দূরের চাঁদটা তখন অপূর্ণ হয়ে লেগেছিলো বিস্তীর্ণ আকাশের গায়ে—বিজনের চোখের সামনে।
কারণ বিজন—সদ্যসতেরোর বিজন –
—কিছুতেই তাকিয়ে থাকতে পারছিলো না চোখের সামনে এক এক করে আলো নিভে যাওয়া দোকানগুলোর দিকে...
কিংবা একটু আগের লোক-ঝলমলে এই মেলার উপর নিশ্চুপে ছড়িয়ে পড়া অন্ধকারের দিকে... এমনকি দুচোখ বন্ধ করে মনের গহনে ভাসতে থাকা সেই বালিকাটির মুখশ্রীটির দিকে...
তাই সে আনমনে তার মুখটা একটু তুলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিলো সামনের ঘরবাড়িগুলোর পিছনের আকাশটার দিকে।
তখনই সে দেখতে পেয়েছিলো ওই দূরের চাঁদটাকে--ওইভাবে--ঘননীল আকাশের গায়ে।
উত্তর কলকাতার এই জায়গাটায় বাড়িগুলো যেন একটার গায়ে একটা ঠাসাঠাসি করে লেগে আছে। সেগুলোর গা ঘেঁষে ঘেঁষে অদ্ভুত ভাবে এঁকেবেঁকে চলে গেছে কতরকম নামের এক একটা গলি। কোনো কোনো গলি আবার হঠাৎ করে থমকে আটকে গেছে কোনো নোনাধরা বাড়ির পিছনদিকের ভাঙাচোরা পাঁচিলে।
বিজনের মামার বাড়ি এইরকমই একটা বহু পুরোনো লালচে রঙ-ওঠা বারান্দাওয়ালা তিনতলা বাড়ি। একচিলতে গলির একেবারে শেষ প্রান্তে। গলিটা এমনিতে খুব চুপচাপ ঝিমিয়ে পড়া। কেবল রাস্তার ওপারের স্কুলটার ছুটির সময় ছাড়া। ছুটির পর ছেলেদের পাল এই গলিটা দিয়েই উলটো দিকের রাস্তায় মোড়ে শর্টকাট করে চলে যায়। তখনই যেন একটু জেগে ওঠে এই নিঝুম পাড়াটা।
বিজন ওই স্কুলেই পড়ে। ফেরার সময় কখনোসখনো বন্ধুদের সঙ্গে একটু আধটু খেলতে গিয়ে দেরিও হয়ে যায় তার। সেই সময় মামা যদি কোর্ট থেকে আগে ফিরে আসে তাহলেই কেলেঙ্কারি। অন্য সময়ে তো বাড়িতে শুধু মামিমা। আর মামিমা ভীষণ ভালো মানুষ। বিজনকে খুবই আগলে রাখেন।
ওই গলিতেই বিজনের স্কুলের বন্ধু সুমন্তদের বাড়ি বিজনের ওই মামার বাড়ির দুটো বাড়ি পরে। বিজন যে ঘরে থাকে অর্থাৎ দোতলায় উঠে বাঁদিকের শেষ ঘরটা থেকে সুমন্তদের বাড়ির দক্ষিণের ঘরটা দেখা যায় সামনের কদমগাছটার ঝাঁকড়া পাতাগুলোর ফাঁকে। ওই ঘরেই বিজন মাঝে মাঝে দেখতে পায় তাকে।
ফর্সা মুখ। কোঁকড়া চুল। কখনো ধবধবে সাদা স্কুল ইউনিফর্মে। কখনো গাঢ় হলুদ ফ্রকে। কখনো ভোরের হাল্কা সাদা আলোয় সে কয়েক মুহূর্তের জন্য জানালার লাগোয়া বারান্দায় আসে। কখনো বিকেলের পড়ন্ত আলোয় গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জানালার সামনে। শেষ বিকেলের আলো যখন তেরছা ভাবে এসে পড়ে তার মুখের উপর--বিজনের চোখে ঠিক যেন প্রতিমার মুখের মতো দেখায় সেই মুখটা। সে সুমন্তর আপন ছোটো বোন।
সুমন্ত ক্লাসের ফার্স্টবয়। বিজন শুনেছিলো ওর বোনও নাকি পড়াশোনায় খুব ভালো। দু-একবার আসতে যেতে চোখাচোখি হয়েছিলো। কিন্তু কোনো কথা বলবার সুযোগ বা সাহস হয়নি বিজনের। আর এই ব্যাপারটাই ঘটে গেল হঠাৎ করে। যেদিন সুমন্ত তার জন্মদিনে বাড়িতে আসতে বললো বিজনকে। "একটু বোসো। দাদা আসছে।"— দরজা খুলে সুমন্তর বোনই বলেছিলো কথাগুলো। সহজেই। কিন্তু কী আশ্চর্য সুন্দর ভাবে। বিজনের তখন তাই মনে হয়েছিলো। সেটা ছিলো রথের দিন।
এটাসেটা কথার মাঝে তাই রথের কথাটাও উঠেছিলো। সেইখান থেকেই কথায় কথায় রথের মেলার কথাও এলো। "দক্ষিণের রাসবিহারীতে বিরাট রথের মেলা বসে ... কতো রকমের জিনিস আসে... কতো দোকান বসে.."— চোখ বড়ো বড়ো করে বলেছিলো সুমন্তর বোন। বিজন মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলো তার চোখমুখের ঝলমলে রূপ। সুমন্ত বলেছিলো--"এমনভাবে বলছিস যেন তুই কতো গেছিস।" মেয়েটি তখন একমুখ লজ্জার হাসি ছড়িয়ে মাথা নীচু করেছিলো। তারপর তার কোঁকড়া চুলে ভরা মাথাটা তুলে বলেছিলো—"বাবা বলেছিলো নিয়ে যাবে। কিন্তু হবে না।" বিজন খুব আস্তে করে জিজ্ঞেস করেছিলো—"কেন? হবে না কেন?" সে চোখ বড়ো বড়ো বলেছিলো—"সামনেই আমার নাচের প্রোগ্রাম যে। রোজ সন্ধেয় রিহার্সাল।" "আমি যেতে পারি। গেলে কি আনবো তোমার জন্যে?"— কথাটা বলতে গিয়েও গলায় কেমন আটকে গিয়েছিলো তার।
সেদিন রাতে বিজনের ঘুম ভেঙেছে বারবার। বিজন একাই শোয়। অনেককাল আগে এ ঘরে বিজনের দাদামশাই থাকতেন। তাঁর ব্যবহৃত অনেক কিছুই রয়ে গেছে এই ঘরে। যেমন অজস্র বইয়ে ঠাসা কাঠের আলমারিটা। ওর মধ্যেই বিজন দেখেছিলো "রুবাইয়াত ই ওমর খৈয়াম - কান্তি ঘোষ অনূদিত"। যার পাতায় পাতায় আঁকা সুন্দরীদের রঙিন ছবিগুলো সুমন্তর বোনের মুখের আদলের সঙ্গে মিশে বারবার এলোমেলো ভাবে ভেসে আসছিলো সেই রাতে বিজনের চোখের সামনে। ভোররাতে বিজন তার ঘরের জানলা দিয়ে আবছা আলো আসার সাথে সাথেই স্থির করলো রাসবিহারী রথের মেলায় তাকে যেতেই হবে।
এ কথা বিজনের পক্ষে তার মামাকে বলা অসম্ভব। অতএব একমাত্র মামিমাই ভরসা। তাই পরদিন রাতেই কথাটা পাড়ল মামিমার কাছে। নানা ভাবে ইনিয়েবিনিয়ে বিজন আসল কথায় এলো। সব শুনেটুনে তিনি বলেছিলেন—"দাঁড়া! তোর মামা কি বলেন দেখি।" "না না মামাকে তোমায় রাজী করতেই হবে"—নাছোড়বান্দার মতো বলেছিলো বিজন। দুদিন বাদে বিজনের অতিষ্ঠ করা তাগাদায় বিজনের মামিমা কথাটা বলেছিলেন তার স্বামীকে। এবং শেষ পর্যন্ত রাজিও করিয়েছিলেন শুধুমাত্র ওই বাপ-মা মরা ছেলেটার মুখটাকে মনে রেখে।
"জানোই তো ছেলেটা কেবল শরীরেই বেড়েছে কিন্তু মনটা ওর সেই সাত বছরের বাচ্চার মতোই আছে।"—বলেছিলেন বিজনের মামিমা।
"আর বুদ্ধিটাও বাড়ে নি সেটাও মনে রেখো"—গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়েছিলেন বিজনের মামা। তারপর বলেছিলেন—"ঠিক আছে আগামী বুধবার যেতে পারে। ওইদিন কোর্ট থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরবো।"
এরপর একটু থেমে বলেছিলেন—"মনে রেখো--এটাই শুরু আর এটাই শেষ কিন্তু। নয়তো এভাবে চললে ছেলে লায়েক হয়ে যাবে।"
"বুধবার! বুধবার!! বুধবার!!!.."— দিনটা যেন বিজনের কাছে আসতেই চাইছিলো না তার মামিমার মুখ থেকে শনিবার রাতে কথাটা শোনার পর। এরপরের তিনটি দিন তার কাছে তিন বছরের মতো দীর্ঘমেয়াদী বলে মনে হচ্ছিলো। এর মাঝে অন্যমনস্কতার জন্য সোমবার ফার্স্ট পিরিয়ডেই প্রচণ্ড বকুনি খেল সে অঙ্কস্যারের কাছে। মঙ্গলবার বাংলা ব্যাকরণ খাতায় একগাদা ভুলের জন্যে জুটলো বাংলাস্যার রক্ষিতবাবুর কাছে চরম অপমান। কিন্তু বুধবার আসতেই বিজনের এই সব অপমানের জ্বালা ভুলে সমানে মনে হতে লাগলো কখন সন্ধে ছটা আসবে। কারণ তখনই ফিরে আসবে তার মামা। আর এলেই—
বাইরের ঘড়িটায় ঢঙ্ ঢঙ্ করে ছটা বাজলো। বিজনের মামা তখন এলেন না। এরপর একই ভাবে যখন সাতটা বাজলো তখনো তিনি এলেন না। আরো কিছুক্ষন কেটে গেলো। রাগে দুঃখে যখন বিজনের মাথা তীব্র যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছিলো ঠিক সেই সময়েই বিজনের মামা বাড়ি ঢুকলেন।
"আজ না হয় থাক ... কোর্টে আজ এতো দেরি হয়ে গেলো... আমাদের হাতিবাগানের মোড়েও নাকি..." কথাগুলো মাথায় বাজ ফেলে দিলো বিজনের।
"না না - তা কী করে হয় - কখন থেকে ছেলেটা বসে আছে তোমার অপেক্ষায়.. কী এমন আর রাত হয়েছে ...ওর বন্ধুরাও তো যাবে... একসাথেই ফিরবে..." বলেছিলেন বিজনের মামিমা।
"ঠিক আছে ... ঠিক আছে... সাবধানে যেও... এই টাকাটা রাখো... কত নম্বর বাসে উঠবে জানো তো?... এখান থেকে সরাসরি যদি যেতে চাও.."— কথাগুলো যেন উড়ে যাচ্ছিলো বিজনের মাথার উপর দিয়ে।
এরপর ঘড়ির কাঁটাকে পিছনে ফেলে প্রাণপণে দৌড়তে চেষ্টা করলো বিজন--একদৌড়ে মোড়ের মাথায় পৌঁছে হাঁফাতে লাগলো - আর যে বাসটাই এসে দাঁড়াচ্ছিলো তার কন্ডাকটরকে জিজ্ঞেস করেছিলো—"এটা রাসবিহারী যাবে? রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে?" যদিও সে জেনেই এসেছিলো কোন নাম্বারের বাস সেখান থেকে সরাসরি যাচ্ছে রাসবিহারীতে। এইভাবে আরো মিনিট পনেরো অপেক্ষা করার পর সেই নির্দিষ্ট বাসটি এলো। বাসটিতে উঠেই অনভ্যস্ত বিজন তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে যাচ্ছিলো লেডিস সিটের দিকে। এক বয়স্ক ভদ্রলোক সেটা দেখে বিজনকে বললেন —"এদিকে এসো খোকা - আমি পরের স্টপেজে নামবো।"
বাসটা প্রথমে হুহু করে চলতে শুরু করলেও শ্যামবাজারের মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে গেলো তো গেলোই। বিজন উদ্বিগ্ন মুখে পাশে বসা ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করলো —"রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে কখন পৌঁছোবে বলুন তো?" খুব নির্বিকার মুখে তিনি উত্তর দিলেন—"এভাবে চললে রাত নটার আগে নয়।" এইভাবে ট্রাফিকের গোলকধাঁধার ভিতর দিয়ে ঠোক্কর খেতে খেতে বাসটা যখন রাসবিহারী মোড়ে এসে দাঁড়ালো তখন সাড়ে নটা বেজে গেছে।
কিছুই না-চেনা-না-জানা বিজন কোনোক্রমে ঢুকে পড়লো মেলার ভিড়ে। অবাক হয়ে দেখতে থাকলো একটার পর একটা মেলার দোকান ...কাঁচের জিনিসের দোকান ....চীনেমাটির জিনিসের দোকান ....মাটির পুতুলের দোকান... মেয়েদের কতো রকমের হার-চুড়ি, ....সাজের জিনিসের দোকান—এরকম আরো কতো কী যা বিজন কখনো চোখেই দেখে নি কোনো দিন।
"তা হলে কী কিনবো? কী কেনা যায় ওর জন্যে এখান থেকে?"—এই ভাবনার মাঝেই বিজনকে হতভম্ব করে দিয়ে তখনই একটার পর একটা দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো—একটা একটা করে নিভে যেতে লাগলো দোকানের আলোগুলো। অর্থাৎ মেলাটা তখন ভাঙতে শুরু করেছে।
ঢোকার সময়ের আলো ঝলমলে মেলাটা বিজনের চোখের সামনেই কত তাড়াতাড়ি একটা অদ্ভুত আলোছায়ায় ঢেকে গেলো ..
বিজন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো সেই আলোছায়া মাখা বাড়িগুলোর দিকে...
তখনই তার চোখে পড়লো বাড়িগুলোর পিছনে ঘননীল আকাশে আটকে থাকা চাঁদের ফালিটায়...
কীসের জন্যে সে এখানে এসেছিলো ....কী কী কিনবে বলে এসেছিলো ....সব যেন মুহূর্তের জন্য উধাও হয়ে গেলো তার মাথা থেকে...
একটা রাগ দুঃখ অভিমান কিংবা অপদার্থবোধ ....সব যেন মিলে মিশে হুহু করে বয়ে যাচ্ছিলো তার মাথার উপর দিয়ে ...চোখের সামনে ভেসে যাওয়া একরাশ মেঘের মতো ....আকাশে লেগে থাকা ওই অপূর্ণ চাঁদটার গায়ে গায়ে...
এরপর অসংখ্যবার ওইভাবে ওই বাড়িগুলোর পিছনের গাঢ় নীল আকাশটায় হুহু করে মেঘ ভেসে গেছে অমন চাঁদের উপর দিয়ে ...
সে দৃশ্যকে কেই বা দেখতে যায় ...কেই বা মনে রাখে ...
কিন্তু ঘটনাক্রমে... হ্যাঁ ...বলা যেতে পারে একটি অতি আশ্চর্য ঘটনাক্রমে...
বিজন ...
উত্তরচল্লিশের ব্যস্ত আইনজীবী বিজন কুমার দে...
তাঁর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের চেম্বার থেকে যাচ্ছিলেন তাঁর এক উকিল বন্ধুর বাড়িতে।
কালিঘাটের পর থেকেই রাস্তায় অস্বাভাবিক জ্যাম - তাঁর ড্রাইভার বললো—"আপনাকে শর্টকাট করে নিয়ে যাচ্ছি স্যার"— বলেই যে রাস্তায় ঢুকলো তা বিজনের আদৌ পরিচিত নয়। কিন্তু গাড়ি চলছিলো হু হু করে। হঠাৎ সে গাড়ি থেমে গেলো সামনের ট্রাফিকের জটলায়। আর থামলো তো থামলোই। নড়ার আর কোনো লক্ষণ নেই। বিজন অধৈর্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে সামনের দিকে একটু হাঁটতে শুরু করলো —
ধর্মদাস রোড—রাস্তায় লোক থিকথিক করছে—বেশিরভাগ লোকের হাতেই কিছু না কিছু জিনিষ—কাগজ বা প্লাস্টিকের মোড়কে বাঁধা—বিজন দেখতে পেলেন আর বুঝতে পারলেন যে সেটা রথের মেলার ভিড়।
রথের মেলা! ব্যাপারটা জানতে পেরেই কী মনে করে বিজন তার গাড়ির ড্রাইভারকে গিয়ে বললেন—"জায়গা বুঝে গাড়িটা কোথাও পার্ক করো তো—আমি খানিক বাদে আসছি"—বলেই সামনের ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন তিনি—ভিড় ঠেলে এগোতে লাগলেন সামনের দোকানগুলোর দিকে—
ঝলমলে করছে সব দোকানগুলো—দেখার মতো সুন্দর সুন্দর জিনিস আছে বেশ কিছু দোকানে—যেমন খুব ভালো কাঠের কাজের জিনিস —দারুণ সুন্দর সুন্দর সেরামিকের ফ্লাওয়ার ভাস—ডোকরার জিনিস —কৃষ্ণনগরের মাটির মূর্তি—যেন চোখ ফেরানো যায় না—বিজন খুব মন দিয়ে দেখছিলেন প্রতিটি জিনিস। তারপর ভাবলেন—'শুধু দেখে কী হবে? কিনেই ফেলি।'
প্রথমেই একটা গাঢ় নীল রঙের ফ্লাওয়ার ভাস--খুব সরু আর রেয়ার শেপের--যেকোনো ভালো শো-পিসের দোকানের জিনিসের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে ...
তারপর একটা কাঠের খুব সূক্ষ্ম কারুকার্য করা পেনস্ট্যান্ড...
এরপর একটা ডোকরার দুর্গা.....
সবশেষে ছাইরঙা একটা ছোট কিন্তু নিখুঁত সুন্দর বুদ্ধমূর্তি...
কিনতে কিনতে দুহাত ভরে গেলো বিজনের--এবার রীতিমত কষ্ট হচ্ছিলো তাঁর এগুলো ওভাবে বইতে —
কিন্তু তা-সত্ত্বেও বিজনের বেশ ভালোই লাগছিলো জিনিসগুলো কেনার পর।
মনে হচ্ছিলো শ্রীলার অর্থাৎ তাঁর স্ত্রীর নীল রঙটা ভীষণ পছন্দের—তাই ওই ফ্লাওয়ার ভাসটা...
শ্রীজা, মানে তাঁর মেয়ে খুব সৌখীন তাই ওই পেনস্ট্যান্ডটা তার পড়ার টেবিলে..
বিতান মানে তাঁর ছেলে বিট্টুর ক্র্যাফটের কাজ খুব পছন্দ তাই ওর ঘরে এই ডোকরার দুর্গাটা...
ভাবতে ভাবতেই বিজন হঠাৎ লক্ষ্য করলেন —
একটা একটা করে নিভতে শুরু করেছে দোকানের আলোগুলো--ঝপঝপ করে পড়তে লাগলো দোকানের ঝাঁপগুলো--বিজনের চোখের সামনেই আলো ঝলমলে মেলাটা দ্রুত ঢেকে গেলো আধো অন্ধকারে--
ব্যাপারটায় কেমন যেন থতমত খেয়ে গেলেন তিনি--হাত ঘড়িতে দেখলেন দশটা পাঁচ--
সামনের লোকজন সব তাড়াহুড়ো করে চলে যাচ্ছে ....
একটা অদ্ভুত অন্ধকার নিশ্চুপে ঢেকে দিচ্ছে সমস্ত জায়গাটাকে....
চোখ চলে গেলো ওই নেমে আসা অন্ধকারের পিছনের বাড়িগুলোর দিকে....
যে বাড়িগুলোর পিছনে ঘননীল আকাশ...
আর কী আশ্চর্য ভাবে সেই আকাশে লেগে রয়েছে এক ফালি চাঁদ...
ঠিক তখনই বিজনের মনে হোলো তার দুহাতের এই প্যাকেটভর্তি জিনিসগুলো কি আদৌ খুলে দেখবে তার স্ত্রী পুত্র কন্যারা? তারা তো নিউমার্কেটের জিনিস ছাড়া —
বিজন ফ্যালফ্যাল করে দাঁড়িয়ে রইলো তার দু-হাত ভর্তি জিনিস নিয়ে ...
সামনের আকাশে হুহু করে ভেসে যাওয়া মেঘগুলো সরে গিয়ে একফালি চাঁদ যেন স্থির হয়ে দাঁড়ালো বিজনের চোখের সামনে....
ঠিক তিনদশক আগের সেই অপূর্ণ চাঁদটার মতো--হুবহু।