• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৫ | এপ্রিল ২০১০ | গল্প
    Share
  • ক্যাম্পের ছেলেমেয়েরা : কৌশিক সেন



    `আমার আর পেট্রুশার বিয়ের ব্যাপারে এক অচেনা জাপানি ভদ্রলোক খুব বিশেষ একটা জায়গা নিয়ে আছেন । তাঁর সাথে আমাদের দেখা হওয়াটা কিন্তু একদম র্যানডম ইভেন্ট-- কেউ কাউকে চিনতাম না শুধু ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় এক বেঞ্চে বসেছিলাম ব্যাস এইটুকুই । তোমরা আমাদের এখন যেভাবে জানো তার প্রায় পুরোটাই সেই ঘটনাটার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বলতে পারো ।'

    শুক্রবার ইউনিভার্সিটির কাফেতে বসে আমাদের সাপ্তাহিক আড্ডায় কথা হচ্ছিল । বক্তা আমার বন্ধু ও সহকর্মী ডক্টর ড্যান ব্রাউন । ড্যান আর পেট্রুশাকে আমি যেভাবে জানি সেটা মার্কিন স্বপ্নের একটা প্রোটোটাইপ বলা যায় । দুজনেই উচ্চশিক্ষিত, মোটা রোজগার, শহরতলিতে বিরাট বাড়ি, আর তাছাড়া দুজনেই সিরিয়াস রকম সমাজসেবী । বছরের অন্তত: একটা মাস ওরা মেডিক্যাল মিশনে কাজ করে, দুনিয়ার যাবতীয় বিদঘুটে হতদরিদ্র জায়গায় ওদের ক্যাম্প চালানোর অভিজ্ঞতা আছে । আমাদের প্রেসিডেন্ট ওবামার মত ওরাও সাদাকালো মেশানো আমেরিকান, ড্যান পেশায় সার্জন, পেট্রুশা অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট । ওরা ডিউক ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে, একই ব্যাচে, যদ্দুর জানি সেখান থেকেই প্রেম এবং বিয়ে । আজকে আড্ডায় ওরা দুজনেই হাজির, বাইরে বেশ একটা মেঘলা মেঘলা দিন, গাছের পাতায় হেমন্তের রং লেগেছে, গল্প শোনার জন্য আইডিয়াল পরিবেশ । আমরাও সবাই নড়েচড়ে বসলাম ।

    ড্যান শুরু করলো, `তোমরা বোধহয় জানো আমি শিকাগোর সাউথ সাইডের ছেলে, ওখানেই হাই স্কুল করেছি । মাংস প্যাক করার একটা ফ্যাক্টরিতে বাবা কাজ করতেন । শহুরে গরীব পাড়ার পরিবেশ যেমন হয়, চাপা ভায়োলেন্স, বিরক্তি আর সন্দেহে বিবর্ণ, সেভাবেই আমার অল্পবয়েসটা কেটেছে । আমি পড়াশুনায় ভালো ছিলাম বটে কিন্তু অন্যান্য দিক দিয়ে সাউথ সাইডের ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব একটা ফারাক ছিল না । বহুৎ খেটেখুটে স্কলারশিপ পেয়ে যখন কলেজে ভর্তি হলাম তখন আর আমাকে পায় কে ? খেলাধূলা আর ফস্টিনস্টি করে বেশ সময় কাটাচ্ছি এমন সময় ওই খেলার মাঠেই একজন পেট্রুশার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল । ওর বাবা আমাদের প্রফেসর, মা লইয়ার, মফ:স্বলে মানুষ, প্রাইভেট স্কুলে পড়েছে, সবদিক থেকেই আমার উলটো । দেখলাম মেয়েটার একটু নাক উঁচু পিউরিটান হাবভাব অথচ চেহারায়, পোষাকে মোহময়ী, তোমাদের ভারতীয় মেয়েদের মত বড় বড় টলটলে চোখ ।'

    `থামো, থামো আমাকে বলতে দাও' পেট্রুশা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে আর কি `আসলে ও ওরকম একটা `টাফ-গাই' ইমেজ বানিয়ে নিয়েছিল, নাহলে সাউথ সাইডে বাঁচা মুশকিল হত । তা যাই বল প্রথম প্রথম আমিও বুঝতে পারিনি, কি যে বিরক্ত লেগেছিল বলার নয়' -- পেট্রুশা বলে চলল, `খুব মাচো হাবভাব দেখাতো আর নিজেকে মস্ত লেডিকিলার মনে করতো । পরিচয় হতে না হতেই লাফ দিয়ে পরের ধাপে এগিয়ে যেতে চেয়েছিল । তা আমার কাছ থেকে মিলল একটি মিষ্টি কথার থাপ্পড় । তারপর ওকে এড়িয়েই চলতাম । ওমা একদিন দেখি লাইব্রেরির এককোনায় বসে বাবু চোখের জল ফেলছেন । আসলে ওর বাবার মৃত্যুর খবর এসেছিল সেদিন । ভদ্রলোকের ক্যানসার ছিল, শরীরও ভালো যাচ্ছিল না, তবুও বাড়ি ছাড়ার পর এতো শিগ্গিরই খবরটা ও আশা করেনি । গোঁয়ার ছেলে দু:খটার সঙ্গে একা একা লড়াই করছিল । আমি জোর করেই কথাবার্তা শুরু করেছিলাম । আস্তে আস্তে ও শুরু করলো নিজের অল্পবয়সের কথা, শিকাগোর রাস্তায় বেড়ে ওঠার টুকরো টুকরো সব দু:স্বপ্নের ইতিহাস । সেদিন বুঝলাম চালিয়াতির আড়ালে ছেলেটার মনটা খারাপ না, ব্যবহারটা একটু বুনো হলেও শোধরানোর আশা আছে । বন্ধুত্ব হয়ে গেল অনেকটা তোমাদের বলিউডি সিনেমার মতো ।'

    `তারপর বুঝলে কয়েক বছর কেটে গেছে', ড্যান খপ করে গল্পের সুতোটা ধরে নিল । আমরা দুজনেই দুজনের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি, কিন্তু একদম ভিতরে আমি তখনও ঘোর প্র্যাক্টিক্যাল, সিনিক বললেও হয়, আর ও আশাবাদী আইডিয়ালিস্ট । তাই বোধহয় সবকিছুর পরও বিয়ের প্রস্তাবটা কিছুতেই লাগাতে পারছিলাম না । দুজনে দিব্যি মজায় আছি, বিয়ে মানেই তো একটা প্রতিষ্ঠানের চাকর বনে যাওয়া । আজকের দুনিয়ায় তো গণ্ডা গণ্ডা লোকজন বছরের পর বছর একসাথে থাকছে, এক বিছানায় শুচ্ছে, বিয়ের নামও করছে না । যত দিন ভালোবাসা ততদিনই একসাথে থাকা । ভালোবাসা যদি ফুরিয়ে যায়, বেশ ভদ্রভাবে যে যার পথ দেখলেই হলো, মারপিট নেই, ডিভোর্সের হাঙ্গামা নেই, প্রেমহীন সম্পর্কের বিরক্তিকর বোঝা টেনে বেড়ানো নেই । খুব বড়ো বড়ো কথা বলতাম যেমন কিনা আমি খাঁটি ভালোবাসায় বিশ্বাস করি, বিয়েশাদির মত সামাজিক সার্কাস আমার জন্য নয় । আদত কথাটা হল আমার কমিটমেন্টে যতটা ভয় ছিল, ভালোবাসায় বিশ্বাস ততটা বোধহয় ছিল না । পেট্রুশা সবই বুঝতো, এসব কথা শুনলেই ও একটা ফ্যাকাসে হাসি হেসে বলতো - `ঠিক আছে, আমার তাড়া নেই' ।

    `আসলে বিয়ে করাটা কেন জরুরী সেটা নিয়ে আমারও একটু কনফিউশন ছিল । তখন আমরা মেডিক্যাল কলেজে, বান্ধবীদের এক এক করে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ।' পেট্রুশা বলল । `মেয়েদের শরীরে একটা প্রাকৃতিক ঘড়ি থাকে জানো তো । একটা বয়েসে সেটা নিয়মিত অ্যালার্ম লাগাতে শুরু করে দেয় । কিন্তু আমাদের তখনও রোজগার বলতে বিশেষ কিছু নেই, ড্যান পাজিটা ঐ এক অকাট্য যুক্তিতে আমায় কাৎ করে দিতো । আমার মতো রাজকন্যার বিয়ে নাকি কোনো উজবুক ম্যারেজ রেজিস্টারের অফিসে হতেই পারে না - ডিউক চ্যাপেলে কেতাদুরস্ত গীর্জা বিয়ে হবে, কম করে দশ হাজার ডলার না হলে আংটি কেনার নাকি প্রশ্নই ওঠেনা । যে লোক পাক্কা অ্যাগনোস্টিক, এমনিতে সমাজের পরোয়া করেনা সে আচমকা গীর্জা বিয়ে কেন করতে চায় সে প্রশ্নটা আমি চেপেই যেতাম - ততদিনে আমি ওর প্রেমে পড়ে গেছি, ওকে হারাবার ঝুঁকি নিতে আমার ভয় হতো ।'

    `এর মধ্যে আমার দু একটা পেপার বেরোতে শুরু করেছে, হঠাৎ করেই লণ্ডনে একটা কনফারেনসে যাবার নেমতন্ন এসে গেল ।' ড্যান বললো । স্কলারশিপ হিসাবে ওরা কিছু টাকা দেবে, তাই আমি ঠিক করলাম ওকেও সাথে নেবো । ওর ইউরোপে হনিমুন করার শখ ছিল, এই সুযোগে সেটা নাহয় আগাম সেরে নেওয়া যাবে, তাতে কি । পেট্রুশা অনেক বাহানা করেও কি ভাগ্যি শেষটায় রাজি হয়ে গেল । কিন্তু কপালের লিখন খণ্ডাবে কে ? আমরা ফেরার দিনে প্যারিসে আটকে গেলাম, ঠিক সময়ে লণ্ডন পৌঁছাতেই পারলাম না । লণ্ডন-নিউইয়র্ক ফ্লাইটটি যথাসময়ে আমাদের ছাড়াই রওনা হয়ে গেল । আমরা সস্তা এক ওঁচা এয়ারলাইন বুক করেছিলাম তাদের প্রতিদিন ফ্লাইটও নেই, সার্ভিসও নেই, সুতরাং দিন পাঁচেকের জন্য আমরা লণ্ডনে আটক । আমাদের সঙ্গে টাকাপয়সা বলতে কুল্লে শখানেক ডলার, ক্রেডিট কার্ডের অবস্থাও তথৈবচ, আর লণ্ডনের হোটেল খরচা তো তোমরা জানোই । মুখ কালো করে ট্র্যানজিট লাউঞ্জে বসে আছি এমন সময় দেখি পাশে বসা এক বৃদ্ধ এশীয় দম্পতি আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছেন । চোখাচোখি হতে ভদ্রলোকটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, `হাই আমার নাম জর্জ ইশিয়ামা, কেমন আছেন আপনারা ?' দিব্যি আমেরিকান উচ্চারণ ।

    আমার খোশগল্প করার মেজাজ ছিলো না তাও আবার চীনে না জাপানি এক অচেনা বুড়োর সঙ্গে । উঠেই যেতাম কিন্তু পেট্রুশা একগাল হেসে আলাপ শুরু করে দিল । দুনিয়ার লোকের সাথে আলাপ করায় ওর মহা উত্সাহ ।

    `তাই তো, প্লেন মিস করেছেন দেখছি । আপনাদের মুখ শুকনো লাগছে. সকালে খাওয়া হয়নি বুঝি ? আমরাও কফি খাবার কথা ভাবছিলাম, যদি কিছু না মনে করেন আসুন না ওই কাফেতে একটু বসি ।' দুচার কথার পরে ভদ্রলোক বললেন ।

    আমি শিকাগোর লোক, সঙ্গে সঙ্গে আমার অ্যান্টেনা খাড়া হয়ে গেল । আমার বদ্ধ ধারণা মানুষ মাত্রেই ধান্দাবাজ । অন্যরকম প্রমাণ না হলে সবাইকে বজ্জাত বলে ধরে নেওয়াই নিরাপদ । জাপানি বা ইংরেজ, কেউই অচেনা লোকের সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ জমাবার জন্য বিখ্যাত নয়, এ বুড়োর নিশ্চয় কোনো মতলব আছে । কাটিয়ে দিতে যাবো কিন্তু দেখি পেট্রুশা তার আগেই মহানন্দে ওদের সঙ্গে রওনা দিয়েছে । অগত্যা গেলাম কাফেতে, খিদের চোটে বেশ কিছু খেয়েও ফেললাম দুজনে । বিল মেটানোর সময় পকেটে হাত দিয়েছি কি, ভদ্রলোক আস্তে করে হেসে বারণ করলেন, দেখলাম ওটার ব্যবস্থা উনি আগেই করে দিয়েছেন । ভদ্রলোক খুব কম কথা বলছেন, ভদ্রমহিলা প্রায় কিছুই না, পেট্রুশাই বকবক করে চলেছে । কথায় কথায় ভদ্রলোক বললেন যে ওঁর জন্ম আমেরিকায় কিন্তু ভদ্রমহিলা খাঁটি জাপানি, কিয়োটোর বাসিন্দা । ওঠার সময় উনি ব্রিফকেস খুলে একটা লম্বামতন চামড়ার ওয়ালেট বার করলেন যার মধ্যে তিন চারটে কোম্পানির ভিজিটিং কার্ড । সবকটার উপরেই জর্জ ইশিয়ামার নাম লেখা আর তার পাশে ছোট্ট করে `ফাউণ্ডার অ্যাণ্ড সি-ই-ও' কথাটি শোভা পাচ্ছে । আমি চোখ ছানাবড়া করে দেখছি আর ভেবে কুল পাচ্ছিনা যে লোকটা কেউকেটা ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট অথবা পাক্কা জালিয়াৎ যাই হোক না কেন আমাদের কাছে কি চায় ? এর মধ্যেই উনি একটা কার্ড নিয়ে আমাদের হাতে দিলেন । শুনলাম বলছেন, `ইয়াং লেডি তোমাদের যদি লণ্ডন দেখার ইচ্ছে থাকে বা এখানে কোন কিছুর দরকার হয় এই নম্বরে আমাকে জানিও । আমি তোমাদের জন্য কিছু করতে পারলে সুখী হবো । শুনে পেট্রুশা তখুনি ওঁর সঙ্গে চলে যায় আর কি ।'

    `চুপ করো মিথ্যাবাদী কোথাকার', পেট্রুশা ড্যানের পিঠে এক কিল বসিয়ে দিলো । `সত্যি কথা মি: ইশিয়ামা মানুষটিকে আমার কিছু না জেনেই ভালো লেগে গিয়েছিল । কে যেন বলেছিল না যে প্রাচ্যের মানুষ বুড়ো হয়েও আরো সুন্দর হতে পারে, উনি তার একটা উদাহরণ বটে । সে কথা যাক, আসলে আমি টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার কথাটাও তখন জানতাম না । ড্যান শিভালরি দেখিয়ে ট্রিপের খরচাপাতি সব নিজে ম্যানেজ করেছে, এদিকে ট্যাঁক যে কখন খালি হয়ে এসেছে ঘুণাক্ষরেও বলেনি । শভিনিস্ট আর কাকে বলে । দাঁতে দাঁত চেপে ম্যানিয়াকের মতন এখানে ওখানে ফোন করার চেষ্টা করছে কেউ যদি কিছু টাকা পাঠাতে পারে । আমি অনেকক্ষণ বাদে বেশ ভয়ে ভয়েই প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম তো সে রেগেই আগুন । আমি কি ওর উপর ভরসা করতে পারছি না যে কোথাকার এক উটকো জাপানির কথায় কান দিতে হবে । বুঝলাম বাবুর পৌরুষে ঘা লেগেছে । আরো বললো আমি নাকি নাইভ, লোকে দুটো মিষ্টি কথা বললেই ভুলে যাই, এটা লণ্ডন, অ্যালাবামা নয়, এরা সব কাঁচাখেকো দেবতা । মাফিয়ারা আছে, তারা ড্রাগের সঙ্গে মেয়েও চালান করে, সৌদি আরবের লোকেরা নানা জাতের মেয়েদের নিয়ে হারেম বানায় । আবার আতঙ্কবাদীরাও আছে তারা কায়দায় পেলেই আমেরিকানদের গুম করে দেয় । এই লোকটারও কোনো বদ মতলব না থেকে যায়না ।'

    `একটা ফোনেও উত্তর এলোনা, এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল তারপর সন্ধ্যা' ড্যান বলে চলল । `বকাবকির পর ও মুখভার করে বসে আছে, আমি কি করবো বুঝতে পারছি না । শেষ অবধি মরিয়া হয়ে কার্ডটা বার করলাম । রিং হতে না হতেই ওদিকে একটা পাক্কা ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টের মহিলাকন্ঠ - মিস্টার ইশিয়ামার আনসারিং সার্ভিস । আমার নামটা জেনে নিয়ে দুমিনিট পরেই বললো - `অনুগ্রহ করে একটু ধরুন উনি এই মুহুর্তে আসতে পারছেন না কিন্তু ওঁর সেক্রেটারি আপনাদের সঙ্গে কথা বলবেন ।'

    তারপরের ঘটনাগুলো আমার এখনো ভাবলে অবিশ্বাস্য মনে হয় । সেই রাত্রে একটা গাড়ি এসে আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে তুলে নিল । সেক্রেটারি ভদ্রলোক ইশিয়ামার হয়ে খুব দু:খপ্রকাশ করলেন । উনি নাকি আসতে পারলেন না বলে ক্ষমা চেয়েছেন আর বলে গেছেন যে আমরা ফোন করলেই যেন আমাদের `টেক কেয়ার' করা হয় । আমাদের নিয়ে তোলা হলো ছিমছাম একটা হোটেলে, পৌঁছতেই জনাতিনেক লোক আমাদের খিদমতে হাজির । তারা জামাই আদরে আমাদের মালপত্র ঘরে পৌঁছে দিয়ে রুম সার্ভিসের অর্ডারটা অবধি নিয়ে গেল । টাকাপয়সার কথা বললেই সবাই জিভ কেটে মাথা নাড়ছে - দে টুক কেয়ার অফ ইট' । `দে' টি যে আসলে কে এবং কেনই বা সে খামোকা আমাদের টেক কেয়ার করছে তা ভেবে আমি চুল ছিঁড়ে ফেলছি, পেট্রুশার কিন্তু কোন বিকার নেই ।

    সেদিন ও ঘুমালো, আমি কাউচে জেগে বসে রইলাম । বলা যায়না রাত্রে যদি হামলাটামলা হয় । নির্ঘাৎ আমার পেট কেটে কোকেন ভর্তি করে আমেরিকায় চালান করবে আর এই সরল মেয়েটাকে কোনো আরব শেখের কাছে বিক্রি করে দেবে । শোবার আগে পেট্রুশাকে মাথার দিব্যি দিয়ে দিয়েছিলাম - যদি কিছু গণ্ডগোল হয় তুমি সোজা দৌড় মারবে, আমার দিকে তাকাবেও না, রাস্তায় নেমে পুলিশ আর আমেরিকান কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করবে । এখানে যা কিছু হয় আমি সামলাবো আমিও শিকাগোর ছেলে ।

    পরদিন সকালে মিস্টার ইশিয়ামা ফোন করে জানালেন যে উনি দশটা নাগাদ লবির কাফেতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন ।' রাতজাগা চোখ মুছতে মুছতে লবিতে গিয়ে দেখি একটা কোণার টেবিলে ভদ্রলোক একাই বসে বসে কাগজ পড়ছেন । সেই শান্ত মুখ, পরিপাটি স্যুট পরা, আমরা আসতে উঠে দাঁড়িয়ে বাও করলেন ।

    পেট্রুশা তো উচ্ছসিত, কলকল করে কত কিছুই না বলে গেল খানিকক্ষণ । উনি স্মিত হেসে সবটা শুনলেন, তারপর সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, `ইয়াং ম্যান তুমি নিশ্চয়ই ভেবে সারা হচ্ছো যে টোপের মধ্যে বঁড়শিটা কোথায় ?'

    আমি হকচকিয়ে গেলাম । ভদ্রলোক আমাদের এখন অবধি এতখানি উপকার করেছেন, অথচ আমার এই প্যারানয়েড সন্দিগ্ধ মনোভাব ওঁর বুঝতে বাকি নেই । অভিজ্ঞতা একেই বলে ।

    হঠাৎ একটা লজ্জা আর অপ্রস্তুত ভাব আমায় একদম ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেল । সামলে নিয়ে সবে শুরু করেছি, `মহাশয় আপনার মহানুভবতার পরিচয় পেয়ে আমরা ধন্য, আমাদের হৃদয় কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত ইত্যাদি ইত্যাদি । উনি আমায় থামিয়ে দিয়ে কৌতুক মেশানো গলায় বললেন, `এটা একদম স্বাভাবিক । সত্যিই তো বিদেশ বিভুঁয়ে অচেনা লোক, গায়ে পড়ে আলাপ করেছে, সন্দেহ তো হবেই । আসলে কি জানো আমার ছোটবেলার খুব পরিচিত দুজন মানুষ ছিলেন, তাঁরাও আফ্রিকান-আমেরিকান, ঠিক তোমাদেরই মত দেখতে । কাল তোমাদের দেখে আমার কেমন যেন ফ্ল্যাশব্যাক হলো । এই দেখো ওদের ছবি ।'

    উনি সেই লম্বা ওয়ালেট খুলে কতগুলো ছবি দেখালেন । সাদাকালো ছবি, মনে হয় বহুদিন আগে তোলা । এক অল্পবয়সী আফ্রিকান-আমেরিকান দম্পতিকে দেখা যাচ্ছে, চেহারাটা আমাদের মতই বটে । কিন্তু আমার নজর কাড়ল ওর সঙ্গে আরো কয়েকটা ছবি । কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া লম্বা লম্বা কোয়ার্টার, একদল এশীয় লোকজন, কারো মুখে হাসি নেই । একটা বাড়ির গায়ে চেনা রেসিস্ট স্লোগান লেখা, শুধু নিগ্রোর বদলে জাপ শব্দটা দেখা যাচ্ছে ।

    `ডিসেম্বর ১৯৪১, এক্সিকিউটিভ অর্ডার নম্বর ৯০৬৬' ইশিয়ামা বলে যাচ্ছেন । পার্ল হারবার আক্রমণের পর ওই অর্ডার অনুযায়ী এক লক্ষ কুড়ি হাজার জাপানিকে তাদের বাড়িঘর, চাকরিবাকরি সবকিছু ছেড়ে ইন্টার্নমেন্ট ক্যাম্পে আটক করা হয়েছিল । এই জাপানিরা হাওয়াই এবং আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে চাকরিবাকরি করতেন, অনেকেই আমেরিকান নাগরিক, এদের একজনের বিরুদ্ধেও গুপ্তচরবৃত্তির সামান্যতম অভিযোগও ছিলনা । এদের জমায়েত করা হয়েছিল উত্তর-পশ্চিমের কনকনে ঠাণ্ডা এবং প্রায় জনহীন সব জায়গায় । ইডাহো প্রদেশের ওইরকম একটা ক্যাম্পে আমার জন্ম ১৯৪২ সালে । আমার বাবা-মা যখন তাদের ছিমছাম বাড়িটি ছেড়ে পাড়ার লোকদের গালিগালাজ শুনতে শুনতে মিলিটারির ট্রাকে গিয়ে উঠেছিলেন তখন আমি মায়ের পেটে ।'

    `মিস্টার ইশিয়ামা আপনার তো আমেরিকানদের ঘৃণা করার কথা কিন্তু আপনি -'
    `কয়েক বছর পরে আমরা ছাড়া পেলাম কিন্তু আমাদের পুরনো পাড়ার প্রতিবেশীরা এটা স্পষ্ট করেই সমঝে দিলেন যে ওখান থেকে আমাদের বাসা ওঠানোই নিরাপদ । আমার বাবার চাকরি ছিল না তার উপর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন । সেসময়ে এই দুজন অচেনা মানুষের অকারণ করুণা না পেলে হয়তো উনি মারাই যেতেন, মা কে রাস্তায় দাঁডাতে হতো আর আমার যে কি হতো কে জানে ।'

    ইশিয়ামা ছবিটার দিকে তাকালেন ।

    `ওদের নাম মার্ক আর বার্থা হিগিনস, আমাদের পুরনো পাড়ায় জ্যানিটরের কাজ করতে আসতো । পার্কের একটা বেঞ্চিতে দুপুরবেলা আমাদের বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে আলাপ করেছিল । ওরাই আমাদের ইনার সিটির অশ্বেতাঙ্গ পাড়ায় নিয়ে তোলে, বাবার চিকিত্সার ব্যবস্থা করে, আমাকে স্কুলে পাঠায়, মাকে একটা চাকরি খুঁজে দেয় । আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনে, অন্যরকম এক আমেরিকার চেহারা দেখায় । ১৯৮৮ সালে মার্কিন কংগ্রেস জাপানি আমেরিকানদের কাছে সরকারিভাবে ক্ষমা চেয়ে প্রত্যেককে কুড়ি হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ মঞ্জুর করেছিল । ততদিনে আমরা জাপানে ফিরে এসেছি, আমাদের ছোট একটা পারিবারিক ব্যবসা আছে । যুদ্ধের পরে জাপানে কাজের অভাব নেই, আমরা ভালো সময়ের মুখ দেখলাম । আমিও ইংল্যাণ্ডে পড়াশুনা শেষ করে একটা বড়ো কোম্পানিতে ঢুকেছি । খুব ব্যস্ত ছিলাম ক্ষতিপূরণ নিতে আর যাওয়া হয়নি তবে প্রেসিডেন্টের সই করা অ্যাপলজি লেটারটা যত্ন করে রেখে দিয়েছি ।' ইশিয়ামা হাসলেন, `এবার বুঝলে তো । আশা করি তোমরা আমার এই সামান্য আতিথেয়তার উপহার গ্রহণ করবে । কোনো কারণ নেই, এমনিই মনে হল তোমাদের বয়স অল্প, বিদেশে আটকে গেছো তাই আর কি ।'

    ওঠার আগে উনি আমাদের হাতে একটা খাম দিয়ে গেলেন যার ভিতরে দুশো পাউণ্ডের একটা আমেরিকান এক্সপ্রেস গিফট কার্ড ।

    `পরদিন সন্ধ্যায় আমরা টেমস নদীর ধারে বেড়াচ্ছি, দূরে ওয়েস্টমিনিস্টার গীর্জা আর পার্লামেন্ট হাউস নরম আলোর স্রোতে ভাসছে । ড্যান বললো, `আমার মাথার মধ্যে একটা ঝড় চলছিল, আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছিলাম কথাগুলো গুছিয়ে বলতে । হাঁটা থামিয়ে আমি পেট্রুশাকে একটা পাথরের বেঞ্চে বসালাম । তারপর কেতামাফিক হাঁটু গেড়ে বসে -'

    `বাকিটা আমি সংক্ষেপে বলছি' পেট্রুশা ড্যানকে থামিয়ে দিল, `প্রস্তাবটা করার আগে ও কয়েক ঘন্টা আবোলতাবোল বকেছিল তার মধ্যে মাত্র কয়েকটা কথা দামী । একনম্বর, ও মেনে নিয়েছিল যে অনেকেই ধান্ধাবাজ কিন্তু সবাই নয়, স্বার্থহীন মানুষ কম হলেও আছে । তাছাড়াও গণ্ডা গণ্ডা লোক আছে যারা কোনটাই নয় । তারা দুর্বল, অশিক্ষিত আর অন্যের ধান্ধাবাজির শিকার, যেমন ওই ক্যাম্পের ছেলেমেয়েরা এবং কিছুটা ও নিজেও । দুনম্বর, শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ও নাকি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে । তাই নিজের চারপাশে, সে যত ছোটই হোক, একটা শুভ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চায় । হয়ত তার ছায়ায় আরো অনেকে আশ্রয় পাবে, বাঁচার সুযোগ পাবে । পুরনো অভ্যেস সব পালটানো দরকার, তার প্রথম ধাপ হলো আমাকে আর ঝুলিয়ে না রেখে বিয়ে করা । আমার মত আশাবাদে দীক্ষা নেওয়া, মেনে নিতে, ক্ষমা করতে শেখা আর ভবিষ্যতের দিকে তাকানো । এইভাবে ও নাকি এখনকার চালু কালচার অর্থাত্‌, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, গা-বাঁচানো হেডনিজম থেকে সরে আসবে । সেইজন্যেই ও বিয়েটা এক্ষুনি করে ফেলতে চায়, একটা সস্তা আংটি অবধি কিনে ফেলেছে ।'
    `ওই সব খোশামুদি শুনেই তুমি গলে গেলে পেট্রুশা ।'

    পেট্রুশা একগাল হাসল, `ক্ষেপেছো । কিন্তু যে লোক মাফিয়াদের সঙ্গে একা হাতে লড়াই করে আমায় বাঁচাতে চায় তাকে আর না বলি কি করে ।'


    (পরবাস-৪৫, মার্চ, ২০১০)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)