• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৯ | জুলাই ২০২০ | গল্প
    Share
  • পিক-রব : রঞ্জন রায়


    আমার হয়েছে এক জ্বালা। পিকরব, মানে কোকিলের ডাক। রবি ঠাকুর তো লিখেই খালাস—‘দূর শাখে পিক ডাকে, বিরামবিহীন’। কিন্তু এই কোকিলের ডাক আর কাউকে নয়, শুধু আমাকেই তাড়া করে বেড়ায়, বারোমাস—একেবারে 'বিরামবিহীন’। আপনারা ভাবছেন সল্ট লেকে আজকাল অনেক আমগাছ, প্রায় সারা বছরই কোকিলের ডাক শোনা যায়, এ নিয়ে এত আদিখ্যেতার কী আছে? মানছি, আমাদের সিএ ব্লকের দোতলার ছাদের কার্নিশের গা ঘেঁষে একটি আমের ডাল ঝুঁকে রয়েছে। তাতে কাকের বাসা এবং কোকিলের ডিম সবই থাকে এবং সেই কোকিল কাককে বোকা বানিয়ে মাঝে মধ্যেই মনের আনন্দে সুর ভাঁজে। প্রায়ই তার সরগম মুদারার ‘পঞ্চম’ ছাড়িয়ে তারার ‘গান্ধার’ ছুঁয়ে যায়, তাতে কী?

    আরে ওসব কিছু না। ব্যাপারটা, আচ্ছা কী করে বোঝাই বলুন দিকি? আসলে আমার কোকিলের ডাক নিয়ে প্রবলেম সেই ছোটোবেলায়, বিশদে বললে ক্লাস ফাইভের হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষার দিন থেকে। হ্যাঁ, আমরা বড়ো হয়েছি মফঃস্বলের একটি ছোটো শহরে, উত্তরবঙ্গের রাজাভাতখাওয়াতে। আমরা মানে আমি আর ও, আমি মনীষা দত্ত—রাজাভাতখাওয়ার রেলস্টেশনের মালবাবু হিমাংশু দত্তের ডাকাবুকো মেয়ে। আর ও হল সমরেন্দ্র, ওখানকার সরকারি স্কুলের বাংলার টিচার হরনাথ বিশ্বাসের একমাত্র ছেলে। আমরা দু’বোন; এক ভাই। ভাই ছোটো, একটু রোগা প্যাংলা। কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই ও জানে—ভয়ের কিছু নেই। কিছু ঝামেলা হলে ওর ছোড়দি আছে। হ্যাঁ, আমার জিভ খুব চলত, মনীষা নাম হয়ে গেল মনসা; যে কথায় কথায় ফোঁস করে ওঠে।

    একটু স্বাস্থ্য ভাল ছিল, তাই হিংসুটেদের মুখ থেকে শুনতে হত ‘ধুমসি’ বা ‘মুটকি’। আমি ঘুরে তাকালেই ছেলের দল অন্যদিকে তাকাত। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে চারজনের একটা দল থেকে কেউ বলল—কোন র‍্যাশনের চাল খায় রে?

    —তোর বাবা যে দোকানের মুটে! রেশন দোকানের নম্বর তোর বাপের থেকে জেনে নিস।

    এভাবেই একদিন পরিচয় হল আমাদের নতুন বাংলা-স্যার হরনাথবাবুর ছেলে সমরের সঙ্গে। ভিড় থেকে কেউ বলল--ওই তো ‘মাল’ যাচ্ছে। ওকেই জিজ্ঞেস কর।

    --এই মাল! শোন্‌, একটা কথা আছে।

    আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। মালবাবুর মেয়েকে মাল বলে ডাকা? ওসব ঝামেলা একবছর আগেই আচ্ছা করে ঝাড় দিয়ে চুকিয়ে দিয়েছি। আবার শুরু হল!

    তেড়ে যেতেই সবগুলো ছেলে হাওয়া, শুধু একটা, মানে একজন দাঁড়িয়ে আছে আর ড্যাব ড্যাব করে আমাকে দেখছে। ঠাটিয়ে একটা চড়, ছেলেটা প্রায় ছিটকে পড়ে আর কি! অবাক হয়ে আমাকে দেখছে আর গালে হাত বোলাচ্ছে।

    —মারলা ক্যান?

    এ বাবা! ছেলেটার রিফিউজি টান এখনও যায়নি? মাল বললে মারব না? এ আবার কী আহ্লাদ!

    --অরা যে কইল তুমার নাম মালবিকা, মালবাবুর মাইয়া—তাই ঘরেতে আহ্লাদ কইর‍্যা মাল কয়?

    --ওরা মিথ্যে কথা বলেছে, আমার নাম মনীষা--তোমাকে পেয়েছে হদ্দ বোকা। আর বাংলার স্যারের ছেলের মুখে ভাষার কী ছিরি! শুদ্ধ করে বলতে পারো না?

    এভাবেই আমরা ধীরে ধীরে বন্ধু হয়ে উঠি। প্রথম প্রথম স্কুলের ছেলেমেয়েরা অবাক হত, অমন মুখরা মেয়ের আবার ছেলেবন্ধু! ক্লাস ফাইভ থেকে? তাও রোগা-প্যাংলা সমরেন্দ্র? যে বাংলা ও ইংরেজিতে তুখোড়, ক্লাস সিক্সে ও ‘উড়িল কলম্বকুল অম্বরপ্রদেশে’র কবির নাম বলে স্যারদেরও তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। ও বাড়িতে বাবার থেকে নিয়ে মেঘনাদবধকাব্য পড়ে ফেলেছে। আমি তখন স্কুল আর পাড়ার লাইব্রেরি থেকে আনছি প্রহেলিকা সিরিজ, টারজান ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড আর সুধীন্দ্রনাথ রাহার অনুবাদে ব্ল্যাক অ্যারো, কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টো, থ্রি মাস্কেটিয়ার্স এইসব। সমরের পাকামি আমার পছন্দ ছিল না। বাংলা-স্যারের ছেলে কিছু কঠিন শব্দের মানে জানবে এতে আশ্চর্যের কী আছে? তা বলে ‘কলম্বকুল’ মানে একঝাঁক তীর! ইন্দ্রলুপ্ত মানে টাক! আর ‘ক্রন্দসী’ মানে আকাশ? আমি তো ভাবতাম ‘ছিঁচকাদুনে মেয়ে’!

    তবে লসাগু গসাগুর অংক কষতে ওর মুখের চেহারা বাটিভরা দুধসাগু হয়ে যেত। আর ভগ্নাংশ, আবৃত্ত দশমিক? এ নিয়ে কিছু না বলাই ভাল। সেখানে উদ্ধারকর্তা বলতে এই মানসী। আমাদের মধ্যে চুক্তি হল যে বাংলা ও অংক—এ দুটো পরীক্ষার দিন প্রথম ঘণ্টার পরে আমরা হল থেকে বেরিয়ে ছাদের বাথরুমে যাব। সেখানে একজন আর একজনের থেকে হেল্প নেব।

    ওর পদবি বিশ্বাস--অর্থাৎ বি, আমার দত্ত—মানে ডি, তাই আমাদের পরীক্ষার সীট পড়ত একই হলে দুটো রো বাদ দিয়ে। ফলে একজন বেরোলে দু’মিনিট পরে অন্যজনের আঙুল তুলে ‘পেয়েছে’ সাইন দিয়ে বেরোতে কোন অসুবিধে হত না।

    এভাবে একবার ‘পিকরব’ মানে জিজ্ঞেস করতেই ও তাচ্ছিল্যের সুর তুলে বলল—এই সব এলিমেন্টারি শব্দের মানে জানস না? কোকিলের ডাক।

    --সেকী? কোকিলের ডাক তো ‘কুহু’; হেমন্তের গানটা মনে কর “ওপারে নীরব কেন কুহু হায়”।

    ও বিরক্তবাবু মুখ করে বলল—যদি আমার উপর তর বিশ্বাস থাকে তাইলে পিকরব মানে ‘কোকিলের ডাক’ লেখ; নইলে তুই যা ভাল বুঝস!

    বিশ্বাস ছিল; আজও আছে। রবিঠাকুর বলে গেছেন ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’। আর ও নিজেই তো মূর্তিমান বিশ্বাস—সমরেন্দ্র বিশ্বাস।

    তাই ও যখন পাঁচ নম্বর বাসের চিঁড়েচ্যাপটা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাকে ঠেট বাঙ্গাল ভাষায় প্রপোজ করল— আমারে বিয়া করবা কিনা কও--—আমি বললাম এখনই বলতে হবে? এই অবস্থায়?

    ওর বাঙালের গোঁ, বলল আর দশ মিনিটের মধ্যে যাদবপুর এইট বি বাসস্ট্যান্ড, মানে ওর স্টপ এসে যাবে। ও আমার মুখ থেকে স্পষ্ট হ্যাঁ বা না শুনে তবে বাড়ি যাবে। আমি বললাম—তুমি মাত্র চাকরিতে ঢুকেছ, মাসে হাজার তিনেক হাতে আসে। তারপর তোমার মা আছেন। আমার মাইনেও মেরেকেটে সাড়ে চার। এতে ঘর চলবে? ভেবে দেখো।

    ওর সেই এক কথা। আমার ওপর বিশ্বাস আছে কি নেই?

    পরের লাইনটা আমার জানা। উপর থেকে রবিঠাকুর দেখছেন, বিশ্বাস হারালে পাপ দেবেন!

    ওহো! অংকের কয়েকটা স্টেপ জাম্প করে সোজা উত্তর মিলিয়ে দিচ্ছি। আমি অঙ্কের ভালো ছাত্রী; জানি মাঝের স্টেপ বাদ দিয়ে প্রবলেম আর অ্যান্সার লিখলে ফুলমার্কস পাব না। তাই মাঝের স্টেপগুলো কষে দিচ্ছি। বারো বছরের হিসেব।

    আমরা দুজনেই ভালভাবে হায়র সেকন্ডারি পাশ করেছিলাম--আমি সায়েন্স, ও আর্টস। আমার মালবাবু বাবা তখন থেকেই সমরেন্দ্রকে অপছন্দ করছিলেন। আর্টস আবার একটা সাবজেক্ট? গাধা ছেলেরা, যাদের আর কোথাও ঠাঁই জোটেনি তারা আর্টস পড়ে। দোষের মধ্যে স্কুলের ম্যাগাজিনে সমরের গোটা দুয়েক কবিতা ছাপা হয়েছিল। বাবার কাছে ওগুলো বখামির চূড়ান্ত লক্ষণ। তখন থেকে আমাকে বলে দিলেন—আর্টসের ছেলের সঙ্গে মেলামেশা যেন বন্ধ করে দিই।

    আমি যত বলি যে সমরের অ্যাডিশনাল বিষয় অংক এবং (আমার সৌজন্যে) সেটা মন্দ শেখেনি বাবা বিশ্বাস করলেন না। ইতিমধ্যে ওর বাবা আমাদের বিশ্বাস-স্যার মারা গেছেন। সমর মাকে নিয়ে যাদবপুরে বাপুজিনগর উদ্‌বাস্তু কলোনি বা ওরকম কোনো জায়গায় একটা টিনের চাল, ছাঁচের বেড়ার ঘরে উঠল আর কোনো একটা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কম্পিউটার স্কুল থেকে ‘নেট-ওয়ার্কিং’ নাকি ‘স্যাপ’ শিখে কাজের চেষ্টা করতে লাগল।

    এদিকে বাবা ট্রান্সফার হয়ে কলকাতার কাছে গড়িয়া স্টেশনের স্টেশনমাস্টার হয়েছেন, বাড়ি নিয়েছেন গায়ে লাগা কলোনিতে। আমি গড়িয়া কলেজ থেকে কেমিস্ট্রিতে অনার্স আর যাদবপুর থেকে মাস্টার্স করে একটা কোল টেস্টিং ল্যাবে চাকরি পেয়েছি, কয়েকমাস হল।

    গড়িয়া কলেজ থেকে বাপুজি কলোনি পাঁচ নম্বর বাসে কুড়ি মিনিট। ফলে আমার আর সমরের মধ্যে যোগাযোগ বেড়ে গেল। বাবা খবর পেয়ে আমাকে বকলেন আর সমরকে এমন কড়কে দিলেন যে ও প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে শিটিয়ে গেল। এমন অপদার্থ ভিজে ন্যাতার মত ছেলের উপর কোন মেয়ে ভরসা করতে পারে? আপনারাই বলুন।

    কিন্তু নিষিদ্ধ ফলের প্রতি লোভ হল মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। তাই মানুষ ভিড়ের বাসে ফুটবোর্ডে ঝোলে, গাঁয়ের দিকে বাসের ছাদে ওঠে, বন্ধ লেভেল ক্রসিং দেখেও তাড়াহুড়ো করে রেললাইন পেরোতে যায় এবং ক্যান্সার বা টিবি হবে জেনেও সিগ্রেট খায়।

    আমাদেরও সেই অবস্থা। যখন যাদবপুরে মাস্টার্স করছি তখন ব্যাপারটা আরও সহজ হয়ে গেল। কিন্তু বাবার গোয়েন্দাগিরি বন্ধ হয়নি। সেবার দুজনে মিলে পদ্মশ্রী হলে সিনেমা দেখতে গেছি। আমি পরেছি একটা খুনখারাপি রঙের লাল টপ আর সাদা জিন্স। এই টপ গত পুজোয় বাবা কিনে দিয়েছিল।

    টিকিট কিনে ঢোকার মুখে মনে হল পানের দোকানের ঝুলন্ত পাটের দড়ি থেকে সিগ্রেট ধরাতে ধরাতে চশমার ফাঁক দিয়ে একজোড়া চোখ জুল জুল করে তাকিয়ে আছে—বাবা!

    সিনেমা দেখতে এসেছে! নাকি অন্য কোনো খবর পেয়ে এসেছে?

    সমরেন্দ্র সোজা হলের ভিড়ে মিশে ভেতরে চলে গেল। আমার সিনেমা দেখা তখন মাথায় উঠেছে। আমি সোজা পাশের গলিতে ঢুকে রিকশায় উঠে সাততাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে দিদিকে বলে আমার সেই লাল টপ ওয়াশিং মেশিনের টবে রাখা বাসি কাপড়গুলোর একেবারে নিচে ঢুকিয়ে দিয়েছি।

    বাবা বাড়ি ফিরল একঘন্টা পরে। আমার ডাক পড়ল।

    --তোকে যেন ছোঁড়াটার সঙ্গে দেখলাম, সিনেমা দেখতে গিয়েছিলি?

    আমি অবাক চোখে তাকাই; কী হল? কোন সিনেমা?

    বাবা আমার অ্যাকটিং দেখে অভ্যস্ত।

    --ভালো করেই জানিস কার কথা বলছি। তোরা দুজনে আজ পদ্মশ্রীতে সিনেমা দেখতে যাসনি?

    আমি বিরক্ত মুখে খবরের কাগজ এনে পদ্মশ্রীর বিজ্ঞাপনের সামনে আঙুল রাখি।

    --এই দেখ, শো শেষ হতে আরও একঘন্টা বাকি। আর আমি একঘন্টা আগে যাদবপুর থেকে ক্লাস করে বাড়ি ফিরেছি।

    --কিন্তু আমি যে তোকে দেখেছি, ছেলেটাকেও। হয়ত তোরা আগের শো দেখে বেরুচ্ছিলি।

    --তা দেখেছ যখন ডাকলে না কেন? ল্যাঠা চুকে যেত।

    —একটু দূরে ছিলি, কিন্তু ঠিকই দেখেছি। সেই গত পুজোয় কেনা লাল টপ!

    আমি হেসে ফেলি। বাপি, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। ওই টপ আজ সকালে বেরোনোর সময় ওয়াশিং মেশিনে ছেড়ে গেছলাম। এখন গোটা বাড়ির ছাড়া জামাকাপড়ের নিচে রয়েছে। একটু পরেই মেশিন চালানো হবে।

    বাবা সন্দিগ্ধ চোখে ওয়াশিং মেশিনে গিয়ে লাল টপের গল্প চেক করে এসে ভুরু কুঁচকে বসে থাকে। আমি চা এনে দিই, কিন্তু বাবার ভুরুজোড়া সেকন্ড ব্র্যাকেট হয়েই থাকে। শুধু পাশের বাড়ির বাগান থেকে কোকিলের ডাক শুরু হয়ে যায়--যেন আমাকে ভেঙাচ্ছে।

    গল্পটা এখানেই শেষ হয়নি।

    পরের দিন রোববার। বাবা বাঘাযতীন বাজারে যাওয়ার সময় বাপুজিনগর গিয়ে সমরেন্দ্রর মাকে শুনিয়ে এল—আপনার ছেলেকে যেন আমার মেয়ের ত্রিসীমানায় না দেখি। ওকে ভালো করে বোঝান, বউদি। নইলে আমাকেই কিছু করতে হবে।

    মাসিমা পালটা দিলেন—সারাজীবন রেলে চাকরি করলেন, অথচ একবারও নোটিসের দিকে চোখ পড়েনি—নিজের মাল নিজের দায়িত্বে রাখিবেন? আপনার মেয়েকে সামলান গিয়ে।

    কেটে গেল আরও দুটো বছর। এতদিনে দুজনের চাকরিজীবন মাত্র শুরু হয়েছে। আর পাঁচনম্বর বাসের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ও বলে উঠল—আমারে বিয়া করবা কিনা কও; এখনই কইতে হইব। দেখি তুমার বিশ্বাসের জোর কত?

    একদিন চুপচাপ সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টে রেজিস্ট্রি করেই ফেললাম। বাড়িতে দিদি ছাড়া কাউকে জানাতে সাহস হয়নি। শেষে যখন সিঁথিতে সিঁদুর পরে জোড়ে আশীর্বাদ নিতে গেলাম বাবা বড়ো বড়ো চোখ করে একমিনিট তাকিয়ে রইলেন। শেষে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন। মা আর দিদি শুকনো মুখে আমাদের খাটে বসিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে লাগল। বেশি প্রশ্ন সমরকেই করা হচ্ছে। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি একমনে শুনে যাচ্ছি পাশের বাড়ির আমগাছে কোকিলের ডাক—সেই বিরামবিহীন পিকরব।

    গানের ক্লাসে শেখা একটি দাদরার লাইন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে—“আমওয়াকে ডারি পে বৈরি কোয়েলিয়া, গা গা কর মুঝে রুলাতী রহী।”

    বাবা ফিরল ঘন্টাখানেক পরে। একগাদা মাছ-মাংস-দই-মিষ্টি বাজার করে এনেছে। আর এনেছে গড়িয়া মোড়ের ফুলের দোকান থেকে কিছু ফুল এবং ধান-দূর্বা। মাকে বলল—প্রদীপ জ্বালিয়ে ধান-দুর্বো দিয়ে ওদের বরণ করো, আশীর্বাদ করো। আর আজ রাত্তিরে তোমরা খেয়েদেয়ে এখানেই থাকবে। ভয় পেয়ো না সমরেন্দ্র, আমি লোক খারাপ নই, গুন্ডা নই।

    সমরেন্দ্র রাজি হল না। কারণ ওর মা একা থাকবেন। তখন মাসিমার কাছে আলাদা করে মুঠোফোন ছিল না। সব ভালোয় ভালোয় মিটে গেল। বউভাত নমো নমো করে সামনের ক্লাবঘরটায় সারা হল। বাবা-মা-দিদি-ভাই সবাই এসেছিল। আমরা কোনো কিছু নেব না বলাতেও বাবা প্রায় জোর করে একজোড়া খাট গছিয়ে দিয়ে গেল।

    মাসখানেক পরের এক বুধবারের সকালে বাবা হঠাৎ হাজির। মুখে কেমন একটা রাগ রাগ ভাব। কী হয়েছে? না বাবার কলিগ এবং দু’এক জন প্রতিবেশী জিজ্ঞেস করেছিল নতুন জামাই কী করে? বাবা বলতে পারেনি।

    সকাল দশটা। শাশুড়ি রান্নাঘরে। আমি অফিসে ফোন করে দিলাম যে বাবাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে হবে—আজকের দিনটি ক্যাজুয়াল নেব। বস বললেন ডাক্তার দেখিয়ে সময় পেলে ছুটি না নিয়ে চলে আসতে, কাজ আছে। আমি লাইন কেটে দিলাম।

    বাবা ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখছিল। পিছনের উঠোনে পুঁইমাচা আর তুলসীমঞ্চ, বাবার মনটা একটু ভালো হয়ে গেল। পাঁচিলের ওপাশ থেকে পাশের বাড়ির সজনেগাছ আর আমের ডাল এদিকে ঝুঁকে এসেছে—মনটা আরও ভালো হল।

    কিন্তু মাত্র দুটো ঘর! হ্যাঁরে মনু, তোর তানপুরা আর হারমোনিয়াম--সেগুলো কোথায় রেখেছিস? দেখিয়ে দিলাম পায়ার নিচে ইঁট দিয়ে উঁচু করা চৌকির নিচে রাখা আছে। বাবার মুখে মেঘের ছায়া। এবার জামাইয়ের চাকরি নিয়ে কথা হবে।

    সমরেন্দ্র দুটো কম্পিউটার খুলে একটাতে কিছু খুটখাট করছিল। বাবার ভাষায় ইঁদুর নিয়ে গেম খেলছিল। বাবা গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করল—আজ অফিস আছে?

    --হ্যাঁ।

    -—ক’টায় খোলে?

    --সাড়ে দশটায়। তবে বারোটা নাগাদ গেলেও চলে।

    --বোধহয় না গেলেও চলে, কী বলো? তা’ চাকরিটি এখনও আছে তো? নাকি মনুকে ভাঁওতা দিয়ে যাচ্ছ?

    এবার আমি ফিল্ডে নামি। বাপি, এসব কী হচ্ছে? ওর যা কাজ তার অনেকটাই ওয়ার্ক ফ্রম হোম। এখনও ও কম্পিউটারে বসে অফিসের কাজই করছে।

    --ওয়ার্ক ফ্রম হোম? সে আবার কী? আমি গড়িয়ার বরদা এভিনিউয়ের বাড়িতে বসে গড়িয়া স্টেশনের গাড়ির আসা যাওয়া কন্ট্রোল করতে পারব? তোকে বোকা পেয়ে জাহাজ দেখাচ্ছে।

    —বাপি, তোমাদের দুজনের কাজের নেচার আলাদা। তুমি বুঝবে না।

    --অ! তুই বুঝবি আমি বুঝব না? বেশ, বোঝার চেষ্টা করি। এই যে বাবাজীবন! কাজটা তুমি ঠিক কী কর বলো তো? এমন কাজ যে বারোটা নাগাদ অফিসে গিয়ে মুখ দেখালেই মাইনে পাওয়া যায়!

    সমর গড়িয়ার স্টেশনমাস্টার শ্রীযুক্ত হিমাংশু দত্তকে ল্যান, নেট ওয়ার্কিং—এইসব অনেকক্ষণ ধরে বোঝানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। বাবার বিব্রত মুখ দেখে আমি কম্প্যু খুলে ডেমো দিয়ে বোঝাতে গেলাম। বাবার কপালে ঘাম। বলল—সে তো বুঝলাম। কিন্তু ও কী করে?

    আমি ফের কিছু বললাম। বাবা বলল—ও? জামাই ভাবে? খালি ভাবার জন্যে পয়সা পায়? কালে কালে কতই দেখব। হরি হে, তুমিই সত্য।

    বুঝলি মনু, আমাদের সময় কাজ করলে পয়সা দিত, খালি ভাবলে না। সে যাকগে, এইসব ঢপের চাকরি কতদিন টিঁকবে তা ঈশ্বরই জানেন। তোর কপালে দুঃখ আছে।

    বাবার চেহারায় আষাঢ়ের মেঘ, চা খেয়ে চলে গেল। বাবা জানত না কয়েক বছর পরে একজন দেশনায়কও এমনই ফরমান দেবেন—হার্ভার্ডের চেয়ে হার্ডওয়ার্ক বেশি দরকার।

    কেটে গেল আরও দুটো বছর। আমরা দুজনেই কোম্পানি বদলেছি। মাইনেপত্তর একটু বেড়েছে। ওর মাইনে এখন আমার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেশি। মুখে নারীপুরুষ সমান বলে যতই লেকচার দিক, কোথাও বোধহয় একটা কাঁটা ফুটেছিল। এখন ওর মুখে হাজার ওয়াটের আলো ঝলমলায়; বডি ল্যাংগুয়েজে বেশ কনফিডেন্ট ভাব। আমরা এখন দক্ষিণ কোলকাতা ছেড়ে সল্ট লেকে ভাড়ায় আছি। আমগাছ আছে, আর সেই পিকরব—বিরামবিহীন। কিন্তু এই ডাকটা আমিই যেন বেশি করে শুনি।

    আমার নতুন অফিস ভবানীপুরে। মাইনেপত্তর ভালো, কাজের প্রোফাইল ভালো। কিন্তু ছুটি চাইলে বস এমন ভাব করেন যেন আমি ওঁকে কিডনি দান করতে বলছি। আমার স্বভাব বদলায়নি। সেই রাত্তিরে সিরিয়াল দেখে নিউজ শুনে, হোয়াটস অ্যাপ আর ইন্সটাগ্রাম করে শুতে শুতে বারোটা একটা। ফলে ঘুম থেকে উঠি দেরি করে। ও চা বানিয়ে ঘুম ভাঙায়। আমি আছোঁচা মুখে বেড-টি ও বিস্কুট খাই, তারপর ব্রেকফাস্ট বানাই। লাঞ্চ বানিয়ে টিফিন বক্স ভরার দায়িত্ব শাশুড়ি সামলে দেন। তারপর অফিসের জন্যে তৈরি হয়ে দু’বার বাস বদলে হাজির হতে প্রায়ই দেরি হয়ে যায়। বস কিচকিচ করেন।

    --এভাবে চাকরি করা যায় না ম্যাডাম, বুঝলেন? নিজেকে পালটান।

    ব্যস, আমি মুহূর্তের মধ্যে মনীষা ম্যাডাম থেকে মা-মনসা রূপ ধারণ করি।

    --ঠিক আছে; আজই আমার রেজিগনেশন অ্যাকসেপ্ট করুন।

    বস সঙ্গে সঙ্গে গলে বরফজল।

    --আমি কি তাই বলেছি?

    এবার উনি আরেকপ্রস্থ কফি আনিয়ে নিলেন।

    আমি চুমুক দিতে দিতে তেতো গলায় বলি—আসলে এফিশিয়েন্ট লোকদের আপনি ঠিক হজম করতে পারেন না। ট্র্যাফিকের চোটে আসতে দেরি হয়েছে সেটা নিয়ে দশটা কথা শোনাচ্ছেন। কিন্তু আমি যে কোনো ফাইল পেন্ডিং রাখি না, দরকার হলে রাত্তির করে বাড়ি ফিরি সে নিয়ে আপনার কোন হেলদোল নেই!

    বস আগামি ক্লায়েন্ট মিট নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।

    রাত্তিরে সমরেন্দ্র জানায় যে বস ওকে ফোন করে অনুযোগ করেছেন।

    —আপনার গিন্নিকে একটু বোঝান—এভাবে চাকরি হয় না। উনি গুণী মেয়ে, কাজ নিয়ে কোনো কমপ্লেইন নেই। কিন্তু এভাবে হরদম লেট করলে ডিসিপ্লিন থাকে কী করে! অন্যদের কী বলব?

    আচ্ছা ছোটোলোক তো! অফিসের ইস্যু নিয়ে বাড়িতে ফোন করে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল? ভেবেছে কী? কালই রেজিগনেশন দেব।

    সমরেন্দ্র যেন ভৈরোঁর আলাপ শুরু করেছে।

    গলা মন্দ্রসপ্তকে। আমাকে বোঝায় যে রেজিগনেশন যে-কোনো সময় দেওয়া যায়। কিন্তু দু’মাসের মধ্যে নতুন ফ্ল্যাটের পজেশন পাচ্ছি, ব্যাংক তার ই.এম.আই. কাটা শুরু করবে। একটু চাপ হয়ে যাবে না?

    এবার গলা মুদারায়—ভেবে দেখো, উনি খুব অন্যায় কিছু বলেননি। এই অফিসটা যদি তুমি চালাতে?

    যাঃ শালা! এর উপর এত ভরসা করেছিলাম? লাউচিংড়ির স্বাদ খারাপ হয়ে গেল।

    দুটো হপ্তা সামলে-সুমলে পার করলাম। তারপরের সোমবার। সকালে ছাদে গিয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে মালকোষ গুনগুন করছিলাম—কোয়েলিয়া বোলে, বন মেঁ ডারে ডারে। নাঃ; শুদ্ধ মধ্যম ঠিকমতো লাগছে না। অফিস থেকে ফিরে রাত্তিরে তানপুরা নিয়ে বসতে হবে।

    মোবাইল বেজে উঠল; বসের গলা—আপনি কোথায়? আধঘন্টার মধ্যে মুম্বাই অফিসের সঙ্গে কনকল শুরু হবে।

    --ব্যস, ধর্মতলার কাছাকাছি এসে গেছি। চিন্তা করবেন না, পৌঁছে যাচ্ছি।

    --ধর্মতলা? আমি যে কোকিলের ডাক শুনতে পাচ্ছি।

    সেরেছে! এই শালার বিরামবিহীন পিকরব।

    --স্যার, ওটা আমার পোষা কোকিল।

    --অ, তা ওটাকে কি আপনি আপনার ব্যাগের মধ্যে নিয়ে ঘোরেন?

    আমি ফোন কেটে দিয়ে হুড়ুমদুড়ুম করে তৈরি হই। তারপর গলাকাটা ভাড়া কবুল করে একটা ওলা-উবের গোছের কার ধরে রওনা দিই।

    সেদিন মিটিং শেষ হলে বস যা-তা বললেন। এত করেও আমি পনেরো মিনিট দেরিতে পৌঁছে ছিলাম। তারপর কোকিলের গল্প শুনে সবাই আমায় ব্যাগ খুলতে বলে। আমি অস্বীকার করি। বস বললেন উনি আমার প্রমোশনের জন্যে মুম্বাই অফিসে রেকমেন্ড করেছেন আর আমি কিনা--! আমি আজ তর্ক করি না। শুধু নিচু গলায় বলি যে আমার প্রমোশন চাই না।

    এতটা বেয়াদপি! পিনড্রপ সায়লেন্স।

    পনেরো দিন পর। ইতিমধ্যে আমার গানের গলা এবং কোকিলের গল্প মিলে অফিসে আমার নিকনেম হয়েছে কোকিলা। কিন্তু আমি ঠিক সময়ে অফিস যাই এবং বাড়ি ফিরি। অফিসে কারও সঙ্গে হাসাহাসি করি না বা জোকস শোনাই না। একদম কাম-সে-কাম মতলব রাখো।

    কিন্তু নিজের ভিতরের আমিটাকে কহাঁতক দাবিয়ে রাখা যায়?

    কাল রাত্তিরে একটু বৃষ্টি হয়ে সকালে আবার ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। শীত এবার যাই যাই করেও পুরো যাচ্ছে না, দোল অবদি টানবে কি?

    এমন সময় হাজির আমার রাজাভাতখাওয়া স্কুলের বকুলফুল পাতানো সুদেষ্ণা। একটা কাজে এসে টিম নিয়ে হোটেলে উঠেছে। এবেলাটা আমার সঙ্গে কাটাবে। আমায় পায় কে!

    অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিলাম—ঠান্ডা লেগে সর্দিজ্বর, গা ব্যথা।

    তারপর আড্ডা, হাহাহিহি, পুরোনো কথা, চায়ের পর চা। সমরেন্দ্রকেও ছুটি নিতে বাধ্য করেছি। রাজাভাতখাওয়ার মেয়ে এসেছে, এখন অফিসে গেলে ধম্মে সইবে?

    বেলা বাজে আড়াইটে। কেউ চান করিনি। এসে গেছে মাটন চাপ, বিরিয়ানি, রুমালী রুটি। আমরা দুই সখি একটা পাতলা লেপের তলায় গায়ে গা লাগিয়ে গল্প করছি, পেটের কাছে লেপের ওপর বিরিয়ানির প্লেট। স্বর্গ আর কোথায়?

    তিনটে বাজে। খাওয়া শেষ হয়নি। নিচের তলায় বেল বাজল। শাশুড়ি এসে জানালেন—বৌমা, তোমার বস এসেছেন। শরীর খারাপ শুনে তোমায় দেখতে।

    উরিত্তারা! সমরেন্দ্র চলে গেল ওনাকে সঙ্গে করে ওপরে নিয়ে আসতে। সুদেষ্ণা এক লাফে লেপ থেকে বেরিয়ে বিছানা গুছিয়ে আমাকে শুইয়ে দিয়ে গলা অবদি লেপ টেনে দিল। তারপর পাশের টেবিলে ঢাকা দেওয়া জলের গ্লাস আর শাশুড়ির থেকে একটা প্যারাসিটামলের স্ট্রিপ ও থার্মোমিটার এনে সাজিয়ে রাখল।

    ইতিমধ্যে হাসিমুখে বস এসে ঢুকলেন। পেছন পেছন ওঁর ড্রাইভার, হাতে একটা বিরাট প্যাকেট। জুতো খোলেননি দেখে শাশুড়ি একটু গম্ভীর হলেন।

    উনি হাসিমুখে বললেন—কেমন আছেন?

    তারপর আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সোজা কাছে এসে কপালে হাত রেখে বললেন—নাঃ; এখন জ্বর নেই মনে হচ্ছে।

    আমি বললাম—দুটো প্যারাসিটামল আর জলপট্টির পর এখন নেমেছে।

    সুদেষ্ণা হাসি চাপতে অন্য ঘরে গেল।

    উনি জিজ্ঞেস করলেন—খিদে পেয়েছে? খেতে পারবেন? কড়া ওষুধে খাওয়া দরকার।

    আমি ইতিবাচক মাথা নাড়ি।

    উনি ড্রাইভারের হাত থেকে প্যাকেট খুলে টেবিলে সাজান। তাতে চিকেন বিরিয়ানি, মাটন চাপ, বেশ ক’টি ডিসপোজেবল প্লেট ও প্লাস্টিকের চামচ।

    --চলুন, সবাই মিলে খাই। ও হ্যাঁ, আরেকটা কাজ বাকি।

    এবার উনি হাতের ফোলিও ব্যাগ থেকে একটি লম্বা খাম বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন—কংগ্র্যাটস! আজই করপোরেট অফিস থেকে প্রমোশনের লিস্ট এসেছে।

    বাইরে তখন আমগাছে পিকরবের যুগলবন্দী শুরু হয়েছে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ: রাহুল মজুমদার

    Tags: Bengali short story, Ranjan Roy
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments