• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৫ | এপ্রিল ২০১০ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • কিন্নর দেশে : খাড়াপাথরের গ্রামে : রাহুল মজুমদার

    দোসরা অক্টোবর দু'হাজার নয় - রাত ন'টা

    প্রবাদ অনুযায়ী ভোর যদি গোটা দিনটার সূচক হয়, তাহলে এবারের বেড়ানো সমস্যাসঙ্কুল হতে চলেছে । বাতানুকূল কামরায় ঢুকে মনে হয়নি এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হবে । ট্রেন চলা শুরু করতেই বৃষ্টিও পড়তে শুরু করল । ফাটা কাচের ফাটল দিয়ে মাওবাদী হানার মতো হানা দিল বর্ষার বর্শা । দশ মিনিটে কামরায় কুলুকুলু সুরধুনি বইতে লাগল । ফলে বেসমেন্টের বাসিন্দা বাক্সপ্যাঁটরারা উচ্চাসনে আসীন হলো । আধঘন্টা পর জল দস্যুর হানা থামল - সর্বজন প্রচেষ্টায় কামরা বন্যাত্রাণের পর মালপত্র আবার পাতালবাসী হলো; আমরাও আমাদের আসন ফিরে পেলাম । ধন্য রেল বাহাদুর ! ফুটাফাটা, ঝড়তি পড়তি কামরা দিয়ে দিব্যি সব `সুপারফাস্ট' ট্রেন খাড়া করে, কান মুলে চড়া দাম আদায় করছে । কোনও অভিযোগ এলে `কানে গুঁজেছি তুলো' । আমরা ভারতাবাসীরা সহনশীলতায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ।

    তেসরা অক্টোবর - সকাল সোয়া সাতটা -

    গতরাতের `সুনামি'-র পর গাড়ি এখন আপনবেগে পাগলপারা - `দুরন্ত' না হলেও ছুটন্ত ।

    সকাল সাড়ে ন-টা -

    এলাহাবাদকে ফেলে গাড়ি এখন কানপুরের সঙ্গে কানাকানি করতে চলেছে ।

    ঠিক দুপ্পুরবেলা -

    কানপুরের আগেই মেলা ঝামেলা - ভাওপুরে হঠাৎ `ভাও' খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল গাড়ি । পনেরো মিনিট পর যাওবা গাড়ি গড়াল, কানপুরে ঢোকার আগে আবার `কান ধরে রেলপথে দাঁড়িয়ে' তবে অনুমতি মিলল । বেরোবার সময়ও একই গান - মিনিট কুড়ি শাস্তি । এবারে নাকি একেবারে দিল্লী ! দেখা যাক - না আঁচালে বিশ্বাস নেই । জয় মা লক্ষ্মী - মানে, আজ লক্ষ্মীপুজোর দিন কিনা - কোজাগরী পুন্নিমে ।

    বেলা দেড়টা -

    এইমাত্র লাঞ্চের লাঙ্ছনা শেষ হলো । লাঞ্চ নিয়ে আসতেই শুরু হলো ভ্রান্তিবিলাস । লাঞ্চবাবুকে দেখামাত্র সকলে যেভাবে `আমারটা' `আমারটা' বলে লোকসভা বসিয়ে দিল, যেন তিন মাস পর `আয়লা'-র ত্রাণ এসেছে । `হামারা ভেজ' `হামারা নন-ভেজ' বলে সকলে এমন চেঁচাতে লাগল, যেন শেয়ার বাজারে আগুন লেগেছে । ফল যা হবার হলো - পরিবেশকের সব গুলিয়ে গেল । নিরামিষাশির জুটল `এগ বিরিয়ানি' আর নন-ভেজ এর কোলে নিরামিষ থালি । এবার যা শুরু হলো, তাকেই বোধহয় শব্দব্রহ্ম বলে । কোন কৌশলে এ ধাঁধাঁ সমাধান হলো, বলতে পারব না । এখন শুধু মুখ চলা, ঠোঁট চাটার শব্দ ।

    বিকেল ছ'টা -

    `দিল্লী বলে টুকি' করতে করতে অবশেষে দিল্লী, থুড়ি নতুন দিল্লী এলো । কুলিবাবাজীর ন্যাজ ধরে ট্যাক্সিস্ট্যাণ্ড । দিল্লীকা ঠগ শুরু করে দিল তার খেল । কুলি আর ট্যাক্সি যৌথ উদ্যোগে কান মুলে বেগুনি করে দিল ।

    সন্ধে সাড়ে সাতটা -

    হিমাচল প্রদেশ ট্যুরিজমের অফিসে বসে ভল্ভো-র অপেক্ষা - সিমলা যেতে হবে তো !

    রাত ন'টা -

    দিল্লীর ঘ্যাম ট্র্যাফিক জ্যাম ঘাম ঝরিয়ে দিল । দিল্লী পার করতেই মিনিটের সেঞ্চুরি পার হয়ে গেল । তারপর বাস দেখাল, ছুট কাকে বলে ।

    চৌঠা অক্টোবর - সকাল সাড়ে ছ'টা -

    রাতে করনালে পেটপুজো আর ভোর ভোর একবার চা-বিরতি দিয়ে ভল্ভো আমাদের সিমলার পথে বসিয়ে দিয়ে বিশ্রাম করতে চলে গেল ।

    সন্ধ্যা সাতটা -


    সিমলার `মল' -- দিনে


    সারাটা দিন `মলবাজি' করে হোটেল ডিপ্লোম্যাটে ফিরে ফ্ল্যাট । লক্কড়বাজার ধরে টুকুস টুকুস করে সিমলার মল-এ । ডানধারে ঘোড়াশালে সবেধন নীলমণি দুটো ঘোড়া । বাঁয়ে গাছ-শান্ত্রীর আড়ালে সোনার বরণ গান্ধীজি - আর চরম বামপন্থী সিমলার বিখ্যাত ত্রক্রাইস্টচার্চ ।


    সোনার বরণ গান্ধীজি ও ত্রক্রাইস্টচার্চ


    এদের সামনে দাঁড়াতেই নজর মল ধরে গড়াতে গড়াতে চলে গেল অ-নে-ক দূর । মলের বাঁ ধারে হিমাচলের প্রতিষ্ঠাতা পারমার সাহেব, আর তাঁর মুখোমুখি মলের ডান ধারে প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধীর সদাসতর্ক নজর । মল জুড়ে অসংখ্য নারী নর আর বানর - অকুতোভয় । মিউনিসিপালিটির বৃটিশ-বাড়ি ছাড়িয়ে ওদিকের মোড়ে দাঁড়ানো লালা লাজপত রাইকে ছাড়িয়ে মল তিন দিকে তিনটে পথ হয়ে ছড়িয়ে গেছে । তার একটা গেছে কালীবাড়ির দিকে । এই শ্যামলা মায়ের নামেই নাকি সিমলা । লাল চেককাটা সাদা জামা পরা জি. পি. ও, ইটরঙা ওভারকোর্ট গায়ে স্টেট লাইব্রেরি - বাকিরা সব ঘুরে বেড়ানো মানুষজনের মতোই রংচঙে পোশাকে মোড়া । শুধু গাছগুলো কালচে সবুজ সাজে সবার থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে । পেরাম্বুলেটরে সওয়ার নবীন থেকে লাঠি ভর দেওয়া প্রবীণ - সবারই ঠোঁটে হয় আইসক্রীম, নয় কফির কাপ । অলস ভ্রামণিকদের ফাঁকফোকর দিয়ে কেজো মানুষদের ব্যস্ত যাতায়াত ।


    লক্কড়বাজার


    লক্কড়বাজার তার পশম আর কাঠের শিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছে - চলছে দরদাম নিয়ে টানাপোড়েন । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বধ হচ্ছে ক্রেতারাই - হাসিমুখে । বানরের ব্যস্ত খেতে আর গা চুলকোতে । ধীরে ধীরে মেঘের আড়ালে এগিয়ে এলো আঁধার চুপিসাড়ে । সারা সিমলা জুড়ে আলোর ফুল ফুটল ।



    সিমলার `মল'-- রাতে


    পাঁচই অক্টোবর - সকাল সাড়ে সাতটা

    সারথি বিকাশ শর্মার হেফাজতে পবননন্দন বাহিত (??) চেপে সিমলা ত্যাগ - খাড়াপথ্থরের উদ্দেশ্যে । কুফরি, ফাগু, হয়ে ঠিওগ - পথ বন্ধুর, ফলে বন্ধুর মতো ব্যবহার তার কাছে আশা করাই বৃথা ।

    সকাল সাড়ে সাতটা

    হরিষে বিষাদ । কলকাতার ভ্রমণসংস্থার কথা এখানে এসে কাজে কিছুই মিলছে না । সিমলার বাসস্ট্যাণ্ড থেকে গাড়ি, থাকা-খাওয়া হিমাচল হেল্প ট্যুরিজমের দায়িত্ব - খড়াপথ্থর, হাটকোঠি, সারাহান, সাংলা, ছিত্কুল, কল্পা, নারকাণ্ডা - এই ছিল চুক্তি । কিন্তু এইমাত্র বিকাশবাণী হলো - সারাহান, সাংলা আর কল্পায় থাকা আর গাড়ি, এইটুকুই - বাকিটা নাকি আমাদের ! বিনামেঘে বজ্রপাত কাকে বলে বিভুঁয়ে এসে ফেঁসে টের পেলাম । প্যাঁচামুখো হয়ে রওনা হওয়া গেল । ঠিওগ থেকে নারকাণ্ডার পথের থেকে মুখ ফিরিয়ে রোহড়ু যাবার পথ ধরল গাড়ি । প্রকৃতির প্রলেপে সমস্ত ক্ষত চাপা পড়ে গেল ।




    গিরিগঙ্গার আশ্রয়


    ভরদুপুর পেরিয়ে আধঘন্টা -

    প্রকৃতিকে সর্বাঙ্গে মেখে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে নতুন আনন্দ সংগ্রহ করতে করতে এসে পড়লাম খাড়াপথ্থরে গিরিগঙ্গার আশ্রয়ে । প্রকৃতি এখানে অনাবিল । পাথুরে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ঘিঞ্জি গলি টপকে একফোঁটা এক দুর্গামন্দির - মূর্তি বলতে ফুট দশেকের এক খাড়া পাথর জরির পাড় দেওয়া লাল কাপড় জড়ানো - এঁরই নামে খাড়াপাথ্থর । একছটাক বাজারটা বড় মলিন, অনাদৃত । খানিক তফাতে ফিটফাট পান্থনিবাস গিরিগঙ্গা - ঝকঝকে তকতকে । ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই সবুজ গ্যালারি অসংখ্য গাছপালা আর গুটিকতক বাড়ি নিয়ে গড়াতে গড়াতে নেমে গেছে হুই অতলে - বোধহয় নদীপানে । তারপর আবার মুখ তুলে চড়তে চড়তে সবুজ থেকে নীলচে সবুজ, নীল, শেষে ধূসর ঢেউ হয়ে গিয়ে মিশেছে তুষারকিরীটিদের পদতলে । মাঝে তাদের ঘিরে খেলে চলেছে নানাবয়সী মেঘের দল - কখনও ঢাকছে, কখনও খুলছে । কিন্তু গুরুমশাই গোছের মেঘ আকাশ থেকে সেই খেলা দেখছে । একলা ঈগল আপনমনে চক্কর কাটছে । বাংলোর সামনের পথটা একপাশে আপেলবাগান অন্যপাশে পাইনবন নিয়ে শুয়ে রয়েছে চুপটি করে ।

    রাত আটটা -

    আঁধারমাখা খাড়াপথ্থরের গায়ে সযতনে জোছনা ঢালছে চাঁদমামা । সারাদিনের হুটোপুটির পর মেঘেরা এখন শান্ত, ক্লান্ত । আমাদের ক্লান্ত চোখ জুড়েও নেমে এলো ঘুম ।



    লক্কড়বাজারের পথে

    (ক্রমশ:)



    (পরবাস ৪৫, এপ্রিল, ২০১০)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)