কোন্ গোত্রে ফেলবো এ' অভিজ্ঞতাকে? ভৌতিক? কিন্তু আমরা তো চোখে কিছুই দেখিনি । উদ্ভট, অবাস্তব? কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতাকে নস্যাৎ করব কোন্ অধিকারে? বিদেহী আত্মা, বা তার ভর করা কোনো বর্তমান মানুষের ওপর ------- এ'সব তো মধ্যযুগীয় কুসংস্কার । আজকের মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের যুগে তারা সব কোথায় পালিয়েছে !
কিন্তু তাহলে আমাদের অভিজ্ঞতাটির ব্যাখ্যা কী?
যাহোক্, পুরো ঘটনাটা গোড়া থেকেই বলি :
এবার শীতের ছুটিতে আমাদের বেনারস বেড়াতে যাওয়া সাব্যস্ত হল । কাশী বা বারাণসী হল ভারতে বাঙালির দ্বিতীয় গৃহ । পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আর কোথাও বাঙালির এতবড় উপনিবেশ নেই । বিশ্বনাথের গলি থেকে দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে 'ভু'------- দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই । কাছেই সারনাথ, বুদ্ধদেবের প্রথম ধর্মপ্রচারস্থল । আর, "বিশ্বনাথ-গলির রাবড়ি যে না খেয়েছে, তাকে ভারতীয় বলতে আমার ঘোর আপত্তি আছে" ------- ভোজনরসিক অধ্যাপক শ্যামলকুমার ঘোষণা করিলেন ।
তাই বেনারস ।
আমার সুপুত্র অয়নচন্দ্র অবশ্য একটু গাঁই-গঁংউই করছিল "এত কাছে" বেড়াতে যাবার প্রস্তাব শুনে, কারণ ওদের ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা নাকি শীতের ছুটিতে "হিলারিয়াস য়ুরোপিয়ান" ট্যুর না হলেও নিদেন ব্যাঙ্কক-পাটায়া ঘুরতে যায় । কিন্তু বেড়ানোর আনন্দের সঙ্গে গন্তব্যের দূরত্বের যে কোনো সমানুপাতিক সম্পর্ক নেই------- এ'বিষয়টা তার নীতিনকাকু বুঝিয়ে বলাতে সে-বেচারি লজ্জা পেয়ে গেল ।
তোমরা যারা পরে এসেছ আর "টিম বিজুদা"-র সঙ্গে পরিচয় হয়নি, তাদের জন্য জানাই, আমরা হলাম এক দল 'প্রবাসী' বাঙালি, তবে 'প্রবাস'টা সত্যি সত্যি ভারতের বাইরে নয়, আমরা থাকি দিল্লির পাশেই নোতুন শহরতলী নয়ডাতে । আমি নিরীহ শ্রীযাদুগোপাল (নামটি অবিশ্যি বিজুদার দেওয়া ও তা বারেবারেই মুড বুঝে বদলায়), আমার পুত্র শ্রীমান অয়ন পড়ে ক্লাস ফাইভে, তার মা হলেন অতীব কৃশকায়া শ্রীমতী সুমিত্রা দেবী, যাঁর শখ ত্রক্রশওয়ার্ড পাজ্ল্ সল্ভ্ করা আর মাঝে মাঝে 'সায়েন্টিফিক আমেরিকান ইণ্ডিয়া'-র পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে নিজবিষয় জুলজির আর্টিক্ল পড়া । আমরা চাকুরিসূত্রে এই নোতুন শহরে এসে একদল বন্ধু পেয়ে গেছি । তার মধ্যে শ্যামল ছিলো আমার স্কুলের বন্ধু, এখানে এসে ফের দেখা বহু বচ্ছর পরে ও নোতুন করে বন্ধুত্ব । আমরা থাকিও একই হাউসিং কমপ্লেক্সে । শ্যামল-লিলির মেয়ে রূপা অয়নদের চেয়ে এক ক্লাস নিচে পড়ে । অয়নের সঙ্গে একই সঙ্গে পড়ে হল গুগ্গুল, যার ভালো নাম শ্রীমান দীপ্যমান বন্দ্যোপাধ্যায় । গুগ্গুল হল অয়নের মায়ের ছোটবেলার পাড়াতুতো বন্ধু অনুর ছেলে । এখানে এসে দেখা গেল আমাদের ঠিক পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে অনুরা । গুগ্গুলের বাবা সুদীপ অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেল তার মজারু স্বভাবের জন্য । এছাড়া রয়েছে নীতিন ও সীমা । আমাদের চেয়ে বয়সে সামান্য ছোট । ওরা যদিও মাড়বারি, ছোটবেলায় থাকত কলকাতায় আর বাঙলা বোঝে যে কোনো বাঙালিরই মত । বিজুদার গপ্পের আসরের নিয়মিত খদ্দের হল নীতিন ও সীমা ।
বিজুদার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, আমাদের চেয়ে গড়ে সতের বছরের বড় । সম্পর্কে যদিও আমার অফিসের 'বস', কিন্তু কলেজের সিনিয়রও বটেন আর তা থেকেই তাঁর সঙ্গে আমাদের বর্তমান ঘনিষ্ঠতার সুত্রপাত । বিজুদার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অফুরন্ত, দেশে ও বিদেশে, এবং তার বেশিরভাগটাই হল নানান উদ্ভট অব্যাখ্যাত বিষয়ে, যা নিয়ে গল্প বলে বলে অয়ন-রূপা-গুগ্গুলদের কম্প্যুটার গেম্স থেকে দূরে রাখতেই তাঁর এই আসরের শুরুয়াৎ । যদিও এখন কচি-কাঁচাদের পাশাপাশি আমরা, তাদের মা-বাবারাও, বিজুদার গপ্পের ভক্ত হয়ে পড়েছি । বিজুদার একটাই দোষ, আমাদের নাম মনে রাখতে পারেন না । কখনও আমাকে 'হরগোপাল' বা সুদীপ কে 'চিনিবাস' বা নীতিনকে 'প্রসাদ রায়' বলে ডাকেন । পরমুহূর্তেই হয়ত আমি হয়ে গেলাম 'গুলাবচন্দ', সুদীপ 'রঘুকিঙ্কর' ও নীতিন 'সেলিম' (আমাদের যদিও চিনতে অসুবিধে হয় না, কাকে ডাকছেন) । কেবল শ্যামল গম্ভীর অধ্যাপক মানুষ বলে তাকে খেয়াল করে সর্বদাই 'পোরোফেসর সাআব' বলে ডাকেন । বিজুদা ভক্ত হলেন অর্গানিক চায়ের (যেটা তাঁর গল্পের ফাঁকে ফাঁকে যোগানো চাই), আর সহ্য করতে পারেন না গপ্পের মাঝখানে মোবাইল ফোন বেজে ওঠা ------- যে-বিষয়ে আমাদের সদা সতর্ক হয়ে থাকতে হয় ।
হঁযা, যে গল্প হচ্ছিল : ঝকঝকে রোদের এক শীতসকালে লিচ্ছবি এক্সপ্রেস থেকে বেনারসে নেমে রাস্তায় নানারঙা মানুষজন বাস-অটো-টাঙ্গা দেখার এক আলাদা আকর্ষণ আছে, কারণ চরিত্রে বেনারস অনেক 'পূর্বি', দিল্লির মত কসমোপোলিটান নয় । এসে থেকে তিনটে দিন আমাদের কোথা দিয়ে যে কেটে গেল বুঝতে পারলাম না । প্রথমদিন শহর ঘুরে আমরা চলে গিয়ে ছিলাম 'ভু' দেখতে । 'ভু' মানে বি এইচ য়ু, 'বেনারস হিন্দু য়ুনিভার্সিটি' ------- পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যের অক্ষয় কীর্তি ! দ্বিতীয় দিন প্রোগ্রাম ছিল সারনাথ, বেনারস থেকে মাত্র আট মাইল । সারনাথের পাশেই মৃগদাব ------- এখানেই তথাগত বুদ্ধদেব প্রথম তাঁর ধর্মোপদেশ দেন পাঁচজন শিষ্যের কাছে । সারনাথ মিউজিয়মেই রয়েছে মহামতি অশোকের ধর্মচক্র আর অশোক স্তম্ভ ------- ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতীক । তৃতীয় দিন যাওয়া হল নীতিনের এক শ্বশুরবাড়ি, মানে সীমার এক দাদু, বাবার কাকাবাবু দ্বারকাদাস অগ্রবালজীর 'গরীবখানা'-য় । তেনারা বারাণসীর পাঁচ পুরুষের অগ্রগণ্য ব্যবসায়ী, অতীব সজ্জন মানুষ । 'গরীবখানা'-য় দক্ষিণহস্তের যা এলাহি ব্যবস্থাংআ ছিল ! পাক্কা মাড়বারি খানা ! ঘরে বানানো দেশি ঘিউ ছাড়া আর কিছু ঢোকবারই হুকুম পায় না তথায় ।
সেখানেই প্রথম চুনারের কথাটা উঠল, নৈলে চুনারে বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা আমাদের আদতে ছিল না । দাদাজিই শোনালেন, "কাল কী করছেন? চুনারের নাম শুনেছেন? চুনার? এখান থেকে মাত্র পঁচিশ মাইল, গঙ্গার ওপারে । দু' হাজার সালের পুরানা কিলা আছে, শকারি বিক্রমাদিত্যের আমলের । ভারতে এর চেয়ে পুরানা কিলা আর গিনে-চুনেই মাত্র টিকে আছে । যান, দেখে আসেন পুরানা হিন্দু যুগের কীর্তি ! ওখানে আমাদের এক পথ্থরের কারখানা আছে । আমাদের গাড়ি আপনাদের কাল লিয়ে যাবে, ঘুরিয়ে লিয়ে আসবে ।"
ইতিহাসের নাম শুনলে তো আমাদের অধ্যাপকমশাই লাফিয়ে ওঠেন । শ্যামল বললও, "হঁযা হঁযা, বেশ হয় । চুনার ফোর্টের নাম তো শুনেছি, দেখা হয়নি । চল, এ'ফাঁকে এক দিনের শীত-পিকনিকও হয়ে যাবে ।"
পিকনিকের নামে কচি-কাঁচার দল আনন্দে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল !
এখন ভাবি, এ' কি পূর্বলিখন ছিল ?
আজ এই চুনার দূর্গে এসে মনে হল যেন এক নি:সঙ্গ প্রাচীন প্রপিতামহ তাঁর সব আগ্রহ নিয়ে শুধু আমাদের আগমনের প্রতীক্ষাতেই বসে আছেন !
আজ সকালে কাগজে দেখেছি কালকের ন্যুনতম্ তাপমান ৬ ডিগ্রি সে. গেছে । মিঠে রোদে ঘুরে ঘুরে আর গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়া খেতে খেতে লাঞ্চের কথা ভুলেই যেতে বসেছিলাম আমরা । ছেলেমেয়েরাও সব খেলাধুলায় মত্ত । সুদীপ কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখে বলল, "দেড়টা তো বাজলো এবার ডান হাতের বন্দোবস্ত কিছু করো ।" সঙ্গে আনা ছিল শুকনো খাবার এককাঁড়ি, টুকরি ভরে ------- স্যাণ্ডুইচ থেকে ডিমসেদ্ধ, আপেল-কমলা থেকে জয়নগরের মোয়া (হঁযা, বেনারসে এই আদত বাঙালি মিষ্টিটি পাওয়া যাচ্ছে দেখে আমরা গাড়ি থামিয়ে এক হাঁড়ি তুলে নিয়েছি) । ডিম-টিম অবশ্য আলাদা আনতে হয়েছে । কারণ নীতিন-সীমা হল 'শুদ্ধ শাকাহারী', আমিষে ঠেকাঠেকি খানা খেতে ওদের আপত্তি আছে ।
আমাদের খেতে দিতে দিতে সুমি বলল, "বিজুদা কোথায় গো ? জয়নগরের মোয়া বিজুদা বড্ড ভালোবাসেন । তাই জয়নগরের মোয়া খেলেই বিজুদার কথা মনে পড়ে ।" মধুরেণ সমাপয়েত্-টা ঐ জয়নগরের মোয়া দিয়েই হচ্ছিল কিনা ।
সুমিত্রার বলা শেষ হল না, ওপরের পাথর বাঁধানো পথ বেয়ে দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে নামতে নামতে রূপা আর গুগ্গুল চেঁচাতে লাগল, "মা, মা, কাকু, কাকু, মানে জেঠু জেঠু !"
কাকু, মানে জেঠু, মানে বিজুদা ? মানে শ্রীবিজনবিহারী সরকার ? এখন, এই মুহূর্তে, এই চুনার দুর্গে ? একি ভোজবাজি নাকি ? এই মাত্র বিজুদার নাম করা হল আর সঙ্গে সঙ্গে উনি এখানে হাজির ? কোথায় উনি ?
"জেঠু ওই ওপরের বুরুজটার সামনে বসে পুজো করছে," উত্তেজনায় হাঁফাতে হাঁফাতে বলল গুগ্গুল ।
"পুজো করছেন ? বিজুদা এখানে বসে ? দূর পাগল, তুই কাকে দেখতে কাকে দেখেছিস," অনু বলে ।
"না গো মা । এক কালো জোব্বা পরা ফকিরও আছেন ।"
"তোকে কী বললেন ?"
"আমাদের কী বলবে ? দেখেইনি তো আমাদের । আমরাই তো দূর থেকে দেখলাম ।"
"চল্ তো দেখে আসি ।"
এবার আমরা দলবল নিয়ে খাবারের কৌটোবাটা শতরঞ্জি গুটিয়ে ওপরের পথ বেয়ে উঠতে লাগলুম । দুর্গচূড়ার কিছু আগে প্রাকারের ধারে গঙ্গার দিকে পিঠ করে মাটিতে জাজিম পেতে বসে আছেন কালো জোব্বা পরা দাড়িওয়ালা এক দরবেশ সাহেব । সামনে সুগন্ধী আগরবাতি জ্বলছে, কোষাকুষির মত দেখতে আরও কিছু সাজ-সরঞ্জামও সাজানো রয়েছে,কালো এক বড় রুমালের ওপরে । তার সামনে হাঁটুমুড়ে মাটিতে বসে যিনি, পেছনদিক থেকে তাঁর ঘি-রঙা হ্যারড জ্যাকেটটি চিনতে ভুল হয়নি আমাদের । দু'জনে গভীর কী আলোচনা করছেন । সহসা গিয়ে পড়ে বিরক্ত করতে কুন্ঠিত হচ্ছি আমরা । কিন্তু বোধহয় বেশ নিকটেই পৌঁছে গিয়েছিলাম, কারণ পদশব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে একগাল হেসে বললেন বিজুদা, "আর এ' যে হংসবলাকা !" দলের প্রথমেই সীমা ছিল, তাকেই ডাকা এই নতুন নামে ।
আমরা সকলে হৈ হৈ করে উঠলাম, "বিজুদা, আপনি এখন, এখানে ? তবে যে
বলেছিলেন শীতের ছুটিতে ভায়ের কাছে মুম্বাই যাবেন ?"
"আরে আরে আরে আরে তোরা সব কোথা থেকে দল বেঁধে এখানে এসে উপস্থিত হলি রে ? অবাক কাণ্ড দেখ, একটু আগেই আমি তোদের কথাই ভাবছিলুম, কারণ আজ........," একটু রহস্যময় হাসেন বিজুদা, "আচ্ছা, তার চেয়ে আয় আগে এনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই," ভাঙা ভাঙা হিন্দুস্তানিতে বলেন বিজুদা, "কামাল সাহেব, এনারা হলেন আমার ভাই-বোনেরা । ইনি শ্রীমান বিট্টুনাথ, উনি মহিউল, ইনি শ্রীমান সন্তোষ ।"
আমরা থতমত ! বিজুদা যে উপনামেই আমাদের ফর্মাল পরিচয়ও করে দিতে শুরু করে দিলেন । কিন্তু বিজুদা নির্বিকার বলে চলেন । ফকির মানুষটিও "বেশ বেশ" ভঙ্গিতে হাত তুলে তুলে সকলকে কুশল জানালেন ।
"আপ সব কলকাত্তা সে তশলিফ লা রহেঁ হেঁ ক্যা ?" বাঙালি বলতে প্রথমেই কলকাতার কথাই মনে আসে সকলের, কিন্তু কলকাতার বাইরের বাঙালির সংখ্যা যে ভেতরের চেয়ে কয়েকগুণ !
ওনাদের কথাবার্তা বোধহয় শেষ হয়ে গিয়েছিল । কারণ এবার কামালসাহেব জাজিম গোটাতে গোটাতে বলেন, "তাহলে সরকার সাহাব, আপনার সঙ্গে ওই কথাই রইল । আজ ঠিক আটটার সময় আমাদের ফির মুলাকাৎ হবে পীর নাঙ্গাবাবার মজহরের পাশে । এই ফাগু আসবে আপনাকে নিয়ে যেতে ।" ফকিরসাহেবের হাত-নুড়কুৎ এক কিশোর ডেয়ো-ডাক্নাগুলো গুছোতে থাকে । এবার তাঁরা সব সরঞ্জাম নিয়ে ঢালু পথে নিচের দিকে হাঁটা দেন ।
এইবার আমরা সব ছেঁকে ধরলাম বিজুদাকে, কেন কী ভাবে হঠাৎ তাঁর এই চুনার দুর্গে আগমন, আজ ইসিবক্ত, সেটা বলতে হবে ।
"সে প্রশ্ন তো আমিও তোদের করতে পারি রে," বিজুদা বলেন ।
তা বটে, আমাদেরও তো আজ এখানে আসবার কথা ছিল না । তবে ?
"তাই জানিস, আমার মন বলছে আজ ঘটবে সে-যোগ । এ' তারই যোগাযোগ ও পূর্বলক্ষণ," বিজুদা কেমন এক উদাস-সন্দিগ্ধ স্বরে বলেন ।
"কী ঘটবে ? কোন্ লক্ষণের কথা বলছেন দাদা ?"
"কী লক্ষণ ?" হঠাৎ চোখ মট্কে দু'হাত তুলে একটু, যাকে বলে, মিসচিভাস স্বরে বলে ওঠেন বিজুদা, "ফিফটীন মেন অন দ ডেড ম্যান'স চেস্ট, ইয়ো হো হো এণ্ড এ বট্ল্ অব রাম !"
"গুপ্তধন !!" আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠি ! 'ট্রেজার আইল্যাণ্ড' কে না পড়েছে ?
"বলেন কি বিজনবাবু ? আপনি কি সত্যিসত্যি কোনো গুপ্তধনের সন্ধানে এখানে আজ এসেছেন না কি ?" গম্ভীর শ্যামলের গলায় খাঁটি বিস্ময় ।
"জী হাঁ, পোরোফেসর সাআব, গুপ্তধনের সন্ধানেই আজ এ'বান্দার আগমন এখানে । এবং এক্কেবারে তিথি-নক্ষত্র মিলিয়ে । তাই তো বম্বে-গোয়া ক্যানসেল করে চুনারে ঠেলে এসে উঠেছি ।"
এবার আমরা হাতজোড় করে বলি, "দাদা আর আমাদের টেনশনে রাখবেন না, এবার....."
"হঁযা, ঝেড়ে কাশছি । চল সকলে মিলে ওই ফাঁকা চত্বরটায় গিয়ে বসি চল্ ।"
"অবাক হচ্ছিস ? হঁযা রে, আগে আমি প্রবল তাম্বকুসেবী ছিলুম । বহুদিন পরে এই ক্যালাবাশ পাইপটা খঁংউজে পেয়ে শখ হল একটু ধূমপানের । এখানে তো আর আমাদের টি-কিং আমার জন্য অর্গানিক চা নিয়ে আসেননি । তাই একটু ধোঁয়া না দিলে গপ্পো বেরোবে না । তা, খোলা জায়গায় ধূম্রপানে তোমাদের কারোর আপত্তি নেই তো গো ?" চা-কোম্পানির সাহেব নীতিনের দিকে ফিরে বলেন বিজুদা ।
আর আপত্তি ! উত্কন্ঠায় মরে যাচ্ছি আমরা ! বিজুদা আবার এই চুনার দুর্গে কী গুপ্তধন খঁংউজতে এসেছেন ? এ' ও তো আরেক আদ্যিকালের ব্যাপার । গুপ্তধন-টন কি আর আজকের কালে পাওয়া যায় নাকি ? সে-সব তো সব মধ্যযুগেই খঁংউজে পাওয়া হয়ে গেছে । সত্যি মিথ্যে যা-ই হোক্, এবার তো আমরা সদলবলে হাজির । যা ঘটনা ঘটেছে বা ঘটবে তা সবই তো আমাদের চোখের সামনেই, পরে বিজুদা তো আর রঙ চড়িয়ে গল্প ফাঁদতে পারবেন না । সুদীপ-শ্যামল-নীতিন-আমি পরস্পর একবার আড়ে আড়ে চোখ ঠারাঠারি করে নিলাম ।
গঙ্গার দিকে মুখ করে এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে শুরু করেন বিজুদা :
"গুপ্তধন বলতে কী বোঝ তোমরা ?"
"সোনার মোহর আর হিরে-জহরত্," বিজুদাকে একটু উস্কে দিতেই সটান জবাব দেয় সুদীপ ।
হাসলেন বিজুদা । ধরতে পরেছেন আমাদের চালাকি । বললেন, "পুরনো পুরনো কপিবুক গুপ্তধন আবিষ্কারের গপ্পো পড়িস নি ? কোনো এক বিশেষ তিথিতে ঠিক অমুকটার সময় জ্যোত্স্নায় পাহাড়ের চুড়োর ছায়াটা ঠিক যেখানে পড়ে, সেখানেই............"
"মানে, আপনার এ' গুপ্তধন ঠিক তিথি-নক্ষত্র মেনে কোনো একদিন পাওয়া যায়, অন্য সময় ফক্কা ?"
সুদীপের হল কী ? আজ সমানে টক্কর দিয়ে চলেছে বিজুদার সঙ্গে ।
বিজুদা রাগ করলেন না । বললেন, "জী হাঁ । আজই সেই তিথি------- ঈসামসীহার আবির্ভাবের পুণ্যলগ্ন, তাও যদি সে-দিনটা মুহররম মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পড়ে । যেটা এ'বছর পড়েছে । সেটা জানতে পেরেই না আমি এখানে এসে ক্যাম্প গেড়ে পড়ে আছি ।" বিজুদার গলা সম্পূর্ণ সিরিয়াস, মস্করার চিহ্ন নেই তাতে ।
"মানে, দাদা, এই চুনার দুর্গের মধ্যে কোথাও সোনাদানা পোঁতা আছে ?" লিলির গলায় পাক্কা অবিশ্বাস ।
"সোনাদানা ছাড়া গুপ্তধন হয় না ?" বিজুদা বলেন, "ক্রিস্টির লিস্ট দেখ না, আন্তর্জাতিক বাজারে এক নামী আর্টওয়ার্কের দাম কয়েক পেটি সোনাদানার সমান ।"
"মানে, এই চুনার দুর্গে কোনো প্রাচীন আর্টওয়ার্ক লুকোনো আছে বলতে চান ? মুঘল মিনিয়েচার ?" শ্যামলের গলা সিরিয়স ।
"না, ওটা তো এক উদাহরণস্বরূপ বললাম", বিজুদা বলেন, "সোনাদানা ছাড়া শিল্প-সামগ্রীও মস্ত দামী চিজ হয়ে থাকে । যেমন, আজ যদি মুন্সী প্রেমচন্দজীর এক অনাবিষ্কৃত উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি খঁংউজে পাওয়া যায়, সাহিত্যমূল্য ছাড়াও তার বাণিজ্যিক মূল্যও অত্যাধিক হবে না কি ? চিত্র, কাব্য, সঙ্গীত এ'সবই মহা মহা ধন । নোতুন করে খঁংউজে পেলে তা সোনাদানার চেয়ে কোনো অংশে কম গুপ্তধন লাভ নয় ।"
"কিন্তু জেঠু হারানো সঙ্গীত কী করে খঁংউজে পাওয়া যাবে ? প্রাচীনকালে তো আর গান রেকর্ড করা যেত না," অয়নের জিজ্ঞাসা ।
"এই তো, এই তো, তোর ছেলে ঠিক জায়গাটি ধরেছে রে জনার্দন !" অয়নের পিঠ চাপড়ে লাফিয়ে ওঠেন বিজুদা, "তাহলেই বল অয়নবাবু, আজ যদি তুমি মিঞা তানসেনের নিজগলায় গাওয়া গান শুনতে পেতে সেটা এক মস্ত ধনলাভ হত না কি ? এক পেটি সোনাদানা পাওয়ার চেয়ে সেটা কি কম বড় গুপ্তধন লাভ ?"
আমরা পরস্পর মুখ তাকাতাকি করতে থাকি ! আজ আবার বিজুদা এ-কোন্ আষাঢ়ে গপ্প ফাঁদতে চলেছেন ? লুপ্ত সঙ্গীত ফির শুনতে পাওয়া, তাও আবার শিল্পীর নিজকন্ঠে ?! আজ এখন এখানে শোনা যাবে ? এ তো উদ্ভট পাগলামি ! কিন্তু আজ যে আমরা সদলবলে অকুস্থলে উপস্থিত, রঙ চড়ানোর মওকা বিজুদা পাবেন কোথায় ?
"আভাস পাচ্ছি তোমাদের মনের ধোঁয়াশার," বলেন বিজুদা, "দেখ, আমিও পাক্কা কিছু জানি না । এক বিশ্বস্তসূত্রে পাওয়া সংবাদের ভিত্তিতেই আমার এখানে আগমন ।"
"দাদা, সে-লুপ্ত সঙ্গীত আমরা শুনতে পাই না ? কোনো স্বর্গীয় সুর ?" সুমি বলে ।
"জানি না, আমি ঠিক জানি না । কামালসাহেবকে পুছতে হবে," উদাস গলায় বলেন বিজুদা ।
"তা জিজ্ঞেস করে নিন না দাদা," বলি আমি, "এতোদিন তো আপনার মুখেই বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গল্প শুনে এসেছি আমরা । আজ চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জনটা হয়েই যাক্ ।"
"কিন্তু সে-কাণ্ড নাকি ঘটে থাকে আজ প্রায় মধ্যরাত্রে । তোমাদের কি আজ চুনারে থেকে যাবার প্ল্যান আছে ? সঙ্গে ছেলেপুলেদের ভালো গরম কাপড় আছে তো ? এই প্রবল শীতে......." উত্কন্ঠিত গলায় বিজুদা বললেন ।
ফিরে যখন এলেন, বিজুদা এক অন্য মানুষ । গম্ভীর মুখ, দৃষ্টি বিহ্বল । অতীব সিরিয়াস লুক । আমরা পরস্পর মুখ তাকাতাকি করছি । তাড়াতাড়ি রাত-আহার সেরে আমরা যখন দল বেঁধে বিজুদাকে অনুসরণ করছি, ঘড়িতে ন'টা বাজে । সারা শহর নিষ্প্রদীপ । এমনটাই নাকি এখানকার দস্তুর । প্রবল ঠাণ্ডা, ডিগ্রি তিনেকের ওপরে হবে না । কোট-আলোয়ান-কম্ফর্টার মুড়ে লেফট-রাইট করতে করতে চলেছে আমাদের বাহিনী বিজুদার নেতৃত্বে । না, সেই দুপুরে দেখা ফকির সাহেবের সাথি কিশোরটির নেতৃত্বে । সে-ই লন্ঠন হাতে সর্বাগ্রে চলেছে আমাদের পথ দেখিয়ে দেখিয়ে । কত রাস্তা রে বাবা ! পথ শেষই হতে চায় না । একবার মনে হল চড়াই পথ বেয়ে দুর্গে উঠছি, পরে মনে হল, না দুর্গকে পাশ কাটিয়ে চলে গেছি, পরে মনে হল ঘুরপথে ফের দুর্গেই ঢুকলাম না কি ? রাতে কি দুর্গে ঢুকতে দেয় ? কোনো গোপন পথ আছে না কি ? চলছি আর ভাবছি । এরমধ্যে কখন এক ছোট গৃহের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছি আমরা সকলে । আবছা আলোয় মসজিদের গম্বুজ দেখলাম বলে মনে হল । খিলান দেওয়া ছোট ফটক মাথা নিচু করে পেরিয়ে অন্দরে আসতে সেই কিশোর ধীরস্বর ডাকল, "আব্বু, আব্বুজান ।"
খুট্ করে শব্দ হল । দরজাটা খুলে গেল । ভিতরে লন্ঠন জ্বলছে । সেই দুপুরে দেখা ফকির সাহেব । স্মিত হেসে বললেন, "তসলিফ লাইয়ে ।"
আমরা সকলে একে একে এসে যেখানে প্রবেশ করলাম, ছোটখাট হলঘর একটি । দু'কোণে দুটি হারিকেন বাতি জ্বলছে । আগরবাতির সুমিষ্ট বাস আসছে । মাটিতে মস্ত এক জাজিম পাতা রয়েছে ঘরের অর্ধেকখানি জুড়ে । আমরা সকলে জুতো খুলে সেখানে এসে বসলাম । কারোর মুখে কোনো কথা নেই । একসঙ্গে এতোজন আছি তাই, নৈলে এই শীতরাতে অচেনা উপাসনাগৃহের গম্ভীর পরিবেশে বুক দুরুদুরু করতই ।
সম্বিৎ ফিরল বাঁশির মধুর সুরে । বিজুদা কখন ফরাসের সামনে এসে বসেছেন আর আপন মনে ফঁংউ দিয়ে চলেছেন তাঁর আড় বাঁশিটিতে । বিজুদার বাঁশির গল্প আগে শুনেছি অনেক, কিন্তু বাঁশি শুনিনি কখনও । অদ্ভুত মনকাড়া সুর, মোহময় । এত অসাধারণ বাঁশি বাজান বিজুদা ! অসাধারণ ! মার্গ সঙ্গীতের গলিঘঁংউজি চিনি না আমরা, কিন্তু শুদ্ধ সঙ্গীতের এক আবেদন আছে, সেটা পেতে ব্যাকরণ না জানলেও চলে । মনে হল কোনো পূজার আঙিনায় উপস্থিত হয়েছি, সঙ্গীতে যেন তারই আবাহন । এটা কি রাগ মালকোষ, মল্লকৌষিক ? মিল আছে চেনা গান "মন তড়পত হরি দরশন কো আজ"-এর সঙ্গে ।
"এবার একটা গল্প বলি শোনো অয়নবাবু," বিজুদা শুরু করেন আজকের গল্প । গলার স্বর আগের আগের গল্পের আসরের চেয়ে অনেক খাদে, গম্ভীর । বাঁশির সুর কখন থেমে গেছে ।
"আজ থেকে প্রায় একশ' বছর আগে বেনারস শহরে এক গুণী গায়িকা থাকতেন । তখন অবশ্য বেনারস-লক্ষ্মৌতে হিন্দোস্তানি গাইয়ে-বাজিয়েদের চাঁদের হাট । তার মধ্যে ইনিও ছিলেন এক নক্ষত্র । রাজার সভাগায়িকা, এ'অঞ্চলের বড় বড় শ্রেষ্ঠীদের ঘরেও তাঁর ডাক পড়ে । প্রভূত ধনসম্পত্তির মালকিন, দোর্দণ্ড প্রতাপ । মস্ত হাভেলি কাশী শহরে । ঘরে লোকলস্কর চাকরবাকরের অভাব নেই । তবু তারই মধ্যে তাঁর খাস সেবিকা তাঁরই এক মাত্র বোনঝি, মা-মরা মেয়েটি । আশ্রিতা । ভোর ছ'টায় উঠে উনুনে আঁচ দেওয়া থেকে রাত বারোটায় এঁংএটা বাসনকোসন মেজে তবে তার ছুটি মেলে । সারা দিনে একদণ্ড পা মুড়ে বসবার উপায় নেই, মাসির ফাই-ফরমায়েস লেগেই আছে । পান থেকে চুন খসলে মেলে দাপুটে মাসির তুখোড় মুখঝামটা । গানের পরিবেশে লালিতা মেয়েটির বড় ইচ্ছে করে গান শিখতে । সব্জী ছিলতে ছিলতে বা কোনো এক দুপুরে একটু ফাঁক পেয়ে গেলে আপন মনেই গেয়ে ওঠে মেয়েটি শুনে শুনে শেখা দু'এক কলি কাজরি : 'জব সুধি আে ও রামা ।'
কিন্তু কে তাকে শেখাবে গান ? তার জন্যে তো মাসির পেয়ারের মেয়ে কমলিনীই রয়েছে, যার তালিমে জন্যে মাস্টার, খাবার জন্যে বানানো পদ্মকোরক দেওয়া আসলি ঘিয়ের কলগাট্টা হালুয়া । কমল কিন্তু দু:খি দিদিটিকে বড়ই ভালোবাসে, লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে গিলিয়ে দেয় সে কলগাটা হালুয়া, যা খেলে নাকি গলার তাসির বাড়ে । আসলে, গান শেখার বিন্দুমাত্র আগ্রহ বা প্রতিভা নেই কমলিনীর । কিন্তু সে-সত্য তার মা মানলে তো !
একদিন সকালে তার মাস্টার একটা টপ্পা কিছুতেই কমলিনীর গলায় তোলাতে পারছেন না, কিছুতেই পারছেন না । পাশের ঘরে ধৈর্যচ্যুতি ঘটল সঙ্গীতসাম্রাজ্ঞীর । মারমুখী হয়ে তেড়ে আসেন রাজেশ্বরী নিজের মেয়ের দিকে, "তোকে আজ এ' টপ্পা গলায় তুলতেই হবে, তুলতেই হবে । নৈলে তেরা জান আজ মৈ লে কে রাখ লুঙ্গী ।"
ভয়ে ঘাবড়ে আরও বেসুর হয় বেচারি । আমাদের দু:খী মেয়েটি ছোট বোনকে বাঁচাতে ছুটে আসে : "গা না কম্লি, গা না, বেশ সহজ তো । এই, ঠিক এই ভাবে গা তো আমার সঙ্গে,"------- বলে গেয়ে ওঠে সে ।
যুগপৎ তার মাসি ও মাস্টারজি চমকে ওঠেন । এ কী শুনছেন তাঁরা উপেক্ষিতা ঝি-এর গলায় ? এই যদি বে-তালিম গায়ন হয় তো শিখলে এ কোন্ শিখরে পৌঁছুবে ?
সে-রাত গুরুজি দু'চোখের পাতা এক করতে পারেননি । সকল গুরুই চান তাঁর অধীত বিদ্যা সত্পাত্রে দিয়ে যেতে, তার মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকতে । এই কী সেই সুযোগ পেলেন গুরু শিয়াজি রাও ? মনস্থির করে ফেলেন গুরুজি । পরেরদিনই তিনি এসে মেয়েটিকে ভিক্ষা চান রাজ্ঞীর কাছ থেকে -- শিষ্যা হিসেবে । প্রতিদানে মিলল তিরস্কার, অপমান ও বহিষ্কার । তাঁর বিন্-বেতনের ঝি-টিকে হাত ছাড়া করতে চাননি রাজেশ্বরী । মনস্থির করেই এসে ছিলেন শিয়াজী । কন্যাসমা শিষ্যাটিকে নিয়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে এলেন পথে । তার মামা অমরনাথজীও সাথ দিলেন ।
হঁযা, সত্যিই পথে । কারণ দু:স্থ সঙ্গীতগুরুর নিজেরই অন্নসংস্থান ছিল না । বহুকষ্টে বাজারের মধ্যে এক কুঠরি মিলল সস্ত্রীক গুরু শিয়াজি ও কন্যাসমা শিষ্যার, এবং অনশনে-অর্ধাশনে কঠোর তপস্যা চলল গুরুশিষ্যা দু'জনেরই ।
এই বাড়িরই সিঁড়ির নিচে এক সন্ত ফকিরের মাজার ছিল । মেয়েটি তার দু:খের দিনে তাঁর স্নেহচ্ছায়ায় সাহারা পেত । প্রতিদিন ধুয়েনেপে তকতকে রাখত মাজারটি । কালে যখন সে এক ভারতবিখ্যাত গায়িকা হয়েছে, তখনও সে কিন্তু ভোলেনি বাল্যের তপস্যাস্থল । নিজব্যয়ে মাজারটি পরিমার্জন করিয়েছে, এক মৌলবি সাহেবকে দিয়ে প্রতি জুম্মাবারে অর্চনা করিয়েছে তীর্থস্থানটির । অবশ্য এর সঙ্গে আরও একটু কৃতজ্ঞতাও ছিল । আমাদের আজকের গল্পের পটভূমিকা সেটাই ।
এরপর দীর্ঘ সাত বছর কেটে গেছে । কঠোর রেওয়াজে একটা জায়গায় পৌঁছেছে আজ আমাদের গল্পের নায়িকা ।
"সিণ্ডারেলা", সীমার গলা ।
বিজুদা কিন্তু গল্পে বাধা পড়ায় বিরক্ত হলেন না, স্মিত হেসে গল্প চালিয়ে যেতে লাগলেন ।
"হঁযা, বিশ-বাইশ বছরের মেয়েটি তখনই ডাক পেতে শুরু করেছে বেনারস-লক্ষ্মৌ-এলাহাবাদ-দ্বারভাঙ্গা থেকে । তার ভারি-ভরকম্ স্বরের বেনারসি টপ্পা-ঠুংরি-ভজনের কদর করতে শুরু করেছে গুণীজন । কিন্তু এমন সময়ই ঘটে গেল সেই দুর্ঘটনা ।
সে-সন্ধ্যায় বেনারসের কাছেই এক আসরে ডাক ছিল তার । আসরের চাহিদা বুঝে আসর মাত করতে দেরি হয় নি মেয়েটির । আসর শেষ হতেই তাই তারিফের ঝড় বইতে শুরু করে দিল । সকলেই কুর্নিশ জানায়, নজরানা দেয় । এই ভিড়ের মধ্যে কেউ তার হাতে এক খিলি মঘাই পান দিয়েছিল । আসরেরে পর গলাটা শুকিয়েই ছিল, তাই অভ্যেসবশে পানটি মুখে দেয় সে । প্রথম পিকটি গলায় গেছে কি যায়নি, গলায় যেন শত ছুরিকাঘাত এসে পড়ল । মুহূর্তে জ্বলে খানখান হয়ে গেল তার সুদীর্ঘ যত্নে লালিত কন্ঠস্বর । অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল আমাদের নায়িকা । জ্ঞান যদিও অচিরেই ফিরল, গলা ফিরল না । সেকালে প্রতিযোগি গাইয়েকে পানের সঙ্গে সিঁদুর খাইয়ে গলা নষ্ট করে দেওয়ার শয়তানি বড় একটা অশ্রুত ছিল না । সেটা জানা সত্ত্বেও নিয়তির কোন্ অমোঘ খেলায় তার আসল মূলধনটিকেই খুইয়ে বসল সদ্য কৈশোর পেরোনো মেয়েটি ।
বেনারসে ফিরে এসে চিকিত্সার ত্রুটি কিছু রইল না ------- হেকিমি, আয়ুর্বেদ থেকে আংরেজি চিকিচ্ছে এলোপ্যাথি । ফল হল না কিছুতেই । প্রতি সন্ধ্যায় বাবা বিশ্বনাথকে গান শুনিয়ে আসতো সে : 'শিব শিব কে মন শরণ হো তব প্রাণ তন সে নিকলে ।' এখনও যায়, গায়ও । কিন্তু নি:শব্দ সে গায়ন । কারণ তার আসল যে গলার স্বর ------- তা-ই তো চুরি হয়ে গেছে । কেবল তার ডাগর ডাগর দু'চোখ বেয়ে অবিরল ধারায় ঝরে পড়ে অশ্রু, "বাবা, আমার কন্ঠ ফিরিয়ে দাও । বাবা, আমার কন্ঠ ফিরিয়ে দাও," আকুল প্রার্থনা জানায় সর্বহারা মেয়েটি ।
এমন করে প্রায় একবছর কাল অতিবাহিত হয়ে গেছে । কন্ঠস্বর ফিরে পাবার সকল আশাই যখন যেতে বসেছে, বাবা কেনারামের বিভূতির খবর পৌঁছল মেয়েটির কানে । হত্যে দিয়ে পড়ল সে বাবার থানে । ধ্যান ভেঙে স্মিত হেসে বাবা কেনারাম তাকে পাশের পাঁক-পুকুর থেকে এক গণ্ডুষ পানি পিয়ে আসতে বলেন । পান করবে কি, সে-পুষ্করিণীর সবুজ থক্থকে জল দেখেই ঘেন্না লাগে মেয়েটির । তবু বাবার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে অসীম ভরোসায় যেই এক গণ্ডুষ পান করেছে, প্রবল বমনে ভিতরের গরল উগরে আসে ও মুহূর্তে নিজ কন্ঠস্বর ফিরে পায় সে !!!
এবং সেই তাঁর যাত্রা শুরু বিংশশতাব্দীর চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক থেকে ভারতশ্রেষ্ঠ ঠুম্রি গায়িকার মর্যাদা পাবার ।
কিন্তু বাবার বিভূতির সেই কৃতজ্ঞতা আজীবন মনে রেখেছিলেন তিনি । যতদিন বেঁচে ছিলেন, প্রতি বছর এইদিনে এই স্থানটিতে এসে বাবার উদ্দেশ্যে তাঁর সঙ্গীত-আরাধনা নিবেদন করে গেছেন তিনি । এসো আমরা সকলে সেই মহীয়সী শিল্পীর আবাহন করি । চক্ষু মুদে ধ্যানে বসলেন বিজুদা ।
"হিজরি তারিখ অনুযায়ী আজই সেই দিন, ঈসামসীহার আবির্ভাবের শুভদিন, যেদিন আকাশের এক নক্ষত্র পূর্বদেশীয় পুণ্য-লোভাতুরদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই শিশুতীর্থে !" হিন্দোস্তানিতে বললেন সেই ফকির-সাহেব ।
আবার বাঁশিতে ফঁংউ দেন বিজুদা । সেই তাঁর আবাহন ।
এবং এবার বাঁশির ধ্বনি ছাপিয়ে এক ভারি নারী কন্ঠ শ্রুত হয় ! "যাও বহি তুম শ্যাম" খাঁটি পূর্বী উচ্চারণে গান ভেসে আসছে পিছন থেকে । অদূরে বসে সেই ফকির কামালসাহেব অস্ফুট ভীতস্বরে আরবিতে কী মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন, আর ঝুলির মধ্যে দ্রুত ফেরাতে লাগলেন তসবিহ্ । বিজুদার বাঁশি থেমে গেছে ।
অয়নের আর্তনাদ ভেসে এলো, "মা !"
লিলি-অনু-সীমারা একসঙ্গে ডেকে উঠল, "সুমি, সুমিত্রা !!"
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আমার পিছনে বসে সুমিত্রার কন্ঠ থেকেই নির্গত হচ্ছে সেই স্বর্গীয় সুর । পদ্মাসনে বসে আমার বারো বছরের বিয়ে করা স্ত্রী, যেন অন্য মানুষ, অন্য মুখভঙ্গিমা ------- শান্ত-সমাহিত, আর কন্ঠস্বর তো আর কারোর ! রোগা তিরতিরে সুমির ওই অবয়ব থেকে এই কন্ঠস্বর বেরোতে পারে না । এ' যাঁর স্বর তাঁর অবয়ব এর আড়াই গুণ হবার কথা । বামহাতে কান চেপে ডানহাত ভাসিয়ে পাক্কা ওস্তাদি ঢং-এ গেয়ে চলেছে সে : "যাও বঁংইহ তুম শ্যাম "।
বিস্ময় শুধু তাতে নয়, যে সঙ্গীত আমাদের কর্ণগোচর হচ্ছে তার উত্কর্ষেও ! মার্গীয় সঙ্গীতের তত্ত্ব আমরা বুঝি না, জানিনা এ' কী রাগ, কী তার তাল লয় সুর । শুধু বলতে পারি তার আর্তিতে ভেসে গেছি আমরা সক্কলে । এ'জিনিস কোনো রেকর্ড-সিডিতে পাওয়া সম্ভব নয় । বারেবারে ফিরে আসে আস্থায়ীটি : "যাও বঁংইহ তুম শ্যাম ।"
সে-এক অভূতপুর্ব অভিজ্ঞতা । প্রবল শীতের রাতের এক আধো-অন্ধকার উপাসনা-গৃহে টিমটিমে আলোয় আমরা গুটিকয় প্রাণী । এ'যদি কিছু দেখার অভিজ্ঞতা হত, তো পরে নিজের চোখকে দোষারোপ করতাম অন্ধকারের দোহাই দিয়ে । কিন্তু যে সুরসাগরে ভেসে গেছি আমরা ? গলার বাজ অত গম্ভীর কিন্তু আর্তিটি কত করুণ অভিমানের । শ্যামকে যেতে বলেও কিন্তু আসল যেতে বলছে না । ওটা অভিমান করে চলে যেতে বলা, যা কেবল প্রিয়কেই বলা চলে । মৃদু মৃদু দুলছে সুমির ঊর্ধাঙ্গ, যেন নাচের তালে । আর দু'চোখ তার ভেসে যাচ্ছে অশ্রুজলে । ভেসে যাচ্ছে বিজুদারও দু'নয়ন এবং সেই ফকির সাহেবেরও । বাকী আমরা সকলে বিহ্বল, ভীত, আপ্লুত !
আধঘন্টাভরের এই অব্যাখ্যাত অভিজ্ঞতার পর সুমির বোধে ফিরে আসতে আরও আধাঘন্টা লেগেছিল । প্রবল শৈত্যের মধ্যরাত্র পেরিয়ে আমরা যখন দল বেঁধে ডেরায় ফিরছি তখন দূর থেকে গীর্জার ঘন্টাধ্বনি ভেসে আসছে । আজ বড়দিন !
বিজুদাকে প্রণাম করে সুমি বলেছে, "দাদা, আপনি মিছে কাতর হচ্ছেন । আমি তো কিছু বুঝতেই পারিনি । কেমন এক ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম আপনার বাঁশি শুনতে শুনতে । বাকিটা এই আজ সকালে শুনছি যে সেই স্বর্গীয় সঙ্গীত নাকি আমারই গলা দিয়ে বেরিয়েছিল !"
গুগ্গুল আবার ওস্তাদি করে বলছে, "আন্টি, আপনে তো কমাল কর দিয়া । অরে বা:, ক্যা গানা গায়া কল আপনে !"
আমাদের হতভম্ভ ভাব কাটতে চায় না । আমরা পরস্পর মুখ তাকাতাকি করতে থাকি , করতেই থাকি । মনের দ্বন্দ্ব মেটে না । আমরা কী দেখলাম, কী শুনলাম ------- এ'কি আদৌ বিশ্বাস্য ? নাকি কোন্ মায়ার জগতে চলে গিয়েছিলাম আমরা কাল রাতে ?!
(পরবাস-৪৫, এপ্রিল , ২০১০)