয় বিশ্বের’ ফেমিনিস্টরা। তাঁরা বললেন নারীবিদ্বেষ-এর সঙ্গে বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক ইত্যাদি সব উঁচু-নীচুর হিসেবগুলির একটা জৈবিক যোগ আছে, তাই কোনও একটিকে আলাদা করে শুধরোনো যাবে না। সবগুলি লড়াই একসঙ্গে লড়তে হবে। এই উপলব্ধি ফেমিনিস্ট মতাদর্শ এবং আন্দোলনকে একলাফে শৈশব-কৈশোর পার করে আজকের পরিণত চেহারায় পৌছে দিল। এর ফল দাঁড়াল সুদূরপ্রসারী। ফেমিনিস্ট বিচার ধীরে ধীরে সমাজবিজ্ঞানের পুরোনো হিসেব-নিকেশকে অনেকটাই বদলে ফেলতে বাধ্য করল। আজ যেকোনো সমাজের উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে কেবল তার জাতীয় আয় নয়, সামাজিক সম্পদ এবং সুযোগ-সুবিধের কতটুকু সেই সমাজের দরিদ্রতম মানুষ, বিশেষ করে মেয়েদের নাগালে—তারই ভিত্তিতে নির্ণয় করার রেওয়াজ চালু হয়েছে।

    খাতায়-কলমে নারী-পুরুষের সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়টি মোটামুটিভাবে স্বীকৃতি পেলেও আজও যেকোনো সমাজেই পুরুষের তুলনায় মেয়েরা সবরকম সামাজিক সুযোগ-সুবিধে থেকে অনেক বেশি বঞ্চিত (এক্ষেত্রে সমাজের ‘নীচের তলার’ গোষ্ঠীকেই হিসেবে রাখতে হবে)। এ ব্যাপারে ভারতবর্ষের মতো সমাজগুলির অন্তর্দ্বন্দ্ব বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সেখানে সমাজ নির্দ্বিধায় নির্বাচন করছে মহিলা দেশনেত্রী, আবার সেই সমাজেই এখনো কন্যাভ্রূণ হত্যার ঘটনা প্রত্যেকদিনের বাস্তব। শুধু বাইরের সমাজেই নয়, পরিবারের ভিতরেও মেয়েদের অযত্ন, অপুষ্টির মর্মান্তিক পরিণতি দেখে শিউরে উঠছি আমরা বারবার। রাষ্ট্রসংঘের মানব উন্নয়নের দলিলে দেখা যাচ্ছে মেয়েদের সংখ্যা পুরুষের নীচে চলে গেছে, প্রকৃতির নিয়মকে উল্টে দিয়ে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের আনুপাতিক হার একসময় দাঁড়িয়েছিল ৯২.৭: ১০০ (Nussbaum 4) । এই তথ্য প্রমাণ করে যে যথার্থ মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক সুযোগ-সুবিধে থেকে মেয়েরা আজও বঞ্চিত। মনে রাখতে হবে এমনটি ঘটছে ভারতবর্ষের মতো একটি সাংবিধানিক গণতন্ত্রে।

    আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং গরীব মেয়েরা: উনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর শুরু অবধি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইগুলো ছিল বিভিন্ন আঞ্চলিক/ভৌগোলিক সীমানায় সীমিত, মূলত: বিভিন্ন পশ্চিমী ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে। আজ, একবিংশ শতাব্দীতে চেহারাটা বদলেছে। সরাসরি রাজনৈতিক দখলদারির পরিবর্তে অর্থনৈতিক আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে গরীব দেশগুলির টুঁটি টিপে ধরার নতুন কলা-কৌশল হিসেবে তৈরি হয়েছে ‘বিশ্বায়ন’, অর্থাৎ বিশ্বজোড়া আন্তর্জাতিক ধনতন্ত্রের অবাধ বাজার। আজকের নয়া উদারনীতির জোয়ারে গরীব দেশগুলির দরিদ্রতম মানুষের প্রত্যেকদিনের রুজি-রোজগার ভেসে যেতে বসেছে, কারণ সবকিছুই আজ কোম্পানির আর্থিক লাভ-ক্ষতির হিসেবে। বলাই বাহুল্য সে লাভের সবটুকুই চলে যাচ্ছে সমাজগুলির উপরের ১ শতাংশ মানুষের ভাণ্ডারে। বিশ্বজোড়া সেই একই ছবি—দুর্বল শ্রেণীর উপর, বিশেষ করে মেয়েদের উপরেই এসে পড়ছে তার কোপ। যে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অঞ্চলের সব মানুষের এতকাল ছিল সমান অধিকার তা দখল করে বসছে বড়বড় বহুজাতিক কর্পোরেশন, গরীব মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে। তারই জেরে গড়ে উঠছে চিপকো আন্দোলনের মত গণ-প্রতিবাদ, মেয়েরাই এগিয়ে আসছেন নেতৃত্ব দিতে। কেবল প্রাচ্যের দেশগুলিতেই নয়, আমেরিকার মত ধনী দেশগুলির গরীব মানুষ সম্পর্কে এই বহুজাতিক সংস্থাগুলি সমান নির্মম, উদাসীন। আর তাই কলকারখানার ক্ষতিকারক বর্জ্যপদার্থ ঢেলে দেওয়ার জন্য অনায়াসে নেটিভ আমেরিকানদের বসতি বেছে নেওয়া হচ্ছে। আর্থিক লাভ-ক্ষতির হিসেবে দরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনগুলির কোনও স্থান নেই। উপছে পড়া ঐশ্বর্যের দেশ আমেরিকায় দরিদ্র মা (বেশিরভাগ সময়েই আফ্রো-আমেরিকান কিংবা ল্যাটিনো) একলা শিশুসন্তান নিয়ে কোনরকমে দিনপাত করছেন, আর তাঁদের জন্য বরাদ্দ অতি সামান্য সরকারি অনুদান বন্ধ করার যাবতীয় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, জাতীয় ঋণের বোঝা কমানোর অজুহাতে, দেশের সেই কর্ণধারেরা যাঁদের লাগাম ধরা আছে বিশাল বহুজাতিক করপোরেশনগুলির হাতে।

    বহুজাতিক সংস্থাগুলির এই বিশ্ব-জোড়া বাজার-অভিযানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অঞ্চলে ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে গণবিক্ষোভ। ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে সর্বগ্রাসী ধনতন্ত্র কিন্তু খুলে দিয়েছে দরজা: গায়ের রঙ, জাতীয় সীমারেখা, ধর্ম, জাতপাতের ঊর্ধে উঠে নারী-পুরুষকে এক মঞ্চে এসে দাঁড়ানোর সুযোগ। তবে, পা ফেলতে হবে খুব সাবধানে। কারণ ধনতন্ত্র এক অদ্ভুত জটিল ব্যবস্থা, তার মূল লক্ষ্য হল ‘লাভ’, আর যে কোনও অবস্থা, এমন কি তারই বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনকে পর্যন্ত চুম্বকের মত টেনে নিতে পারে সেই লাভের হিসেবে (আধুনিক মেয়েদের ‘সুগন্ধি’-র নাম “emancipation’—এই রকম আর কি)। লাভের স্বার্থে সে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ঐতিহ্যগত ভাগাভাগিকে (পুরুষ ‘উপরে’, মেয়েরা ‘নীচে’) কখনো বজায় রেখে চলে, আবার প্রয়োজনে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। পশ্চিমে ‘দাসপ্রথা’ কৃষিশ্রমের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের কোনও পার্থক্য রাখেনি। আবার, একই সঙ্গে ‘সাদা’ মধ্যবিত্ত মেয়েদের ক্ষেত্রে ‘ঘরে-বাইরের’ অভ্যস্ত ব্যবস্থাকে বজায় রেখে চলেছিল। আজকের ধনতন্ত্র গত শতাব্দীর তুলনায় অনেক বেশী ‘উন্নত’। বাইরে গণতন্ত্রের তকমা এঁটে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদকে ধরে রাখতে সে এক জটিল, নিপুণ জাল বিছিয়েছে বিভিন্ন স্তরে, সেই স্তরগুলি আবার পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অচ্ছেদ্য বাঁধনে। একদিকে সে কাজে লাগাচ্ছে গরীব দেশগুলির দরিদ্রতম গোষ্ঠীর মেয়েদের কায়িক শ্রম, অজস্র নিম্নমানের কল-কারখানায় মূলত: ‘তৃতীয় বিশ্বের’ দেশগুলিতে, পশ্চিমী সমাজের নিজেদের ধার্য ন্যূনতম পারিশ্রমিকটুকুও ফাঁকি দিয়ে। খানিকটা তারই জেরে আমেরিকার মত সমাজের গরীব, বিশেষ করে আফ্রো-আমেরিকান ছেলেদের বেকারত্বের সমস্যা জটিল হয়ে উঠছে। অজস্র বেকার যুবক আঁকড়ে ধরছে ‘হিংসা’ এবং ‘বন্দুকের’ জীবন। ‘আইনের দৌলতে’ ‘কালো’ যুবকের ‘স্পর্ধা’ থাকছে নিয়ন্ত্রণে, ওদিকে চলছে বন্দুকের রমরমা ব্যবসা। বলাই বাহুল্য ‘কালো’ মানুষ আর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা গরীব ‘অ-নথিভুক্ত’ শ্রমিক ভরে তুলছে দেশগুলির জেলখানা। উপছে পড়া জেলখানা থেকে আরও জেলখানা—এইভাবে জমে উঠছে ‘জেলখানার ব্যবসা’। এক্ষেত্রে এই কারাগার-ব্যবসাকে বিঘ্নহীন রাখার দায়-দায়িত্ব পালন করে চলেছে আইন-আদালত বিভাগ—এক নিখুঁত বোঝাপড়া। সামান্য মারিজুয়ানা পকেটে রাখার অপরাধে ‘কালো’ এবং গরীব ল্যাটিনো ছেলেদের যেতে হচ্ছে জেলে, ধরে রেখে দেওয়া হচ্ছে দীর্ঘদিন, আর ‘কারাগার-ব্যবসা’-র মুনাফা থাকছে অটুট। ‘বর্ণবিদ্বেষ’, পুরোনো সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধকে জিইয়ে রেখে ধনতন্ত্র কেমন করে তার মুনাফার হিসেব অক্ষত রাখে তার আরেকটি অভিনব উদাহরণ দেওয়া যাক। পশ্চিমের বর্ণবিদ্বেষী সমাজে ‘কালো’ মেয়েদের ঘন, কোঁকড়া চুল সাধারণত ‘সৌন্দর্যহানিকর’ হিসেবে ধরা হয়। এদেশে ‘বিউটি পার্লার’গুলোতে অল্পবয়সী ‘কালো’ মেয়েরা ভিড় করে তাই চুল ‘সোজা’ করতে। পার্লারগুলিতে ‘সোজা’ চুল সরবরাহ করে ভারতবর্ষের মত দেশ। আমাদের দেশে মন্দিরে মেয়েরা মানত ক’রে অনেকসময় মস্তকমুণ্ডন করে। তাদের সেই চুল চলে আসে পশ্চিমী বাজারে ‘কালো’ মেয়েদের ‘প্রয়োজন’ মেটাতে। পশ্চিমের বর্ণবিদ্বেষ আর প্রাচ্যের সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের এমন নিবিড় যোগাযোগের দৃষ্টান্ত মেলা ভার!

    তবে ইতিহাস এখানেই শেষ নয়। জাতীয় সীমারেখা পেরিয়ে ধনতন্ত্র যেমন তার ফাঁদ পেতেছে বিশ্ব জুড়ে, আবার তাকে রুখতে মানুষও আজ অনেক বেশি সচেতন এবং সংঘবদ্ধ। আধুনিক টেকনোলজিকে কাজে লাগিয়ে ‘মধ্যপ্রাচ্যের বসন্ত’ কখনো ‘শিকাগো’-র রাস্তায়, কখনো ‘সিয়াটেল’ শহরে, কখনো গ্রীসের রাস্তায়, কখনো বা কলকাতায়। আজকের ধনতন্ত্র-বিরোধী এই আন্তর্জাতিক আন্দোলনকে সফল হতে হলে একদিকে তার গর্ভে মূল ফেমিনিস্ট মন্ত্রকে ধরে রাখতে হবে। অন্যদিকে বিভিন্ন অঞ্চলের নারী-আন্দোলনগুলিকে তাদের নিজস্ব ‘সীমারেখা’ (জাতীয়, আর্থিক শ্রেণিগত, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মের পার্থক্য ইত্যাদি) উত্তীর্ণ হয়ে সামিল হতে হবে ‘বিশ্বায়ন-বিরোধী’ লড়াইয়ের মঞ্চে। এই দুই যৌথ প্রয়াসের সমন্বয়ের মধ্যেই বোধহয় নিহিত আছে অপেক্ষাকৃত সুস্থ, মানবিক, বাসযোগ্য এক পৃথিবীর সম্ভাবনা।

    উল্লেখিত বই:

    Freire, Paulo; Pedagogy of the Oppressed, Continuum, New York, 1970
    Nussbaum, Martha C.; Women and Human Development: The Capabilities Approach, Cambridge University Press, 2000



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)