বেশ হঠাৎ করেই একটা সুযোগ এসে গেল জর্ডন যাবার।
গত নভেম্বরে আপিসের কাজে যেতে হয়েছিল দুবাই, দিন ৫/৬-এর জন্য। কিন্তু দু-দিন কাটতে না কাটতেই দুর্যোগ – দুবাই-এর সুলতানের ভাই মারা গেলেন, আর তার ফলে তিন দিন সব ছুটি। আমার সঙ্গী গণেশন বাড়ি ফিরতে রাজি নয় আর এখানে হোটেলে বসে বসেই বা কী করব? এমন সময় অপ্রত্যাশিত ভাবে হোটেলের ট্রাভেল ডেস্কের সুন্দরী মহিলা একটা দারুণ প্যাকেজ অফার করলেন – “জর্ডনে তিন রাত চার দিন” মাথাপিছু মোটে ৩৫০ ডলারে থাকা খাওয়া ঘোরা সব। প্লেন ভাড়াও বেশ সস্তা – দুবাই থেকে দুই ঘন্টার ফ্লাইট ভারতীয় টাকায় ৬০০০-এ যাতায়াত!
আর কী চাই? অতএব জয় মা কালী বলে বেরিয়ে পড়লাম দুই মক্কেলে।
জর্ডন সম্বন্ধে একটু জানিয়ে রাখি।
এশিয়া মহাদেশের এক্কেবারে পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এই ছোট্ট মরুদেশটির ইতিহাস খুব প্রাচীন। পৃথিবীর অন্যতম পুরাতন ব্যাবিলনীয় সভ্যতা্র (আজকের ইরাক-ইরান কে কেন্দ্র করে) বিস্তার হয়েছিল এই লোহিত সাগরের তীরবর্তী দেশ অবধি। এর পশ্চিম থেকেই শুরু মিশরীয় সভ্যতা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দেশের অবস্থান–-দক্ষিণে সৌদি আরব, দক্ষিণ-পশ্চিমে ইজিপ্ট, পশ্চিমে ইজরায়েল, উত্তরে সিরিয়া, পূর্বদিকে সৌদি আরব আর ইরাক।
জর্ডনে পৃথিবীর বেশ কয়েক লাখ পর্যটক প্রতি বছর পদার্পণ করে মূলত দুটি অভিনব দ্রষ্টব্য দেখতে; একটি হল মৃত সাগর (ডেড সী) আর একটি সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম – পেত্রা।
দিন ১
আমাদের প্লেন খুব ভোরে দুবাই থেকে উড়ে সকাল ৮ টার মধ্যে আমাদের নামিয়ে দিল রাজধানী আম্মানে। বিমানবন্দরে দ্রুত ভিসা পেয়ে গেলাম। কিছু লোকাল দিনার নিয়ে আর সিম কার্ড কিনে উঠে পড়লাম আমাদের জন্য নির্দিষ্ট গাড়িতে। আজকের গন্তব্য আম্মান, তারপর মাডাবা শহর হয়ে রাত্রে পেত্রা।
আম্মান হচ্ছে দেশের রাজধানী আর সবচেয়ে বড় শহর। যেকোনো মরু-শহরের মত বালুপাথরের বাড়িঘর, উঁচুনিচু রাস্তা, প্রচুর টিলা আর কিছু ছোট পাহাড় ছড়ানো। শহরের নতুন দিকটি বেশ সাজানো, কিছু ঝাঁ-চকচকে বাড়ি, হোটেল, ফুটবল স্টেডিয়াম, মল ইত্যাদি।
এইখানে জানিয়ে রাখি যে রোমান সাম্রাজ্যের যে বিস্তার পশ্চিম এশিয়া অবধি ঘটেছিল তার প্রভাবে জর্ডন প্রায় পাঁচশো বছর (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে) রোমান শাসনের অধীনে ছিল। এই সময় রোমানরা জেরসা নামে একটি নতুন শহর গড়ে তোলে আম্মান থেকে কিছুটা উত্তরে। ইতালীর বাইরে এই জেরসাতেই এখনও সবচেয়ে বেশি রোমান স্থাপত্যের নিদর্শন মেলে। আমাদের সময়ের অভাবে জেরসা যাওয়া হয়নি। কিন্তু দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে আমরা আম্মানেই কিছু রোমান স্থাপত্যের দর্শন পেলাম।
প্রথমেই দেখলাম দুই হাজার বছর পুরোনো এক বিশাল রোমান এম্ফিথিয়েটার যার নাম ফিলাদেলফিয়া। মুগ্ধ করে দেবার মত পাথরের তৈরি এই স্থাপত্য। ঘন্টাখানেক ঘুরে দেখে গাড়ি নিয়ে উঠলাম কাছেই এক পাহাড়ের উপর, যেখানে আছে খুব পুরোনো এক রোমান মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ (ওদের ভাষায় সিটাডেল)।
পাহাড়ের উপর থেকে অপূর্ব দেখা যায় পুরো আম্মান শহর। ওখানেই আছে একটি ছোট্ট কিন্তু চমৎকার জাদুঘর। প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে ওই জাদুঘরের দ্রষ্টব্য বস্তু সমূদয়ের মূল্য অপরিসীম। গত ছয় হাজার বছরের মানবসভ্যতার ইতিহাস ওখানে সাজিয়ে রাখা রয়েছে। ওই একটি ছোট্ট জাদুঘর দেখেই জর্ডনের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কাছে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
এরপর লাঞ্চ হল হাম্মাস, চিকেন স্যালাড আর বিশাল আকারের ময়দার রুটি দিয়ে। পরবর্তী গন্ত্যব্য মাডাবা, প্রায় ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে জর্ডন মুসলমান-প্রধান দেশ হলেও এখানে প্রায় ৫% খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী এবং তাদের বেশিরভাগের বাস এই মাডাবা অঞ্চলে।
পৃথিবীর সব খ্রীষ্টানদের কাছে জর্ডন একটি অতি পবিত্র স্থান। ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুসারে মুসা (মোজেস) তাঁর স্বজাতি হিব্রুদের মিশরের ফারাও-এর দাসত্ব থেকে মুক্ত করে লোহিত সাগর পার করে এই জর্ডন-এ এনে তাদের প্রতিজ্ঞাসূত জমি (প্রমিসড ল্যান্ড) দিয়েছিলেন। আর এই সেই মাডাবা যার মাউন্ট নেবোতে মুসার মৃত্যু হয়। আমরা নেবো পাহাড়ে গাড়ি করে উঠে দূর থেকে ওই প্রমিসড ল্যান্ড দেখলাম। সেই পাহাড়ের ওপর এক অপূর্ব চার্চ আছে যেখানে মুসার সমাধি দেখার পুণ্য অর্জন করতে হাজার হাজার খ্রীষ্টধর্মী সারা বছর এখানে আসে।
এই মাডাবার আরেক দ্রষ্টব্য এখানকার মোজেকের কাজ। সিরামিকের তৈরি অপূর্ব সব ঘর সাজানোর দ্রব্য এখান থেকে সারা বিশ্বে সরবরাহ হয়। হাতে বেশি সময় ছিল না তাই এক মোজেক কারখানায় ঝটিকা সফর সেরে আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম পেত্রার পথে।
ভয়ঙ্কর সুন্দর এই রাস্তা, একদিকে ডেড সী-র নীল জলরাশি আরেকদিকে বেলে পাথরের নানান আকৃতির পাহাড় – বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলাম “এই পথ যদি না শেষ হয়”।
সন্ধ্যা হবার মুখে পৌঁছোলাম পেত্রা, পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট্ট বুটিক হোটেলে রাত্রে থাকার ব্যবস্থা। জানলা দিয়ে আলোকোজ্জল নগরী দৃশ্যমান। সেই কোন সকাল থেকে দৌড়ে বেড়াচ্ছি , শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মন তরতাজা। তাড়াতাড়ি গরম জলে হাত পা ধুয়ে, ডিনার সেরে আবার দৌড়, এবার “পেত্রা বাই নাইট”। কিছুটা গাড়িতে গিয়ে এক প্রকাণ্ড ট্যুরিস্ট সেন্টারের সামনে নেমে পড়তে হল, এবার বাকিটা হাঁটা – প্রায় ৪ মাইল। টিকিট কেটে অন্যান্য যাত্রীদের অনুসরণ করে প্রায়ান্ধকার বালুকাময় রাস্তা দিয়ে দুরু দুরু বক্ষে হাঁটা শুরু। বেশ ঠান্ডাও পড়তে শুরু করেছে এর মধ্যে।
আগেই বলেছি পেত্রা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে একটি। এর কত ছবি দেখেছি, কত বর্ণনা পড়েছি আর আজ নিজের চোখে দেখব ভেবেই পরম রোমাঞ্চিত হয়ে আছি।
অনেকের মত আমারও ধারণা ছিল যে পেত্রা একটি মন্দির কমপ্লেক্স। কিন্তু এখানে এসে ভুল ভাঙল। এই গোটা শহরটিই উৎসর্গ করা মৃতদের জন্য আর বালুপাথরের পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা অপূর্ব সব মন্দিরের মতো স্থাপত্যগুলি হচ্ছে সমাধি। নেবাটিয়ান প্রজাতির রাজা, রানী, মন্ত্রী, সেনাপতি থেকে সাধারণ প্রজারও সমাধি। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে পরবর্তী চারশো বছর ধরে গড়ে উঠেছিল এই পেত্রা শহর যা মূলত ছিল সমস্ত আরব দুনিয়ায় মধ্যে স্থলপথে বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। তার মূল কারণ জর্ডনের ভৌগোলিক অবস্থান (যা আমি আগেই লিখেছি) – সুদূর রোম আর গ্রীস থেকে সওদাগরেরা তাদের পসরা নিয়ে আসত এই পেত্রায়, আর এখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়ত বাকি আরব দেশগুলিতে। এই সমস্ত সওদাগরদের থাকা-খাওয়া আর মনোরঞ্জনের বিবিধ বন্দোবস্ত ছিল এই শহরে।
এইসব নয়নাভিরাম পাহাড় খোদাই করা সমাধিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর আর বিখ্যাতটির নাম আল খাজানে (The Treasury) যেটা কিনা নেবাটিয়ান রাজা আরেটাস ৪-এর সমাধি। আজ এই প্রথম রাত্রে আমাদের গন্তব্য সেই আল খাজানে। এই সমাধিস্থলের নাম কেন আল খাজানে বা The Treasury সেই নিয়ে কিছু মতভেদ আছে। কিছু ঐতিহাসিকের মতে এই অসাধারণ স্থাপত্যটি মিশরের ফারাওরা তৈরি করেছিল তাদের কিছু ধনসম্পত্তি দেশের বাইরে লুকিয়ে রাখতে। তবে এই বিশ্বাসের পক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
এর সামনের প্রাঙ্গণে সপ্তায় ৪ দিন রাত ৯-টা থেকে দুটি আধ ঘন্টার শো হয় – কিছুটা সাউন্ড ও লাইট এর মতো। হাঁটারাস্তায় কোন আলো নেই – শুধু ২০ ফুট দূরে দূরে কাগজের ঠোঙার মধ্যে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা। প্রথম এক মাইল খোলা রাস্তা যার দুই ধারে বালির টিলা, তারপর শুরু আসল রাস্তা – বিশাল উঁচু অন্ধকার পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে দিয়ে সরু গলি চলে গেছে এঁকেবেঁকে। নেহাত আগে পরে আরও অনেক ভ্রমণকারী ছিল তাই আমরাও চললাম ওই প্রায়ান্ধকার পথ ধরে বেশ দুরুদুরু বক্ষে। প্রায় আধ ঘন্টার ওপর জোরে হাঁটার পর দুই পাহাড়ের প্রকাণ্ড ফাটলের (দ্য সিক) মধ্যে হঠাৎ এসে পড়লাম একটা খালি জায়গায় – চোখ তুলে চেয়ে দেখি দাঁড়িয়ে আছি আল খাজানের সামনে,
বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি জেগে, না স্বপ্ন দেখছি, সেই অপরূপ স্থাপত্য আমার হাতের নাগালে!! তখন বাজে ৮.৪৫, শো শুরু হতে কিছু সময় বাকি। আল খাজানের সামনের প্রসারিত চত্তরে প্রায় ১০০ মাদুর পেতে রাখা আমাদের বসার জন্য, আর সামনে জ্বলছে কয়েক-শো মোমবাতির কাগজ মোড়া প্রদীপ - কী অসাধারণ মোহময় করে তুলেছে পুরো জায়গাটাকে যে বলে বোঝানো যাবে না। ওপরে খোলা আকাশে চাঁদের আলোর তলায় বেশ কনকনে হাওয়ায় বসে থাকতে থাকতে এসে গেল গরম গরম চা, কাগজের কাপে। ঠিক ৯-টায় শুরু হোল শো, লাইভ বাঁশীর স্বর্গীয় ধুনে। বংশীবাদক ঘুরে ঘুরে আরব্য রজনীর সুর বাজিয়ে চলল আর তার সঙ্গে শুরু হল আল খাজানের উপর নানা রঙের আলোর খেলা। ১৫ মিনিট পর এক বুড়ো ঘোষক এসে তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে পেত্রার ইতিহাস ভূগোল নিয়ে আরো ১৫ মিনিট কিছু একটা বলার চেষ্টা করে গেল। এরপর ফেরার পালা আবার সেই অন্ধকার আঁকাবাঁকা পাথুরে গলিপথ দিয়ে। হোটেলে ফিরে কালক্ষেপ না করে সোজা ঘুমের দেশে।
কাল সকাল সকাল আবার পেত্রা দর্শন প্রায় সারাদিনের জন্য।
দিন ২
সকাল ৭টায় প্রাতঃরাশ সেরে মালপত্র গাড়িতে রেখে ৮-টার মধ্যে পৌঁছোলাম আবার সেই ট্যুরিস্ট সেন্টারের সামনে। এবারে টিকিটের সঙ্গে পাওয়া গেল ইংরেজি বলা গাইড যার বকাবকানি শুনতে শুনতে হাঁটা শুরু কালকের সেই পথ ধরে। রাতের অন্ধকারে কাল আশেপাশে যা কিছু দেখা যায়নি আজ ‘নয়ন মেলিয়া দেখিতে থাকিলাম’। সকালের সূর্যের নরম আলো পড়ে সামনের বেলে পাথরের পাহাড়ে রঙের বাহার।
আমাদের রাস্তার দু-ধারে নানা আকারের টিলার গায়ে গায়ে অজস্র সমাধির মেলা। এরপর এসে গেল সেই পাহাড়ি ফাটলের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। কোথাও কোথাও ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের আলো আসছে কিন্তু বেশিরভাগটাই ছাওয়া আর এই আলোআঁধারিতে দু-পাশের পাথরের দেওয়ালে নানা রঙের খেলা। এই নেবেটিয়ান প্রজাতি অত্যন্ত অগ্রসর ছিল মরুদেশে জল সরবরাহ আর সেচ ব্যবস্থায়। আমাদের চলার রাস্তার দু-পাশে এই দু-হাজার বছরের পুরোনো সেই জল সরবরাহ ব্যবস্থার নিদর্শন এখনও অটুট।
আল খাজানের সামনে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। দু-দুখানা চায়ের দোকানে বসার জায়গা নেই। আমরা ওই অপরূপ স্থাপত্যের একটু কাছে গিয়ে ছবিটবি তুলে তার পাশ দিয়ে এগিয়ে চললাম পেত্রার আরেক দিকে। মাইলের পর মাইল পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা সমাধিস্থলগুলি দেখে মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়!
শোনা যায় হাজার বছর আগে এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই গোটা শহর নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এরপর বাণিজ্যের কেন্দ্রটি আরও দক্ষিণে আকাবা নামে আরেকটি শহরে স্থানান্তরিত হয়। এরপর কয়েক-শো বছর পেত্রা লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। এর পুনরাবিষ্কার ঘটে ১৮১২ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ, তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটি চা সরবতের দোকানে জিরিয়ে নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। লোকালয়ে পৌঁছোতে ৩-টা বেজে গেল। সামনেই পড়ল একটি বড় হোটেল যার রেস্তোরাঁয় ভরপেট বাফে লাঞ্চ খেয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম।
এরপরের গন্তব্য ওয়াদি রাম যেখানে ধু-ধু মরুভূমির মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে থাকার ব্যবস্থা। আগে দুবাইতে মরুভূমির মধ্যে খাওয়াদাওয়া করেছি কিন্তু রাত্রে থাকা এই প্রথম। এখানে কয়েক মাইলের মধ্যে অনেক মরু রিসোর্ট – তার মধ্যে একটিতে আমাদের বুকিং। তাঁবু মানে কাপড়ের তৈরি ছোট ছোট শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘর (স্নানঘর সমেত)। রিসোর্টে ঢুকে প্রথমে আপিস ঘর, তারপর একটি বিশাল তাঁবু যেখানে খাওয়াদাওয়া আর বিনোদনের ব্যবস্থা আর তার পরেই লাইন দিয়ে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক থাকার তাঁবু।
আমাদের বলা হলো সন্ধ্যে ৭-টার মধ্যে বড় তাঁবুতে পৌঁছে যেতে কারণ ওই সময় এরা বালির তলায় পোঁতা নানাবিধ খাবার বার করবে। হাতমুখ ধুয়ে গরম জামা চড়িয়ে আমরা ৭-টার মধ্যে পৌছে গেলাম নির্দিষ্ট জায়গায়। সূর্য ডুবতেই কনকনে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। গোটা ছয়েক শেফ কাঠ জ্বালিয়ে একটা আগুনের বলয় তৈরি করল আর ১০ মিনিট বাদে আগুন নিভে গেলে শাবল ইত্যাদি দিয়ে বালির নীচ থেকে বার করল দুটি বিশাল জালা যার মধ্যে গরম বালির তাপে সারাদিন ধরে পাক হয়েছে ভাত আর মাংস। এরপর ওই বড় তাঁবুর মধ্যে সবাই খাওয়াদাওয়া শুরু করল।
বাফেতে অনেক পদ কিন্তু কোনটা কী কিছুই বোঝা গেল না। কিছু স্যালাড, রুটি আর ওই মাংসভাত দিয়ে ডিনার শেষ করলাম এরপর ওই রিসোর্ট-এর কর্মীরা শুরু করল আরবিক বাজনার তালে উদ্দাম নৃত্য। অনেক গেস্টও যোগ দিলেন তাতে। বলা বাহুল্য আমরা ছিলাম দুটি মাত্র ভারতীয় আর সারাদিনের ধকলের পর আমাদের পক্ষে আর ওই নাচে যোগদানের প্রশ্ন ছিল না। ৯টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম লেপ মুড়ি দিয়ে।
দিন ৩
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে অল্প আলো ফুটতে শুরু করেছে। যত গরম জামা ছিল সব পরে, মাথায় টুপি চাপিয়ে তাঁবুর বাইরে এসে দেখলাম মরুভূমির বুকে সূর্যোদয় - আমাদের চারিপাশে বালির সমুদ্রে রং বদলানোর খেলা। এই মরুভূমিতে একটু দূরে দূরে আছে বেলে পাথরের পাহাড় – নানা আকারের নানা সাইজের। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে হাওয়ার দাপটে এদের ক্ষয় হয়ে হয়ে অদ্ভুত সব আকৃতি ধারণ করেছে যা দেখলে অবাক হতে হয়।
বেলা ৯-টার মধ্যে প্রাতঃরাশ সেরে আমরা এবার গাড়ি নিয়ে চললাম দক্ষিণ দিকে, দু-ঘন্টার পথ পেরিয়ে যাব আকাবায়।
আকাবা জর্ডনের অন্যতম বড় শহর – প্রধান বন্দর আর বাণিজ্য কেন্দ্র। লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত এই শহরে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আছে।
ছবির মতো সাজানো শহর। চারিদিকে হোটেল, রেস্তোরাঁ আর দোকানপাটে ভর্তি। লোহিত সাগরের অংশ ওই আকাবা উপসাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখা যায় অপর পাড়ে ঈজিপ্ট আর ইজরায়েল। আমরা পৌঁছে একটা আধ ঘন্টার নৌ ভ্রমণে গেলাম উপসাগরের বুকে। নৌকার তলায় কাঁচ লাগানো যার মধ্যে দিয়ে দেখা যায় কোরালের সমারোহ।
দুপুরে লাঞ্চ খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেল বিকেল হাঁটতে বেরোনো হল। দোকানের মধ্যে বেশিরভাগই খাদ্যদ্রব্যের আর তার মধ্যে বাদাম, আখরোট ইত্যাদির প্রাচুর্য। কিছু গিফট ও স্যুভেনিরের দোকান যেখানে প্রধানত লোহিত সাগরের থেকে তোলা কোরালের গয়নাগাঁটি পাওয়া যায়। এখানে একটি দোকানে আলাপ হল এক বাংলাদেশী কর্মচারীর সঙ্গে, ৭ বছর ধরে এখানে আছে, ঝরঝরে আরবী ভাষা বলতে পারে। ও বলল যে বেশ শান্তিপূর্ণ দেশ এটি, আশেপাশের দেশে যুদ্ধ বাঁধলে পর্যটক আসা কিছুটা কমে কিন্তু দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কোন প্রভাব পড়ে না। ও দু-বছরে একবার দেশে যায়, মা বউ বাচ্চা সব দেশেই থাকে। ওর থেকে জেনে নিয়ে একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁয় ডিনার খেতে গেলাম, নিরামিষ থালি, বেশ ভালই লাগল। হেঁটে ফেরার পথে দেখলাম আকাবা উপসাগরের অপর পাড়ে ইজিপ্ট আর ইজরায়েলে আলোর রোশনাই।
দিন ৪
আজই আমাদের ফেরার দিন, বিমান ছাড়বে রাতে, আম্মান থেকে।
আমাদের আজ ডেড সী দেখার কথা। হোটেলে প্রাতঃরাশ সেরে ৯টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বাঁ হাতে ইজরায়েল-এর কাঁটাতারের বেড়া বরাবর আমরা ছুটলাম উত্তর দিকে। ঘন্টাখানেক বাদে এসে গেল সেই দুর্দান্ত রাস্তা যার একপাশে ডেড সী আরেক পাশে বিচিত্র সব পাহাড়। রাস্তায় দুটো জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি তুললাম যাতে এই অপরূপ জায়গা দেশের লোকেদের দেখাতে পারি।
১১.৩০ নাগাদ আমরা পৌঁছোলাম রামাদা হোটেলে যেখানে হবে লাঞ্চ, কিন্তু তার আগে ওদের ব্যক্তিগত তটে আমরা স্নান করব ডেড সী-তে। এই হোটেলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৫০ মিটার নীচে আর এর তটে যেতে আরো ১০০ মিটার নামতে হয়।
ডেড সী আসলে একটি হ্রদ যার দুইটি অভিনবত্ব, (এক) সমুদ্রপৃষ্ঠেরও নীচে এর অবস্থান (এসিয়ার সবচেয়ে নীচু জায়গা) আর (দুই) এর জলে এত নুন যে এতে কোন প্রাণী বাঁচতে পারে না (তাই এই নাম) আর এই অত্যধিক নুনের ফলে মানুষ এর জলে কখনও ডোবে না।
আমরা হোটেলের মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে ঘামতে ঘামতে পৌঁছালাম ডেড সীর তটে। ওখানে চেঞ্জ রুম, শাওয়ার রুম সব আছে। বালির থেকে কাদা বেশি আর এই কাদা নাকি ত্বকের জন্য দারুণ ভাল। তাই হাজার হাজার পর্যটক এখানে গায়ে কাদা লাগিয়ে ত্বকের পরিচর্যা করতে আসে। এই ভরদুপুরেও অনেক পুরুষ মহিলা সারা গায়ে কাদা মেখে রোদে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে ডেড সীর নুন জলে একটু ভেসে এসে আবার কাদা লাগায়। আমরা অল্প একটু কাদা পায়ের পাতায় লাগিয়ে জলে নামলাম, সত্যিই তো ভেসে আছি!! আমার সঙ্গী গণেশন সাঁতার না জানায় একটু ভয়ে ভয়ে ছিল, তারপর ভেসে থাকার ঠেলায় জল থেকে আর উঠতেই চায় না। কাদা ধুয়ে, কলের জলে স্নান করে তারপর লাঞ্চ সারলাম রামাদার প্রকাণ্ড ডাইনিং রুমে।
ডেড সীর তটে আরেকটু সময় কাটিয়ে বেলা ৫.৩০ টা নাগাদ রওনা দিলাম বিমানবন্দরের দিকে। আমাদের চালকবাবাজীর কথা তো বলাই হয়নি। ওর নাম ছিল মাহাদ – মধ্যবয়সি জর্ডনবাসী। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারে। অনেক দেশ-বিদেশের খবর রাখে, বিশেষ করে আরব দুনিয়ার। গত চার দিন ওর সঙ্গে কাটিয়ে বেশ মজা পেলাম। বিমানবন্দরে পৌঁছে যা অল্প কিছু স্থানীয় মুদ্রা ছিল সব দিয়ে দিলাম মাহাদকে। ওকে বিদায় জানিয়ে মাল ঠেলে এগিয়ে চললাম ভারাক্রান্ত মনে।
প্লেনের জানালা দিয়ে ফিস ফিস করে বলে উঠলাম “বাই বাই জর্ডন”।