উত্তর আমেরিকায় শীতের সময় সবথেকে ভালো বেড়ানোর জায়গা হ'লো দক্ষিণ আমেরিকা । মাত্র দু'তিন ঘন্টার জেটল্যাগ এবং আরামের গ্রীষ্মকাল সেখানে । এ-বছর কিন্তু আমরা চললাম আরও দক্ষিণে একেবারে দক্ষিণ মেরুর দেশ, অ্যান্টার্কটিকায় । সেখানে সারা বছর হাড়-কাঁপানো শীত । মধ্যগ্রীষ্মেও তাপমাত্রা উত্তর আমেরিকার শীতের মতোই । বন্ধুজন প্রশ্ন করেন--কী দেখতে যাচ্ছো, এই ঠাণ্ডায় ? বরফ ছাড়া আর কী-ই বা আছে ? আশা করি সেই প্রশ্নের উত্তরটা পাঠকজন এই লেখা থেকে আন্দাজ করে নিতে পারবেন ।
পৃথিবীর দক্ষিণতম দু'টি দেশ চিলে ও আর্জেন্টিনা । তার মধ্যে আর্জেন্টিনার উশুহাইয়া ( (Ushuaia) ) শহরটাকেই পৃথিবীর দক্ষিণতম শহর বলে মানা হয় । ও-দেশের ভাষায় `পৃথিবীর শেষ প্রান্ত'-- Fin del mundo ।
আন্দিস পাহাড়ের লেজের ফাঁকে গোঁজা এই অঞ্চলটির নাম টিয়েরা দেল ফুয়েগো (
Tierra del fuego ) বা আগুনের দেশ । উত্তরে ম্যাজেলান প্রণালী ও দক্ষিণে বীগল চ্যানেল দুই মহাসাগরকে যুক্ত করেছে । বিখ্যাত পর্তুগীজ আবিষ্কারক ম্যাজেলানই টিয়েরা দেল ফুয়েগো নাম দেন । ১৫২০ সালে তাঁর নাবিকেরা স্থানীয় ইয়ামান আদিবাসীদের গ্রাম থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখে প্রথমে নাম দিয়েছিলেন `ধোঁয়ার দেশ', তারপরে সেটা বদলে `আগুনের দেশ' করা হ'লো । শোনায় ভালো, আর ধোঁয়া থাকলে আগুন তো থাকবেই !
এই আদিবাসীরা কিন্তু বেশিদিন বাঁচেনি । বন্দুক ও রোগের তাড়নায় কয়েক দশকের মধ্যেই সবাই নির্বংশ হয় । এখন এদেশে শুধু ইওরোপীয়দেরই বসতি ।
দক্ষিণে ঠিক উশুহাইয়ার পায়ের তলায় আরেকটি সরু প্রণালী আছে যেখান দিয়ে ১৮৩৩ সালের ২৯-শে জানুয়ারি একটি বিখ্যাত জাহাজ এইচ,এম,এস বীগ্ল ও তার বিখ্যাত যাত্রী চার্লস ডারউইন প্রথম আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে পা দেন । তাঁরই নামে এটি বীগ্ল চ্যানেল নামে খ্যাত ।
কেপ হর্ন |
ম্যাজেলান ও বীগ্ল চ্যানেল দুটিই বেশ সরু, দ্বীপসংকুল আর শীতকালে জমে বরফ । তাই বড়ো জাহজগুলো কেপ হর্ন ঘুরেই এক সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্রে প্রবেশ করে । কেপ হর্ন দুর্দান্ত ঝড় ও স্রোতের জন্য কুখ্যাত । অনেক জাহজ ও নাবিক এখানে প্রাণ দিয়েছে । সামনে ৫০০মাইল চওড়া এই প্রণালীটির নাম ড্রেক প্যাসেজ ( (Drake Passage) ) । এখানেই দুই মহাসমুদ্রের উত্তাল মিলন । বিখ্যাত (আসলে, কুখ্যাত) ব্রিটিশ নাবিক ফ্রান্সিস ড্রেক-এর নামে চিহ্নিত । যদিও ড্রেক নিজেও এই প্যাসেজ দিয়ে যাওয়ার সাহস করেননি । ঝড়ে জাহজডুবির পর একটিমাত্র জাহাজ সম্বল করে ম্যাজেলান প্রণালী দিয়ে পাশ কাটান ।
ড্রেক প্যাসেজ পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক সমুদ্র । এখনো প্রতি বছর দু'একটি জাহাজ এখানে বিপদে পড়ে । আমাদের ফিরে আসার দু'দিন পরেই একটি জাহাজ প্রায় ডুবতে বসেছিলো । আর্জেন্টিনার নৌবাহিনী তাকে উদ্ধার করে ।
উশুহাইয়া |
পৃথিবীর শেষ প্রান্তে যেতে এইসব আবিষ্কারকদের প্রায় বছর দুয়েক সময় লাগতো । এখন দু'দিনেই আমেরিকা থেকে উশুহাইয়া পৌঁছনো যায় । রাজধানী বুয়েনস আয়ার্স থেকে পাম্পাস ও পাতাগোনিয়া পেরিয়ে পাঁচ ঘন্টার উড়ান । প্লেনে কিন্তু মনে করে জানালার পাশের সীট নেবেন । কারণ, উশুহাইয়ার এয়ারপোর্টে নামা এক বিশেষ রোমাঞ্চকর ব্যাপার । আন্দিসের বরফ-ঢাকা ধারালো চূড়াগুলি প্রায় ছুঁয়ে প্লেনটা নামতে থাকে । নীচে শুধু উজ্জ্বলনীল সমুদ্র ও ঝকঝকে সাদা পাহাড় । পাহাড়গুলি এতো কাছে যে মনে হয় জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় । নীচে সমুদ্রের জলে ডুববার শেষ মুহূর্তে প্লেনটি মাটি ছোঁয় । পৃথিবীর শেষ প্রান্তে নামবার এমন রোমাঞ্চে আপনার নিশ্চয়ই গায়ে কাঁটা দেবে ।
উশুহাইয়া শহরটি ছোট্ট । ট্যুরিজম এখানকার প্রধান ব্যাবসা । দক্ষিণ মেরু যাবার সব জাহাজগুলি এখান থেকেই ছাড়ে । ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে শহরটা নানা দেশের ট্যুরিস্টের ভিড়ে জমজমাট । ড্রেক প্যাসেজের এতো কাছে বলে সবসময় এখানেও ঝোড়ো হাওয়া বইছে । গ্রীষ্মেও গড় তাপমাত্রা ১২ ০ সে:, আর হঠাৎ করে যে-কোনো মুহূর্তে তাপমাত্র একেবারে -২০ ০ সে: তে নেমে যেতে পারে ! শহরের চারদিক ঘেরা দুর্গম পাহাড় ও উত্তাল সমুদ্রের জন্য আর্জেন্টিনার সরকার ১৮৭৩ সাল থেকেই এখানে দেশের রাজনৈতিক বন্দীদের নির্বাসন দিতে শুরু করে । এদের ওপর নানারকম অত্যাচার ও দুর্ব্যবহারের কথা ইতিহাসে লেখা আছে । ১৯৪৭ সালে সরকার নিজেই এ-ব্যবস্থাটা বন্ধ করে । পুরোনো জেলটা এখন ঐতিহাসিক মিউজিয়াম ।
উশুহাইয়া থেকে একটু দূরে টিয়েরা দেল ফুয়েগো ন্যাশনাল পার্ক । ১৯৬০ সালে এর পত্তন । ঈগল, কারাকারা, কণ্ডোর, রাজহাঁস ইত্যাদি নানা পাখি ছাড়াও দুর্লভ হুয়ানাকো (
(Guanaco) ) দেখা যায় । এদের লোম পশমিনা থেকেও কোমল ও দামী ।
`এম, এস, এক্সপিডিশন'--আমাদের জাহাজ |
উশুহাইয়া শহর থেকে এক সোনালী বিকেলে আমরা চড়লাম এম,এস, এক্সপিডিশন--আমাদের জাহাজে । প্রায় একশ' জন ট্যুরিস্ট ও ৬০ জন গাইড, কর্মী ইত্যাদি । আমাদের প্ল্যান ছিলো দশ-দিনের যাত্রা । ড্রেক প্যাসেজ পার হয়ে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে পা ছোঁয়ানো । মহাদেশের অভ্যন্তরে যাওয়ার ক্ষমতা বা সাহস আমাদের নেই । তাই জাহাজের সুরক্ষিত আরামে থেকে এই বিশাল মহাদেশটি একটু উপভোগ করা । যেহেতু এই মহাদেশে থাকা খাওয়ার কোনো জায়গা নেই, তাই জাহাজই সহায় ।
এই অত্যাধুনিক জাহাজে সবরকমের সুরক্ষা ও সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই যাত্রা বেশ বিপজ্জনক । তাই প্রথম দিনেই আমাদের সবার
safety drill নিতে হ'লো । অন্যান্য জাহাজের তুলনায় অ্যান্টার্কটিকা-গামী জাহাজে জলে নামার ডাইভ স্যুট আগাপাশতলা গরম নিওপ্রিন ( (Neoprene) )-এ তৈরি, না-হলে এই বরফজলে দু'মিনিটেই মৃত্যু নিশ্চিত । লাইফবোটগুলোও পুরো ঢাকা, ভেতরে চেপেচুপে পনেরো-জনের মতো বসার জায়গা এবং সাতদিনের মতো র্যাশন করা খাবারের প্যাকেট । আমাদের বলা হ'লো প্রথম দিনটা নির্জলা উপোস--র্যাশনের খাবারে পেট সইয়ে নেওয়ার পদ্ধতি ।
অ্যান্টার্কটিকায় আমরা ছিলাম ছ'দিন । প্রতিদিন রুটিন ছিলো লাঞ্চের আগে ও পরে চার-পাঁচ ঘন্টা ডাঙায় ল্যাণ্ডট্রিপ । আর সন্ধ্যায় ডিনারের পর নানা বিষয়ে লেকচার--পাখি, আবহাওয়া, বরফ, ইতিহাস ইত্যাদি । খাবারের ব্যবস্থা খুবই ভালো--চীনা, ভারতীয়, ফ্রেঞ্চ--একেকদিন একেক ধরনের রান্না ।
জাহাজ থেকে ডাঙায় নামার পদ্ধতিও আমাদের প্রথম দিনেই শেখানো হয়েছিলো । সেই নিয়মগুলি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হ'তো, যাতে কেউ জলে না-পডে, আহত না-হয় বা ডাঙায় হারিয়ে না যায় । সুরক্ষা সম্বন্ধে আমাদের গাইডরা খুবই সিরিয়াস ছিলো ।
ট্রেকিং--গাইডদের সতর্ক দৃষ্টি ছিলো সবসময়ে |
অ্যান্টার্কটিকার কোনো বন্দর বা জেটি নেই । জাহাজ ডাঙা থেকে একটু দূরে গভীর জলে নোঙর ফেলতো এবং আমাদের দশ-বারো জনের এক একটি দলকে রবার ডিঙিতে করে ডাঙায় নামানো হ'তো ।. ডাঙা মানে হাঁটু অবধি বরফ জল ও তার পর দশ-বারো ফুট গভীর বরফের রাজত্ব । জলটুকু পার হবার জন্য সবাইকে হাঁটু পর্যন্ত উঁচু গামবুট দেওয়া হয়েছিলো । এছাড়াও সবাইকে তিনপ্রস্থ প্যান্ট (লংজন, উলের প্যান্ট ও ওপরে ওয়াটার-প্রুফ প্যান্ট), দুই প্রস্থ দস্তানা ও মোজা--নীচে সিল্ক, ওপরে উল--গায়ে দুই প্রস্থ জামা, তার ওপর মোটা পার্কা, মাথায় টুপি এবং পার্কা-হুড, চোখে রোদ-চশমা, এর পরেও যদি দেহের কোনো অংশ খোলা থাকে তো সেখানে পুরু করে সানস্ক্রীনের প্রলেপ । এবার ওপরে লাইফ জ্যাকেট । এ-ছাড়াও কাঁধে ব্যাগ, ক্যামেরা, দূরবীন, জলের বোতল, হাতে লাঠি.... কল্পনা করুন--এতোসবের পর আমাদের Goodyear blimp -এর মতোই দেখাত । দিনে দুবার করে এই ধড়াচূড়ো পরা ও ছাড়াও বেশ পরিশ্রমের কাজ ছিলো ।
দুলুনি কম থাকলে জাহাজের ডেক-এ পিকনিক |
অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছনোর আগে অবশ্য ভয়াবহ ড্রেক প্যাসেজ পার হওয়ার পরীক্ষা । প্রায় ৫০০ মাইল চওড়া ড্রেক দক্ষিণ আমেরিকা ও অ্যান্টার্কটিকার ঠিক মাঝখানে । ৫০ ০ ও ৬০ ০ অক্ষাংশের মধ্যে এর অবস্থান । সর্বক্ষণ এখানে ৪০-৫০ মাইলের ঝোড়ো হাওয়া ও ১০-২০ ফুট উঁচু ঢেউ । নাবিকদের ভাষায় বলে Screaming Sixty আর Furious Fifty । এর মাঝে পড়ে আধুনিক cruise জাহাজগুলিও মোচার খোলার মতো খাবি খায় ।
প্রথম দিনেই আমাদের
"Drake Shake" সম্বন্ধে সাবধান করা হয়েছিলো । জাহাজের সব ফার্নিচার মেঝেতে আটকানো, প্যাসেজ ও সিঁড়িতে রেলিং দেওয়া । দবাইখানা থেকে বিনা পয়সায় যত ইচ্ছা Dramamine পাওয়া যায় । এত সব সত্ত্বেও প্রথম দিন ড্রেক-এ পড়ে অনেকেই মোশন সিকনেস-এ কাবু । সৌভাগ্যবশত আমার ওই রোগের বালাই নেই । কিন্তু ঝড়ের শব্দে ও জাহাজের দুলুনিতে প্রথম রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেলো । ঘরে কাগজপত্র, বই, জলের বোতল সব সশব্দে মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছে । ওগুলো তুলবো কি, সোজা হয়ে দাঁড়ানোই মুশকিল । বিছানা থেকেই পড়ে যাবার অবস্থা । কোনোক্রমে তোষক আঁকড়ে ধরে টাল সামলাই ।
আরেকটা ব্যাপারে আমাদের সাবধান করা হয়েছিলো--টাল সামলাতে দরজার পাল্লা যেন না ধরি । দরজাটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে আঙুল চিপটে যাবার সম্ভাবনা । প্রতিবারই নাকি দু'একজনের এরকম অবস্থা হয় ।
আমরা যারা সুস্থ ছিলাম, একদিনের মধ্যেই টাল সামলে চলাফেরা করতে শিখে গিয়েছিলাম । রাতেও ঘুমোতে আর অসুবিধা হয়নি । ফেরার পথে জাহজটা একটু আগেই ড্রেক-এ ঢুকে পড়েছিলো । ডিনারের সময়--পরিবেশনকারিরা প্রস্তুত ছিলো না । হঠাৎ বড়ো একটা ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রত্যেক টেবিলের প্লেট, গেলাস, ছুরি-কাঁটা সব মাটিতে পড়ে ছত্রখান । সে এক দৃশ্য বটে ! অবশ্য ওয়েটারদের বাহবা দিতে হয় । দু মিনিটে সব সাফ করে খাওয়া পরিবেশন শুরু করে দিলো । আর ওই দুলুনিতে তাল রেখে কী করে যে এরা ছ'সাতটা প্লেট হাতে পরিবেশন করে, দেখেই অবাক হতে হয় ।
অ্যালব্যাট্রস বারো ফুট সাইজের ডানা মেলে অনায়াসে হাওয়ায় ভেসে থাকে |
ড্র্রেক প্যাসেজটা কিন্তু সামুদ্রিক পাখি দেখার জন্যে সব থেকে ভালো জায়গা । ৫০-৬০ ০ -র মাঝখানে ঝোড়ো হাওয়াটা এইসব পাখিদের খুব পছন্দ । আরাম সে পাখা মেলে ঘন্টার পর ঘন্টা এরা হাওয়ায় ভেসে থাকতে পারে । জাহাজের পেছনে পেছনে মাছের আশায় এরা ঝাঁক বেঁধে ওড়ে । অবশ্য জাহাজের দুলুনি, জলের ছাঁট ও হাওয়ার দাপট বাঁচিয়ে ডেকে দাঁড়ানোই মুশকিল, ফটো তোলা তো দূরের কথা । ঝাঁক ঝাঁক পেট্রেল, অ্যালব্যাট্রস, Shear water , টার্ন, গাল ইত্যাদি কতো পাখি যা খোলা সমুদ্র ছাড়া কোথাও দেখা যায় না । ছোট্ট ছ'ইঞ্চি সাইজের প্রায়ন ঢেউয়ের মাথায় ঝিলিক দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় । বিরাট অ্যালব্যাট্রস তার বারো ফুট সাইজের ডানা মেলে অনায়াসে হাওয়ায় ভেসে থাকে । তারা নাকি দিনের পর দিন এভাবে উড়তে পারে । রাতে তারা উড়ন্ত অবস্থাতেই ঘুমোয় ও কখনো সখনো জাহাজের জানালায় ধাক্কা খায় । এ-ছাড়াও আছে কেপ পেট্রেল, ডানায় সাদা-কালোর আঁকিবুকি । দূর থেকে মনে হয় এক ঝাঁক ঘুড়ি উড়ছে । আরও কতো পাখি !
অবিচ্ছিন্ন বরফ-ঢাকা বিরাট মহাদেশ |
ঢেউ আর হাওয়ার বেগ অনুযায়ী ড্রেক পেরোতে ১-২ দিন সময় লাগে । একবার ৬০- ০ -র দক্ষিণে পড়লে দুলুনি অনেক কমে যায় । ৬০ ০ অক্ষাংশই অ্যান্টার্কটিক মহাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানা । এরই মধ্যে উশুহাইয়া থেকে নিউজিল্যাণ্ড পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন বরফ-ঢাকা বিরাট মহাদেশ, যার আয়তন আমেরিকারও দেড়গুণ । কিন্তু এখানে কোনোদিন ল্যাপ বা এস্কিমোদের মতো কোনো মানুষ বাস করেনি ; উত্তর মেরুর ভালুকের মতো কোনো স্থলপ্রাণীও নেই এখানে । নেই কোনো শহর, বন্দর, রাস্তা বা এয়ারপোর্ট । এই বিশাল মহাদেশটি কোনো দেশের অধিকারে নেই । তাই কোনো ভিসা, কাস্টমস বা পাসপোর্টেরও বালাই নেই । এমন আশ্চর্য দেশ না দেখে পারা যায় ? এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি !
জন্ম দিচ্ছে বিশালকায় হিমশৈলর |
উত্তর-পশ্চিম কোণে দু'একটা দ্বীপ ছাড়া দেশটি ৯৯% পুরু বরফে ঢাকা । জলের পাড়েও বরফের উচ্চতা ৬ থেকে ২০ ফুট । অগুনতি হিমবাহ ভেঙে পড়ছে সমুদ্রের জলে । জন্ম দিচ্ছে বিশালকায় হিমশৈলর বা (iceberg) -এর ।
এতো বরফ সত্ত্বেও দেশটা মরুভূমির মতোই শুকনো । হাওয়ায় আর্দ্রতা নেই বললেই চলে । ঠাণ্ডায় না জমলেও ডি-হাইড্রেশনে মারা পড়ার সম্ভাবনা ।
মহাদেশটাকে পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ করেছে একটা পর্বতশ্রেণী--আন্দিসেরই শেষাংশ । আমাদের যাত্রা উত্তর-পশ্চিম কোণেই সীমাবদ্ধ ছিলো । দেশের অভ্যন্তরে ভীষণ ঠাণ্ডা হলেও সমুদ্রের ধারে তাপমাত্রা সহনীয় । দিনে ২০ ০ ফা: থেকে রাত্তিরে -১০ ০ ফা:, জায়গা বিশেষে । অবশ্য ঝোড়ো হাওয়ার জন্যে ঠাণ্ডা অনেক বেশি বলে মনে হয় ।
সমুদ্রের তীর ঘেঁষে ছোটো ছোটো আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক ঘাঁটি । আমেরিকা, চিলে, আর্জেন্টিনা ইত্যাদি অনেক দেশ এখানে সাময়িক ঘাঁটি পেতেছে । আগে ওই সব জায়গাগুলিতে তিমি ও সীল শিকার করা হ'তো । আজকাল ওসব কাজ আইন করে বন্ধ করা হয়েছে ।
সবাই অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশের ব্যবহার করে |
অ্যান্টার্কটিকায় রাস্তাঘাট বা শহর-গ্রাম না থাকার দরুণ কোনো ম্যাপ বা ঠিকানা দেওয়া মুশকিল, তাই সবাই অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশের ব্যবহার করে । এতে সব জায়গার সঠিক অবস্থান জানা যায় । এছাড়াও দক্ষিণ মেরুতে দিক নির্ণয়ও গোলমেলে কারণ সব দিকই উত্তর দিক । তাই লোকেরা কথায় কথায় অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশই ব্যবহার করে । উত্তর গোলার্ধে আমরা এবিষয়ে মোটেই তেমন সচেতন নই ।
মহাদেশটা এতো বড়ো হওয়া সত্ত্বেও ১৮০০ সালের আগে এর অস্তিত্ব পর্যন্ত জানা ছিলো না । ১৮২০ সালে একটি রাশিয়ান মাছ ধরার জাহাজ প্রথম এর দর্শন পায় । পরের বছর প্রথম মানুষের পদার্পণ হয় এখানে । অভ্যন্তরে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত পৌঁছতে আরো অনেক বছর ও অনেক প্রাণ লেগেছিলো ।
১৯০৯ সালে উত্তর মেরুতে সফল যাত্রার পর সবাই দক্ষিণ মেরু নিয়ে পড়লো । ব্রিটিশ অভিযাত্রী আর্নেস্ট শ্যাকলটন (
(Ernest Shackleton) )-এর বিখ্যাত, ট্রাজিক যাত্রাকাহিনি হয়তো অনেকেই জানেন । ১৯০৯ সালে মাত্র ৯৭ মাইলের ভুলে তিনি দক্ষিণ মেরুর কেন্দ্রটিতে পৌঁছতে পারেননি । তারপরে ১৯১২ সালে হ'লো নরওয়ের রোয়ল্ড আমুণ্ডসেন ও ব্রিটেনের রবার্ট স্কটের মধ্যেকার সেই বিখ্যাত প্রতিযোগিতা । দু'জনে দু'দিক থেকে শুরু করে মেরুকেন্দ্রে পৌঁছবার চেষ্টা করেন । আমুণ্ডসেন বিজয়ী হয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিলেন । তার পরেও অনেক অভিযাত্রী মেরুবিজয়ের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে প্রাণ দিয়েছেন । এখনও দক্ষিণ মেরু পৃথিবীর অন্যতম দুর্গম জায়গা ।
এতোদিন দেশটি কারুর অধিকারে ছিলো না । ১৯৬১ সালে ৪৭-টি দেশ মিলে
অ্যান্টার্কটিক চুক্তি (
Antarctic Treaty ) স্বীকার করে (ভারতও ১৯৮৩ সালে যোগ দিয়েছে) । চুক্তি অনুযায়ী ৬০ ০ র দক্ষিণে কোনো দেশই পাকাপাকিভাবে দখল বসাতে পারবে না । শুধু বৈজ্ঞানিক কাজের জন্য ঘাঁটি তৈরি করা যেতে পারে । এই রকম অনেক তৈরি হয়েছে । পূর্ব-অ্যান্টার্কটিকায় আমেরিকা বেশ বড়ো ক্যাম্প তৈরি করেছে--অনেকটা ছোটো এক শহরের মতোই । দেশ বিদেশ থেকে বিজ্ঞানীরা এখানে পরিবেশ, আবহাওয়া ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন । চুক্তি অনুযায়ী কেউই মিলিটারি বা পারমাণবিক কাজকরম করতে পারবে না এবং অ্যান্টার্কটিকার পশু পাখি ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে ।
দক্ষিণ মেরুতে সূর্যাস্ত |
(পরবাস ৪৭, জানুয়ারি, ২০১১)