• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৯ | জুলাই ২০২০ | গল্প
    Share
  • তর্পণ : এম চিত্রা
    translated from Hindi to Bengali by শম্পা রায়

    মূল হিন্দি 'তর্পণ' থেকে বাংলায় অনুবাদ

    শম্পা রায়





    “বাবা, সকালে উঠেই তুমি সায়গলের সিডি চালিয়ে দাও কেন? কী মনখারাপ করা গান। জব দিল হি টুট গ্যয়া, হাম জী কর ক্যা করেঙ্গে? গান, নাকি কান্না। বন্ধ করো। নতুন নতুন কত সিডি অমৃতা ঘরে এনে রেখেছে। সে-সব শোনো।”

    “বাবা, তুমি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ। এই ল্যান্ডলাইনের বিল বারোশো টাকা? এত! আমরা তো কোথাও ফোনই করি না। ঘরে থাকিই বা কতক্ষণ? অফিসে খেটেপিটে শুধু শুতেই তো রাতে ঘরে আসি। আমরা থাকতে কারোর ফোন এলে তুলি। যাদের ফোন করার দরকার তাদের তো অফিস থেকেই সেরে নিই। আমাদের কাছে নিজের মোবাইল রয়েছে। তোমার পেসমেকার বসানো। তাই তোমাকে মোবাইল দেওয়া হয় নি।”

    “অমৃতা বলছিল, তুমি শুধু ফালতু বকো। ভাগ্য ভালো যে বিল কম এসেছে। বর্ষীয়ান নাগরিকদের তো সরকার সব ক্ষেত্রেই ছাড় দিয়েছে।”

    “আমার মনে হয়, এমটিএনএল বয়স্কদের জন্য ফোনের দর অর্ধেক করে রেখেছে। নাহলে বাবার আর কী। প্রতি আধ ঘন্টায় উনি কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের কমে কথা বলেন না। ফোনে এত কথা কেন বলেন কে জানে। কার সঙ্গেই বা বলেন? যার সঙ্গে বলেন, তারও নিশ্চয়ই প্রচুর অবসর। সেই হিসেবে বিলটা তো অল্পই বলতে হবে।”

    “নাও, শোনো তোমার বাপের কীর্তি – পাশের রমণিকা আমায় চার্টার্ড বাসে বলল। কাল দুপুরেরই ঘটনা। রাস্তার মোড়ের ধোপা-বউটা একটু বমি করেছে কি না করেছে--বাবা তাকে রিক্সায় তুলে হাসপাতালে নিয়ে দৌড়েছেন। ওখানে গিয়ে জানা গেল রতনিয়ার বাচ্চা হবে। আমরা তো জানতামই না। ঝুট-ঝামেলায় আমি তো থাকিই না। পাড়ার লোকজন নানা আজেবাজে কথা বলছে। এই, খন্না রতনিয়াকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে উঠল কেন? আমি এখন কার কার কাছে গিয়ে সাফাই গাইব যে, বাবা পঁচাশি পার করেছেন।”

    “বাবা! এটা কী ব্যাপার? অফিসে যাওয়ার হুড়োহুড়ি সত্ত্বেও সকালে আমি জলের বোতলগুলো ভরে ফ্রিজে লাইন দিয়ে রেখে যাই। সন্ধ্যেবেলা দুজনে তেতেপুড়ে ঘরে ফিরি – এক ঢোঁক ঠান্ডা জলও ভাগ্যে জোটে না। পাড়ার জমাদার, পোস্টম্যান, ঠেলাওয়ালারা তো আমাদের চেয়ে ভাগ্যবান - ওদের যখনই তেষ্টা পায়, তুমি বোতলগুলো খালি করতে দিয়ে দাও। তুমি বোঝো না কেন বাবা। পরোপকারের সেই যুগ গেছে; যখন গরমের দিনে বাড়ির সামনে লোক জলের কলসি রাখত, রাস্তায় জলসত্র বসাত।”

    “গত সপ্তাহেই তো বাড়িতে নিমকি এসেছিল, বাবা। আমি তো ছুঁয়েও দেখিনি। এত তাড়াতাড়ি শেষও হয়ে গেল? হা-ক্লান্ত হয়ে ঘরে এসে একটা পেগ নিতে হলে নুন মুখে দিয়ে স্কচে চুমুক মার। এখান থেকে বাজার কতদূর জানো না? এমনিতে তো তুমি বল যে, বিকানেরি ভুজিয়া দাঁতে ভাঙতে পারো না। তাহলে কাকে আপ্যায়ন করতে গিয়ে নোনতার বয়ামটা খালি করে ফেললে তুমি!”

    “সারাদিন ঘরে আলো-পাখা জ্বালাও কেন বাবা? গত বছরই তো চোখের ছানি অপারেশন হল। তুমিই তো বলেছিলে অপারেশন ঠিকমতো হয়েছে, তুমি খুশি। এখন চোখে পরিষ্কার দেখতে পাও, এমনকী সাধারণ আলোতেও বেশ ভালোভাবে পড়তে পারো। কাল সন্ধ্যেবেলা চার্টার্ড থেকে নেমে গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখতে পেলাম বাড়ির বারান্দার আলোটা জ্বলছে। কে জানে কখন থেকে জ্বালিয়ে রেখেছ তুমি। কেন এমন করো। আজকাল তো দিন বড়ো হয়েছে? বাবা, এই দুর্মূল্যের মধ্যে বিদ্যুৎ অপচয়ের খরচ কীভাবে মেনে নেওয়া যায়। বলো?”

    “ঘরে শাক-সবজি নিয়ে এলেই সংসারের খরচ ওঠে না বাবা। হাজারটা খরচ থাকে। কোনটা কোনটা গুনতে বলব? নিজের ওষুধপত্রেই তো আপনার পেনশন খরচ হয়ে যায়। অন্যান্য সমস্ত খরচ তো আমাদেরই চালাতে হয়। মানলাম যে, পেনশন কম। মাইনেটাই তো কম ছিল। কিন্তু সিক্সথ পে-কমিশনে বেড়ে যাওয়া টাকা হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই যখন মেয়েকে ঘুষ দিতে পাতিয়ালায় ছুটলেন তখন আপনার কী হয়েছিল বাবা? বুঝি, এটাই স্বাভাবিক। ফোঁপরদালালি করার দক্ষিণা তো দিতেই হবে, তাই না!”

    “বাবা তুমি এটা কি করেছ? বসবার ঘরে মায়ের ছবি টাঙিয়ে দিলে? মায়ের ছবি কি সৈয়দ হায়দর রেজার কোনো পেন্টিং? দেওয়ালটা কী খারাপ লাগছে দেখতে! ষাট-সত্তর হাজার টাকা জমাতে পারলে ভেবেছিলাম রেজার একটা পেন্টিং কিনে এখানে টাঙিয়ে দেব। নয়তো ওঁর কোনো পেন্টিং-এর পোস্টার কিনে বাঁধিয়ে নেব। বসবার ঘরের সৌন্দর্য খিলখিলিয়ে উঠবে। পাড়া-পড়শি ঈর্ষায় জ্বলবে। ওদের ঘরের দেওয়ালে রেজার পেন্টিং সাজানো রয়েছে।”

    “এটা তো সত্যি যে, কোনোরকমে প্রাসাদ বানালেই লোকে তার মালিক হতে পারে না। মহলে থাকার জন্য সেইরকম যোগ্যতা লাগে। এই তো অবস্থা। যেখানে বসে চা খায়, সেই চেয়ারের তলাতেই কাপ-প্লেট গুঁজে রাখে। মাছি ভনভন করছে তো করুক। কিচ্ছু আসে যায় না। তাছাড়া, লন্ডভন্ড করে রাখার মজা তো গুছিয়ে থাকার মধ্যে নেই।”

    “সম্পত্তি করের ক্ষেত্রে বর্ষীয়ান নাগরিকদের অনেক ছাড় আছে, মানলাম। তোমার যুক্তিগুলো ঠিক বাবা! ঠিকই ভেবেছ তুমি! এতে আমাদের টাকা কিছুটা বাঁচে আর তা-ই করা উচিত। আমরা তো অঢেল কিছু রোজগার করি না কিন্তু মরার পর যে কাজ করতে হবে তা যদি মরার আগেই হয়ে যায় আর নির্ঝঞ্ঝাটেই হয়, তবে তার চেয়ে ভালো ব্যাপার আর কী-ই বা হতে পারে? তোমার একমাত্র হকদার আমি। দুজনেই আমরা রোজগার করি। বর্ধিত সম্পত্তিকর বেশ ভালোভাবেই দিতে পারব। বাড়িটা এখন আমার নামে করিয়ে নিতে যত খরচ হবে, তোমার অবর্তমানে সেই কাজের জন্যই চারগুণ বেশি টাকা দিতে হবে। তার চেয়েও বোধহয় বেশি। কাগজপত্র তাহলে কবে তৈরি করাব বাবা? উকিল বলছিল যে রেজিস্ট্রির সময় আপনার বাবাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থিত থাকতে হবে। ওনার মতামত জিজ্ঞাসা করা হবে। তবে রেজিস্ট্রির জন্য ম্যাজিস্ট্রেট বাড়িতেও আসতে পারেন কিন্তু ওনার আসার ফিস ষাট-সত্তর হাজারের কম হবে না, এদিকে তোমার হাত কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। পেনশন অফিসের পেনশন ক্লার্ক নালিশ করছিল যে খন্না সাহেবের হাতের লেখা বদলে যাচ্ছে। এবার বাকিটা তুমি ভাবো বাবা।”




    মূল গল্পের লেখিকা চিত্রা মুদগল সাহিত্য আকাদেমী প্রাপ্ত হিন্দি-সাহিত্যের এক বিশিষ্ট ব্যক্তি।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার

    Tags: Bengali translation from Hindi short story, M Chitra, Sampa Ray
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments