• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫০ | ফেব্রুয়ারি ২০১২ | রম্যরচনা
    Share
  • সমীর ও রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ : সৌরীন ভট্টাচার্য

    কলকাতার দুঃসংবাদ পেলাম টেলিফোনে। আমি তখন শহরের বাইরে। বছরের শেষ। কলকাতাকে ফাঁকি দিয়ে আমরা কয়েকজন তখন চষে বেড়াচ্ছি রাজস্থানের এধার ওধার। সন্ধেবেলায় হোটেলে ফিরে আয়েশ করে টেলিফোনে গল্প করতে করতে কলকাতার খবরাখবর পাই। একসঙ্গে জোড়া খারাপ খবর। ঋতু গুহ এবং সমীর সেনগুপ্ত । গত শতকের ষাটের দশক থেকেই যারা আমরা ঋতু গুহের গানে মুগ্ধ তাদের খারাপ তো লাগবেই। কী সব গান ছিল। 'কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ', এর কোনো জুড়ি নেই। একটু আগে আগেই হয়তো গানের অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে সরে গেলেন। জানি না গলা ওঁর সঙ্গে বেশি আগে থেকেই অসহযোগিতা করল কি না। মনে পড়ে গেল উনিশশো পঁচাত্তরে মহাজাতি সদনের এক অনুষ্ঠানে গান শুরু করেই গলা আটকে গেল। আবার গোড়া থেকে নতুন করে ধরলেন কলিটাকে। পঁচাত্তরে তো ওঁর গলায় বয়স লাগার কথা নয়। কোথায় যে কী ঘটে কী জানি। আমি মঞ্চে ওঁকে শেষ যা দেখেছি সে গান নিয়ে আলোচনা করতে, গাইতে না। মনে পড়ে যাচ্ছিল নানা গানের কথা। জয়যাত্রায় যাও গো, আর কারো অ্যালবামে যেন তেমন করে পাই না গানটা। ইদানীং কারো গলায় আছে কি গানটা? কী জানি। মনে করতে পারি না তো।

    সমীরের শরীর খারাপ যাচ্ছিল সে কথা জানতাম। কিছুদিন আগেই হাসপাতালেও যেতে হয়েছিল তাও জানা ছিল। ফিরে এল। আবার কাজের মধ্যে ফিরে গেল। শরীরের কারণে বাড়ি থেকে বেশি বেরোত না। এমনিতেও সমীর খুব একটা বাইরের সভাসমিতির ব্যাপারে থাকত না। একটু আধটু গান শোনা, কবিতা পাঠ, এইসব আসরে দেখা হত। তাও এই শরীর খারাপের পরে কমে এসেছিল। এক সময়ে সে তো মোটর বাইক চালাত। মনে আছে শক্তির মৃত্যুর পরে যাদবপুরে স্মরণসভা, সঙ্গে শক্তির বইপত্র ও পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রদর্শনী। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কোনো কিছু হবে আর সমীর নেই তা হয় না। সে-সব হয়ে যাবার পরে আমাদের কফিহাউসের আড্ডা হবে। যাদবপুরের কফিহাউস। বেঙ্গল ল্যাম্প থেকে কফিহাউস পর্যন্ত আমরা কয়েকজনে হেঁটে গেলাম, সমীর আমাদের পিছন পিছন আস্তে আস্তে বাইক চালিয়ে গেল। কলকাতায় দু-চাকার ঝুঁকির কথা বললাম। বললাম, 'বরঞ্চ না হয় তুমি একটা গাড়িই কিনে ফ্যালো'-- কলকাতার মধ্যবিত্তের তখনো দু-পকেট ভর্তি গাড়ি ওঠেনি।

    আরো পরে, এই তো বোধহয় গত বছরেই। সমীর একদিন আমাকে গাড়ির লিফ্‌ট দিতে চাইল। বলল, 'মেয়ের গাড়ি সঙ্গে আছে, এসো, উঠে পড়ো।' সল্টলেকের সিটি সেন্টারের কাছে আই ডি এস কে থেকে ফিরছিলাম আমরা। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এক প্রবন্ধসংকলনের আনুষ্ঠানিক প্রকাশের সভা ছিল। সমীরের শরীর তখন বেশ খারাপ। দেখে খুব বোঝা যেত না অবশ্য। আর নিজের শরীরের কথা সাতকাহন করে বলার লোক ছিল না সমীর। বলল, 'চলছে'।

    তখন সে কাজকর্মের মধ্যে প্রায় ডুবে ছিল একেবারে। তার হাতে যে আর খুব বেশি সময় ছিল না, সে-কথা কি সে বুঝতে পেরেছিল তখনই? সে কি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুষিয়ে নিতে চাচ্ছিল? তার তো অনেকটা সময় বাজে খরচ হয়েই গেছে। সে নিশ্চয় জানত এ কথা। যদিও নিজের মুখে এসব কথা সে বলেনি কখনো। তার মনটা ছিল কবিতায়, সাহিত্যে, সংগীতে। সত্যি কথা বলতে আমরা ওই সময়টায়, দু-এক বছরের আগে পরে যাদবপুরে যারা কাছাকাছি এসে গিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য সুতোর টান ছিলেন বোধহয় বুদ্ধদেব বসু। ব্যক্তিগতভাবে একেবারেই নয়। অন্তত আমার বেলায় তো নয়ই। তাঁর রচনা, তাঁর কবিতা, তাঁর 'কবিতা' পত্রিকা। এই সবই সেই মাধ্যাকর্ষণ। আমাদের বছরে ছিল মানবেন্দ্র। অমিয়ও ছিল। একটু বোধহয় সুদূর, তখনকার বয়সের তুলনায় বাজে কথায় সময় নষ্ট করার লোক যেন সে ছিল না ঠিক। আর ছিল এই সমীর আর কমলেশ চট্টোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব বসুর গদ্য গ্রন্থাবলিও সে যেন সবই মুখস্থ বলে দেবে মনে হত। যাদবপুরের আরো কয়েকজন বাউণ্ডুলে ছাত্রের সঙ্গে মিলে গড়িয়া স্টেশনের কাছে তাদের আস্তানার নাম ছিল উজ্জয়িনী। খড়ের চালের মাটির ঘর। সে ঘরে তখনো কেরোসিনের হ্যারিকেন জ্বলে। বিদ্যুৎ প্রবেশাধিকার পায়নি সেখানে। কিন্তু কমলেশের সংগ্রহে তখনই ছিল 'কবিতা' পত্রিকার প্রায় পুরো সেট। পুরোনো সংখ্যা ইচ্ছেমতো দেখা যেত কমলেশের উজ্জয়িনীর ঘরে। সমীর কখনো সেখানে ছিল কিনা আমার ঠিক মনে পড়ে না। সে থাকত হস্টেলে। তার রুমমেট ছিল আমাদের বন্ধু ভাস্কর। সমীর নাকি তখন বাঁশি বাজাত। জামা জুতো না ছেড়েই শুয়ে পড়ত এক একদিন বাঁশি বাজাতে বাজাতে।

    ১৯৬০ বা ৬১, ঠিক মনে নেই। আমি একদিন সমীরকে আবিষ্কার করেছিলাম পুরোনো দিল্লির রেল স্টেশনে। সে বোধহয় এম. এ. পরীক্ষার পরে বেড়াতে গিয়েছিল মাসির বাড়িতে। আমি ততদিনে একটা চাকরি জোগাড় করে দিল্লির বাসিন্দা। ওখানে বেশ কয়েকদিন আড্ডা হয়েছিল মনে আছে। কনট্‌ প্লেসের টী ক্লাবের কফি পকোড়া। আর তারপর, একদিন তো মনেই পড়ছে, সন্ধের পরে আমরা আড্ডা দিয়েছিলাম যন্তর মন্তরের মধ্যে। কোনো একটা কিছুর মাথায় চড়ে, বেশ উঁচুতে বসে। দারোয়ান বা প্রহরী গোছের কেউ বারণই বা করেনি কেন। এসব কথা কিচ্ছু মনে পড়ছে না। মনে আছে শুধু আড্ডার কথাটা। এমন হতে পারে যে তখন নিরাপত্তার বাতিকটাই কম ছিল। আর ওই উঁচুতে বসে সিগারেট খাওয়া ছাড়া আর কোনো অসামাজিক কাজই আমরা করিনি।

    তারপর একটা সময়ে ছিল যাদবপুর এইট বি-র পিছনে মানবের বাড়ির আড্ডা। সেখানে আবার ওদের দু-জনের বিনি সুতোর টান ছিল দাবা। আমি ও ব্যাপারটায় খুব মজা পেতাম না। তবে বসে থেকেছি অনেকদিনই। কিছুক্ষণ বাদে অবশ্য চাল ফেরত নেওয়া নিয়ে ওরা একটা গোলমাল পাকিয়ে তুলত। এমনি করে দেখতে দেখতে যেন কেটে গেল কতগুলো বছর। সবেতেই লাগল ভাঁটার টান। একজন একজন করে চলে যাচ্ছে। যারা আছে এখনো তারাও মূলত আছে টেলিফোনে। তাও কমে আসছে ডাকাডাকি। বোধহয় ফুরিয়ে আসছে কথা। অনেকেই তাকিয়ে থাকছি বিকেলের দিকে। ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। পড়ন্ত বেলার হলুদ-কালো পাখি জানলার ধারে এসে যেন বলে যায়: এবার যাব। আজকের মতো।

    বেঁচে থাকার অনেকটা সময়, সবটা হয়তো নয়, সমীর যে-আদলে তার জীবনটাকে সাজিয়ে নিয়েছিল নিজের ভাষায় বলতে গেলে তা এইরকম: ".. তৎসত্ত্বেও সংসারের সমস্ত দায়িত্ব থেকে তিনি আমাকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি দিয়েছেন। আমাকে আলুর দাম জানতে হয় না, র‍্যাশন দোকানটা কোথায় আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই, ব্যাঙ্কে আমার সই মেলে না, পোস্টাপিসে এম. আই. এস. তোলার জন্যে লাইন দিতে হয় না; আমি সারাদিন নিজের কাজ বা অকাজ নিয়ে থাকি। খিদে পেলে খেতে পাই।" কথাগুলো সে লিখেছিল রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা এই নামের বইয়ের ভূমিকায়। স্ত্রী মায়ার নামে কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে। এই যে জীবনাদর্শ তা ঠিক কতটা আদর্শ জীবন তা নিয়ে বেঁচে থাকলে সমীরের সঙ্গে হয়তো তর্ক তোলা যেত। কিন্তু জীবনযাপনের এই ছকটা সে কোথায় খুঁজে পেয়েছিল তার বন্ধুদের কাছে সেকথা কিছু অজানা ছিল না। আমরা সবাই জানতাম সে এইভাবেই থাকতে চেয়েছিল। এইটাকেই সে তার স্বভাবধর্ম করে নিতে চেয়েছিল, এবং জীবনের শেষের বেশ অনেকগুলো বছর তা সে করতেও পেরেছিল। এতটা যে পেরেছিল তাতে মায়ার নেপথ্য ভূমিকা নিশ্চয়ই স্মরণযোগ্য। সেই সরল কথাটাই সে অকপটে স্মরণ করেছে এখানে। আমরা দু-জনের কাছেই কৃতজ্ঞ এই কারণে যে, মায়ার হাতে-তুলে-দেওয়া এই সোনার সুযোগ সমীর এক কণা অপব্যবহার করেনি। সে আক্ষরিক অর্থে প্রায় সারাদিন তার কম্‌পিউটারের সামনে বসে থাকত। অন্য বইপত্র নোট ইত্যাদি দেখে কাজ করার সুবিধার জন্য সে একটা গানের নোটেশন আটকে রাখার মতো স্ট্যাণ্ড জোগাড় করে নিয়েছিল। সারাদিন একটা চেয়ারে স্থির বসে থেকে সে এই কাজ দিনের পর দিন করে গেছে।

    সত্যিই ভাবলে বেশ অবাক লাগে যে ওই বয়সে এসেও সে তথ্য সংবলিত কাজে হাত দিতে পিছপাও হয়নি। শক্তপোক্ত শরীরেও যে-কাজে অনেককে ঘাবড়ে যেতে হয় সে-কাজে শরীরের কিছু বেয়াড়াপনা সত্ত্বেও সে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিল অকৃপণভাবে। সমীর সেনগুপ্ত ও প্রশান্তকুমার পালের মতো মানুষদের কথা ভাবতে গেলে পুলিনবিহারী সেনদের কথা কিরকম স্বতঃই আমার মনে এসে যায়। পরম্পরার একটা কথা ভাবতে ইচ্ছে করে। আমাদের এ সময়টা তেমন অনুকূল না হলেও এসব ধারা কেমনভাবে যেন একটু-আধটু প্রবাহিত হয়েই যায়। সমীর তো যথেষ্ট বেশি সময় হাতে পায়নি। যেটুকু পেয়েছে তার একটুও বাজে খরচ না করে সে যেসব বই তৈরি করে যেতে পেরেছে তার মধ্যে আছে রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা, গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথরবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন । রবীন্দ্রচর্চায় যাঁরা আগ্রহী হবেন তাঁরা এসব বইয়ের জন্য সমীরের কাছে ঋণী থাকবেন। এ ছাড়াও সমীর গত কয়েক বছরের মধ্যে আরো অনেক কিছু লিখেছে। লিখেছে ছোটোদের লেখা ও কিছু স্মৃতিকথাও। সমীরের অনেক কাজই অসমাপ্ত রয়ে গেল।

    রবীন্দ্রপ্রাসঙ্গিক বই তিনটি আভিধানিক ধাঁচে বিন্যস্ত। যদিও গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ-এর বিন্যাস বর্ণানুক্রমিক নয়। মোট ২৯৮টি গানের বিষয়ে খবর আছে এ বইতে। "গানগুলিকে সাজানো হয়েছে তাদের সুরের কালক্রম হিসেবে;" কথাবস্তুর কালক্রম বিচার করে নয়। তা হোক। সেই বিন্যাসে ছোটোখাটো কোনো গোলমাল কোথাও আছে কিনা তা আপাতত আমার বিচার্য নয়। থাকলেও তা মিলিয়ে মিলিয়ে সব জায়গায় খুঁজে বের করা আমার পক্ষে শক্ত কাজ। আমি সে চেষ্টাও করছি না। সে এসব বইয়ের প্রকৃত সমালোচক হয়তো কোনোদিন করবেন। আমি বইগুলিকে হাতে তুলে নিচ্ছি আমার মতো সাধারণ পাঠকের কাজে লাগবে বলে। কী কাজে লাগতে পারে সেই কথাটাই বলার চেষ্টা করব।

    গান যাকে বলে তার আলোচনা করতে গেলেই কথা আর সুর নিয়ে একটা ঝামেলার ব্যাপার উঠে পড়েই। আর রবীন্দ্রনাথের গানের বেলায় এ সমস্যা অনিবার্যভাবে উঠবেই এবং শেষমেশ সম্ভবত সমস্যার কোনো মীমাংসা নেই। যাঁদের এ গান ভালো লাগে তাঁদের লাগে, অনেকের ক্ষেত্রে খুবই ভালো লাগে। আবার এমনও অনেকে আছেন যাঁদের কাছে এ গান তত ভালো লাগে না। শুধু এই ভালো লাগা না-লাগার স্তরে আটকে থাকলে ব্যাপারটা নিয়েই হয়তো খুব কিছু বলার থাকে না। কিন্তু কথা আর সুর কে কাকে ছাপিয়ে কতদূর যাবে সে তর্ক অমীমাংসিতই থেকে গেছে। তা ছাড়া সুর ও বাণীর যথাযথ ভারসাম্য ঠিক কীভাবে সাধিত হতে পারে, এসব নিয়ে তাত্ত্বিক জটও পুরোপুরি কাটেনি। এদিকে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে শুনতে একটা কথা তো সাধারণ শ্রোতা হিসেবে অনেকের মনে আসতেই পারে। আমাদের বাংলা ভাষার গীত রচয়িতারা অনেকেই প্রচুর ভালো গান রচনা করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বেলায় তাঁর বলার কথাটাই এত অনাবিলভাবে গান হয়ে বেরিয়ে এসেছে যে তা একটা অন্য মাত্রা পেয়ে যায়। সর্বত্র না হলেও বহু জায়গাতে গানের মধ্যে কোনো বানানো চেহারার কথাটা মনেই আসে না। অবনীন্দ্রনাথ যে একবার বলেছিলেন রবিকার গানে আছে তাঁর জীবনী, সে বোধহয় এইরকম একটা কিছু ভেবেই হবে। সমীর কিন্তু তার গান সংক্রান্ত বইতে এর বাইরে আরো একটা কথা তুলতে চেয়েছে। বললাম বটে এর বাইরে, তবে সবটা হয়তো এর বাইরেও নয়। সমীর তুলতে চেয়েছে একটা কালচেতনার কথা। এই গানের শ্রোতার কালচেতনার কথা। ভারতীয় অভ্যাসে ও মনে সময়ের ধারণা নাকি তেমনভাবে কাজ করে না। সবকিছুকে সময়ে বিন্যস্ত হিসেবে দেখার ব্যাপারটা নাকি অনেকটাই পাশ্চাত্য রীতির ধরন। সমীর বলেনি স্পষ্ট করে, তবে পাশ্চাত্য রীতিসম্মত সময় ধারণা বলতে সে বোধহয় সময়ের একমুখিতার কথাই ভাবছে। সময়ের ধারণা সব কালে সব সংস্কৃতিতে অত সরলরৈখিক না হতেই পারে। তা না হলেও সে ধারণা কালচেতনাহীন নাও হতে পারে। অর্থাৎ কালচেতনারও রকমফের সম্ভব।

    সমীর যে সময়ের মাপে গানগুলিকে, অন্তত কিছু গানকে, পেতে চেয়েছে, সে বোধহয় এই গানগুলির রচয়িতার জীবনের তাগিদে। কবির জীবন ও তার জট জটিলতার সঙ্গে গানগুলিকে কিছুটা মিলিয়ে দেখা যায়। তাতে নিশ্চয়ই আমাদের একটা বাড়তি পাওনার সম্ভাবনা থাকে। বিভিন্ন গানের সঙ্গে লাগোয়া কিছু গল্প ছিল। তা অনেকের স্মৃতিকথায় ধরা আছে। সেসব গল্পের কিছু কিছু এক জায়গায় এখন আমাদের হাতে এল। গানগুলোকে শোনার সময়ে পিছনের কথা থেকে ছোটো এক ধরনের মজা আমাদের নিশ্চয় প্রাপ্য। কিন্তু সময়ের বিচারে যে ভাবনার ইঙ্গিত ভূমিকায় পাওয়া যাচ্ছে তার উপরে খুব বেশি জোর দিতে গেলে অন্য এক অসুবিধার বিপদ দেখা দিতে পারে। জন্মলগ্নে গানগুলো একটা কোনো নির্দিষ্টতায় হয়তো বাঁধা ছিল। 'হয়তো' বলছি এই জন্য যে ঘটনার ব্যাপারটা সত্য হলেও গানের বাঁধা পরার ব্যাপারটা পুরোপুরি সত্য নাও হতে পারে সবসময়ে। আর হয়ও যদি তাহলেও সে কিন্তু বড়োজোর ওই জন্মমুহূর্তের কথা। সার্থক গান বা অন্য কোনো রচনার বেলাতেও নাড়ি কেটে বেরোতে খুব সময় লাগে না। আর ওই নাড়ি কাটার ব্যাপারে রচনার এ পারে যিনি আছেন তাঁর ভূমিকা খুব বড়ো। গান যিনি শুনছেন তিনি তাঁর অভিজ্ঞতায় মিলে যাচ্ছেন ওই শোনার মধ্য দিয়ে। জন্মলগ্নের অনুশাসনকে বেশি প্রশ্রয় দিলে সেই মেলার পথে তা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কালাতীতকে আমরা বোধহয় একটু বেশি ভয় পাই। অত ভয় পেলে চলবে কেন। গান জাতীয় জিনিস একটুখানি তো অনন্তেরও বটে। ওই যে নির্দিষ্টতায় বাঁধা থেকেও অনন্তের দিকে একটু হাত বাড়ানো তার মজা আছে তো।

    রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা বইয়ের প্রকল্পটি আলাদা। নানা সময়ে বিদেশিরা রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে দেখছেন, নিচ্ছেন বা পাচ্ছেন, তার কথাটা বোঝার চেষ্টা থেকে এ বই। এই প্রকল্প খুব জরুরি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষার কবি ও লেখক। কাজেই আমরা তাঁকে মূল ভাষাতেই পাচ্ছি। অতএব আমাদের আর কি পাবার থাকতে পারে। এইরকম একটা চিন্তা অনেক সময়ে আমাদের পেয়ে বসে। এই ধরনের চিন্তা থেকে বাঙালি পাঠক রবীন্দ্রনাথের বিপুল পরিমাণ ইংরেজি রচনা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। না, অন্যদের করা রবীন্দ্ররচনার ইংরেজি অনুবাদের কথা বলছি না আমি। রবীন্দ্রনাথের নিজের ইংরেজি রচনার কথা বলছি। তার চরিত্র কখনো হয়তো অনুবাদ, কখনো হয়তো-বা অনুসৃষ্টি। তা সে যাই হোক। আমরা যে ওই রচনাগুলির দিকে খেয়াল করি না, তার জন্য একটা খুব বড়ো জিনিস আমাদের খেয়ালের বাইরে থেকে যায়। বাংলাভাষী পাঠক ছাড়া অন্যেরা কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে পাচ্ছেন ওইসব ইংরেজি রচনার মধ্য দিয়ে। সবটুকু হয়তো সরাসরি নিজের রচনার মধ্য দিয়ে নয়। অন্যের অনুবাদও হয়তো সেখানে বড়ো নির্ভর। আর এই অনুবাদ নির্ভরতা শুধু রবীন্দ্রনাথের বেলাতেই বা কেন, যে কোনো লেখকের বেলাতেই খুব খেয়াল করার মতো ব্যাপার। কে আর আমরা ক-জন লেখককে তাঁদের নিজেদের ভাষাতে পেয়ে থাকি। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে বিশেষ কথাটা এই যে, তাঁর নিজের হাতে লেখা ইংরেজি রচনার পরিমাণ কয়েক হাজার পৃষ্ঠা। রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষার ভাগ্যবান পাঠক হিসেবে আমরা যদি নিজেদের খুব বড়ো করে দেখে আলাদা করে রাখি, তাহলে কিন্তু আমরা নিজেদেরই খানিকটা ঘেরাটোপে আটকে ফেলব। আর আমাদের সে রবীন্দ্রমূর্তিও হবে নিতান্ত অসম্পূর্ণ।

    রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিদের ভাবনা এই জায়গায় জরুরি। সমীরের মাথায় এর কাছাকাছি কোনো কথা নিশ্চয় ছিল। আমাদের রবীন্দ্রভাবনার অন্য রকমের একটা আটকে যাবার কথা দিয়ে সমীর তার কথা শুরু করেছে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে কিছুটা যেন অলৌকিক ঘটনা। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, উনিশ শতকের বাঙালি নবজাগরণ, আমাদের নতুন সংস্কৃতির বিস্তার, বাঙালি জীবনে ঠাকুর পরিবারের ভূমিকা ইত্যাদির কথা দিয়ে শুরু হয়েছে সমীরের প্রস্তাবনা। এসবের এক মিলিত ফল রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে বড়ো সুদূর। তিনি দেবোপম। ঠিক। খানিকটা ঠিক। কথাটা খানিকটাই মাত্র ঠিক। প্রথমত, আমাদের সময়ে এ কথা যে অর্থে যতটা ঠিক, তার আগের একটা লম্বা সময় জুড়ে এ কথা যে অর্থে যতটা ঠিক, তার আগের একটা লম্বা সময় জুড়ে এ কথা সে অর্থে মোটেই ততটা ঠিক ছিল না। ইঁট পাটকেল কিছু কম জোটেনি ওঁর কপালে। কাজেই ওঁর সামনে আঙুল তুলে চোখ রাঙিয়ে কথা বলার লোকের খুব অভাব হয়নি। সেটা ছাড়াও এই এখন, আমাদের সময়কালে আর একটা ব্যাপার আছে। আজ তাঁর জন্মের পরে দেড়শো বছর পার করে এসে এক রকমের সম্ভ্রমের একটা রেওয়াজ মোটামুটি তৈরি হয়েছে ওঁর জন্য। তবে তার মানে মোটেই এই নয় যে রবীন্দ্ররচনার গ্রহণ আমাদের কাছে কোনো তাৎপর্যে পৌঁছোতে পেরেছে। কাজেই এখনো এক ধরনের আলগা উদাসীনতা তাঁর জন্য আমাদের মনে দিব্যি বরাদ্দ করা আছে। অর্থাৎ তাঁর নিজের ভাষার পাঠকের কাছেই তাঁর দূরত্ব এখনো ঘোচেনি।

    এই রকম অবস্থায় আমরা রবীন্দ্রনাথকে যে চোখে দেখি সেটা কখনোই একমাত্র দেখা হতে পারে না। আর আমরা বাংলা ভাষার পাঠক বলে আমাদের দেখার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব আমরা কিছুতেই দাবি করতে পারি না। যে-কোনো লেখকের বেলাতেই এ কথাটা আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। নিজের সংস্কৃতি এবং অন্য নানা সংস্কৃতি, এইসব ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের যে প্রতিকৃতি তাই নিয়েই একটু একটু করে গড়ে ওঠে সেই পূর্ণ প্রতিকৃতি তাই নিয়েই একটু একটু করে গড়ে ওঠে সেই পূর্ণ প্রতিকৃতির আদল। আমরা আমাদের লেখককে কী চোখে দেখি আর অন্যেরাই বা তাঁকে কী চোখে দেখে এই সবটুকুর জন্যই মন খোলা রাখতে হয় আমাদের। রবীন্দ্রনাথের মতো কোনো ব্যক্তির বেলায় কথাটা আরো জরুরি। তিনি তো বিশ্বের কোনো এক কোনায় কোনো এক নিভৃতে নিজেকে গুঁজে রাখেননি। কথাটা তাঁর ব্যাপ্ত ভ্রমণসূচির দিক থেকেই শুধু মানে করে লাভ নেই। নানা দেশ নানা তর্জমায় তাঁর রচনা একটা সময়ের পর থেকে পৌঁছে গেছে অবিরল। ফলে তাঁর ছিল রীতিমতো এক বিশ্ব পটভূমি। সেই পটভূমিতে তাঁকে পেতে গেলে বিদেশিদের কাছে আমাদের যেতেই হবে। আর সেই যাওয়ার মধ্যে উত্তমর্ণ-অধমর্ণের টানাপোড়েন যত কম থাকে ততই ভালো।

    এই প্রকল্পের কাজটা সমীর করতে চেয়েছে অনেক যত্নে ও পরিশ্রমে। ১১৫৫ পৃষ্ঠার এই বইটা যে সে শেষ করে যেতে পেরেছে তার জন্যই আমরা তার কাছে ঋণী থাকব। তার তথ্যের অবলম্বন প্রধানত বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিকথা ও রবীন্দ্রসান্নিধ্যের মানুষজনের চিঠিপত্র, ডায়েরি ও অন্যান্য রচনা। তথ্যের ব্যাপারে মৌলিক আবিষ্কারের কোনো দাবি নেই তার। প্রভাতকুমার, পুলিনবিহারী কিংবা প্রশান্তকুমারদের কথা এরকমের তথ্যভিত্তিক কাজের বেলায় আমাদের মনে পড়বেই। কিন্তু তাঁদের মতো তথ্যের প্রাথমিক উৎসে পৌঁছোবার অত সুযোগ জীবন সমীরকে দেয়নি। যতটুকু সুযোগ তার ছিল তার সবটুকুর সদ্‌ব্যবহার করতে সে নিজের শরীরের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছিল। এক চেয়ারে স্থির বসে থাকার এ নিষ্ঠা আমাদের সময়ে খানিকটা বিরল হয়ে এসেছে বই কি।

    সমীরের পদ্ধতিতে একটা সমস্যা ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। বইটাকে সে সাজিয়েছে ব্যক্তিনামের পদবির বর্ণানুক্রমে। অর্থাৎ তার নজর নিবদ্ধ হচ্ছে এক একজন ব্যক্তির উপরে। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ প্রতিফলিত হচ্ছেন। কারো মধ্যে বেশি, কারো মধ্যে কম। এই বইয়ের পাঠক পাবেন সেই টুকরো প্রতিফলন। সবগুলো মিলিয়ে মূর্তির আদল কতটা পাঠকের কাছে ধরা পড়বে সে ব্যাপারে আমার একটু সংশয় রইল। আর এতজন মানুষের প্রসঙ্গে এত কথা, কাজেই অনেক প্রসঙ্গে মাত্র কিছুটা দূর পর্যন্তই যাওয়া সম্ভব হয়েছে। আর বইটার চরিত্রও যেহেতু রেফারেন্স বইয়ের মতো তাই অনেকেই হয়তো এ বই আগাগোড়া টানা পড়বেন না। একটা কোনো পূর্ণাঙ্গ মূর্তি পাবার পক্ষে সেও আর এক অন্তরায়।

    সমীর নেই। এসব কথা এখন আর বলেই বা কী লাভ। সে বেঁচে থাকলে তার কাছে আর একটা একটু অন্যরকমের বইয়ের দাবি হয়তো জানানো যেত। এ বইটা তৈরি করতে গিয়ে তাকে যতটা পড়াশোনা করতে হয়েছে, যত প্রয়োজনীয় বইপত্র তাকে সংগ্রহ করতে হয়েছে তার ভিত্তিতে তার নিজের একটা অবস্থানে সে নিশ্চয় পৌঁছোতে পেরেছিল। সেই অবস্থানে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন হয়তো ছিল, অনেক দ্বিধা সংশয় হয়তো তার নিজের মনেই দেখা দিয়েছিল। এইসব কথা আমাদের জানতে দিয়ে সে নিজের আখ্যানের জন্য যদি একটা বই লিখত। বর্তমান বইয়ে অনেকের অনেক কথা এক জায়গায় জড়ো করে সে আমাদের প্রচুর উপকার করেছে। কিন্তু তার কথাটা সরাসরি আমাদের জানতে দিল না। বিভিন্ন প্রসঙ্গে তার মনটাকে আমরা হয়তো খানিকটা অনুমানে বুঝে নিতে পারি। কিন্তু সব মিলিয়ে তার মনে যে-ছবিটা আঁকা হয়েছিল সেটা পেতে আমাদের তো ইচ্ছে করে।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)