কোথায় লুকিয়ে আছে কোন্ ডালের ফাঁকে --- দেখা যায় না । কিন্তু শোনা যাচ্ছে তার অদ্ভুত শিস্ --- টু উ উ টু উ উ টিট্ টিট্ টিট্ ………..। কী করুণ সুর , না ? এ'রকম শিস্ আর কোনো পাখির গলায় কখনও শোনেনি কিটু । দিদিকে জিজ্ঞেস করেছিল , "কী পাখি রে দিদি ? ঠিক সন্ধ্যের মুখটাতে ঐ বড় ডুমুরগাছটাতে এসে বসে , আর কখন ফুরুক্ করে উড়ে পালিয়ে যায় । দেখাই যায় না চোখে ?"
দিদি সিরিয়ালের পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে বিরক্ত গলায় বলেছে , "তোর তাতে কী ? আমায় ডিসটাব করবি না একেবারে ।"
বেশ বাবা । কাকে যে শুধোয় কিটু ।
"কিটু , কিরীটি .........! " ঠিক এই সময়েই নিচের গেটে অঙ্কস্যরের হাঁক । এই রে , এখনো দু'টো অঙ্ক বাকি । কিটু চট্পট্ তৃতীয় 'সরল কর'-টা খাতায় টুকতে শুরু করে দেয় । আজ ফের কপালে দু:খু আছে মনে হয় ।
সন্ধ্যে হতে-না-হতেই বীরেনবাবু স্যর ঠিক আসবেন , আসবেনই । ওঁনার কী একদিনও পেট কামড়ায় না , জ্বর হয় না , মাথা ধরে না ? মামীর তো হর-সন্ধ্যেয় মাথা ধরে , কাছে গেলেই সেই চিনেবামটার গন্ধ পাওয়া যায় । কিটু অঙ্কে খুব কাঁচা কিনা , তাই মামা ইস্কুলের স্যরকেই ঠিক করে দিয়েছেন , প্রতি সন্ধ্যেবেলায় পাক্কা দেড়টি ঘন্টা অঙ্ক কষা চাই-ই চাই ।
"আজও হোম টাস্ক পুরো হয় নি , কিটু ? তোর আর কবে চেতনা হবে র্যা ? তোকে না বলেছি , অঙ্ক সব ক'টা ট্রাই করবিই করবি , না পারলে তখন আমি দেখব ? " হাতে স্কেল খানা তুলে নিতে নিতে বীরেনবাবুর গলা কড়া হয়ে আসে , "আজ তোমার মামাবাবুকে বলে………"
"না স্যর । মামাকে বলবেন না । আমি করে ফেলব , সব ক'টা করে ফেলব । করেই তো ফেলছিলাম । মাঝখান থেকে ঐ পাখিটা এসেই তো ………."
"কি ? পাখি ? সন্ধ্যেবেলা তুমি পাখি দেখে পড়ায় হেলা করচ ? দাঁড়াও , তোমার হচ্ছে .........."
পটাস্ !
'হচ্ছে' আর কোথায় ? হয়েই তো গেল । কিটুর খোলা হাঁটুতে বীরেন স্যরের স্কেলের মোক্ষম এক ঘা পড়ে জ্বালা ধরিয়ে দিলো । আর এতেই কিটুর 'মন দিয়ে' অঙ্ক করার শেষ ইচ্ছেটাও উবে গেল । এই জন্যেই না অঙ্ক জিনিসটাকে একদম ভালো লাগে না কিটুর ! আচ্ছা , কেউ যদি সারাজীবন অঙ্ক না-ই করে, সে কি বড় হবে না ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী ছোটবেলায় অঙ্ক কষতেন ?
'পটাস্' করে আরেকটা ঘা পিঠে পড়তেই হঁংউস ফিরে পেল কিটু ।
"আবার অন্যমনস্ক হচ্ছিস ? সরলের একটা স্টেপে কতক্ষণ আটকে থাকবি র্যা ? ইজিকুয়ালটু দিয়ে পরের স্টেপটা লেখ্ না ।"
আজকের জলটা অনেক দূর গড়ালো । কারণ , আজ অন্যদিনের মত রাত দশটা না করে মামা সন্ধ্যে সাতটাতেই দোকান বন্ধ করে ফিরে এসেছে । অঙ্কের কসরৎ তখনও চলছে । মামা বাড়ি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল মাস্টারের অভিযোগের পাহাড়--- "কিরীটির কোনো মন নেই অঙ্কে । গতবার বারো পেয়েও চেতনা হয়নি । এ'ভাবে চললে ফের গাড্ডু পেতে হবে , এই বলে রাখলুম ।" ইত্যাদি ইত্যাদি ।
এবং তার রেশ রাতে খেতে বসেও চলল । মামী তো এমনিতেই খড়্গহস্ত হয়েই থাকে , আজ ফের সেই "আমার যে দিকে দু'চোখ যায় চলে যাবো " শুরু হয়ে গেল ( যদিও যায় না কোথায় কোনোদিনও ) ।
সত্যিই কি সে 'গন্ডমূর্খ' ? কেন আমি তবে অঙ্ক পারি না ? আগেকার দিনে হলে নাকি তাকে এই ক্লাস ফোরেই দু'বচ্ছর ঘষটাতে হত । ভাগ্যিস এখন ক্লাসে ফেল করিয়ে বসিয়ে রাখার পাট চুকে গেছে । আচ্ছা , বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে কেমন হয় ? কোন্ দিকে যাবে ? এ'দিকে এনজিপির দিকে না ও'দিকে পিসির বাড়ি গৌহাটি ? অনেক ছেলেই তো বাড়ি থেকে পালায় । অনির্বাণের ছোটমামা তো বাড়ি থেকে পালিয়ে সেই কানাডা চলে গিয়েছিল । এখন এলে তাকে সবাই কত মান্যি করে !
"কিঁকু , ওঁ কিঁকু ? ঘুঙোএঁ ঙাকি ?"
মুখ বুজে 'উঁ উঁ' করে কেউ কথা বললে এমন শোনায় , যা আধা বোঝা যায় , আধা অনুমান : "কিটু ও কিটু , ঘুমোলে নাকি ?"
কে ? কে বলল ? তাকেই ডাকছে না ? বিছানায় সটান উঠে বসে কিটু । এ'দিক ও'দিক তাকাতে লাগল ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে । কৈ , কেউ নেই তো ? জানলার ধারে গিয়ে বাইরে মস্ত ডুমুরগাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল কিটু । কেউ নেই । দোতলার এই ঘরে তো থাকেও না আর কেউ , কিটু ছাড়া । মামার হার্ট এটাক হয়ে থেকে নিচেই শোয় ।
'টু উ টু উ উ টু উ উ উ টিট্ টিট্ টিট্ ……..'
হঠাৎ সেই পাখিটার শিস্ শোনা গেল , তেমনই করুণ স্বরে । আজ এতো রাতে এসেছে ? ডাকছে একদম কাছ থেকেই , যেন জানলার ধারেই বসে আছে , অনেক কাছে , 'টু উ টু উ উ টু উ উ উ টিট্ টিট্ টিট্ ……..'
পাখিটা কি আজ জানলার কাছেই চলে এসেছে ?
আধঘন্টা হল কারেন্ট চলে গেছে । কিটু ঘরের কোণে রাখা হারিকেনের আলোটা একটু উস্কে দিতে পেছনে ফিরেছে , ঠিক জানলার ধার থেকেই ফের কে যেন বলে উঠল , "কিঁকু ও কিঁকু , ঙুমি অঙ্ক কাও ঙা ? " সেই যেন মুখ বুজে কথা বলা , যদি ও বুঝতে অসুবিধে হয় না । বলছে , "কিটু ও কিটু । তুমি অঙ্ক পারো না ? "
বনের পাখি কথা বলে ? এ'রকম প্রায়-মানুষের মত ? ভূত-টুত নয় তো ? ভূত আর রূপকথা মিলিয়ে শ' খানেক গল্প পড়া আছে কিটুর , কৈ এমনটা তো কোথাও পড়ে নি ! ক্লাস নাইনের বিশ্বজিতদা অবশ্য একবার গম্ভীরভাবে বলেছিল , "আমাদের এই জলপাইগুড়ি জেলার একটা ভৌতিক ইতিহাস আছে , তা জানিস ?!" বিশ্বজিত দা আবার শীর্ষেন্দুর লেখার পরম ভক্ত !
"কিটু , তোমার কোনো ভয় নেই " , এবার পাখির গলাটা অনেক স্পষ্ট হয়ে এসেছে , "তুমি এটা রাখো । অঙ্ক মিলে যাবে ।"
তার পরেই কোনো পাখির ডানা ঝাপটে উড়ে যাবার শব্দ ।
কিটু দৌড়ে জানলার কাছে এসে ডাইনে-বাঁয়ে অনেক দূর পর্যন্ত কিচ্ছু দেখতে পেল না অন্ধকারের মধ্যে ।
পাখিটা কি কিটুকে কিছু দিয়ে গেল ? কী ? ভালো করে বোঝবার আগেই তো সে-পাখি হাওয়া !
এ'সব ভাবতে ভাবতেই কখন যে রাতের ঘুমটা এসে গেছে , কিটুর খেয়ালই নেই ।
"কৈ দেখি দেখি ", কিটু পড়া ছেড়ে লাফ মেরে গেছে । জানলার ধারে মেঝেতে বিঘৎ খানেক লম্বা এক চিনেমুরগির পালক পড়ে আছে !
কিটুর মনে পড়ে গেল কালরাতে সেই পাখির খোনাগলার কথা বলা , সেই আশ্বাস ।
"কৈ দাও দাও ওটা আমায় । ওটা আমার "।
মেঝে থেকে তুলে রঙীন পালকখানাকে অঙ্ক খাতার পাতার ফাঁকে ঢুকিয়ে নেয় কিটু । বেশ চমত্কার রঙচঙে তো পালকখানা !
থার্ড পিরিয়ডে অঙ্ক । বীরেনবাবু বোর্ডে এক মস্ত সিঁড়ি ভাঙা লিখে দিয়ে ঘুরে ঘুরে ক্লাস প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন , যেমন করেন । সকলের সঙ্গে কিটুও ধরেছে অঙ্কটা সেকেন্ড স্টেপে আগে মাথায় রেকারিং-এর কাজটা করে নিতে হবে , তারপর ফার্স্ট ব্রাকেট , তারপর সেকেন্ড । এ'---এ'--- এই উত্তরটা হল …….এক । অঙ্কটা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছে যখন --- অবাক কান্ড , ক্লাসের আর কারও হয় নি অঙ্কটা তখনও , ফার্স্ট বয় জয়ন্তরও না ! বীরেনবাবু অবাক চোখে তাকিয়ে এগিয়ে এলেন তারদিকে , " কি রে , তোর হয়ে গেছে ? দেখি উত্তরটা ?"
বীরেনবাবুর সঙ্গে সঙ্গে সারা ক্লাসের দৃষ্টি তার দিকে ! 'কিটুচরণ' অঙ্কে ফার্স্ট , সারা ক্লাসের মধ্যে ? এবং এই অঙ্কটা জয়ন্তও মেলাতে পারলো না । বোর্ডে কষে দিয়ে , দ্বিতীয় অঙ্কটাও এবার লিখে দিলেন বীরেনবাবু স্যর , " নাও জয়ন্ত , দেখি এবারও কিরীটি তোমায় মারতে পারে কিনা ।"
ও: এই অঙ্ক ? তিন মিনিটও লাগল না কিটুর । উত্তেজনায় বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল কিটু , "হরির গতিবেগ ঘন্টায় আট কিমি !"
এবার আর বীরেনবাবু ততটা খুশী হলেন না , "আ: দাঁড়া না । সবাইকার কি হয়েছে ? তোকে বলিচি চেঁচিয়ে উত্তরটা সারা ক্লাসকে বলে দিতে ? " এগিয়ে এসে কিটুর খাতায় অঙ্কের স্টেপ গুলো দেখতে দেখতে খিঁচিয়ে উঠলেন বীরেন বাবু ।
আসলে , কিটু নিজেই বড্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ে ছিল নিজের সাফল্যে ।
ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়া মাত্রই সারা ক্লাসের ছেলেরা উঠে এসে ঘিরে ধরে কিটুকে , "কী রে কিটুলাল , আজ যে ম্যাজিক দেখালি বড় !" বা , "কী করে পারলি রে তুই এই কঠিন 'সরল কর'-টা ? কাল কি স্যর তোকে বাড়িতে এই অঙ্কগুলোই করিয়ে দিয়েছিলেন নাকি ?"
না , বীরেনবাবু স্যর কিটুকে এ' অঙ্কগুলো বাড়িতে কষিয়ে দেননি । দেবার কথাও নয় । তার আসলে 'হয়েছে' যে সত্যি কী , সেটা কিটু নিজেই জানে না । অবাক কিটু নিজেও কম হয়নি !
আজ আর বিকেল হতেই বল খেলার মাঠে যেতে ইচ্ছে করল না কিটুর । বিকেল বিকেল "প্রশ্নমালা - ৭" নিয়ে বসতে বসতেই এক দুই তিন চার করে করে দেড় ঘন্টার মধ্যেই পঁচিশটা অঙ্ক সাবাড় ! অঙ্কগুলো যে আসলে এতো সহজ , কিটু আগে সেটা কোনো দিন বোঝেই নি ।
এর দশ মিনিট পরে নিচের গেটে যখন বীরেন বাবুর "কিটু --- কিরীটি " ডাক শোনা গেল কিটু তখন প’ড়ে আসা বিকেলের আলোয় ডুমুর গাছের ডালে সেই নাম-না-জানা পাখিটার খোঁজ করছে ।
অঙ্কে কিটুর হঠাৎ এমন অসাধারণ উন্নতিতে বীরেনবাবু স্যরও অবাক কম হন নি । আজ বাইশ বছর ছাত্র পড়াচ্ছেন , একদিনের মধ্যে কোনো ছাত্রের এ'হেন অভাবনীয় উন্নতি তিনি কক্ষনো দেখেন নি । গতকালের পিটুনিতে কাজ হল ? তা , এমন কিল-চড় তো কিটুর ঘাড়ে-পিঠে আকছার পড়ছে ।
একটার পর একটা অঙ্কে টিক্ দিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন স্যর , আর অবাক চোখ তুলে তুলে কিটুর দিকে তাকাচ্ছেন ।
"পঁচিশখানা অঙ্কই তুমি নিজে নিজে করে ফেলেছ , কিরীটি , কেউ বলে-টলে দেয় নি তো ? " চেকিং শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন স্যর ।
"না স্যর , কে বলে দেবে ? কে আছে ?"
"হুম্ , তা বেশ তা বেশ । কিপ ইট আপ মাই চাইল্ড , কিপ ইট আপ ! " আজ দেড় ঘন্টার জায়গায় পৌনে ঘন্টাতেই ক্ষান্ত দিয়ে চটিতে পা গলালেন বীরেনবাবু স্যর , 'কড়া'-বলে যাঁর সুনাম বা বদনাম আছে ।
স্যর চলে যেতেই কিটু লাফ দিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে জানলার পাশটিতে আর ঢঁংউড়ে ঢঁংউড়ে দেখছে গাছের ডালপালার ফাঁকে , ---সেই পাখিটা আজ এলো কিনা । না: , আজ আসেনি পাখিটা । আর নিচে মামির ঘরে যা জোর জোর টিভি চলছে , এতো আওয়াজে পাখি আসে ? পালকখানা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল কিটু ।
খবরটা চাউরেছে । কী করে ? রাতে খেতে বসে দিদি বলল , "কী রে কিটে , তুই নাকি আজকাল ক্লাসে অঙ্কয় ফাস্ট হচ্চিস ? "
"টুকু , ওর পেছনে লেগো না । ওকে খেতে দাও ।" বেগুনভাজা দিয়ে রুটি চিবোতে চিবোতে গম্ভীর স্বরে মামা বললেন ।
"না বাবা , তুমি জানো না । কিটু না………"
তারপর গম্ভীর মামির দিকে তাকিয়েই চুপ করে যায় দিদি ।
ডাকটা খুব হালকাস্বরে যদিও , তবু একবার শুনেই তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছে কিরীটিরঞ্জন । এর প্রতীক্ষাতেই না পুরো দুটো দিন বসে ছিল সে ! এখন শুনশান রাত । এক পশলা বিস্টি হয়ে গেছে বোধহয় এর মধ্যে । এখন চকচকে চাঁদ উঠেছে ।
"এসেছ ? এসেছ তুমি ? কোথায় ? সামনে এসো । দেখা দাও "। কাতর স্বর বলল কিটু ।
"কাল সকালে আট আর নয় প্রশ্নমালা দুটো পুরো হয়ে যাওয়া চাই ।" পাখির গলার স্বর এখন খুবই স্পষ্ট !
"দু'-দু'টো প্রশ্নমালা , একই দিনে , একই সঙ্গে ? " অবাক , ভয় পাওয়া গলায় প্রশ্ন করে কিটু ।
না , আর কোনো উত্তর নেই । পাখির ডানা ঝাপটেরও কোনো শব্দ পাওয়া গেলে না যদিও । ও' কি তবে লুকিয়ে বসে আছে গাছের ডালে ?
"কোথায় তুমি ? সামনে এসো না ?" জানলার রেলিং দু'হাতে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে কিরীটি ।
"কে রে কিটু ? কার সঙ্গে কথা বলছিস ? " নিচের উঠোনে মামা বেরিয়ে এসেছেন ।
এই রে ! মামা জেগে আছে এখনও ? দোকানের হিসেব আজ মিলছিল না বোধহয় ।
সপ্তাখানেক পরে আর থাকতে না পেরে সতুকে বলেই ফেলল কিটু । সতু হল কিটুর একমাত্র বন্ধু । সে-ই কেবল কিটুর দু:খুটা বোঝ কারণ অঙ্কে সে-ও রেগুলার গাড্ডা খায় । সতুর হয়েছিল টাইফয়েড । দু'-সপ্তার বেশি স্কুলে আসেনি । আজ বিকেলে তাই সটান ওদের বাড়িতেই গিয়ে হাজির হল কিটু ।
"কি হে কিরীটিরঞ্জন , তুমি নাকি দারুণ ভালো ছাত্র হয়ে উঠেছ ?" সামনের উঠোনে পায়চারি করছিলেন সতুর বাবা । চমকে উঠল কিটু ! সে কি , খবরটা এখানেও এসে পৌঁচেছে ?
"হঁযা , কাল শঙ্করও এসেছিল । বলছিল ।" সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সতু বলল , "আয় ওপরে আয় কিটু । আমি ভালো আছি । কাল থেকে ইস্কুল যেতে বলেছেন ডাক্তারবাবু ।"
পালকটা খাতার ফাঁকে নিয়েই এসেছে কিটু । দোতলার ঘরে ঢুকে এ'দিক-উ'দিক কেউ নেই দেখে নিয়ে সন্তর্পণে সেটি সতুর পড়ার টেবিলে ওয়েট চাপা দিয়ে রাখল কিটু ।
"কী রে এ'টা ? মুরগীর পালক ? "
"আমার সাফল্যের চাবিকাঠি !" বেশ রহস্যগল্পের ঢঙে বলল কিটু ।
"মানে ?"
"মানে"-টা এবার পুরো প্রাঞ্জল করে কিটু তার প্রাণের দোস্তের কাছে : সেই প্রথমরাতে পাখির খোনাগলার কথা থেকে পালক পাওয়া ও এরই মধ্যে পুরো বছরের অঙ্কের সিলেবাস তার শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত !
প্রথমটায় বিশ্বাস করতে চায় নি সতু । পরে চোখ বড় বড় করে বলল , "সত্যিসত্যিই যদি এ' পালকের কোনো ক্ষমতা থাকে , কিটু , দিয়ে যা না আমায় এটা দু'দিনের জন্যে । তোর তো পুরো বছরের সিলেবাস শেষ হয়েই গেছে । আমিও না হয় উত্রে যাই এ' যাত্রা ।"
"রেখে দে'। " পরম উদারতায় প্রাণের বন্ধুর কাছে ব্রহ্মাস্ত্রখানি ছেড়ে আসেন কিটুবাবু ।
কিন্তু না: । এ' পালক সতুর ওপর কোনো কাজ ই করল না । দু'-দিন পরে সবার নজর বাঁচিয়ে পালকটা কিটুকে ফেরৎ দিতে দিতে হতাশ সতু বুড়ো আঙুল নেড়ে 'কলা' দেখালো ।
এবং , এ' দু'দিন কিটুরও আর অঙ্কের বই ছঁংউতে ইচ্ছে করেনি , সেই আগের দিনের মত । অঙ্কে ফের তার অনীহা দেখে বীরেনবাবু স্যর ধমকেছেন , "কী হে কিরীটিরঞ্জন , কোথায় গেল সে-মন ? আবার কেন আনমনা ?"
অতএব ? অতএব , পালকখানি ফের ফেরৎ নিয়ে নিল কিটুচরণ ।
আজ সারা রাতই প্রায় জেগে বসে ছিল সে । মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে ঢুলে এলেও ফের সজাগ হয়ে উঠেছে । কী জানি , পাখিটা হয়ত রোজই আসে । তাকে ঘুমন্ত দেখে ফিরে ফিরে যায় । আজ ধরতে হবে ও একটা পাক্কা ফয়সালা করতে হবে ওর সঙ্গে ।
কিন্তু রাতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে , কিটু নিজেই খেয়াল করেনি । ঘুম ভাঙলো সেই করুণ সুরে একটানা পাখির ডাকে , "টু--টু--টু--টু--টুট্--টুট্--টুট্--টুট্------"।
ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেছে কিটু ।
ভোর হয়ে এসেছে , যদিও এখনও যথেষ্ট অন্ধকার । আজ এতো ভোরে এসেছে পাখি টা ? ডাকছে সেই জানলার ধারের ডুমুরগাছটায় বসেই ।
আজ দেখতেই হবে পাখিটাকে । লাফ মেরে বড় জানালাটার ধারে এসে দাঁড়ালো কিটু । আর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল ডাকটা ।
সেকি ! পাখি কি রাগ করল ? থেমে গেল কেন তবে ? কিটু এবার গঁংউড়ি মেরে জানলার তলাটায় বসে পড়ল । আর কী আশ্চর্য , তখনই "টু--টু--টু--টু----" ডাক ফের শুরু হয়ে গেল ।
পাখিটা কি তবে দেখা দিতে চায় না ? না দিক্ , আমার উপকারী বন্ধু সে , ভাবে কিটু । হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের তলা থেকে কাজুবাদামের ঠোঙাটা টেনে নিয়ে এসে জানলার পাটার ওপর রেখে এলো সে যাতে পাখি দেখতে না পায় তাকে । তিনদিন থেকে বন্ধুর জন্যে এ' নজরানা কিনে এনে রেখেছে সে ।
জানলার তলায় কতক্ষণ ঘাপটি মেরে বসে ছিল , খেয়াল নেই কিটুর । পায়ে ঝিন্ ঝিন্ ধরতে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গেল সে ! এর ই মধ্যে জানলার পাটা থেকে কাজুর ঠোঙা হাওয়া ! নিয়ে গেছে তার বন্ধু ! আনন্দে মনটা ভরে উঠল কিটুর !!
এরপর থেকে সেই নাম-না-জানা পাখিটার জন্যে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকাটা এই দৈনিক শখ হয়ে দাঁড়ালো কিরীটি রঞ্জনের : কবে সে আসে , কবে সেই "টুট্--টুট্--টুট--টুট----" করুণ সুর শোনা যায় !
শেষে প্রায় সাতদিন পরে আরেক লোডশেডিংয়ের সন্ধ্যায় ফের "টু--টু--টু--টু----" ডাক শোনা গেল । কিটু কিন্তু আজ লাফ মেরে ওঠেনি , যদি সে ভয় পেয়ে পালায় ? এবার জানলার গায়েই সেই মুখ-বোজা কথা , "কিঁকু , ও' কিঁকু --- ইকিঁহাসের কালক কাই ?"
"ইতিহাসের পালক ? না ইতিহাসের জন্যে কোনো পালক চাই না আমার । আমি এমনিতেই ইতিহাসে ভালো ।" কিটুর মুখ থেকে আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো , "তুমি সতুর জন্যও একটা পালক দেবে , পাখি ?"
"হুঁ--হুঁ--হুঁ-হুঁ---"
"হাসছ কেন পাখি ?" , মুখ না ঘুরিয়েই প্রশ্ন করে কিটু ।
"তুমি বড্ড ভালো ছেলে কিটু । সেদিন আমার বাচ্চাগুলোকে যত্ন করে মাটি থেকে তুলে এনে দিয়েছিলে , তাই তো তোমাকে পালক দিলাম" , এতোদিনে পাখির কথা কিটুর কানে অনেক পরিষ্কার হয়ে এসেছে । ও , পালক তাহলে এমনি এমনি পাওয়া যায় না , 'অর্জন' করতে হয় !
"পাখি , ও পাখি , তুমি বড্ড ভালো গো । মামা বলে কিটুকে যে অঙ্ক শেখাবে সে ভগবান ! তুমি ভগবান , পাখি ? পাখি , তুমি আমার মাকে এনে দিতে পারো ?" কিটুর গলা কান্নাভেজা ।
পাখি চুপ ।
"আমার বাবাকে ? "
কোনো সাড়াশব্দ নেই পাখির ।
কিটুও চুপ ।
"পাখি ও পাখি ! ও' নাম-না-জানা পাখি ! " এবার বড় কাতর স্বর ডাকে কিটু , "তুমি চলে যেও না বন্ধু আমার !"
"টু--টু--টু--টু--টুট্--টুট্--টুট্--টুট্------" তেমন ই করুণ সুরে ডেকে জানান দেয় পাখি , ‘আছি’ !
"পাখি , আমি ক্লাস ফাইভে উঠলে আরেকটা পালক দেবে তো আমায় ?"
"গোগোঁ ।"
"দেবে ? বা: , বেশ । ক্লাস সিক্সে যখন উঠবো ?"
"দোবো ।" এবার আরও স্পষ্ট স্বর পাখির ।
"বা: , পাখি বা: ! তুমি আমাকে প্রতি ক্লাসে একটা করে পালক দিয়ে যাবে ? "
"আমি যদ্দিন বাঁচব ", স্পষ্ট বলে পাখি জানলার একদম কাছ থেকে । আর বলেই হুস করে ডানার আওয়াজ তুলে ডুমুর গাছে ছেড়ে উড়ে যায় সেই আশ্চর্য পাখি !
আজ স্কুলে হৈ হৈ পড়ে গিয়েছিল । গর্বিত বীরেনবাবু তাঁর যোগ্য ছাত্রকে নিয়ে ওপরের ক্লাসে হাজির হয়েছিলেন । ক্লাস ফাইভের অঙ্ক সট্-সট্ করে বোর্ডে ক’রে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল কিটু হেডমাস্টার মশায়ের সামনে । গর্বিত স্যর বুক ঠুকে বললেন , "আমার ছাত্র ! এ' ছেলে মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করবে , দেখে নিও ।"
তারপর থেকেই মনটা কেমন খারাপ হতে শুরু করেছে কিটুর ।
এ' সব কৃতিত্ব তার নয় , শুধু এক পাখির পালকের ?! সেই পাখিটা যখন আর আসবে না , তাকে আর পালক দেবে না , মরেই যাবে যখন , তখন কি কিটু আবার সেই ক্লাস ফোরের ষষ্ঠ প্রশ্নমালায় ফিরে যাবে ? লোকে হাসবে না ? দুয়ে দেবে ।
কাঁধের ব্যাগটা খুলে ব্রিজের পাঁচিলের ওপর রাখল কিটু । অঙ্ক খাতা থেকে বের করল সেই বিঘত্-প্রমাণ রঙীন পালকখানা । ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল দু'-একবার । অস্তসূর্যের ম্লান আলো এসে পড়েছে সেই রঙীন পালকের গায়ে-পিঠে , আর ঝলমল করে উঠছে সেই পালক ।
তারপর 'ফঁংউ:' দিয়ে উড়িয়ে দিলো কিটু পালকটাকে । উড়ে উড়ে উড়ে উড়ে পালকটা যতক্ষণ নিচে নদীর জলে গিয়ে পড়ল , তাকিয়ে রইল পালকটার দিকে , যদিও অস্ত আলোয় শেষটুকু আর দেখা গেল না ভালো ।
এবার ফিরে চলল কিটু বাড়ির দিকে । বীরেনবাবু স্যর এসে পড়বেন ।
না: , এবার থেকে মন দিয়ে অঙ্কটা কষতে হবে ॥
(পরবাস-৪৭, জানুয়ারী, ২০১১)