• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৯ | জুলাই ২০২০ | গল্প
    Share
  • ভবিতব্য : স্বরূপ মণ্ডল


    বাপের, থুড়ি চোদ্দ পুরুষের জন্মে এমন বন্ধ কেউ কখনো দেখেছে! মন্দিরে পর্যন্ত তালা ঝুলিয়ে দিলে! কাতারে কাতারে ভক্ত আসতো এই মন্দিরে। দুবেলা মন্দিরের চৌকাঠে মাথা না ঠুকলে যাদের দিন চলতো না তাদের টিকিটি দেখা গেল না। কেউ এতটুকু আর্জি পর্যন্ত করলে না। কারোর একবারের তরে মনে হলো না, এইভাবে ঘরবন্দী হয়ে বাঁচার চেয়ে মায়ের চরণে ঠাঁই নেওয়াই শ্রেয়। কী এক কাল ব্যাধি এলো, সব কিছু ওলটপালট করে দিলে!...

    নিজের মনেই গজগজ করতে করতে ঘাটে যাচ্ছিলেন সত্তর ছুঁইছুঁই কালীপদ আচার্য মহাশয়। হাতে তামার ঘটি, কাঁধে গামছা। মন্দিরের দিকে চোখ পড়তেই হুহু করে উঠলো বুকটা। যে মন্দির প্রাঙ্গণ এক সময় ঝকঝক তকতক করতো, আজ তার দশা দেখলে চোখে জল আসে। ছুঁচ ঘাস আর ঝিঁঝিটি গাছে ভরে গিয়েছে। এক পরত ধুলো জমেছে দেউড়িতে।


    দুই

    ভাগীরথীর দু’ পারের দুই চিত্র। পূর্ব পারে শিল্পাঞ্চল। পুর এলাকা। শহরের সবরকম সুযোগ-সুবিধা উপলব্ধ। আর পশ্চিম পারে জগন্নাথবাটী। অজ পাড়া-গ্রাম। অনেকটা প্রদীপের নীচেই অন্ধকারের মতো। গ্রামের মাঝখানটিতে কালী মন্দির। খুব জাগ্রত কালী। আচার্যিমশাই মন্দিরের সেবায়ত। পৌষ মাসে উপচে পড়ে ভিড়। যার যা মানত থাকে দিয়ে যায়। কেউ সোনার টিকলি, কেউ আবার সোনার চোখ দেয়। কত যে পাঁঠা বলি হয় তার ইয়ত্তা নাই। পৌষ-কালী দর্শনের জন্য দূর দূরান্ত থেকে ভক্তের সমাগম হয়। এক পৌষেই সারা বছরের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংস্থান করে নেন তিনি। এমন একটা জাগ্রত স্থানকে পতিত করে দিল। খুব রাগ হয় আচার্যিমশাইয়ের। এই কি ভাল লাগে! দিনমান খালি ঘরে বসে থাকা আর খবর গেলা। কত আক্রান্ত হলো, কত মরলো, কত সুস্থ হলো, কোথায় পুলিশ পেটাল, কোথায় পুলিশকে পেটাল। দূর দূর! তার চেয়ে যা হবার হোক। সব কিছু খুলে যাক।

    অবনীশ বাজারে যাচ্ছিল। দত্তবাড়ির ছেলে। উচ্চশিক্ষিত, পরোপকারী। গ্রামের সকলেই মান্যি করে ওকে। আচার্যিমশাইকে দেখে বললো, “কি ঠাকুরমশাই, আজ থেকে তাহলে মন্দিরের তালা খুলছে?” আচার্যিমশাই বিষ চোখে তাকালেন অবনীশের দিকে। দোষটা অবশ্য অবনীশেরই। লেখাপড়া শিখে যদি ঠাকুর দেবতার প্রতি অবিশ্বাস জন্মায় তবে আচার্যিমশাইদের চলবে কি করে? খোলার কথা ছিল বটে পয়লা থেকে। অবনীশের কথায় মনে পড়লো আজ মঙ্গলবার, পয়লা। বাড়িতে বসে থেকে থেকে অভ্যেসটাই বদলে গিয়েছে। আগে এই আচার্যিমশাইয়ের কাছ থেকেই কত জন কত বিধান নিয়ে গেছে। পাঁজিটা নখদর্পণে ছিল তাঁর। আর আজ দিন, ক্ষণ, তারিখ, বার কিছুই মনে থাকে না।

    তুই নিজে বিশ্বাস করবি না, করিস না। তোর অবিশ্বাস নিয়ে তুই থাক। না তো গাঁয়ের লোকেদের পর্যন্ত মাথা খাচ্ছিস! নিজের মনেই আওড়ালেন তারপর নাক সিঁটকে বললেন, “তাতে তোর কী? তুই তো আর ঠাকুর-টাকুর মানিস না! দু’ কলম লেখাপড়া শিখে নিজেকে নাস্তিক ঠাওরেছিস। যত্ত সব অনাসৃষ্টি, অনাচার!” অবনীশ বুদ্ধিমান ছেলে। আচার্যিমশাইয়ের রাগটা ঠিক কোনখানে সেটা আঁচ করতে পেরে বললো, “আমার মানা না মানায় মন্দিরের ভীড় কি কিছু কমেছে ঠাকুরমশাই? নেহাতই মড়ক লেগেছে নইলে মন্দিরের চৌকাঠে মাথা ঠোকার কি আর লোকের অভাব? তাছাড়া, আপনিই তো বলেন মা-ই নাকি এসব করছে?” “করছেই তো! দু’ পাতা বই পড়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছিস। তোদের জব্দ করার জন্যই তো এই ব্যবস্থা!” ফুঁসে উঠলেন আচার্যিমশাই। “জব্দ কি আর আমরা একা হচ্ছি ঠাকুরমশাই?” অবনীশের কথায় প্রদীপের উসকে দেওয়া সলিতার মতো জ্বলে উঠলেন আচার্যিমশাই, বললেন, “তোদের পাপে মোদের সাজা! অমান্যি করবি তোরা, আর ঠেলা পইতে হবে আমাদের! মা কি এমনি এমনি রুষ্ট হয়েছেন?” আচার্যি মশাইয়ের মেজাজ বিগড়ে আছে বুঝে কথা বাড়াল না অবনীশ। শুধু যাওয়ার সময় স্বভাবসিদ্ধভাবে একটা টিপ্পনী কাটলো, “তা, আমার হয়ে মাকে একটু মিনতিটিনতি তো করতে পারেন? তাতে আমারও ধর্মেকর্মে মতি আসে!” আচার্যিমশাই উত্তর খুঁজে পেলেন না। কটমট করে তাকালেন অবনীশের দিকে।


    তিন

    পুণ্যতোয়া জাহ্নবী বয়ে চলেছে কুলকুল রবে। হৃত রূপ ফিরে পেয়েছে সে। আনন্দে উছলে পড়ছে দুই কূলে। স্বচ্ছ কাচের মতো জল। ও পারের আকাশচুম্বী নলগুলো থেকে আর ধোঁয়া ওঠে না আগের মতো। বিষাক্ত কালো জল এসে মেশে না আর। লঞ্চ, ষ্টিমার চলাচল সব বন্ধ। ছোট ছোট জেলেডিঙিগুলো ভেসে বেড়ায় গঙ্গার বুক জুড়ে। অত্যাধুনিক মানব সভ্যতা যেন থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোন জাদুবলে। যাদের উপর জাদু কাজ করে না, শুধু তারাই গতিশীল। বয়ে চলেছে আপন ছন্দে। ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। কত পাখি উড়ে যাচ্ছে পূর্ব থেকে পশ্চিম পারের নীল আকাশটার দিকে। মেঘ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে আলোর ছটা।

    ঘাটের পারে দাঁড়িয়ে ছিলেন আচার্যিমশাই। ঘটিটা সিঁড়িতে রেখে দিয়ে তিনবার গঙ্গা স্পর্শ করে জলে নামলেন। গা-হাত-পা কচলে নিয়ে পূর্বদিকে মুখ করে জোরে শ্বাস টেনে পরপর তিনবার ডুবলেন। তারপর পইতেটা আঙুলে জড়িয়ে দু’ হাতে করে জল নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে হাতের জল নিঃশেষ করে আকাশের দিকে চেয়ে প্রণাম করলেন। ফিরে এসে ঘটিটা নিয়ে আবার কিছুটা জলে নেমে এক ঘটি জল ভরে নিয়ে এসে সিঁড়িতে রাখলেন। গা, মাথা মুছে গামছাটা জলকাচা করে নিংড়ে নিয়ে কোমরে জড়ালেন তারপর পরনের ধুতিখানা ভাল করে কেচে ঘটি হাতে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। ঘাট থেকে বাড়ি মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। মোরাম দেওয়া রাস্তা। দুই ধারে কৃষ্ণচূড়ার সারি। রাস্তা ঢেকে গিয়েছে ঝরা ফুলে। চারদিক সবুজে ভরে উঠেছে। দূর থেকে ভেসে আসছে কোকিলের ডাক।

    খুব রাগ হয়েছিলে অবনীশের উপর। জাহ্নবীর জলে ধুয়ে গিয়েছে সব রাগ। এখন অন্য চিন্তায় মগ্ন। মন্দিরের যা হাল তাতে পরিষ্কার করাতেই দু’দিন কেটে যাবে। তার উপর সরকারি নির্দেশিকার ফ্যাচাং তো রয়েছেই। যে মায়ের চানজল খেয়ে দেশ দুনিয়ার লোক তরে গেল, কত কঠিন ব্যাধি ভাল হয়ে গেল আজ তাকেই কিনা কীটনাশক দিয়ে বিশুদ্ধ করতে হবে! এ অমর্যাদা কি সহ্য হয়? উঃ! ভাবলেই পাপ লাগে। এর পরেও কি ঠাকুর-দেবতার উপর মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধা থাকবে?


    চার

    ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছে। ঝনঝন রবে কাঁসর বাজছে। ঢক্বানিনাদে ভরে উঠছে মন্দির প্রাঙ্গণ। মায়ের সামনে বাদ্যির তালে তালে সন্ধ্যা আরতি করছেন আচার্যিমশাই। বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করেই ভক্ত সমাগম ঘটেছে। মানুষের অটল বিশ্বাসে এতটুকু মলিনতা আসে নি। আচার্যিমশাইয়ের সারা অঙ্গ দুলে দুলে উঠছে। বেশি বেশি করে তাল দিচ্ছেন আজ। দেখে মনেই হচ্ছে না তিনি অনভ্যস্ত। ধূপের গন্ধে মম করছে। কেমন যেন একটা ঘোর লাগা অবস্থা তাঁর। আচার্যিমশাইকে বারবার সাবধান করেও কোন ফল হয় নি। মায়ের উপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস। যিনি ভাঙছেন, তিনিই গড়বেন। তিনি মারছেন আবার তিনিই বাঁচাবেন। তাঁকে দেখে ভক্তেরাও জোর পেয়েছে মনে। কিচ্ছুটি হবে না আর!


    পাঁচ

    পাঁচদিন হলো আচার্যিমশাইয়ের ঘুষঘুষে জ্বর সঙ্গে খুকখুক কাশি। বাড়ির লোকের কথায় আমল দেন নি। এ সামান্য ঠান্ডা লাগা জ্বর! মোড়ের মাথায় আনন্দের ওষুধের দোকান থেকে কয়েকটা প্যারাসিটামল কিনে খেয়েছেন। তাতে সাময়িক স্বস্তি পেলেও ফের গা গরম হয়েছে। কাশিটা রয়েই গিয়েছে। গেল রাত থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে তাঁর। আর ফেলে রাখা ঠিক হবে না ভেবে আচার্যিমশাইয়ের স্ত্রী শিবানীদেবী মেয়েকে ফোন করলেন। ওঁদের একমাত্র মেয়ে কোলকাতায় থাকে। স্বামী আর সন্তান নিয়ে একরকম ফ্ল্যাটবন্দী অবস্থা। ফোন করতেই মেয়ে ভয়ে তটস্থ হয়ে বাবাকে শীগগির হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিল। দূরে থেকে এর বেশি কিই বা করবে সে? এদিকে আচার্যিমশাইয়ের জ্বরের খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই গোটা গ্রামে কেমন যেন একটা চাপা আতঙ্কের আবহ তৈরি হয়েছে। এতটুকু বিশ্বাস হচ্ছে না নিজেদের। এই পাঁচদিনে অনেকেই মন্দির গিয়েছেন, প্রসাদ ও চানজল খেয়েছেন। খবরটা শুনেই অনেকেরই গা জ্বর জ্বর ভাব শুরু হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা আটকে আছে গলায়। প্রকাশ্যে আচার্যিমশাইকে গালি পাড়তে শুরু করেছে অনেকেই। সবার মনের একই অবস্থা। হায় কী করলাম! কেন মন্দিরে গেলাম? যদিও বা গেলাম, প্রসাদ আর চানজল কেন খেতে গেলাম? অবনীশ ঠিকই বলে। সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য ঠাকুরের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন সঠিক স্বাস্থ্যবিধির। তাছাড়া, ঠাকুর তো আর মন্দিরে থাকে না, থাকে মনে। কী যে হবে এখন?


    ছয়

    হাসপাতালের আঠারো নম্বর বেডে শুয়ে আছেন আচার্যিমশাই। আইসোলেশনে রাখা হয়েছে তাঁকে। খাওয়ার সময় খাওয়া আর বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করা। পরিবার, পরিজন, পূজা-অর্চনা ছেড়ে এই কী ভাল লাগে! এর চেয়ে মরণ ভাল। কিন্তু যেখানে একটি জীবনের মূল্য এত বেশি সেখানে মৃত্যু কামনা করা অপরাধ। সাদা পোষাক পরিহিতা একজন লেডি ডাক্তার আঠারো নম্বর বেডের কাছে এসে বললেন, “গুড লাক, কালীপদ বাবু! আপনার পরীক্ষার রিপোর্ট এসেছে। নেগেটিভ। আজই আপনাকে ছুটি দেওয়া হবে। আচার্যিমশাই মুখে কিছু বললেন না, শুধু অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন ডাক্তারের চোখের দিকে। কালো, গভীর, টানা চোখ। কোথায় যেন দেখেছেন। মনে পড়ছে না। খোলা জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে ডাক্তারের মুখের উপর। যেন স্বয়ং আনন্দময়ী মা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। হাতদুটো জোড় করে কপালে ঠেকালেন।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার

    Tags: Bengali short story, Swarup Mandal
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)