• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫০ | ফেব্রুয়ারি ২০১২ | গল্প
    Share
  • স্পর্ধার খেলা : সীমা ব্যানার্জী


    আসুন না একটু রাগ প্রকাশ করি, ঘৃণা প্রকাশ করি, একটু নড়ে চড়ে বসি। যে রাগ-ঘৃণা প্রকাশে অ-মানুষেরা নড়ে উঠবে। আমাদের কেন পক্ষ নিতে হয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে! আচ্ছা, অ-মানুষেরা কি মানুষ হতে পারে না? কেন পারে না? মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে কেন এক একটা জীবন ধূলিস্যাৎ করে, আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এই প্রশ্ন কেবলি নাড়াচাড়া করে। যদিও জানি, হয়ত আমার এই লম্প-ঝম্প বাতুলতা ছাড়া আর কিছু না, তাও প্রশ্ন করাটা-তে তো কোন ট্যাক্স লাগে না, তাই না?

    **************

    মিল্টির ময়নার সাথে হঠাৎ দেখা আটলাণ্টার সুপার মার্কেটে। আকাশে আজ যেন কেমন এক গুমোটে ভাব।

    “আরে ময়না যে, কেমন আছিস তুই? কতদিন পর তোকে দেখলাম। কি করছিস রে এখন? আজকাল একদম সময় পাই না রে। আজ একটু সময় পেয়ে শপিং -এ এলাম। ভালোই হল তোর সাথে দেখা হয়ে গেল।” একসাথে গড়গড় করে কথাগুলো বলে তাকাল ময়নার দিকে। ময়না প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু নিজেকে সামলিয়ে বলল,
    “এই তো, চলে যাইতেছে আপা। কলেজে ঢুকসি তো, একটু ব্যস্ত আসি।”
    “কলেজে ঢুকছস নাকি? বাহ! কবে ঢুকছস? আর কি নিয়াই বা পড়ত্যাছ?”

    মিল্টি ময়নাকে দেখলেই ওর সাথে ওর ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। যদিও মিল্টি কলকাতার মেয়ে। একেবারে খাস ঘটি। সব ভাষাই ওর কাছে খুউব মিষ্টি লাগে। তাই যা জানে বলে সেই ভাষাভাষি মানুষদের সাথে। এই মেয়েটাকেও তেমনি খুব ভালোবাসে মিল্টি। খুব মিষ্টি স্বভাব ময়নার। আর ওর কথাগুলো যেন খুব প্রাণবন্ত।

    খুলনার মেয়ে ময়না ডাক্তার হাবিবকে বিয়ে করে অভিবাসীদের দেশ আমেরিকায় এসেছিল এক বুক ভালবাসা মাখানো প্রেমস্বপ্ন নিয়ে। একমাথা কাল কুচকুচে লম্বা সোজা চুল আর ফর্সা রঙে বেশ নাদুসনুদুস দেখতে। এদেশে এসে অবধি শরীরে একটু বেশি মেদ লেগেছে। খুব পান খায় ময়না। এক মুখ পান নিয়ে যখন কথা বলে, বেশ লাগে দেখতে তখন।

    ডাক্তার হাবিবের সাথে ওর বিয়ে হয়েছিল ঠিক ছয়মাস আগে। হাবিব কাজ করে নিউ-ইয়র্কের এক হাসপাতালে। বেশি বয়স না হাবিবের, বড়জোর ৩০ বছর হবে। জন্মেছে এই অভিবাসী দেশেই। হাবিবের দিদিমা দেশের মেয়ে ময়নাকে পছন্দ করে রেখেছিলেন একমাত্র আদরের নাতির জন্য । আর নাতিও দিদিমা বলতে অজ্ঞান। ব্যস! একারণেই এই বিয়ে।

    খুব গুণী মেয়ে ময়না তো! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ্যাকাউন্টিং-এ মাস্টার ডিগ্রি নিয়েছে কৃতিত্বের সাথে। গানেরও নাকি একটা ডিগ্রি আছে। খুব ভাল কবিতা লেখার হাত। অসাধারণ রান্না করে, তবে সবচেয়ে বড় গুণ যেটা-- সেটা হল ওর অদ্ভুত মিষ্টি ব্যবহার। সব কিছুতেই এই অসাধারণতা যেন শোনা যায় না।

    দুই ননদ, প্রফেসর শ্বশুর আর গৃহবধূ শাশুড়ি এই নিয়ে ময়নার নুতন সংসার যাত্রা শুরু হল ক্যানসাসে। খুব ধুমধাম করে বিয়ের পার্টি দেওয়া হল নামকরা এক হোটেলে। একেবারে বাঙালি কনের সাজে সেদিন অপরূপা লাগছিল ময়নাকে। এই হাসিখুশী মেয়েটাকে সেদিনই সবার খুব ভাল লেগে গেল। আর মিল্টির তো খুবই ভাল লেগেছে।

    তারপর থেকে যা হয় এই ভিনদেশে... আর দেখা সাক্ষাত নেই। হয় পূজো, নয়ত হপ্তান্তে কোন পার্টিতে একটু বাঙালির মুখ দেখা তা যে দেশেরই হোক না কেন। স্বভাবতই বাঙালি দেখলে বেশ ভাল লাগে অন্যান্য বাঙালিদের মতন মিল্টির-ও।

    দেখতে দেখতে দূর্গাপূজা এসে গেল। আবার দেখা ময়নার সাথে। একটা চেয়ারে একা বসে আছে । মিল্টিকে দেখে ছুটে এসে ওর পাশে বসলো।

    মিল্টি ওকে জিগেস করল; “কি রে, কেমন আছিস তুই? একা কেন? এখনও পান খাচ্ছিস?” অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে করে ফেলল। মিল্টির স্বভাব হল একসাথে প্রশ্ন করার... তারপর... মনে হয়, সে একটু রেস্ট নেয়।

    "পান ছাড়া এক মিনিট থাকতে পারি না আপা", বলে পার্স থেকে বার করে আরেকটা পান মুখে ঢুকিয়ে দিল ময়না।

    মিল্টি ওর দিকে তাকিয়ে দেখল -- চোখে জল । ভাবল, জিজ্ঞেস করে বোধহয় ভাল করেনি। মা বাবার জন্য বোধহয় মন কেমন করছে। কিন্তু ময়না মিল্টিকে বলল,
    "আমার কথা কিছু শুনেছো, আপা?”

    কিছুটা আশ্চর্য হয়েই মিল্টি বলল,
    "না তো রে। কেন কি হয়েছে। যদি আপত্তি থাকে... বলিস না। তোকে ভালবাসি বলে জিগেস করছি।"
    "না, তোমাকে বলব, না বলার কি আসে? লজ্জার-ই বা কি আছে? অন্যায় করলে তবে তো লজ্জা! লজ্জা করলে এ দেশে একা থাকব কি করে? তোমার তাড়া নেই তো, আপা? তাহলে চলো ওই ক্যাফে বার-এ গিয়ে কথা বলি। কারণ, সময় লাগবে তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে।”

    দুজনে গিয়ে দু কাপ কফি আর প্যাস্ট্রি অর্ডার দিয়ে দুখানা চেয়ারে মুখোমুখি বসল। খুব যেন সাহসী মেয়ে লাগলো সেই মূহুর্তে ময়নাকে। বলল,
    "আপা, আমাদের দেশে আমরা লড়াই করে স্বাধীনতা এনেছি । কাজেই কোন কিছুতেই আমরা ভয় পাই না। আমি স্বাধীন বাংলাদেশের মেয়ে। সুখ দুঃখ আমার সাথি, আমি তাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।”

    তারপর ওর দুঃখের ঝাঁপি খুলে দিল প্রসারিত ভাবে।
    "সেই দিনটা আমি কোনদিন ও ভুলতে পারব না, আপা। বাশার আব্বাজান না থাকলে আমার যে কি হইত একমাত্র আল্লাই জানেন।
    কবি অমিতা দেবীর আশ্চর্য সহজ সরল প্রাণের কবিতা আমার আজও মনে আসে...শুনবে, আপা?
    “যবে শুধায় সকলে মোরে, তুমি কি পেয়েছ?
    কই দেখালে না আজি?
    মৌ্ন নতমুখে থাকি, কি দিব উত্তর--
    কি পেয়েছি আমি?...
    অন্তহীন পাওয়া সে যে ঋতুতে ঋতুতে
    বর্ণে গানে বিচিত্রিতা মাঝে,
    শূন্য পাত্র পূর্ণ করি রাখে যে সদাই
    তাই মোর দুঃখ কিছুই নাই।”

    মিল্টি কেমন যেন চুপ হয়ে গে্ল...... আস্তে আস্তে। মুখের ভাষা হারিয়ে কোথায় যেন লুকিয়ে পড়ল। খালি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল হাঁ করে। মনে মনে ভাবলঃ এই ভিনদেশে নতুন বিয়ে হয়ে আসা এই মেয়েটা বলে কি?

    "সেদিন সূরুয ওঠেনি আপা। সকালবেলা মনে হচ্ছিল সন্ধ্যাবেলা।"

    মিল্টি দেখল দু ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল ওর মুঠো করা দুহাতের ওপরে, মুছল না সেই জল। শুধু তাকিয়ে রইল সেই জলের দিকে। কালো একটা সিন্থেটিকের শাড়ি পরে এসেছিল। কেমন যেন ফ্যাকাসে লাগছিল ওকে। চোখের জল বিন্দু বিন্দু পড়ে ওর কালো শাড়ির কোলে খেলা করতে লাগল।

    এইবার যা গড়গড় করে বলে গেল, মিল্টির অবাক-কে আরো গভীরে নিয়ে গেল। হাসি-কান্নার সময় মানুষের কন্ঠস্বরের যে পরিবর্তন হয়, তার নমুনা হাতেনাতে পেল মিল্টি।

    "বিয়ের পর আমাকে নিয়ে হাবিব নিউ-ইউর্ক চইলা গেল। দেখতে দেখতে দু হপ্তা কেটে গেল আপা। বেশ কাটছিল দিনগুলো যখন হাবিব ছুটি নিয়ে বাড়িতে ছিল আর আমরা এইখানে ওইখানে ঘুরে বেড়া্স্সিলাম। কিন্তু, হাবিব কাজে যোগ করার পর থেকেই আর একলা ভাল লাগতেসিল না, তাই অনেক ভেবে ওকে একদিন বল্লাম...
    ইউনিভার্সিটি খুব কাছে । ভাবসি, বাড়িতে বসে না থেকে আবার পইড়ে নিই। এখানে এত্ত সুযোগ। কিন্তু হাবিব যা বলল তা শুনে আমার মনের ইচ্ছে পাখিটা ছটফটিয়ে উঠল আপু। ডানা ঝাপটিয়ে ঝাপটিয়ে দুমড়ে মুচড়ে পড়তে লাগল বুকের মধ্যে। ওর চোখের ভালবাসা এক নিমেষে উড়ে গিয়ে একটা হিংস্র খেঁকশিয়ালকে আমি দেখতে পাইলাম।

    আমার খুব খারাপ লাগল। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে বুঝাইতে পারলাম না। বুকের ভেতর ইচ্ছেপাখিটা ডানা ঝাপটায়। আমি নিজেকে সামাল দিতে পারি না। তারপর কি যে হল, রোজই একবার করে ও যখন হাসপাতাল যেত বলতাম আবার কখনও বা আমাকে আদর করার সময় বলতাম আমার মনের ইচ্ছা। আমি পড়তে খুব ভালবাসি আপা, যখন আমার এই দ্যাশে বিয়ার কথা হইত্যাসিল, দিনরাত কত স্বপ্ন দ্যাখসি।

    এমনি দিন কাটতে কাটতে...একদিন রুমালিয়া ঘেরাটোপে এল সেই ভাঙা ভায়োলিন সকালবেলা।

    হাসপাতাল যাবার আগে আমাকে বলে গেলঃ 'আমি যদি আবার শুনি যে তুমি পড়বা... সেদিন কিন্তু দ্যাখবা......আমার মনের আলখাল্লা –র মধ্যে কি আছে। আমার আসল রূ...প....!!' -বলে, ধমাস শব্দে কপাট বন্ধ কইরা বার হইতে তালা লাগাইয়া দিল।

    আমি খুব জোরে জোরে কাঁন্দলাম । কেউ শোনে নাই একমাত্র চার দেয়াল-- যার সান্ত্বনার ভাষা ছিল না আপা। ধনুকের বাঁকা অন্তরে শিস দেয় দমকা ব্যথা। ঠিক কইরা লই যে আর না, এবারে একটা কিছু করতেই হইব। ভদ্রলোক সাইজ্যা হাসপাতাল যাইত্যাসে লোকের রোগ সারাইবো কইরা...... তার মনের রোগ সারাইবো, কে আপা......?”

    ওর কোলে চোখের জল দিয়ে বেশ একটা ছোট্ট নদী বয়ে যাচ্ছিল। মিল্টিরও চোখে যেন কোথা থেকে একরাশ শুকনো লংকার তেজ বাসা বাঁধল। বুকের ভেতর একসাথে হাজারটা হাতুড়ি পিটতে শুরু হল। ময়নার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিচয় পেল এবার।

    "রাতে আইস্যা আদরের বদলে আমারে এক ধাক্কা দিয়া দেয়ালে ফেইল্যা দিল। আমি কান্দি নাই আপা। আমি একটুকুনও কান্দি নাই। খালি ভাবতাসিলাম... এই অধম পশুটারে উচিত শিক্ষা দিতে হইব। সে দিন কিছু না খাইয়া খালি পানি খাইয়া শুয়ে পড়লাম। সে জিগায়অ নাই । পরের দিন আবার আমারে ভেতরে রাইখ্যা দরজায় তালা লাগাইয়া কাজে চইল্যা গেল।

    ফোন করলাম দ্যাশে। আম্মু, আব্বু ও দাদারে কইলাম সব কথা। আম্মু আব্বু কয়ঃ 'মেয়েমানুষের সহ্য করতে হয় । তুমিও করবা। দ্যাশে ফেরত আইলে লোকে খারাপ কইব। আস্তে আস্তে সব ঠিক হইয়া যাইব।'

    আমার দাদারে কইলাম আবার । সে কইলঃ 'তুই নিজের মনরে জিগা । সেইখানে যা উত্তর পাইবা তাই করবা। কারুর কথা শুনবা না। আমি তোর সাথে আছি বইন। তুই স্বাধীন দেশের মেয়ে। কাজেই তোর স্বাধীনতা তোর কাছে, হলেই বা অভিবাসী।'

    আমি নিজের মনরে জিগাইলাম। কোন উত্তর পাই না। শেষে অনেক চিন্তা ভাবনা কইরা ঠিক করলাম, আমাকে একটা উপায় বার করতে হইব। আমি প...ড়...ব...!! যেমন কইরা হউক, আমি পড়ব!!

    আমার শ্বশুরবাড়ির পাশে থাকে বাশার আব্বাজান। হ্যাঁ আপা, বাশার আব্বাজান। আমার নিজের আব্বুর চেয়ে বড়ো-- যিনি আমার মনের কথা জানতে পেরেসিলেন--আমার আব্বু পারে নি তা...আপা। বাপ মা হইলেই যে সন্তানের ব্যথা বুঝবে, এ কোন কিতাবেও লিখা নাই।

    আমার আল্লা ওনাকে আমার কাছে পাঠাই দিয়েসিলেন। ভ্যাগিস ওনার ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল। ওনাকে ফোন করলাম। ফোন করার সাথে সাথে বাসায় ভাবি ফোন ধরেই এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করলেনঃ 'কি খবর ময়না ? বরকে পাইয়া আমাদের ভুইল্যা গ্যাসোস।' বললামঃ না ভাবি। নুতন সংসার তো...সব কিছুই নতুন লাগত্যাসে। বাশার আব্বাজান আছে, ভাবি? একটু দরকার আসে।"

    বললেন, "হ্যাঁ আসে দেব?”
    --” তাড়াতাড়ি দাও ভাবি। আমি খুব বিপদে পড়সি।"

    এই কথা বলতে না বলতেই বাশার আব্বাজান আমার সাথে কথা শুরু করলেন। ওনাকে সব বললাম খুলে। উনি শুনে শুধু চুপ করে রইলেন।

    তারপর বললেন,
    "আমি কালই যাইতাসি। তুই চিন্তা করিস না। ওনাদের মেয়ে নাই তাই প্রথম থেকেই আমাকে ওনারা স্নেহ করতেন। জানি না আমি কেন ওনাদের সু-নজরে পড়েসিলাম আপা। উনি না থাকলে আজ আমার কি হইত কে জানে? কারণ একটাই, ভুল করে পড়বো বলেসিলাম ঘরে না বইসে থেকে।"

    বলতেই যেন ওর চেহারার মধ্যে একটা কঠিন মূর্তি দেখতে পেল মিল্টি।

    ঠিক পরের দিন বাশার আব্বাজান এলেন হাবিব থাকাকালিন। হাবিব কিন্তু কিসসু জানে না যে, কেন এসেছে ওর বাশার চাচা। কথা শুরু হল এমনি ভাবে যে ময়না একদম থাকতে চাইসে না এখানে । ওর একা ভাল লাগসে না । সুযোগ পাইয়্যা এক তরফা আমার সব দোষ দেখাইতে লাগল।

    বাশার আব্বাজান বললেনঃ “ওকে এখানকার কলেজে অ্যাডমিশন দিয়া দাও, তাহলে তুমি না থাকাকালিন ওর সময় কাইট্যা যাবে। আর ও ত ভালো মেয়ে--পড়াশুনা নিয়ে থাকলে দেখো ওর মনও বসে যাবে। এখানে কেউ বসে থাকে না, হাবিব, তা তুমি ভাল করেই জানো...আর ময়না যখন পড়াশুনায় ভালো তখন পড়াশুনা নিয়ে সময় কাটানো তো খুব ভাল কথা।”

    হাবিব বললো, “ না চাচা। ময়না এখানে পড়াশুনা করুক- আমি তা চাই না। তাছাড়া আর তো কদিন পড়েই সংসার বাড়বে তখন কি হবে? আমার আম্মুও তো বাড়ীতেই ছিল, তাই না? মেয়েমানুষের বিয়ার পর সংসার-ই আসল। পড়ার পর বলবে -চাকরি করবে!’’

    বাশার আব্বাজান আর বেশি কথা বললেন না। খালি ভাবলেন, এই আধুনিক দেশে জন্মেও তার কেন এই ক্ষুণ্ণ মনোবৃত্তি।

    "আমি এবার কাজে যাচ্ছি, আবার পরে কথা হবে। ময়নাকে কিছু বলার দরকার নেই চাচা। আপনি তো কদিন থাকবেন তাই না?”

    বাশার আব্বাজান মিথ্যে কথা বললেন, "আমি একটা কাজে এসেছি শেষ হলেই চলে যাব কাল বা পরশু।" হাবিব বলল, “না না দুদিন থাকুন না আমাদের ও ভাল লাগবে।" আমি তখন হাবিবের লাঞ্চ রেডি করছিলাম। বাশার সাহেবের মনে হচ্ছিল উনি চলে গেলেই বাঁচে হাবিব।

    যাই হোক, পরের দিন আবার বাশার আব্বাজান কথা পাড়লেন আমাকে কলেজে ভর্তি করার কথা। হাবিবের চোখে মুখে ফুটে উঠল সেই তীব্র হিংসা। হাবিব বোধহয় নিজেই জানে না নিজের চেহারার কথা কিন্তু বাশার আব্বু ঠিকই দেখতে পেলেন। আর কথা বাড়ালেন না।

    হাবিব কাজে যাবার ঠিক দশ মিনিট আগে হাবিব-কে বললেন যে, 'আমি ময়নাকে নিয়ে যাচ্ছি ক্যানসাসে । তোমার মন ঠিক হলে আবার ও আসবে তোমার কাছে। এইভাবে দুজনের এক সাথে থাকা ঠিক নয়। তোমরা দুজনেই যথেষ্ট গ্রোন আপ কাজেই কোন একটা বিপদ ঘটার আগেই আমি ময়নাকে কে নিয়ে যাচ্ছি। তোমার আম্মু ও আব্বুর সাথে আলোচনা করে কথা হবে। তবে বুঝলাম তোমার এখনও ম্যাচিউরিটি আসে নি। ম্যারিড লাইফ কি ভাবে লীড করতে হয়, এখনও সে জ্ঞান তোমার আসে নি।'

    হাবিব কিছু না বলে দরাম করে দরজা বন্ধ করে চইলা গেল। আমিও আমার জিনিসপত্র গুসিয়ে নিয়ে চলে এলাম বাশার আব্বাজান-এর সাথে ক্যানসাস।

    সেই শুরু হয়েসিল আমার জীবনের আরেক সংগ্রাম। কত আশা-ভালবাসা নিয়ে এসেছিলাম এই নতুন দেশে নতুন বেশে।

    শ্বশুর-শাশুড়ি সব কথা শোনার পর হাবিবকেই সমর্থন করেসিলেন। বাশার আব্বুজান –কে বলেসিলেন 'তাহলে ওকে ডিভোর্সের জন্য তৈরি হতে বল বাশার। আমার ছেলেকে ছেড়ে যদি আসতে পারে নিজের মনের জোরে... তাহলে, সে তার ভবিষ্যৎ নিজেই তৈরি করুক। আমরা ওকে আর নেব না।'

    জানো আপা! আমার বুকের ভেতর মনে হচ্ছিল যেন ভূমিকম্প শুরু হল । মাথাটা ঘুরে গেল কারণ কদিন বেশ মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার হয়েসিল আমার ওপরে। নারী হয়ে এই অপ্রিয় সত্যকে মেনে নিতে পারতেসিলাম না কিছুতেই। ওনারা এসব দেখেও বাড়ি চলে গেলেন।

    আচ্ছা আপা? এরা এদেশে এসে কি শিখেছে, এই বধূ নির্যাতকরা কি শিক্ষা দিচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীকে বলতে পারো? আমি কি সত্যি কোন ঘোরতর অন্যায়-এর অপরাধী? পড়াশুনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাওয়া কি সত্যি অন্যায় আপা, না শুয়ে বসে সময় নষ্ট করাটা ন্যায়-এর পর্যায়ে পড়ে? সঠিক উত্তর কোথায় পাব... জানি না আপা?

    আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম বাশার আব্বাজানের দিকে। নিঃস্বতা হল আমার মাথার দুই পাশ। দুজন খুব বন্ধু ছিলেন ছোটবেলা থেকে। আমার জন্য সেই বন্ধুতে চিড় ধরে গেল চিরতরে।

    বাশার আব্বাজান বললেন, 'চল ময়না আমার বাড়ি থাকবা। আমরা আছি তো, কোন চিন্তা নেই। তুমি পড়বা আমাদের কলেজে, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। সেই শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার চলে আসা আপা। আবার নতুন করে জীবনের পথে নামলাম একা, একাকী--সাথে বাশার আব্বাজান আর ভাবীর পাহাড়প্রমাণ স্নেহ আর প্রেরণা।”

    মিল্টি অবাক হয়ে শুনছে আর ভাবছে কেমন করে নির্বিবাদে বলে চলেছে একের পর এক ঘটনা। কত সাবলীলভাবে বলে চলেছে দুঃখের ঘটনা সারিবদ্ধভাবে। গলা ধরে যাচ্ছে না। যেন একটা ভীষণ যুদ্ধের জন্য তৈ্রি হতে চলেছে।

    মিল্টি ভাবল, যুক্তি যদি ভেতর থেকে মনকে নাড়া দেয় তাহলে উপেক্ষিত জীবনের বঞ্চনা ও ক্ষোভকে অদৃষ্ট বলে মেনে নেবার অপরিসীম শক্তির ভিত আসে দুর্বল হয়ে। এখানে তো অন্য কোন সমস্যা নেই, একটি শিক্ষিতা আধুনিকার আত্মকথন, আত্মবিবেচনা। সেই মেয়ের পড়াশোনাকে ভালবাসা কি ন্যায্য কোন ঘোরতর অপরাধ?

    মিল্টি বলল, "তারপর?”

    ডিভোর্স হইয়ে গেছে ভালভাবে। ওরা ভাবেননি যে, আমি এই ভাবে শক্ত হইয়ে পড়ব। আমি কলেজে ভর্তি হয়েসি বাশার আব্বাজানের সহায়তায়। এ্যকাউন্টিং–এ আবার মাস্টার্স করসি। এই বছরই গ্র্যাজুয়েট হব। আমার জন্য দোয়া করো... যাতে একটা ভালো চাকুরি পাই।

    আমি এখন এ্যাপার্টমেন্ট-এ থাকি। বাশার আব্বুই ব্যবস্থা করে দিয়েসেন। আপা, 'এই আমি বেশ আছি।'-- কবি শক্তি চ্যাট্টার্জ্জীর কথায় । আমার জন্যেই বোধহয় লিখেসিলেন তিনি।”

    একদিন আমার বাসায় আসবে আপা?”" “নিশ্চয়-ই আসব সময় পেলে। কেন আসব না রে? তোর হাতের রান্না খেতে কে না চায়...ব...ল?”

    তারপর মিল্টি দেখে, হঠাৎ ওর চকচকে হাসি মুখটা নিচের দিকে করে দুটো হাত নিয়ে মুঠো করছে আবার খুলছে। ওর ওই দুষ্টুমিকরা হাতের দিকে তাকিয়ে মিল্টি বললঃ
    “হম ম্ ম্! কি ব্যাপার গো? আমাকে বলবে না?” আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে আবার সাদাটে হয়ে গেছে দিনটা।
    "আপা একটা কথা বলব, তোমাকে না বলে থাকতে পারতেছি না।"
    "বলে ফ্যাল না । নিশ্চয়ই কোন সুখবর। কি বল?”
    "বাশার আব্বু আমাকে রুমন-এর সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েসেন।"
    “তা...ই নাকি? বাহ্! খুব ভাল কথা ! কংগ্রাচুলেশন! কি করে রুমন?”
    "রুমন এখানে বায়ো মেডিকাল সায়েন্সে পি এইচ ডি করসে, কমপ্লিট হলেই আমাকে শাদি করবা বলেসে।”

    ওর ফর্সা গালে গোলাপি আভা। ঠকঠক্ করে কাঁপছে ওর তিরতিরে ঠোঁট। কানগুলো লাল হয়ে উঠেছে। হঠাৎ দুই হাতের মুঠো শক্ত করে বাঁধা।

    "কিন্তু জানো আপা আমার বড় ভয় করত্যাসে। বলগাহীন উন্মত্ত মুক্তির স্রোতে হয়ত উন্মাদনা আছে কিন্তু সুস্থ মানসিকতা কি আবার আমি ফিরে পাবো?”
    "কেন, পাবি না? সব পুরুষরাই কি আর এক ঢং-এ সাজে রে? সবাই কি আর হাবিবের মতন নাকি? মানুষ মাত্রেই তো ভালমন্দ মেশানো... তাই না? দেখ তাহলে তো সুখী দম্পতির ব্যাকরণ মিথ্যে হতো।"
    "রুমন বলসে, আমি আরো পড়াশুনা করতে চাইলে ওর আরো ভাল লাগবে। এখানে দুজন মিলে চাকরি করলে অনেক সুবিধা কারণ, জানোই তো আপা ভালভাবে যে... একজনের চাকুরি না থাকলে আরেকজনের চাকুরিতে সংসার এর কোন অসুবিধা হবে না।"

    আবার একটু লাজুক লাজুক মুখ করে বললঃ “ও আমাকে খুব ভালবেসে ফেলেসে আপা। আমরা বিয়া করব তবে আমার চেয়ে এক বছরের ছোট রুমন। বাশার আব্বু বলেসেন যে, “এক বছরের ছোট এমন কিছু খারাপ নয়। ভালবাসা যেখানে মজবুত, সেখানে একটু ছোট বয়স কোন বেড়া তৈ্রি করবে না।”

    তারপর-ই হঠাৎ ময়না বললঃ “এবার উঠি আপা। একটু শপিং করেই বাসায় ফিরব। কাল আবার আমার একটা ইন্টারভিউ আছে। আবার পরে কথা হবে। আমার জন্য দোয়া কোরো কিন্তু।”

    ##

    তারপর একদিন বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড পেল মিল্টি। রুমনের সাথে ময়নার বিয়ে দিচ্ছেন বাশার সাহেব, ক্যানসাসের ডে ইন হোটেলে।

    অনেক লোক এসেছিল বিয়েতে । ময়নাকে সবাই যে খুব ভালবাসে বোঝা গেল। বেশ দেখতে রুমনকে। লম্বা চওড়া সুপুরুষ। দুজনকে মানিয়েছে বেশ সুন্দর।

    সমস্ত রান্না একা করেছে ময়না । অত লোকের রান্না করা সহজ কাজ মোটেই না। সত্যি যে খুব গুণী মেয়ে ময়না-- তার নিদর্শন আরেকবার বুঝিয়ে দিল সবাইকে ... আরোও বুঝিয়ে দিল...সে হারেনি।

    তারপর আবার এখানে ওখানে দেখা হ্য় ময়না আর রুমনের সাথে। দেখে বেশ সুখি সুখি মনে হয় ওদের। মিল্টি মনে মনে খুশি হয় এই ভেবে যে, সত্যি ময়না জিতে গেল এই সাংসারিক যুদ্ধে। সে প্রমাণ করে দিল, নারী পারে না এমন কাজ নেই।

    তারপর দুবছর পরে আবার দেখা... ঝলমলে শাড়িতে ময়নার সাথে- এক বিয়েবাড়িতে। সেই গাল ভরা হাসি আর মুখ ভরা পান।

    মিল্টি জিগেস করলঃ “কি গো কত্তা কই?”

    পেছনে দেখালো টু সিটেড স্ট্রলার হাতে রুমন আর সেই স্ট্রলারে দুই ফুটফুটে বাচ্চা। আমার যমজ ছেলে আর মেয়ে আপা।

    মিল্টি বলল, "বাহ! এতো বসান তুমি ময়না। কি নাম রেখেছো, গো?”
    "গয়না আর অলংকার।"
    "আরে বাহ! ভারি মিষ্টি নামদুটো তো। সত্যি তো। তোমাদের আসল গয়না আর অলংকার।"
    “আমার মত যেন জীবনে দুঃখ না পায় আপা তার জন্য ওদেরকে আশীর্বাদ করো। দোয়া করো যেন ওরা হাসিখুশী থাকতে পারে সারা জীবন। ছেলে যেন কাউকে বিনা দোষে দুঃখ না দেয়, কারুর চোখে দুঃখের পানি না আনে। ওর আব্বার মতন যেন মনুষত্বের অধিকারী হয়, আর মেয়ে যেন এইরকম-ই হাসি খুশি থাকে, আমার মতন যেন যুদ্ধ না করতে হয়...” বলেই মুখটা আবার দুঃখে ভরে উঠল।

    একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললঃ "সেই দিনটা আজও আমি ভুলতে পারতেছি না আপা। এই ভুলে থাকা নয়--সে তো ভোলা।"
    মিল্টি সব শুনে বলল, "এবার সব ভুলে যাও। দেখ কি সুন্দর হাসছে ওরা বাবার দিকে তাকিয়ে। এমন সুন্দর সন্তানদের দিয়েছে তোমাকে রুমন । কত সুন্দর জীবন দিয়েছে তোমাকে। আবার কি চাই? শুনেছি তুমি একটা ম্যাগাজিন-ও বার কোরছ আজকাল, তাই না?"
    "হ্যাঁ, আপা...আর আমার এই কাজে সহায়তা করছে রুমন আর আমার এই দুই সম্পদ। আমি যেন এমনি থাকি আপা, তাই আমাকে আশীর্বাদ করো, আর কিছুই চাই না।"

    আবার সেই একগাল পান খাওয়া হাসি নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

    শুধু মনে মনে বলল মিল্টি... কোন কিছুই কারুর জন্য থেমে থাকে না। নারীসুলভ রমণীয়তা তো ময়না ত্যাগ করেনি, একজন শিক্ষিতা আধুনিকা নিজেকে বিশ্লেষণ করে ভালবাসার স্বরূপ সন্ধান করেছে মাত্র।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments