সেই ধারণা যখন শিক্ষিত বাঙালির কাছে আর অপরিচিত রইল না, ইংরিজি শিক্ষার প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম জগতের সাহিত্য-সংস্কৃতি এসে পৌঁছল ভারতবর্ষে, বিশেষত কলকাতা-কেন্দ্রিক বাংলায়, অনেক পরিবারেই তখন পাশ্চাত্য প্রভাব পড়েছিল । কিন্তু রবীন্দ্র-উত্তর বাঙালি লেখকদের মধ্যে ক-জন সেই বিশ্বচেতনাকে অন্ত:স্থ করেছিলেন ? এ-প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে রীতিমত বিস্মিত হতে হয় । না, রবীন্দ্রনাথের উত্তর সাধকদের মধ্যে সেই বিশ্বমনস্কতা বিরল।
রবীন্দ্রনাথের প্রায় অর্ধশতক পরে এক মৃত্যুঞ্জয়ী শিশু জন্মেছিল অবিভক্ত বাংলার অবহেলিত অঞ্চল পূর্ববঙ্গের এক মফস্বল শহরে, অসম্পন্ন পরিবারে । জন্ম মুহূর্তে মাতৃহীন শিশুটি তত্ক্ষণাৎ পিতৃপরিত্যক্ত হয়ে প্রতিপালিত হয় দাদু-দিদিমার কাছে । আসলে পঞ্চদশী মায়ের অতি-দুর্বল মৃতকল্প শিশুটি যে আদৌ জীবিত থাকবে এ চিন্তা কারোরই কল্পনার মধ্যে ছিল না । সময়টা ছিল বিশ শতকের প্রথম দশক, বিপন্ন নবজাতকদের বাঁচানোই কঠিন ছিল তখন, আর জন্ম মুহূর্তে যারা মাতৃহীন হতো দৈবের দয়াই ছিল তাদেরে একমাত্র ভরসা । দৈব দয়া করেছিল এই শিশুটিকে, একমাত্র সন্তান হারিয়ে শোকসন্তপ্ত মাতামহী-মাতামহ অকালমৃত কন্যার একমাত্র সন্তানটিকে অতি আদরে লালন-পালন করেন । মা-বাবার অভাব শিশুটি কখনোই অনুভব করেনি, কারণ সদর্থে দাদু-দিদাই ছিলেন তার মা-বাবা । তাঁরা শিশুটির নাম রাখেন বুদ্ধদেব ।
বুদ্ধদেব বসুর জীবনের গল্প এক অসামান্য প্রতিভার অধিকারী "সর্বহারা"র সফলতার বিরল গল্প । রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক ঐতিহ্য, বৈভব, প্রতিপত্তি, আভিজাত্য, এক বৃহৎ পরিবারের সম্মিলিত মেধা ও গুণের উত্তরাধিকার, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে তিন পুরুষের পরিচয়, কোনোটাই বুদ্ধদেবের ছিল না । ছিল শুধুই ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা ও মেধা, আত্মবিশ্বাস, সাহিত্যপাঠের অনন্ত তৃষ্ণা, স্বপ্নপূরণের একক ও একাগ্র প্রচেষ্টা, শত্রুর উপহাসকে নগণ্য করার শক্তি, এবং সিদ্ধান্তে অনম্য থাকার ক্ষমতা । ভাগ্যের বিড়ম্বনায় পিতৃপরিচয় শুধু ঐ `বসু' পদবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ।
তিনি হতেই পারতেন `বুর্জোয়া'-বিরোধী নব্য ইন্টেলেকচুয়েলদের বিশ শতকের নতুন আদর্শ, উপাদান সব ঠিকঠাকই ছিল তৃণমূল থেকে উঠে আসা, অর্থাভাবের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধে ব্যপৃত, অসাধারণ প্রতিভাবান এই কবি ছেলেটির, কিন্তু বাদ সাধল তার ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য, রোমান্টিক মন । আরাম কেদারায় বসে সাম্যবাদের জন্যে লড়াই করবার আর্থিক সামর্থ্য তার ছিল না, ছিল না দারিদ্রের অহংকার । কোনো দারিদ্রেরই তা থাকে না । তথাকথিত ভদ্র বংশে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেও সেই সময়ের অবিভক্ত বাংলায় যার আক্ষরিক অর্থে কোনো চালচুলো ছিল না, ছিল না বংশগত জমিবাড়ি, যে নিজে আর্থিক অনিশ্চয়তায় অহরহ বিপন্ন, আকাশের চাঁদকে কখনোই `ঝলসান রুটি' মনে করা, অথবা নিজেকে `ছুতোর, মুটে-মজুরের' কবি মনে করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি । আশৈশবই তার ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব প্রকট ছিল । বাস করতেন নিজের সঙ্গে নিজে এক কল্পনার দুনিয়ায়, এক স্বপ্নের মনোজগতে, খেলাধুলায় অনিচ্ছুক এক ভাবুক কবি । পশ্চাত্পদ মফ:স্বল নোয়াখালিতে বই - শুধু বই - রাশি-রাশি অক্ষর তার সঙ্গী । দিনরাত শব্দের সঙ্গে তার খেলা । কবিতা লেখা, হাতে লেখা পত্রিকা বের করা, নাটক তৈরি তার নেশা । বন্ধু বলতে `দা' - তার দাদু । তাঁর নাতিটি যে `বিশেষ' অচিরেই বুঝেছিলেন তিনি । তারপরে, প্রতিনিয়ত শিশুটির জন্মগত প্রতিভাকে স্ফুরিত করতে নিজেকে উত্সর্গ করেছিলেন ।
সেই তিনজন, যারা পরস্পরে চোখেও দেখেনি,এই তিনটি মানুষের মধ্যে একটিই সামান্য-সূত্র দেখি আমি । এঁরা তিনজনই তীক্ষণধী ছিলেন, জীবনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বুদ্ধদেব বসুর আন্তর্জাতিক মনস্কতাকে পুষ্ট করেছিলেন, ক্ষুরধার করেছিলেন ।
কিংবা ছিল স্বল্পমাত্র পরিচিত...
তারা আজ আমার ছোট্ট ঘরে ঘেঁষাঘেঁষি প্রতিবেশিতায়...
ঘুরে-ফিরে তারা আসে যায় -
সুধীন্দ্র, প্রভুচরণ, পরিমল রায় ।
১৯৩১-এ এম. এ. পাশ করার পর তিনি ঢাকা ছেড়ে স্থায়ীভাবে কলকাতা চলে আসেন । শুরু হয় তাঁর কখনো-শেষ-না-হওয়া সংগ্রাম - অভাবের সঙ্গে, বেকারত্বের সঙ্গে, অশ্লীলতার অপবাদের সঙ্গে, কিন্তু স্বধর্ম বিচ্যুত হননি কখনোই । সাহিত্যই তাঁর জীবনের একমাত্র কেন্দ্র ছিল আমৃত্যু । ১৯৩৫-এ প্রতিষ্ঠা করেন "কবিতা" - শুধু কবিতার জন্য উত্সর্গিত বাংলার প্রথম `লিট্ল ম্যাগাজিন' (এই শব্দটিও বুদ্ধদেব বসুই প্রবর্তন করেন) - যার ২৫ বছরের ইতিহাস বিশ শতকের আধুনিক বাংলা কবিতার বিবর্তনের ইতিহাস । এই পত্রিকার মধ্যেও "বিদেশী সাহিত্য" নামক একটি আলাদা অংশ থাকত, থাকত অনুবাদ, এবং আলোচনা । অনেকেই হয়ত জানেন না যে `কবিতা ভবন' থেকে তিনি এজরা পাউণ্ডের "কনফ্যুশিয়াস" প্রকাশ করেছিলেন, যখন পাউণ্ড আমেরিকায় বর্জিত, কমিউনিস্ট সন্দেহে গৃহবন্দি । "প্রগতি" পত্রিকা প্রকাশের সময় যে স্বপ্ন তরুণ বুদ্ধদেব দেখতেন "কবিতা" পত্রিকায় এসে সেই স্বপ্ন যেন আরো ঘনীভূত হলো, কেন্দ্রে নিয়ে এলেন শুধু কবিতাকে, এবং আন্তর্জাতিকতাকে । বুদ্ধদেব বসুর আন্তর্জাতিকতার মূল উত্সেও আছে বিশ্বসাহিত্য বিষয়ে তাঁর প্রবল উত্সাহ এবং অপরিচিতকে পরিচিত করাবার, তাঁদের কাজের গুরুত্ব প্রচার করার অপ্রতিরোধ্য বাসনা । `কবিতা'র দুটি আন্তর্জাতিক সংখ্যা দেখলে এই মন্তব্যের অর্থ স্পষ্টতর হবে ।
ঘরে বসেও যে বই এর মধ্য দিয়ে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় নিজের অভিজ্ঞতায় তা জেনেছিলেন বলে, ত্রক্রমে ত্রক্রমে এক অনন্য অনুবাদকের ভূমিকায় তাঁকে পাই আমরা, যিনি অনুবাদ করছেন পাঠককে এক নতুন জগৎ চেনাতে । বুদ্ধদেবের সমসাময়িক অনেক কবিই ইয়োরোপ বা দূর প্রাচ্যের কবিতা অনুবাদ করেছেন, কিন্তু অনূদিত রচনার ও মূলের লেখকের পশ্চাত্পট বিষয়ে পাঠককে অবহিত করানো, সেই দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করানো, অনূদিত সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করে পাঠককে এক বৃহত্তর জগতের মুখোমুখি আনার প্রচেষ্টাটুকুও তাঁর আগে অন্য কেউ করেননি । আমার মনে হয়, বুদ্ধদেব যখন ইংরিজি অনুবাদে বিশ্বসাহিত্য পড়তে শুরু করেন ঢাকায়, তাঁর কিশোর বয়সে, তাঁর মনে সেই সব লেখক, তাদের সংস্কৃতি, সমকালীন শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে অনেক প্রশ্ন জাগতো যার উত্তর তিনি পেতেন না । সেই সময়ে অনুবাদ সাহিত্য পড়ে আরো জানবার যে কৌতূহল তিনি অনুভব করতেন, যে সব প্রশ্ন তাঁকে অস্থির করত, উত্তর না জানার যে অভাব তাঁকে তাড়িত করত, সেই স্মৃতি তাঁর মন থেকে কখনই মুছে যায়নি । প্রবীণ বয়সে পৌঁছে তাঁরই মত কৌতূহলী পাঠকের জন্যে, তরুণ পাঠকের জন্যে, সাহিত্যের ছাত্রদের জন্যে তাঁর জীবনব্যাপী গবেষণার দলিল উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন অনুবাদের সঙ্গে `ভূমিকা' নামধারী অসামান্য সব প্রবন্ধে, টীকায় । রীতিমত গবেষণা পত্র সেই সব `ভূমিকা'র উদ্দেশ্য একটিই : সাধারণের মধ্যে বিশ্বসাহিত্যের চেতনার প্রচার ও প্রসার । অবশ্যই এই প্রবণতা বুদ্ধদেবের শিক্ষক সত্তা বা প্রচারক সত্তার অন্য রূপ ; কিন্তু আমি মনে করি, সর্বোপরি এ তাঁর পরোপকারী সত্তার অভ্রান্ত পরিচয়, যা তিনি `প্রগতি' ও `কবিতা' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘকাল দিয়েছেন । একের পর এক কবিকে পাঠকদের হাত ধরে চিনিয়েছেন তিনি, তা সে জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-সমর সেন-সুভাষ মুখোপাধ্যায় হন, বা বোদলেয়ার-রিলকে-হ্যেল্ডারলিন-পাস্তারনাক । পৃথিবীর ইতিহাসে এমন উদাহরণ দুটি আছে বলে জানিনা । স্বয়ং এক কীর্তিমান সৃষ্টিশীল লেখক হয়েও তিনি মনের কোন্ উদারতায় অক্লান্ত উদ্যমে সমসাময়িক অপর কবি-লেখকদের প্রশস্তি গেয়েছেন তা বোঝা সহজ নয়, যদি না আমরা মানি যে কবিতার - বৃহদার্থে বিশ্বসাহিত্যের - উপাসনাই তাঁর একমাত্র "ধর্ম" ছিল । অবশ্যই সেই ধর্মের যাজক ছিলেন তিনি, ছিলেন তার প্রচারক ।
আন্তর্জগতের ধারণা প্রতিষ্ঠিত না হলে যে "সাহিত্যে"র বিশ্বায়িত রূপটি অধরা থেকে যায়, সে বিশ্বাস বদ্ধমূল ছিল বলেই অনুবাদকে এক ব্যতিক্রমী ধারায় বাহিত করতে পেরেছিলেন । দেখিয়েছিলেন অনুবাদ নেহাতি ভাষান্তর নয়, মূল রচনাকে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় টেনে আনাই যথেষ্ট নয়, সার্থক অনুবাদকে হয়ে উঠতে হবে স্বাদে-গন্ধে মৌলিক রচনা, মূল রচনার অন্ত:সার (এসেন্স) এবং আত্মা (সোল) অক্ষুন্ন রেখে । মনে রাখতে হবে অনুবাদের বিকল্পে "অনুসৃষ্টি" শব্দটিই বেশি গ্রহণযোগ্য এখন, অর্থাত্, অনুবাদ কোন যান্ত্রিক পদ্ধতি নয়, সে নিজেই এক মৌলিক সৃষ্টি । মূল ভাষার বিশেষজ্ঞরা শব্দের অথবা শব্দবন্ধের আক্ষরিক অনুবাদ হলো না বলে সমালোচনায় যখনই মুখর হন, তখনই বুঝতে হবে তাঁরা নিজেরা সৃষ্টিশীল কবি বা লেখক নন । এক ভাষার রচনা অন্য ভাষার রচনায় পরিবর্তিত করার সৃজনপ্রক্রিয়া বিষয়ে তাঁরা অনভিজ্ঞ । এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে । "যথাযথ" বা "বিশুদ্ধ" অনুবাদ বলে কিছু নেই, কিছু হতে পারেনা, মূলের শুদ্ধতা অনুবাদে রক্ষা করা সম্ভব নয় বলেই । এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সংস্কৃতির পার্থক্য ভাষায় প্রতিফলিত হয় । ফরাসি থেকে বাংলায়, অথবা বাংলা থেকে ইংরিজিতে অনুবাদের সময় আক্ষরিক অর্থে "যথাযথ" হবার চেষ্টা যিনি করেন, তিনি মূলের জগতেও পৌঁছোন না, অনুদিত ভাষার জগতের মধ্যেও ঢুকতে সক্ষম হন না, মাঝখানে ত্রিশংকু হয়ে ঝুলে থাকেন । তাঁর অনুবাদ `সাহিত্য' হয়ে ওঠেনা । পাঠযোগ্য অনুবাদ বা অনুসৃষ্টির মধ্য দিয়েই আমরা শেষ পর্যন্ত বিশ্বকে চিনি, জানতে পারি বিভিন্ন সংস্কৃতির অস্তিত্ব, এমন কি আমাদের "ভারতীয়" পরিচয়কে অক্ষুণ্ণ রাখতে ভিন্ন ভাষাভাষি অঞ্চলগুলিকেও জুড়ে রেখেছে অনুবাদ । মূল ভাষা জানলে অনুবাদে সে ভাষার সাহিত্য পড়ার প্রশ্ন ওঠে না, আর মূল ভাষা না জানা থাকলে (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জানা থাকে না), কোথায় অনুবাদ "যথাযথ" নয় তা জানার কোন উপায় নেই । সাধারণ পাঠক অনুবাদটি পড়ে সাহিত্য হিসেবে সেটি কতটা উপভোগ করলো, সেটাই প্রধান বিচার্য । বাঙালিদের ইংরিজিতে গীতাঞ্জলি পড়তে আদৌ ভাল লাগে না, ভাগ্যিস বাংলা ভাষায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ ইয়েট্সের ভাল লেগেছিল, নয়তো রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়াই হতো না । বিশ্বে তাঁকে পরিচিত করাতে অনুবাদ ছাড়া উপায় কী ? অর্থাত্, অনুবাদ আন্তর্জাতিকতার এক অপরিহার্য অঙ্গ, অনুবাদের সাহায্য ছাড়া বিশ্বকে জানার দ্বিতীয় কোন উপায় নেই । বুদ্ধদেব বসু যৌবন বয়স থেকেই এই বিশ্বাস তাঁর পত্রিকাগুলির মধ্য দিয়ে প্রচার করেছেন । এই ভাবনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই আধুনিক য়োরোপীয় কবিদের বাঙালি পাঠকের ঘরের দরজায় পৌঁছে দেবার শ্রমসাধ্য ও ব্যাপক অনুবাদ কর্মে হাত দেন মধ্যবয়সে । শেষ পর্যন্ত, তিনিই ভারতবর্ষে প্রথম প্রবর্তন করেন বিশ্বসাহিত্যের আকাদেমিক পাঠক্রম "তুলনামূলক সাহিত্য", নবনির্মিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ।
এ দেশে আজ থেকে অর্ধ শতাব্দীরও আগে কলেজ পাঠ্য বিষয় হিসেবে তুলনামূলক সাহিত্যের প্রবর্তন শিক্ষাক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ঘটনা । কথাটা আমি ভেবেচিন্তেই বলছি, আবেগতাড়িত হয়ে নয় । এবং "যুগান্তকারী" বিশেষণটি আক্ষরিক অর্থেই ব্যবহার করছি ।
বুদ্ধদেব বসু অনুভব করেছিলেন "সাহিত্য" কোনো একটিমাত্র ভাষা-নির্ভর বিষয় হিসেবে পঠিত হলে সাহিত্য পাঠের ধারণাটাই অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে যায় । বাস্তবে সেটাই ঘটেছে বহুকাল ধরে । পঞ্চাশের দশকে তো বটেই, আশির দশকেও ইংরিজি বিভাগগুলি ব্রিটিশ শাসকের মায়াজাল থেকে বেরোতে পারেনি ; আর আঞ্চলিক ভাষার বিভাগগুলিও সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হবার প্রবণতা দেখাচ্ছিল । বুদ্ধদেব বসুর সাধ্য ছিল না শিক্ষা জগতের সাম্রাজ্যবাদীদের ঘাঁটিতে হাত দেন । অথচ সাহিত্যপাঠের এক উদার আদর্শ তাঁর মনে লালিত হচ্ছিল বহুকাল ধরেই । যদি তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো বিপুল জমি-জায়জাতের (??) উত্তরাধিকারী হতেন তা হলে অবশ্যই একটি বিশ্বসাহিত্য পাঠের শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতেন এ বিষয়ে আমার সন্দেহমাত্র নেই, কিন্তু অর্থভাগ্য তাঁকে সন্তর্পণে এড়িয়েই চলেছে আমৃত্যু । তবে ঘুর পথে তাঁর স্বপ্ন আংশিকভাবে সাকার হয়েছিল ।
১৯৫৩ সালে তিনি যখন প্রথমবার আমেরিকায় পড়াতে যান, "কম্পারেটিভ লিটেরেচার" নামক সাহিত্যের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে তাঁর প্রথম সরাসরি পরিচয় হয়, এবং দেখেন আত্মীয়-বিষয়গুলির মধ্যে কিভাবে আন্তর্বিভাগীয় আদান-প্রদান চলে । সেখানেই শেষ নয়, সাহিত্যের সঙ্গে যে সংগীত, শিল্প, সিনেমার অবধারিত যোগ আছে, তাদের মধ্যে যে তুলনা, মিলন ও সহবাস সম্ভব সেই ধারণাও বুদ্ধদেবকে রোমাঞ্চিত করে । তাঁর স্বপ্নের এই বাস্তবায়িত রূপ দেখেও হয়তো তিনি কিছুই করতে পারতেন না এই সংকীর্ণ-চিন্তার দেশে, যদি না ভারতের তত্কালীন শিক্ষামন্ত্রী হতেন হুমায়ুন কবীর, যিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার কাজে বুদ্ধদেব বসুর চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি বলে অন্য কাউকে মনে করেননি, এবং যাদবপুর এঞ্জিনীয়ারিং কলেজের রেক্টর, কলকাতার তত্কালীন মেয়র, ত্রিগুণা সেন স্বতন্ত্র চিন্তায় বিশ্বাসী হতেন । যেন এক দৈবযোগে সমমনস্ক তিনটি তারকা কাছাকাছি এল । অতি নি:শব্দে সংঘটিত হল এক বিপ্লব । দুটি নতুন বিভাগ স্থাপিত হলো, ভারতের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যার কোন অস্তিত্ব ছিল না । দুটিই আন্তর্জাতিক পাঠক্রমের বিভাগ । বুদ্ধদেব বসু প্রতিষ্ঠা করলেন তুলনামূলক সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্যকে কলেজি শিক্ষার পরিসরে এনে ফেললেন একক প্রচেষ্টায় । ইন্টারন্যাশনেল এযাফেয়ার্স হুমায়ুন কবীরের নিজস্ব স্বপ্নের ফসল । ত্রিগুণা সেন ১+৩+২ এই হিসেবে ভাগ করলেব বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের ৬ বছরের পাঠক্রম । শক্ত হাতে হাল ধরলেন সেই নতুন চিন্তাধারায় তৈরি ব্যতিক্রমী ক্যাম্পাস বিশ্ববিদ্যালয়টির । শুরু করে দিলেন সব বিভাগ, নি:শব্দে, একটিও নতুন বাড়ি তৈরি না করে, এঞ্জিনীয়ারিং কলেজের পরিসরেই, ১৯৫৬ সালে । রেজিষ্ট্রার প্রবীর বসু মল্লিকের টেবিলে অকস্মাৎ ফাইলের সংখ্যা বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল অবশ্যই, কিন্তু এই মহাযজ্ঞটি তিন পুরোহিত মাত্রই দেড় বছরের মধ্যে সম্পন্ন করেন । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহারথীদের ডাক পড়লো না, প্রায় গোপনে কলকাতার বুকে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়ে গেল - এমন স্বেচ্ছাচারী ধৃষ্টতায় প্রবল কুপিত হয়েছিলেন তাঁরা । দুর্বাসা মুনির শক্তি তাঁদের মধ্যে থাকলে কি অগ্নিকাণ্ড হতো কে জানে ! আমি যাদবপুর "বিশ্ববিদ্যালয়ে"র মাঠে-ঘাটে ও পলিটেকনিক থেকে এঞ্জিনীয়ারিং কলেজের সব বিল্ডিং-এ ঘুরে-ঘুরে ক্লাশ করা প্রথম বছরের প্রথম ছাত্র, তদুপরি বুদ্ধদেব বসুর কন্যা, এই সব ঘটনারই প্রত্যক্ষদর্শী । সত্যিই আশ্চর্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের এই ইতিহাস ।
বুদ্ধদেব বসুর আন্তর্জাতিক মন অবাধে উড়লো তুলনামূলক সাহিত্যের অলিগলি বেয়ে । তাঁর করা সিলেবাস আমাদের নিয়ে গিয়েছিল এক রোমাঞ্চকর অপরিচিত বিশ্বে, অচেনা সব লেখক, অজানা সব বই, এবং অবিশ্বাস্য পণ্ডিত সব অধ্যাপক । যাদবপুরের প্রাথমিক পর্বে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, গৌরীনাথ শাস্ত্রী, ফাদার আঁতোয়াঁ, ফাদার ফালোঁ, ডেভিড ম্যাকাচ্চেনর মতো শিক্ষকদের কাছে বিশ্বের সাহিত্য পড়ার অভিজ্ঞতা যে আমাদের কত ঋদ্ধ করেছিল কেমন করে বলি ! আমাদের মধ্যে সহসা বিশ্বচেতনার জাগরণ ঘটিয়েছিল ভারতবর্ষের শিক্ষা জগতে বুদ্ধদেব বসুর দু:সাহসী অবদান "তুলনামূলক সাহিত্য" - বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষিতে সাহিত্যপাঠের নতুন দিশা ।
বুদ্ধদেব বসু প্রবর্তিত তুলনামূলক সাহিত্য পরবর্তী সময়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটা বা কি ভাবে অনুসৃত হয়েছে এর কোনো গবেষণা-ভিত্তিক নথি আমি দিতে পারব না, তবে এ কথা আজ সকলেই জানেন যে এখন সারা ভারতবর্ষে সাহিত্য পড়ানোর ধরনে আমূল বদল এসেছে । আশির দশক থেকেই পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চলছিল, কিন্তু গত দুই দশক ধরেই লক্ষ করেছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সাহিত্য শিক্ষার ক্ষেত্রে তুলনামূলক সাহিত্যকে জড়িয়ে নেওয়া হয়েছে । হোক বাংলা বা হিন্দি, ইংরিজি বা গুজরাটি, সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে তুলনামূলক আলোচনার প্রচলন ত্রক্রমবর্ধমান, লক্ষণীয়ভাবে বর্ধিত হয়েছে অন্য দেশ এবং ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক সাহিত্য বিষয়ে কৌতূহল ও চেতনা, অনুবাদের গুরুত্ব আজ সর্বত্র স্বীকৃত, এবং একমাত্রিক সাহিত্য বিভাগগুলিতে এমন অধ্যাপক-গবেষকের অভাব নেই যারা বহুমাত্রিক সাহিত্যচর্চায় উত্সাহী, পারঙ্গম এবং তন্নিষ্ঠ । তুলনামূলক আন্তর্জাগতিক সাহিত্যের ভাবনা এখন প্রতিটি সাহিত্য বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ।
(পরবাস ৪৫, মার্চ, ২০১০)