• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৯ | জুলাই ২০২০ | গল্প
    Share
  • চিনির বাড়ি : সিলবিনা ওকাম্পো
    translated from Spanish to Bengali by শর্বরী গরাই

    মূল স্প্যানিশ 'La casa de azucar' থেকে বাংলায় অনুবাদ

    শর্বরী গরাই





    কুসংস্কারগুলো ক্রিস্তিনাকে কিছুতেই ছাড়ছিল না। আবছা ছবিওলা কয়েন, কালির আঁচড়, কাচের ওপার থেকে দেখা চাঁদ, সিডার গাছের কান্ডে হঠাৎ নিজের নামের আদ্যক্ষর চোখে পড়লে ও আতঙ্কে পাগল হয়ে যেত। যখন আমাদের আলাপ হয়েছিল, ক্রিস্তিনা ছিল একটা সবুজ রঙের ড্রেসে, যেটা একেবারে ছিঁড়ে না যাওয়া পর্যন্ত রোজ পরতো, ও হ্যাঁ, আমাকে বলেছিল ওটা ওর জন্য পয়া, আর যখনই অন্যটা, নীলটা, যেটা পরলে ওকে বেশি সুন্দর দেখায়, পরতো, তখন আমাদের দেখাই হত না। এই আজগুবি বাতিক পাল্টানোর জন্য লড়াই করতাম। ওর শোবার ঘরের ভাঙ্গা আয়নাটা ওকে দেখিয়েছিলাম, এমনকি জোরাজুরি করতাম ওর সুবিধামত ও যেন ভাঙা আয়নার টুকরোগুলো কোনো পূর্ণিমার রাতে জলে ফেলে দেয়, দুর্ভাগ্য দূর করার জন্য, কিন্তু ওটা ও রেখে দিয়েছিল। বাড়ির আলোগুলো হঠাৎ করে নিবে গেলে ও কখনো ভয় পেত না। সবাই জানে এটা নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর সঙ্কেত, তা সত্ত্বেও ও শান্তভাবে যতগুলো খুশি মোমবাতি জ্বালাত। সবসময় বিছানার ওপর টুপিটা রাখত ফেলে, অন্য কেউ এমন ভুল করবেই না। ওর আতঙ্কগুলো ছিল ব্যক্তিগত। এইসবে ওর নিজের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধা পেত। যেমন, ডিসেম্বর মাসে স্ট্রবেরি কিনতে পারত না, শুনতে পারত না বিশেষ কোনো মিউজিক। লাল লাল মাছ দিয়ে বাড়ি সাজাতে খুব ভালোবাসত, কিন্তু সেটাও ছাড়তে হল। কতগুলো রাস্তা ছিল যেগুলো আমরা পার হতে পারতাম না, বিশেষ কিছু লোক, বিশেষ কিছু সিনেমা আমরা বারবার দেখতে পারতাম না। আমাদের সম্পর্কের শুরুর দিকে এইসব কুসংস্কার আমার বেশ ভালোই লাগত, কিন্তু পরে আমি বিরক্ত হতে শুরু করলাম আর তারপর আমি সিরিয়াসলি চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমাদের এনগেজমেন্টের সময় আমরা একটা নতুন ফ্ল্যাট খুঁজতে বাধ্য হলাম। কারণ? ওর মনে হত আগের বাসিন্দাদের প্রভাব পড়বে ওর জীবনে (কখনও আমার জীবনের কথা বলত না, যেন বিপদ কেবল একা ওকেই সাবধান করে দিচ্ছে, আমাদের জীবন আর ভালোবাসার বাঁধনে আটকে থাকবে না)। যেখানে আগে কেউ কখনও থাকেনি এমন একটা ফ্ল্যাটের খোঁজে শহরের সব এলাকায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে পৌঁছে গেলাম শহরের দূরতম প্রান্তে—কিন্তু হায়, সব কটাই হয় বিক্রি হয়ে গেছে, নয় ভাড়া হয়ে গেছে। সবশেষে একটা ছোট্ট বাড়ি খুঁজে পেলাম, মন্তেস দে ওকা রোডে, মনে হচ্ছিল যেন সেটা চিনি দিয়ে তৈরি। ধবধবে সাদা বাড়িটা কী অসম্ভব ঝকঝক করছিল। টেলিফোন ছিল আর ছিল সামনে ছোট্ট একটা বাগান। মনে হল বাড়িটা হয়তো সম্প্রতি তৈরি হয়েছে, কিন্তু জানতে পারলাম যে ১৯৩০এ ওখানে একটা পরিবার থাকত, আর তারপরে ভাড়া দেবার জন্য বাড়ির মালিক একটু অদলবদল করেছেন। কিছুটা বাধ্য হয়েই আমি ক্রিস্তিনাকে বুঝিয়েছিলাম যে বাড়িটাতে এর আগে কেউ কখনও থাকেনি, এটা একবারে আদর্শ, আমাদের স্বপ্নের বাড়ি। ক্রিস্তিনা বাড়িটা দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘আমরা যে ফ্ল্যাটগুলো দেখেছি, এটা সেগুলোর চেয়ে কত আলাদা! এখানে পরিষ্কার বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়, এখানে কেউ আমাদের জীবনে ঢুকতেও পারবে না আর হাওয়ায় ভেসে থাকা বিষাক্ত চিন্তা ভাবনাগুলো দিয়ে তাকে নোংরাও করতে পারবে না।’

    অল্পদিনের মধ্যেই আমরা বিয়ে করে ওখানে থিতু হলাম। আমার শ্বশুর শাশুড়ি আমাদের উপহার দিলেন শোবার ঘরের আসবাবপত্র আর আমার বাবা মা দিলেন খাবার ঘরেরগুলো। বাকিটা আমরা একটু একটু করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিলাম। আমার ভয় ছিল প্রতিবেশিনীদের মাধ্যমে ক্রিস্তিনা হয়তো আমার মিথ্যেটা ধরে ফেলবে, কিন্তু ভাগ্য ভালো ও কেনাকাটা করত পাড়ার বাইরে আর প্রতিবেশিনীদের সঙ্গে কখনও কথা বলত না। আমরা সুখী ছিলাম, এতো সুখী যে কখনো কখনো আমার ভয় করত। একটা টেলিফোন এসে আমার আশা চুরমার করে না দেওয়া পর্যন্ত আমার বিশ্বাস ছিল চিনির বাড়ির শান্তি কখনো ভাঙবে না। কপাল ভালো ক্রিস্তিনা সেদিন ফোনটা ধরেনি, কিন্তু হয়তো আর একদিন ধরত। যে ফোন করেছিল সে সেনিওরা বিওলেতার কথা জিজ্ঞাসা করছিল, নিসন্দেহে সে আগের ভাড়াটেকে খুঁজছিল। যদি ক্রিস্তিনা জানতে পারত যে আমি ওকে ঠকিয়েছি, আমাদের সুখের দিন ফুরিয়ে যেত, আমার সঙ্গে আর কথা বলত না, ডিভোর্স চাইত। অতটা বাড়াবাড়ি না করলেও, একসঙ্গে থাকার জন্য হয়তো এই বাড়িটা আমাদের ছেড়ে দিতে হত। হয়তো যেতে হত ভিলা উরকিসায়, বা কিল্মেসেস-- ওখানকার বোরডিং হাউসগুলোর মালিকেরা আমাদের এক টুকরো জমির আশ্বাস দিয়েছিল, যেখানে আমরা বানিয়ে নিতে পারতাম (কী দিয়ে? জঞ্জাল দিয়ে! ভালো ভালো জিনিষ আমার পয়সায় কুলোবে না।) একটা ঘর আর একটা রান্নাঘর। প্রতি রাতে আমি খেয়াল করে রিসিভার নামিয়ে রাখতাম যাতে অসময়ের কোন ফোন আমাদের জাগিয়ে না দেয়। রাস্তার দিকের গেটে একটা লেটার বক্স লাগালাম, চাবির দায়িত্ব আমার, চিঠি বিলির ভারও।

    একদিন খুব সকালে দরজায় ধাক্কা, কেউ একটা প্যাকেট ফেলে গেল। আমার ঘর থেকে শুনতে পেলাম আমার স্ত্রী বাধা দিচ্ছে, আর তারপর শুনলাম কাগজ ছেঁড়ার আওয়াজ। সিঁড়ি দিয়ে নামলাম, দেখি ক্রিস্তিনার হাতে একটা ভেলভেটের ড্রেস। উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে বলল, “এই মাত্র এটা দিয়ে গেল।” দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে পরে এল ড্রেসটা, বেশ লো-কাট।

    “কবে বানাতে দিয়েছিলে?”

    “অনেকদিন আগে, ভালো লাগছে আমায়? যখন আমরা থিয়েটারে যাব, তখন পরব। তোমার ঠিক লাগছে না?”

    “দাম মেটালে কী দিয়ে?”

    “মা আমাকে কিছু পেসো দিয়েছিল।”

    আমার একটু অদ্ভুত মনে হল, কিন্তু কিছু বললাম না, ওর মনে কষ্ট দিতে চাইনি।

    আমরা দুজনে দুজনকে পাগলের মতো ভালবাসতাম, কিন্তু আমার অস্থিরতা আমাকে বিব্রত করছিল, এমনকি রাতে ক্রিস্তিনাকে জড়িয়ে ধরার সময়েও। মনে হল ওর স্বভাব পাল্টে গেছে। হাসিখুশি থেকে বিষণ্ণ, মিশুকে থেকে চুপচাপ, শান্ত থেকে অস্থির। ওর খিদে পেত না। আর বানাত না আমার খুব প্রিয় একটু গুরুপাক, হুইপড ক্রিম আর চকলেট দিয়ে তৈরি সেইসব জিভে জল আনা মিষ্টি। আগের মতন নাইলনের নেট দিয়ে আর সাজাত না টয়লেট সিটের ঢাকনা, ডাইনিং রুমের শেলফ, আলমারি ও আরও সব জায়গা। চা-এর সময় ভ্যানিলা নিয়ে আর আমার জন্য অপেক্ষা করত না, রাতের শোয়ে থিয়েটার বা সিনেমাতেও আর যেতে চাইত না। এমনকি কেউ আমাদের টিকিট উপহার দিলেও নয়। এক রাতে বাগানে একটা কুকুর ঢুকল কেঁউ কেঁউ করতে করতে। ক্রিস্তিনা ওকে মাংস খেতে দিল, জল খেতে দিল, স্নান করানোর পর (যাতে ওর গায়ের রংটাই পাল্টে গেল) ঘোষণা করল ওকে পুষবে। নামকরণ করা হলো আমোর (ভালোবাসা), কারণ ও আমাদের বাড়ি এসেছিল সত্যিকারের ভালোবাসার সময়। কুকুরটার মুখের তালু ছিল কালো, তার মানে জাতে খাঁটি।

    এক বিকেলে হঠাৎ বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। গেটেই থমকে গেলাম কারণ দেখি বাগানে একটা সাইকেল দাঁড় করিয়ে রাখা – নিঃশব্দে ঢুকলাম, আর একটা দরজার পেছনে লুকিয়ে পড়লাম, ক্রিস্তিনার গলা শুনতে পেলাম।

    “কী চান?” দুবার বলল।

    “আমি আমার কুকুরটাকে খুঁজতে এসেছি –” একটা মেয়ের গলা বলে উঠল। “এতবার এই বাড়িটার সামনে দিয়ে গেছে যে, ও এই বাড়িটাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এই বাড়িটা মনে হয় যেন চিনির। যবে থেকে রঙ করেছে, প্রত্যেক পথচারীর নজর কেড়েছে। কিন্তু আমার ভালো লাগত এর আগেরটা, সেই পুরনো বাড়িগুলোর মতো গোলাপি রোম্যান্টিক রঙ। এই বাড়িটা আমার কাছে ছিল খুব রহস্যময়, এর সবকিছু আমার ভালো লাগত, ফোয়ারাটা, যেখানে ছোট্ট পাখিরা জল খেতে আসত, ফুলে ভরা লতাগুলো, যেমন হলুদ, কমলা, করনেট। আট বছর বয়স থেকে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছি, যেদিন আমরা ফোনে কথা বলেছিলাম সেই দিন থেকে। মনে আছে আপনি কথা দিয়েছিলেন আমাকে একটা ঘুড়ি উপহার দেবেন?”

    “ঘুড়ি তো ছেলেদের জন্য।”

    “খেলনার ছেলে মেয়ে হয় না। ঘুড়িগুলো আমার ভালো লাগত কারণ মনে হত ওগুলো যেন বিশাল বিশাল পাখি, ওদের পাখায় চড়ে ওড়ার স্বপ্ন দেখতাম। আপনার কাছে হয়তো আমাকে ঘুড়ি উপহার দেবার কথা দেওয়াটা একটা খেলা ছিল, কিন্তু আমি সারারাত ঘুমাইনি। পাঁউরুটির দোকানে আমাদের দেখা হয়েছিল, আপনি পিছন ফিরে ছিলেন বলে মুখটা দেখতে পাইনি। সেদিন থেকে আপনার কথা ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি, কেমন হতে পারে আপনার মুখ, আপনার মন, আপনার নকল ভঙ্গি। আমাকে ঘুড়িটা কোনোদিন দিলেনই না। গাছগুলো বলত আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন। এরপর আমরা বাবা-মায়ের সাথে মোরোন শহরে চলে গেলাম। এখন, সপ্তাহখানেক হল আমি আবার এখানে।”

    “মোটে তিন মাস হল এই বাড়িটায় আছি, আর এর আগে আমি কখনো এই এলাকায় আসিনি। আপনি হয়তো গুলিয়ে ফেলছেন।”

    “আমি এইরকমই কিছু ভেবেছিলাম আপনাকে। এতবার কল্পনা করেছি আপনাকে। তার ওপর আবার ঘটনাচক্রে আমার স্বামী ছিল আপনার প্রেমিক।”

    “আমার নিজের স্বামী ছাড়া আমি আর কারো প্রেমিকা ছিলাম না। এই কুকুরটার নাম কী?”

    “ব্রুতো।”

    “একে নিয়ে যান, আমি ভালবেসে ফেলার আগে।”

    “বিওলেতা, আমার কথা শুনুন। যদি কুকুরটাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাই, ও মরে যাবে। আমি ওর যত্ন করতে পারব না। আমরা খুব ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে থাকি। আমি আর আমার স্বামী চাকরী করি, ওকে বাইরে নিয়ে ঘোরানোর জন্য আর কেউ নেই।”

    “আমার নাম বিওলেতা নয়। বয়স কত?”

    “ব্রুতোর? দু-বছর। আপনি ওর সঙ্গে থাকতে চান? আমি মাঝে মাঝে ওকে দেখতে আসব, কারণ ওকে আমি খুব ভালোবাসি।”

    “না আমার স্বামী অচেনা কারোর বাড়িতে আসা পছন্দ করেন, না তাদের থেকে কুকুর উপহার নেওয়া।”

    “তাহলে ওঁকে বলবেন না। প্রত্যেক সোমবার সন্ধ্যা সাতটায় প্লাজা কোলোম্বিয়ায় আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। কোথায় জানেন? সেন্ট ফেলিসিটাস চার্চের সামনে, অথবা যেখানে, যে সময় আপনি চাইবেন সেখানেই আমি অপেক্ষা করব, যেমন কন্সটিট্যুশন ব্রিজে, অথবা লেজামা পার্কে। ব্রুতোর চোখ দুটো দেখেই আমি খুশি থাকব। আমার এই উপকারটা করবেন? রাখবেন ব্রুতোকে?”

    “ঠিক আছে, ব্রুতো আমার সঙ্গে থাকবে।”

    “ধন্যবাদ, বিওলেতা।”

    “আমার নাম বিওলেতা নয়।”

    “আপনি নাম পাল্টেছেন? আমাদের জন্য আপনি বিওলেতা। সবসময় সেই একই রহস্যময়ী বিওলেতা।”

    জোরে দরজার আওয়াজ আর ক্রিস্তিনার হিলজুতোর খটখট শুনতে পেলাম, সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। একটু দেরি করে লুকোনোর জায়গা থেকে বেরোলাম, ভাব দেখালাম যেন তক্ষুনি বাড়ি পৌঁছেছি। দুজনের কথাবার্তায় কোন ছলনা ছিল না বোঝার পরেও, জানি না কেন, এক বোবা সন্দেহ আমাকে ঘিরে ধরছিল। মনে হচ্ছিল যেন আমি থিয়েটারের একটা অংশ দেখলাম, যেটা বাস্তবে আর এক রকম। ক্রিস্তিনার কাছে স্বীকার করলাম না যে, ওই মেয়েটাকে দেখে আমি অবাক হয়েছি। এর পরের ঘটনাগুলোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সবসময় ভয় পাচ্ছিলাম যে ক্রিস্তিনা আমার মিথ্যেটা ধরে ফেলবে। আফসোস করছিলাম কেন আমরা এখানে থাকতে এলাম এই ভেবে। প্রত্যেক বিকেলেই আমি সেন্ট ফেলিসিটাস চার্চের সামনের প্লাজাতে ঘুরে বেড়াতাম, যাতে জানতে পারি ক্রিস্তিনা দেখা করতে এল কিনা? ক্রিস্তিনা যেন আমার অস্থিরতাটা ধরতেই পারছিল না। কখনো কখনো ভাবতাম আমি হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলাম। কুকুরটাকে জড়িয়ে ধরে ক্রিস্তিনা একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করলো--

    “আমার নাম বিওলেতা হলে তোমার ভালো লাগত?”

    “ফুলের নাম ভালো লাগে না আমার।”

    “কিন্তু বিওলেতা তো সুন্দর একটা রঙেরও নাম।”

    “তোমার নামটাই আমার পছন্দ।”

    এক শনিবার, বিকেলের দিকে, ওকে দেখতে পেলাম কন্সটিট্যুশন ব্রিজের ওপর। লোহার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এগিয়ে গেলাম, ও বিরক্ত হল না।

    “কী করছো এখানে?”

    “ঘুরে বেড়াচ্ছি। ওপর থেকে রাস্তা দেখতে আমার ভালো লাগে।”

    “এটা কেমন যেন মনখারাপ করা একটা জায়গা; তাছাড়া আমি চাই না তুমি একা একা ঘুরে বেড়াও।”

    “আমার তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। আর আমি একা ঘুরে বেড়াতে পারব না কেন?”

    “রেলগাড়ির কালো ধোঁয়া তোমার ভালো লাগে?”

    “যানবাহন আমার ভালো লাগে। আমি বেড়ানোর স্বপ্ন দেখি। সে আমি বেড়াতে যাই বা না যাই। ‘যাওয়া আর রয়ে যাওয়া, রয়ে যাওয়া থেকে ছেড়ে যাওয়া’ (Ir y quedarse, y con quedar partirse – Lope de Vega)।”

    আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। ঈর্ষায় পাগল হয়ে (ঈর্ষা কীসে? সব কিছুতে) গোটা রাস্তায় ওর সাথে কথা বললাম না।

    “আমরা হয়তো সান ইসিদ্রিও বা অলিভোস-এ একটা ছোট্ট বাড়ি কিনতে পারি, এই এলাকাটা এত বাজে –” ওকে বললাম, এমন ভাব দেখিয়ে যেন আমার পক্ষে ওইসব জায়গায় বাড়ি কেনা খুব সহজ।

    “এরকম ভেবো না। আমাদের খুব কাছেই আছে লেজামা পার্ক।”

    “ওটা খুবই বাজে। স্ট্যাচুগুলো ভাঙা, গাছগুলো হেলে পড়া, ফোয়ারায় জল নেই, ভিখিরি, বুড়ো আর কানা-খোঁড়ারা ঝোলা নিয়ে যায়, ময়লা ফেলতে বা ঘাঁটতে।”

    “আমি এসব খেয়াল করিনি।”

    “আগে তো তুমি যে বেঞ্চে বসে কেউ রুটি বা কমলালেবু খেয়েছে সেখানে বসতে চাইতে না।”

    “আমি অনেক পালটে গেছি।”

    “যতই পাল্টাও না কেন, ওইরকম একটা পার্ক তোমার পছন্দ হতেই পারে না। আমি জানি যে ওখানে একটা যে মিউজিয়াম আছে তার দরজায় পাহারায় আছে দুটো মারবেলের সিংহ। আর তুমি ছোটোবেলায় সেখানে খেলতে, কিন্ত এসব কিছুই বোঝায় না।”

    “তোমাকে বুঝিই না—” ক্রিস্তিনা উত্তর দিল। আমার মনে হল যেন আমাকে গ্রাহ্য করল না, এমন অবহেলা যা ঘৃণায় পরিণত হতে পারে।

    আমার উদ্বেগ কাটাতে দিনের বেলাগুলো, যেগুলো আমার মনে হতো বছর, ওকে পাহারা দিতাম। প্রতিটা বিকেল চার্চের সামনের চৌমাথায় কাটত আর শনিবারগুলো সেই ভয়ঙ্কর কালো কন্সটিট্যুশন ব্রিজে। একদিন আমি সাহস করে ক্রিস্তিনাকে বললাম--

    “যদি আমরা জানতে পারি যে এই বাড়িতে আগেও কেউ থাকত, তাহলে কী করবে তুমি ক্রিস্তিনা? এখান থেকে চলে যাবে?”

    “যদি এখানে কেউ আগে থেকে থাকে, তাকে হতেই হবে জন্মদিনের কেকের ওপর সাজানো ওই চিনির পুতুলগুলোর মতো। চিনির মতো মিষ্টি এক মানুষ। এই বাড়িটা আমাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে, হয়তো ঢোকার মুখে ওই ছোট্ট বাগানটাই আমাকে শান্ত করেছে, জানি না। সারা পৃথিবীর সমস্ত সোনার বদলেও আমি এখান থেকে যাব না। আর তাছাড়া আমাদের কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। তুমি নিজেই কিছুদিন আগে আমায় বলেছিলে।”

    আমি আর জোর করলাম না, কারণ পুরোটাই জলে যেত। নিজেকেই সান্ত্বনা দিলাম এই ভেবে যে সময় সব ঠিক করে দেবে।

    এক সকালে রাস্তার দিকের দরজায় বেল বাজল। আমি দাড়ি কামাচ্ছিলাম, ক্রিস্তিনার গলা শুনলাম। যখন দাড়ি কামানো শেষ হল আমার স্ত্রী ততক্ষণে আগন্তুকের সঙ্গে কথা বলছে। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম, আগন্তুকের গলার স্বর এত গম্ভীর আর পা দুটো এত বড়ো যে আমি হেসে ফেললাম।

    “যদি আপনি আবার দানিয়েলের সঙ্গে দেখা করতে যান, খুব বেশি দাম দিতে হবে আপনাকে, বিওলেতা।”

    “আমি জানি না কে দানিয়েল,আর আমার নামও বিওলেতা নয়।”

    “আপনি মিথ্যা বলছেন।”

    “আমি মিথ্যা বলি না। দানিয়েলের সঙ্গে দেখা করার কোনো কারণ নেই।”

    “আমি চাই আপনি জানুন ব্যাপারটা কী।”

    “আমি শুনতে চাই না।” ক্রিস্তিনা হাত দিয়ে কান চাপলো।

    আমি ঘরে ঢুকে আগন্তুককে চলে যেতে বললাম। কাছ থেকে দেখলাম ওর গলা, হাত আর পা। সন্দেহ হল যে ওটা মহিলার ছদ্মবেশে কোনো পুরুষ। আমার কী করা উচিত সেটা বোঝার সময় না দিয়েই বিদ্যুৎ চমকের মতো সে অদৃশ্য হয়ে গেল, বেরোবার দরজাটা আধখোলা রেখেই।

    এই ঘটনাটা নিয়ে ক্রিস্তিনা আর আমি কেন যে কোনো কথা বললাম না, সেটা হয়তো আর কোনদিন বুঝতে পারব না। যেন আমাদের ঠোঁটদুটো বন্ধ হয়ে যেত কাঁপা কাঁপা অতৃপ্ত চুমু আর অকাজের কথা ছাড়া বাকি সবকিছুতে। ওই দিনগুলোতে, আমার এত দুঃখের দিনে ক্রিস্তিনার গান গাওয়ার শখ হল। ওর গলার স্বর ছিল মিষ্টি, কিন্তু আমার অসহ্য লাগত, কারণ ওটা যেন সেই গোপন পৃথিবীর অংশ যা আমাকে ওর থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ, যে আগে কখনো গান গায়নি, সে এখন দিনরাত গান গাইছে, জামাকাপড় পরতে পরতে বা, স্নানের সময় বা রান্না করতে করতে বা জানলা বন্ধ করতে করতে।

    একদিন ক্রিস্তিনাকে বেশ জটিল ভাষায় বলতে শুনলাম--“আমার মনে হয় আমি যেন অন্য কারোর জীবন যাপন করছি, আনন্দ, বেদনা, ঠিক, ভুল-- সব অন্যের। আমার ওপরে কেউ ভর করেছে।”

    এইসব তোলপাড় করা কথা না শোনার ভান করলাম, আর তাছাড়া জানি না কেন, আমি পাড়ায় খোঁজ নিতে শুরু করেছিলাম। বিওলেতা কে? কোথায় থাকত? তার জীবনের সব খুঁটিনাটি।

    আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে খাতা কাগজ পেন্সিলের একটা দোকান ছিল। এইসব খোঁজখবরের ব্যাপারে এই দোকানের মহিলাটিকে ছিলেন একেবারে আদর্শ। খুব বকবক করত, সব কিছুতে নাক গলাত, তোষামোদে খুশি হওয়া টাইপের। কাগজ পেন্সিল কেনার বাহানায় এক বিকেলে ওর সঙ্গে আলাপ করতে গেলাম। ওর চোখ, হাত আর চুলের প্রশংসা করলাম। কিন্তু একবারও বিওলেতা শব্দটা উচ্চারণ করার সাহস হল না। ওকে বললাম যে আমরা প্রতিবেশি। অবশেষে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, কে থাকত আমাদের বাড়িতে। মিনমিন করে বললাম---বিওলেতা বলে কেউ থাকত না?

    আমাকে খুব হাবিজাবি কিছু বলল, তাতে আমি আরও অধৈর্য হয়ে উঠলাম। পরদিন মুদির দোকানে গেলাম, অন্য কোনো খবর জোগাড় করতে। আমাকে ওরা বলল যে বিওলেতা এক মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আছে, আমাকে তার ঠিকানাও দিল।

    “এমন এক গলায় গান করি যা আমার নয়। আগে হলে হয়তো আমার খারাপ লাগত, কিন্তু এখন আমার ভালোই লাগে। আমি অন্য মানুষ, হয়তো আমার নিজের চেয়েও বেশি সুখী।” বেশ রহস্যময় ভাবে ক্রিস্তিনা আমাকে বলল।

    আবার এমন ভাব করলাম, যেন শুনতেই পাইনি। আমি কাগজ পড়ছিলাম।

    বিওলেতার খবর জোগাড় করতে, স্বীকার করছি, আমি ক্রিস্তিনাকে অবহেলা করছিলাম।

    ফ্লোরেসে, সেই মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেলাম। ওরা আমাকে আরসেনিয়া লোপেজের ঠিকানা দিলেন, উনি ওর গানের টিচার।

    রেতিরো স্টেশনে ট্রেন পালটে অলিভোসে যাবার ট্রেনে উঠলাম। যাবার পথে এক কুচি বালি আমার চোখে পড়েছিল, তার ফলে, ঠিক যে সময় আমি আরসেনিয়া লোপেজের বাড়ি ঢুকছি, আমার চোখ দিয়ে এমন ভাবে জল পড়তে লাগল যে মনে হচ্ছিল যেন আমি কাঁদছি। বাইরের গেট থেকেই মেয়েদের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, পিয়ানোর বিভিন্ন স্কেলের সাথে গলা সাধছিল, আমার মনে হল ওটা অর্গান।

    লম্বা, দোহারা, ভয়াল চেহারার আরসেনিয়া লোপেজ করিডরের ভেতরের দিকে দেখা দিলেন, হাতে একটা পেন্সিল। কোনো রকমে বললাম যে আমি বিওলেতার খবর নিতে এসেছি।

    “আপনি কি স্বামী?”

    “না, আমি আত্মীয়।” রুমাল দিয়ে চোখ মুছে উত্তর দিলাম।

    “আপনি হয়তো তাঁর অসংখ্য স্তাবকদের একজন হবেন,” আমার হাত ধরে আধবোজা চোখে বললেন, “এসেছেন সবাই যা জানতে আসে, কেমন ছিল বিওলেতার শেষের দিনগুলো? বসুন। একজন মরে গেছে বলেই সে বিশ্বস্ত, নিষ্পাপ, ভালো হবে এরকম ভাবার কোনো দরকার নেই।”

    “আমাকে সান্ত্বনা দিতে চান?” প্রশ্ন করলাম।

    উনি আমার হাত ওর ভেজা ভেজা হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, আপনাকে সান্ত্বনা দিতে চাই। বিওলেতা শুধুমাত্র আমার ছাত্রীই ছিল না, ও ছিল আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। হ্যাঁ, আমাকে পছন্দ করত না। হয়তো আমাকে যথেষ্ট গোপন কথা বলে ফেলেছিল, আর একটা কারণ, আমাকে ও ঠকাতে পারেনি। শেষের যে ক’দিন ওকে দেখেছি, খুব তিক্ত ভাবে নিজের ভাগ্যকে দুষত। হিংসায় মরে যেত। একটানা বলে যেত, ‘কেউ আমার জীবনটা ছিনিয়ে নিয়েছে, কিন্তু ওকে অনেক দাম দিতে হবে। আমি আমার ভেলভেটের ড্রেসটা পাব না, ও পাবে, ব্রুতো ওর হবে। পুরুষেরা মেয়ে সেজে আমার বাড়িতে না এসে ওর বাড়িতে আসবে। আমি আমার স্বর হারাব আর সেটা চলে যাবে ওই অযোগ্য মহিলার গলায়, আর কোনোদিন আমি আর দানিয়েল কন্সটিট্যুশন ব্রিজে এক অসম্ভব ভালোবাসায় দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরব না।’”

    আরসেনিয়া লোপেজ আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, “মন খারাপ করবেন না। অনেক বিশ্বস্ত মহিলা পাবেন, আমরা জানি যে ও খুব সুন্দর ছিল। কিন্তু সৌন্দর্যই কি দুনিয়ার একমাত্র ভালো জিনিষ?”

    উনি তাঁর সহানুভুতি দেখাতে আমাকে বিদায়ের সময় জড়িয়ে ধরতে এসেছিলেন, কিন্তু হতবাক, আতঙ্কিত আমি আরসেনিয়া লোপেজকে আমার পরিচয় না জানিয়েই ওই বাড়ি থেকে চলে এলাম।

    সেই দিন থেকে ক্রিস্তিনা, অন্তত আমার কাছে, বিওলেতায় পরিণত হল। সবসময় আমি ওকে অনুসরণ করার চেষ্টা করতাম, ওকে ওর প্রেমিকদের সঙ্গে দেখতে পাওয়ার জন্য। আমি নিজেকে ওর থেকে এতটাই দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম যে ওকে অচেনা মহিলার মতো দেখতাম। এক শীতের রাতে সে পালিয়ে গেল। ভোর পর্যন্ত তাকে খুঁজলাম।

    ওই চিনির বাড়িতে, যেটা এখন খালি পড়ে আছে, কে যে কার শিকার হলো সেটা এখনো জানি না।




    মূল গল্পের লেখিকা সিলবিনা ওকাম্পো (১৯০৩ - ১৯৯৩) আর্জেন্টিনার লেখিকা। Jorge Luis Borges-এর মতে তাঁর কবিতা স্প্যানিশ সাহিত্যের বিশেষ সম্পদ। বাঙালিদের কাছে নামটা চেনা চেনা লাগতেই পারে, কারণ তাঁর বোন হচ্ছেন বিক্তোরিয়া ওকাম্পো।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ উইকিপেডিয়া থেকে

    Tags: Bengali translation of Spanish short story, Sharbari Gorai
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments