ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে নিচের তলার টিউবওয়েলের হাতল মেশিনের মতো কে যেন চালাতে লাগল। ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করে টিনের বালতিগুলো সিমেন্টের ওপর টেনে নেওয়ার আওয়াজে আমার মাথার ভিতরটা রি রি করে উঠল।
আমাদের উপরতলার রান্নাঘরের জানলা খুলে আমাদের রাঁধুনি নিকষা-মাসি নিচের তলার কাজের লোককে উদ্দেশ্য করে এক হাঁক দিল,—বলি ও অন্নদার পো, কাকপক্ষী ওঠার আগে কি হট্টগোল শুরু করেছ, বল দিকি? এদিগে আন্নাঘরে একবাটি চায়ের জল পরজন্ত ফুটলো কি ফুটলো না, আর কলতলায় তোমরা কাঁসরঘন্টা ঢ্যাঁঙ-ঢ্যাঁঙ করতি নেগেছ!
নিচে অন্নদার পো নীলকণ্ঠ হাতল টানতে টানতেই গলা খাঁকরালো বার তিনেক, আর তরিবত করে পাশের গ্যাঁদাফুলের ঝোপে এক আঁজলা থুতু ফেলল। কিন্তু তার হাত কলের হ্যাণ্ডেলটিকে দুরমুষ ও হামানদিস্তা—দুই এর কায়দায় অবিরত চালাতে লাগল।
নিকষা-মাসি বিরক্তির এক নিদারুণ ভঙ্গি করে মাছের আঁশ ও বাসনমাজার ছাই ভর্তি কুলো উল্টালো দুই বাড়ির ব্যবহারের জন্য নিচে রাখা জমাদারের পাশকুঁড়ার ড্রামের উপর। ঝুপঝুপ ঝুপঝুপ। কিছু উড়ন্ত ছাই নিচের বাড়ির বালতির জলে পড়ল।
জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো দৃষ্টি উপরে নিক্ষেপ করে নীলকণ্ঠদা বালতির জল ঢেলে ফেলে আবার ঘ্যাঘর চরখার ধ্বনি তুলে জল পাম্প করতে লাগল।
বুঝলাম নিত্যকার শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ শুরু হয়েছে ভাড়াটে বনাম মালিকের বাড়ির।
প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমার দাদু প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে লোন নিয়ে, অনেক সাধ করে বেহালায় এই বাড়ি করিয়ে ছিলেন। ওনার ইচ্ছে ছিল যে ওনার ছেলে রাণা ও রাজা ভবিষ্যতে বিয়ে করে সংসার পেতে একেকজন একেক তলায় সুখে কাল কাটাবে। সে কাল আসা অবধি দাদু নিচের তলাটা ভাড়া দিয়ে দেবেন, দুই ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে ছোটো নীড়ের প্রয়োজন, বড় দোতলার নয়। ভাড়ার টাকার চেয়ে বেশি ভদ্র ভাড়াটে পাওয়া নিয়েই দাদুর বিশেষ লক্ষ্য ছিল। তারা আত্মীয় বন্ধুর মতো থাকবে। সারা দিন ঠাম্মা একা থাকেন, সময় সময়ে দুটো ভালো কথা বলতে আসবে, নিচের তলাটাও খালি পড়ে থাকবে না।
ভাড়াটে এলো। খুবই ভদ্রলোক মনে হল। ভদ্রলোক বড় করে আকপাল তিলক কাটেন। সারাক্ষণ 'রাধাগোবিন্দ' ছাড়া কোনো বাক্যি শুরু করেন না। ভাড়াটে গিন্নী বিকেলের সূর্যের মতো বড় গোল লাল সিঁদুরের টিপ পরেন। দাদু খুসি হয়ে মাত্র দেড়শো টাকায় ভাড়া রফা করলেন। দিন আসে দিন যায়, পরম প্রীতিতে দুই বাড়ির দিন কাটে।
ইতিমধ্যে ঠাম্মা স্ট্রোকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। নিচের কাদম্বরী-দিদা ঠাম্মাকে দেখতে আসেন, বাটিতে করে আলুপোস্ত ও বিউলির ডাল করে নিয়ে আসেন। ঠাম্মার ফর্সা অসহায় থুতনি টিপে নাড়িয়ে আদর করেন। ঠাম্মার স্ট্রোকে অবশ হাতের চুড়ি নিয়ে নাড়াচাড়া করেন।
একদিন দাদু কাদু-দিদার বাটি চচ্চড়ি খেয়ে দেখেন ভীষণ নুন, ঝিঙে পোস্ততে খুব ঝাল। দাদুর মনে একটু ধন্ধ হল। নিকষা-মাসিকে বললেন যে লোক দেখা করতে আসলে ঠাম্মাকে একা না ছাড়তে, আর নিকষা-মাসি বা দাদু আগে না চাখলে কোনো বাইরের খাবার ঠাম্মাকে না খেতে দিতে।
নিকষা-মাসি ল্যাজকাটা পিট-বুল কুকুরের মতো খুব বিশ্বাসী ও তেজি। তাছাড়া তার সহজাত সন্দিহান স্বভাব তার অসহায় প্রভু-পত্নীর নিরাপত্তা সম্বন্ধে সহজেই তাকে অতি সতর্ক করে তুলেছিল। কাদু-দিদা আসলেই ঠাম্মার পাকা চুল বাছার, বা নখ কাটার, বা তেল মাখানোর অছিলায় নিকষা-মাসি ঠায় ঠাম্মার ঘরে বসে থাকত; এমন কি ঠাম্মার মাথার উকুন বাছছে সে -এই রটনা করতেও নাকি তৈরি ছিল নিকষা-মাসি, পরে শুনেছি।
এত পাহারা সত্ত্বেও কিছু খুচরো হাতসাফাই এর ভেল্কি নিকষা-মাসিকে তাক লাগিয়ে দিতে থাকল। ঠাম্মার নতুন রেণুকা ট্যালকাম পাউডার কৌটো, ধূপকাঠির আধ-ব্যবহৃত প্যাকেট, ওডোমস, চুলশুদ্ধু সরু চিরুনি, সেফটিপিন লাগানো সায়ার দড়ির তিন গজ ইত্যাদি। তবুও ওপরতলা ও নিচের তলার মধ্যে যাওয়া আসা বজায় রইল। মাঝারি ভাব ও কিছু টুকটাক বিরক্তিতে দিন চলতে থাকল।
তারপর যথা সময়ে দাদু ও ঠাম্মা দু'জনেই গত হলেন। বাবা, মা আর আমি বেহালার এই বাড়ির উপর তলায় যেমন ছিলাম, তেমনি রইলাম। জেঠু, জেঠিমা ও তাদের মেয়ে, আমার থেকে দুই বছরের বড় দিদিভাই, উপলা—আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালির দো-মিশালি জীবন কাটাতে লাগালো।
যে বছর পৃথিবী জুড়ে ব্যাংকিং সংকট সব অর্থসংস্থানগুলোকে পিছমোড়া করে পেড়ে ফেলল, সে বছর বাবার এতদিনকার কাজের জায়গায় অনির্দিষ্ট টলোমলো দেখা দিল। মা সেবার পুজোতে একটাও নতুন শাড়ি কিনলেন না। আমার ড্রয়িং ক্লাস, নাচের ক্লাস, জাপানী ফুল সাজানো শেখার ক্লাস সব বন্ধ হয়ে গেল। বাবা তার শখেরবাজারের পেটোয়া পানের দোকানের খিলি দেওয়া কায়দা করে বানানো পান ছেড়ে পাড়ার সস্তার লবঙ্গ আঁটা জল ছেটানো দরকচা পাতার ত্রিভুজ খেতে আরম্ভ করলেন।
সেই অগ্নিমূল্য বাজারের তাড়নায় বাবা ঠিক করলেন যে নিচের ভাড়াটেদের অল্প টাকা বাড়ানোর কথা বলবেন।
মা'র পিসির বাড়ি মেদিনীপুর থেকে আনা গয়নাবড়ির বেশ বড় ভাগ ও এক জ্যামের শিশি ভর্তি আমার প্রিয় কাসুন্দি ভেট নিয়ে বাবা আর আমি নিচের তলার দরোজায় কলিং বেল বাজালাম।
জনার্দন কাকু স্যাণ্ডো গেঞ্জি আর চেক-কাটা লুঙ্গি পরে টিভিতে সিনেমা দেখছিলেন। আমাদের দেখে তাড়াতাড়ি টিভি বন্ধ করে টেপ-রেকর্ডারের সুইচ অন করলেন। কৃষ্ণ নামগানে ঘর ভরে গেল।
বাবা একটু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন—জনাদা, আপনার সাথে একটু কথা ছিল।
আমি কমলা কাকিমাকে খাবারগুলো দিয়ে ওদের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া দিদির সাথে ভিতরে গোপাল ও রাধা পুতুল নিয়ে খেলতে গেলাম।
ওদের নিচের তলাটা ঠিক আমাদের উপরের তলার প্রতিচ্ছবি। তিনটে শোবার ঘর, একটা বাথরুম, ভাঁড়ার ঘর লাগোয়া লম্বাটে রান্নাঘর। বরং ওদের একটা পিছনের বারান্দা আছে যা আমাদের উপরে নেই। আর সামনের জমির ঘাস, দুটো নারকেল গাছের তলায় পড়া ডাব, একটা গোলাপখাস আম গাছের ঢিল-টিপ করে পাড়া ফল, সবই ওরা পায়। এতবড় জায়গার জন্যে মাত্র দেড়শো টাকা ভাড়া গত পঁচিশ বছর ধরে, ভাবা যায় না। আমার মতো আনাড়ির কাছেও সেটা পুরোদস্তুর মগের মুলুক মনে হল।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ওদের বাইরের ঘরে এসে দেখলাম বাবার মুখটা কঠিন ও ম্লান। মুখের পানের পুঁটুলিটা এক গালে আবের মতো স্থির হয়ে আছে। জাবর কেটে রসাস্বাদন চলছে না আর। বুঝলাম ব্যাপার গুরুচরণ।
জনাকাকা বাবাকে বললেন, তাহলে সেই কথাই রইল।—
বাবা ট-ট করে পান মুখিদের আমতার ভাষায় কি যেন বলতে গেলেন।
জনাকাকা গেঞ্জির গলার ফাঁক দিয়ে পৈতেতে বুড়ো আঙুলের শান দিতে দিতে আমাদের দরজা অবধি এগিয়ে দিলেন। আপাতদৃষ্টিতে সেটা আবাহন-বিসর্জনের সৌজন্যতার মতো দেখতে হলেও, ভঙ্গিতে কোথায় যেন একটা নিষ্প্রেম গলাধাক্কার ভাব মনে হল।
তোমায় আমি ছোট ভাইয়ের মতো মনে করি, বুঝলে রাজা। রাধেশ্যাম, জয় গুরু। তোমার বাবা আর আমার বাবা ধর্ম-ভাইয়ের মতো এক বাড়িতে ওপর নিচে বাস করতেন। পিতার বাক্য বেদবাক্য। জয়গোবিন্দ, হরেকৃষ্ণ হরে হরে। তোমার বাবা আর আমার বাবা যে ভাড়া ঠিক করে ছিলেন—তার নড়চড় করা ঠিক হবে না। কি বল, রাজাবাবু?
বাবা আর আমি পাড়ার ফুটবলে হেরে যাওয়া পার্টির মতো চোরামুখে সিঁড়ি উঠতে লাগলাম।
ওপরে মা ঝাঁটা দিয়ে জোরে চাপড় দিয়ে বিছানার চাদর টান টান করছিলেন। আমাদের দেখে কোমরে আঁচল জড়িয়ে ঝাঁটাটাকে তলোয়ারের মতো করে ধরলেন। সারা জীবন অনেক ঝগড়াটে ঠিকে ঝি সামলিয়ে মা'র ভাবমূর্তিতে একটা বর্গিদের সর্দারনির মতো রণং দেহি ভাব কায়েম হয়ে গেছে। তাছাড়া মুখচোরা বাবার হয়ে প্রতিবাদ সালিশি করতে করতে মা'র 'দক্ষিণী'তে সাধা গলায় জুটের পাপোষে খড়ি ওঠা পা রগড়ানোর মতো একটা খরখরে ভাব এসে গেছে।
বাবা বললেন, ভাড়া বাড়ানোর কথায় তো না বলে দিল। নানা অজুহাত দেখাল, সামনের সিঁড়িতে ফাটল ধরেছে—আমরা মেরামত করাইনি, পাশের ড্রেনে মশার বাথান—আমরা পি ডব্লুই ডি কে বলে তার সৎকার করিনি। তাছাড়া জনাদার ব্যবসায়ে মন্দা।
মা এবার থাকতে না পেরে বলে উঠলেন, ওসব অজুহাতের নিকুচি করেছে। ব্যবসায়ে মন্দা না আরো কিছু। কমলাদির গয়নার বহর দেখেছ?
সত্যি, ম্যান্টনে জনাকাকুর সেল ফোনের দোকান রমরমা চলছে। ঝলমলে নিয়নের আলোতে চোখ পিটপিট করে প্রথম ভিতরে ঢুকলে। রাত নেই দিন নেই হিন্দি সিনেমার গান বাজে। তাও 'রুদালি' বা 'রেনকোট' ধরনের বুকফাটানো কষ্টের প্রেমের গান নয়। ঝম ঝমা ঝম লোফার টাইপের গান, 'সঙ্গম হোগা কি নহি', 'চোলি কে নিচে ক্যা হ্যায়' ইত্যাদি। খদ্দের দলে দলে আসে। আর সাঁইবাবার ক্যামিও লকেটযুক্ত সোনার হার গলায় দুলিয়ে তেল চুকচুকে চুলে টেরিকাটা স্টোর ম্যানেজার দিস্তে দিস্তে টাকা গুণে দেয়ালের সেফে ভরে। এ দৃশ্যকে মোটেই ব্যবসায়ে মন্দা বলা চলে না।
যাই হোক, তারপর থেকে ভাড়াটে আর বাড়ির মালিকের পরিবারের মধ্যে অলক্ষ্য-সমর শুরু হল। ভাড়া যেটুকু বা দিচ্ছিল জনাকাকারা তাও বন্ধ হয়ে গেল। মা আর কমলা কাকিমার সিঁড়ির নিচের ল্যাণ্ডিংয়ে দেখা হলে তড়িৎগতিতে এ ওর অপর দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, যেন দুজনে কোনো রানির দুই দিকের সিংহদ্বার রক্ষাকারি প্রতিহারিণী। বাবা ও জনাকাকার রাস্তায় মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা হলে, একজন রাস্তা পেরিয়ে অন্য দিকের ফুটপাথে হাঁটা দেয়।
আমার এতদিনকার খেলার সাথী বিষ্ণুপ্রিয়াদিদি আমাকে ধার দেওয়া ল্যাকমির আই-ব্রাও পেনসিলটা ঘটা করে ফেরৎ নিয়ে গেল। স্কুলের লাঞ্চরুমে দেখা হলে ওর চোখে একটা অদ্ভুত তাচ্ছিল্যের ভাষা এনে আমার দিকে কটাক্ষ করে নিজের ক্লাসের মেয়েদের কি যেন বলতে লাগল। আমি বাথরুমে আয়নার সামনে অনেক প্র্যাকটিস করেও অমন তাগড়া দুর্বিনীত কটাক্ষ কিছুতেই আয়ত্তে আনতে পারলাম না।
মা কথায় কথায় আমায় নানান নিষেধবাক্য, সাবধানবাণী, তুলনামূলক জ্ঞান দিতে লাগলেন—ত্বিষা, আমি যেন তোমায় নিচের বিষ্ণুর মতো আঁচল উড়িয়ে রাস্তায় হাঁটতে না দেখি।
- ত্বিষা, নিকষা-মাসি মা নিতে আসলে স্কুল থেকে এক পা বেরোবে না। নিচের বিষ্ণুর মতো ফটফট করে পাড়া বেড়াতে যেন না দেখি।
- ত্বিষা, এত ঘনঘন শ্যাম্পু করার কি আছে? শেষে চুলগুলোয় মরচে পড়া রং ধরবে নিচের কমলার হেনা দেওয়া চুলের মতো।
বাড়ির লোকেদের হিম-সংগ্রামের সাথে দুইতলার কাজের লোকেদের মধ্যেও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হল। আগে ইলশেগুঁড়ি শুরু হলে, নিকষা মাসি হয়তো মুদির দোকানে গেছে নিচের নীলকণ্ঠ দৌড়ে আমাদের ছাদের কাপড় গুলোও তুলে ভিতরে দিয়ে যেত। এখন বৃষ্টিতে সৃষ্টি ভেসে গেলেও নীলকণ্ঠের কোনো পাত্তা পাওয়া যাবেনা। আমরা যদি বাড়িতে না থাকি, বা নিকষা-মাসি যদি ভাল্লুকে জ্বরে একসা হয়ে পড়ে থাকে।
তেমনি নিচের বারান্দায় আমসত্ত্ব দিলে নিকষা-মাসি পুরোনো কাপড় আর বাদুড়ে রং দিয়ে বিকট এক কাকতাড়ুয়া বানিয়ে বারান্দার রেলিঙে দাঁড় করিয়ে আসত যাতে কাকপক্ষী ত্রিসীমানায় না আসে। এখন নীলকণ্ঠ হয়তো দুপুরে পাড়ার রিকশাওয়ালাদের সাথে নয়াপয়সা দিয়ে তিনপত্তি খেলতে গেছে, তখন সাতটা কাকে এসে আমসত্ত্বের উপর দাঁড় বাইতে থাকলেও নিকষামাসির মুখ দিয়ে একটা হুশ-হুউশ বেরোবে না।
নিচের কমলাকাকিমা সত্যনারায়ণ পুজো করলেন, আমাদের ডাকলেন না। সিন্নি না খাওয়ার কষ্টে আমার জিভের জল নদী হয়ে পেটে চলে গেল। পুজোর ধূপ-ধুনোর ধোঁয়া ওদের দরজার তলা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এসে বাবার হাঁপানি বাড়াল।
মাও শনি পুজো করলেন, নিচের কাউকে বললেন না। বেগুন পুড়িয়ে খোসা ওপরের ঠাকুরঘর থেকে নিচে ওদের কলতলায় ফেলল নিকষামাসি। অতিথিদের জুতো চটিগুলো ডাঁই করে ল্যাণ্ডিংয়ে ওদের দরজার সামনে রাখা হল।
শত্রুতা শনৈঃ শনৈঃ বাড়তে লাগল। বাবা ইনল্যাণ্ড লেটারে জনাকাকাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে লিখলেন। জনাকাকা পোস্টকার্ডে জবাব দিলেন, কভি নেহি, কভি নেহি, কভি নেহি।
পোস্টম্যান সেই চিঠি পড়ে পাড়ার ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে বিজ্ঞপ্তি হাজির করল। ট্যাক্সিওয়ালারা রিক্সাওয়ালাদের বলল। রিক্সাওয়ালা রাতের লাঠি ঠোকা পাহারাদারকে, পাহারাদার পানওয়ালাকে। মায় পুরো বেহালা বাজারে ব্যাপারটা চাউর হয়ে গেল। গেল বছর ঠাকুরমশায়ের ছেলের বৌ মাংসের দোকানের হেড-কষাই এর সাথে পালানো ইস্তক এত রগরগে পরচর্চা পাড়ার গেজেটিয়ারদের হাতে আসেনি।
লোকে অনেকদিন পরে একটা রসদার গুলতানির খোরাক পেয়ে যারপরনাই ভণ্ড ক্ষোভরূপী কৌতুহল নিবারণ করতে দুই বাড়ি যাতায়াত শুরু করে দিল।
বাবা কর্পোরেশনকে সমীপেষু-টমিপেষু দিয়ে বিরাট কমপ্লেনের চিঠি লিখলেন যে ভাড়াটে চারমাস ভাড়া দেয়নি। মোমবাতি দিয়ে লাল গালা গলিয়ে তাতে দাদুর সীলমোহরের ছাপ এঁটে অনেক কায়দা করে সেই খাম পাঠানো হল। কিন্তু কোনো তার জবাব এল না।
মা বললেন, কর্পোরেশনে তো সব মাছিমারা কেরানীদের কারবার। সবাই জানে। তোমারও বলিহারি, ওদের পয়সা খরচ করে চিঠি লিখতে গেছ। অরণ্যে রোদন আর কাকে বলে।
এতদিন অম্লকষায় শুনে শুনে বাবার মধ্যে এক নৈর্ব্যক্তিকতা এসে গেছে, পৌরুষে আর ঘা লাগে না। তবু বাবা নিজের 'পর্ণপটিকা' সংঘের পান-মৌজ বন্ধুদের পরামর্শ নিয়ে আলিপুরের এক নামজাদা উকিল ঠিক করলেন। জনাকাকাও তাতে টেক্কা দিতে নিজের 'ভীমরতি' ক্লাবের সদস্যদের সুপারিশে পার্ক স্ট্রীটের আরো দামি ও জাঁদরেল উকিল বহাল করলেন।
এমনি করে বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুলের আড়া-আড়ি চলল। বাবা এক এমএলএ-কে এই ভাড়া প্রতিকারের জন্যে দরখাস্ত করলেন বাবার বন্ধুর কুটুমের পিসতুতো দিদির জামাই-এর মাধ্যমে। জনাকাকা তাঁর পরলোকগত প্রপিতামহের অর্ধনারীশ্বর মন্দিরের পুরোহিতের ছেলের বসের পরিচিত এক এমপি-র সাথে যোগাযোগ করলেন।
দু পক্ষের উকিলরা বহু অবান্তর ও কিছু উদ্ভট পরামর্শ দিয়ে নিজেদের রোজগার প্রতিপাদন করতে সক্ষম হলেন। নিচের তলার কত অর্থ ক্ষতি হল জানিনা, তবে আমাদের টাকার শ্রাদ্ধ হল, তবু ভাড়া বাড়ানো গেল না, আর ভাড়াটে ওঠানোও গেল না। কানাঘুষোয় শোনা গেল যে জনাকাকা তো বাড়ি ছাড়বেন নাই, এমন কি বিষ্ণুপ্রিয়াকে বিয়ে দিয়ে জামাই-মেয়ে, নাতিপুতিদের আজীবনের মতো নিচে নিখরচায় মোতায়েন করে যাবেন।
দুই ব্যূহে কোঁদল যখন তুঙ্গে, এমন সময় সেই শীতে তিন সপ্তাহের ছুটিতে আমেরিকা থেকে জেঠু, জেঠিমা কলকাতা এসে পৌঁছলেন। সঙ্গে ওদের মেয়ে উপলা, আমার থেকে মাত্র দুই বছরের বড়, কিন্তু আমার থেকে কোটিগুণে রূপে, স্বভাবের কমনীয়তায়, মনের অনুপমতায় উন্নত। আমি দিদিভাই-এর দিকে তাকিয়ে দেখি আর দেখি, চোখে হারাই। একই বাড়ির মেয়ে আমরা, কিন্তু কি আমেরু তফাৎ। ভাবি বিদেশি মাটির রস বোধহয় দেশি ফুলকে আরও সমুজ্জ্বল, আরো মাধুরী-প্রতুল করে তোলে।
এদিকে বাবার উকিল ব্যারিস্টার রঙ্গলাল বসু মিত্র জেঠুদের আসার খবর শুনে একটা কূটনৈতিক চালের সুযোগ পেলেন। এ বাড়ির অর্ধ সত্ত্ব বাড়ির বড় ছেলে রণদীপ ভৌমিক ওরফে রাণা ওরফে জেঠুর ভাগে। তিনি বিদেশ থেকে ফিরে আসছেন, কলকাতায় বসবাস করবেন নিকট ভবিষ্যতে। বেহালার এই পৈত্রিক বাড়ির নিচের তলায় চুনকাম মেরামত অল্প ভাঙচুর করে সপরিবারে নিচের তলায় থাকবেন। অতএব জনাকাকাদের না উঠলেই নয়। তাদের দুই মাসের নোটিস দেওয়া হল।
জনাকাকারা আগে আগে গৃহহারা হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে আইনের পৃষ্ঠপোষকতা ও করুণা পেয়েছেন। এখন বিদেশ থেকে প্রত্যাবৃত্ত বাড়ির ছেলে বাড়ি পাবে না, তাকে বৌ মেয়ের হাত ধরে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে—এই এত বড় অবিচার প্রবর্তিত হলে—তার জন্যে দায়ী হবেন স্বয়ং জনার্দন বাগচি।
জেঠুর বিদেশে থেকে থেকে গান-ফাইট, হাই-স্পীড কার-ক্র্যাশ, ওয়ালস্ট্রীট, ইনসাইডার ট্রেডিং—এইসব মোটা ভারী খবরে অভ্যস্ত। দেশের এইসব সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ বুঝতে একটু সময় লাগল।
জেঠু এতদিন বিদেশে থাকা সত্ত্বেও বাঙাল ভাষাটা ছাড়তে পারেননি। রান্নাঘরকে এখনও বলেন 'পাকঘর', বাচ্চাদের বলেন 'পোলাপান', বিয়েকে বলেন 'বিন্তা'। জেঠু গ্রীনকার্ড নিয়ে চাকরির জন্যে আমেরিকা রওয়ানা হবার আগে দাদু তড়িঘড়ি আনন্দবাজারে ইংরিজি জানা মেয়ের খোঁজে বিয়ের পাতায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। যাতে জেঠুর পাড়ার ক্ষেমঙ্করী চন্দ্রমুখী স্কুলের ইজ ওয়াজ উচ্চারণের ইংরিজি সাহেবরা বুঝতে না পারলে, বৌ যেন তাতে খটাস ফটাস ধরনের ট্যাঁস টানে কিছু বলে ঠেকা দিতে পারে। দরকার হলে বিদেশে জেঠুর চাকরিটাও বজায় রাখতে বৌ-এর এ জাতের গুণের প্রয়োজন, দাদু শুনেছিলেন।
কিন্তু জেঠিমা কনভেন্টে পড়া মেয়ে হলে কি হবে— সেও আঠারো বছরের বৈবাহিক সংসর্গে স্বামীর দাম্পত্য আলাপের মহামারী ছোয়াঁচে আক্রান্ত। সেও বাঙাল ভাষায় জেঠুর সাথে সমানে তাল দেয়।
মা ঠোঁট উল্টে বলেন, দেখো আদিখ্যেতা! আজকালকার দিনে আবার কেউ হাতে বেগ, আকাশে মেঘ বলে নাকি। মা জেঠুকে খুব ভক্তি করেন, কিন্তু জেঠিমার সাথে আড়াআড়ি সম্পর্ক। আমার যদিও জেঠিমাকে খুবই সরল ও আপনভোলা মনে হয়—মার ঠেসগুলো খুব একটা বুঝতে পারেন না।
আসার পর জেঠিমা একদিন সহজ ভাবে ছাদে রোদে টাঙান নিজেদের জামা কাপড়ের সাথে নিচের তলার জামাগুলোও উল্টে উল্টে দিয়েছিলেন যাতে রোদ্দুরে রং জ্বলে না যায়। কমলা কাকিমার দুটো ব্লাউজে তারে আটকানোর কাঠের ক্লিপ ঠিক করে না লাগানোতে সে দুটো হাওয়ায় উড়ে ছাদের কাকের মলাদৃত কার্নিশে গিয়ে লেপটে পড়েছিল। আর যায় কোথায়। নিচের তলা থেকে অনেক রাগান্বিত কথা সিঁড়ি বেয়ে, জানলা দিয়ে ভেসে, বারান্দার সিলিং ভেদ করে উপরে শোনা যেতে লাগল।
রুবিয়া ভয়েলের ও বাটার সিল্কের দাম বাজারে সোনার দামের চেয়েও বেশি। বারবার কাচলে তার জৌলুষ কি থাকে। তাছাড়া দামি কাপড় 'দীপ' সাবানের গুঁড়ো দিয়ে না কাচলে নয়। এই মাগ্যির বাজারে এত পয়সা নষ্ট করার মুরোদ ম্লেচ্ছসাহেবদের মোসাহেবি-করা লোকদের থাকতে পারে, কিন্তু সবার নেই ইত্যাদি। জেঠিমা অপ্রস্তুত হয়ে নিচের দরজায় টোকা দিয়ে প্রয়োজনের উর্ধে খেসারতের প্রস্তাব নিয়ে বলতে গিয়েছিলেন, কাউয়ার বিষ্ঠার লাইগ্যা এত রাগ করনের কি হইল, কমলা? ধুইয়া ফেলায়লেই হল। আমারে দাও, কালকেই দিয়া যামু।
কমলাকাকিমা দড়াম করে দরজাটা জেঠিমার মুখের উপর বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমন কি 'আ মোলো যা' এমন ধরনের উক্তি দরজার হুড়কো লাগাবার সাথে সাথে কমলা কাকিমার মুখনিসৃত হয়েছিল, নিকষামাসির বিবৃতিতে জানা গেল। অথচ এই জেঠিমা ও কমলাকাকিমা প্রায় এক সময়ে নতুন বৌ হয়ে এই বাড়িতে আসার দরুণ কি ভাবটাই না ছিল তাদের এক সময়ে, পাড়ার লোকদের মুখে শুনেছি।
মা ঘটনাটা শুনে কমলাকাকিমার উপর ক্ষুব্ধ হওয়ার চেয়ে বেশি জেঠিমার উপর বিরক্ত হলেন। আরও যাও ভালমানুষি করতে। কি দরকার যেচে অপমান নিতে।
যুদ্ধের অসি-ঝঞ্ঝনা আরও এক পর্দা বাড়ল। মা নিকষামাসিকে দিয়ে নীলকণ্ঠদার মাধ্যমে নিচের সকলকে জানালেন যে উপরের ছাদে আর ভাড়াটেদের কাপড় শুকানো চলবে না। প্রত্যুত্তরে নিচের সিঁড়ির ধাপে রেখে যাওয়া আমাদের বরাদ্দ খবরের কাগজ মাঝেমধ্যেই উধাও হয়ে যেতে লাগল। সকালের চা-চিঁড়েভাজার সাথে খেলার খবর পড়ার রুটিন ব্যাহত হওয়াতে বাবার কোষ্ঠকাঠিন্য, অর্শ, অম্বল তামাদি রোগ উত্তরোত্তর বেড়ে চলল, আর পানপরাগের টিনের বদলে ইশবগুলের শিশি বাবার ফতুয়ার পকেটে ডেলা হয়ে তাঁবু গেড়ে বসল।
অন্যান্য বারের মতো নিচের চাপা কলের টাটকা জলে চান না করতে পেরে জেঠুর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। আমেরিকার পতাকার রঙের লাল নীল সাদা চেকচেক ড্রেসিং-গাউন পরে অনেক দুঃখময় স্বগোতক্তি সহকারে এমন সারা বাড়িতে পায়চারি করতে লাগলেন জেঠু যে মাকে প্রায় কাবাডি খেলার মতো করে পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে জেঠুর পথচলা বাঁচিয়ে রান্নাঘর থেকে বাথরুম থেকে শোওয়ার ঘরে যাতায়াত শুরু করতে হল।
জেঠিমা তা সত্বেও সন্ধির চেষ্টায় আমেরিকা থেকে শেখা পুডিং করে নিচে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করেছিলেন। মার একে জেঠিমার রান্নায় ভরসা নেই, তদুপরি শত্রুপক্ষকে কিছু খেতে দেওয়া মানে বিষপ্রয়োগের দোষারোপ মাথায় নেওয়া—তোমার বৌদিকে বল তো ওদিকে না এগোতে। পুডিং-মুডিং খেয়ে আমাদেরই বদহজম হচ্ছে, আবার নিচের তলার পেট ছাড়লে আর দেখতে হবে না—খুনের দায়ে হাতকড়া পড়বে। শেষ পর্যন্ত বাবার মারফত জেঠুকে দিয়ে বলিয়ে জেঠিমাকে নিরস্ত করা হল।
এদিকে দিদিভাই নিচের বিষ্ণুপ্রিয়াদির জন্যে আমেরিকার নেটিভ রেড ইণ্ডিয়ান মিক্ম্যাক গোষ্ঠীদের তৈরি পুঁথির মালা ও পালকের ব্রোচ এনেছিল। সেই উপহারগুলো না দিতে পেরে দেখলাম দিদিভাইয়ের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। তবে বিষ্ণুদির মধ্যে কোনো আকুলিবিকুলি দেখলাম না দুবছর অন্তর শীতের ছুটিতে ভাব-হওয়া বন্ধুর জন্যে।
কদিন আগে উড়নির পুচ্ছ ঝাপটা দিয়ে পিছনে দুলিয়ে কপালের কেয়ারলেস-কেয়ারফুল ঢঙে ছাঁটা চুল আলতো আঙুল দিয়ে কানের পিছনে পাকিয়ে সাইকেল রিকশায় চেপে বিষ্ণুদি কোথায় গেল। উপরের বারান্দা থেকে দিদিভাই উৎসাহ ভরে হাত নেড়ে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বিষ্ণুদি উপরের দিকে তাকিয়ে দেখেও দেখল না, আর দিদিভাইয়ের হাত নাড়ার প্রতি-অভিবাদন তো জানালই না। দিদিভাইয়ের হাসি মুখটা ম্লান হতে দেখে আমার খুব কষ্ট হল। মনে হল দিদির কাছে বড়দের মনোমালিন্য কেন ছোটদের মধ্যেও সংক্রামিত হবে—এই প্রশ্নটা অধরা হয়েই রইল।
এদিকে নিচের জনাকাকারা পাড়ার গুণ্ডাদের ধরেছেন, যাতে ভয় পেয়ে বাবা কেস তুলে নেন। বাবার বন্ধুরা অমনি বাবাকে অন্য আরেক আরো ধুরন্ধর গুণ্ডার খোঁজ নিতে বলল। বাবার এসব ব্যাপারে বিশেষ এলেম নেই, তবে নিরুপায় হয়ে পানের দোকানের আর ওষুধের দোকানের চেনাশোনাদের দিয়ে গুণ্ডামহলে একটু সুপারিশ করতে বললেন।
মাফিয়া টাইপের গুণ্ডারা সেই মাসে গ্যাস আর ফুটবলের ব্ল্যাক করা টিকিট নিয়ে হুজ্জুতিতে প্রচুর ওভারটাইম রোজগার করছে, তাদের আর পায় কে। বাজারে একটু মন্দা না পড়লে তারা আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত সাংসারিক পাতিদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। ওদিকে পলিটিক্যাল গুণ্ডাদের খাঁই খুব বেশি। উঁচু মহলে চড়া-বড়া করে তারা ধরা কে সরা মনে করছে। শুধুমাত্র দরজায় উড়ো চিঠির হুমকি দিতেই এক হাজার টাকা বরাদ্দ। দরজা খুলে কড়কে দিতে পাক্কা আড়াই হাজার এর কড়কড়ে এক টাকার নোট।
মা দুশ্চিন্তায় জেরবার হয়ে সারা বাড়ির বিছানাগুলো আগাপাসতলা ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে টান টান করতে লাগলেন, আর আলনার সব শাড়িগুলো নিরন্তর পাট খুলে আবার ঝাপটা দিয়ে দিয়ে সারাদিন রাত পাট করতে লাগল। আমরা শুনতে থাকলাম ঝপ ঝপ ঝপাস, আর ফট ফট ফটাস—মার অবিরত উৎকণ্ঠার নিনাদ।
জেঠু এসব দেখে খুব বিব্রত হয়ে বাবাকে বললেন—রাজা, এসবে আর কাম নাই। এতগুলান টাকা বরবাদ। এইবার তিসুর বিয়াশাদির টাকায় টান পরবো ওখন। তাছাড়া ঘরের বৌ-ই যদি এই সব অশান্তির লাইগ্যা ফাগোল হইতে বসে, তা'লে লাভখান কি হইবো, কও দেখি? গুণ্ডা ছাড়াই লড়তে হইবো।
জেঠুর বাঙাল টানের অকাট্য যুক্তিতে বাবা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সূচ্যগ্র ভূমির জন্যে প্রাণহানি হয় হোক, কিন্তু বৌ পাগল হলে মুশকিল। ওপরতলার গুণ্ডা সন্ধানের ওখানেই ইতি হল।
নিচের তলার গুণ্ডা ভাড়া করার পর্ব কিন্তু পুরোদস্তুর চলতে লাগল। নিকষামাসি এসে খবর দিতে লাগল, কোন দিন কোন গুণ্ডা দলের কেমন ইন্টারভিউ হয়েছে জনাকাকা ও কমলাকাকিমার ড্রয়িংরুম ফোরামে। শেষমেষ এক দলকে নাকি সর্বাঙ্গিক ভাবে পছন্দ হয়েছে নিচের তলায়, পাড়ার গুজব গেজেটে সরব সমাচার বেরোল। দলের নাম—সার্বজনীন সমস্যা সমাধান সমিতি। দলের আদর্শবাণী—
কে মেরেছে, কে ধরেছে, কে দিয়েছে গাল
আমরা তাদের দেখে নেব, হবে যে তার কাল।
এই দলের ছেলেরা সমূহবদ্ধ ভাবে ছাড়া কোথাও যায় না। মেঘলা দিনেও সানগ্লাস পরে থাকে। বারবেল নিয়ে রোজ বেহালা পুকুরের সামনের শিবমন্দিরের চত্বরে এক্সারসাইজ করে ও হাতের গুলির উপর শার্টের হাতা গুটিয়ে ছাড়া পরে না।
পাড়ার লোকেরা তাদের লোফার স্টাইলে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা, পানের লাল মিশ্রিত লালা সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে মুখে টেনে 'স স' করে কথা বলা, পড়াশুনা না করা, চাকরি না করা দেখে যারপরনাই বিরক্ত। মেয়েরা ওদের নামে থরহরি কম্পমান। তারা শিষ দেয়, মেয়েদের নামে কমেন্ট করে, ওদের দেখলেই সিনেমার গান প্যারোডি বানিয়ে করে, বেসুরো সিটি বাজায়। অন্য ক্লাবের মাস্তানদের কারণ অকারণে টাইরড দিয়ে পিটিয়ে আসে। গাড়িওয়ালাদের গ্যাস ট্যাঙ্কে জ্বলন্ত ফুলঝুরি ফেলে দেয়। সাইকেলওয়ালাদের টায়ার ব্লেড দিয়ে কেটে রাখে। হন্টনকারীদের অন্ধকার গলিতে মোকাবিলা করে। ওদের সাথে গুণ্ডামিতে পাল্লা দেবে এমন কারো ঘাড়ে মাথা নেই।
এ হেন ঘোরকলিযথ গুণ্ডাগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতা গিরগিটি একদিন বেল বাজিয়ে বাবা ও জেঠুর সাথে দেখা করে চালিয়াতি সুরে অনেক কিছু বলে গেল। গুরুজনদের সামনে তার মুখের সিগারেটের জ্বলন্ত ধৃষ্টতা দেখে বাবা এতই থতমত খেয়ে গেলেন, যে নিজের মুখের পানের পিকটা ফেলে একটা কথাও বলতে পারলেন না। জেঠু বাঙাল সুরটাকে চলতি ভাষায় পরিনত করার প্রাণপণ চেষ্টা করে বললেন—মাহের পর মাহ ভাড়া না দিলা, গৃহস্থের চলে কেমনে? তমরাই কও, এডা কি এট্টা বিধান হইল?
উদ্ধত মুখভঙ্গি করে ধোঁয়া ছাড়ছিল গিরগিটি, আমরা উপরের কোণের জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম। সিগারেটের শেষাংশ মাটিতে ফেলে নিজের জুতোর গোড়ালি দিয়ে পিষে দিতে দিতে গিরগিটি বলল, উকিল আদালত থানা পুলিশ এসব দিয়ে আপনাদের কিসসুটি লাভ হবে না। আপনাদেরই তাহলে এখান থেকে ভিটে ছেড়ে চলে যেতে হবে। ভাড়াটেদের রাইট্স আছে। স্কোয়াটার্স রাইট্স—শুনেছেন তো।
জনাকাকার উকিল বোধহয় এসব কথা শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছিল।
অন্যায় প্রপঞ্চতার এই অপমানে ভয়ে আমাদের সারা বাড়িতে একটা থম মারা ভাব এসে গেল। সেদিন কেউ আর রেডিওতে সন্ধ্যার নাটক পর্যন্ত শুনতে বসল না। জেঠিমা আর মা শুধু লেড়ি বিস্কুট দিয়ে জল খেলেন, আর আমরা ঠাণ্ডা পান্তা ভাত খেয়ে শুতে গেলাম।
এদিকে দিদিভাইদের আমেরিকা ফিরে যাওয়ার দিন এগিয়ে আসতে লাগল। সেদিন বিষ্যুদবার দুপুরে দিদিভাই আর আমি লক্ষ্মীপুজোর বাতাসা ও ফুল কিনতে বড় রাস্তার দশকর্মা ভাণ্ডারের দিকে যাচ্ছি। চারিদিকে চুপচাপ, কলকাতার ডিসেম্বরের মৃদু শীতের নাতিচপল বাতাস। আমি একটু শীতকাতুরে বলে মার কাশ্মীরী শালটা ঘটা করে পেঁচিয়ে পরে চলেছি। দিদিভাই বিদেশি মানুষ, ওর কাছে এই ঠাণ্ডা তুচ্ছ। উন্মুক্ত মাথায়, খোলামেলা ভাবে বোটানিকাল গার্ডেন্স এর প্রজাপতির মতো হাল্কাভাবে চলেছে।
হঠাৎ রাস্তার মোড় ঘুরতেই চমকে উঠলাম। ছোটো গলির ও মোড়ে একদল ছেলের জটলা। ছেলে না তো—গিরগিটির দল। বুড়ো জামরুল গাছের গুঁড়িতে হেলান দেওয়া তাদের বাইসাইকেলগুলো দানব কালো ডেয়ো পিঁপড়ের মতো লাগছে। আর সানগ্লাস পরা ছেলেগুলো যেন কোনো অন্য গ্রহের মুখোশ পরা বোম্বেটে দস্যু।
অন্য সময় হলে ভাবলেশহীন মুখ করে ওদের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যেতে আমি পিছপা হতাম না। কিন্তু নিচের তলার সাথে এই লড়াই, গিরগিটির আমাদের বাড়িতে এসে ধমকে যাওয়া—সব মিলিয়ে আবহাওয়া মোটেই সুবিধের মনে হচ্ছিল না ইদানীং।
গত দুদিন ধরে নিকষামাসি চারপাইএর উপর আপাদমস্তক ভুষো কম্বল ঢাকা দিয়ে ফ্লু জ্বরে ধুঁকছে, তা নাহলে আমাদের সাথে আসত। অবশ্য এই ছেলেরা আর কি করবে। বড়জোর আজেবাজে মন্তব্য করবে, সিটি দেবে। আমরা চোখ কান বুজে ওদের আওয়াজ দেওয়া গায়ে না-মেখে বেরিয়ে যাব।
যথারীতি তাদের তির্যক, ইঙ্গিতময় বাণী আমাদের চারপাশে পাখি ঠোকরানো আধ-খাওয়া জামরুল ফলের মতো ঝরতে লাগল। এই বর্ষণের মধ্যে দিয়ে আমরা তিরপলে মোড়া জিপগাড়ির মতো এগোতে থাকলাম।
এমন সময়ে গাছের অন্ধকার ঘুপচি ছায়া থেকে বেরিয়ে আসল স্বয়ং গিরগিটি নিজে। লাল শার্টের কলার তোলা, সরীসৃপ গিরগিটির গলবন্ধের মতো। অন্য মাস্তানদের তুলনায় বেঁটে, সরু ল্যাজের মতো লিকলিকে শরীর। দিদিভাই এর দিকে তাকিয়ে বলল—এই যে মিস আমেরিকা, কোতায় চললি মাইরি?
ইতিমধ্যে দলের পাইক পেয়াদারা যারা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছিল, তারা ধুয়ো দিয়ে গান শুরু করল -
যাচ্ছিস তো যা না
আমার মাথা খা না।
দিদিভাই একটু থমকে দাঁড়িয়ে জবাব দিতে যাচ্ছিল। ওর কুমারীপূজার ছোটমেয়ের মতো সরল চোখ, ওর সাদা সালোয়ারকামিজ পরা পাখির মতো রোগা কোমল শরীর, ওর আধফোটা টগরের মতো অপর্যাপ্ত সৌন্দর্যের মুখ। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হতে চলল। আমি সাবধান করতে বললাম—দিদিভাই, ওদের কথার জবাব দিও না।
কিন্তু জ্যা-মুক্ত তীরের মতো ওর ঈষৎ বিদেশি টানের কথা বেহালার এই গলির শিরশিরে বাতাসে তীর থেকে ফানুস হয়ে, আবার ডিগবাজি খাওয়া খেলার বল হয়ে, আবার আন্দোলিত কোনো পতাকা হয়ে এই বখাটে, বাউণ্ডুলে, অযোগ্যদের গাছতলার শিলাকৃত মিছিলের দিকে এগিয়ে চলল।
—আমরা পুজোর ফুল কিনতে বাজার যাচ্ছি।
গিরগিটি বোধহয় আজ অবধি কোনো ভালো মেয়ের ভদ্র উত্তর শোনেনি। হয়তো চমকে গেল। পিছনে সাগরেদরা খিক খিক করে হাসির রোল তুলেছে।
গিরগিটি পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে একটা কি ছোটো জিনিষ আমাদের সামনে ছুঁড়ে দিল। দেখলাম একটা সিগারেট লাইটার। আস্ফালনের মতো করে বলল—এনে দে দিকি জিনিসটা আমার হাতে।
আবার আমি ত্রস্ত হয়ে বলে উঠলাম, দিদিভাই, তুলোনা ওটা। দিদিভাই এখানে বড় হয়নি। এসব অভিজ্ঞতা নেই। এ সময়ে যে ওদের পাত্তা না দিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় তা ঠিক বুঝতে পারে না। ওর জগতের নিয়ম অনুযায়ী প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। কেউ কিছু চাইলে সেটা যথাসাধ্য দেওয়ার চেষ্টা করতে হয়।
দিদিভাই হাঁটু ভেঙে নিচু হয়ে বসে লাইটারটা কুড়িয়ে নিল। মুঠির মধ্যে সেটা ধরে গিরগিটির দিকে এগিয়ে চলল। স্লো মোশান সিনেমার নায়িকার মতন ওর প্রতি আঙ্গিকে একটা প্রতিবেদন ছিল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ত্রাসে বিস্ময়ে দেখতে থাকলাম।
ওদিক থেকে সার্বজনীন সমস্যা সমাধান সমিতির সদস্যদের হাসির জোয়ার বর্ষায় গলির ধারের নালার জলের মতো ঝর ঝর করে তোড়ে বইতে লাগল। সত্যি সত্যিই দিদিভাই লাইটারটা গিরগিটির হাতে তুলে দিল। এমন দিন হয়তো গিরগিটির মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো জীবনে কখনো আসেনি।
হাতের এক সার্বভৌম কর্তৃত্বের ইঙ্গিতে দলের ছেলেদের হাসি থামাতে ইশারা করল গিরগিটি। হাত পেতে লাইটারটা নিল। একটু হতভম্ব হয়ে দিদিভাইয়ের দিকে তাকাল। মেয়েদের হেনস্তা পেয়ে অভ্যস্ত সে, তাদের যেচে বা উলটে অপমান করতে তেমনই সিদ্ধহস্ত। এই অভূতপূর্ব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যেন এর পরের দাবার চালটা ওর জানা নেই, এমন একটা ক্যাবলা ভাব তার চোখের মধ্যে দেখা গেল।
আমি আর দিদিভাই ততক্ষণে বড় রাস্তা পার করে অনেকটা এগিয়ে গেছি।
পরের দিন দিদিভাই আর আমি শিবমন্দির গেলাম। পাড়ার সবুজ সংঘের বড়দিনের উৎসব উপলক্ষে পিয়ানো-অ্যাকর্ডিয়ান ও মাউথ-অর্গানের কনসার্ট শেষ থেকে শুরু বিনা উপদ্রবে বসে দেখলাম। পরের দুদিন পাড়ায় চক্কর কাটলাম। ছেলেদের দল এখানে ওখানে টহলদারি করছে দেখলাম, কিন্তু আমাদের দেখলে তাদের জুলজুল করে তাকানো বা শিষ দেওয়া—একদম কিচ্ছুটি দেখা বা শোনা গেল না। গিরগিটিকেও রাস্তার সব মজলিশে দেখা গেল না।
জনান্তিকে শোনা গেল যে গিরগিটি নাকি হাইস্কুলে আবার নাম লিখিয়েছে। পাড়ার অস্কাদা, দেবাংশুদার কাছে টিউশন পড়ছে। স্কুলের পরে দু বছর কলেজ করে খালাসি হয়ে সে জাহাজে আমেরিকা যাবে। নিচের জনাকাকুকে নাকি উলটে হুমকি দিয়েছে—গত চার মাসের ভাড়া নগদ থোক টাকায় বাবাকে সুদ বাবদ দিয়ে দিতে।
উড়ো খবর এও শুনলাম যে গিরগিটি কর্পোরেশনকে দরখাস্ত করেছে বেহালা বাজারের পাশের রাস্তার নাম বদলিয়ে উপলা লেন করা হয়।