—"যেটা কারেক্টলি বলতে পারো না সেটা বলতে যাও কেন?"
—"কেন রে? কি কারেক্টলি বলতে পারলাম না?"
—"কি আবার? কি বললে একটু আগেই? — 'প্রোনাউনসিয়েশন' — বললে না?"
— "হ্যাঁ — তো কি হোলো?"
—"কি হোলো মানে? কথাটা 'প্রোনাউনসিয়েশন' নয় — 'প্রোনানসিয়েশন' — ঠিক করে বলতে না পারলে বলবে না"
সেই পিকাইয়ের এমন গম্ভীর ভারিক্কি চালে বলা কথাগুলো শুনে থতমত খেয়ে গেলেন তার মা মন্দিরা। তারপর আস্তে করে বলে উঠলেন — "ও! আচ্ছা! ঠিক আছে!" বলে মুখ নীচু করলেন তিনি। একটা রূপোলী জলের রেখা অলক্ষ্যে নেমে এলো তাঁর গালের পাশ দিয়ে।
সুধীন্দ্রনাথ শুনেছিলেন কথাগুলো। কারণ তিনি ঠিক সেই সময়েই ঢুকতে যাচ্ছিলেন ওই ঘরটিতে। কিন্তু ঢুকলেন না। ওই কথাগুলো কানে আসতে। ফিরে এলেন নিজের ঘরে। মর্মাহত হয়ে। তাঁর মনে পড়লো এই মন্দিরাই পিকাইকে হাতে পেন্সিল ধরে শিখিয়েছিলো অ আ ক খ.....যোগ-বিয়োগ গুণ-ভাগ-নামতা.... মুখস্থ করিয়েছিলেন — 'তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে...' কারণ সেই সময়টায় সুধীন্দ্রনাথের ছেলে সুতীর্থ চাকরিসূত্রে বাইরে ছিলো — আর সুধীন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন অসুস্থতায় শয্যাশায়ী। পরে অবশ্য শ্রীজা বলে পাশের বাড়ির মেয়েটি পিকাইকে পড়াতে শুরু করে। খুব মেধাবী মেয়ে। একটি নামকরা মিশনারি স্কুলে পড়ায়। সেই ক্লাস টু থেকে এই সেভেন চলছে পিকাইয়ের শ্রীজারই গাইডেন্সে। সব কিছু পড়ানোর দায়িত্বে। আর পিকাইও ক্লাসে রীতিমতো ভালো রেজাল্ট করে। সুধীন্দ্রনাথের নয়নের মনি তার পিকাইভাই তার বন্ধুদের থেকে সব বিষয়েই অনেক এগিয়ে। ওই তালগাছের মতোই — সব গাছ ছাড়িয়ে — যার জন্য তাঁর গর্বের শেষ নেই।
কিন্তু পিকাইয়ের ওই কথাগুলো ঘরে ঢুকতে গিয়ে শুনতে পেয়েই যেন মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গিয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ। ও ঘরে না ঢুকে নিজের ঘরেই ফিরে এসেছিলেন তিনি। ইজিচেয়ারে বসে পাশের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে ভাবছিলেন পিকাইয়ের বিষয়ে এইসব কথাগুলো। তখনই ঠিক করে নিলেন এর পর কি করা উচিত তাঁর। খানিকবাদে সুধীন্দ্রনাথ তাঁর নাতিটিকে ডেকে বললেন — "রাতে খাওয়ায় পর একটা রাফ খাতা নিয়ে একবার এসো তো আমার কাছে।"
পিকাই শুনে একটু অবাক হোলো। কারণ তার দাদাই তো কোনো দিন খাতা নিয়ে আসতে বলে না। দাদাই তো শুধু গল্প বলে। বলতে বলতে কিছু লেখার থাকলে নিজের খাওয়াতেই লিখে দেখায়। তাহলে? যাইহোক রাতের খাওয়া শেষ করেই পিকাই একটা বাঁধানো খাতা নিয়ে হাজির হোলো তাঁর দাদাইয়ের ঘরে। ঠিক তখনই ওই ঘরের প্রকান্ড দেওয়ার ঘড়িটায় ঢঙ্ করে একটা শব্দ হোলো। অর্থাৎ সময় রাত সাড়ে নটা।
"এখন একটু গ্রামার পড়া হবে। অন্যভাবে। হয়তো খটমটে লাগতে পারে। বুঝতে না পারলে বলবে। প্রথমে ইংলিশে বানান করে লেখো তো 'প্রো-নাউন্স'"— কোনো ভূমিকা না করে সৌজন্য সামনে এসে বসার সাথে সাথেই কথাগুলো বললেন সুধীন্দ্রনাথ। সৌজন্য একটু থতমত খেয়ে গেলো। কারণ এই ভাবে তার দাদাই কখনো ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে খাতা পেন ধরিয়ে দেয় না। তাছাড়া তার মনে হোলো — এই বানানটা হঠাৎ তার দাদাই তাকে লিখতে বলছে কেন!
সৌজন্য বানানটি লিখে খাতাটি এগিয়ে দিলো সুধীন্দ্রনাথের দিকে। সুধীন্দ্রনাথ দেখে বললেন — "কারেক্ট। এবার বলো তো কথাটার মানে কি?”
সৌজন্য বললো — "উচ্চারণ করা"।
সুধীন্দ্রনাথ বলে উঠলেন — "ভেরি গুড। তার মানে 'ভার্ব' — তাইতো? তাহলে এর নাউন ফর্মটা কি বলতে পারবে?" প্রশ্ন শুনে সৌজন্য একটু ঘাবড়ে গেলো।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "তুমি কিন্তু কথাটা জানো — আমি জানি"। সৌজন্য অবাক হয়ে তাকালো তার দাদাইয়ের দিকে।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "আজ সন্ধেয় যে কথাটা বলছিলে তোমার মাকে — মনে পড়ছে?"
সৌজন্য যথেষ্ট বুদ্ধিমান তাই ধরতে পারলো কথাটা। তাই আস্তে করে বললো — "প্রোনানশিয়েশন"।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "একদম ঠিক। বানানটা লিখতে পারবে তো?" সৌজন্য খাতাটা নিয়ে বানানটা লিখে দেখালো।
সুধীন্দ্রনাথ খাতাটা দেখে বললেন — "ভেরি গুড"। বলেই খাতাটা টেনে লিখতে শুরু করলেন। তারপর খাতাটা দেখিয়ে বলতে লাগলেন — "এই দ্যাখো। খাতার মাঝখানে আমি লিখলাম — 'নাউন্স' — মানে 'বলা'। এর থেকে এলো 'অ্যা-নাউন্স' — মানে ঘোষণা করা, 'প্রো-নাউন্স' — মানে উচ্চারণ করা, 'ডি-নাউন্স' মানে আপত্তি বা প্রতিবাদ করা, 'রি-নাউন্স' — মানে অস্বীকার করা .... এগুলো সব ভার্ব। এর থেকে যখন নাউন ফর্ম হচ্ছে অ্যানাউন্সমেন্ট, ডিনাউন্সমেন্ট, রিনাউনস্সমেন্ট। কিন্তু প্রোনাউন্সমেন্ট নয় প্রোনানশিয়েশন! তাহলে সায়েবদের ভাষার ব্যাপারস্যাপার গুলো কেমন বোঝো"
এরপর সুধীন্দ্রনাথ সৌজন্যের চোখে চোখ রেখে খুব ধীরে ধীরে বললেন — "তাহলে আজ সন্ধেয় তুমি তোমার মাকে যা বলেছো তা সঠিক। কিন্তু সঠিক ভাবে জানা বা বলা মানেই কিন্তু সার্থক ভাবে জানা বা বলা নয়।" তারপর একটু থেমে বললেন — "বুঝতে পারলে না তো?"
পিকাই দুদিকে মাথা নেড়ে বললো — "নাহ্।"
সুধীন্দ্রনাথ এবার তাঁর শরীরটাকে ইজিচেয়ারে এলিয়ে দিয়ে এক চিমটে মৌরী মুখে ফেলে বললেন — "তাহলে একটা গল্প শোনো। ছোট্ট গল্প। মহাভারতের।" এরপর মৌরীটা একটু চিবিয়ে নিয়ে বললেন — “সেই সময় উদ্দালক নামে এক বিখ্যাত ঋষি ছিলেন। তাঁর মেয়ের নাম ছিলো সুজাতা আর ছেলের নাম ছিলো শ্বেতকেতু। শ্বেতকেতু সুজাতার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ছিলো। যাইহোক উদ্দালক একসময়ে আরেক মহাতেজা মুনির সঙ্গে সুজাতার বিয়ে দিলেন"। সৌজন্য বিজ্ঞের মতো বলে উঠলো — "মহাতেজি বলো"। সুধীন্দ্রনাথ তাঁর নাতির কথায় হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন — "বেশ বলেছো! কিন্তু জেনে রাখো কথাটা মহাতেজা। অর্থাৎ বিরাট তেজ, মানে ক্ষমতা আছে যার। আর তুমি যেটা বলছো সেখানে তেজি মানে রাগী কিংবা বদরাগী। এটা কিন্তু খারাপ অর্থে বলা হয়।"
যাইহোক বিয়ে হয়ে গেলো কহোড় নামের সেই মুনির সঙ্গে ঋষিকন্যা সুজাতার। কিছু কাল পরে মুনি কহোড় যখন বেদপাঠ করছিলেন তখন সুজাতার গর্ভ থেকে তার সন্তান বলে উঠলো — "কে এইভাবে ভুল উচ্চারণে বেদ পাঠ করছেন?" শুনে রাগে অপমানে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলেন মহামুনি কহোড়। বললেন — "কি স্পর্ধা! আমার সন্তান হয়ে আমার বেদপাঠের ভুল ধরছে! তাও মায়ের গর্ভে থেকেই!" তারপর বললেন — "এই পাপে তুই যখন জন্মাবি, তোর শরীরের আট জায়গা ব্যাঁকা থাকবে — লোকে তোকে বলবে — 'অষ্টাবক্র'।
পিকাই চোখ বড়োবড়ো করে জিজ্ঞেস করলো — "তাই হোলো? সত্যি সত্যিই?"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — “অবশ্যই। একে অত বড়ো মুনি, তাঁর উপর পিতা বলে কথা — সে কি আর ফেলনা হয়"।
পিকাই আবার জিজ্ঞেস করলো — "ওই রকম আট জায়গায় ব্যাঁকা হয়ে জন্মালো?”
"সুধীন্দ্রনাথ আবার একটিপ মৌরী মুখে নিয়ে বললেন — "নিশ্চয়ই। তাই তাঁর নাম হোলো অষ্টাবক্র মুনি"।
পিকাই শুনে থ হয়ে গেলো। বললো — "তারপর? তারপর?"
সুধীন্দ্রনাথ বেশ নিস্পৃহ হয়ে বললেন — "তারপর আর কি?" বলে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে হাতের আঙুল মটকাতে লাগলেন।
পিকাই যেন বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই জিজ্ঞেস করলো — "গল্পটা শেষ? এখানেই?"
সুধীন্দ্রনাথ আগের মতোই নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন — "সে অনেক কথা — পরে একদিন দিন বলবোখন, এখন অনেক রাত হয়ে গেছে শুতে যাও।"
সুধীন্দ্রনাথ জানতেন যে তিনি ইচ্ছে করেই থেমে গিয়েছিলেন গল্পের সেই জায়গায় যাতে তার ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া, উচ্চারণ নিয়ে মায়ের ভুল ধরিয়ে দেওয়া এই তেরো বছরের কিশোরটিকে একটু ভাবায়।
সুধীন্দ্রনাথের ধারণায় কোনো ভুল ছিলো না। সেই রাতে সৌজন্যের বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিলো আর মনে হচ্ছিলো —
ভুল ধরার জন্য শরীরের আট আটটা জায়গাটা ব্যাঁকা... — তাহলে কি তারও কপালে এরপর.. কিন্তু কি হোলো শেষটায়...
পরদিন রাতে খাওয়ায় পর সৌজন্য গুটিগুটি পায়ে এসে হাজির হোলো সুধীন্দ্রনাথের ঘরে। সুধীন্দ্রনাথ এমনটাই আন্দাজ করেছিলেন। বইয়ের থেকে মাথা তুলে তিনি বললেন — "কি হোলো কিছু বলবে?"
সৌজন্য বললো — "ওই গল্পটায় তারপর কি হোলো বলবে না?"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "ও হ্যাঁ। বলা হয় নি তো পুরোটা। তাহলে এক কাজ করা যাক। আজ তো বুধবার। এ কদিন তোমার স্কুলের টাস্ক থাকবে। আর আমারও হাতে প্রচুর কাজ জমে গেছে। শনিবার রাতে তোমায় বাকিটা বলবো।" বলেই আবার বইয়ের মধ্যে ডুবে গেলেন তিনি।
সৌজন্য ভালো ভাবেই জানে যে এরপর তার দাদাকে আর হ্যাঁ করানো যাবে না। আর এদিকে সুধীন্দ্রনাথ কিছুটা ইচ্ছে করেই বললেন শনিবারের কথাটা। কারণ তিনি চেয়েছিলেন অষ্টাবক্রের ব্যাপারটা যেন তার নাতির মনে একটু সময় নিয়ে ঘুরপাক খায়। এখানেও সুধীন্দ্রনাথের ধারণা নির্ভুল ছিলো।
শনিবার রাত নটা বাজতে না বাজতেই সৌজন্য সুধীন্দ্রনাথের ঘরে এসে হাজির। কারণ গত দুদিন ধরে তার চোখ বুঝলেই ভেসে আসছে একটা ব্যাঁকাচোরা দোমড়ানো মোচড়ানো চেহারা — সেই অভিশপ্ত অষ্টাবক্র মুনির! আর তখনই তার মনে হচ্ছে — তাহলে কি আমারও? তাই তার চোখে মুখে একটা তো ফারাক হয়েছেই যা সুধীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়ালো না।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "বোসো। বোসো। সামনের চেয়ারটায় ভালো করে বসো।" বলেই শুরু করলেন — অষ্টাবক্র জন্মানোর আগেই তার বাবা কহোড় মুনি অষ্টাবক্রের মা সুজাতাকে বললেন — "শোনো এবার আমায় বাইরে বেরোতে হবে। যাব জনকরাজার কাছে। ওখানে তর্কযুদ্ধে জিতে কিছু ধনদৌলত নিয়ে আসবো যাতে সন্তান পালনে কোনো অভাব না হয়।" কিন্তু কহোড় যেমন ভেবেছিলেন ব্যাপারটা আদৌ সেই রকম হোলো না। কারণ জনকরাজার সভায় ছিলেন বন্দি নামে এক বিরাট পণ্ডিত। যার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে জেতা অসম্ভব। অতএব কহোড়ও পরাজিত হলেন। এবং এই বন্দির নির্দেশে কহোড়কে জলের তলায় ডুবিয়ে দেওয়া হোলো।"
সৌজন্য চোখ বড়ো বড়ো করে বললো — "কি ভয়ঙ্কর!" সুধীন্দ্রনাথ এক চিমটে মৌরী মুখে ফেলে বললেন — "এটাই ছিলো ওনার নিয়ম। তর্কযুদ্ধে হেরে গেলে জলের তলায় ডুবিয়ে দেওয়া হবে। এই হিসেবে কহোড় মুনির আগে আরো অনেক মুনি-ঋষিকে তিনি জলের তলায় পাঠিয়েছেন এই ভাবে।" সৌজন্য আগের মতোই চোখ বড়ো বড়ো করে বললো — "কি নিষ্ঠুর!"
সুধীন্দ্রনাথ ইজিচেয়ারে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে বলতে থাকলেন — "এদিকে অষ্টাবক্রের তো জন্ম হোলো। অষ্টাবক্রের দাদু অর্থাৎ মহামুনি উদ্দালক তাঁর মেয়ে সুজাতাকে, মানে অষ্টাবক্রের মাকে বললেন — 'খবরদার! তোমার ছেলে যেন তার বাবার এই দুর্ঘটনার কথা ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে।' সেই জন্য অষ্টাবক্র জানতো তার দাদু উদ্দালক তার বাবা এবং মামা শ্বেতকেতু তার দাদা। এইভাবেই দিন যায়। কিন্তু বিপদ এলো একদিন। ততদিনে অষ্টাবক্র আরো বড়ো হয়ে গেছে। শ্বেতকেতু অষ্টাবক্রকে উদ্দালকের কোলে দেখতে পেয়েই বলে উঠলো — 'তুমি আমার বাবার কোলে বসেছো কেন? সরো এখান থেকে।' এইবার অষ্টাবক্র তার মা সুজাতার কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে বললো ব্যাপারটা। এই অবস্থায় সুজাতা বাধ্য হলেন অষ্টাবক্রকে তার বাবার ওই দুর্ঘটনার কথাটা বলতে।
সবকিছু শুনে অষ্টাবক্র বললো — 'মা আমি যাবো ওই জনকরাজার রাজসভায়। দেখবো কে আমায় হারাতে পারে তর্কযুদ্ধে।' অষ্টাবক্রকে কিছুতেই নিরস্ত করা গেলো না। অষ্টাবক্রের সঙ্গে চললো তার মামা শ্বেতকেতু। মামা হলেও শ্বেতকেতু অষ্টাবক্রের চেয়ে বয়সে খুব একটা বড়ো নয়। অর্থাৎ এই দুই অল্পবয়সী ছেলে রওনা দিলো জনকরাজার রাজসভার দিকে। তর্কযুদ্ধের জন্য।" — এই বলে সুধীন্দ্রনাথ একটু থামলেন।
সৌজন্য বললো — "বাব্বা! বিদ্যে নিয়ে যেন যুদ্ধ করতে চলেছে।" সুধীন্দ্রনাথ হেসে বললেন — ঠিক বলেছো। সে যুগে বলা হোতো ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রের মতোই ব্রাহ্মণের বিদ্যাবুদ্ধি তার হাতিয়ার। যাইহোক ওরা জনকরাজার প্রাসাদে তো গেলেন কিন্তু দ্বাররক্ষী তাদের ঢুকতেই দিলো না। বললো — 'তোমরা নিতান্তই ছেলেমানুষ। জনকরাজার সভায় কেবল জ্ঞানী লোকেরাই ঢুকতে পারেন।' এ কথা শুনে অষ্টাবক্র বললো — 'আমরা সমস্ত বেদ ভালোভাবে পড়েছি, তাই বয়স কম হলেও আমরা জ্ঞানী। অতএব ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিন। দেখি জনকরাজার সভায় কত বড়ো তার্কিক পণ্ডিত আছেন।' দ্বারপাল বললো — 'না না! তোমরা বড়ো ছেলেমানুষ। এ কাজ আমি করতেই পারি না।' অষ্টাবক্র বললো — 'আপনি কে জ্ঞানী সেটা বয়স দিয়ে বিচার করবেন? না তার বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে বিচার করবেন? কারণ ভেবে দেখুন অনেকেই থাকেন যাদের বয়সের ভার বাড়লেও বুদ্ধিতে তাঁরা হাল্কাই থেকে যান। কখনোই জ্ঞানী হন না। যেমন তুলো গাছের ফল পেকে গেলেও হাল্কাই থেকে যায়।' অষ্টাবক্রের কথায় দ্বারপাল মুগ্ধ হলেন। এবং ভিতরে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিলেন।
রাজসভায় এসেই অষ্টাবক্র বললেন যে তাঁরা সভার শ্রেষ্ঠ তার্কিক পণ্ডিতের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামতে চান। জনকরাজা বললেন — 'বেশ তো তার আগে আমার এই সামান্য ধাঁধার উত্তরটা দাও দেখি!'
সৌজন্য একথা শেষ হওয়া মাত্র বলে উঠলো — "ধাঁধা? কি ধাঁধা?"
সুধীন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বললেন — অনেকটা এই রকম : বলো তো কি যাতে বারোটা ভাগে তিরিশটা টুকরো আছে, আবার চব্বিশটা ভাগে তিনশো ষাটটা টুকরো আছে? অষ্টাবক্র সঙ্গে সঙ্গে বললো — 'অতি সহজ। একটা বছর। যা বারো মাসের ভাগে আর প্রতিটি মাস তিরিশ দিনের টুকরোয় ভাঙা। এটাই আবার তিনশো ষাট দিনে বারোটি পূর্ণিমা আর বারোটি অমাবস্যায় ভাঙা যায়।' রাজা রীতিমতো বিস্মিত হলেন। তারপর বললেন — 'বলো দেখি — কোন প্রাণী ঘুমোলেও চোখ বোঝে না? কে জন্মানোর পরেও স্পন্দিত হয় না? কোন বস্তু বেগে বৃদ্ধি পায়?' অষ্টাবক্র হেসে উত্তর দিলো — 'অতি সহজ। মাছ ঘুমোলেও চোখ বোঝে না। ডিম জন্মেও স্পন্দিত হয় না। আর নদী বেগের দ্বারা বৃদ্ধি পায়।' উত্তরগুলো শুনেই জনকরাজা বুঝলেন এ বালক হয়েও সত্যিই জ্ঞানী। তিনি বললেন — 'অসাধারণ তোমার বুদ্ধি! তুমি অবশ্যই সভায় আসতে পারো। কিন্তু মনে রেখো সেখানে আছেন সর্বশ্রেষ্ঠ তার্কিক পণ্ডিত বন্দি। তাকে কেউ কোনোদিন তর্কে পরাজিত করতে পারেনি। আর তিনি যখন কাউকে তর্কে পরাজিত করেন, তখনই তাকে জলে ডুবিয়ে দেন। অতএব — অষ্টাবক্র বললেন — 'রাজা আপনি ভয় পাবেন না। উনি কখনো সেরকম কোনো পণ্ডিতের সামনে আসেন নি বলে এমন মিথ্যে ধারণা হয়েছে। আমার সঙ্গে তর্ক বিদ্যায় ওনার সব দর্প চূর্ণ হবে দেখুন।' যাইহোক এইবার তো সভায় অষ্টাবক্র আর বন্দি মুখোমুখি হলেন। শুরু হোলো এক প্রবল তর্কযুদ্ধ।
সৌজন্য বলে উঠলো — "বাব্বা! এ যেন কুস্তি"।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন একেবারে ঠিক বলেছো। কিন্তু কুস্তির শেষে জিতলো সেই দশ বছর বয়সী অষ্টাবক্র।
সৌজন্য বললো — "না না ওরকম ভাবে বললে হবে না। কিভাবে অষ্টাবক্র সেই তর্কযুদ্ধে জিতলো সব বলতে হবে"।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "এই রে! সেটা তোমায় বলা তো বেশ কঠিন হবে। কারণ এর অনেক কিছুই তো তোমার জানার কথা নয়"।
সৌজন্য নাছোড়বান্দার মতো বলে উঠলো — "না না বলতে হবে! সব বলতে হবে!"
সুধীন্দ্রনাথ এবার তার আদরের পিকাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন — "ঠিক আছে। আমি আমার মতো করে বলছি যতটা পারি।"
বলেই হাতের আঙুল গুলো মটকাতে মটকাতে বললেন — বন্দি বললেন — 'আমি যা বলবো দেখি তুমি ঠিক তার পরেরটা মিলিয়ে বলতে পারো কিনা। যেমন ধরো — সূর্য যদি এক হয় দুই বলতে কি বোঝো?' অষ্টাবক্র সঙ্গে সঙ্গে বললো — 'জগতে সূর্য একটি আর রথের চাকা দুটি।' বন্দি বললেন — 'তিন বলতে বোঝায় তিন ভুবন — স্বর্গ, মর্ত্য আর পাতাল। অষ্টাবক্র হেসে বললো — পণ্ডিত আপনি তিনে যদি বলেন ভুবন, চারে তাহলে দিক/ উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম, আমার কথা ঠিক।'
শুনে সৌজন্য হাততালি দিয়ে বললো — 'দারুণ দারুণ।'
সুধীন্দ্রনাথ হেসে বললেন — 'তুমি তো দারুণ বলে হাততালি দিচ্ছো। এদিকে আমার পক্ষে তো এই ভাবে বলা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কারণ এ যে বেশ লম্বা তর্ক যুদ্ধ।'
সৌজন্য তার দাদুর হাত দুটো ধরে দোলাতে দোলাতে বললো — "না না তাও বলো বলো"।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "কি বিপদ। আচ্ছা দেখি চেষ্টা করে।" বলে আবার বলতে শুরু করলেন । বন্দি বললেন — 'আমাদের শরীরে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়।'
সঙ্গে সৌজন্য বলে উঠলো — "জ্ঞানেন্দ্রিয় মানে?"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "সেন্স অর্গান। কান, নাক, চোখ, জিভ আর ত্বক মানে গায়ের চামড়া।"
সৌজন্য বললো — "হ্যাঁ হ্যাঁ। জানি। জানি। পড়েছি।"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "এবার অষ্টাবক্র উত্তর দিলেন — 'পাঁচে ইন্দ্রিয় ছয়ে ঋতু / উত্তর দিলাম এই হেতু।' সৌজন্য আবার হাততালি দিয়ে উঠলো।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "বন্দি তখন একটু রেগে গিয়েই বললেন — 'সাত বলতে বোঝায় সাত ঋষি অর্থাৎ সপ্তর্ষি। তাহলে আট বলতে কি বোঝো?' অষ্টাবক্র হেসে বললো — 'সপ্তর্ষি যদি হয় অষ্টবসু কেন নয়?' বুঝলে না তো পিকাইভাই। না বোঝাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু জেনে রাখো এই ভাবে চললো আরো কিছুক্ষন। শেষ পর্যন্ত। তেরো নম্বরে এসে বন্দি নিজেই আটকে গেলেন নিজের কথায়। যেটা সম্পূর্ণ করলেন অষ্টাবক্র। অর্থাৎ তর্ক যুদ্ধে বন্দি পরাজিত হলেন। তখন জনকরাজা বললেন — 'অষ্টাবক্র। তুমি বালক হয়েও সত্যিই জ্ঞানী। তাই বন্দিকে তুমি পরাজিত করতে পেরেছো। এখন সে তোমার অধীন। তুমি বন্দিকে এখন যেমন ভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারো।’ অষ্টাবক্র তার উত্তরে বললেন — 'এই বন্দিকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং আমার ইচ্ছা ও যেভাবে সবাইকে তর্ক যুদ্ধে হারিয়ে জলে ডুবিয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনি ওকেও এক্ষুনি জলে ডুবিয়ে দেওয়া হোক। এটাই ওর উপযুক্ত শাস্তি।'
সৌজন্য হাততালি দিয়ে বললো — "ঠিক ঠিক। অষ্টাবক্র রিভেঞ্জ নিলো দারুণ ভাবে।"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "না পিকাইভাই। তুমি যেভাবে ভাবছো ঠিক সেই ভাবে রিভেঞ্জ কিন্তু হয় নি।"
সৌজন্য অবাক হয়ে বললো — "সে কি? কেন? বন্দিকে তাহলে জলে ডুবিয়ে দেওয়া গেলো না?"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "শোনো তাহলে। বন্দি বললো — 'জ্ঞানী অষ্টাবক্র। আপনার আদেশের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আপনার কথায় আমায় জলে ডুবিয়ে দিলে আমার মঙ্গল হবে। আমার পিতা স্বয়ং বরুণদেব। তিনি জলের দেবতা। তাই জলের নীচে গেলে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। বরং আপনার কথাতেই আমি জলের নীচে গিয়ে আমার পিতার কাছে পৌঁছাতে পারবো। তিনি আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন। আর হ্যাঁ। এর আগে যাদের আমি তর্ক যুদ্ধে পরাজিত করেছি, তাদের সবাইকে জলের নীচে পাঠিয়েছি বটে, কিন্তু কাউকে হত্যা করিনি। ওনাদের সবাইকেই পাঠিয়েছি আমার পিতা বরুণদেবের কাছে। তাঁর বিশেষ যজ্ঞের কাজে। ওনাদের সবাই এবার ফিরে আসবেন। আর জ্ঞানী অষ্টাবক্র, আপনার পিতা কহোড় মুনির সঙ্গে এবার আপনার দেখা হবে। ঠিক যেমন আমিও আমার পিতা বরুণদেবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।'
এই পর্যন্ত। বলে সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "তাহলে কি বুঝলে পিকাইভাই?"
পিকাই অর্থাৎ সৌজন্য বললো — "তাহলে তো এতে বন্দির ভালোই হোলো।"
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "ঠিক বলেছো। তোমায় এর আগেও বলেছিলাম এই পুরাণ মহাভারতের গল্পে কখন মাঝেমাঝেই খারাপের মধ্যে ভালো লুকিয়ে থাকে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা কি হোলো বুঝলে না?"
"আসল ব্যাপার?" — জিজ্ঞেস করলো সৌজন্য।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "জ্ঞানের জন্য অষ্টাবক্রকে অভিশপ্ত হতে হয়েছিলো তার জন্মের আগেই। আর সেই জ্ঞান সার্থক হোলো যখন সে তার ওই অভিশাপ দেওয়া বাবাকে ওই জ্ঞান আর বিদ্যা দিয়েই উদ্ধার করলো বন্দির হাত থেকে। তাই কি না বলো?"
সৌজন্য কোনো কথা না বলে চুপটি করে রইলো।
সুধীন্দ্রনাথ আবার বললেন — "তাহলে বুঝতে পারছো তোমার বিদ্যা কখন সার্থক হয়?"
সৌজন্য একটু চুপ করে থেকে বললো — "এখানেই শেষ?" কারণ তার চোখে ভাসছিলো অষ্টাবক্রের তালগোল পাকানো কল্পিত শরীরটা।
সুধীন্দ্রনাথ তাঁর নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন — "নাহ্। একটা সামান্য ঘটনা আছে এরপরেও। কহোড় মুনি জল থেকে উঠে এসে বললেন অষ্টাবক্রকে — 'যাও এইবার ওই সামনের নদীতে গিয়ে একটা ডুব দিয়ে এসো।' অষ্টাবক্র বাবার কথামতো তাই করতে গেলো। আর নদী থেকে উঠেই দেখলো একটা ম্যাজিক!"
"কি ম্যাজিক? "— চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করলো সৌজন্য।
সুধীন্দ্রনাথ বললেন — "অষ্টাবক্রের শরীর একেবারে সুস্থ সাধারণ হয়ে গেছে। শরীরের কোথাও কোনো খুঁত নেই।"
সৌজন্য চোখ গোল গোল করে বলে উঠলো — "তাহলে এরপর অষ্টাবক্রের চেহারা একেবারে পারফেক্ট?'
সুধীন্দ্রনাথ হেসে বললেন — "একদম! তাই তো ওই নদীর নাম হয়ে গেলো সমঙ্গা। কারণ অষ্টাবক্রের দেহের অসমান অঙ্গগুলো ওই নদীর জলের স্পর্শে সব সমান হয়ে গেলো। বুঝলে?"
সুধীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করলেন যে সৌজন্যের মুখে এ কদিন ধরে যে কালো ছায়াটা ছিলো সেটা যেন সরে গিয়ে আগের ঝলমলে ভাবটা ফিরে এলো তখনই।
সৌজন্য সেই ঝলমলে মুখে একগাল হাসি নিয়ে বললো — "যাক তাহলে এবার অষ্টাবক্রের জীবনটা সার্থক হোলো।"
সুধীন্দ্রনাথ এবার সৌজন্যের দিকে তাকিয়ে বললো — "আর আমার গল্প বলাটা?"
সৌজন্য কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়িয়ে নিঃশব্দে হ্যাঁ জানালো। সুধীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করলেন সৌজন্যের চোখের কোলদুটো জলের আভাসে যেন চিকচিক করছে। সুধীন্দ্রনাথ বুঝলেন এইবার তাঁর এই গল্পবলাটা তার নাতির ওই টলমলে চোখের জলে সার্থক হয়ে ভাসছে।