• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫০ | ফেব্রুয়ারি ২০১২ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • আমাদের UK সফর : রাহুল মজুমদার


    আঠারোই অকটোবর, রাত আটটা -

    'দুরন্ত' বেগে দিল্লী হয়ে 'দেরাদুন জনশতাব্দী' বাহিত হয়ে হরিদ্বার স্টেশনে পৌঁছে শেষ হলো আমাদের এবারের UK, মানে 'উত্তরাখণ্ড' ভ্রমণের প্রথম পর্ব। কালের কবলে এককালের হরদ্বার আজ পাকাপাকিভাবে হরিদ্বার। স্টেশন থেকে অটোবাহনে চলেছি বিষ্ণুঘাটে, আস্তানার খোঁজে।

    রাত সাড়ে আটটা -

    মা গঙ্গা সগর্জনে ছুটে চলেছেন হাতবাড়ানো দূরত্বে। পথের আলো তাঁর বুকে পড়ে টুকরো টুকরো হীরের জাল তৈরি করছে। পেটের ছুঁচোরা মহাসমারোহে কীর্তন শুরু করেছে।

    উনিশে অকটোবর, ভোর পৌনে পাঁচটা -

    কানের কাছে উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্রপাঠের যন্ত্রণা আর ঘন্টাধ্বনির ঘনঘটায় ঘুমবাবাজী পগার পার।

    ভোর সোয়া ছ-টা -

    অন্ধকারকে সরিয়ে প্রভাতালোকের আবির্ভাব আর তারপরেই দিনকরের আত্মপ্রকাশ। পাখিরা সমস্বরে তাঁকে আহ্বান জানাচ্ছে; ভোরের হিমেল হাওয়ায় পাতা নাড়িয়ে গাছেরা তাঁকে অভিবাদন জানাচ্ছে। হরিদ্বার আড়মোড়া ভাঙছে।

    সকাল সাড়ে সাতটা -

    চা-খাবারের দোকান সুগন্ধ ছড়াতে আরম্ভ করেছে। পুন্যার্থীরা শীতার্ত বাতাস আর হিমেল জল উপেক্ষা করে গঙ্গাস্নানের পুণ্য অর্জন করছে। মার্তণ্ড গঙ্গাজলে আগুন ছড়াচ্ছেন। বেশ কিছু নানা সাইজের মানুষ গঙ্গা থেকে পুণ্য পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত - প্রায় সব পুণ্যার্থীই গঙ্গায় পয়সা ফেলে পুণ্য 'কেনেন' - ফলে মাথাপিছু আয় মন্দ হচ্ছে না মনে হয়।

    বেলা সাড়ে বারোটা -

    ফাঁকতালে পুণ্যার্জন। রিকশাবাহন হয়ে হরিদ্বারের 'গলি' নামক নানান জন-নদী পেরিয়ে মনসাপাহাড়ের গোড়ায়। তারপর 'উড়নখটোলায়' উড়ে মনসামন্দিরের এলাকায়। সেখান থেকেই দূর-দর্শন সেরে, কফি সেবন করে, পবননন্দনদের জিমন্যাস্‌টিক্‌স উপভোগ করে আবার মর্তে প্রত্যাবর্তন। রোদ বড় চড়া, তাই হোটেলে ফিরে ঘরে ঢুকে পড়া।

    রাত আটটা -

    শেষ বেলায় মনুষ্যচালিত দ্বিচক্রযান বাহিত হয়ে হরকী পৌড়ি, যার অধুনা পরিচয় হরি কি প্যারী। সেখানে জনসমুদ্রে বসে সন্ধ্যারতির অপেক্ষা। সুদীর্ঘ বক্তৃতা আর চাঁদা (থুড়ি, দান) আদায়ের পর আঁধার ঘনাতে মিনিট দশেকের 'মহা আরতি'। 'পুণ্য' লাভ করে চা চাপিয়ে সে পুণ্য হজম করে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন।

    বিশে অকটোবর, সকাল ন'টা -

    টাটা ইণ্ডিকায় চড়ে, বিশ্বম্ভরের হাতে নিজেদের সঁপে, হরিদ্বারকে টা টা জানানো গেল।

    বেলা এগারোটা -

    দেরাদুন। জবর শহর, জবর ভিড়, দিব্যি গরম। কল্পনা ভেঙে খান খান।

    বেলা বারোটা কুড়ি -

    মসুরী, মানে আমাদের মুসৌরি। ৬০০০ ফুট। হিল স্টেশনের সব গুণেই গুণী।

    বেলা একটা -

    কেম্‌টি ফল্‌স্‌। চোখজুড়ানো, মনভরানো। সময়ের অভাবে তাকে ভালো করে চাখা গেল না।

    বেলা আড়াইটে -

    সুয়াখোলিতে পেটের খোল ভরালাম। পথ পাহাড়ী, মন বাহারী।

    বেলা সোয়া তিনটে -


    ধনোলটি


    ঘনবনে নিরজনে ধনোলটি। ৭৫০০ ফুট। শান্তির নিকেতন।

    বেলা সাড়ে পাঁচটা -

    গা ঘেঁষা ECO-PARK-এর সৌন্দর্যে মন ভরালাম। পবননন্দনদের নন্দনবন। নির্জন পথ দুপাশে পাইনের পাহারা নিয়ে শুয়ে রয়েছে। ঘোড়াশাল ঘোড়াহীন। সূয্যিমামা পাহাড়ের আড়ালে লুকোবার তাল করছেন। নানা রঙের ফুলেরা পার্কের বুকে অসংখ্য তারা ফুটিয়েছে। এক ঝাঁক ফুলের মতো ছেলেমেয়ে দোলনা আর ট্রাম্‌পোলিন ঘিরে খেলায় মত্ত। এক কোনায় হাতের কাজের পসরা নিয়ে গুটিসুটি বস এয়াছে একটা দোকান। গুটিসুটি ফিরে এলাম ডেরায়।

    রাত আটটা -

    আঁধারের সঙ্গে শীত এসে জাঁকিয়ে বসল নিঃশব্দে। পাশের সেঞ্চুরি পেরোনো বাংলো ঘুমে কাতর।

    একুশে অকটোবর, সকাল সাতটা -

    সাতসকালে চা-টায়ের সঙ্গে জুটল ঘন পাইনের ফাঁকে ফাঁকে তুষারশৃঙ্গের উঁকিঝুঁকি আর বানরসেনার কসরতের ফ্রী এনটারটেইনমেন্ট।

    সকাল ন'টা -

    লেটলতিফদের বেরোতে লেট। রোদ ঝলমলে বিজন ধনোলটি বিদায় জানালো।

    সকাল ন'টা কুড়ি -

    কদ্দুখাল। এখান থেকে তিন কিলোমিটার চড়াই ঠেঙিয়ে সুরখুন্তা মাতার প্রাচীন মন্দির। তবে, এখন তার শরীরে দিব্যি চেকনাই। এখান থেকে নীল আকাশের গায়ে তার রঙীন উপস্থিতি দারুণ লাগছে।

    সকাল সাড়ে ন'টা -

    পাহাড়ের গায়ে ওঁকারানন্দ শিবমন্দিরের নান্দনিক উপস্থিতি।

    সকাল দশটা -

    রূপসী কানাতাল, কৌড়িয়া, জড়িপানি, চোপড়িয়াল, আরাসোই টপকে চম্বা। সাধারণ, অপরিচ্ছন্ন, গরম। কোনওরকমে তাকে টপকানো গেল।

    বেলা পৌনে এগারোটা -

    পৃথিবীর সবথেকে উঁচুতে অবস্থিত বাঁধগুলোর অন্যতম টিহরী ড্যাম। জমাজলে সৃষ্ট টিহরী লেকও তার পান্না-সবুজ রূপ মেলে ধরেছে। অসংখ্য মানুষের হাহাকার, অগণিত প্রাণীর আর্তনাদ ডুবে গেছে তার গভীর জলে। গুটিকয় গাছ তাদের স্ববর্গের দুর্দশার কথা জানাচ্ছে অসহায় হাত তুলে। তাদের দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে টিহরী ড্যাম নির্লজ্জ সুন্দরী।

    বেলা একটা পঁচিশ -

    রীতিমতো টের পাওয়ানো খারাপ রাস্তা পেরিয়ে ধুলো মেখে শ্রীনগর। যথারীতি গরম আর ভিড়।

    বেলা আড়াইটে -

    পেট বাবাজীর প্রবল প্রতিবাদে রুদ্রপ্রয়াগের তিন কিলোমিটার আগেই খাদন পর্বের বিরতি।

    বেলা সোয়া তিনটে -

    রুদ্রপ্রয়াগ। আরও ভিড়, আরও গরম।

    বেলা তিনটে আটচল্লিশ -

    অগস্ত্যমুনি। আগে এখান থেকে কেদারনাথ উড়ে যাবার উপায় ছিল। এখন সে যাত্রা নাস্তি।

    বেলা চারটে -


    চন্দ্রাপুরী


    চন্দ্রাপুরী। মন্দাকিনীর কোল ঘেঁষে অপরূপ অবস্থান। এতক্ষণের ধুলোমাখা, গরমচাটা বিরক্তি উবে গেল। মন্দাকিনী এখানে খাপখোলা বাঁকা তলোয়ার।

    সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টা -

    শেষবেলায় তুষারশৃঙ্গেরা ঝাঁকিদর্শন দিলেন। আমরা তো ফুলবাগানে বসে মুগ্ধই, মাছের খোঁজে তুর্কীনাচন নাচা ছোট্ট পাখিগুলোও খানিক থমকে এ দৃশ্য দেখে নিচ্ছে।

    বাইশে অকটোবর, সকাল ছ'টা -

    তুষারকিরীটিদের প্রসন্নবদন আর মন্দাকিনীর উপলখচিত অমলধারায় সুপ্রভাতে সূচনা।

    সকাল সাড়ে ছ'টা -

    তুষারমৌলীর কিরীটে সোনালি আগুনের ছোঁয়া।

    সকাল ন'টা -

    ত্রিযুগীনারায়ণের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া। সকালের হিমেল হাওয়ায় আগাম খুশীর ছোঁয়া।

    সকাল সাড়ে ন'টা -

    সিয়ালসোর, ভীরী পার করে কুণ্ড। এখান থেকে ডাইনে মোচড় মারলে প্রায় স্বর্গের কাছাকাছি উখীমঠ। আমরা বামপন্থী হয়ে মন্দাকিনী লঙ্ঘন করলাম; অবশ্যই রথে চড়ে।

    সকাল পৌনে দশটা -

    চৌখাম্বা সুবিশাল উপস্থিতি দেখতে দেখতে গুপ্তকাশী। হুই নিচে মহাতীর্থ কালীমঠ।

    সকাল সোয়া দশটা -

    চৌখাম্বার সতর্ক দৃষ্টির পাহারায় নারায়ণকোটি, খুমেরা পেরিয়ে ফাটা। অতীতের ফাটাচটি থেকে এখন পবনহংস উড়াল দেয় কেদারনাথের উদ্দেশে। পকেটে রেস্ত থাকলে সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত না করে কেদারদর্শন সম্ভব।

    সকাল দশটা চল্লিশ -

    এখান থেকেও পবনহংস পাখা মেলে।

    সকাল দশটা পঞ্চান্ন -

    রামপুর, সীতাপুর পার করে সোনপ্রয়াগ 'টুকি' বলার আগেই বাঁয়ে মোচড় স্বর্গপানে।

    বেলা এগারোটা -

    দূ-উ-র থেকে দর্শন হলো সরকাটা (মুণ্ডুকাটা) গণেশ মন্দির। গণেশের মুণ্ডু ওড়ার প্রাচীনতর কাহিনী আছে এর পেছনে। গৌরীকুণ্ডে স্নান করার সময় মা দুর্গা গণেশকে পাহারাদার নিযুক্ত করেন। কারও প্রবেশ নিষেধ। এমন সময় স্বয়ং মহাদেব হাজির। যতই উনি গণেশকে নিজের পরিচয় দেন, গণেশের এককথা - যেতে নাহি দিব। শিব জানেন না গণেশের পরিচয়। গণেশও আগে কখনও শিবকে দেখেননি। ফলং যুদ্ধং। ভয়ানক সেই যুদ্ধে রেগেমেগে মহেশ্বর শূলের আঘাতে গণেশের মুণ্ডপাত করে। এই সময় গোলমাল শুনে গণেশজননী বেরিয়ে এলেন। এসে গণেশের অবস্থা দেখে শিবকে এমন দাবড়ানি দিলেন, যে তাঁর অবস্থা কাহিল। তা ছাড়া উনি তখন জেনে গেছেন যে, গণেশ তাঁরই সন্তান। তখন, খোঁজ, মুণ্ডু খোঁজ। গণেশের আসল মুণ্ডু আর পাওয়াই গেল না। শেষমেষ এক একদন্তী হাতির মুণ্ডু দিয়েই গণেশের মুখ আর প্রাণ, দুটোই রক্ষা হলো। ওই মন্দিরের ওখানেই নাকি এই কেচ্ছা ঘটেছিল।

    বেলা সাড়ে এগারোটা -


    ত্রিযুগীনারায়ণ


    চড়তে চড়তে ত্রিযুগীনারায়ণ। সুপ্রাচীন ছোট্ট এক মন্দির। জনপদও বেশ প্রাচীন। তবে, ইদানীং গাড়িপথ হওয়ায় আধুনিকতা নাক গলাতে শুরু করেছে। এই ত্রিযুগীনারায়ণেই বিয়ে হয়েছিল হিমালয় দুহিতা গৌরী আর দেবাদিদেব শঙ্করের। সাক্ষী ছিলেন স্বয়ং নারায়ণ। সেই থেকেই সব হিন্দু বিবাহে নারায়ণকে সাক্ষী থাকতে হয়। বেচারা! হরপার্বতীর বিয়েতে যে হোমকুণ্ড জ্বালানো হয়েছিল, তা আজও জ্বলছে অনির্বাণ। প্রতিনিয়তি পুণ্যার্থীরা তাতে কাঠ যোগান দেন। তা এই 'বিবাহ-স্বর্গে' ঘোর অধর্মীর রীতিমতো ধর্মমতে পুনর্বিবাহ হলো। আজ থেকে এই তীর্থের মাহাত্ম্য দ্বিগুণ হয়ে গেল।

    বেলা পৌনে দুটো -

    ফিরতিপথে সোনপ্রয়াগকে বুড়িছোঁইয়া ছুঁয়ে রামপুরে রামখিদে মেটানো।

    বিকেল চারটে -

    চন্দ্রাপুরীর মনোরম পুরীতে প্রত্যাবর্তন।

    তেইশ অকটোবর, বেলা দশটা -

    বিদায় স্বপ্নপুরী চন্দ্রাপুরী।

    বেলা দশটা সাতাশ-

    মন্দাকিনীর ধার ধরে কালকের পথে গুপ্তকাশী। এবার শুধু নেমে চলা।

    বেলা দশটা পঞ্চাশ -

    নামতে নামতে কালীগঙ্গার ধারে কালীমঠ। সুন্দর পরিবেশে প্রাচীন মন্দির। মহাতীর্থ। কিছু অলস, ধীর স্থির মানুষ, অলস পশুপাখি, অলস বাতাস। গোটা পরিবেশে একটা মধুর আলস্য ছড়িয়ে রয়েছে।

    বেলা সোয়া বারোটা -


    উখীমঠ


    কালীমঠ দর্শন সেরে কুণ্ড হয়ে চলে এলাম উখীমঠ। মন্ত্রী এসেছেন, তাই তুমুল ব্যস্ততা। মন্ত্রীমশাই বেশ সভ্যভব্য হাসিখুশি মানুষ।

    বেলা চারটে দশ -

    ওঁকারেশ্বর মন্দির। কেদারনাথ আর মদমহেশ্বরের শীতকালের আস্তানা। বেশ পুরোনো মন্দির। দেখার মতো।

    চব্বিশে অকটোবর, সকাল সাড়ে আটটা -

    উখীমঠকে বিদায় জানালাম। আজ চোপতা।

    সকাল ন-টা পঁচিশ -


    চোপতা পেরিয়ে জঙ্গলে দেখা প্রায় দেড় মিটার লম্বা


    সিরসোলি, মাস্তুরা, তালা পেরোতেই জঙ্গল এসে আগলে ধরল। বনের মাঝে দু-চারটে বাড়ি নিয়ে দোগলভিটা। বুনোজন্তুদের প্রতিবেশী হয়ে বসবাস। মাথার ওপরে তুষারশৃঙ্গের পাহারা।

    সকাল ন-টা পঁয়ত্রিশ -


    চোপতা


    চোপতা। তুঙ্গনাথের প্রবেশদ্বার। পথের কালো ফিতেটা দুপাক খেয়ে চোপতা পেরিয়ে ফের ঢুকে গেছে জঙ্গলে। বাঁদিকে বন গড়াতে গড়াতে নেমে গেছে কোন অতলে। ডানদিকে চড়তে চড়তে চন্দ্রশিলার টংয়ে। সারা চোপতা জুড়ে দ্রিঘাংচুদের ব্যস্ততা।

    সকাল সোয়া দশটা -

    'বিল্লু' আর শ্রীচরণ ভরসা করে তুঙ্গনাথ যাত্রা। তোরণ পেরোতেই কিংবদন্তি মঙ্গল সিংয়ের চটি। বনের ফাঁকে চড়া চড়াই। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দিগন্ত বিস্তৃত শৃঙ্গরাজি।

    সকাল পৌনে এগারোটা -

    হঠাৎ গাছেরা সরে দাঁড়ালো। তুষারকিরীটিমালার অবারতি দর্শন।

    সকাল সাড়ে এগারোটা -

    বিল্লু-বাহিত হয়ে বউ এগিয়ে গেছে। আমার জিভ হাঁটু ছুঁই ছুঁই। অগত্যা চা খাবার নাম করে দম জমানোর চেষ্টা। চা-টনিকে আবার চারদিকের দৃশ্য, এমন কী প্যাঁচ-খাওয়া চড়াই পথটাও আবার ভালো লাগতে লাগল।

    বেলা সাড়ে বারোটা -

    সবথেকে উঁচুকেদার তুঙ্গনাথ। আনাচে কানাচে বরফ। হাফডজন দাঁড়কাক। দেড় ডজন পুণ্যার্থী আর কোয়ার্টার ডজন পূজারী। মেঘলা আকাশের ইতিউতি কদাচিৎ হিমবন্তের উঁকি। পুজোর ডালি নিয়ে বউ বসে কুলফি হচ্ছে আধঘন্টা ধরে।

    বেলা একটা -


    তুঙ্গনাথ লিঙ্গ


    মন্দিরের সামনে পূজার্চনা করছেন কিংবদন্তি পাণ্ডা ৯৭ বছরের মহেশানন্দ মৈঠানি। শিবের বাহুর দর্শন সেরে ফেরার পালা। হাড় হিম করা ঠাণ্ডায় আর বেশিক্ষণ থাকলে ভক্তিটক্তি জমে বরফ হয়ে যাবে। অতএব, এবার অধঃপতন, থুড়ি, অধোগমনই আবশ্যিক।

    বেলা সোয়া একটা -

    খাদ্যবিরাম। একটা ঈগল তীক্ষন নজর রাখছে চক্কর মেরে।

    বেলা দুটো চল্লিশ -

    ব্যাক টু চোপতা। আবার মধ্যপ্রদেশে খাদ্যপ্রেরণ।

    সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টা -

    সূয্যিমামা দেবদারুবনে ডুব দিতেই শেষ আলোটুকুও মুছে গেল।

    রাত আটটা -

    বাইরে ৪.৫ ডিগ্রির গাঁট্টা। আমরা দুজনে লেপাবৃত হয়ে গ্যাঁট হয়ে খাটটায়।

    পঁচিশে অকটোবর, ভোর ছ'টা -

    তুষারশৃঙ্গের রূপের ছটায় ১ ডিগ্রির ঠাণ্ডাও সয়ে নেওয়া যাচ্ছে। কেদার, চৌখাম্বা, কে নেই! দ্রিঘাংচুদের বিধানসভার অধিবেশন বসেছে।

    সকাল আটটা দশ -

    চলল এবার গাড়ি; আউলি পানে পাড়ি।

    সকাল ন'টা -

    এ অরণ্য, কী অনন্য! অরণ্যবাসীরা দর্শন দিচ্ছে অহরহ। পথের অবস্থা ভালো নয় তেমন - তবে, বনানীর রূপে সব উসুল। সাধে কি বলে, কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না!

    বেলা সাড়ে ন'টা -

    মণ্ডল। এখনও চোখ বুজলেই অরণ্যের রূপসুধা।

    সকাল দশটা সাত -

    সগর। এখান থেকেই পথ গিয়েছে রুদ্রনাথের।

    সকাল সোয়া দশটা -

    গোপেশ্বর। গোপীনাথ মন্দির দর্শন। দীপাবলীর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সবাই।

    সকাল এগারোটা -

    চমোলি। সাধারণ।

    সকাল এগারোটা দশ -

    বিরহি। নির্জন, অপরূপ। ঠাণ্ডা কম। উপবাসভঙ্গের আয়োজন করা গেল।

    বেলা বারোটা পাঁচ -

    মায়াপুর, গডোরা হয়ে পিপলকোটি।

    বেলা বারোটা পঞ্চাশ -

    পাখি পেরিয়ে হেলং। এখান থেকে কল্পেশ্বরের পথ ধরা যায়।

    বেলা পৌনে দুটো -

    যোশীমঠকে টুকি বলে চড়চড়িয়ে আউলি। অপূর্ব! একটাই আফসোস - রোপওয়ে বন্ধ।

    রাত আটটা -

    গোটা দিনটা কাটল মহা আলস্যে বিলাসে। তুষারশৃঙ্গেরা সব মাঝেমধ্যে টুকি বলে মেঘের আড়ালে মুখ লুকোতে থাকলেন। কাল সকালে তাঁদের প্রসন্নবদন দেখতে পাব, এই আশায় আছি।

    ছাব্বিশে অকটোবর, সকাল ছ'টা দশ -

    নন্দাদেবী প্রভাতের প্রথম আগুনে স্নান করছেন। হিমালয়ের শিখরসভার রূপের ছটায় দশদিক উদ্ভাসিত। হাতি, ঘোড়ি, মানা, নীলকণ্ঠরা সব রঙের হোলিখেলায় মাতোয়ারা। আজ দীপাবলী। আলোর মাতনেই দিনের শুরু। একেই বোধহয় বলে সুপ্রভাত।

    বেলা দশটা -

    বিদায় অপরূপা আউলি। এবার যাত্রা বদ্রীনাথে।

    সকাল দশটা পঁয়ত্রিশ -

    যোশীমঠ। বদ্রীনারায়ণের শীতকালীন আবাস এই জ্যোর্তিমঠ। ব্যস্ত শহর। মাথায় হাতি, ঘোড়ির পাহারা।

    সকাল দশটা পঞ্চাশ -

    বিষ্ণুপ্রয়াগ। ধৌলীগঙ্গা বা বিষ্ণুগাড এসে মিশেছে অলকানন্দায়।

    সকাল দশটাপঞ্চান্ন -

    নন্দাদেবী বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভে প্রবেশ করলাম।

    বেলা এগারোটা দশ -

    দু-সিকের উত্তুঙ্গ পাহাড়ের পাহারায় অলকানন্দার উজানে এসে পৌঁছলাম গোবিন্দঘাটে। অলকানন্দাকে পেরিয়ে পথ গিয়েছে নন্দনকানন আর লোকপাল হেমকুণ্ডে।

    বেলা সোয়া এগারোটা -

    পাণ্ডুকেশ্বর। এখানেই নাকি পাণ্ডুরাজার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল।

    বেলা এগারোটা পঁয়ত্রিশ -

    হনুমান চটি। বহুদিন পর্যন্ত এখানেই গাড়ির ফুলস্টপ ছিল। এরপর ছিল ফুটস্টেপ।

    ঠিক দুক্কুরবেলা -

    বদ্রীনাথ। নর নারায়ণের মাঝে, নীলকণ্ঠের নিগরানিতে বিষ্ণুর নিবাস। নীলকণ্ঠের বিশাল উপস্থিতি স্তব্ধবাক করে দেয়।

    বেলা তিনটে -

    অলকানন্দাকে পেরিয়ে মন্দির দর্শন। দু-দিক থেকে গা ঘেঁষে আসা বসতির মাঝে রঙীন উপস্থিতি। সামনে রূপসী অলকানন্দার দোবাঁকি রূপ। উষ্ণকুণ্ডে স্নান করে বহু পুণ্যার্থী পাপস্খালন করছে। অতীতের বদরীবন আজ বেপাত্তা।

    বেলা তিনটে পঁচিশ -

    মহাপ্রস্থানের পথে ভারতের শেষ গ্রাম মানা দেখার উদ্দেশ্যে পাড়ি।

    বেলা তিনটে চল্লিশ -

    ভারতের শেষ গ্রাম মানা। ৩১১৮ মি.। এখানে সরস্বতী এসে মিশছে অলকানন্দায়। ঠিকঠাক বললে, অলকানন্দা এসে পড়ছে সরস্বতীতে।

    বেলা চারটে -

    ব্যাস গুহা, গণেশ গুহা এড়িয়ে ভীমপুল। পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থানের পথে মহাবেগবতী সরস্বতীকে পেরোতে ভীম এক বিশাল পাথর ফেলে সেতু বানিয়েছিলেন। এখানেই দ্রৌপদী দেহরক্ষা করেন। প্রাকৃতিক সেতুর ওপরে এখন মানুষের কারিকুরি। ডানদিকে ভীমগর্জনে নেমে আসছেন সরস্বতী। ধারে ছোট্ট সরস্বতীর মন্দির। ইচ্ছে ছিল, বসুধারা প্রপাত দেখে আসার। কিন্তু ওদিকে মানায় বসে মানিনী বোধহয় শেকড় গজিয়ে ফেলল। বেলাও পড়ে এসেছে। অতএব, পিছে মুড়।

    বেলা চারটে কুড়ি -

    ফিরতি পথে ঘাড় ঘুরিয়ে শেষবারের মতো মানা আর আবছা বসুধারাকে দেখে নেওয়া। গাড়ি বদ্রীনাথ ছুঁই ছুঁই।

    সন্ধ্যা ছ'টা -

    মন্দিরে সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে। বোধহয় দেওয়ালী উপলক্ষ্যেই রঙীন আলোয় ঝলমল করছে মন্দির। এদিক ওদিক অল্পসল্প বাজি ফাটছে। এই গম্ভীর পরিবেশে বেশ বেমানান। তাপমাত্রা এখন ৬ ডিগ্রী!

    সাতাশে অকটোবর, ভোর সাড়ে পাঁচটা -

    বাইরে আঁধার যাই যাই করেও যাচ্ছে না। শীতার্ত বদ্রীনাথ জুড়ে একটা নীলচে চাদর। রাতে নর নারায়ণের গায়ে তুষারের আলপনা পড়েছে। তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী।

    সকাল ছ-টা পনেরো -


    নীলকণ্ঠ বদ্রীনাথ থেকে


    নীলকণ্ঠ এখন কনকমণ্ডিত - সোনার মুকুট। নিচে গোটা বদ্রীনাথ এখনও ঘুমে কাতর।

    সকাল ছ-টা পঁচিশ -

    বদ্রীনাথ আড়মোড়া ভাঙছে। মন্দিরের ঘন্টা বাজছে। গোটাকয়েক চায়ের দোকান ঘোমটা খুলেছে। দুতিনটে হলুদ ঠোঁটের 'চাফ' খাবারের খোঁজে বেরিয়েছে। মনটা বড় চা চাচ্ছে।

    সকাল পৌনে দশটা -

    বিদায় বদরীবিশাল। নীলকণ্ঠের আশীর্বাদ নিয়ে ফিরতিপথে চাকা গড়ালো, পাড়া জুড়ালো, নটে গাছটি মুড়োলো।



    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)