অশোক : অসম্ভব ! অসম্ভব ! এভাবে চলতে পারে না, কিছুতেই না !
কাকলি : কি হল কি ? চেঁচাচ্ছো কেন ?
অশোক : শোন, আর এক মুহূর্ত এদেশে নয় । তুমি স্যুটকেস গোছাও, আমরা দেশে ফিরে যাব । ছেলে মেয়েদের খবর দাও, আমি আর ওদের কলেজের খরচ জোগাতে পারব না, দে হ্যাভ টু টেক কেয়ার অফ দেমসেলভস । রিয়াল এস্টেট এজেন্টকে খবর দাও, কালই যেন দেখা করে । আর ফোন বুকটা -
কাকলি : আগে ব্যাগগুলো নামিয়ে রাখ, তার পর কথা বলো । ওফ, সবসময় মাথা গরম - একটু ঠাণ্ডা হয়ে বস তো ।
অশোক : কি বলছ কি তুমি ? মাথা গরম হবে না ? জানো আজ এই আধ ঘন্টার বাজার করার জন্য আমার কত ডলার খসেছে ?
কাকলি : কত ?
অশোক : দুশ তিরিশ ডলার !
কাকলি : দুশ তিরিশ ডলার ? কি বলছ কি তুমি ? এই কটা ব্যাগ - কি কিনেছ কি তুমি ?
অশোক : যা বলেছ তাই কিনেছি ।
কাকলি : তার জন্য দুশ তিরিশ ডলার ?
অশোক : না, বাজার করেছি একশ চল্লিশ ডলারের ।
কাকলি : বলছ কি ? একশ চল্লিশ ডলার ?
অশোক : আজ্ঞে হ্যাঁ ম্যাডাম । বাজারে তো যাও না, আটা ডাল কি ভাও মালুম নেই পড়তা !
কাকলি : আর বাকি টাকা কিসে খরচ হল ?
অশোক : তোমার গাড়ির পেছনে ।
কাকলি : সেকি ? কি হল ? কোন অ্যাক্সিডেন্ট করেছ নাকি ?
অশোক : অ্যাক্সিডেন্ট করব কেন ?
কাকলি : তাহলে নিশ্চয়ই টিকিট দিয়েছে পুলিশ ! উফ্, কত বলি সাবধানে গাড়ি চালাও, শুনতেই চাও না । সব সময় অন্যমনস্ক । কি করছিলে, স্পিডিং ? নাকি রেডলাইট ভেঙেছো সেবারের মত ?
অশোক : তুমি আমার কথা শুনবে ? ওসব কিছুই হয়নি । নব্বুই ডলার খরচা হয়েছে তোমার সাধের গাড়িতে গ্যাস ভরতে !
কাকলি : গ্যাস ভরতে নব্বুই ডলার ? সেকি গো ?
অশোক : কেন, তুমিই তো গাড়িটা চালাও, গ্যাস ভরতে কত খরচা হয় জানো না ?
কাকলি : কতই আর হবে ? তিরিশ চল্লিশ বড়জোর ।
অশোক : তিরিশ চল্লিশ ? কোন যুগে পড়ে আছো তুমি ? এখন গ্যাস কত করে গ্যালন জানো ?
কাকলি : আমি অত খেয়াল করতে পারিনা সব সময় । ক্রেডিট কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলি, ফিল আপ - ব্যস্ ! কত করে গ্যালন এখন ?
অশোক : ফোর ফিফটি ! ভাবতে পারছ, ফোরফিফটি ডলার এ গ্যালন !
কাকলি : সর্বনাশ ! বলছ কি গো ? এত দিনে ডাকাতি ।
অশোক : তবে আর বলছি কি ? এদেশে আর থাকা নয়, স্রেফ মারা পড়ে যাব । তুমি স্যুটকেস গোছাও ।
কাকলি : ইস্, তখন এই ধুম্সো এস ইউ ভি টা না কিনলেই হত ।
অশোক : গরিবের কথা বাসি হলে সত্যি হয় । তখন পই পই করে বলেছিলাম, এত বড় গাড়ি কিনো না । খরচ সামলাতে পারবে না । শুনেছিলে সে কথা ?
কাকলি : তখন তো আর তেলের দাম এত বেশি ছিল না । তাছাড়া তুমিই তো বলেছিলে, ভাল ডিল দিচ্ছে, অনেক ভাল ভাল ফিচার, সেফটি অনেক ভাল -
অশোক : আহ্, ঐ ফাঁদেই তো পাকড়েছে আমাদের । গভীর চক্রান্ত বুঝলে, গভীর চক্রান্ত - তেল কোম্পানী আর গাড়ির কোম্পানী একজোট হয়ে এই চক্রান্ত করেছে । প্রথমে বড় গাড়ি কেনাও, তারপর তেলের দাম বাড়িয়ে দাও । পালাবে কোথায় বাছাধন ?
কাকলি : তাহলে কি হবে এখন ? এইভাবে গ্যাসের দাম বাড়তে থাকলে তো সংসার চালানো দায় হবে ।
অশোক : পালাতে হবে, এই দেশ ছেড়ে পালাতে হবে । প্রথমেই ঠকেছি আমরা । ঐ গ্যাসের দাম দেখেই সন্দেহ করা উচিৎ ছিল - 85 cents a gallon ! Too good to be true. হবুচন্দ্র রাজার দেশের গল্প শোননি ? যে দেশে দুধের চেয়ে তেলের দাম সস্তা, সেখান থেকে প্রথমেই আমাদের পালানো উচিৎ ছিল । তা নয়, আমরা আমাদের গুরুজনদের উপদেশ না শুনে, বোকার মত মনে করেছি এটাই স্বর্গরাজ্য । মূর্খ আমরা, অতি মূর্খ । তুমি আমাকে ফোনটা দাও, তারপর ইমিডিয়েটলি স্যুটকেস গোছাতে শুরু কর । কি কি নেবে আর কি কি রেখে যাবে তার একটা লিস্ট বানাও - বেশি কিছু নিও না এখন দেশে সব পাওয়া যায় । তাছাড়া ভোল্টেজ ফ্রিকোয়েন্সির ঝামেলাও আছে ।
কাকলি : এই নাও ফোন, কিন্তু কাকে ফোন করবে ?
অশোক : বিবেক, বিবেক -
কাকলি : বিবেককে ফোন করবে ? তোমার মাথাটা গেছে - বিবেকের কথা শুনতে তোমার ফোন লাগে ?
অশোক : আহ্, সে বিবেক নয় - বিবেক বসু - ট্র্যাভেল এজেন্ট । প্লেনের টিকিটগুলো যত তাড়াতাড়ি কেটে ফেলতে হবে । যে হারে তেলের দাম বাড়ছে, এরপর আর প্লেনে চাপার সামর্থও থাকবে না ।
(ডোর বেল বাজে)
অশোক : দেখ আবার কে এল । উফ ফোন বুকটা আবার কোথায় গেল, কাজের সময় কিচ্ছু পাওয়া যায় না । এই যে -
(ফোন বুক পেয়ে ফোন নাম্বার বার করে ফোন ডায়াল করেন)
অশোক : -হ্যালো, হ্যাঁ বিবেক আমি অশোকদা বলছি, খুব জরুরি দরকার । আমার ইমিডিয়েটলি দেশে যাবার দুটো টিকিট দরকার ।
- হ্যাঁ, ইমার্জেন্সি তো বটেই -
- কি বলছ- না না বাড়িতে সবাই ভাল আছে । তুমি আমাকে কবে টিকিট দিতে পারবে ?
- কবে যাব ? এস সুন এস পসিবল - বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেলেই রওনা ।
- কবে ফিরব ? না না ওয়ান ওয়ে, ওয়ান ওয়ে টিকিট -
- আমি সিরিয়াস বিবেক, আমি খুব সিরিয়াস
- তুমি একটু দেখে বল কি রকম টিকিটের দাম পড়বে ?
- কি বলছ কি তুমি, এত দাম ? এত দিনে ডাকাতি ?
- কি বললে, ফুয়েল সারচার্জ ? ঠিক ধরেছি আমি, ঠিক ধরেছি । এই তেলই আমাদের মারবে ।
- তুমি আর একটু খোঁজ খবর নিয়ে আমাকে জানাও ।
- তাড়াতাড়ি, কল ব্যাক করো ।
- রাখছি ।
(ইতিমধ্যে কাকলির সাথে সৌমেন ঘরে এসেছে)
অশোক : এই যে সৌমেন এসে গেছে । তোমার সাথে জরুরি দরকার আছে ।
সৌমেন : কি ব্যাপার দাদা, কি হয়েছে ? আপনি নাকি দেশে ফিরে যাচ্ছেন ?
অশোক : হ্যাঁ, তোমাদের এই দেশে আর নয় । এই মাত্র বিবেক বসুকে বলে দিলাম টিকিট বুক করতে ।
সৌমেন : আমাদের দেশ বলছেন ? দাদা, আপনি কিন্তু আমার চেয়ে অনেক বেশিদিন আছেন এদেশে ।
কাকলি : দেখ না, তোমার দাদার মাথায় যে কি ভূত চেপেছে । বলছে তেলের দাম বেড়েছে বলে নাকি দেশে ফিরে যাবে । আচ্ছা, এদেশে কি আর কেউ থাকছে না ? সবাই দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে ?
অশোক : পালাতে পারলে এরাও পালাতো । আমাদের সুযোগ আছে, সময় থাকতেই তার সদ্বব্যবহার করতে হবে ।
সৌমেন : কিন্তু পালিয়ে যাবেন কোথায় দাদা ? আপনি কি মনে করেছেন দেশে তেলের দাম কিছু কম ।
অশোক : হয়তো বেশি, কিন্তু দেশে এখানকার মত পেট্রোলিয়ামের উপর ডিপেন্ডেন্ট হয়ে থাকতে হবে না । ওখানে গাড়ি না চালালেও চলে, ট্রাম আছে, বাস আছে রিক্সা আছে, নিদেনপক্ষে গরুর গাড়ি আছে ।
সৌমেন : আপনি সে কথা বলছেন, দেশের লোক কিন্তু তা বলছে না । এই তো সেদিন আমাদের মমতাদি পর পর বন্ধ ডাকলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে, পেট্রোলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ।
অশোক : প্রতিবাদ তো করেছে ! এখানে তো সবাই মুখ বুজে সব মেনে নিচ্ছে । এদেশে ঐ মমতা ব্যানার্জীর মত নেতার প্রয়োজন জানো ! দুদিন যদি বন্ধ ডেকে আমেরিকা অচল করে দিতে পারো দেখবে চড় চড় করে গ্যাসের দাম, চালের দাম সব কমে যাবে । ইয়েস বন্ধ ইস দি আনসার !
কাকলি : সেকি, আমেরিকায় আবার বন্ধ হয় নাকি ?
অশোক : হওয়াতে হবে । ওটাই একমাত্র উপায় - প্রতিবাদ করতে হবে, গর্জে উঠতে হবে এই সব তেল কোম্পানি আর স্পেশাল ইন্টারেস্টের বিরুদ্ধে । সৌমেন তুমি বন্ধের ব্যবস্থা কর ।
সৌমেন : আমি ব্যবস্থা করব ?
অশোক : হ্যাঁ, তুমি করবে ইয়াং ম্যান । আমেরিকানদের বুঝিয়ে দাও বাঙালির তেজ কাকে বলে । বাংলার আর কিছু চিনুক না চিনুক, বেঙ্গল টাইগারকে সবাই চেনে ।
সৌমেন : কিন্তু দাদা -
অশোক : কোন কিন্তু নয় । আমি তোমার পেছনে আছি । মনে রেখ, যদি এই কাজে সফল হই তবেই আমি এদেশে থাকব, ফেল করলেই বিবেক বসু ।
কাকলি : আচ্ছা তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? বন্ধ ডাকব বললেই কি বন্ধ ডাকা যায় নাকি ? নিজের ঘর বন্ধ করা ছাড়া আর কি বন্ধ করতে পারবে শুনি ?
অশোক : দেখ তুমি আমাকে চটিয়ে দিও না । আমি যদি রেগে যাই, তাহলে আমি কিন্তু যা খুশি তাই করে ফেলতে পারি । তুমি দেখতে চাও ?
সৌমেন : দাদা, আপনি রাগ করছেন কেন ? বৌদি কিছু ভুল বলেন নি । এখানে দেশের মত বন্ধ সম্ভব নয়, ওটা বেআইনি ।
অশোক : ছি ছি ছি সৌমেন । তুমি না ছাত্র রাজনীতি করতে ? কলেজের মাঠে গরম গরম বক্তৃতা দিতে ? এরকম ভীতু হয়ে গেছ তুমি, একটা সামান্য বন্ধ ডাকতে ভয় পাচ্ছ ? নাহয় পুলিশে জেলেই নিয়ে যাবে, কিন্তু তাই বলে বাঙালির বাচ্ছা হয়ে প্রতিবাদ করবে না ?
সৌমেন : কিন্তু এখন তো আর রাজনীতি করি না দাদা । আপনি তো সিটিজেন, ভোট দেন, আমার তো সে অধিকারও নেই । পুলিশ আমাকে ধরলে আর জেলে নয়, সোজা ডিপোর্ট করে দেবে ।
কাকলি : ছি ছি, তোমার লজ্জা করছে না সৌমেনকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে ? না না সৌমেন ওসব বন্ধ টন্ধের ঝামেলায়া তোমাকে যেতে হবে না ।
অশোক : বেশ, তোমাদের কাউকে কিছু করতে হবে না । যা করবার আমিই করব । যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে -
কাকলি : কি করবে তুমি ? বন্ধ ডাকবে ? কেউ তোমার কথা শুনবে না ।
অশোক : শুনবে শুনবে সবাই শুনবে । প্রতিবাদ আমি করবই, তবে মমতার পথে নয়, সৌমেন ঠিকই বলেছে, ওপথে ঝামেলা আছে । আমি আমাদের গুর্জরের মহান নেতা, আমাদের মহাত্মার পথে প্রতিবাদ করব - অহিংস আন্দোলন - নন ভায়োলেন্ট প্রোটেস্ট - আমি অনশন করব - আমরণ অনশন । এটা আমেরিকানরা ভাল বোঝে ।
সৌমেন : দাদা, আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন । বৌদি আপনার কাছে এল্কাসেলজার আছে ? কিম্বা পুদিনহারা ? একটু দাদাকে দিন, আরাম বোধ করবেন ।
অশোক : ঠাট্টা করছ ? কর । কিন্তু তোমায় একটা কথা বলে যাই সৌমেন, একদিন তোমরা বুঝবে আমার কদর কি ! অনশন করে যদি মারা যাই তাহলেও বুঝবে, যদি সফল হই তাহলে তো কথাই নেই ।
কাকলি : তুমি অনশন করবে ? দুঘন্টা না খেলে যার মাথা গরম হয়ে যায় , সেই তুমি কতক্ষণ না খেয়ে থাকতে পার দেখব আমি ।
অশোক : দেখো, দেখো ! সখি, আজও তোমার এই পতিদেবতাটিকে চিনতে পারলে না তুমি । আগামীকাল ভোর থেকে আমার অনশন শুরু হবে, তৈরি থেকো তোমরা ।
কাকলি : ঠিক আছে, কাল সকালেই দেখা যাবে কিরকম অনশন কর তুমি । সৌমেন এখন চল তুমি, তোমার জিনিসটা দিয়ে দি ।
অশোক : যাও, যাও, সবাই চলে যাও । কিন্তু মনে করো না আমি পিছিয়ে যাব - যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে - একলা চল একলা চল -
সৌমেন : কিন্তু দাদা, ঘরে বসে আপনি একলা অনশন করলে তো কোন ফল হবে না । সবাইকে জানাতে হবে । আপনার প্রতিবাদ যদি কেউ না শোনে, তাহলে তো কোন লাভ নেই ।
অশোক : দিস ইজ হ্যোয়ার আই থট ইউ কুড বি অফ সাম হেল্প ! কিন্তু তুমি, এবং তোমার বৌদি যদি কোনরকম কোয়াপরেশন না কর, তাহলে মনে কোরো না আমি অথৈ জলে পড়ব ।
সৌমেন : ঠিক আছে, বলুন আমাকে কি করতে হবে ? আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি ?
অশোক : লোক জোগাড় কর, লোক । সবাইকে খবর দাও, বল এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদের সাক্ষী হবার জন্য সবাই যেন দলে দলে উপস্থিত হয় ।
সৌমেন : কিন্তু কোথায় ? এখানে ? আপনার বাড়িতে ?
অশোক : খেপেছো ? বাড়িতে বড়জোর ডায়েটিং হয়, অনশন হয় না । আমাদের কোন পাবলিক প্লেস খুঁজতে হবে । যেমন ধর আমাদের টাউন হলের পাশের পার্কে । ওখানে একটা তাঁবু খাটানোর ব্যবস্থা কর, একটা মাইক্রোফোন আর সাউণ্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা কর । আর হ্যাঁ, প্রেস, প্রেসকে খবর দাও । খবরের কাগজ, টেলিভিশন, রেডিও সবাইকে জানাও ।
সৌমেন : বৌদি একটা কাগজ-কলম দিন, সব নোট করে নিই ।
কাকলি : সৌমেন তুমি কি সত্যিই এইসব করবে নাকি ?
সৌমেন : দাদা যখন বলছেন, করতে তো হবেই । উনিতো ঠাট্টা করছেন না ।
অশোক : কাকলি, তুমি এখনো ঠিক মানতে পারছো না, যে আমি অনশন করতে পারি ? হয় হয়, এরকম হয় - কুবলার রসের ফাইব স্টেজেসর, প্রথম স্টেজ ডিনায়াল, এরপর -
কাকলি : বাজে কথা বলো না তো -
অশোক : মন শক্ত করো কাকলি - সামনে কঠিন পরীক্ষা । যদি সহজে দাবি না মানে, তাহলে অনেক কিছু দেখতে হবে তোমাকে । দেখবে কিভাবে আমার শরীর ভেঙে পড়ছে - প্রথমে ডিহাইড্রেশন হবে, ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ব, স্নায়ু শিথিল হয়ে যাবে, কথা বলার শক্তি চলে যাবে, অথরিটি চেষ্টা করবে নাক দিয়ে টিউব ঢুকিয়ে ফোর্সফিড করতে, জোর করে ইন্টার্ভেনাস স্যালাইন ডেক্সট্রোজ দেবার চেষ্টা করবে, আমি বাধা দেব - সে এক বীভত্স রক্তারক্তি ব্যাপার হলে - সব তোমাকে সহ্য করতে হবে ।
কাকলি : (ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন) কি সব অলক্ষুণে কথা বলছ তুমি । দোহাই তোমার ওসব করো না, তার চেয়ে চল দেশেই ফিরে যাই ।
অশোক : যাব কাকলি যাব, কিন্তু তার আগে দেখিয়ে দিয়ে যাব বাঙালি কি চীজ - বিনয় বাদল দিনেশ, ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীনদের দেশের লোক আমি । যাবার আগে এই দেশের জন্য একটা কাজের কাজ করে যাব ।
(কাকলি বেরিয়ে যায়)
অশোক : একি চললে কোথায় ? এখন যে অনেক কাজ আছে ।
কাকলি : (চলে যেতে যেতে, কান্নাভেজা গলায়) আমি আসছি ।
সৌমেন : দাদা, প্রেসের সব ফোন নাম্বার যোগাড় করে ফেলেছি । এবার এক এক করে ফোন করতে হবে । কিন্তু তার আগে পলিটিকাল পার্টির কিছু নেতা- টেতাদেরও তো জানানো দরকার ।
অশোক : অবশ্যই ! নেতাদের তো ডাকতেই হবে । তুমি এক কাজ কর । আমাদের হিল্লোল ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, মৃণালকে খবর দাও । পলিটিকাল মহলে ওর অনেক কানেকশন আছে, ও সবাইকে বুঝিয়ে রাজি করাতে পারবে । তাছাড়া, হিল্লোল ক্লাবের মেম্বারদের সবাইকে হাজির করতে হবে ।
সৌমেন : কিন্তু দাদা, মৃণালকে কলটা আপনিই করুন । সেটাই বোধহয় ভাল হবে । আমি ফোন করলে ও আবার মনে করতে পারে আমরা ওকে যথেষ্ট ইম্পর্টান্স দিচ্ছি না ।
অশোক : হ্যাঁ, ঠিক বলেছ । দাও আমাকে ফোনটা দাও ।
সৌমেন : এই নিন ।
(অশোক ফোন ডায়াল করে)
অশোক : -হ্যালো - হ্যাঁ মৃণাল শোনো, আমি অশোকদা বলছি ।
- ভাল থাকব কি করে ভাই, যা চলছে তাতে কি করে ভাল থাকা যায় বুঝি না ।
- শোন তোমার সাহায্য চাই, আমি অনশন করছি ।
- আহ্, ধর্ষণ করব কেন, অনশন অনশন - হাঙ্গার স্ট্রাইক - বুঝেছ । অনশনকে ধর্ষণ কি করে শুনছ বুঝিনা ।
- না আমার মাথা ঠিকই আছে, তোমাদের মাইণ্ডটাই করাপ্ট হয়ে গেছে, গদি পেলে তোমরা আসল ইস্যুগুলো সব ভুলে যাও । যত সব বাজে ব্যাপার মাথায় ঘোরে ।
-নিশ্চয়ই বাজে ব্যাপার ! কি করছ কি তুমি, বাঙালিদের এতবড় একটা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হয়ে কি করছো ? কেবল দুর্গা পুজার নাম করে লারে লাপ্পা গান, হলিডে পার্টির নামে মদ্য পান আর অসভ্য টুইস্টনাচ । এদিকে স্পেশাল ইন্টারেস্ট আর অয়েল লবি দেশটাকে উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে, সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে বসে আছো । কোথায় প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠবে, মিছিল বার করবে, কংগ্রেসম্যান সেনেটরদের কাছে পিটিশন পাঠাবে - তা নয় ধর্ষণের চিন্তা মাথায় ঘুরছে ।
- হ্যাঁ আমি প্রতিবাদ করছি, তীব্র নিন্দা করছি, আর কাল থেকে আমরণ অনশন - ভাল করে শোন-অ-ন-শ-ন ! বুঝেছ । টাউন হলের সামনের পার্কে কাল প্রেসের লোকে ছেয়ে যাবে, বক্তৃতা হবে - পিকেটিং হবে -
(ওপাশ থেকে মৃণাল ফোন রেখে দেয়)
- হ্যালো ? হ্যালো ?
(সৌমেনকে)
দেখলে, দেখলে কেমন অসভ্য লোক । ফোন কেটে দিল ? একটা সামান্য ভদ্রতা নেই । ছি ছি ছি একে তোমরা ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট করেছো ? ইমপিচ কর, ইমিডিয়েটলি ইমপিচ কর ।
সৌমেন : তাহলে হিল্লোল ক্লাবের তরফ থেকে কোনো সাপোর্ট পাওয়া যাবে না বলছেন ?
অশোক : কেন পাওয়া যাবে না ? হিল্লোল ক্লাব কি মৃণালের জমিদারি নাকি ? ক্লাবের প্রত্যেকটি মেম্বারকে জনে জনে ফোন কর । আমি দেখিয়ে দেব লিডারশিপ কাকে বলে । আমি তোমাকে এখুনি ফোনের লিস্ট দিচ্ছি ।
(কাকলি প্রবেশ করেন)
অশোক : এই যে ম্যাডাম, কোথায় গিয়েছিলেন ? আজ ডিনারের কি ব্যবস্থা করেছো ? শোনো পরোটা, কষা মাংস কর । আর একটু বিরিয়ানি । পাবদা মাছ আছে না ? বার কর । বেশ জমিয়ে ঝাল বানাও । পোস্তর বড়া আর কলাই ডাল তো করবেই । ভাল মন্দ খেতে চাই বুঝেছো । কে জানে হয়তো এটাই আমার শেষ খাওয়া ।
কাকলি : আচ্ছা, একটা ব্যাপার করলে হয় না ? দেশে তো শুনেছি রিলে অনশন হয় । ধর প্রথমে তুমি দুঘন্টা অনশন করলে, তারপর সৌমেন দুঘন্টা করল, এই ভাবে -
অশোক : রিলে অনশন ? ছো: ! এটা বলতে তোমার লজ্জা করল না ? এই সব করে করেই তো অনশনের মতো একটা পাওয়ারফুল ননভায়োলেন্ট ওয়েপনকে এরা ভোঁতা করে দিয়েছে । অনশন করতে হলে করতে হবে গান্ধীজির মতো, বিনোবা ভাবের মতো, জয়প্রকাশ নারায়নের মতো । ধুঁকতে ধুঁকতে যখন প্রাণবায়ু যাই যাই করছে, ঠিক তখনই অথরিটি নতি স্বীকার করে মুখের কাছে ফলের জুস এনে ধরবে, তবেই না অনশন ।
(কাকলি আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন)
কাকলি : ঠিক আছে, তোমার যা খুশি তুমি কর । আমি রান্নার ব্যবস্থা করি !
অশোক : তাই যাও, ভালো করে রান্না কর । আবার কবে তোমার হাতের রান্না খাবো তার কোনো ঠিক নেই ।
সৌমেন : ঠিক আছে, আমি তাহলে উঠি দাদা । আপনার টেন্টের, মাইকের ব্যবস্থা করি । ফোন করতে হবে । আর এর মধ্যে যদি কোনো প্ল্যান চেঞ্জ করে জানাবেন, সেই মত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে ।
অশোক : না না, এখন যাবে কি ? এটাই আমাদের সেন্ট কম । সব প্ল্যানিং এখানে বসেই হবে । বৌদি রান্না করছে, খেয়ে দেয়ে, এখানেই শুয়ে পড়বে । কাল সকালে এখান থেকেই সোজা টাউন হল । তুমি এখন ফোনটা নিয়ে বসো ।
(হঠাৎ বাইরে অশোকের মেয়ে ঝিমলির উত্তেজিত গলা, সেই সাথে কাকলির কান্না ভেজা কন্ঠস্বর শোনা যায় । ঝিমলি প্রবেশ করে সাথে কাকলি ।)
ঝিমলি :
অশোক : তুই এসে গেছিস । যাক খুব ভাল কথা । তোর সাহায্যেরও খুব প্রয়োজন আছে । তোকে পাশে পেলে মনে অনেক জোর পাব ।
ঝিমলি :
কাকলি : (কেঁদে ওঠেন) তোর বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে । তুই ওকে জোর করে কোনো মাথার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা, তা না হলে তোর বাবা আর বাঁচবে না ।
অশোক : বাজে কথা বলো না । না, আমার মাথা একদম ঠিক আছে, এই দেশের সব ম্যাদামারা মেরুদণ্ডহীন মানুষদের চেয়ে অনেক বেশি ভাল আছে ।
ঝিমলি :
অশোক : আমার কিছু হয় নি । আমি কেবল প্রতিবাদ করতে চেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ -
ঝিমলি :
সৌমেন : ঝিমলি, আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি । অশোকদা অনশন করছেন, মানে
ঝিমলি :
অশোক :
সৌমেন : দাদা, আমাকে একটু বলতে দিন ।
অশোক : দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে । লাইক ওয়াইল্ড ফায়ার । দেখবি শহরে শহরে, সবাই অনশন করছে - হাঙ্গার স্ট্রাইক - করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে ।
ঝিমলি :
অশোক : শুনেছ, শুনছে কাকলি ? আমার নিজের মেয়ে বলছে, অনশন করাটা নাকি ডাম্ব আইডিয়া ! ভাবতে পারছো ?
কাকলি : ঠিকই বলেছে ! এত লোক থাকতে তোমার এত মাথা ব্যাথা কেন ? এসব ঐ রাজনৈতিক নেতাদের কাজ, তোমার নয় ।
অশোক : না, এটা প্রত্যেকটি সিটিজেনের কাজ । আজকের সিটিজেন, কালকের নেতা ।
কাকলি : তুমি নেতা হবে ? ওরে ঝিমলি কি হবে রে, তুই তোর বাবাকে বোঝা ।
ঝিমলি :
অশোক :
ঝিমলি :
অশোক :
ঝিমলি :
অশোক :
ঝিমলি :
অশোক : তোর মাকে বল । ওটা তোর মার সখ - উঁচু গাড়িতে চড়লে নাকি নিজেকে বেশ বড় বড় লাগে !
কাকলি : ঠিক আছে, ওটা নাহয় দূর করা গেল । তাহলেই কি তেলের ডিম্যাণ্ড কমে যাবে ।
ঝিমলি :
অশোক : পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন - হাসালি আমায় ।
ঝিমলি :
সৌমেন : হ্যাঁ দাদা, আমি দু একবার চড়েছি, বাস সার্ভিসটা খুব খারাপ নয় । তবে ফ্রিকোয়েন্সি খুব কম ।
ঝিমলি :
অশোক : সৌমেন, মেয়েটা কিন্তু যুক্তিগ্রাহ্য কথা বলছে, তোমার কি মনে হয় ?
সৌমেন : কথাগুলো তো ঠিকই দাদা, কিন্তু লোকে মানছে কই । সবাই যদি মানে তাহলে তো-
অশোক : ব্যাস ঠিক আছে । চেঞ্জ অফ প্ল্যান, আমাদের আন্দোলনের লাইনটা পাল্টাতে হবে ।
সৌমেন : কি রকম দাদা ?
অশোক : নো অনশন -
কাকলি : যাক বাবা বাঁচা গেল ।
অশোক : কিন্তু তাই বলে আমি থেমে থাকবো না । এবার আমার আন্দোলন হবে `তেল ছাড়ো', `কুইট অয়েল' আন্দোলন - `গিভ আপ অয়েল এণ্ড গেট ব্যাক ইওর ফ্রিডম' এই হবে আমাদের স্লোগান ।
ঝিমলি :
সৌমেন : বা: খুব ভালো কথা । এখন তো আমার তাহলে আর কোনো কাজ নেই, আমি তাহলে উঠি বৌদি ।
অশোক : সেকি, কাজ নেই মানে ? নতুন আন্দোলনের জন্য তৈরি হতে হবে না । শোনো তুমি একটা প্রেস কনফারেন্সের ব্যবস্থা কর, সমস্ত মিডিয়ার লোকেদের থাকা চাই । পিটিশন করতে হবে, সিগনেচার ক্যাম্পেন করতে হবে, ঘরে ঘরে মেলার পাঠাতে হবে । রাস্তার মোড়ে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়াতে হবে, গ্যাস স্টেশনে হ্যাণ্ডবিল দিতে হবে । আরও কাজ আছে - ডিপার্টমেন্ট অফ পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশনের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হবে, আরও বাস সার্ভিস বাড়াতে হবে । শহরে শহরে সাইকেল রিক্সা চালু করতে হবে, কমপ্লিটলি গ্রীন ট্রান্সপোর্টেশন । তুমি এখুনি কাজে লেগে পড় । ঝিমলি, তোমাকেও থাকতে হবে আমাদের সাথে, কাজে লেগে পড় কাজে লেগে পড় -
ঝিমলি : আমি ?
অশোক : অফ কোর্স ! তোমার আইডিয়া, আর তুমি ফাঁকি দেবে তা তো হয় না । কুইট অয়েল মুভমেন্টের তুমিই তো প্রধান পরামর্শদাতা ।
কাকলি : সৌমেন, তুমি কিন্তু ডিনার করে যাবে । অবশ্য অনশন যখন হচ্ছে না, তখন -
অশোক : নো নো মাই ডার্লিং সেটি হচ্ছে না । অনশন এখন হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু পরোটা মাংস হচ্ছেই । পাবদা মাছটা আমরা নাহয় ছাড়তে পারি, কিন্তু আর কিছু নয় ! ভোজ্য তেলের বিরুদ্ধে কিন্তু আমাদের আন্দোলন নয় ! ওটা কুইট করার কোনো প্রয়োজন নেই এই মুহূর্তে ।
(সকলে হেসে ওঠে, আলো নিভে যায় ।)
(পরবাস-৪৭; জানুয়ারি, ২০১১)