• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৫ | এপ্রিল ২০১০ | প্রবন্ধ
    Share
  • বাবু, তোরা কী দেখতে আসিস জঙ্গলমহলে ? : দেবব্রত সিংহ

    "আষাঢ় মাসে ডাগর বেলা
    তরাই ত টানালি তলা (ধানের চারা তোলা)
    বেলা সাঁঝ ও প্রহরে
    কামীনরা সব চলিল ডহরে
    সারাদিনটা খাটাই লিলি
    পেঁদা পাইয়ে (মিথ্যে ওজনে) বেরুন (মজুরি) দিলি
    দুধের বাছা ভখের (খিদের) জ্বালায় কাঁদে হে
    আমার দুধের বাছা ভখের জ্বালায় কাঁদে ।"
    এক শীতের সকালে বেলপাহাড়িতে ব্লক কংগ্রেসের অফিসে মনোজ কালিন্দীর সঙ্গে দেখা । বাঁশপাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের জুজারধরা গ্রামের বছর বত্রিশের কুচকুচে কালো পাথরের মতন শক্ত সমর্থ চেহারার আদিবাসী তরুণ । বেলপাহাড়ির কংগ্রেস নেতা সুব্রত ভট্টাচার্য বললেন, জঙ্গল থেকে আমি যে ১২৬ জন ছেলেকে ফিরিয়ে এনেছিলাম তার মধ্যে ও ছিল একজন । `অরণ্যের অধিকার'-এর বসাই টুডুকে মনে আছে আপনার, জঙ্গলে যে রাতে ওকে প্রথম দেখি তখন তাই মনে হয়েছিল আমার । পুলিশ কিন্তু কথা রাখেনি বুঝলেন । বলেছিল ওদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফিরিয়ে আনুন আমরা ওদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবো, আর্থিক প্যাকেজ দেব ইত্যাদি । দেয়নি কিছুই উল্টে কেস ঠুকে দিয়েছে ৩০২ ধারার । তারপর চালান করে দিয়েছে সবাইকে । ওকেও করেছিল । জেল খেটেছে তেরোমাস ।

    শেষ ডিসেম্বরের কনকনে শীতে একটা মাত্র হাফ হাতা সাদা শার্ট গায়ে ষাটোর্ধ্ব তরুণ সুব্রতবাবু একটানা বলে গেলেন কথাগুলো । বললেন, কেস একটা নয়, একটায় ছাড়া পায় আবার একটা ঠুকে দেয় । একজন খেটে খাওয়া মানুষ সে যে রাষ্ট্রদ্রোহী নয় এটা তাকে কতবার প্রমাণ করতে হবে বলতে পারেন ! তবে আমাদের বেলপাহাড়ির এই আদিবাসী মানুষগুলোর বেঁচে থাকার ইতিহাসটা বুঝতে হবে আপনাকে । এখানকার লোকগানের মধ্যে সে ধরা আছে অনেকটাই । মনোজ ভালো গাইতে পারে । আপনি শুনুন ।

    মনোজ কালিন্দী গাইলো `আষাঢ় মাসে ...' । ভারী মিঠে গলা । বলল গানের কথাগুলো সব সত্যি । ওটাই ছিল আমাদের জীবন । বাবুদের ক্ষেতে আষাঢ়ের ডাগর বেলার দিনে ধানের চারা তুলতে গেলে নিয়ম ছিল এরকমই । তুমি যতটা চারা তুলবে ততটা তোমাকে রুইতেও হবে । তোমার কোনো বিরাম নেই বিশ্রাম নেই । খাটুনির বাঁধা কোনো সময় নেই । বেলা ডুবলে সন্ধে হলে হতেই পারে । এরকম হাড়ভাঙা খাটুনির পরে কত মিলতো জানেন, ৩ পাই (৩ কেজির কাছাকাছি) ধান আর ৩টি টাকা । তাও ধানের মাপটা ঠিকঠাক দিত না বাবুরা । আমাদের ধান দেওয়ার আলাদা পাই ছিল একটা । যাতে কম জিনিস ধরে সেভাবে পাইটাতে গোবর টোবর লেপা থাকতো । এসব নিয়ে কারো কিছু বলার জো ছিল না । বাবুদের মুখের ওপরে কে বলবে কে প্রতিবাদ করবে । আমাদের এখানে নিতাই মুড়া প্রথম মানুষ যে এ নিয়ে বলতে গেছিল । বাবুরা ওকে ছাগল চুরির কেস দিয়ে চালান করে দিলে জেলে । তারপর ১৯৭৮ সালে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে ওরা (মাওবাদীরা) । সেই আন্দোলনের পরে এখন আমাদের কাজের সময় বেঁধে দেওয়া হল সকাল আটটা থেকে বিকাল তিনটা, মাঝে একঘন্টা বিশ্রাম আর মজুরি হল চল্লিশ টাকা দেড় পাই মুড়ি । সেই সঙ্গে বাবুই ঘাসের দড়ির কথাটাও শুনুন । এখানে বাবুই দড়ি পাকিয়ে দিন চলে অনেকের, তার দাম আগে ছিল ১ টাকা চার আনা, এখন দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার টাকা ।

    একটি নির্দেশনামা একটি ইতিহাস :

    সালটা ১৮০৫ । `চুয়াড় বিদ্রোহ'-এ ব্রিটিশ রাজ রীতিমতন পর্যুদস্ত । কীভাবে কোন পথে গেলে একেবারে দাবিয়ে রাখা যাবে তথাকথিত `চুয়াড়দের' সেই ভাবনা থেকে মাথায় আসে জঙ্গলমহল গঠনের পরিকল্পনা । জারি হয় নির্দেশনামা । বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের তেইশটি পরগণা নিয়ে গঠিত হয় জঙ্গলমহল । তারপর থেকেই রাতারাতি হাতবদল ঘটে যায় জঙ্গলমহলের অর্থনীতির । জঙ্গলমহলের চাষবাস এমনিতেই একফসলি, বৃষ্টিনির্ভর ; এর ওপর জঙ্গলভিত্তিক অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে এলাকার চেহারা গেল পাল্টে । জল, জমি আর জঙ্গলের চিরায়ত অধিকার থেকে শুরু হল আদিম মানুষজনের বঞ্চনার কাল । ক্ষোভে, দু:খে গান বাঁধলেন প্রান্তবাসীরা ।

    ঝুড়ি ঝাঁটি শালপাতা
    তুলতে আখন যাব কুথা
    বাবু করে মানা গো
    কখন হল বাবুদের বন ইটা নাই ছিল জানা গো ।
    মধ্যযুগে ষোড়শ শতাব্দী অবধি মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গলের মতন মঙ্গলকাব্যগুলিতে বা তারও আগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ও বৈষ্ণবপদাবলীতে এবং পরবর্তীকালের চৈতন্যজীবনী সাহিত্যে লোকসাধারণের চালচিত্র তেমনভাবে উঠে আসেনি । দেবতা-মাহাত্ম্য ও দেবকল্প মানুষজনের জীবনকাহিনির ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে লোকসাধারণের অতি সাধারণ জীবন । মঙ্গলকাব্যে কালকেতু-ফুল্লরার মতন অন্ত্যজ মানুষজনের সুখদু:খ মাখা জীবনের জলছবি ফুটে উঠলেও তা প্রায় সবটাই ধর্মীয় মোড়কের আবরণে আবৃত । ধর্মীয় প্রভাব কাটিয়ে উঠে মানবতার জয়গানে মুখরিত হতে পারেনি মঙ্গলকাব্যের আখ্যান ।

    মধ্যযুগের দৈবী পরিমণ্ডলের কাব্যসাহিত্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হল সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত আরাকান রাজসভার কবি দৌলতকাজীর `সতী ময়নামতী' বা লোরচন্দ্রাণী এবং সৈয়দ আলাওলের `পদ্মাবতী' । মানবতাবাদের মহিমায় উজ্জ্বল এই কাব্য লোকজীবনের ঐশ্বর্যে মণ্ডিত । দেবদেবীর মাহাত্ম্য রচনার মধ্যযুগীয় বৃত্তের বাইরে হিন্দু মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে এক নতুন ভাবচেতনায় নির্মিত হয় এই লোকজীবনের আখ্যান ।

    অষ্টাদশ শতাব্দীতে মঙ্গলকাব্যধারায় সর্বশেষ কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর তাঁর `অন্নদামঙ্গল'-এ দৈবী চরিত্রের লোকায়ত রূপ ফুটিয়ে তোলেন । অন্নদামঙ্গলে লোকসাধারণের প্রতিনিধি ঈশ্বরী পাটনীর কন্ঠে সাধারণ মানুষের চিরায়ত আর্তির কথা নিবেদিত হয়েছে দেবী অন্নদার কাছে, `আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে' ।

    এরপর শুরু হল বাংলা আধুনিক কাব্যসাহিত্যের ধারা । ইউরোপীয় রোমান্টিকতার আবেগ ও নবজাগরণের প্রভাবে নতুন ধারার কাব্যরীতি এবং কাব্যচর্চার অঙ্গন থেকে বহুদূরে সরে গেলেন বাংলার প্রান্তিক মানুষেরা । রবীন্দ্রনাথের অকপট স্বীকৃতি ধ্বনিত হল `ঐকতানে',

    `কৃষাণের জীবনের শরিক যেজন,
    কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
    যে আছে মাটির কাছাকাছি
    সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি'
    বাবু, বেনিয়া আর মহাজনরা সরকারি মদতে যে ছল, চাতুরী আর প্রতারণার ধূর্ত কৌশলে সাঁওতাল পরগণার `দামিন ই কোহর' সাঁওতালদের কুলিতে রূপান্তরিত করেন এখানেও তেমনটাই করা হল । সাঁওতাল, ভূমিজ, মুণ্ডা, লোধা, শবর, কুর্মী, মাহাতোরা একদিন আবিষ্কার করলেন তাঁরা মানুষের বদলে রূপান্তরিত হয়েছেন `কুলিতে' । কাজেই রেললাইন পাততে কুলি চাই, চা বাগানে কুলি চাই, কয়লাখাদানে কুলি চাই, চলে যাও জঙ্গলমহলে । পেট খোরাকি আর গুটিকয়েক কাঁচা টাকার লোভ দেখিয়ে `কুলি' নিয়ে যাওয়ার জন্যে শুরু হয়ে গেল আড়কাঠিদের আনাগোনা । ত্রক্রমশ সস্তা মজুর সরবরাহের কেন্দ্রভূমি হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠল জঙ্গলমহল । স্বাধীনতার পরেও এতটুকু বদলালো না ছবিটা । ডি. ভি. সি. -র সুবাদে গাঞেগয় সমভূমির `নামালভূমিকে' সর্ববৃহৎ শস্যভাণ্ডারে পরিণত করার কর্মযজ্ঞে এমনিভাবেই একদিন ডাক পড়লো জঙ্গলমহলের কুলিদের । বেলপাহাড়ি, ঝা.দগ্রাম, বিনপুর অঞ্চল থেকে দলে দলে, হাজারে হাজারে যেতে লাগলো নামালের কুলি । স্বাধীনতার ষাট বছর পার হতে চললো তবু ছেদ পড়েনি সেই ট্রাডিশনে ।

    ২০০৮ এর নভেম্বরে ছোটপেলিয়া গ্রামে মাওবাদী সন্দেহে লালগড়ের পুলিশ যে লোকটিকে বের করে দিতে বলে সাঁওতাল পাড়ার মেয়েদের, যার জন্য ছিতামনি মুর্মু পুলিশের বন্দুকের বাঁটের আঘাতে খুইয়েছেন দুচোখের দৃষ্টিশক্তি তিনি ছিলেন এরকমই একজন আড়কাঠি । ধানকাটার মরশুমে `কুলি' নিয়ে যেতে এসেছিলেন জঙ্গলমহলে । দরদস্তুর চলছিল সেই নিয়ে । কিন্তু জঙ্গলমহলের মানুষদের পেট খোরাকির তাড়নায় আজো কেন ছুটতে হবে নামালে । প্রশ্নটা কাকে করা যাবে । পার্টিকে না পঞ্চায়েতকে । উত্তর নেই কোনো তরফেই, কোনো উত্তর নেই ।

    উন্নয়নের চালচিত্র : জীবন ও জীবিকা

    গ্রামের (??) চাঁদাবিলা । বেলপাহাড়ি থেকে সিঁদুরিয়া মোড়ের পাকা রাস্তা ছেড়ে ভুলাভেদার জঙ্গল পার হয়ে আমরা যখন পৌঁছলাম সেখানে তখন ভরা দুপুরবেলা । সাঁওতাল গ্রাম । কাঁচা ধুলোর রাস্তার দুপাশে সার দেওয়া মাটির কুঁড়েঘর । আমরা এসে দাঁড়ালাম ক্ষুদিরাম মাণ্ডির বাড়ির সামনে । ওর বউ সুনিয়া মাণ্ডি একগাল হেসে খাটিয়া পেতে বসতে দিলে । বললে, উ (ক্ষুদিরাম) তো নাই চল্যে গেছে নামালে । গোটা গ্রামটিতে ৭০ ঘর পরিবারের বাস, তার মধ্যে অনেকেই নামালে । ফিরবে পৌষ সংক্রান্তির মকর পরবে । দুপুরবেলা দাওয়া উঁচু মাটির বাড়ির সামনে যারা রোদ পোয়াচ্চিল (??) তারা দু চারজন আমাদের দেখে কাছে এলো । ওপাশে খাটিয়াতে বসে খালি গায়ে গামছার মতন খাটো শাড়ি পরে শালপাতা বুনছিল বুধনি মাণ্ডি, বয়স ৮০র কাছাকাছি ।

    বললাম, শালপাতা বুনছেন কেন । বলল, খাব কী । ভাতা পান নি । কে দিবেক । পঞ্চায়েত । না দেয় নাই কিছুই । মোড়ল মাণ্ডি (৪৫) দাঁড়িয়েছিল খালি গায়ে বাচ্চা কোলে । বউ গেছে জঙ্গলে কাঠ আনতে । বলল, বাবুই ঘাসের দড়ি পাকাই, শালপাতা বুনে, জঙ্গলে ঝুড়ি ঝাঁটি বিচে কুনমতনে বাঁচে আছি আমরা ।

    সুনিয়া মাণ্ডি বলল, ঐ যে শালপাতা দেখছেন ওরকম একহাজার পাতা বিচলে পাওয়া যায় ৫০/৬০ টাকা, বিয়াঘরের মরশুমে ১০০ টাকা দর মিলে । জঙ্গলে একহাজার শালপাতা তুলতে লাগে দু দিন । সেলাই করতে একদিন । তারপর হাটে বিচতে আরো একদিন । জঙ্গল কাঠ আনতে গেলেও তাই । একদিন লাগে কাটতে আরেকদিন লাগে হাটে বিচতে ।

    - কোথাকার হাট ?
    - শিলদার ।
    - শিলদা এখান থেকে কত দূরে ?
    - তেইশ কিলোমিটার ।
    - বেলপাহাড়ি ?
    - পনেরো কিলোমিটার ।
    - তাহলে বেলপাহাড়ি যাও না কেন ?
    - বেলপাহাড়িতে এক বোঝা কাঠ বিচলে মিলে পঁচিশ টাকা । আর শিলদাতে পাই পঁয়ত্রিশ টাকা ।

    আমি হতবিস্মিত হয়ে শুধোলাম আরে বলো কী । পঁয়ত্রিশ টাকার এক বোঝা কাঠ বেচতে তোমরা ছেচল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা হাঁটো ! সুনিয়া মাণ্ডি নির্বিকার চিত্তে উত্তর দিল, তা নাহালে কী করব বাবু, পেট ত চালাতে হবেক ।

    শিক্ষা ও স্বাস্থ্য :

    বেলপাহাড়ির জুজারধরা গ্রামের নিত্যানন্দ মাহাতো জঙ্গলের পাহাড়ি পথে ১৮ কিলোমিটার হেঁটে পড়তে যেত বাঁশপাহাড়ি হাই ইস্কুলে । পাথুরে রাস্তা ভেঙে মানারডি, ওড়লি, কাশীজোড়া, মধুপুর, কাশমার, ধরমপুর, বিদরি হয়ে তাকে একা একা পৌঁছতে হত ইস্কুলে । গ্রীষ্মের দিনে যখন `মর্নিং ইস্কুল' বসতো তখন তাকে রাত তিনটের সময় বেরুতে হত বাড়ি থেকে । সময় গড়িয়ে গেছে ঢের । নিত্যানন্দের পড়াশুনার পাট চুকে গেছে বহুদিন । এখন তার মেয়ে সন্ধ্যা মাহাতো যায় পড়তে, বাবার মতন মেয়েকেও পড়তে যেতে হয় ১৮ কিলোমিটার দূরে বাঁশপাহাড়ির হাই ইস্কুলে ।

    যেখানে মানুষগুলোর খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই একটা দুস্তর লড়াই সেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতন উন্নয়নমুখী পরিষেবার কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো । জঙ্গলমহল যেহেতু জঙ্গলমহল তাই সেখানে সব গ্রামে প্রাইমারি ইস্কুল কেন থাকবে ? কোথাও কোথাও এমনও থাকতে পারে যেখানে চার পাঁচটা গ্রাম মিলে একটা প্রাইমারি ইস্কুল । যেমন বেলপাহাড়ির কলাবনি, চিরুগোড়া, শ্যামনগর, চাঁদাবিলা । লালগড় ব্লকের আগয়া, বাঁশবেড়, জগন্নাথপুর, বড় ও ছোট শ্যামনগর । বেলপাহাড়ির চাঁদাবিলা গ্রামের মতো আরো অনেক গ্রাম রয়েছে যেখানে প্রাইমারি ইস্কুলে পড়তে যেতে হলে শিশুদের পার হতে হবে এক দেড় কিলোমিটার জঙ্গলের পথ । চাঁদাবিলায় যেসব বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ভিড় করেছিল আমাদের সামনে তাদের সবারই ক্লাস থ্রি ফোরে পড়ার বয়স । পরনে ছেঁড়া জামা প্যান্ট, মুখে চোখে সারা শরীরে অপুষ্টির ছাপ । জঙ্গল পার হয়ে কলাবনি প্রাইমারি ইস্কুলে পড়তে গেলে আর যাই হোক ডালভাত খেয়ে বাঁচতো । আমি শুধিয়েছিলাম । ওরা বলল বাচ্চারা একা একা জঙ্গল পার হয়ে যাবে কী করে । আমি জানতে চেয়েছিলাম, তাহলে কি ওদের পাঠাবে না ইস্কুলে । বলল, একটু বড় হলে পাঠাব । রবীন টুডু (৩০) বলল, তখন আবার আট দশ বছর বয়সে যাতে চায় নাই ইস্কুলে ।

    আমরা ফেরার পথে দেখলাম সেই ইস্কুলটি । কলাবনি প্রাথমিক বিদ্যালয় । রাস্তার ধারে ইস্কুল । অভুক্ত ছেলেমেয়ের দল ভাতের অপেক্ষায় মিড ডে মিলের রান্নাঘরের সামনে খেলে বেড়াচ্ছে । প্যারা টিচার মেয়েটির বাড়ি গ্রামে, সে বাইরের টুলে বসে রোদ পোয়াচ্ছিল । বলল শিক্ষক আছেন দুজন তারা এখন ট্রেনিংয়ে । ফেরার সময় এলাকার একজন মানুষ বললেন, দেখুন আগে আমাদের এখানে ঠিকা মাস্টার পাওয়া যেত, ধরুন আপনি ইস্কুলে যাবেন না, তখন তিনশো টাকা দিয়ে আপনার বদলে ঠিকা মাস্টার রেখে দিলেন কাউকে । এখন সেই ঠিকা মাস্টার নিয়োগের কাজটা সরকার নিজেই করে দিচ্ছে । পড়াশুনা হবে কী করে বলুন ।

    স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল একেবারে বেহাল । বেলপাহাড়িতে ১৪ বেডের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি এলাকার ভরসা । সেখানে গড়ে ৮৫ থেকে ৯০ জন রুগী ভর্তি হয় । ওদলচুয়া, শিলদা, রঘুনাথপুরে সাবসিডিয়ারি হেলথ সেন্টার আছে । সেখানে রুগী ভর্তির পরিকাঠামো নেই । ভুলাভেদার জঙ্গলে যে সাবসিডিয়ারী হেলথ সেন্টারটি চালু ছিল সেটি উঠে গেছে বহুকাল । কাজেই গ্রামগুলি এখন হাতুড়েদের চিকিত্সায় । চাঁদাবিলার মানুষেরা জানালেন কোনো গুরুতর রুগী থাকলে তাকে খাটিয়ায় শুইয়ে চারকোনায় চারটে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে `ডুলি' কাঁধে ১৫ কিলোমিটার দূরে নিয়ে যেতে হয় বেলপাহাড়ির হাসপাতালে ।

    সরকারি যোজনা সরকারি প্রকল্প :

    ঝাড়গ্রামে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে শুধিয়েছিলেন, আপনি জাদুঘর দেখেছেন । কথাটা শুনে হকচকিয়ে গেছিলাম । বললেন, আমাদের এখানে জাদুঘর আছে । ঝাড়গ্রাম শহরে দেখছেন বড় বড় হোটেল, গেস্ট হাউস, রিসর্ট, ফ্ল্যাটবাড়ি, বাংলোবাড়ি, সরকারি উদ্যান, আরো অনেক কিছু শহর ছেড়ে জঙ্গলমহলে যান দেখে আসুন দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্প, সর্বশিক্ষা প্রকল্প, অন্ত্যোদয় যোজনা, অন্নপূর্ণা যোজনা, ইন্দিরা আবাস যোজনা, স্বর্ণজয়ন্তী রোজগার যোজনা, বার্ধক্যভাতা, বিধবা ভাতার কাগুজে মোড়কে জঙ্গলমহলের জাদুঘর বানিয়ে আদিম মানুষগুলিকে কীভাবে আদিম করে রেখে দেওয়া হয়েছে ।

    তখন অবরোধ চলছিল জনসাধারণের কমিটির । সেসময় লালগড় ব্লকের আগয়া গ্রামের তরুণ সুশান্ত সোরেনের মোটরবাইকে শহর থেকে মাত্র দু আড়াই কিলোমিটার দূরের কয়েকটা গ্রামে ঘুরে এসেছিলাম । সত্যারডি, নতুনডি, রাধানগর, জারালাটা ইত্যাদি । সত্যারডি, নতুনডি একেবারে এপাড়া ওপাড়া দুটি গ্রাম । পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শুকনো খটখটে ক্যানেল । শুখা সময়ে জল থাকে না, বর্ষায় যখন খাল বিল ভরে যায় তখন জল দেওয়া হয় । গোটা গ্রামে সারাবছর জলের কষ্ট । সত্যারডিতে চারটি কুয়োর মধ্যে তিনটি পরিত্যক্ত । একটিতে জল আছে চল্লিশ ফুট নীচে । অসিত মিদ্যা (৫৫) বলল, `আপনি গ্রীষ্মকালে আসলে আপনাকে এক গেলাস জল খাওয়াতে পারব নাই । তখন আমরা যা খাই সে কাদামাখা ঘোলা জল ।' গ্রামের মানুষজনের রোজগারপাতি বলতে ইটভাটা আর নামালে খাটতে যাওয়া । খলনা মিদ্যার বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি, বিধবা মানুষ স্বামী মারা গেছেন বহুদিন, কোনো ভাতা টাতা পাননি । বৃদ্ধ গুণধর মিদ্দ্যা (৮০), নিরঞ্জন মিদ্দ্যা (৮১) চাঁদু মিদ্দ্যা (৭৫) ওঁরা সবাই বললেন আমাদের নামটা লেখে লিয়ে যাও বাবা আমরা কিছু পাই নাই । ১০০ দিনের কাজের কথা শুধোতে অসিত মিদ্দ্যা বলল, কাজ কুথায় ? ঐ দেখুন রাতারাতি রাস্তা হচ্ছে, ট্রাক্টরে করে কনটাকটারের লোক মোরাম ঢাল্যে রাস্তা করছে । কেনে আমাদিকে কি লাগানো যাত নাই কাজে ? মিছা বলব নাই ই পাঁচ ছ বছরে কাজ পেয়েছি ৮/৯ দিন । আসলে কি জানেন বাবু ভোটের সময় বাপ বলে, ভোট ফুরালে চিনতে লারে, তখন খাটে খাও ।

    সত্যারডির অনুকূল মিদ্দ্যা (৪২), প্রদীপ মিদ্দ্যা (২৪) নির্মল মিদ্দ্যা (২৭) ওরা সবাই ঘুরে দেখালে মাটির কুঁড়েঘরগুলির অবস্থা; দেওয়াল ভেঙে পড়েছে অনেকের । বলল আমাদের এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলো দেখছেন এরা পড়বে কোথায় গাঁয়ে কোনো প্রাইমারি ইস্কুল নাই ।

    রাধানগরের লালমোহন টুডু (৪০) সরাসরি বলে দিলে দেখুন স্যার আমরা পার্টিকে তেল দেওয়ার লোক না । এই দেখুন ই বছর মাত্র সাত দিন কাজ দিইছিল । ঝারি মুর্মু বিধবা মানুষ বয়স সত্তর পার, তিনি বললেন উসব ভাতা টাতা কী বলছ আমরা কিছু পাই নাই । রায়মণি টুডুর (৭১) এক চোখ অন্ধ, আরেক চোখে ছানি পড়েছে । বার্ধক্য ভাতা বিধবা ভাতার কথা শুধোতে বললেন, আমরা আতসব কী জানি, না কর্যে দিলে উসব পাবো কি করে ।

    জারালাটা শবরদের গ্রাম । প্রাইমারি ইস্কুলের পেছনে ছোট্ট একটা ক্ষয়াটে দেওয়ালের মাটির কুঁড়েঘরের সামনে সকালের রোদে তিন মাসের রিকেট শিশুকে কোলে নিয়ে হাঁটু অবধি জীর্ণ একখানা শাড়ি পরে দাঁড়িয়েছিল বারি ভক্ত্যা (৩০) । স্বামী কানাই ভক্ত্যা (৩৫) গেছে জঙ্গলে কাঠ আনতে । সেই কাঠ ঝাড়গ্রামের বাজারে বিক্রি করে চাল নিয়ে আসবে, তারপর ফুটবে ভাত । বারি ভক্ত্যারা কুঁড়েঘরে কোনো দরজা বসাতে পারেনি । এবড়ো খেবড়ো দেওয়াল, মাথা নিচু করে সেই ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখলাম কয়েকটা পুরনো এনামেলের থালা বাটি আর ছেঁড়া কাঁথা ছাড়া ভেতরে নেই কিছুই । বারি ভক্ত্যা রেশন কার্ড বের করে দেখালো । লাল রঙের অন্ত্যোদয় কার্ড, ফোলিও নং ১৩/৩৪৬-৩৫১ রেশন দোকানের নম্বর ৬১ দোকানদার চিত্তরঞ্জন মাহাতো । বলল মাসে ১৫ কেজি চাল দেয় । আর এই ঘরটা দেখছেন ইটা ইন্দিরা আবাসের ঘর । বলেছিল, তোরা মাটির দিয়ালটা দিয়ে দে তোদিকে এক হাজার টাকা দিব, এক কুইন্টাল চাল দিব । দেয় নাই কিছুই । কাগজে টিপ ছাপ লিয়ে মাথার উপরকার ঐ টিন টুকুন দিয়ে গেছে ।

    বললাম, কতবছরের কথা এটা ?
    বলল, গেল বছরের । ঐ যে শৈলেন ভক্ত্যা তখন মেম্বর ছিল ।
    বারি ভক্ত্যার ইন্দিরা আবাসের ঘর দেখে শবর পাড়ার ভেতরে ঢোকার আর ইচ্ছে হচ্ছিল না । ওদিকে কালীপদ ভক্ত্যার (৭০) ঘর । সে আর তার জোয়ান ছেলে শুয়েছিল উঠানের রোদে । ১০০ দিনের কাজের কথা শুধোতে বলল, কাজ পায়েছিলম দুদিন । কী করব ঝোড়া কোদাল লিয়ে গেলম কাজ করতে বললেক জায়গা নাই শেষ, তখন কী করি চল্যে আলম । কাজে না লাগালে ত লিজে থাকে আমরা লাগতে পারছি নাই । কথা বলতে বলতে মাথায় এক বোঝা কাঠ নিয়ে জঙ্গলের ওদিক থেকে ঘরে ঢুকল কুনি ভক্ত্যা (৭০) । বৃদ্ধার পরনে গামছার মতন জীর্ণ একখানা কাপড় ।

    ঝাড়গ্রাম শহর থেকে দু আড়াই কিলোমিটারের গ্রামগুলোর যখন এই অবস্থা তখন বহুদূরে জঙ্গল পাহাড়ে ঘেরা বেলপাহাড়ির অবস্থা যে আরো খারাপ হবে সে আশংকা ছিলই; তবে তার ছবিটা যে এরকম হতে পারে ভাবতে পারিনি । চাঁদাবিলা গ্রামের ক্ষুদিরাম মাণ্ডির বউ সুনিয়া মাণ্ডি বি. পি. এল (ফোলিও নং ১৩৭৭) কিন্তু তার বউ সুনিয়া মাণ্ডি এ. পি. এল (ফোলিও নং ২০২৫) । কার্ড দুটো উল্টে পাল্টে দেখলাম কার্ডে তারিখ ছাড়া আর কিছু লেখা নেই । ডিলারের নাম, বরুণকুমার মাহাতো । দোকান নং ৭৪ । কেন্দিশোল ।

    আমি শুধোলাম, কেন্দিশোল জায়গাটা কতদূরে ।
    বলল, ইখান থাকে ১৫ কিলোমিটার । সকালে যাই রেশন আনতে সন্ধ্যায় ফিরি । তাও কি জানেন রেশনে ২ কেজির দাম কাটে লেয় আলাদা করে । বলে ভাড়া খরচা, রেশন তোলার ভাড়া ।

    গ্রামে নতুন জব কার্ড হয়নি কারো । নতুন জব কার্ডের জন্য অ্যাকাউন্ট খোলার নিয়ম হয়েছে পোস্ট অফিসে । বলল, নতুন জব কার্ড করতে গেলে, আড়াইশো তিনশো করে টাকা লাগবেক বলেছে । পুরনো জব কার্ড কোথায় বলতেই মুখী সরেন বের করে দিলে কার্ড (নং ০৮০৪২২১৫০), দেখলাম তাতে ২০০৮ সালের কাজের বিবরণের জায়গাতে কালির আঁচড় পড়েনি । আমাদের কথাবার্তার ফাঁকে একজন লাঠি হাতে ঠুকঠুক করে এসে দাঁড়ালো সামনে । নাম মদন মাণ্ডি । বয়স ৭৭ । নামালে খাটতে গিয়ে বাস থেকে পড়ে চোট পেয়ে একটি পায়ে তেমন জোর নেই, লাঠিটি সম্বল । শীতের দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছিল । সেই গড়ানো দুপুরের বুনো হাওয়ায় তার গায়ে নেই কিছুই, পরনে যেটি আছে সেটি একটি টেনা (কাপড়ের টুকরো) । আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন মানুষটি । বললাম, বার্ধক্যভাতা পেয়েছেন ? কিছু বুঝতে পারলেন না ।

    লোকেরা বলল, কানে কম শোনে আরো জোরে বলুন । তাই বললাম । এবার উত্তর দিলেন না পাই নাই । কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । আমি আবার শুধোলাম, পঞ্চায়েত কিছু দেয় নি ?

    এবার ক্ষোভের স্বরে বৃদ্ধ মদন মাণ্ডি চেঁচিয়ে বলে উঠল, দিবেক । মর্যে গেলে দিবেক ।

    কথাটা শুনে এত মনখারাপ হল সে ভাবা যায় না । ফেরার সময় জঙ্গলের লাল ধুলোর পথে সারা পথ জুড়ে কানে বাজতে লাগলো মদন মাণ্ডির কথাগুলো । বেলপাহাড়ি পৌঁছে সোজা ব্লক অফিস । বিডিও ছুটিতে । জয়েন্ট বিডিও সভাপতি দুজনে উন্নয়ন নিয়ে মিটিং করতে গেছেন জেলায় । পাওয়া গেল না কাউকেই । কর্মাধ্যক্ষ দীপালি বাসকে বসেছিলেন । তিনি বললেন, `কোন গাঁয়ের কথা বলছেন চাঁদাবিলা । উয়ারা বলক আফিসে না আল্যে উসব পাবেক কী করে' ।

    বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতি । ভারী অদ্ভুত তাঁদের কাজকর্মের খতিয়ান । ২০০৬-০৭ আর্থিক বছরে তাঁরা কেন্দ্র রাজ্য মিলিয়ে মোট ৪২টি প্রকল্পে মোট বরাদ্দ অর্থ থেকে খরচ করে উঠতে পারেন নি ৩ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা । ঐ একই আর্থিক বছরে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের বরাদ্দকৃত ৩৫ লক্ষ টাকা খরচ করার জায়গা তাঁরা খুঁজে পান নি । সেইকারণে চলতি আর্থিক বছরে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ কোনো অর্থ বরাদ্দ করেনি বেলপাহাড়িকে । একদিকে মানুষের অপরিসীম দারিদ্র্য আরেক দিকে দারিদ্র্য দূরীকরণে সরকারি অর্থ খরচ করতে না পারার অক্ষমতা । কী বলা যাবে একে উন্নয়ন না অনুন্নয়ন ।

    বেলপাহাড়ি ব্লক অফিস । বিশাল জমিদারি বাড়ির মতন পুরনো বিল্ডিং । সেসব পেছনে ফেলে চলে আসছিলাম । গাড়িতে উঠতে যাবো । হঠাৎ গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন মাঝবয়সী মানুষ হাতছানি দিয়ে ডাকলো আমাকে । তার চোখের চাউনি যেন কেমন । ড্রাইভার শান্তনু বলল, যাবেন না স্যার । লোকটা মদ খেয়েছে দেখছেন না চোখ দুটো লাল । তবু গেলাম তার কাছে । তখন সে আমার দিকে একবার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, বাবু, তোরা কী দেখতে আসিস জঙ্গলমহলে ?

    (পরবাস ৪৫, এপ্রিল, ২০১০)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)